সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]

#পর্বঃ৫৫

মেঘলা আকাশ, বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে প্রবল বেগে,মাথার উপরের পাইনগাছ গুলো অন্ধকারের মাঝে উথাল-পাথাল হয়ে উড়ছে, যেন কোনো বিদঘুটে জন্তুজানোয়ার।ঘুনাক্ষরেও ভুলবশত সেদিকে একবার চোখ চলে গেলে মনে হয়, এখনই ছুটে এসে বিশাল হা তুলে থাবা বসাবে ঘাড়ে, শুষে নেবে শরীরের শেষ র'ক্তবিন্দু।

দেখলেই কেমন ভয়ে শীড় দাঁড়া বেয়ে নেমে আসে হীমধরা শীতল স্রোত। এমন একটা গা ছমছমে পরিবেশেও নিদারুণ ভঙ্গিমায় ব্যালকনিতে বসে আছে নীলিমা। ওর কোন হেলদোল নেই এই দমকা বাতাসে, যেন এক নির্জীব আত্না, খুলে রাখা রেসমের মতো চুলগুলোও সেভাবেই উড়ছে এলোমেলো হয়ে।

নীলিমাকে উদাসীন দেখাচ্ছে, সেই সন্ধ্যা থেকেই কি যেন অযাচিত ভাবনায় বুদ হয়ে আছে মেয়েটা,মনের মাঝে চলছে হাজারো জটিল সমীকরণ, যা ওর একান্ত নিজের। সমীকরণের সমাধান যে নীলিমার অজানা, তেমনটা নয়। ও তো স্রেফ নিজের যোগ্যতা আর অপরিনামদর্শীতা নিয়ে দ্বিধাদন্দের মধ্যে আটকে আছে, তবুও আজ মন বলছে এবার একটা সমাধান প্রয়োজন,সত্যিই প্রয়োজন।

সায়রের মতো এমন একটা সজীব হৃদয়ের পুরুষের সাথে ঘর বাঁধতে হলে আরও আগে প্রয়োজন।

সায়রের নাম নিতে না নিতেই রুমে এসে হাজির হলো সায়র, কাঁধে তার ছোট্ট ব্যাগপ্যাক, মনে হয় শুট ছিল আজ। সায়রের উপস্থিতি টের পেয়ে নীলিমা পেছনে ঘাড় ঘোরালে সায়র একটা ক্লান্ত মাখা হাসি নিক্ষেপ করলো নীলিমার পানে, নীলিমা সেভাবেই নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু , সায়র ব্যালকনির দিকে দু'কদম এগিয়ে এসে নীলিমাকে বললো,

--- রান্না করেছো কিছু? নাকি আমি করবো?

ওয়েল, সায়রের এই কথাটা নীলিমার কাছে নতুন কিছু নয়, কারন গত দু'মাসে নীলিমা হাতে গোনা কয়েকদিন রান্না করলেও, বেশির ভাগ সময়ই রান্নাবান্নাটা সায়র নিজেই করে , যখন সময়ের অভাবে করতে পারেনা, তখন বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে দেয়। তবুও রান্নাবান্নার জন্য নীলিমাকে হুকুম করেনা কখনো।

সায়রের কথার পাছে নীলিমা জানালো,

---- করেছি, ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার বাড়ছি।

পরিবেশটা কিঞ্চিৎ অসহনীয় আর দমবন্ধকর, কেমন যেন গুমোট ভাব প্রকাশ পাচ্ছে নীলিমার আচার আচরণে, এ যেন তীব্র ঝড়ের পূর্বাভাস, অবশ্য বাইরেও ঝড়ো হাওয়া বইছে খুব। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে জলদি ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সায়র।

আর যখন বেরিয়ে আসে তখন দেখতে পায় ডাইনিং এ খাবার বেড়ে অপেক্ষা করছে নীলিমা।

মখমলের মতো নরম বাথ টাওয়ালটা গলায় ঝুলিয়ে সায়র এগিয়ে গিয়ে খেতে বসলো চুপচাপ, সবকিছু এখনো আগের ন্যায় থমথমে, নীলিমা কেমন যেন আজকে একটু বেশিই চুপচাপ। চুলফুল খুলে অমন বারান্দায় বসেছিল, পাইন গাছের পেত্নী ভর করলো কিনা সেটাও ভাবনার বিষয়, সায়র ভাবলো কিছুক্ষণ, অতঃপর নিরবতা ভেঙে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো ,

---- বলছি যে নীলিমা, কোম্পানি থেকে আমাকে বড় একটা এপার্টমেন্টে ওঠার জন্য বলা হচ্ছে, আমার ম্যানেজার ও সেখানে সর্বক্ষন কর্মরত থাকবে, তুমি যদি বলো তো এই এ্যাপার্টমেন্টটা আমরা শীঘ্রই ছেড়ে দেবো।

নীলিমা খেতে খেতে গভীর কন্ঠে বললো,

--- কেন, এই বাসাটায় কি সমস্যা? এখানেও তো আপনার ম্যানেজার আসে প্রয়োজন হলেই।

সায়র একটু ভেবেচিন্তে শান্তস্বরে জবাব দিলো,

--- আই নো, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে , এবার আমাদের এই বাসাটা থেকে অন্য কোথাও মুভ করা দরকার, একটা প্রোপার গোছানো সংসার প্রয়োজন আমাদের, ইউ নো হোয়াট আই মিন। নয়তো..

থেমে গেলো সায়র, নীলিমা বেশ শান্ত স্বরে শুধালো,

--- নয়তো কি?

--- নয়তো আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে না কিছুতেই,আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছে, যেটা ঘুচিয়ে ফেলা খুব প্রয়োজন নীলিমা, আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই আর পাঁচটা কাপলের মতো গুছিয়ে সংসার করতে চাই, বাচ্চাকাচ্চা জন্ম....

আবারও মাঝপথে কথা আটকে গেলো সায়রের। নীলিমা কিছুই বলছে না,মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে শুধু । নীলিমার নীরবতা সায়রকে পীড়া দেয়, অজানা অধিকারবোধে ফুঁসে ওঠে হৃদয়টা, তবুও নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে গভীর কন্ঠে সায়র বলে,

--- হতে পারে আমার এই পুরাতন এপার্টমেন্টটাই সেই দূরত্বের একমাত্র কারন,নয়তো এখনো সংসার সংসার ফিলটা পাচ্ছি না কেন? কেনইবা কাছে থেকেও তুমি এতো দূরে?

এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে, সায়রের কথায় কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই টেবিল ছেড়ে উঠে যায় নীলিমা, ওর থমথমে চেহারা সুরতে রাগ স্পষ্ট। নীলিমাকে চলে যেতে দেখে সায়র ওকে আবারও পিছু ডেকে বলে,

--- সত্যি করে বলো তো, তুমি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো তাইনা? জোর করে বিয়ে করেছি বলে?

---- না নেই,

--- কি নেই?

--- আমি আপনার উপর রাগ করে নেই।

নীলিমার সোজাসাপটা উত্তর, নীলিমার উত্তর শুনে সায়র একটু স্বস্তিতে চোখ বুজলো, পরক্ষণেই চট করে চোখ খুলে নীলিমাকে ডেকে বলে উঠলো,

--- নীলিমা!লাস্ট কোশ্চেন?

এবার দাড়িয়ে পরলো নীলিমা, আস্তে করে পেছনে তাকিয়ে শুধালো,

---কি?

--- কাল রাতে আমি কি কিছু...? না মানে তোমার সাথে কোনো অভদ্রতা?

সঙ্গে সঙ্গে কঠিন জবাব ভেসে এলো নীলিমার দিক থেকে,

--- হ্যা করেছেনই তো, চরম অভদ্রতা করেছেন।যা নয়, তাই বলে গালি দিয়েছেন আমাকে ,ডা'ইনী বুড়ি, কু'টনী বুড়ি, পিশাচিনী, আরও কত কিই।

নীলিমার কথা শুনে সায়র আহাম্মক হয়ে গেলো, শেষমেশ কিনা মাল খেয়ে নিজের বউকে এভাবে গা'লিগালাজ করেছে ও, ছিহ! সব দোষ এই হা'রামি বন্ধুগুলোর।শালা বুদ্ধি দেওয়ার নাম করে একেবারে ফাঁ'সির আ'সামি বানিয়ে ছেড়ে দিলো?

সায়র অসহায়ের মতো করে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে দেখে,নীলিমা এবার হনহনিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। নীলিমা রেগেমেগে চলে যাচ্ছে,ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে ডাকলো সায়র,

--- নীলিমা, নীলিমা শোনো একটু, আমি আসলে ওভাবে মিন করতে চাইনি, বিশ্বাস করো কাল রাতে যা করেছি, যা বলেছি, সে সব কিছুই আমি মনের ভুলে করেছি, আই সয়ার একটা কথাও আমার মনের কথা ছিলনা।

সায়রের কথায় পেছনে ঘুরে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নীলিমা, বললো,

--- তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কাল আপনি আমাকে ভুল করে চুমু খেয়েছেন? আর যে ওই যে আদুরে কথাগুলো, সেগুলোও সব মিথ্যে ছিল?

এবার যেন আকাশ ভেঙে পরলো সায়র, ওর মাথার মধ্যের ঘিলু সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তার মানে কি ও কাল নীলিমাকে চুমু খেতে পেরেছিল? নাকি নীলিমা ওকে নিয়ে ঠাট্টা করছে? মনের মাঝের হাজারো কনফিউশান দূর করার উদ্দেশ্যে ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে সায়র অস্ফুটে বললো,

--- ইয়ে মানে সত্যিই কি চুমু খেয়েছিলাম?

বুকের উপর দু'হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে, নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয় নীলিমা,

---হ্যা, খেয়েছিলেন।

নীলিমার কথায় বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেলো সায়রের, এতোক্ষণে ভেতরটা কেমন শান্তি শান্তি লাগছে, মনে থাকুক বা না-ই থাকুক, চুমু যে খেয়েছিল এটাই বড় কথা, সেই ভেবে উৎফুল্লতায় কুলকুলিয়ে হেঁসে উঠে সায়র বললো,

---- বিশ্বাস করো নীলিমা কাল যা করেছি, যা বলেছি, সব মন থেকে করেছি, সব।

সায়রের কথায় আচমকা চোখ মুখ কুঁচকে গেলো নীলিমার,যেন বিয়ে বাড়ির পঞ্চ ব্যাঞ্জনের মাঝে হুট করেই কাঁচা করল্লা মুখে পুরে দেওয়া হয়েছে ওর। মুখটাকে সেভাবেই রেখে খেঁকিয়ে উঠে নীলিমা বললো,

--- কি বললেন, আপনি যা বলেছেন সব মন থেকে বলেছেন?

সায়র মুচকি হেসে উপুর নিচ মাথা ঝাকালে, নীলিমা দ্বিগুণ রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ ,

---- তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমি আসলেই একটা ডাইনী বুড়ি?

হকচকিয়ে উঠলো সায়র, জলদি হাসি থামিয়ে বললো,

--- এমা সেটা কখন বললাম?

নীলিমা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

--- এই যে এখন বললেন। আপনি কাল রাতে যা বলেছেন সব আপনার মনের কথা।

এরপর আর সায়রের প্রত্যুত্তরের জন্য এক মূহুর্ত ও অপেক্ষা করলো না নীলিমা, ঠাস করে ওর মুখের উপরেই লাগিয়ে দিলো দরজাটা।

এদিকে নিজের কথায় নিজেই বোকা বনে গেলো সায়র, মনেমনে চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিজের গালে নিজেই থাপ্পড় বসালো সজোরে, তারপর চোখ খুলে অসহায় সুরে নীলিমাকে ডেকে বললো,

--- বউ আমার, বিশ্বাস করো কাল রাতে একটুও নিজের মাঝে ছিলাম না আমি, আর নাতো হুঁশে থেকে কোনোকিছু করেছি।কাল যা যা বলেছি , যা যা করেছি, এমনকি যদি চুমুও খেয়ে থাকি তাহলে সেটার জন্যও আমি খুবই দুঃখীত, তোমাকে হার্ট করা আমার উদ্দেশ্য নয় রাগিনী, আমিতো তোমাকে ভালোবাসার জন্য নিয়ে এসেছি, দুঃখ দিতে যাবো কেন বলো? সবাই তো বিয়ের আগে প্রেমে পরে, আমরা না-হয় বিয়ের পরেই প্রেম করবো, তুমি সময় নাও, আমি অপেক্ষারত। আমাদের গল্পটা হবে লাভ আফটার ম্যারেজ।ইজন'ট ইট বিউটিফুল?

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তখনও উদগ্রীব হয়ে নিজেকে নির্দোষ আর শুদ্ধ পুরুষ প্রমান করায় ব্যস্ত সায়র। আজ যে করেই হোক নীলিমাকে বোঝাতেই হবে, যে তার একমাত্র স্বামী হলো সরলতার প্রতীমা, আগাগোড়া একজন শুদ্ধ পুরুষ। সে মাল খেয়ে এসে অনুমতি ব্যাতীত বউকে চুমু খেয়ে ফেলেছে, এটা মোটেও শুদ্ধ পুরুষের কাজ নয়, তাই ভুলটুকু স্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করাটা জরুরি।

তবে নীলিমার বোধ হয় এতো বেশি শুদ্ধতায় কিঞ্চিৎ আপত্তি রয়েছে, তাই তো নিজের শুদ্ধ স্বামীকে খানিকটা অশুদ্ধ বানানোর পায়তারা করে একটা খোলামেলা নাইট ড্রেস পরে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে খানিকটা আবেদনময়ী রূপে দাঁড়িয়ে পাতলা অধর জুগলে গাঢ় লিপস্টিক লাগাতে লাগাতেই নীলিমা বলে,

---- এই নাইটড্রেসটা জামা কাপড়ের প্যাকেটে পেয়েছি, সাইজটা আমারই, কে কিনলো বলুন তো?

নীলিমার কথার কোনোরূপ জবাব দিলো না সায়র, বরং গভীর চোখে ওর ধনুকের মতো বাঁকানো নারী শরীরটা একঝলক পরখ করে শুষ্ক ঢোক গিললো শুধু ।

--- কি দেখেছেন অমন করে?

সায়রের চোখদুটো চিকচিক করছে, ও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মনের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বেসর্বা প্রশ্রয় দিয়ে ফট করেই বলে উঠলো,

---- আজকে একটু অশুদ্ধ হতে চাই নীলিমা,উহুম একটু নয় অনেকটা অশুদ্ধ।

*************************************************

বাইরে বাতাসের তান্ডব, শেষ রাতে বোধ হয় ঝড় উঠবে। সায়রদের এপার্টমেন্টের চাইতেও ক্রীতিকের এই নির্জন শহরতলীর বাড়িতে বাতাসের বেগ দিগুণ । তবে থাই লাগানো বিশাল জানালা ভেদ করে সেই প্রকান্ড ঝড়ো হাওয়া প্রবেশ করতে পারেনা অরু ক্রীতিকের মাস্টার বেডরুম অবধি। ভেতরে যা প্রবেশ করে তা হলো প্রতিধ্বনিত বাতাসের শাঁই শাঁই আওয়াজ।আওয়াজটা ভ'য়ানক, কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে,হুট করে যে কেউ শুনলে নির্ঘাত আঁতকে উঠবে।

কিন্তু হঠাৎ বইতে থাকা তীব্র ঝড়ো বাতাসের শাঁই শাঁই আওয়াজে আঁতকে উঠল না অরু, এমনকি চমকালোও না খুব একটা। কারণ এর থেকে বড় চমক তো ওর সামনেই বসে আছে, যার নাম জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। মানুষটা আস্ত একটা চমক,প্রতি সেকেন্ড অন্তর অন্তরই সে চমকে দেয় অরুকে, এই যেমন মাত্রই নিজের খোলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসে, একেবারে বাধ্য স্বামীর মতো বউয়ের কাছে নিজের অসহায়ত্ব স্বীকার করে নিলো,কোনোকিছু না ভেবেই হদিস দিয়ে দিলো নিজ হৃদয়ের অসহনীয় পীড়ার, এ পীড়া যে নতুন নয়,তবে মুখ ফুটে প্রকাশ করাটা ছিল পুরোপুরি নতুন এক অধ্যায়, এই যে জায়ান ক্রীতিক নিজের অসহায়ত্ব অরুর সামনে তুলে ধরলো, নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে দিলো, এটা কি চারটে খানি কথা? বোধ হয় না।

কিন্তু অরুও তো ক্রীতিকেরই বাঁকা পাঁজরের হাড়, এমন ঘাড় ত্যাড়া পুরুষের পাঁজর থেকে সৃষ্টি হওয়া নারী ও তো কম যায়না,তাইতো ক্রীতিকের এমন আবেগাপ্লুত কথাকেও একেবারে সোজাসাপ্টা অগ্রাহ্য করলো অরু, নিজের চূড়ায় উঠে থাকা রাগটাকে এক বিন্দুও না দমিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে সোজা হাঁটা দিলো পাশের বেডরুমের উদ্দেশ্যে, যেখানে আগে, ও আর অনু ঘুমাতো।

অরুর কোমল চেহারায় কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট, আজ বেজায় চটেছে সে, তারউপর রুম থেকে অবধি চলে যাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্রীতিক নিজেও এগিয়ে গেলো অরুর পিছু পিছু, ওকে আটকানোর চেষ্টা করে বললো,

--- বেইবি, কোথায় যাচ্ছিস? ব্যথা করছে তো।

অরু পিছু ফিরলো না, হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো করিডোর ধরে, অরু থামছে না দেখে ক্রীতিক এবার দ্রুত কদমে এগিয়ে অরুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, অতঃপর গেস্ট রুমের দরজাটা সশব্দে লক করে দিয়ে বললো,

--- কোথায় যাচ্ছিস?

অরু গাল ফুলিয়ে জবাব দিলো,

--- ঘুমাতে।

ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চাপলো,মাথাটা সামান্য নুয়িয়ে অরুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

--- সাহস তো কমনা, আমার সাথে ঘুমাবি না, সেটা আবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করছিস? তোকে অনুমতি দিয়েছি আমি অন্য রুমে ঘুমানোর?

ক্রীতিকের ডমিনেটিং কথায় অরুর মেজাজটা আরও বেশি বিগড়ে যায়, ও তৎক্ষনাৎ দু'হাতে ক্রীতিকের চওড়া বুকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সামনে থেকে, তারপর গটগটিয়ে হেটে চলে গেলো ছাঁদ বারান্দার দিকে।

বাইরে ঝড়ো হাওয়ার তোড় বেড়েছে বৈকি কমেনি, তবে এই মূহুর্তে অরুর চড়াও মেজাজের কাছে এসব ঝড়ো হাওয়া টাওয়া কিছুই পাত্তা পেলোনা। অরু চলে যাচ্ছে দেখে ক্রীতিক আবারও এগিয়ে এসে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে, পেছন থেকেই এক নাগাড়ে অরুর মাথায়, খোলা চুলে, পিঠে সবখানে শব্দ করে চুমু খেতে খেতে অরুকে মানানোর চেষ্টা করে বললো,

--- বেইবি, বেইবি আই ডিডন'ট মিন ইট, ইউ নো না, হাউ মাচ আই লাভ ইউ। তাহলে কেন বুঝতে চাইছিস না? কেন এভাবে অবহেলা করে হার্ট করছিস আমাকে? তুই শুধু একবার বল, তুই যা বলবি আমি তাই করবো, তাও প্লিজ আমার সাথে একটু কথা বল। প্লিজ হার্টবিট, আই কান্ট টলারেট দিস পেইন এনি মোর।

ক্রীতিকের চোখে মুখে ভীষন অসহায়ত্ব,হাতে এখনো ক্যানোলা লাগানো , তাই খুব শক্ত করে ধরতে পারেনি অরুকে,যার দরুন অরু একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ক্রীতিকের বাঁধন থেকে। নিজেকে ছাড়িয়ে ক্রীতিকের থেকে দূরত্ব বাড়াতে চুপচাপ এগিয়ে গেলো পুলের দিকে।

তবুও ক্রীতিক কিছু বললো না,বরং নতুন উদ্যমে এগিয়ে গিয়ে পুনরায় জড়িয়ে ধরলো অরুকে, এবার একটু কৌশল খাটিয়েই অরুকে জব্দ করেছে সে, একহাত রেখেছে অরুর কোমড়ে, অন্যহাত গলা আর বুকের মাঝখানে, এবার আর নড়াচড়া করতে পারছে না অরু, যার ফলরূপ ক্রীতিকের হাতের মধ্যে থেকেই একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে ও, বলিষ্ঠ দেহের ক্রীতিকের হাতের মধ্যে থেকে চিংড়ি মাছের মতোই লাফাচ্ছে অরু, ওদের ধস্তাধস্তিতে ক্রীতিকের ক্যানোলা লাগানো হাত থেকে ফিনকি দিয়ে র'ক্ত বেড়িয়ে আসে একপর্যায়ে , তবুও ক্রীতিক এইটুকুনি ছাড়ছে না অরুকে, বারবার শান্ত স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করছে শুধু ,

--- বেইবি প্লিজ, বলেছি তো আর হবেনা, দেখ আমি সরি বলছি।আ'ম এক্সট্রেমলি সরি,তাও তুই কথা বল প্লিজ,আমার থেকে নিজেকে এভাবে বারবার আলাদা করিস না, এতে আমি রেগে যাই, তোর দূরত্ব সহ্য হয়না আমার। বোঝার চেষ্টা কর একটু।

ক্রীতিকের কথা শেষ হতে না হতেই ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পা ফসকে আচানক পানিতে পরে গেলো ওরা দুজন। পানিতে হাবুডুবু খেয়ে অরু তাড়াহুড়ো পুল থেকে উঠতে গেলে স্কার্ট সমেত একটা পা টেনে ধরে আবারও অরুকে পুলের মাঝে ছু'ড়ে মা'রে ক্রীতিক, আকস্মিক কাহিনিতে আপনা আপনি কয়েক ঢোক পানি খেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা তুললো ক্রদনরত অরু।

ঠান্ডা পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গমরঙা ত্বকে লালচে বর্ণ ধারন করেছে ওর, কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় রাঙা কপোল বেয়ে অবাধে গড়িয়ে পরছে তপ্ত নোনাজল, যা চোখ এড়ালো না স্বয়ং ক্রীতিকেরও,নিজের কর্মকান্ডে ব্যতিগ্রস্থ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুকে একটানে কাছে নিয়ে এসে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ক্রীতিক শুধালো,

--- ব্যথা লেগেছে?

পরমূহুর্তেই কান্নার বাঁধ ভেঙে গেলো অরুর,কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই অনেকটা শব্দ করে কেঁদে উঠলো ও, কাঁদতে কাঁদতে ক্রীতিকের বুকে ইচ্ছে মতো কি'ল ঘু'ষি ছেড়ে অভিমানি কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো,

--- তুই একটা পঁ'চা স্বামী, তোর সাথে কোনো কথা নেই আমার,থাকতে পারেও না, তুই সবসময় আমাকে বকিস, কথায় কথায় গায়ে হাত তুলিস, তোর দেওয়া হাজারটা ভালোবাসার ক্ষত আমার শরীরে, তাও আমি সবকিছু সহ্য করি, চুপচাপ মেনে নিই, কারন আমি জানি যে আমি তোর দূর্বলতা, তুই আমাকে না পেলে উন্মাদ হয়ে যাবি,থাকতে পারবি না আমায় ছাড়া, তাই বলে তুই আমার ভালোবাসায় এভাবে আঙুল তুলবি, এভাবে?

তোর মতো একরোখা, অবাধ্য, বদ মেজাজী মানুষকে ভালোবেসে কিই না সহ্য করেছি আমি? কথার আ'ঘাত, শারীরিক য'ন্ত্রনা, মানসিক যন্ত্র'না,আরও কত কিই তার ইয়াত্তা নেই।তাহলে তুই কিভাবে আমার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললি, কিভাবে বল?

শেষ কথাতে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে ক্রীতিকের বাহুতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো অরু। ও এতো জোরেই কামড়ে ধরেছে যে ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক,তবুও অরুকে সরায়নি নিজের থেকে, আর না তো অরুর এতো এতো অভিযোগের পাছে একটা টু শব্দ করেছে।

নিজ দাঁতের শক্তি পরে এলে, ক্রীতিকের ভেজা টিশার্টটা টেনে ধরে অরু আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলে,

---- সত্যি করে বলুন তো, ভালোবাসা আর অবসেশন এক না তাই না? তার মানে কি আপনিও আমাকে ব্যবহার করছেন? যখন আমার বাহ্যিক সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে তখন....

---জাস্ট শাট ইউর ফাকিং মাউথ অরু!

অরুর কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠলো ক্রীতিক,ওর কথায় নিজের অজান্তেই কপালের রগ ফুলে উঠে কখন যে শান্ত মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগের পারদ ছড়িয়ে পরেছে তা টের পায়নি ক্রীতিক নিজেও।

এদিকে ক্রীতিকের ধমকে কম্পিত হয়ে উঠেছে অরুর শরীর, ক্রীতিক এতোটা ভ'য়ানক টোনেই ধমক দিয়ে উঠেছে, যে অরু এবার কান্নাকাটি ভুলে গিয়ে মূহুর্তেই ক্রীতিকের অগ্নিদৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে, পুলের মধ্যেই পিছু হাটতে শুরু করলো। অরু খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, যে অযথাই একটা ঘুমন্ত সিংহকে জাগ্রত করেছে ও। এবার অরুর কপালে দুঃখ আছে, বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা দরকার, অরু তা ছাড়িয়ে গিয়েছে, ক্রীতিকের হাত থেকে সেই কখন থেকে র'ক্ত ঝড়ছে তাতে অবধি নজর নেই ওর, চোখ মুখ খিঁচে যা মন চায় তাই বলে গিয়েছে ক্রীতিককে। বলতে বলতে শেষ পর্যায়ে এসে মুখ ফসকে যেটা বললো, সেটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাগের চোটে গুমোট হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের চোখ মুখের ভঙ্গিমা।

--- কি বললি তুই? আবার বল?

ক্রীতিকের গুরুগম্ভীর পুরুষালী প্রতিটি কথার ভাঁজে ভাঁজে উপচে পরছে কতৃত্ব আর কঠিন শাসন।

অরু তাতে ভড়কালো,জিভ দিয়ে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে ক্রীতিকের ইস্পাতের ন্যায় কঠিন মুখমন্ডলের দিকে আড় চোখে চেয়ে রইলো শুধু।

অরুকে অনুসরণ করে ক্রীতিক সামনে এগোতে এগোতে চোখ মুখের আদলে আরও খানিকটা কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তীর্যক কন্ঠে বললো,

---- কতটা ভালোবাসিস তুই আমাকে? কতদিন ধরেই বা ভালোবাসিস? তোর প্রতি আমার আসক্তি সম্পর্কে কতটুকুই বা ধারণা রাখিস তুই? তুই কি আদৌও জানিস তোর জন্যই যে আমি এমন?

অরু কিছুই বলছে না, শুধু চুপচাপ ভয়ে ভয়ে পেছনে পা ফেলছে, আর ক্রীতিক ওকে অনুসরন করে সামনে এগোচ্ছে।যার দরুন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বারবার সুইমিং পুলটা চক্কর দিচ্ছে ওরা দুজন। অরু চুপ করে আছে দেখে ক্রীতিক আচমকা ওকে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে টেনে এনে ওর কোমড়টা শক্ত করে চেপে ধরে কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বললো,

---- তুই যখন এগারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলি তখন থেকে তোর প্রতি আসক্ত আমি। এই রূপ, এই যৌবন কোথায় ছিল তখন? আমাকে বোঝার মতো মনটাও তো তৈরি হয়নি তখনও।

ক্রীতিকের কথা শুনে সচকিত হয়ে নুয়িয়ে রাখা মাথাটা অকস্মাৎ তুলে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু।

ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,

--- আই নো, ইটস নট ফেয়ার। কিন্তু কি করবো বলতো? নারী জাতির উপর এক আকাশসম ঘৃণা আর অভিমানের উর্ধে গিয়ে তোকে আমার ভালো লেগেছিল, মনে হয়েছিল তোর হৃদয়টা পেজা তুলোর মতোন নরম আর উষ্ণ। আমার কঠিন বরফের মতো শীতল, নির্জীব হৃদয়ে একটু খানি উষ্ণতার ছোঁয়া দিতেই উপর ওয়ালা বোধহয় তোকে আমার নিকট পাঠিয়েছিল সেদিন। সেই উষ্ণতা, সেই ছোট্ট হাতের স্পর্শ আজও আমাকে পুলকিত করে অরু, ঠিক সেদিনের মতোই চমকে দেয় বারবার , নিজের অজান্তেই সেদিন আমার বুকে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তুই। ব্যাস, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেলো হৃদয়ে তোলপাড়, তিরতির করে ভেঙে গেলো দাম্ভিকতার পাহাড়, সেদিন আমিও বোধ করেছিলাম, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য মায়ার বাঁধনের বড্ড প্রয়োজন, আর তুই হলি আমার সমগ্র জীবনের একমাত্র মায়াপরী। সেদিনের পর থেকেই নিজের স্ট্যাটাস,পাসোর্নালিটি,বয়স, সম্পর্কের সমীকরণ সবকিছুর মাথা খেয়ে তোর প্রতি অবসেসট হয়ে গিয়েছিলাম আমি। চোখ বুঝলে কিংবা চোখ খুললে, দিন রাত শুধু তোকেই দেখতাম, তুই আমার মাথা থেকেই বের হতিস না। আমি জানতাম এটা ঠিক নয়, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে , তাও আমি সারাক্ষণ তোকেই চাইতাম।

শুধুমাত্র নিজের অবাধ্য চিন্তাচেতনা, আর বেপরোয়া ইচ্ছে গুলোর হাত থেকে তোকে বাঁচিয়ে রাখবো বলে, নিজেই সরে এসেছিলাম তোর কাছ থেকে, বাড়িয়েছিলাম হাজার মাইলের দূরত্ব, দু'জনার মাঝে টেনে দিয়েছিলাম তিক্ততার এক মহা প্রাচীর, একাকী বিষন্ন জীবনে কতটা যন্ত্রনায় দিন রাত অতিবাহিত করেছি সে হদিস রাখিস তুই? অথচ কোনোকিছু না যেনেই, আমার ভোগ করা যন্ত্রনার একাংশ ও সহ্য না করেই আজ এখন এই যায়গায় দাঁড়িয়ে কি সুন্দর আমার ভালোবাসায় নিজের ছোট্ট আঙুলটা তাক করে ফেললি অরু? আমার থেকেও বেশি ভালোবাসিস তুই? আন্সার মি?

অরুর মুখে কথা নেই,কিইবা বলবে ও? জেনে শুনেই তো ভালোবাসার মহাসমুদ্রে ঝাপ দিয়েছে ও, ক্রীতিকের মতো করে অন্য কেউ ভালোবাসতে পারবে না বলেই তো ক্রীতিকের প্রেমে পরতে বাধ্য হয়েছে অরু, নতুন করে মনকে বোঝানোর তো কিছু নেই।এই মানুষটার হাতে নিজের ভালোবাসার গল্পের শিরোনাম উপসংহার সবই তো লেখা শেষ বহু আগেই। অরু জানে ক্রীতিক যেমন অতিরিক্ত ভালোবাসা দেয়, কষ্টটাও তেমন অতিরিক্তই দেয়, তাও অরুর জায়ান ক্রীতিককেই চাই, মুখে একশোবার না বললেও, মনেমনে হাজার বার হ্যা বলে বসে আছে ও। এ যেন জেনেশুনে বি'ষপান।

নিজের শক্ত হাতের বাঁধন ঠিলে করলো ক্রীতিক, আস্তে করে অরুর কোমড় ছেড়ে দিতেই ভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে ক্রীতিকের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু, যেন ও বলতে চাইছে,

--- কি ব্যাপার ছেড়ে দিলেন কেন? এতোক্ষণ এতো জোরাজুরি করলেন, আর এখন এভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন? ধরে রাখুন না আমাকে।

কিন্তু তার একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারলো না অরু, আত্মসম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে। অরু নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে আছে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ক্রীতিকের বুক চিড়ে, কিছুক্ষন চোখ বুজে নিজেকে খানিকটা সংযত করে শান্ত স্বরে ক্রীতিক বলে,

--- আই নো, মাই অবসেশন ইজ আনহেলদি, রাগের সময় যা খুশি তাই করি আমি,নিজের অজান্তেই তোকে অনেক অনেক কষ্ট দিই, আমি মানি, সব দোষ আমার। আমি অনেকটা বেপরোয়া, আর ছন্নছাড়া তাও মানি, কিন্তু তুই শুধু একটাবার আমার হয়ে থেকে যা অরু, ট্রাস্ট মি, আমি ভালোবাসতেও জানি।

ক্রীতিকের শেষ কথাগুলোতে ঠিক কি পরিমাণ জাদু ছিল, তা বোধ হয় অরু বলে বোঝাতে পারবে না। ক্রীতিকের মতো পিছুটান বিহীন মানুষও যে এতো কাতর হয়ে কাউকে থেকে যেতে বলতে পারে, সেটা অরু আজকেই প্রথম আবিষ্কার করলো, আর ও এটাও জানে যে ক্রীতিক এই কথাগুলো আজ প্রথম বারই বলেছে,অথচ প্রথম বারেই কি সুন্দর হৃদয় নাড়িয়ে দিলো।ক্রীতিকের কথার পাছে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অরু বলে,

---- ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি তো,তাছাড়া ফিরে গেলে তোমাকে কোথায় পাবো আমি? তোমার অতিরিক্ত ভালোবাসার অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গে নিজেকে দ'গ্ধ করা যে এখনো বাকি।

বাইরে বিজলি চমকাচ্ছে, ক্ষনে ক্ষনে বিজলির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে সুইমিং পুলের নীল বর্ণের টলটলে স্বচ্ছ পানি, বাতাসটাও বেড়েছে দিগুণ, বাইরের এহেন বৈরী আবহাওয়া দৃষ্টিগোচর হতেই ক্রীতিক অরুকে উদ্দেশ্য করে অনুভূতিহীন কন্ঠে বলে,

---- আমার স্পর্শ খারাপ লাগলে, আমি আর তোকে টাচ্ করবো না কখনো, আর না তো তোকে কোনোকিছুর জন্য জোরজবরদ'স্তি করবো, শুধু আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ঘুনাক্ষরেও মুখে আনবি না, ব্যাস এটুকুই চাওয়া। ওয়েদার খারাপ জলদি রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ কর, নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

কথা শেষ করে পুল থেকে ওঠার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে পা বাড়ায় ক্রীতিক, তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে অরু ডেকে বলে,

--- কে বলেছে আপনার স্পর্শ আমার খারাপ লাগে?

অরুর কথায় ক্রীতিক পেছনে ঘাড় ঘোরালে, অরু এগিয়ে এসে লাফ দিয়ে ক্রীতিকের কোলে উঠে পরে।

অরুর দুই উরুতে হাত রেখে ওকে সামলে নিয়ে, ক্রীতিক গম্ভীর মুখে বললো,

--- এখন আবার কি চাই?

--- আপনার স্পর্শ। কতদিন হয়ে গেলো আপনি আমাকে একটু আদর করেন না।

ক্রীতিক শুষ্ক ঢোক গিললো, ঢোক গেলার সময় ওর এ্যাডামস এ্যাপেলটা কি আকষর্নীয় ভাবে ওঠা নামা করলো,যা দেখে চোখ দুটো আচানক নেশায় বুদ হয়ে গেলো অরুর, অগত্যাই অরু নিজের খেইর হারিয়ে হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করলো ক্রীতিকের গলাটা। অরুর গভীর চাহনী পড়ে ফেলতে খুব একটা সময় লাগলো না ক্রীতিকের,ও একটানে অরুর হাতটা নিজের গলা থেকে সরিয়ে বাঁকা হেসে শুধালো,

--- যা বলছিস, আর যা করছিস, তা কি সজ্ঞানে ভেবে চিন্তে করছিস? আমার ভালোবাসা যে য'ন্ত্রনাদ্বায়ক সেটা ভুলে গেলি?

অরু আস্তে আস্তে নিজের চাহনি উপরে তুলে ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে বলে,

--- এতোকিছু বুঝিনা, আমি আপনাকে চাই, জেনে শুনে আপনার বি'ষাক্ত ভালোবাসা গ্রহন করেছি আমি, যন্ত্রনা তো সহ্য করতেই হবে,তাছাড়া আজকে নতুন তো কিছু নয়।

প্রথমে গাল, এরপর কানের লতিতে আলতো স্পর্শ করে নিজের হাতটা অরুর চুলের ভাঁজে প্রবেশ করায় ক্রীতিক, অরুর লম্বা চুল গুলোকে মুঠি বদ্ধ করে মুখটা নিয়ে আসে নিজের মুখের খুব কাছে,অতঃপর সেভাবেই ধরে রেখে হিসহিসিয়ে ক্রীতিক বলে,

---- আজ আমি একটু বেশিই রেগে আছি অরু, সহ্য করতে পারবি না আমায়। আর না তো আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইছি।

ক্রীতিকের বলা কথা গুলো চুপচাপ শুনে গেলো অরু, অতঃপর কোনোকিছুর ইঙ্গিত না দিয়েই চোখের পলকে ক্রীতিকের সিগারেটে পো'ড়া বাদামি ঠোঁটে নিজের ওষ্ঠাধর চেপে ধরে কয়েক সেকেন্ড।

আবেগের বশবর্তী হয়ে স্বামীর রাগ ভাঙানোর আশায় ওই একটা ছোট্ট চুমুই যথেষ্ট ছিল এই মূহুর্তে ক্রীতিককে beast বানিয়ে দিতে,

ক্রীতিকের থেকে নিজের ঠোঁটের কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্ব বাড়িয়ে মাথাটা নিচু করে অরু বলে,

---- আর কখনো আপনার উপর রাগ করবো না আমি, আর নাতো আপনাকে এভাবে জ্বালাতন করবো।আপনি কতো অসুস্থ বলুন তো।আমি সত্যিই একটা ইমম্যাচিউর,সব ভুলে যাই আমি।

ক্রীতিক প্রথমে চুপচাপ অরুর কথা শুনে গেলো, পরক্ষনেই বাঁজপাখির মতো আ'ক্রমণ বসালো ওর ফিনফিনে কোমল ওষ্ঠাধরে, অরুর দম ফেলার ফুরসত নেই, অথচ ক্রীতিক ছাড়লো তো নাই, উল্টো ঠোঁটের কাজ অবহ্যত রেখেই হিসহিসিয়ে বললো,

---- একশো বার করবি, যত ইচ্ছে তত রাগ করবি আমার উপর, দিন শেষে তোর সব রাগ ভাঙানোর দ্বায়িত্ব শুধু আমার, তোর রাগ ভাঙাতে যা করতে হয় তাই করবো আমি,দরকার পরলে সারাদিন সারারাত তোর পিছু পিছু ঘুরবো,কোনো সমস্যা নেই তাতে ।ইউ হ্যাভ প্রোপার রাইট টু বি এ্যাঙ্গরি উইথ মি বেইবি। এ্যান্ড আই হ্যাভ প্রোপার রাইট টু পানিশ ইউ হার্ড।

শেষ কথাতে তীর্যক হাসির রেখা ফুটে ওঠে ক্রীতিকের ভেজা অধরের কোনে,

অরু তৎক্ষনাৎ নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে, ক্রীতিকের পানে ভ'য়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

--- আবারও মা'রবেন?

এবার আর জবাব দিলো না ক্রীতিক, অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে নিয়েই পুল থেকে উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো করিডোর আর ছাঁদ বারান্দার মাঝখানে রাখা কাউচের দিকে, সেখানে অরুকে ছু'ড়ে ফেলে দিয়ে নিজের হাতের ক্যানোলা খুলতে উদ্যত হলে অরু হকচকিয়ে উঠে বললো,

---- ওটা খুলবেন না প্লিজ। এমনিতেই অনেকটা জখম হয়েছে, আর না।

ক্রীতিক চোখ ছোট ছোট করে অরুর আগাগোড়া পর্যবেক্ষন করে হাস্কিস্বরে বললো,

--- দেন ইউ হ্যাভ টু হেল্প মি বেইবি।

কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্থ হলো অরু, মিয়িয়ে যাওয়া গলায় শুধালো,

--- ক..কি হেল্প?

ক্রীতিক অরুর কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে একই স্বরে বললো,

--- জাস্ট আনবাটন মাই শার্ট।

*****************************************

--- আমাদের গল্পের ইষ্টিকুটুম হলেন আপনি সায়র, আমি নই।

স্বামী স্ত্রীর একান্ত ঘনিষ্ঠতম মূহুর্ত পার করে সায়র যখন নীলিমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম আবেশে চোখ বুজেছিল মাত্র কয়েকসেকেন্ড, ঠিক তখনই কথা ছোড়ে নীলিমা।নীলিমার কথায় তন্দ্রা ছুটে যায় সায়রের, মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে নীলিমার গলায় থুতনি ঠেকিয়ে ভ্রু কুঁচকে সায়র বলে ওঠে ,

--- মানে? আমি এতো কঠিন বাংলা বুঝিনা নীলিমা, একটু বুঝিয়ে বলবে?

সায়রের কথার পাছে নীলিমা রহস্যময়ী হাসি উপহার দিয়ে বলে,

---- আপনাদের সবার ধারণা ভুল সায়র, আপনি আমাকে বিয়ে করতে জোর করেন নি, আর নাতো আপনি আমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছেন।

নীলিমার কথা শুনে সায়র এবার ধরফরিয়ে উঠে বসে, অবাক কন্ঠে বলে,

--- কি বলছো এসব? আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তোমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছি বলে তোমার আব্বাজান আমার দিকে ব'ন্দুক অবধি তাক করেছিলেন।

নীলিমা নিঃশব্দে হাসলো, ওর হাসিটা ছিল ব্ল্যাকহোলের মতোই রহস্যেঘেরা, কিংবা মোনালিসার হাসির থেকেও বেশি অদ্ভুত। মুখের হাসিটা ধরে রেখেই নীলিমা বলে,

--- শুরু থেকে শেষ অবধি সবকিছুই সাজানো ছিল সায়র।

সায়র শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বললো,

--- একটু খুলে বলবে প্লিজ?

নীলিমা হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়, পরক্ষণেই বলে,

---- আচ্ছা আপনার একটুও অদ্ভুত লাগেনি, কথা নেই বার্তা নেই হুট করেই আমার বিয়ে কি করে ঠিক হয়ে গেলো? কিংবা আমাদের বিয়ের পরে আব্বাজান আমাদের কেন খুজলো না? আচ্ছা বাদ দিন আমিই বলছি, আসলে আমি আর আব্বাজান চাইতাম কোনোভাবে আপনি আমাকে বিয়েটা করুন, কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলনা, শুনলাম আপনিও অনু আপার বিয়ের পরেই চলে যাবেন, তাই বুদ্ধি করে নিজের বিয়ের নাটক টা সাজিয়েছিলাম,পরে নিজেই অন্য ফোন দিয়ে আপনাকে আমার বিয়ের খবরটা দিয়েছি, যাতে আপনি এসে আমাকে নিয়ে যান। আর জোর করে বিয়ে করে নেন।

সায়র স্তম্ভিত কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

--- এতোটা নাটক কেন করেছিলে নীলিমা? আমিতো তোমাকে শুরু থেকেই পছন্দ করতাম, আর তোমার যদি আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছেই থাকে, তাহলে শুধু শুধু আমাকে ইগনোরই বা করেছিলে কেন?

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- একটা একটা করে বলি?

সায়র বুঝদারদের মতো মাথা ঝাকালো।

নীলিমা বললো,

--- প্রথমত মানুষ বিপরীতমূখী জিনিসে আকর্ষিত হয় বেশী, আপনার মতো সুপুরুষদের ক্ষেত্রে এই জিনিসটা একটু বেশিই দেখা যায়, তাইতো আমি ছিলাম আপনার সম্পূর্ণ বিপরীত। যার ফল দেখুন, আপনি খুব দ্রুতই আমার প্রতি আকর্ষন অনুভব করেছেন।তবে বিয়ের পরেও আপনার সাথে স্বাভাবিক না হতে পারার কারণ একটাই ছিল।আর তা হলো, অনুশোচনা।নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে অবলম্বন করেছিলাম আমি, আপনার মতো মানুষকে ব্যবহার করেছি শুধু মাত্র নিজের স্বার্থ হাসিলের আশায়, এসব ভাবতে গেলেই তীব্র অনুশোচনা আর অ'পরাধ বোধে মাথাটা হেট হয়ে যেতো আমার।

--- বিয়েটা কেন করেছিলে?

নীলিমার কথার মাঝেই প্রশ্ন করে সায়র,

প্রত্যুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীলিমা বলে,

---- একটা শয়তানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, মা মা'রা যাওয়ার সময় চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে অভাবে পরে আমাদের বাড়িটা বন্ধক রেখেছিলেন আব্বা। বাড়িটা যার কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিল, সে হলেন আমাদের পুরান ঢাকার প্রভাবশালী জনৈক ব্যক্তি। টাকার গরমে যা নয় তাই করে বেড়ান তিনি, দিনদুপুরে মেয়েদের তুলে এনে সম্ভ্রম হানি করেন,এছাড়া লুটপাট, মা'রামারি হানাহানি এসব তো তার নিত্যদিনের কারবার।

কিন্তু বলেনা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়, আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো,

বাড়ি বন্ধক দেওয়ার কয়েক মাসের মাথাতেই ঋণের বোঝা দিগুণ হয়ে গেল, প্রতিমাসে এতো মোটা অংকের সুদ দিতে গিয়ে আব্বা হিমসিম খেতে শুরু করলেন, একপর্যায়ে ঋণের বোঝা ভারী হয়ে এলে নির্দয় লোকটা সুযোগ বুঝে এক সাথে সব টাকা দাবি করে বসে, না দিতে পারলে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে সেই হুমকি ও ঢুকিয়ে দিয়ে যান আব্বাজানের চিন্তিত মস্তিষ্কে।

--- ইটস 21st century, নীলিমা, এরকম লোক এখনো এক্সিস্ট করে? আমিতো ভাবতেই পারছি না।

কপালে দু'হাত ঠেকিয়ে, দুশ্চিন্তা গ্রস্থ কন্ঠে কথাটা বললো সায়র, সায়রের কথার পাছে নীলিমা বলে,

---- করে, বাংলাদেশে এর থেকেও বহুগুন খারাপ লোক এক্সিস্ট করে সায়র।

--- তারপর কি হলো?

নীলিমা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

--- তারপর আর কি, যা হওয়ার তাই হয়েছে, আব্বাজানের কাকুতি মিনতিতে লোকটা আমাকে তুলে নেয়নি ঠিকই, তবে একটু বড় হতেই, পুরো মহল্লায় ঘোষণা করে দিয়েছে সে আমাকে বিয়ে করবে, এমনকি আব্বাকেও হু'মকি দিয়ে রেখেছে, তার সাথে বিয়ে না দিলে আমাকে সমাজে মুখ দেখানোর অবস্থাতেই রাখবে না।

জানেন, সে সময় এমন একটা কু'প্রস্তাবকেও চুপচাপ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না আব্বাজানের হাতে, নয়তো কোনোদিন দেখা যেত সুস্থ মানুষ ভার্সিটি গিয়েছি,আর ফিরে এসেছি লা'শ হয়ে। নিজের মেয়েকে হারানোর ভয়ে আব্বাজান সর্বদা তটস্থ ছিলেন, তাই তিনি লোকটাকে অনুরোধ করেন আমাকে যাতে পড়তে দেওয়া হয়, বিয়ে আমার তার সাথেই হবে। লোকটা আব্বাজানের কথায় রাজি হলেও চারিদিকে ততদিনে জানাজানি হয়ে যায় যে, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।যার দরুন লোকটার ভয়ে বিয়ের প্রস্তাব তো দূরে থাক, আমার চোখে চোখ তুলে পর্যন্ত কেউ তাকাতো না অবধি।

এভাবেই দিন যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে নিজেকে বলির পাঁঠা ভাবতে শুরু করি আমি, কারন আমার ভবিষ্যতে বলে আর কিছু নেই,ঠিক এমন একটা দম বন্ধকর জীবনের মাঝপথে আটকে গিয়ে আমি যখন ছটফট করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই ইষ্টিকুটুম রূপে আমার জীবনে পদচারণ ঘটান স্বয়ং আপনি। ততোদিনে মনে মনে আপনার মতোই কাউকে খুজছিলাম আমি সায়র, উপর ওয়ালারা কাছে দিনরাত প্রার্থনা করে বলেছিলাম, যাতে আমার জীবনে এমন কেউ আসে, যে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে দূর বহুদুরে, অনেক অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে সযত্নে নিজের আস্তিনে লুকিয়ে রাখবে সে আমায়। দেখুন সত্যি সত্যিই তাই হলো, আমার প্রার্থনা কবুল হলো। আপনি আমায় বাঁচালেন, আমার জীবনে ইষ্টকুটুম রূপে এসে আমার রক্ষাকবজ হয়ে গেলেন।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো নীলিমা। সায়র দ্রুত হস্তে নীলিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,

--- কাঁদছো কেন বউ? আমি আছি তো, তোমার ইষ্টিকুটুম। এরপর কোন ভুড়িওয়ালা আমার বউকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় দেখবো আমি, ব্যাটাকে চোখের সামনে পেলে যদি ওর গোঁফ টেনে না ছিঁড়েছি তো আমার নামও সায়র আহমেদ নয়।

সায়রের কথায় ফিক হেসে দিলো নীলিমা, নীলিমা হাসছে দেখে হাতের বাঁধন দৃঢ় করে নীলিমাকে নিজের চওড়া বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে নিয়ে ওর ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে সায়র বললো,

--- আজ রাতে আর শুদ্ধ হতে ইচ্ছে করছে না বউ, একদমই করছে না।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৫৬

সুন্দর একটা দিনের সূচনা হলো ধরণীতে। বিগত ঊনিশ বছরের জীবনে যতগুলো সুন্দর সকাল পার করে এসেছে অরু, তার মধ্যে আজকের সকালটা অন্যতম। অবশ্য অরুর নিকট ক্রীতিকের সংস্পর্শের সকাল গুলো বরাবরই স্বপ্নের মতোই সুন্দর আর আনন্দদায়ক। কাল রাতে ঝড়ো হাওয়ার তান্ডব ছিল প্রকট, তবে বৃষ্টি হয়নি এক ফোঁটাও। অথচ আজ সকাল সকালই আকাশ বাতাস ছাপিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে মুখরিত চারপাশ।

সকালের আকাশটা ঘুটঘুটে কালো মেঘে ঢাকা পরেছে, আজ আর সূর্যের মুখ দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমেরিকার এই এক বেহাল দশা, আবহাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই এখানে, এই রোদ তো এই বৃষ্টি।

আজ অরুর ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজে। বাইরে একফোঁটাও দিনের আলো নেই,তাই পর্দার ভাড়ি পাল্লা টেনে রাখা রুমটাও ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে আছে, অরু পিটপিট করে চোখ খুলে পুরো রুম হাতরে কোথাও ক্রীতিকের দেখা পেলো না। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে হুট করেই কোথায় চলে গেলো লোকটা, কে জানে? অরু খুব বেশি ভাবলোও না, আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে স্বভাব বশত বিছানা হাতরে ক্রীতিকের ফোনটা তুলে নিলো হাতে। দুজনার বার্থডে দিয়ে সেট করা পাসওয়ার্ডটা খুলে একেকটা ফোল্ডারে ঢুকে এটা সেটা দেখতে লাগলো অরু, যদিওবা অরুর মতে এই মোবাইলটার থেকে বোরিং মোবাইল ফোন দুনিয়াতে আর দুটো নেই।কি সব হাবিজাবি ডকুমেন্টস দিয়ে ভর্তি সব। গ্যালারীতেও কিছু নেই, সর্বশেষ ছবি তোলা হয়েছে আরও মাস দুইয়েক আগে।তাতে দেখা যাচ্ছে দার্জিলিং এ সায়রের হোমস্টে থেকে কাঞ্চনজঙ্খার একটা ঝাপসা ভিউ।

--- ধুর বোরিং।

ফোনের সব গুলো সফটওয়্যারে ছোটমোটো একটা ঢু মে'রে হতাশ হয়ে ঠোঁট উল্টে কথাটা বলে ফোনটা সাইডে রেখে দিলো অরু, ঠিক এমন সময় ফোন থেকে আগত টুংটাং ম্যাসেজের আওয়াজ পুনরায় আকর্ষন কেড়ে নিলো ওর, তাইতো সকাল সকাল কে ম্যাসেজ দিয়েছে দেখার জন্য আবারও নতুন উদ্যমে ফোনটা হাতে নিলো অরু, নোটিফিকেশনে ভাসছে অর্ণবের নাম, সাথে কিছু ভিডিও লিংক আর ছোট্ট বার্তা।

--- ডান ব্রো।

ছোট্ট ম্যাসেজে চোখ বুলিয়ে মনের মাঝের কৌতুহল আর দমিয়ে রাখতে পারলো না অরু, ফট করেই ঢুকে গেলো লিংকে।আর ঢুকে যা দেখলো তাতে সমস্ত গাঁ গুলিয়ে উঠলো ওর, তৎক্ষনাৎ একটা বিরক্তিকর ভাব প্রকাশ পেল চেহারার আদলে, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকহাত দূরে ছুড়ে মা'রলো ফোনটাকে,অতঃপর ক্রীতিকের উপর ক্রোধান্বিত হয়ে একা একাই তেঁতো গলায় বলে উঠলো,

--- ডার্ক রোম্যান্স শোনেন সেটা মানলাম, তাই বলে উনি এইসব দেখবেন? ছিহ!

কথাটা বলতে বলতেই কপালের মাঝে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ পরলো অরুর, কিছু একটা মনে পরার মতো সচকিত হয়ে বিড়বিড়ালো ও,

---- এক সেকেন্ড, ভিডিওর লোকটাকে চেনা চেনা লাগলো মনে হচ্ছে , কোথায় যেন দেখেছি।

সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরও একবার ভিডিও তে চোখ বোলালো অরু, আর যা দেখলো তাতে ওর হাড় হীম হয়ে গেলো আ'তঙ্কে। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে চোয়াল জোড়া আপনা আপনি দু'দিকে ফাঁক হয়ে গেলো ওর, মুখ দিয়ে বেরোলো অস্পষ্ট আওয়াজ,

---- রেজা ভাই এসব কি করছে? আর এমন একটা ভিডিও ইন্টারনেটেই বা কি করে এলো?

অরুর ছোট্ট মস্তিষ্কটা কোনো কিছুরই ইঙ্গিত দিতে পারলো না হঠাৎ করে, একটু নড়েচড়ে বসে ভিডিওটাতে আবারও নজর দিয়ে বারবার পজ করে লেকটার চেহারা ভালোমতো পরখ করলো অরু, অতঃপর অস্ফুটেই বললো,

--- অণর্ব ভাইয়া রেজা ভাইয়ের এমন গোপনীয় একটা ভিডিও ওনাকে পাঠালো কেন হঠাৎ? ক্রীতিক কুঞ্জের সব ঠিকঠাক আছে তো? নাকি সাংবাদিকরা মা'কে এসবের জন্য বিরক্ত করছে?

হাজারটা দুশ্চিন্তায় ভার হয়ে এলো অরুর মাথাটা, মস্তিষ্কে জড়ো হওয়া কোনো প্রশ্নেরই উত্তর নেই অরুর কাছে।সবকিছুর উত্তর জানতে হলে ক্রীতিককে প্রয়োজন, কিন্তু সে কোথায়? শেষ প্রশ্নটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই ক্রীতিককে খোঁজার উদ্দেশ্যে মোবাইল সমেত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অরু। তাড়াহুড়োয় ভুলেই গেলো যে ওর পড়নে এখনো ক্রীতিকের ওভার সাইজ টিশার্ট রয়েছে , জামাটা অন্তত বদলানো উচিৎ ছিল।

এদিক সেদিক খুঁজে অবশেষে ক্রীতিকের দেখা মিললো জিমে। ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়িটার সবচেয়ে বড় রুমটাই ক্রীতিকের ব্যক্তিগত জিমনেশিয়াম। যদিওবা এই রুমে খুব কমই আসা হয়েছে অরুর, কারণ জিমে ওর কাজটাই বা কিই? তাও আজ খুঁজতে খুঁজত এখানেই হদিস মিললো ক্রীতিকের, অরু একটু উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখলো, ক্রীতিক ট্রেডমিলের উপর সমানে দৌড়াচ্ছে, ওর পরনে ওভার সাইজ ব্যাগী প্যান্ট আর কালো রঙা স্যান্ডোগেঞ্জি। মাথাটা কালো ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। তাও পেছন থেকে মাথার শেষভাগের সেলাইয়ের দাগ গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান, চুল বড় হলে হয়তো ধীরে ধীরে ঢেকে যাবে সেগুলোও। কিন্তু ছোট ছোট বাজ কাটিং হেয়ার স্টাইলেও যে গৌড় বর্ণের জায়ান ক্রীতিককে এতোটা মানাবে সেটা বোধ হয় অরুর কল্পনাতীত।

আর এই মূহুর্তে, ট্রেডমিলের উপর দৌড়াতে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক সুদর্শন যুবকটির চওড়া বলিষ্ঠ পৃষ্ঠদেশের দিকে চেয়ে অষ্টাদশীর মুখ থেকে একটাই কথা বেরোলো শুধু ,

---- হাউ ম্যানলি!

অরুর আওয়াজ পেয়ে ট্রেডমিলের গতি কমালো ক্রীতিক, ধীর গতিতে দৌড়াতে দৌড়াতেই অরুকে উদ্দেশ্য করে বললো,

--- গুড মর্নিং বেইবি।

ক্রীতিকের মুখ থেকে পাওয়া সকাল সকাল উষ্ণ সম্মোধনে ভ্রম কেটে গেলো অরুর, অন্য সময় হলে হয়তো এখন গিয়ে একটু ঢং করতো স্বামীর সাথে, কিন্তু এই মূহুর্তে এসবের জন্য একটুও সময় নেই ওর হাতে, নিজের অযাচিত ভাবনা গুলো বড়'ই ভাবাচ্ছে অরুকে, যার দরুন সময় নষ্ট না করে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে ভিডিওটা প্লে করে ওর মুখের সামনে ধরলো অরু, থমথমে গলায় শুধালো,

--- এসব কি?

ক্রীতিক খানিকটা মিনারেল ওয়াটার পান করে, নতুন উদ্যমে দৌড়াতে দৌড়াতে নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

--- তোর মামাতো ভাই রেজার নু** ভিডিও।

অরু দাঁত কটমটিয়ে বললো,

--- সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আপনার ফোনে এসব কি করে এলো?

ক্রীতিক ঠোঁট উল্টাল, গা ছাড়া একটা ভাব নিয়ে বললো,

--- শুধু আমার ফোনে নয়, পৃথিবীতে যত সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার মানুষ আছে সবার ফোনেই এটা শো করছে। ছাত্রলীগ সহসভাপতির অপকর্ম ফাঁস। আরও কয়েকটা আছে দেখবি নাকি? ইজন'ট ইট ইরোটিক? অবশ্য তোর আমার কাছে কিছুই না এসব।

শেষ কথাটা বলে এক ভ্রু উঁচিয়ে, অরুর পানে শয়তানি হাসি নিক্ষেপ করলো ক্রীতিক।

ক্রীতিকের হাসিতে গা জ্বলে উঠলো অরুর, ও তৎক্ষনাৎ ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,

--- চুপ করুন অসভ্য লোক, আপনি একটা অ'শ্লীল।

ক্রীতিক ট্রেডমিল থেকে নেমে কাঁধের উপর তোয়ালে রেখে, সেটা দ্বারা গলার ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে গিয়ে বসলো এককোনে রাখা ডিভানের উপর, অতঃপর আঙুলের ইশারায় অরুকে কাছে ডেকে বলে উঠলো,

---পৃথিবীর সব পুরুষই বউয়ের কাছে অসভ্য বেইবি, আমার বন্ধু সায়রকেই দেখনা, সারা পৃথিবীর সামনে শুদ্ধ পুরুষ নামে খ্যাত হলেও গিয়ে দেখ, ব্যাটা দিন শেষে বউয়ের কাছে গিয়ে ঠিকই অশুদ্ধ হতে চায় ।

অরু ক্রীতিকের নিকট এগিয়ে এসে বিরক্তি নিয়ে বললো,

---- আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন, সত্যি করে বলুন এসবের পেছনে আপনার হাত রয়েছে, তাইনা?

ক্রীতিক এবার নিজের উরুর উপর ইশারা করে অরুকে বসতে বললো, অরু চোখমুখ কালো করে, ঠাস করেই গিয়ে বসে পরলো সেখানে। ক্রীতিক অরুর পিঠে নিজ কপালে ঘাম মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- রাগ করতে হবেনা, কি জানতে চাইছিস বল?

পেছনের দিকে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে অরু শুধালো,

--- কেন করেছেন এটা? মামির পরিবার কি এখন আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? তাছাড়া হলুদ সাংবাদিকরা যদি ক্রীতিক কুঞ্জে এসে মাকেও হ্যারাস করে তখন?

--- চিন্তা নেই,তোর মাকে কেউ হ্যারাস করবে না, সাদা পোশাক ধারী পুলিশ রয়েছে বাড়ির চারিদিকে। আর তোর মামির পরিবারের কথা যদি বলিস তাহলে বলবো তাদের একটা উপযুক্ত শিক্ষা হওয়া উচিৎ,রেজাকে আমি একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু জা'নোয়ার টা সেই সুযোগের যোগ্যতাই রাখেনা।

--- মানে?

অরুর সামান্য মানের পেছনে অনেক বড় কৌতূহল লুকিয়ে রয়েছে, তাই একটু খোলাসা ভাবেই জবাব দিলো ক্রীতিক,বললো,

---- মনে আছে আমাদের ভিডিও ধারণ করতে মিডিয়ার লোক লেলিয়ে দিয়েছিল রেজা?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক বলে,

--- এই ভিডিও গুলো তখনই সংগ্রহ করেছিলাম। বা'স্টা'র্ড টা ক্ষমতার বদৌলতে রাত হলেই মেয়েদের সাথে এসব নোংরামি করে বেড়াতো, আর দিনের বেলা স্বাধু সেজে মাইকের সামনে গিয়ে মানুষকে শান্তির বানী শোনাতো। রেজার কিংবা ওর এসব নোংরা কাজকর্মে আমার কিছুই যায় আসতো না, যদি না ও আমার সাথে লাগতে আসতো। তখনই চেয়েছিলাম ওর সব অপকর্ম ফাঁস করে ওকে জেলে পাঠাবো। কিন্তু ওই যে, একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। মস্ত ভুল করেছিলাম তখন, যার ফলরূপ আমার কলিজা অবধি নজর দিয়ে ফেলেছে রা'স্কেলটা। তবে কথায় আছে না, লাস্ট বাট নট লিস্ট। আমি ওর চোখ উপড়ে ফেলিনি, কিন্তু এমন ব্যাবস্থা করেছি যে, চোখ থাকতেও আর কোনোদিন চোখ তুলে কারও দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো মান সম্মান টুকু অবশিষ্ট নেই ওর।

কথা বলতে বলতেই ক্রীতিকের চোখ মুখের ভঙ্গিমা কেমন পাল্টে গিয়েছে, শান্ত নদীর মতো চোখ দুটোতে ফুটে উঁঠেছে কাঠিন্যতা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্রীতিক এখনো রেগে আছে।রেজার ভাগ্যটা ভালো যে ও আমেরিকাতে রয়েছে , নয়তো বাংলাদেশে থাকলে না জানি কি করতো রেজার সঙ্গে। হয়তো দেখা যেত, সত্যি সত্যিই রেজার চোখ দুটো হ্যামার দিয়ে গেলে দিতো ক্রীতিক।

কি সব উদ্ভট চিন্তা করতে করতেই শরীর কাটা দিয়ে উঠলো অরুর, আজেবাজে চিন্তা সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ও ক্রীতিককে শুধালো,

---- এখন কোথায় আছে রেজা?

জবাবে ক্রীতিক বললো,

--- ভিডিও ভাইরাল হবার পর থেকেই পলাতক, ভুক্তভোগী মেয়েগুলো সব একেএকে পুলিশের কাছে গিয়ে কমপ্লেইন করেছে, সবাইকে চাকরি, রেশন,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সিট, এসবের প্রলোভন দেখিয়ে, দিনের পর দিন নিজের স্বার্থ হাসিল করতো রেজা, ছাত্র লীগের নেতা বলে ভয়ে এতোদিন কেউ মুখ না খুললেও, এবার সুযোগে সব অপকর্ম বেরিয়ে আসছে ব'দমাশ টার।

ক্রীতিকের কথা শুনে চুপচাপ মুখে আঁধার নামিয়ে বসে রইলো অরু, দক্ষিণের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আঁচড়ে পরছে ওদের শরীরে, হঠাৎ ঠান্ডা জলের স্পর্শ পেয়ে জানালার দিকে এক ঝলক পরখ করে পুনরায় অরুর দিকে দৃষ্টিপাত করে ক্রীতিক শুধালো,

--- মুড অফ?

অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ায়, ক্রীতিক ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো,

--- অনেক তো হলো, এবার তো পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করতে হবে বেইবি, তোকে গ্রাজুয়েট হতে হবে। আমি সিন্ধান্ত নিয়েছি তোর গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা আর বিডি তে ফিরবো না। লাস্ট একবছরে একটা সেমিস্টারও কম্পিলিট করতে পারিস নি এদিক ওদিক করতে গিয়ে, অনেক হয়েছে ফাঁকিবাজি আর না।

অরু নাকটা সিকোয় তুলে, অসহায় মুখে বললো,

--- কিন্তু আমার তো ইকোনমিকস পড়তে একটুও ভালো লাগেনা।

---- লাগতে হবে, ভবিষ্যতে জেকে গ্রুপে বসতে হবে। আমার পাশাপাশি বিজনেসের হাল ধরতে হবে, যেভাবে তোর মা আমার বাবার ছাঁয়া হয়ে পাশে থেকেছিল,ঠিক সেভাবে।

অরু তৎক্ষনাৎ পেছনে ঘুরে আশ্চর্য হয়ে বললো,

---- আপনি কি চাইছেন আমিও আমার মায়ের সাথে কোম্পানি নিয়ে দন্দে লিপ্ত হই?

অরুর কথার জবাবে তীর্যক হাসলো ক্রীতিক, অতঃপর বললো,

--- আমি বেঁচে থাকতে তোর সাথে লাগতে আসার মতো কলিজা কারোর নেই বেইবি, কিন্তু আমি যখন না থাকবো, তখন তো তোর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে এই ক্রুয়েল পৃথিবীটাতে। আমাদের নিষিদ্ধ সম্পর্কের জের ধরে তোকে অনেকে অনেক ভাবে হেয় করতে চাইবে, দেখবি কাছের মানুষরাও কেমন রূপ বদলে ফেলবে, তখন যদি তুই বিগেইনার হোস তো তোর জন্য সবকিছু সামলানো খুব কঠিন হয়ে যাবে, নিজের দ্বায়িত্ব বুঝে নিতে গিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ভাবে কটাক্ষের স্বীকার হতে পারিস, যা তোকে সামনে এগোতে দেবে না, কারণ ওরা চাইবে তুই যাতে ভেঙে পরিস, ভেঙে পরে নিজের অধিকার ছেড়ে দিস । তাই আমি থাকতে থাকতেই আমার পাশে থেকে আমার হাত ধরে নিজের যায়গাটা নিজেই তৈরি করে নিতে হবে তোকে বেইবি। আর এসবের জন্য পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।

ক্রীতিকের এতোসব জ্ঞানের বানী কানে ঢুকলো না অরুর, বরং ও বেশ বিরক্ত হয়ে ক্রীতিকের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে তাকিয়ে বললো,

--- আপনি থাকতে থাকতেই মানে?আমায় ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি? কিছুদিন আগে এতো বড় একটা এ্যা'ক্সিডেন্ট হলো, এখন আবার এসব বলছেন, আমার একটুও ভালো লাগছে না আপনার কথাবার্তা চুপ করুন এক্ষুনি।

ক্রীতিক মৃদু হেসে অরুর খোলা চুলে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বললো,

---- এটাতো কথার কথা বললাম বেইবি, তবে যা বলেছি খুব ভেবে চিন্তে চিরন্তন সত্যি কথাগুলোই বলেছি, তুই জানিস আমি আবেগে গা ভাসানো মানুষ নই, তাই তিক্ত হলেও সত্যি বলতে আমার মুখে বাঁধেনা।

অরু ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

--- তাই বলে এসব বলবেন?

ক্রীতিক অরুর কলার বোনের ভাঁজে টুকরো চুমু খেয়ে বললো,

--- বলবো না, তার আগে তুই বল, তুই পড়াশোনা শুরু করবি এবং সিরিয়াস হবি।

অরু একটু ভাবলো,পরক্ষণেই ছোট ছোট চোখ করে ক্রীতিকের দিকে নজর দিয়ে বললো,

---- ঠিকাছে পড়বো, তবে একটা শর্ত।

--- কি শর্ত?

ক্রীতিকের বুকের উপর নিজের পিঠ ছেড়ে দিয়ে আবদারের স্বরে অরু বললো,

--- পড়াশোনার পাশাপাশি আমি উপন্যাস লিখতে চাই, এটা আমার স্বপ্ন, না করতে পারবেন না কিন্তু।

অরুর কথার প্রত্যুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হার মেনে নেওয়ার মতো করেই ক্রীতিক অসহায় গলায় বললো,

--- ইউ ক্যান ডু ইট।

ক্রীতিকের আস্কারা পেয়ে অরু এবার আবদারের ঝুড়ি খুলে বসলো, একনাগাড়ে বলতে লাগলো সব,

---- আর আমি সকালে ব্রেকফাস্টও বানাতে চাই।

---- ইউ ক্যান।

--- এ বাড়িটাকে নতুন করে ডেকোরেট করতে চাই।

--- ইউ ক্যান।

---- নীলিমার সাথে দেখা করতে চাই?

---- ইউ ক্যান।

---ডোরাকে এনে দিন।

--- ইউ ক্যান।

ক্রীতিকের শেষ কথাতে থেমে গেলো অরু, ডোরাকে এনে দিতে বলার সাথে ইউ ক্যান এর কি সম্পর্ক ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে, চকিতে পাশ ফিরে তাকায় অরু। পাশে তাকাতেই দেখলো গালে হাত দিয়ে ওর দিকেই নিস্প্রভ চোখে চেয়ে আছে ক্রীতিক, যেন শিল্পী তার নিজ হাতে বানানো কোনো স্কাল্পচারকে বিস্ময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ক্রীতিককে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু হাত নাড়িয়ে শুধালো,

--- কি দেখছেন?

তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো ক্রীতিক,

--- তোকে।

ক্রীতিকের কথায় খানিকটা লজ্জা পেয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথায় নুয়িয়ে ফেললো অরু।

অরুকে লজ্জা পেতে দেখে ক্রীতিক এবার সটান বসে কাঠকাঠ গলায় বললো,

--- লেনদেনে আমি খুব কড়া অরু, তোকে আমি বিনা শর্তে এতোকিছুর অনুমতি দিয়ে দিলাম, বিনিময়ে আমি কি পাবো?

অরু হেঁসে বললো,

--- আপনার তো সবই আছে, আর কি চাই?

--- রাইট নাও ইউ হ্যাভ টু শাওয়ার উইথ মি, আপাতত এটাই চাই, লেটস গো।

যদিও ক্রীতিকের চাহিদার কথা শুনে বিশাল বড় একটা ঝটকা খেলো অরু, তবে ক্রীতিক তার ধার ধারলো না মোটেই, বরং অরুকে টেনে হিঁচ'ড়ে, সাথে করে নিয়ে ত্যাগ করলো জিম রুম।

*****************************************

নদীর স্রোতের মতোই কলকলিয়ে বয়ে যায় সময়। চোখের পলকে খসখস করে উল্টে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা।মিনিট, ঘন্টা, দিন,রাত পরবর্তীতে মাসের পর মাস কিভাবে যে সময় গুলো চলে যায় তা ঠাওর করা দুষ্কর। স্থান কাল ভেদে সময়ের এই বিবর্তন কিছুটা মিশ্র প্রতিফলন ফেলে রেখে যায় মানুষের মাঝে, কেউ মরিচীকার মতো হাতরে বেড়ায় পুরনো ফেলে আসা স্মৃতি, কেউবা এক বুক আশা নিয়ে প্রতীক্ষা করে নতুনের আগমনী বার্তার।

আজ তেমনই একটা সুন্দর দিন, এলিসার বেবি শাওয়ার আজ, দেখতে দেখতে কখন যে সাতটা মাস পেরিয়ে গেলো,পেটের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা সত্তাটার আসারও সময় হয়ে গেলো অথচ কোনোকিছুই সেভাবে অনুভব করতে পারলো না এলিসা।

কি করেই বা পারবে? গত সাত মাসে প্রেগন্যান্সী সিকনেস ওর ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি, বেবি বাম্প নিয়েই কর্পোরেট অফিসে ফুল টাইম ডিউটি করে গিয়েছে পুরো সময়টাতে। কিন্তু এতোগুলো দিন পেরিয়ে এলিসার নিজেরও মনে হলো এখন একটু অর্ণবের কথা শোনা প্রয়োজন, বাচ্চাটা গর্ভে বড় হচ্ছে, তারও তো ভালো থাকা মন্দ থাকার ব্যাপার রয়েছে, তাছাড়া অর্ণব সেই তিন মাস থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছে যাতে এলিসা এবার একটু শান্ত হয়। অবশেষে সাত মাসের মাথায় এসে বাচ্চার মুখ চেয়ে এতো ভালো কর্পোরেট জবটা ছেড়েই দিলো এলিসা। আর আজকে যে এই বেবি শাওয়ারের এতো বড় আয়োজন, সেটা মূলত সায়র, ক্রীতিক আর অর্ণবেরই প্ল্যান। ওদের তিনজনার একটা মাত্র মেয়ে বেস্টফ্রেন্ড, অবশ্যই সে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট ডিজার্ভ করে।যতই হোক ওদের চারজনের মধ্যে আর কেউ কোনোদিন মা হবে না আর, যা হবে সব বাবা।

বেবি শাওয়ারের আয়োজন করা হয়েছে বেশ জাঁকজমক ভাবে, চারিদিকে ল্যানটার্ন আর স্ফটিকের রোশনাই এ পুরো হলরুমটা ঝিলমিল করছে। পুরো অনুষ্ঠানের থীম আজ স্কাই ব্লু। এলিসাকে থীমের সাথে মিলিয়ে আকাশী রঙের গাউন আর পার্লের মুকুট পরানো হয়েছে, তাতে গুটি ইংরেজি অক্ষরে লেখা মম টু বি। অর্ণব ও এলিসার সাথে মিলিয়ে স্কাই ব্লু রঙের স্যুট চড়িয়েছে গায়ে, বউয়ের সাথে রঙ মিলিয়ে জামা কাপড় পড়ার অভ্যেসটা আর গেলোনা ছেলেটার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আজকে এলিসা একটুও রেগে নেই অর্ণবের উপর, বরং নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো হাসবেন্ডের গলা জড়িয়ে ধরে একের পর একে ফটোতে পোজ দেওয়ায় ভীষণ ব্যস্ত সে।

হলের এক কোনে ডোরাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে এলিসা অর্ণবকে দেখে মৃদু হাসলো অরু, অতঃপর চোখ ঘুরিয়ে তাকালো প্রত্যয় আর অনুর দিকে, গত মাসেই আমেরিকা এসেছে অনু। আসলে এসেছে বললে ভুল হবে, প্রত্যয় জোর করে নিজের সাথে নিয়ে এসেছে অনুকে, কারন অনু দু'মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাঝখানে কোম্পানির কাজে বেশ কয়েকমাস দেশে ছিল প্রত্যয়, পরে যখন অনুর এই অবস্থা হলো, তখন নিজের অনাগত সন্তানের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে আর একা একা ইউ এস এ ফিরতে পারলো না প্রত্যয়। একজন দ্বায়িত্বশীল স্বামী আর সন্তানের মতোই আব্বু আম্মু স্ত্রী সমেত ফিরে এলো সে। প্রত্যয়ের ছোট্ট এ্যাপার্টমেন্টে এখন প্রতিনিয়ত খুশির ফোয়ারা বয়ে যায়, মাঝেমধ্যে তো অরুও এসে যোগ দেয় ওদের পারিবারিক আড্ডায়, তারপর সন্ধ্যা হয়ে এলেই কোথা থেকে যেন ক্রীতিক ফিরে এসে ঠিক সময় মতো নিয়ে যায় তার ছোট্ট বউকে। বউ টউ নিয়ে আবার রাত্রিবেলা একদমই রিস্ক নেয়না সে,অরুকে কাছে না পেলে যদি ঘুম না হয়? সেই দুশ্চিন্তায়।স্বভাবটা যে শুধুমাত্র ক্রীতিকেরই, তেমনটা বললে মিথ্যে বলা হবে। আজকাল অরুর ও তো ঘুম হয়না মানুষটার শক্ত, চউড়া, ঢেউ খেলানো বুকে মাথা না ঠেকালে।

--- কিরে কি ভাবছিস?

নীলিমার অকস্মাৎ ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়লো অরুর, ধ্যান ভেঙে গেলে অরু আস্তে করে ঘাড় ঘোরালো নীলিমার পানে,শ্যামা মেয়েটাকে আজ এই অফ হোয়াইট গাউনে চমৎকার লাগছে, কি সুন্দর গাউনের সাথে ম্যাচিং করে হেয়ার স্টাইল করেছে, পুরোই ডিজনি প্রিন্সেস সিনড্রেলা। অবশ্য নীলিমার এই পরিপাটি সাজগোজের পেছনো সায়রের অবদানই সবচেয়ে বেশি, কারণ আগে পরে যে কোনো পার্টি ফাংশনেই নিজের পার্সনাল স্টাইলিস্টকে দিয়ে নীলিমার ড্রেসআপ করায় সায়র, ওই জন্যই প্রত্যেকবারই চমৎকার লাগে নীলিমাকে, যেন কোন সর্গ পরী,পার্ফেক্শনের উর্ধে যা থাকে তাই হলো নীলিমা ।

--- আবার কি ভাবতে বসলি বলতো?

অরুর পাশের চেয়ারটাতে আয়েশ করে বসে কথাটা বললো নীলিমা।

অরুও এবার এগিয়ে গিয়ে নীলিমার পাশে বসলো। ডোরাকে আদর করতে করতে নীলিমাকে শুধালো ,

---- শুনলাম লন্ডন গিয়েছিলি? কেমন কাটলো ভ্যাকেশান?

নীলিমা ঠোঁট উল্টে জানালো,

--- সায়র শুটের কাজে বিজি ছিল খুব, সেভাবে ঘোরা হয়নি, তোদের কি খবর?

--- এই চলছে, বকুনি ঝকুনি আর পড়াশোনা।

নীলিমা নিঃশব্দে হাসলো, অতঃপর বললো,

---- তুই বলেই ক্রীতিক ভাইয়াকে সামলাতে পারিস, অন্য কেউ হলে নির্ঘাত মুখ চালাতে গিয়ে ওনার হাতে মা'র খেয়ে ভর্তা হয়ে যেত।

নীলিমার কথা শুনে অরু মৃদু হেসে ক্রীতিকের পানে চাইলো, যে এই মূহুর্তে হলের এককোনে দাঁড়িয়ে অতিথিদের সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত সময় পার করছে, পরনে ফুল ব্ল্যাক স্যুট তার, কানে লাগানো এয়ারপড,হাতের ঘড়ি এমনকি টাই'টা অবধি কালো রঙের । ক্রীতিকের চুল বড় হয়ে গিয়েছে এখন, সেই আগের মতো ঘাড় ছুঁই ছুঁই লম্বা চুল গুলো বেশ স্টাইল করে সেট করা, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো দিয়ে আবৃত গৌড় বর্ণের লোকটাকে দেখে সবার আড়ালে লাজুক হাসলো অরু, এই ভেবে লাজুক হাসলো যে, এই ড্যাশিং, হ্যান্ডসাম, হিরোদের মতো দেখতে ছেলেটা তার প্রতি কি ভীষণ ভাবে আসক্ত।গত সাত মাসে কতবার কত রকম ভাবেই না পা'গলামি করেছে তার জন্য। প্রয়োজনে শাসন করেছে, নিজের রাগ সংবরণ করতে না পারলে একটু অতিরিক্তই করেছে, তবে দিন শেষে ঠিকই অরুর রাগ ভাঙাতে উঠে পরে লেগেছে, নিজেকে যতটা অসহায় প্রমান করলে অরুর মন টলবে, ঠিক ততটাই দূর্বল হয়েছে সে। সেই সময়গুলোতে কোথায় যেন উবে যায় ক্রীতিকের ম্যানলি ইগো। পাছে এসে ভর করে আর্দশ স্বামী হওয়ার ভীষণ পায়তারা। তবে পুরো পৃথিবী সেই ভেতরের জায়ান ক্রীতিকটাকে আবিষ্কার করতে পারেনি কোনোকালেই,যা অরু পেরেছে। অরুকে যদি কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে, এই বদ মেজাজী, উগ্র লোকটার সাথে কি করে থাকো বলোতো? অরু তখন একগাল হেসে জবাব দেয়,

---- তোমরা যা জানোনা, তা কেবল আমিই জানি। কারণ আমি ওনার উগ্রতা নয় ভালোবাসার মাপকাঠিতে তলিয়ে আছি।যেখানে ওনার এক বুক ভালোবাসার রাজ্যে উগ্রতা নিছকই এক কীটপতঙ্গ মাত্র। ভালোবেসে সেটুকু ও সহ্য করতে না পারলে ভালোটা আর বাসলাম কই?

ক্রীতিকের দিকে সেই তখন থেকে শুকনো মুখে চেয়ে আছে দেখে নীলিমা অরুকে কনুই দিয়ে খোঁচা মে'রে এলিসাকে দেখিয়ে বললো,

--- তবে যাই বলিস না কেন, অনু আপা আর এলিসা আপু কিন্তু এগিয়ে গেলো আমাদের চেয়ে।

এলিসার ভরাট গুলুমুলু চেহারাটার দিকে চেয়ে আপসোসের সুরে অরু বলে ওঠে,

--- ঠিকই বলেছিস। ওরা সত্যিই লাকি।

অরুর আপসোস শুনে মনটা ভার হয়ে এলো নীলিমার, পরক্ষণেই বুদ্ধিমানদের মতো চট করেই নীলিমা বলে উঠলো,

---- বেবি নিলে কেমন হয় বলতো? আমিতো সায়র কে বললেই ও বেবি নেওয়ার জন্য লাফিয়ে উঠবে।

অরু মুখ কাঁচুমাচু করে ক্রীতিকের দিকে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- তুই তো চাইলেই পেয়ে যাবি, কিন্তু আমার যে অনুমতি নিতে হবে।

অরু যখন কথাগুলো বলছিল ঠিক তখনই স্টেজ থেকে বল নাচের ঘোষণা করলো ক্যাথলিন আর তার ফিয়ন্সে।

ঘোষনা শুনে সায়রের সঙ্গে বল নাচ করবে বলে তৎক্ষনাৎ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নীলিমা , আনন্দে আত্মহারা হয়ে খুশিতে করতালি দিয়ে নীলিমা যায়গা ছেড়ে উঠে গিয়েও পুনরায় ফিরে এসে, অরুর কানে কানে হিসহিসিয়ে বলে গেলো,

---- এই সুযোগে জিজুকে কনভিন্স করে ফেল, দেখবি নাচতে নাচতেই হ্যা বলে দেবে।

*****************************************

--- চলুন ডান্স করবো।

আচমকা সু'পরিচিত রিনরিনে আওয়াজটা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই কানের একটা এয়ারপড খুলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে পাশে তাকালো ক্রীতিক। দেখলো ওর দিকেই চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে অরু। অরুর এমন গদোগদো ভাবসাব দেখে হাসি পেলো ক্রীতিকের, তবে ও হাসলো না নিজেকে যথাসম্ভব সংবরণ করে, মুখের আদলে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে এক ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,

--- কাহিনী কি?

---কোনো কাহিনী নেই, চলুন তো সবাই নাচ করছে।

কোনো রকম জবাবদিহিতা ছাড়াই একপ্রকার টেনেটুনে ক্রীতিককে বল নাচের মঞ্চে নিয়ে গেলো অরু। এখানের পরিবেশটাই অন্যরকম, সবাই নিরিবিলি পার্টনারের সাথে কোমড় দোলাচ্ছে আর একটা হ্যাপি মোমেন্টের সাক্ষী হচ্ছে, এলিসাকেও খুব সাবধানে আঙুলের মাথায় ঘোরাচ্ছে অর্ণব।

তবে আজকের বল নাচের স্টেজে দাঁড়িয়ে হুট করেই সেই প্রথম দিনের কথা মনে পরে গেলো ক্রীতিকের । যখন ওর সামনের মেয়েটা স্বয়ং অরুই ছিল, কিন্তু মেয়েটার দু'চোখে ছিল অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার ছড়াছড়ি , ভীত হরিণীর মতো একরত্তি শরীর নিয়ে ক্রীতিকের বাহুতে সেদিন কুঁকড়ে ছিল অরু , আর শেষমেশ কিছু না বলেই হুট করে এক পায়ের নুপুর ফেলে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিল মেয়েটা।অথচ আজ মেয়েটার দু'চোখে রয়েছে নিদারুন চঞ্চলতা, নেই বিন্দু মাত্র সংশয়, আর নাতো আছে কোনোরূপ অনিশ্চয়তা। একরাশ খুশির পারদ যেন উপচে পরছে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা থেকে, যা চাইলেও টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে পারবে না ক্রীতিক। অগত্যাই অরুর খুশিতে খানিকটা ঢেউ তুলে দিয়ে, ওর কোমড় চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো হঠাৎ। অরু ভড়কালো না, বরং নিজের হাতটাকে তুলে রাখলো ক্রীতিকের কাঁধের উপর, তারপর শুরু করলো দুজন দুজনার সাথে গানের তালে পা মেলানো। ল্যাভেন্ডার কালারের গাউন সাথে স্মোকি আইশ্যাডো আর হালকা স্টোনের জুয়েলারিতে অরুকে মারাত্মক সুন্দর লাগছিল, ক্রীতিক কম্পলিমেন্ট দিতে জানেনা খুব একটা, তবুও আজ অরুর সব সংশয় কাটিয়ে দিতে ওকে ঘোরাতে ঘোরাতে হাস্কিস্বরে বলে উঠলো ,

--- তোকে অপরূপ লাগছে বেইবি।

অরু হাসলো সামান্য, তারপর আবারও চোখ রাখলো ক্রীতিকের কালো চোখের মনিতে ,মূহুর্তেই দুজন দু'জনার চোখে চোখ রেখে হারিয়ে গেলো গভীরে, চোখে চোখেই হাজারো কথা আদান প্রদান হলো ওদের বোধ করি। চারিদিকে প্রেম প্রেম সুগন্ধ, পৃথিবীর সকল চিন্তা ভুলে গিয়ে হুট করেই ক্রীতিকের মনে হচ্ছে, আশেপাশে এই চোখ জোড়া ছাড়া কিচ্ছু নেই। কোন মানুষ নেই, কোনো শব্দ নেই, কোন বস্তু নেই, কেউ নেই।

আছে শুধু দুইজোড়া তৃষ্ণার্থ চোখ, যার ঘোলাটে চাহনী দেখে মনে হয় একে অপরের দিকে জনম জনম তাকিয়ে থাকলেও সেই তৃষ্ণা মিটবে না কোনদিন, উল্টো দিনকে দিন বেড়েই যাবে তাকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। দুটো চোখ নেশার ঘোরে বুদ,তখনও পারিপার্শ্বিক সকল আওয়াজ ছাপিয়ে মিষ্টি একটা সুরেলা গলা কানে ভেসে এলো ওদের দুজনার, সেই গানে আরও একবার সবকিছুর উর্ধে গিয়ে মনের মাঝে ভালোবাসার হলকা জ্বলে উঠেছিল দুজনারই, খুব কাছেই কেউ একজন প্রান দিয়ে গাইছে,

i have died every day

waiting for you,

Darling don’t be afraid,

i have loved you,

For a thousand year's

I'll love you for a

Thousand year's......

ক্রীতিক যখন অরুর চোখের অতল গহ্বরের ডুবে যাচ্ছিল, ব্যস্ত হয়ে ওর চোখের মাঝে নিজের সত্তাটাকে খোজার আপ্রান চেষ্টা করছিল,ঠিক সেই মূহুর্তে সকল রোমান্টিকতায় একবালতি জল ঢেলে দিয়ে অরু ঠাস করেই বলে ওঠে,

--- আমার বাবু চাই।

অরুর এহেন আবদার শুনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো ক্রীতিকের, চোখে কয়েকবার পলক ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো ক্রীতিক,

---- কিহ, কি চাই?

অরু চোখের ইশারায় এলিসাকে দেখালো, যে এই মূহুর্তে ডিভানে বসে বসে পেস্ট্রি কেক খাচ্ছে। এলিসাকে এক ঝলক পরখ করে ক্রীতিক অরুর পানে তাকিয়ে বললো,

--- তো?

---- আমারও বাবু চাই।

অরুর কথার প্রত্যুত্তরে ক্রীতিক ভাবলেশহীন গলায় বললো,

---- হ্যা তোর তো বাবু আছেই, ডোরা না তোর মেয়ে?

ক্রীতিক ইচ্ছে করে কথা ঘোরাচ্ছে, তিল কে তাল বানাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেলে তেতে উঠলো অরু, বিরক্ত কন্ঠে বললো,

----এই বাবু সেই বাবু না, এলিসা আপুর মতো বাবু চাই আমার, আপার মতো বাবু চাই আমার।

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

--- বাবু কি হাতের মোয়া? যে চাইলেই পাওয়া যাবে?

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,

--- এনে দিন, আমি জানি আপনি সব পারেন।

ক্রীতিক অরুর কপালে আলতো চুমু খেয়ে জানালো,

--- এখন নয়, একটু বড় হ। ঠিক সময় মতো পেয়ে যাবি।

ক্রীতিকের কথার পাছে অরু রেগেমেগে কিছু বলবে তার আগেই অর্ণব আর সায়র এসে কি দরকারে যেন ডেকে নিয়ে গেলো ক্রীতিককে। যাওয়ার আগে পেছন ঘুরে অরুর উদ্দেশ্যে ক্রীতিক বললো,

--- এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না বেইবি,ওদিকে গিয়ে বস।স্টেজটা পিচ্ছিল, সামলাতে পারবি না।

ক্রীতিকের এতো কেয়ারিং এই মূহুর্তে আদিখ্যেতার মতোই বিরক্ত ঠেকলো অরুর নিকট। যার দরুন রাগে দুঃখে অরু একাই নাচতে শুরু করলো পা'গলের মতো, যদিও বা জীবনে প্রথমবার চার ইঞ্চি পেন্সিল হীল পরে নাচতে গিয়ে অরু জুত করতে পারলো না খুব একটা, কয়েক মিনিটের মাথাতেই ক্রীতিক যে ওকে এতোক্ষণ সামলে রেখেছিল তার হাতেনাতে প্রমান সরূপ পা মচকে পরে গেলো মেঝেতে ।

অরু এভাবে পরে গিয়েছে দেখে দ্রুত ছুটে এলো অনু, উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

--- কিরে এভাবে পরে গেলি কি করে? ব্যথা পেয়েছিস কোথাও ?

অরু মাথা তুলে অসহায় স্বরে বলে উঠলো,

--- পায়ে ভর দিতে পারছি না আপা, মনে হয়ে মচকে গিয়েছে।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শক্ত হাতে বোনকে তুলে একসাইডে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। অরু হঠাৎ হঠাৎ ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে ফেলছে, তা দেখে অনু বললো,

--- তুই বস, আমি এক্ষুনি বরফ ম্যানেজ করে নিয়ে আসছি, বরফ লাগালে ব্যথা কমবে আশা করি।

কথাটা বলে অরুকে বসিয়ে রেখে দ্রুত কোথাও একটা চলে গেলো অনু। ওদিকে অরু ব্যথা পেয়েছে শুনে কই থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো ক্রীতিক, আশেপাশে তখনও সবাই ছিল,কিন্তু ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে ওদের কে স্পেস দিয়ে যে যার মতো চলে গেলো সবাই।

--- কতবার বলেছি এসব হাই হীল পড়তে হবে না, তবুও জিদ ধরে পরলি, এখন ব্যথাটা কে পেলো শুনি? ইশ গোড়ালিটা কালচে হয়ে গিয়েছে একদম।

অরুর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে, ওর পা থেকে জুতো গুলো খুলতে খুলতেই রাগি গলায় অরুকে ধমকালো ক্রীতিক। কিন্তু অরুতো অরু, ও এখনো তখনকার ব্যাপারটা নিয়ে ঝুলে আছে, তাইতো অভিমানে ক্রীতিকের হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসলো চট করে। ওর কান্ডে ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,

--- কি হয়েছে?

অরুর সোজাসাপ্টা জবাব,

--- আমার বাবু চাই।

অরুর এহেন ছেলেমানুষী তে রাগ হলো ক্রীতিকের, কোনমতে নিজেকে সংবরণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

---- বলেছি না পরে।

--- না এক্ষুণি।

ক্রীতিক চেয়ার সমেত অরুর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে, গম্ভীর গলায় শুধালো,

--- বাচ্চা বাচ্চা যে করছিস, বয়স কত তোর? তুই নিজেই তো একটা বাচ্চা। একটা বাচ্চাকে বাচ্চা দিয়ে তারপর দুই বাচ্চাকে সামলাতে হবে আমার, আমি এসব রিস্কে নেই।

হ্যা, না কিছুই না বলে,মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে আছে অরু, তা দেখে ক্রীতিক ওকে একটু মানানোর চেষ্টা করে বললো,

---প্রেগন্যান্সীর জন্য একটা নূন্যতম বয়স লাগে বেইবি, নয়তো বাচ্চাকে সামলাবি কি করে? তাছাড়া তোর হেলথ কন্ডিশন বেবি নেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা সেটাও তো যাচাই-বাছাই করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা,

মাঝপথেই থেমে গেলো ক্রীতিক, অরু এবার আগ বাড়িয়ে শুধালো,

--- সবচেয়ে বড় কথা কি?

--- তোর ভালোবাসায় আমি কোনো ভাগিদার এলাউ করতে রাজি নই অরু।

অরু আশ্চর্য হয়ে গেলো ক্রীতিকের এহেন ছেলে মানুষী কথায়, ও আশ্চর্য কন্ঠেই বলে উঠলো ,

---- আপনি কি পাগল? বাচ্চাটা আপনার হবে, আর আপনি তাকে এখনই হিংসা করছেন?

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বললো,

---- যা বলেছি তাই।

অরুও যেন নাছোড়বান্দা, ও গাল ফুলিয়ে প্রত্যুত্তর করে জানালো,

---- না আমার বাবু চাই, চাই-ই চাই।

মেয়েটার ডানপিটে জিদের কাছে আরও একবার পরাজিত হয়ে হার মানার মতোই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ক্রীতিক, অতঃপর একহাতে অরুর জুতো আর অন্য হাতে অরুকে কোলে তুলে গভীর গলায় বললো,

---- ঠিকাছে বাসায় চল, দিচ্ছি তোকে বাচ্চা।

কথাটা বলে অরুকে নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল ক্রীতিক, তখনই পেছন থেকে অনু এসে দেখলো এই কাহিনি, ক্রীতিক অরুকে নিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে অনু বিড়বিড়িয়ে বললো,

---- আরেহ বরফ না লাগিয়েই কোথায় যাচ্ছে এরা?

প্রত্যয় পাশ থেকে অনুর কাঁধে হাত রেখে তীর্যক কন্ঠে বলে,

---- চিন্তা নেই, ক্রীতিক ভাই ঠিক সামলে নেবে অরুকে । তুমি এদিকে এসে একটু বসোতো, আজ অনেক নড়াচড়া করেছো এবার একটু রেস্ট করো।

প্রত্যয়ের কথায় অনু হাসি সংবরণ করতে না পেরে, মুখের উপর হাত রেখে বললো,

---- তুমি এমন ভাব করছো, যেন তোমার বাচ্চাটা কালকেই পৃথিবীতে চলে আসবে।

প্রত্যয় বোকাদের মতো মাথা চুলকে বললো,

--- কি করবো বলো? তর সইছে না তো।

ওদিকে ক্রীতিককে এভাবে চলে যেতে দেখে, সায়র হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠে শুধালো,

---- কিরে জেকে, পার্টি তো শেষ হয়নি, এখনই কোথায় যাচ্ছিস তোরা?

ক্রীতিক অরুকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে না ঘুরেই উত্তর দিলো,

---- বউকে বেস্ট গিফট দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে, তাই বাসায় যাচ্ছি।

ক্রীতিকের ঘুরানো প্যাচানো কথাটা প্রথমে ধরতে না পারলেও, যখন এর আসল মানে সায়রের ব্রেইনে ক্যাঁচ করলো, তখন আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলো না সায়র, দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নীলিমার হাত থেকে খাবার দাবার সব কেড়ে নিয়ে সাইডে রেখে বললো,

---- তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো, আই থিংক আমাদের বাসায় যাওয়া উচিৎ।

মুখ ভর্তি খাবার গুলো তাড়াহুড়ো চিবুতে চিবুতে নীলিমা বলে ওঠে,

--- কেন?

বড়সড় তান্ত্রিকদের মতো করে, কৌশলী কন্ঠে সায়র বললো,

--- জেকে কে এবার হারাতেই হবে আমায়, ব্যাটা সবকিছুতে ফাস্ট। এবার আর সেটা হতে দিচ্ছি না আমি। দ্রুত খাও জান, হারি আপ,বাসায় গিয়ে প্রসেসিং শুরু করতে হবে তো।

ওই হিটলার ব্যাটাকে আমার আগে কিছুতেই বাবা হতে দেওয়া যাবেনা, নেভার।

সায়রের কথার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকলো না বেচারী নীলিমার, তবুও মেয়েটা বাধ্য স্ত্রীর মতোই স্বামীর কথায় ব্যস্ত হয়ে পরলো মুখ ভর্তি খাবারকে দ্রুত গলধঃকরন করার কাজে।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#সারপ্রাইজ_পর্ব

বাইরে হালকা হালকা তুষার পাত হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরেই রোদের দেখা নেই,চোখের সামনে কাঁচের দেওয়াল গলিয়ে পেজা তুলোর মেঘের মতোন ঝরে পড়ছে শুভ্র বরফ কনা, বরফের আস্তরণে পুরো শহরতলী শুভ্রতায় ছেয়ে গিয়েছে, দেখলেই কেমন প্রান জুড়িয়ে আসে।

গেইটের সামনে চেরিব্লোসম গাছ দু'টো ন্যাড়া হয়ে পরে আছে,রঙিন ফুল তো দূরে থাক, তরতাজা সবুজ পাতার ছিটেফোঁটাও নেই তাতে, যতদূর চোখ যায় শুধু বরফের আস্তরণ।

ক্রীতিকের মাস্টার বেডরুমের বিশালাকৃতির জানালাটার পর্দা সরিয়ে বাইরের ফ্রন্ট ইয়ার্ডটায় একঝলক চোখ বুলিয়ে নিলো অরু, অতঃপর হাতে এক কাপ কফি নিয়ে, ফায়ারপ্লেসের পাস ঘেঁষে বসে পরলো গিয়ে জানালার মুখোমুখি হয়ে।

আজ সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছে ক্রীতিক, কি নাকি ক্লায়েন্ট ফ্লায়েন্ট এর সাথে দরকারি মিটিং রয়েছে, না গেলেই নয়।নয়তো অরুর বাবু পেটে আসার পর থেকে খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া স্ব'শরীরে অফিসে যায়না সে। বাড়িতে বসেই নিজ দ্বায়িত্ব গুলো বেশ নৈপুণ্যতার সহিত সামলে নেয়। যদি কখনো প্রয়োজন পরে তো প্রত্যয়ই বাড়ি বয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

সারাজীবন একা থাকতে পছন্দ করা ক্রীতিক গত দু’মাস ধরে দু'জন সার্ভেন্ট ও রেখেছে বাড়িতে, অরুর আন্ডার এইজ প্রেগন্যান্সি, ডক্টর বলেছে খুব সাবধানে থাকতে, মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা ও প্রকট, তাই রান্না বান্না থেকে ঘরের যাবতীয় কাজ, সবকিছু সার্ভেন্ট দ্বারাই করানো হয়। অনুর মিসক্যারেজের কথা চিন্তা করে অরু নিজেও বেশ ভয়ে থাকে এসব নিয়ে, তাই মন চাইলেও খুব বেশি একটা ধকল দেয় না নিজের শরীরকে। অবশ্য এই ক্রুটিপূর্ণ প্রেগন্যান্সির পেছনে মোক্ষম কারন রয়েছে। কারণটা আর কেউ নয় , স্বয়ং মাথা গরম, রগ চটা, বেপরোয়া ক্রীতিক নিজেই।

ক্রুটিপূর্ণ প্রেগন্যান্সির কথা ভাবতে গিয়েই ছয়মাস ধরে বেড়ে ওঠা নিজের ছোট্ট উদরে আলতো হাত ছোঁয়ালো অরু। মনে মনে ভাবতে লাগলো সেদিন সকালের কথা,

সেবার নেদারল্যান্ডের টিউলিপ গার্ডেনে ঘুরতে যেয়ে ভ্যাকেশনটা বেশ ভালোই কেটেছিল ওদের সবার।সায়র নীলিমা, অর্ণব এলিসা সহ মোট তিন জোড়া কাপল একসাথে যাওয়ায় টিউলিপ গার্ডেনের পাশেই একটা মস্তবড় ভিলা রেন্ট করেছিল ওরা, যেই ভিলাতে দু'তলার প্রত্যেকটা বারান্দা থেকে টিউলিপের বাগান স্পষ্ট দেখা যেত।

নেদারল্যান্ডস পৌঁছানোর পরে তিন চারটা দিন সবাই একসাথে ঘুরে ফিরে, হইহুল্লোর করে ভালোই আনন্দে কেটেছিল ওদের সবার। কিন্তু বিপত্তি ঘটে পাঁচ দিনের মাথায়, সেদিন হঠাৎ করেই ঘুম থেকে উঠে অরুকে পাশে পেলোনা ক্রীতিক। এমনটা সাধারনত কখনো হয়না,কারণ আড়মোড়া ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও, ওই শক্ত চওড়া বুকের মধ্যে ঢুকে খানিকটা সময় ধরে ওম না নিলে, মোটেই ভালো লাগেনা অরুর। অথচ আজ সে সকাল সকাল গায়েব।

আগের রাতে অনেক বেশি দেরি করে ঘুমাতে যাওয়ার দরুন ক্রীতিক ভেবেছিল হয়তো ওর নিজেরই ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়ে গিয়েছে, তাই অরু হয়তো আছে লিভিং রুমে কিংবা অন্য কোথাও। কিন্তু কিসের কি? পুরো ভিলাতে কোথাও অরু নেই।

শেষমেশ না পেরে দরজায় নক করে করে ওদের সবার ঘুম ভাঙিয়েছে ক্রীতিক। তবে ওরাও কোনো হদিস দিতে পারলো না অরুর। এমন একটা অচেনা দেশে, অচেনা যায়গায় এসে হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলো মেয়েটা? কোনো বিপদ আপদ হলোনা তো আবার? এক আকাশ পরিমান হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই একহাত দিয়ে নিজের চুল নিজেই খাঁমচে ধরলো ক্রীতিক। ওকে এভাবে উদ্বিগ্ন হতে দেখে এলিসা মানানোর স্বরে বলে,

--- শান্ত হ জেকে,ঠান্ডা মাথায় ঠিক করে ভাব কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? আচ্ছা ফোন করেছিলি নিশ্চয়ই?

এলিসার কথায় দাঁত দাঁত চাপে ক্রীতিক, অতঃপর বিরক্তির সুরে বলে,

--- ফোনটা নিয়ে গেলে তো করবো? ইডিয়েট একটা, আজ ওকে খুঁজে পেলে খবর আছে, আমি যে ওর কি হাল করবো নিজেও জানিনা।

ক্রীতিকের কথার মাঝে ওকে থামিয়ে দিয়ে, ওর দিকে টিস্যু বক্স এগিয়ে দিতে দিতে সায়র বললো,

---- তোর নোজ ব্লেডিং শুরু হয়েছে আবার।

ক্রীতিক এক টুকরো টিস্যু হাতে নিয়ে, সেটা দ্বারা নাক মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,

---- এই মেয়েটা আর আমাকে শান্তি দিলোনা। আমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে ওকে খুঁজে বের করতে করতে।

কথা শেষ করে টি টেবিল থেকে গাড়ির চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বাইরের দিকে হাটা ধরে ক্রীতিক, ওকে চলে যেতে দেখে অর্ণব উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে,

--- কোথায় যাচ্ছিস তুই একা একা? আমরা আসবো?

ক্রীতিক যেতে যেতে জবাব দেয়,

---- দরকার নেই, আসেপাশের টুরিস্ট এরিয়া গুলো একটু খুজে দেখে আসছি আমি, তারপরেও যদি না পাই, তো পুলিশের কমপ্লেইন করা ছাড়া আর উপায় দেখছি না।

ক্রীতিকের কথার পাছে অর্ণব পুনরায় বলে,

---- কিন্তু তোর তো নোজ ব্লেডিং হচ্ছে, কার ড্রাইভ করতে পারবি তো?

ক্রীতিক আর দাঁড়ায় না, ইতিমধ্যে ওর বুকের মধ্যে দাউদাউ করে অস্থিরতার আ'গুর ধরিয়ে দিয়েছে, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ও আর নিজেকে সামলাতে পারবে না, নির্ঘাত বুকের ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে মা'রা যাবে। তাই আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে তপ্তস্বরে জবাব দিলো ক্রীতিক,

---- পারবো।

*****************************************

সারাটা দিন হন্যে হয়ে এদিক সেদিক খুঁজেও লাভ হলোনা কোনো। ক্রীতিক ধারণা করেছিল অরু হয়তো বা পাকামি করে একা একাই কোনো টিউলিপ গার্ডেনে ঢুকে পরেছে, কিন্তু তেমন কিছুই নয়। অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে একরাশ বিষন্নতা আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পুনরায় ভিলাতে ফিরে এলো ক্রীতিক, উদ্দেশ্য ফোন করে পুলিশ কে জানানো, তারা যদি কোনো সোর্স এর মাধ্যমে খুঁজে দিতে পারে ওর হৃদস্পদন কে।

তখন তাড়াহুড়োয় ফোনটাও নিয়ে বের হতে পারেনি,তাই আবারও ভিলাতেই ফিরতে হলো ক্রীতিক কে। ক্রীতিক যখন চোখ বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘরের দুয়ারে পা রাখে, ভেতরে গিয়ে সবার একেক করে নানান প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, সেই ভেবে যখন ওর বক্ষপিঞ্জর ব্যথায় টনটন করে ওঠে, ঠিক তখনই ভেতর থেকে ভেসে আসে এলিসার ধমকা ধমকির আওয়াজ, কাউকে উদ্দেশ্য করে একটু রাগান্বিত স্বরেই এলিসা বলছে,

---- কোথায় গিয়েছিলে তুমি? সারাটা দিন একটা খোঁজ নেই খবর নেই, জেকে টা উদভ্রান্তের মতো খুঁজে বেরিয়েছে তোমায়, কি জানি হয়তো পুলিশেও কল করে দিয়েছে এতোক্ষণে, আজ ও ভিলাতে ফিরলে তোমার সাথে কি হবে ভাবতে পারছো?

এতোটুকু শোনা মাত্রই ক্রীতিকের কৌশলী মস্তিষ্কটা সচল হয়ে উঠলো, কারও উপর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলো মূহুর্তেই, মাথার মধ্যে ভলভলিয়ে বেড়ে ওঠা তীব্র ক্রোধটাকে ক্রীতিক সামলালো না মোটেই, বরং দু'হাত মুঠি বদ্ধ করে হনহনিয়ে ভেতরে গিয়ে বাজপাখির মতো ছো মে'রে শক্ত হাতে চেপে ধরলো অরুর চোয়াল, ক্রীতিকের হাতের বাঁধন এতোটাই শক্ত যে অরুর মনে হচ্ছিল এক্ষুনি গালের হাড় হাড্ডি সব গুড়ো গুড়ো হয়ে ভেঙে যাবে।

--- আমাকে না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলি বল?

দাঁতে দাঁত পিষে অরুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছোড়ে ক্রীতিক।

ক্রীতিকের এমন ক্ষ্যাপাটে সিংহের মতো আচরনে ভড়কে যায় সবাই , নীলিমা ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে সায়রের শার্ট খামচে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,

---- ভাইয়াকে থামাও, অরুকে তো মে'রেই ফেলবে আজ।

সায়র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, অতঃপর নীলিমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড়ালো,

---- কিছুই করবে না।

ক্রীতিক চক্ষু গরম করে অরুকে ভস্ম করে দিতে চাইলো, সেভাবেই ক্ষুদ্ধ কন্ঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

--- কোথায় গিয়েছিলি জবাব দে?তোকে না পেলে আমি যে কুত্তার মতো তোকে খোঁজার জন্য পুরো শহর চষে বেড়াবো সেই হুঁশ ছিলনা তোর ব্রেইনে? আন্সার মি!

গর্জে উঠলো ক্রীতিক, ওর এহেন কঠোর ধমকে কম্পিত হয়ে উঠলো অরু, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো ,

--- আআমি তো একটু বড় টিউলিপ গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম চলে আসবো তাড়াতাড়ি, কিন্তু গাড়ি পাইনি একটাও।

--- এইইই! কাকে মিথ্যে গল্প শোনাচ্ছিস তুই? শহরের এমন কোন টিউলিপ গার্ডেন নেই যেখানে আমি তোকে পাগ'লের মতো খুঁজিনি, আর তুই এখানে আমাকে বানিয়ে বানিয়ে উপন্যাসের ডায়লগ শোনাচ্ছিস? কলিজায় ভয় নেই?

এই পর্যায়ে গর্জে উঠে অরুর বুকের কাছের জামাটা খামচে ধরে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো ক্রীতিক।

অরুর মিথ্যে জবাবে ক্রীতিকের রাগের পারদ দিগুণ তালে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, এবার এলিসা এগিয়ে এসে ক্রীতিকের হাতটা টেনে হিঁচড়ে ছাড়ালো অরুর থেকে। অতঃপর ক্রন্দনরত অরুকে নিজের বাহুতে টেনে নিয়ে বললো,

--- অনেক হয়েছে জেকে, আজকের মতো ছেড়ে দে মেয়েটাকে, কাল না হয় ঠান্ডা মাথায় শুনিস সবকিছু।

ক্রীতিক ক্রুদ্ধস্বরে বললো,

--- ওকে সাফসাফ উত্তর দিতে বল এলিসা,ও সারাদিন কোথায় গিয়েছিল, নয়তো আজ আর ওকে ছাড়াছাড়ি নেই, আমি ওর সাথে যা ইচ্ছে হয় তাই করবো আজ।

এলিসা আর অরু কে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো না ক্রীতিকের সম্মুখে , বরং তাড়াহুড়ো করে অরু সমেত চলে গেলো নিজের বেডরুমে।

*

তখন গভীর রাত, সন্ধ্যা রাতে অরু ক্রীতিকের ঝামেলার দরুন, পুরো ভিলা এখন শুনশান নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, অন্য কোনো দিন হলে হয়তো এখনো সবাই লিভিং এ বসে আড্ডা আনন্দে মেতে থাকতো। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি, খানিক বাদে বাদেই রাতের আঁধারকে সঙ্গ দিতে লেকের পার থেকে ভেসে আসছে কোলাব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আওয়াজ। সেই সাথে টিউলিপের বাগান থেকে ধেয়ে আসা রাতজাগা পাখিদের ডানা ঝাপ্টানোর শব্দে গভীর ঘুমে কাঁদা হয়ে আছে সকলে। ঠিক এমন সময় অর্ণবের গভীর আরামদায়ক ঘুমের ইস্তফা দিয়ে ওর মুঠোফোনটা বেজে উঠল তার স্বরে।

এতো রাতে এই ফোনের আওয়াজ বড্ড বিরক্ত ঠেকলো অর্ণবের কানে, অগত্যাই ফোনটা কেটে দিয়ে পাশ ঘুরে শুয়ে পরলো অর্ণব। কিন্তু ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটির বোধ হয় এই প্রত্যখ্যান সহ্য হলোনা মোটেই, যার দরুন আবারও ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল মোবাইলটা। এবার আর উপায়ন্তর না পেয়ে ঘুমু ঘুমু চোখে মোবাইল রিসিভ করে কানে ধরলো অর্ণব, তবে এপাশ থেকে কিছু বলার ফুরসত না দিয়ে ওপাশ থেকে বিরক্তির স্বর ভেসে এলো ক্রীতিকের, সে দাঁত কটমটিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠলো ,

--- শালা ফোন তুলছিস না কেন? ম'রে গেছিস?

অর্ণব চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুলে বললো,

---- ম'রিনি, তবে তুই কেন অন্য রুম থেকে বারবার কল দিয়ে আমার হা'র্টঅ্যাটাকের বন্দোবস্ত করছিস সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না?

ক্রীতিক ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললো,

---- আমার বউ কই?

--- লাইক সিরিয়াসলি জেকে? তোর বউ কই সেটা জানার জন্য তুই আমায় মাঝরাতে কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিস?

ক্রীতিক দমলো না, নতুন উদ্যমে গম্ভীর গলায় বললো,

--- তোর বউ তখন আমার বউকে বগলদাবা করে রুমে নিয়ে গিয়েছে, এখন দিয়ে যেতে বল, বউ ছাড়া আমার ঘুম আসেনা।

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায় সুরে ক্রীতিককে মানানোর চেষ্টা করে বললো,

---- ভাই বিশ্বাস কর, এতো রাতে এলির ঘুম ভাঙালে ও নির্ঘাত আমায় উষ্ঠা মে'রে ইউ এস এ পাঠিয়ে দেবে।

---- তাহলে ট্রিক্স খাটা।

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধালো,

---- ট্রিক্স খাটাবো মানে?

ক্রীতিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

--- মানে আবার কি? তুই এই মূহুর্তে এলিসাকে কল করে বলবি, তোর প্রচন্ড পেট ব্যথা করছে, ঘরে বাইরে শুরু হয়ে গিয়েছে, এক্ষুনি হসপিটালে না গেলে বাইরে যাওয়ার আর উপায় থাকবে না,ঘরেই শুরু করতে হবে।

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব নাকটা সিকোয় তুলে বলে ওঠে,

--- ইউউ, এসব বলবো? ভাই এসব আমি বলতে পারবো না, তুই প্লিজ আজকে রাতটা একটু নিজেকে সামলা, কাল ভোর হলেই তোর বউকে আমি নিজে তোর হাতে তুলে দিয়ে আসবো।প্লিজ ভাই।

অর্ণবের কন্ঠে ভীষণ আকুতি, অথচ ক্রীতিক তাতে দু'পয়াসার আবেগ না ঢেলেই কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,

---- যা বলেছি চুপচাপ তাই কর, নয়তো কাল এলিসা নয় আমি নিজেই তোকে কিক মে'রে ইউ এস এ পাঠিয়ে দেবো।

এরপর অর্ণব আর কিছু বলতে গিয়েও পারলো না, কারণ কথা বলার আগেই পিক পিক আওয়াজ করে লাইন কেটে দেয় ক্রীতিক।

অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে উপায়ন্তর না পেয়ে বুকে মাথায় ক্রুশ একে এলিসার নাম্বারে কলটা করেই ফেললো অর্ণব।

*****************************************

গভীর রাত, ঘুমে তলিয়ে আছে পুরো শহর,অত্যাধুনিক ভিলার প্রত্যেকটা জানালা হাট করে খুলে রাখা হয়েছে, সেখান থেকেই বইতে থাকা ঝিরিঝিরি হিমেল হাওয়ায় ঘুমটা গাঢ় হয়ে উঠেছে অরুর, ঠিক এমন হয় তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হতেই ধীরে ধীরে কিছুটা তন্দ্রা কেটে গেলো ওর। ঘুমের মাঝেই মনে হতে লাগলো ও হাওয়ায় ভাসছে।

প্রচন্ড হাওয়ার তোড়ে লম্বা চুল উড়ে এসে আঁচড়ে পরছে চোখে মুখে। কিন্তু ঘুমের মাঝে এমন অদ্ভুত অনুভূতি হওয়ার কারণ টা কি? এটা কি স্বপ্ন? কথাগুলো মস্তিষ্কে ক্যাচ করতেই অকস্মাৎ চোখ খুলে ধরফরিয়ে উঠলো অরু।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে লাফিয়ে ওঠায় কোথাও একটা থেকে পরে যেতে গিয়েও পরলো না ও, কারণ কেউ একজন দৃঢ় হাতে সামলে রেখেছে ওকে। ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেলো এবার, অরু চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওকে কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিক। অন্ধকারের মাঝেও ক্রীতিকের উপস্থিতি টের পাওয়ার মতো ক্ষমতা অরুর আছে, কিন্তু এভাবে ঘুমের মধ্যে অ'পহরণ করে তুলে নিয়ে যাওয়ার মানেটা কি? কেন যেন বিরক্তিতে শরীরটা চিড়বিড়িয়ে উঠলো অরুর, ক্রীতিক সবসময় বাড়াবাড়ি করে। তাই অরু এবার ধাতস্থ হয়ে ক্রীতিককে কয়েকটা কড়া কথা শোনানোর প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তার আগেই ওকে রুমে এনে বিছানায় ছু'ড়ে মা'রে ক্রীতিক। অরুকে বিছানায় রেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা জানালা গুলো লাগিয়ে দিতে দিতে কঠিন স্বরে বলে,

--- কোথায় ছিলি সারাদিন সত্যি করে বল অরু।

ব্যাস, এক বলেই ছক্কা হাঁকালো ক্রীতিক, যার ফলসরূপ অরুর সব হাওয়া ফুঁসস। অরু ভেবেছিল ক্রীতিক হয়তো ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছে এতোক্ষণে, এখন হয়তো একান্তে অরুর সঙ্গ চায় বলেই এভাবে তুলে নিয়ে এসেছে ওকে। কিন্তু না, এটা তো জায়ান ক্রীতিক, ওভার পসেসিভ, ওভার রিয়েক্টিভ। তার কাছ থেকে ছাড় পাওয়া কি এতোই সহজ?

অরু ভাবছে দেখে ক্রীতিক আবারও এগিয়ে এসে অরুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়, অতঃপর রাশভারি আওয়াজে শুধায়,

---- কি হলো, এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে এতো সময় লাগছে কেন? আমি কি খুব কঠিন প্রশ্ন করেছি?

অরু ভড়কালো, সামান্য তোতলানোর সুরে বললো,

--- দদেখুন প্রত্যেকেরই তো এইটুকুনি প্রাইভেসির প্রয়োজন তাই না? তাছাড়া আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি।

অরুর কথায় সন্তুষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ক্রীতিকের দৃষ্টিতে অগ্নিস্ফুলিং ফুটে উঠলো মূহুর্তেই। তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত হয়ে ব্লেডের মতো ধারালো হয়ে উঠলো যেন, সে এগিয়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চকচকে হ্যা'ন্ডকাফ্ বের করতে করতে বললো,

---- তোর মাঝে এমন কি আছে? যা আমার অজানা অরু?কি এমন প্রাইভেসি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, যা আমি উন্মুক্ত করিনি? চল দেখবো আজ।

ক্রীতিকের গতিবিধি পরখ করে অরু এবার ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতে ক্রীতিককে মানানোর চেষ্টা করে কিছুটা আত'ঙ্কিত সুরে বললো,

---- এমনটা করোনা প্লিজ, এটা মোটেই উচিত হবে না, খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে।

অরুর তুলতুলে নরম গালে পরম আবেশে হাত বুলিয়ে, হাস্কিস্বরে ক্রীতিক বলে,

---- আই হ্যাভ প্রোপার রাইট টু মেকিং লাভ উইথ ইউ বেইবি, এখানে অন্যায় কোথায় দেখলি? আমাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা ভুলেও করিস না।

ক্রীতিকের কথার টোনে হু'মকি সুস্পষ্ট, কিন্তু অরু তাও বাঁধা দিচ্ছে ওকে। বারবার বলছে,

---- প্লিজ এভাবে না, এটা ঠিক হচ্ছে না।

ক্রীতিক সেসবের তোয়াক্কা না করে অরুর হাতদুটো আটকে ফেললো হ্যা'ন্ডকাফ্, অতঃপর ওর কান্না থামাতে মুখে লাগিয়ে দেয় এক টুকরো ডাকট্ টেপ। এবার অরু পুরোপুরি ক্রীতিকের বশে, ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই অরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বললো,

--- তোর ভালোর জন্য বেঁধেছি, কারণ আজকে যতক্ষণ না সত্যিটা বলবি, ততক্ষণে আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই । বি রেডি ফর ইওর হার্ড পা'নিশমেন্ট বেইবি।

অরুর মুখ বাঁধা, তাই ও কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো শুধু, যার অর্থ,

--- এটা করবেন না প্লিজ।

তবে ক্রীতিক আর অপেক্ষা করে না, নিজের সবটুকু আকর্ষন, উন্মাদনা অরুর মাঝে বিলিয়ে দিয়ে ডুবে যায় ভালোবাসার অতল গহ্বরে।

*

অবশেষে ক্রীতিকের দেওয়া অতিরিক্ত ভালোবাসাময় য'ন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে শেষ রাতে অকস্মাৎ নিস্তেজ হয়ে পরলো অরু। অরু জ্ঞান হারিয়েছে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ক্রীতিকের যেন ভ্রম কেটে যায়। নিজের মাঝের পৈচাশিক আর ডমিনেটিং ভাব উবে গিয়ে মূহুর্তেই চোখে মুখে ঝরঝরিয়ে নেমে আসে একরাশ কাতরতা। সেই কাতর স্বরেই অরুর গালটা আলতো ঝাঁকিয়ে ডেকে ওঠে ক্রীতিক,

---- বেইবি, আর ইউ ওকে না? খুব বেশি ব্যথা দিয়েছি?

অরু জবাব দেয় না, তা দেখে ক্রীতিকের পিলে চমকে গেলো, এমনটা তো কখনো হয়না, ক্রীতিকের বরাবরই ওয়াইল্ড লাভ, লাভ ট'র্চার এসব বেশ পছন্দ। ব্যাপারগুলো ক্রীতিকের নিকট রোমাঞ্চকর বলে অরুও মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় সবটা। কিন্তু এমনটা তো কখনো হয়না। এর আগেও বহুবার এভাবে মিলিত হয়েছে তারা,কিন্তু অরু আজ প্রথম বারই জ্ঞান হারালো, কিন্তু কেন?

হাজারও অযথা চিন্তাদের বহর একসাথে ঘীরে ধরেছে ক্রীতিকের মন মস্তিষ্ক, কিন্তু এখন চিন্তা করার সময় নয়, যত দ্রুত সম্ভব অরুর জ্ঞান ফেরাতে হবে, সেই ভেবে ক্রীতিক নিজেদের মাঝের বস্রটুকু ঠিকঠাক করে তাড়াহুড়ো পায়ে উঠে গিয়ে অরুর হাত মুখ সব খুলে দিলো। এরপর অরুকে ছোট বাচ্চার মতো করে কোলের মধ্যে নিয়ে ঠান্ডা পানির ছাট দিতে লাগলো ওর চোখে মুখে।

খুব বেশিক্ষণ নয়, মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাবধানেই অরুর চেতনা ফিরে এলো, অরু চোখ খুলেছে দেখে ওকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে, চোখ দু'টো বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো ক্রীতিক। ওদিকে চেতনা ফিরতেই প্রচন্ড ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ক্রীতিকের থেকে ছিটকে দূরে সরে যায় অরু। অরু এভাবে দূরে সরে গিয়েছে দেখে, ক্রীতিক অপ'রাধী গলায় বললো,

--- বেইবি আস্তে, তুই উইক।

অরু নাক টেনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো এবার, কাঁদতে কাঁদতে বললো,

--- আপনি একটা জা'নোয়ার, আপনার জন্যই আমি উইক, এখন আবার দরদ দেখাচ্ছেন কোন মুখে?

অরুর আপসোসের কান্নায় হৃদয় ছিড়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের, ও এগিয়ে গিয়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরে বললো,

---- আ'ম সরি হার্টবিট, আমি বুঝতে পারিনি তুই এভাবে হঠাৎ করেই জ্ঞান হারাবি, তোর শরীরটা দূর্বল জানলে আমি কখনোই এমনটা করতাম না, আর হুট করে ব্লেডিং....

ক্রীতিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অরু, কাঁদতে কাঁদতে দু'হাতে ক্রীতিকের চুল খামচে ধরে বললো,

---- আমার বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে, আমি তোকে ছাড়বো না জায়ান।

অরুর কথা শুনে ক্রীতিকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো, এসবের মাঝে বাচ্চা আবার কোথা থেকে এলো? অরুর পানে একটা আহত চাহনি নিক্ষেপ করে, ক্রীতিক বলে ওঠে,

--- বাচ্চা মানে?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,

--- বেশ কয়েকবার টেস্ট করেও বারবার পজিটিভ রেজাল্ট আসছিল, তাই পুরোপুরি সিওর হতে ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম।

অরুর কথায় ক্রীতিকের চোখ কপালে উঠে গেলো, অরু প্রেগন্যান্ট তার মানে বাচ্চাটা ওর নিজের, এটা ভাবতেই, অরুর দু'বাহু ঝাঁকিয়ে ক্রীতিক দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠে,

---- তো আমাকে বললি না কেন ইডিয়েট? সারাদিন তোকে পা'গলের মতো খুঁজেছি আমি, এই অচেনা শহরে এমন কোনো টুরিস্ট এরিয়া নেই যেখানে আমি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরাইনি। আর তুই কিনা ডক্টরের ক্লিনিকে ছিলি?

জবাবে কাঁদতে কাঁদতে অরু বলে,

---- আপনি বাচ্চা চাচ্ছিলেন না কিছুতেই , কিন্তু এটা এসে গিয়েছিল কোনোভাবে, ভয় করছিল যদি আপনি এ্যাবরশন করার জন্য জোর করেন, তাহলে আমার বাচ্চাটার কি হতো? তাই চুপি চুপি গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি চলেও আসবো কিন্তু, কি জানি কেন, আসার পথে একটাও গাড়ি পাচ্ছিলাম না।

অরুর এতোসব কথা শুনে নিজের চুল নিজেই টেনে ধরলো ক্রীতিক,অরুর উপর চরম বিরক্ত হয়ে ক্রীতিক রাশভারী গলায় বললো,

--- তুই কি পা'গল অরু? নিজের অনাগত বাচ্চাকে কেন আমি নষ্ট করতে বলবো? হোয়াই? এটা তুই ভাবলি কি করে, সেটা আমায় বল?

--- তাহলে কেন করলেন এটা বলুন?

অরুর প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক রেগেমেগে বলে,

---- আমি কি জানতাম ইডিয়েট?

ক্রীতিকের কথায় ঝাঁজিয়ে ওঠে অরু, কাঁদতে কাঁদতে আহত সুরে বললো,

---- বাচ্চাটা মনে হয়না আর টিকবে।

--- টিকবে না মানে? এক্ষুনি ডক্টরের কাছে যাবো আমরা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, জাস্ট ফাইব মিনিটস বেইবি।

অরু হকচকিয়ে উঠে বললো,

--- কিন্তু এখনো তো সকাল হয়নি, এই সময় ডক্টর কোথায়?

অরুর বাক্যটুকু শেষ হওয়ার আগেই ক্রীতিক ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,

---- সেটা তোর না ভাবলেও চলবে।

*****************************************

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আজ সবার প্রথমে ডাইনিং এ হাজির হয় সায়র আর নীলিমা। সায়র আগে আগে ছিল আর নীলিমা পেছনে। ও যখন হাই তুলতে তুলতে ডাইনিং এর দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই নজরে পরে ক্রীতিক আর অরুকে। সাধারণত ভ্যাকেশনে আসার পর থেকে ক্রীতিক আর অরুই একমাত্র জুটি যারা সবার শেষে ডাইনিং এ হাজির হতো। ক্রীতিক নিজে বেলা করে ঘুমাতো দেখে, অরুকেও জোরজবরদস্তি করে নিজের কাছে আটকে রাখতো। অথচ আজ সূর্য একেবারে পশ্চিম আকাশে উদয় হওয়ার মতোই অরু ক্রীতিক সবার আগে ডাইনিং এ। শুধু ডাইনিং এ বললে ভুল হবে, অরুকে পাশে বসিয়ে রেখে ক্রীতিক নিজ হাতে ফ্রুটস খাওয়াচ্ছে ওকে, ব্যাপারটা পুরোপুরি সন্দেহজনক। তাই ডাইনিং এ এসে বসতে বসতে সায়র শুধালো ,

---- সূর্য আজ কোন আকাশে উদয় হলো জেকে? কাল রাতেই দেখলাম বউ কে ধমকাচ্ছিস, আর এখন পাশে বসিয়ে ফ্রুটস খাওয়াচ্ছিস? বাহ বাহ।

সায়রের কথার বিপরীতে ওর দিকে গরম চাহনি নিক্ষেপ করে, ক্রীতিক ক্ষুব্ধ গলায় বলে,

--- শাট আপ, idiot. শী ইজ প্রেগন্যান্ট উইথ মাই বেইবি।

ক্রীতিকের কথায় শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো লিভিং রুম, কারও মুখে কোনো রা নেই, কেবলই চামচ নাড়ার টুংটাং আওয়াজ। এমতাবস্থায় ফট করেই অরুর নিকট এগিয়ে গিয়ে নীলিমা বেকুবের মতো বলে ওঠে ,

---- কিরে অরু, তুই না বলেছিলি ক্রীতিক ভাইয়া বাচ্চা নিতে মোটেই ইচ্ছুক নয় তাহলে হলো টা কি করে?

অরু গাল ভর্তি ফ্রুটস চিবুতে চিবুতে জবাব দিলো,

--- ভুল করে।

অরু কথাটা বলতেই ঠোঁট টিপে কৌতুক মিশ্রিত হাসি হাসলো সায়র, হাসতে হাসতে ক্রীতিককে উদ্দেশ্য করে সায়র বললো,

--- তুই আজকাল এসবেও ভুল করিস ভাই?

ক্রীতিক জবাব দিলো না, উল্টো নিজের মাথামোটা বউটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরু পাপ্পি আইস করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের পানে, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা সে। সায়র ক্রীতিককে খোঁচা মে'রে আরও দু'একটা কথা শোনাবে, তার আগেই ওদের মাঝে আগমন ঘটে অর্ণব আর এলিসার।

এলিসার কাঁধে ভর করে মুমূর্ষু রোগীর মতো হাটছে অর্ণব, ওকে এভাবে হাটতে দেখে সায়র উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে,

---- কি হয়েছে তোর অর্ণব?

অর্ণব কিছু বললো না, এলিসা জবাব দিলো,

--- কি জানি কি স্ট্রিট ফুড খেয়ে, ডিসিন্ট্রি বাঁধিয়েছে, কাল থেকে কতবার গিয়েছে তার হিসেব নেই, তাই রাতেই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম।

পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে সায়র বলে,

--- কি বলিস , আমাদের কেন জানালি না? রাস্তা ঘাটে কোথাও কাজ সারেনি তো আবার?

অর্ণব দাঁত কটমটিয়ে সায়রের পানে অগ্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

---- শালা বেশি কথা বলিস তুই।

অর্ণবের ঝাড়ি খেয়ে থামলো সায়র, এবার অর্ণবের চোখ গেলো ক্রীতিক আর অরুর দিকে, ওদের পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা মাত্রই এলিসার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো অর্ণব, ওকে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে এলিসা ঠোঁট উল্টে শুধালো,

--- কি ব্যাপার এতোক্ষণ তো হাঁটতেই পারছিলি না, এখন ওমন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলি যে, ক্লান্ত লাগছে না?

কাঁধ ঝেড়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে অর্ণব বললো,

--- নাহ এখন ঠিক আছি, আয় জান তুই ও আমার পাশে এসে বস, কাল থেকে বড্ড খাটুনি গিয়েছে তোর।

সায়র খেতে খেতে অবাক দৃষ্টিতে অর্ণবকে পরখ করে বললো,

---- কি অদ্ভুত ডিসিন্ট্রি রে বাবা, এইটুকুর মধ্যে সেরে গেলো?

সায়রের কথার জবাবে অর্ণব কথা ছুড়বে, তার আগেই অরুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো ক্রীতিক।

সায়র ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রীতিকের পানে চেয়ে শুধালো,

--- তুই আবার বউ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

সায়রের কথার জবাব না দিয়ে, ক্রীতিক ওদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো,

--- আমরা আগামী কাল তোদের সাথে ইউ এস এ ফিরছি না, ডক্টর অরুকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেছে, এই মূহুর্তে জার্নি করা পসিবল নয়। তাই আমরা আর কিছুদিন পরে ফিরবো।

কথা শেষ করে অরু সমেত রুমের দিকে পা বাড়ায় ক্রীতিক।

এদিকে সায়রের সব খটকা থেকেই যায়, ও খাবার চিবুতে চিবুতে একা একাই বিড়বিড়ায়,

--- অদ্ভুত তো, আমার বউকে তো ডক্টর বেড রেস্টে থাকতে বললো না,অথচ ওর বউকে বললো। কালকেই গিয়ে ডক্টর ব্যাটাকে ধরতে হবে।

*****************************************

বিগত দিন গুলোর কথা ভেবে আরও একবার প্রানোচ্ছ্বল হাসি হাসলো অরু। ঠিক সেসময় দরজার পাসওয়ার্ড খোলার পিক পিক আওয়াজ হলো নিচ তলা থেকে, বোধ হয় ক্রীতিক এসেছে,সেই ভেবে তাড়াহুড়ো করে আবারও কম্ফোর্টারের নিচে গিয়ে ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো অরু।

উদ্দেশ্য একটাই, তার শক্ত চওড়া উষ্ণ বুকে মুখ লুকিয়ে একটু খানি আবেশিত ওম গ্রহন করা। তার মাতাল মাতাল স্যান্ডাল উড পারফিউমের গন্ধটা নিজের সর্বাঙ্গে ধারণ করা। এই ছোট্ট জীবনে প্রাপ্তির ঝুড়ি পরিপূর্ণ, আর কিইবা চাই?

........................................................................

𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃

Episodes
1 List of stories...
2
3 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43 এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44 এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45 এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46 এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47 এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48 এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49 এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50 এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51 এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52 এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53 এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54 এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55 এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56 এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57 এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58 এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59 এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60 এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62 ইট পাটকেল [Part.1]
Episodes

Updated 62 Episodes

1
List of stories...
2
3
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43
এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44
এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45
এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46
এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47
এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48
এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49
এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50
এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51
এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52
এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53
এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54
এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55
এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56
এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57
এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58
এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59
এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60
এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62
ইট পাটকেল [Part.1]

Download

Like this story? Download the app to keep your reading history.
Download

Bonus

New users downloading the APP can read 10 episodes for free

Receive
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download MangaToon APP on App Store and Google Play