#পর্বঃ২০
নিশুতিরাতে জোয়ার ভাঁটার উদ্যম গতি আর সামুদ্রিক ঢেউয়ের বিশাল গর্জনে চারিদিক অপার্থিব লাগছে। মাঝরাতের পরও কেটে গিয়েছে আরও কয়েক প্রহর। রাত জাগা পানকৌড়ি গুলো এখনো চিঁউচিঁউ করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বেলাভূমি জুড়ে। চোখের সামনে জ্বলছে ফায়ারপ্লেসের দাউদাউ অ'গ্নিশিখা, সেথা থেকেই কাঠকয়লা পো'ড়ানো মটমট আওয়াজ ভেসে আসছে। ক্রীতিকের ভাসা ভাসা চোখ দুটোতে জলন্ত অ'গ্নিশিখার প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান। সায়র ফায়ারপ্লেসের আ'গুনে আরও কয়েকটা কাঠের টুকরো দিয়ে ক্রীতিক আর অর্ণবের মুখোমুখি হয়ে বসে পরলো। অতঃপর নিজেদের মনের হাজারো কৌতুহল মেটাতে সায়র যখন ক্রীতিককে কিছু প্রশ্ন করতে যাবে, ঠিক তখনই অর্নব ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বোঝায়,
--- আমি জিজ্ঞেস করছি।
ক্রীতিক তখনও আপন মনে জ্বলন্ত অ'গ্নিশিখার হেলদোল পরখ করায় ব্যাস্ত। অর্নব ওকে ডেকে বলে,
--- সবাইকে রেখে অরুর প্রতিই এতো অবসেশট কেন তুই?
ক্রীতিক নিস্প্রভ চোখে জবাব দেয়,
--- আই ডোন্ট নো!
অর্নব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
--- আচ্ছা কবে থেকে এসব শুরু হয়েছে সেটা তো বল? তাছারা ওর জন্যে যদি তোর এতোই টান তাহলে বাংলাদেশে যাসনা কেন তুই?
ক্রীতিক একটু উপহাস করে হেঁসে বললো,
--- কে বলেছে ওর জন্য আমার টান? ও আমার আসক্তি। মানুষ জানে নে'শা খারাপ জিনিস, তবুও নে'শাগ্রস্থরা নে'শা ছাড়তে পারেনা, অরুও আমার কাছে নে'শার মতোই , আমি জানি ওর আমার সম্পর্কে আগুন পানি সম জটিলতা তবুও ওকে আমার চাই।এট এনি কস্ট।
সায়র পাশ থেকে বলে ওঠে,
--- তাহলেতো তুই অরুর প্রেমে পরেছিস।
ক্রীতিক কপট হেসে জবাব দেয়,
--- এগারো বছরের বাচ্চা মেয়ের প্রেমে কে পরে ভাই?তবে হ্যা,আ'ম সিওর, আমি বাংলাদেশে থাকলে এতোদিনে অরু আমার বাচ্চার মা হয়ে যেতো । ওই জন্যই তো দেশে যেতাম না, কারণ ওর কাছে গেলে নিজেকে সামলানো, উত্তাল সাগরে পাল তোলা ডিঙি নৌকা সামলানোর মতোই মুশকিল।
সায়র আর অর্নব হতভম্ব হয়ে ক্রীতিকের পানেই চেয়ে আছে, দু'জনের মনেই একই প্রশ্ন কি বলছে এই ছেলেটা?
ওদের চোখে হাজারো কৌতুহলের ছড়াছড়ি দেখে, ক্রীতিক ভাবতে থাকে, ঠিক কবে নাগাত শুরু হয়ে ছিল সবকিছু, তারপর খানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে বলতে শুরু করে,
--- অরু যখন প্রথম ক্রীতিক কুঞ্জে আসে, তখন আমি সবে সবে কলেজ পাশ দিয়ে ভার্সিটিতে উঠেছি মাত্র। তখন আমার কাছে জীবন মানে, আভিজাত্য, কতৃত্ব,পাওয়ার এসবই। কারণ ছোট বেলা থেকেই আমাকে এটাই শিখানো হয়েছে, যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে গেলে পূর্ব পুরুষদের পথ অনুসরণ করো। আমিও তাই করেছি। ছোট বেলা থেকেই ন্যানি, ট্রেইনার,মাস্টার এদের কাছে লালিত পালিত হতে হতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পরিবার বলে কিছু হয়,তারপর যখন একটু ম্যাচিউর হই, তখন প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার জোরে আশেপাশের সবাইকে নিজেই কট্রোল করতে শুরু করি, আমার হাতের ইশারাতে সবাই যখন পুতুলের মতো নাচতো তাতে আমার অন্তরে পৈচাশিক আনন্দ হতো। তখন থেকেই ডমিনেটিং স্বভাবটা ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, যা এখনো বদলাতে পারিনি আমি।
কলেজে ওঠার পর পারিবারিক সূত্রেই আমার রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়। প্রথম প্রথম বাবা বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান,সভা সমাবেশে নিয়ে গেলেও পরক্ষণে বাবার হয়ে আমারই যেতে হতো,একপর্যায়ে বাবা নয় সয়ং আমার জন্যই আমাকে যেতে হতো। ততদিনে প্রফেসর হওয়া, বিজনেস সামলানো কিংবা আমার শখের রাইডিং সব কিছুই ছিল দিবাস্বপ্ন মাত্র। কারন আমার ধ্যান,জ্ঞান সবকিছুই তখন রাজনীতিতে নিবদ্ধ।তখন মনে হতো, নিজে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়েও ক্ষমতার জোরে পাবলিক ভার্সিটিতে লিড দেওয়ার মতো পৈশাচিক তৃপ্তি আর কিছুতে নেই।
বাইরের জগতে এতো সুনাম, এতো জনপ্রিয়তা, এতো স্বজনপ্রীতি লোকেদের ভীড়েও দিন শেষে আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ , যার উদরে আমার জন্ম হয়েছিল, যে খুব ছোট্ট বেলায় আমাকে ফেলে নিজের আত্মতৃপ্তির উদ্দেশ্যে নিজ দেশে পারি জমিয়েছিল,সেই বিদেশিনী মাকে বরাবরই ঘৃণা করে এসেছি আমি, তার সাথে মায়ের জাতি টাকেও। কেনো যেন আত্মিক টান কখনোই ছুঁতে পারেনি আমাকে, হয়তো ছোট থেকেই মায়ের মমতাহীন বেড়ে ওঠা সেজন্য । এভাবেই হাজারো মানুষের বেস্টনে একাকী, বিষন্ন জীবনটা ভালোই যাচ্ছিল । অনায়াসে দিন পার করে দেওয়ার মতো অনেক ব্যাস্ততাই ছিল তখন আমার কাঁধে। কখন বাড়িতে ফিরতাম, কখন বেরিয়ে যেতাম কেউ তার হদিস জানতো না। বলতে গেলে আমাদের পরিবারটা দিনকে দিন রাজনীতি প্রাঙ্গনে পরিনত হচ্ছিল, একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কেউ কারও খোজ নিতাম না আমরা।
এক পর্যায়ে পরিবারের এরূপ ভাঙন লক্ষ করে দাদাসাহেব মৃ'ত্যু সজ্জায় এসে বাবাকে আবারও বিয়ে করতে বলেন। দাদার কথা রাখতে বাবাও সেই বয়সে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঠিক তখনই আমার সৎ মায়ের সাথে পরিবারে আগমন ঘটে আরও দুই সদস্যের অরু আর অনু।
ওদের বাবার সম্মন্ধে আমার কিছুই জানা নেই। জানা থাকার কথাও না, কারণ বাবার বিয়ে নিয়ে আমার কোনোরূপ মতামত ছিল, না আমার এসবে কিছুই আসে -যেত।আর কিভাবেই বা আসবে? পরিবার কি জিনিস সেতো আমি জানিই না। ওরা ওদের মতো দিন কাটাতো,পড়াশোনা করতো আর আমি আমার মতো। ওই সময় অরুর দিকে ঠিক করে কখনো তাকিয়েছিলাম কিনা সেটাই বলা মুশকিল । যদিও বা কখনো সামনে পেয়েছি ধরে ঠাস ঠাস করে থা'প্পড় মেরেছি। তবুও আমার রুমে সারাক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দিতো মেয়েটা, সুযোগ পেলেই রুমে এসে এটা-ওটা ধরতো। মাঝেমধ্যে তো বিরক্ত হয়ে খুব মা'রতাম।
ক্রীতিকের কথার মাঝে হুট করেই সায়র ফোড়ন কেটে বলে,
--- তুই কিরে, এখন যার জন্য দিওয়ানা হয়ে ছটফট করিস, তখন তাকে এভাবে মা'রতিস?
ক্রীতিক মৃদু হেসে বলে,
--- আই উইশ, অরু আগের মতো এখনো আমার রুমে উঁকি ঝুঁকি দিতো।
--- আর তুই ওঁকে ঠাস ঠুস করে মা'রতিস।
অর্নব সায়রকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
--- আহা! থামতো তুই, জেকে তারপর কি হয়েছিল?
ক্রীতিক পুনরায় বলতে শুরু করে,
--- অরুর মা সুদক্ষ এবং স্মার্ট মহিলা ছিল, যার জন্য বাবার সাথে ব্যাবসায়িক কাজে বিভিন্ন যায়গায় যেতেন তিনি, বলতে গেলে বাবাকে সাহায্য করার জন্যই, তবে আমার সাথে তার খুব একটা সাভাবিক সম্পর্ক ছিলোনা,যার দরুন সপ্তাহে একবারও আমাদের মুখ দেখাদেখি হতোনা, যদি হতো সেটাও অরুর জন্য, অরুকে মা'রলে সেটা নিয়ে নালিশ যেত বাবার কাছে।
বিপরীতে বাবার থেকে পেতাম হাজারটা তিরস্কার আর ভ'ৎসনা। এসবের কারনে মনে মনে জিদ হতো অরুর প্রতি,জিদের বসে দ্বিতীয়বার আমার রুমে এলে আরও বেশি করে মে'রে দিতাম ওকে।
এরকম যেতে যেতে বছর খানিক চলে যায়, তারপর একদিন, এটুকু বলে থেমে যায় ক্রীতিক,
সায়র, অর্নব দুজনই উৎকন্ঠা নিয়ে শুধালো --তারপর একদিন?
এবার ক্রীতিক নিজেও ভাবতে থাকে সে রাতের কথা,
পূর্নিমা রাত,আকাশে রূপোর থালার মতো মস্তবড় চাঁদ উঠেছে।চাঁদের নিয়ন আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিপাশ। ক্রীতিক কু্ঞ্জের মহলের ছাঁদটার আয়তন ছোট্টখাটো ফুটবল খেলার মাঠের মতোই বৃহৎ। জোছনা রাতে মায়ের অনুমতি সাপেক্ষ ছাঁদের পাঁচিল থেকে আচারের বয়াম গুলো ঘরে আনতেই ছাঁদে এসেছিল অরু। তখনই পাঁচিল ঘেষে দাড়িয়ে থাকা পুরো দস্তুর কালো দিয়ে আবৃত লম্বা মতো কাউকে দেখতে পেয়ে, অকস্মাৎ ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে অরু। তবে গলার স্বর বাইরে বেরোনোর আগেই শক্ত হাতে ওর মুখ চে'পে ধরে ক্রীতিক। অরু থেমে গিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বলে,
--- তুই এখানে কেন?
ক্রীতিকের কথায় উত্তর না দিয়ে অরু,মিনিমিনিয়ে বলে,
--- আপনার তো জ্বর এসেছে, হাতটা কেমন আ'গুনের গোলার মতো গড়ম হয়ে আছে।
ক্রীতিক অরুর শরীরে একপ্রকার ধা'ক্কা দিয়ে বলে,
--- জ্বর আসলে তোর কি? যা করতে এসেছিস সেটা করে নেমে যা, জ্ব'রের ঘোরে তোকে দেখতে ইচ্ছা করেনা।
ক্রীতিকের রগচটা সভাব চরিত্র সবকিছুই অরুর জানা, তাই ও আর না বারিয়ে চুপচাপ আচারের বয়াম নিয়ে ছাঁদ থেকে নেমে যায়।
*****************************************
মাঝরাত, কারেন্ট থাকা সত্বেও রুমের চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জ্বরের ঘোরে অন্ধকার রুমে শুয়েই থরথর করে কাঁপছে ক্রীতিক। সন্ধ্যা রাতে দুই দুইটা প্যারাসিটামল খেয়েও কাজ হয়নি,উল্টে হাড়কাঁপিয়ে দিগুণ তালে জ্ব'র উঠেছে। পার্টির লোকেদের থেকে বারবার কল আসাতে মোবাইলটাও বন্ধ করে রেখেছে ও। অনেক বেশি জ্বরের তোপে অন্ধকার রুমের মাঝেই জোনাকিপোকা দেখছিল ক্রীতিক।ঠিক তখনই গভীর তিমিরকে হটিয়ে একটা মোমবাতি সমেত রুমে প্রবেশ করে কিশোরী অরু। পরনে তার কালো রঙের কামিজ মাথায় আধটানা ঘোমটা। ক্রীতিক তখনও জ্বরের তোপে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, অরু মোমটা নিয়ে রুমের মাঝে এগিয়ে এসে নিজে থেকেই বললো,
--- বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে, জেনারেটর ও নস্ট হয়ে পরে আছে, আপনার তো জ্বর তাই ভাবলাম মোমবাতি নিয়ে আসি।
--- মোমবাতির প্রয়োজন নেই আমি অন্ধকার ভালোবাসি, তুই যাতো।
ক্রীতিকের এহেন ধমকেও অরু যায়না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ওর পাশ ঘেঁষে। অরুকে অনেকক্ষন যাবত দাড়িয়ে থাকতে থেকে ক্রীতিক হাস্কি স্বরে নাক টেনে বলে,
--- কি হলো যাচ্ছিস না যে? আবারও মা'র খাওয়ার শখ জেগেছে? শখ জেগে থাকলে কাছে আয় থা'প্পড় দিচ্ছি।
অরু মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,
--- মা আঙ্কেলের সাথে শহরের বাইরে গিয়েছে,মামির অসুখ শুনে সকাল সকাল আপাও নানা বাড়ি গিয়েছে, বলেছিল বিকেলের মধ্যে ফিরবে কিন্তু ফেরেনি, এখন আবার কারেন্টও নেই, আমার অন্ধকারে ভয় করছে ভাইয়া, এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকি, কারেন্ট এলেই চলে যাবো।
অরুর আকুতিভরা টলটলে চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে নিজে একটু সরে গিয়ে অরুর জন্য বিছানাতেই যায়গা করে দিলো ক্রীতিক। অরুও টু শব্দ না করে ভয়ে ভয়ে সেখানটায় গিয়ে বসে পরে।
ক্রীতিক চোখ দুটো বন্ধ রেখেই অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
--- ভালো করে বস মা'রবো না।
অরু এবার ভালোভাবেই বসে, হাতে থাকা জলপট্টিটা ক্রীতিকের কপালে রেখে দেখে দেয়।
ক্রীতিক ভ্রুকুটি করে চোখ উল্টে সেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- এটা কি দিয়েছিস?
অরু জানায়,
--- জ্বর হলে মা আমাদের মাথায় এটা দিয়ে রাখে, এতে অনেকটা আরাম লাগে,আপনি অন্ধকারে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন, মনে হলো আপনার এটা প্রয়োজন তাই নিয়ে এসেছি।
অরুর কথা শুনে ক্রীতিক ওর মুখের পানে চাইলো,গত দের বছরে আজই বোধ হয় প্রথম ঠিকভাবে অরুর মুখের দিকে চাইলো ক্রীতিক,
সদ্য কিশোরীতে রূপ নেওয়া কচি একটা চেহারা। টিমটিমিয়ে জ্বলতে থাকা মোমের হলদে আলোও ওর চেহারাটা অস্পরীর মতোই সুন্দর লাগছে তীব্র জ্বরের ঘোরে থাকা ক্রীতিকের নেশালো চোখ দুটোতে। হুট করেই কেন যেন মনে হচ্ছে অরুর মতো মায়াবী মুখ পৃথিবীতে আর দুটো নেই।
ক্রীতিককে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু ঠোঁট কামড়ে একটু এগিয়ে এসে জলপট্টিটা আবারও উল্টে দিলো।
--- আমার জন্য কেন করছিস এসব?
ক্রীতিকের অজ্ঞাত প্রশ্নের উত্তর নেই অরুর কাছে, কিইবা বলবে ও? দেখছে মানুষটা জ্বরে পু'ড়ে যাচ্ছে, অথচ কাউকে মুখ ফুটে বলছেনা অবধি , একা একাই কষ্ট সহ্য করছে, তাইতো হাতে করে জলপট্টিটা নিয়ে আসা।
--- কি হলো, কিছু বল?
অরু আস্তে করে জবাব দেয়,
-- আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছিল তাই।
ক্রীতিকের মতো পরিবারচ্যুত, বেপরোয়া, বেখেয়ালি, মায়ার বাঁধনহীন ছেলের কাছে অরুর অযাচিত মনে মুখ ফসকে বলা এই বাক্যটা ছিল আকাশসম আন্তরিকতা। অরুর কথায় অধিক তাপমাত্রায় দা'উদাউ করে জ্বলতে থাকা হৃদয়টা হঠাৎ করেই কেমন শীতল হয়ে গেলো, উল্টে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো দিগুন তালে।হুট করেই মনে হতে লাগলো অরু ওর আপন, খুব আপন।
অরুর দিকে তাকিয়ে হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই কখন যে বিদ্যুৎ চলে এসেছে টের পায়নি ক্রীতিক,টের পাওয়ার কথাও নয়,কারন এই রুমে এখনো আলো জ্বলছে না, বাইরের ঘরে মৃদু আলো জ্বলতে দেখে অরু বলে,
--- বিদ্যুৎ চলে এসেছে, এবার আমি যাই।
ক্রীতিক অরুর হাত টেনে ধরে, ঘোর অসম্মতি জানিয়ে বলে,
--- কোত্থাও যাবিনা তুই, এখানে বসে থাক আমার সামনে।
--- কককেন?
ক্রীতিক হাস্কি স্বরে জবাব দেয়,
--- তোকে দেখবো তাই।
ক্রীতিক শক্ত করে অরুর হাত ধরে রেখেছে,
উপায়ন্তর না পেয়ে অরু সেখানেই বসে থাকে সারারাত, একপর্যায়ে ঝিমুতে ঝিমুতে কখন যে ক্রীতিকের বুকের উপরই ঘুমিয়ে পরেছে সেটা অরুর অজানাই রয়ে যায়, অথচ ক্রীতিকের চোখে একফোটাও ঘুম নেই, ও সারারাত জেগে ঘোর লাগা চোখে অরুকে দেখেছে, সময়ের সাথে সাথে মোমের আলো ফুরিয়ে গিয়েছে, তবুও দেখেছে, শেষমেশ অরু যখন ক্রীতিকের বুকেই ঘুমিয়ে পরে, তখন দ্বিতীয়বারের মতো আবারও হৃদস্পন্দন গতি হারায় ক্রীতিকের। ও চোখ দুটো বন্ধ করে হিসহিসিয়ে বলে,
--- তুই আমার অরু, খুব তারাতাড়ি বড় হয়ে যা, তোকে আমি দেখবো, সারাজীবন ধরে দেখবো।
*****************************************
সেদিন রাতের পর থেকেই ক্রীতিকের হৃদয়ে বাসা বাধে অরুর প্রতি অজানা এক আসক্তি। যার কোনো নামদাম নেই, শুধু হৃদ মাঝারে বয়ে চলা এক সুপ্ত, গভীর, আর বেসামাল অনুভূতির ছড়াছড়ি । ধীরে ধীরে সবার আড়ালে শুরু হয় অরুর প্রতি নিজের দখলদারি। অরু যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতো সেই রাস্তায় সবসময় দুজন লোক লাগানো থাকতো। অরু কার সাথে মিশছে কার সাথে ঘুরছে,বন্ধু মহলে কোনো ছেলের আনাগোনা আছে কিনা সব কিছুরই পাই টু পাই খবর নিতো ক্রীতিক, অরু আম পারতে গিয়ে গাছ থেকে পরে ব্যাথা পেয়েছে বলে,সেদিনই বাপ দাদার আমলের ঐতিহ্যবাহী আম গাছকে কে'টেকুটে বাড়ি থেকে বিদায় করে ক্রীতিক । বাড়ির ঐতিহ্য,বাবা দাদার স্মৃতিকে এভাবে কেটে ফেলায় ছেলের বেপরোয়া কান্ডে জামশেদ জায়ান চৌধুরী ও হতবাক হয়েছিলেন, কিন্তু বলার মতো কিছু নেই তার।কিইবা বলবেন?ছেলে কি তার কথা শোনে?
এভাবে সময়ের পরিবর্তনে সেই আসক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে দিগুণ হারে, স্কুল ব্যাতিত ক্রীতিক কুঞ্জের বাইরে পা রাখা নিষিদ্ধ হয়ে যায় অরুর জন্য। কিশোরী অরুর মাথায় ঢোকেনা, হঠাৎ করেই ক্রীতিক কেন তার উপর এতো অধিকার দেখাচ্ছে। আগেতো কখন আসতো কখন যেত তারই হদিস থাকতো না, আর এখন বাড়িতে কেউ না থাকলেই ক্রীতিককে দেখতে পায় অরু। শুধু দেখতে পায় বললে ভুল হবে, ওকে জোর জ'বরদস্তি করে নিজের সামনে বসিয়ে রাখে ক্রীতিক,চোখের সামনে থেকে সরলেই গালে এসে আঁচড়ে পরে শক্ত হাতের থা'প্পড়। থা'প্পড় খেয়ে অরু কাঁদলে পুনরায় থা'প্পড়।
*****************************************
এভাবেই দিন যাচ্ছিল, সবার অগোচরে ভেতরের সুপ্ত অনুভূতি গুলো তরতর করে বাড়ছিল ক্রীতিকের মাঝে।ক্রীতিকের হুটহাট করা পাগলামিতে বিরক্ত হয়ে আজকাল আর আগের মতো ওর রুমের ধারে কাছেও ভেরে না অরু। মাঝেমধ্যে ওকে একনজর দেখে চলে যাবে বলে,ওর নাম করে ক্রীতিক জোরে জোরে ডাকে, তবুও সেদিকে পা বাড়ায় না অরু।
তবে আজকে দুরুদুরু বুকে সেই আসতেই হলো ক্রীতিকের রুমের সামনে। বাড়ির অফিস রুমে পার্টি অফিসের মিটিং চলছে, সবাই উপস্থিত, অথচ ক্রীতিকের খবর নেই,মোবাইল বন্ধ করে অন্দরমহলে বসে সে কি করছে কে জানে? মিটিং এর মাঝে সবাই তর্ক বিতর্কে ব্যাস্ত, তাই জামশেদ জায়ান চৌধুরী অরুকে ডেকে বলে,
--- তোমার ক্রীতিক ভাইয়াকে ডেকে দাওতো অরু।
তার কথা রাখতেই আপাতত ভর সন্ধ্যাবেলা ক্রীতিকের রুমে কড়া নেড়েছে অরু।
অরু কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ওকে হ্যাঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে গেলো ক্রীতিক, ভেতরে নিয়ে গিয়ে চোখ রাঙিয়ে অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
--- গত দুদিন ধরে ডাকছি তোকে?সামনে আসছিস না কেন কি সমস্যা?
অরু মুখ ঝামটি দিয়ে বলে,
-- সবসময় বকাঝকা করেন, গায়ে হা'ত তোলেন আপনাকে আমার বিরক্ত লাগে।
-- আগেতো মা'রলেও পেছনে ঘুরঘুর করতি তখন বিরক্ত লাগতো না?
-- তখন তো বুঝতাম না যে আপনি আমায় এতো অপছন্দ করেন, এখন তো বুঝি আমি আপনার সৎ বোন,তাই আমাকে দু-চোখে দেখতে পারেন না আপনি।
অরুর কথা শেষ হতে দেরি হলো, তবে ওর শরীরে ক্রীতিকের হাত পরতে দেরি হলোনা। ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
--- এটা কেন দিয়েছি জানিস? নিজেকে আমার সৎ বোন দাবি করার জন্য, তুই আমার বোন না, আমার বোন হওয়ার কোনো যোগ্যতাই তোর মাঝে নেই। আর না আমি তোকে বোনের নজরে দেখি।
মা'র খেয়ে গালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসেই ফুপিয়ে কাঁদছে অরু।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ক্রু'দ্ধ মস্তিষ্কটাকে স্থীর করে অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে পরে ক্রীতিক, তারপর আলতো হাতে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
---আ'ম সরি অরু,খুব লেগেছে? কেন আমাকে এভাবে য'ন্ত্রনা দিস বলতো? তুই যখন আরেকটু বড় হবি তখন আমার আজকের কথাগুলি ঠিক বুঝতে পারবি, ততদিন শুধু তোকে একটু দেখে দেখে রাখতে হবে আমার।
ক্রীতিকের মুখে আদুরে আওয়াজ শুনে অভিমানে অরু এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠলো,
এভাবে নাক ফুলিয়ে কাঁদায় ওকে অনেক বেশি আকর্ষনীয় আর মায়াবী লাগছিল ক্রীতিকের চোখে, তাই নিজেকে সংযত না রাখতে পেরে হুট করেই ওর গালে সশব্দে চুমু খেয়ে বসলো ক্রীতিক। তবে ওদের বসার ধরনটা এমন ছিল যে, যে কেউ পেছন দিক থেকে দেখলে ভুল বুঝতে পারে, হলোও তাই।
মিসেস আজমেরী শেখ বাড়িতেই ছিলেন সেদিন, ক্রীতিকের রুম থেকে মেয়ের ক্রন্দনরত আওয়াজ শুনেই তিনি বুঝে গিয়েছেন আবারও হয়তো তার ছোট মেয়েটাকে মে'রেছে ক্রীতিক।
তৎক্ষনাৎ তিনি মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য ক্রীতিকের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন, তবে রুমে প্রবেশের আগেই পা দুটো আটকে গেলো তার, সন্ধ্যা রাতের আবছা আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখেলের তার ছোট্ট মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ঠ সময় পার করছে ক্রীতিক।
*****************************************
পার্টি অফিসের ছোট বড় সবার সামনে, পরপর অনর্গল থা'প্পড়ের আ'ঘাতে র'ক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের গৌড় মুখমন্ডল। আর দুটো থা'প্পড় দিলেই হয়তো নাক ফে'টে ফিনকি দিয়ে র'ক্ত বেরিয়ে আসবে।
তবুও কিছুতেই থামানো যাচ্ছেনা জামশেদ জায়ান চৌধুরীকে। রা'গের তোপে থরথর করে কাঁপছেন তিনি, হাতের পাশাপাশি মুখ দিয়ে যা আসছে সেটা বলেই আ'ঘাত করছেন নিজের একমাত্র ছেলেকে। অরু অনু ওর মায়ের আঁচল ধরে রুমের এককোণে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জামশেদ জায়ান চৌধুরী ওকে মা'রতে মা'রতে ক্লান্ত হয়ে বললেন,
--- আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল কোনো আমেরিকান নাচনেওয়ালীর ছেলের চরিত্র এর চেয়ে ভালো আর হবে না।
বরাবরই নিজের মায়ের কথা শুনলে ক্রীতিকের মাথায় র'ক্ত উঠে যায়, উগ্রতার চড়ম সীমানায় পৌঁছে যায় ও,এবারও তাই হলো, চিৎকার দিয়ে নিজের বাবার মুখের উপর বললো,
--- তুমিই সেই আমেরিকান নাচনেওয়ালীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে,যার ফল আমি।
সঙ্গে সঙ্গে জামশেদ জায়ান আবারও ওকে সজোড়ে চ'ড় মারলেন, অতঃপর আশেপাশের চ্যালাপ্যালাদের ডেকে বললেন,
--- প্রাইভেট জেটের ব্যাবস্থা করো,আজ এই মূহুর্তে ও দেশ ছাড়বে, স্বাধীনতা পেতে পেতে ওর ভেতরের পুরোটাই নর্দমার মতো কালো হয়ে গিয়েছে, ওকে শুদ্ধ করা প্রয়োজন, তারজন্য সবার আগে ওর স্বাধীনতা হর'ন করতে হবে। আজ এই মূহুর্তে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরীর রাজনৈতিক পদ বাতিল করা হলো, তোমার রাজনৈতিক জীবন এখানেই সমাপ্ত। বিদেশে গিয়ে মানুষ হয়ে ফেরো।
বাবার কথার পিঠে ক্রীতিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছু'ড়ে মা'রে, দলের লোকেদের হাত থেকে নিজের পাসপোর্ট আর ব্যাগটা ছো মে'রে নিয়ে, ছোট্ট অরুর দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও চোখ সরিয়ে বলে,
--- ফিরবো না, কোনো দিন ফিরবো না এ দেশে, শুধু একটা গুরুত্বপূর্ন জিনিস রেখে গেলাম, সময় হলে সেটাও নিয়ে যাবো। কারণ ক্রীতিক কোনো জিনিস হাত পেতে নেয়না, কে'ড়ে নেয়।
.
ক্রীতিক যখন গাড়ি করে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, তখন দোতলার দেওয়াল জোড়া জানালা দিয়ে ওর পানেই অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিল অরু। ক্রীতিকও তাই,ও গাড়িতে বসে ছিল ঠিকই তবে হিং'স্র দপদপে চোখদুটো ছিল দোতলার জানায় নিবদ্ধ।
একপর্যায়ে গাড়িটা যেতে যেতে চোখের আড়াল হয়ে যায়, তবুও সেদিকে তাকিয়ে রয় অরু, কি নিয়ে এতো ঝামেলা হলো সেসব মাথায় না ঢুকলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে ও, আজ ওর জনই বাড়ি ছাড়া হয়েছে বাড়ির একমাত্র রাজপুত্র, জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
ওদিকে যেতে যেতেই ক্রীতিকের কে'টে যাওয়া ঠোঁট দুটো বাঁকা হাসিতে প্রসারিত হলো, ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দিয়েই বিড়বিড়ালো সে,
---love is temporary but obsession is permanent. and I'm da'ngerously obsessed with you aurora seikh. খুব বেশি না, আমাকে সামলানোর মতো একটুখানি বড় হ, আমি অপেক্ষার প্রহর গুনছি.....
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ২১
ক্যালিফোর্নিয়াতে আজ বেজায় ঠান্ডা পরেছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে একেবারে নাক মুখ চিড়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। এলোমেলো বাতাসের তীব্রতায় ঝড়ে পরা আকর্ষনীয় ম্যাপল পাতায় ভরে উঠেছে রাস্তাঘাট। আজকে আর যেন-তেন শীতের পোশাক পরে শীত নিবারন করার সুযোগ নেই, তাইতো উষ্ণ কোর্ট, গ্লোভস,পায়ে বুট,মাথায় উলের বিনি হ্যাট পরে, একেবারে রয়েসয়ে বাইরে বেরিয়েছে অনু। আজ বাইরে না গিয়ে ভেলভেট কম্ফোর্টারের মধ্যে শুয়ে আরাম করে ঘুমালে হয়তো সবচেয়ে বেশি ভালো হতো। কিন্তু আগামী কাল মায়ের অপারেশন, আজ না গেলে কেমন করে হবে? গত দুদিন ধরে অরু আর ক্রীতিক বাড়িতে নেই, এই দুদিনে ওর যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে প্রত্যয়, সব সময় ফোন করে খোঁজ নেওয়া, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে দেওয়া, কিংবা নার্সিংহোমের কোনোরূপ জরুরি প্রয়োজনে ছুটে আসা।কি না করেছে?
এতো যত্ন, এতো মূল্যয়নে অনুর মতো কঠোর হৃদয়ের মেয়েটাও আজকাল প্রত্যয়ের প্রতি দূর্বলতা অনুভব করে। ইচ্ছে তো করে হৃদয়টা বের করে হাতে তুলে নিয়ে প্রত্যয়কে উপহার দিয়ে দিতে,আফটার অল হি ডিজার্ব ইট।
.
প্রত্যয়কে নিয়ে অসংখ্য দানাবাঁধা স্বপ্ন আর ভাবনারা মাথায় কিলবিল করছে অনুর। মাঝে মাঝেই অযাচিত মনে একাই ফিক করে হেসে উঠছে ঠোঁট জোড়া। একমনে প্রত্যয়কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে বাস স্টপেজের কাছে চলে এসেছে তা টেরও পায়নি অনু। যখন টের পেলো তখন দেখলো বাস এখনো আসেনি, অপেক্ষা করতে হবে কিছুক্ষন, তাই এগিয়ে গিয়ে একটা শিশিরে ভেজা বেঞ্চি হাত দিয়ে সামান্য পরিস্কার করে সেখানটায় বসে পরলো ও। বেঞ্চিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় চোখের সামনে দৃশ্যগত হলো পূর্বের ন্যায় একই ঘটনা। এই নিয়ে পরপর তিনদিন ওই মেয়েটাকে প্রত্যয়ের সঙ্গে দেখেছে অনু। রাস্তার ওপাশেই ক্যাফেটেরিয়াতে দাড়িয়ে আছে ওরা দুজন। প্রত্যয় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে কিছু একটা বলে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। প্রত্যয় চলে যেতেই হুট করে, একদম হুট করে অজ্ঞাত মেয়েটার চোখে চোখ পরলো অনুর। এভাবে চোখাচোখি হওয়ায় ভেতরটা কেমন আঁতকে উঠল ওর। তৎক্ষনাৎ তরিৎ গতিতে চোখ নামিয়ে নিলো অনু।জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
--- কে এই মেয়ে? সব সময় প্রত্যয় সাহেবের সাথেই কেন দেখা যায় তাকে? ওনার বোন? কই চেহারাতে তো মিল নেই।
--- এই যে!!
অনুর অস্পষ্ট বিড়বিড়ানির মাঝেই স্পষ্ট বাংলায় ওকে ডেকে উঠল কেউ। অনেকদিন পর অচেনা মুখে বাংলা আওয়াজ শুনে চট করে মাথা তুলে চাইলো অনু, তবে সেই মানুষটিকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে উল্টে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো ওর। এতো একটু আগে প্রত্যয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাঙালি মেয়েটা, এখানে কি করছে সে? অনু চুপচাপ তাকিয়ে আছে দেখে মেয়েটা পুনরায় বললো,
--- কানে শুনতে পাওনা নাকি?
মেয়েটার কথায় চড়ম ক্রো'ধের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। কওয়া নেই বলা নেই হুট করে এসে এভাবে খিটখিটে আওয়াজে কথা বলাটা মোটেই পছন্দ হলোনা অনুর, মেয়েটার আচরনে সুন্দর মেজাজটা হঠাৎ করেই কেমন বিগড়ে গেলো, তবুও যতটুকু সম্ভব নিজেকে সংবরণ করে কাঠকাঠ আওয়াজে অনু বললো,
--- কি চাই?
অনুর থেকে বোধ হয় এতোটা কাঠিন্য আশা করেনি মেয়েটা, তাই ওকে চোখ পাকিয়ে গলার স্বর কঠিন করে সে বললো,
--- এ্যাই মেয়ে, কাকে কি বলছো তুমি?
অনু এবার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো, দু'হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রেখে ,ভ্রু উঁচিয়ে সাভাবিক ভঙ্গিমাতে বলে,
--- আপনাকে বলছি, কি চাই?
মেয়েটা এবার তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,
--- প্রত্যয়ের সাথে যে এতো ঢলাঢলি করছো, আমি কে সেটা নিশ্চয়ই বলেছে?
--- না বলেনি, হয়তো সেরকম ইম্পর্ট্যান্ট কেউ না তাই বলার প্রয়োজনবোধ করেনি, আপনার খুব বেশি বলার ইচ্ছে থাকলে আপনিই বরং বলুন, আমি শুনছি, আর হ্যা একটু জলদি বলবেন প্লিজ, আমার তাড়া আছে।
মেয়েটা খিটখিট করে বলে উঠলো,
--- বেশি স্মার্ট সাজার চেষ্টাও করোনা,তাহলে পস্তাবে, হি ওয়াজ জাস্ট ইউজিং ইউ,টু ফরগেট সামওয়ান, এন্ড দ্যাট ওয়াজ মি। আমি ওর বিগত সাত বছরের ভালোবাসা।
মেয়েটার কথায় অনু শুষ্ক ঢোক গিললো, মনের ভেতর বিশ্বাস হারানোর ভয়টা কুন্ডলী পাঁকিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তবুও ভেতরের শ'ঙ্কাটাকে নিঃশব্দে আড়াল করে বললো,
--- আপনাদের ভালোবাসা যদি এতোই পিওর হয়, এতোই দৃঢ় হয়,তাহলে আমার কাছে কি চাইতে আসে আপনার বয়ফ্রেন্ড, ধরে রাখতে পারেন না?
অনুর কথায় মেয়েটার আত্নবিশ্বাসে ভাঁটি পরলো, সে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বললো,
--- আমি ওকে চিট করেছি, বাট আই স্টিল লাভ হিম। আর আমি এও জানি ও আমার কাছেই ব্যাক করবে। কারণ সাতদিনের ভালোবাসা, সাত বছরের ভালোবাসার কাছে কিছুই না।
অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
-- স্টুপিড।
অনু শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই ওর চুল খাম'চে ধরলো মেয়েটা, তারপর প্রচন্ত ক্রো'ধে কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটা বললো,
--- তুই আমার প্রত্যয়ের ধারে কাছেও আসবি না, নয়তো আমার সুগার ড্যাডিকে দিয়ে তোর খবর করিয়ে ছাড়বো। আমার হাত যে কতটা লম্বা সেটা তোর ধারণারও বাইরে।
অনু বিপরীতে কিছু বলবে তার আগেই কোথা থেকে যেন ছুটে এসে এক ঝটকায় ধা'ক্কা মে'রে মেয়েটার হাত সরিয়ে দেয় প্রত্যয়, অন্য হাতে অনুকে আগলে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
--- আর ইউ ক্রে'জি? রাস্তার মধ্যে কি করছো এসব? নেক্সট টাইম এভাবে পেছনে পরে থাকলে আমি তোমার নামে পুলিশে কমপ্লেইন করতে বাধ্য হবো তিন্নি।
এতোক্ষণে বাস এসে পরেছে পাবলিক প্লেস হওয়াতে চারিদিকে মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। সবার দৃষ্টি এখন ওদের তিন জনের দিকে। কেউ কেউ তো সুযোগ পেয়ে ভিডিও করা আরম্ভ করা দিয়েছে, অনু এতোক্ষণ যাবত চুপ করেই ছিল কিন্তু এই মূহুর্তে প্রত্যয়ের এসব আগলা দরদ ওর মোটেই ভালোলাগছে, গা ঘিনঘিন করছে, ইচ্ছেতো করছে প্রত্যয়কে সপাটে একটা চ'ড় মে'রে দিতে,কিন্তু পাবলিক প্লেসে নাটক করে কারোর হাসির পাত্র হতে চায়না অনু, তাই যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে প্রত্যয়ের বাহু থেকে নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে, হাঁটা ধরলো রাস্তার উল্টো পথে, ওকে এভাবে চলে যেতে দেখে প্রত্যয়ও হাটা দিলো অনুর পিছু পিছু। প্রত্যয় পেছনে আসছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনু ঘাড় ঘুরিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো,
--- ওখানেই দাঁড়ান, আর আসবেন না। অনুরোধ নয়,নিষেধ করছি।
অনুর নিম পাতার মতোন তেঁতো কথায় প্রত্যয় আর এগোতে পারলোনা, অগত্যাই দাঁড়িয়ে পরলো রাস্তার মাঝখানে, অনু চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেলো সেখান থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত অনুকে দেখা যায়, ঠিক ততক্ষন ওর যাওয়ার পানে নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রত্যয়।এক পা ও নড়লো না।
*****************************************
খুব ভোর নয়, সকাল পেরিয়ে বেলা গড়িয়েছে অনেকটা। চারিদিকে সূর্যের সোনালী আলোর ঝলকানি, অরু সেই কখন থেকে ক্রীতিকের রুমের সামনে দাড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে পায়চারি করছে। মনে মনে ভাবছে,
--- শুনেছি ভোর রাতে রুমে ঢুকেছে এখনো ঘুমিয়ে আছে কিনা কে জানে? নক করবো কি করবো না? করবো কি করবো না? না থাক চলে যাই, না একবার করেই দেখি।
অরু যখন কি করবে না করবে ভেবেই কুল পাচ্ছিল না, তখনই ভেতর থেকে ডেকে ওঠে ক্রীতিক,
--- তোর পায়চারি তে মাথা ঘোরাচ্ছে আমার ভেতরে আয়।
অরু চট করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
--- আপনি কি করে বুঝলেন আমি দাঁড়িয়ে আছি?
কথাটা বলে ভেতরে ঢুকতেই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে দ্রুত পেছনে ঘুরলো অরু। ক্রীতিক গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে, ওর জিম করে কৃত্তিম উপায়ে বানানো ভি শেইপ পৃষ্ঠদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান অরুর চোখে। এভাবে অসময়ে এসে পরে নিজেই লজ্জিত হলো ও। অরুর কথার জবাবে ক্রীতিক সামনে ঘুরে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,
--- মেইবি, আমি তোর শরীরের গন্ধ পাই।
অরু এখনো পেছনে ঘুরে দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
--- হয়ে গিয়েছে তাকাতে পারিস।
অরু যেন কিছুই বোঝেনি, লজ্জাও পায়নি, সেভাবে করেই মুখ ভঙ্গিমা সাভাবিক রেখে ঘুরে বললো,
--- আপনি কি ভ্যাম্বায়ার? না মানে শুনেছি ভ্যাম্পায়াররা মানুষের গন্ধ পায়।
ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ব্ল্যাক বেল্ট ঘড়িটা হাতে পরতে পরতে ক্রীতিক বলে,
--- বেশি বেশি ফ্যান্টাসী বই পড়লে এই হয়, মাথার মধ্যে সব ভুত প্রেত ভর করে বসে আছে, ক্লাসের বই তো খুলেও দেখিস না, এবার ইউ এস এ ফিরে তোকে দেখে নিচ্ছি আমি।
পড়াশোনার কথা আসতেই অরু দ্রুত কথা ঘুরিয়ে কাজের কথায় চলে এলো, মিনমিনিয়ে বললো,
--- আপনার ফোনটা একটু দিবেন আপাকে কল করতাম।
--- রাতের ফ্লাইটে তো ফিরেই যাচ্ছি কল করার কি আছে?
জবাবে অরু ঠোঁট উল্টে বলে,
--- আপার জন্য মন খারাপ লাগছে, আমি কথা বলতে চাই।
ক্রীতিক নিজের হাতের কাজ করতে করতে বললো,
--- জ্যাকেটের পকেটে আছে খুঁজে দেখ, আর হ্যা, আমার সামনে বোনের সাথে একদম ন্যাকামি করবি না, যা কথা বলার নিজের রুমে গিয়ে বল।
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ফোন নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। তারপর আবারও কি ভেবে যেন ফিরে এসে বলে,
--- ফোনের পাসওয়ার্ডটা...
--- তোর আর আমার বার্থডে।
অরু হতবাক হয়ে পুনরায় শুধালো
--- কিহ?
ক্রীতিক ঘাড় ঘুরিয়ে ধমকের সুরে বললো,
--- কানে কম শুনিস?
অরু ভয়ে তটস্থ হয়ে এদিক ওদিক ঘাড় নাড়িয়ে,আবারও দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতেই লক খুলে কল লাগায় অনুর নাম্বারে।
একবার, দু'বার, তিনবার,গিয়ে চারবারের মাথায় কল তুললো, অনু।
--- হ্যালো আপা!
এপাশ থেকে অরুর উৎসুক গলা শুনেই তেতে উঠলো অনু, গলারস্বরে হাজারো বিরক্তি টেনে এনে ঝাঁজ নিয়ে বললো,
--- কি সমস্যা কল দিয়েছিস কেন? আমাকে একা রেখে সৎ ভাইয়ের টাকায় থাইল্যান্ড গিয়েছিস,ঘুরছিস,ফিরছিস, খাচ্ছিস, এনজয় করছিস, তবুও স্বাধ মিটছে না? নাকি আমাকে ইউজ করে আমার ঘাড়ে পা দিয়ে জীবন কাটানোর শখ এখনো মেটেনি?
অনুর তিক্ত কথায় চড়াৎ করে মস্তিষ্কটা ঝাঁজিয়ে উঠলো অরুর, ও নিজেও তেজি স্বরে বললো,
--- মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছিস তখন থেকে, কি হয়েছে কি করেছি আমি?
অনু উল্টো ক্রো'ধ দেখিয়ে বললো,
--- যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি, বুঝেশুনে বলেছি, তোরা সবাই আমাকে ব্যাবহার করিস নিজেদের প্রয়োজনে। কেন বলতো? সব সময় তোদের চিন্তাই আমার কেন করতে হবে? আমার কি ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু নেই?
অরু এবার নরম সুরে শুধালো,
---কি হয়েছে আপা?
অরুর প্রশ্নের কিঞ্চিত পরোয়া না করে,অনু মুখে যা আসছে উন্মাদের মতো তাই বলে যাচ্ছে, অরু জানে আপার রা'গ উঠলে মাথা ঠিক থাকেনা, পরে আবার নিজেই সব সামাল দেয়, তাই এতোএতো তিক্ত কথার বিপরীতে
অরু নিজের রাগ সংবরন করে আবারও জিজ্ঞেস করল,
--- কি হয়েছে বলনা আপা? কে কি বলেছে তোকে? মা ঠিক আছে, আমি...
ওর একাধারে প্রশ্নের একপর্যায়ে অনু নিজের খেইর হারিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
--- তুই এবার আমাকে বিচারকদের মতো প্রশ্ন করা বন্ধ কর অরু, আমি বিরক্ত তোর এসব প্রশ্নে, তোর এতো আনন্দ আমার সহ্য হচ্ছেনা, আমার ঘাড়ে পা দিয়ে এভাবে জীবন কাটাতে লজ্জা হয়না তোর? আর কতদিন আমার উপর ভরসা করে বাঁচবি? তোদের দেখভাল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি, এবার একটু রেহাই দে, এবার অন্তত আমাকে ইউজ করা বন্ধ কর।
--- আমি তোকে ইউজ করি?
--- হ্যা করিস, তোরা সবাই মিলে আমাকে নিজেদের সার্থে ইউজ করিস, এবার আমাকে আমার মতো বাঁচতে দে অরু, একনাগাড়ে চোখ খিঁচে কথাগুলো বলে মুখের উপর ফোন কেটে দিলো অনু।
ওদিকে অনুর বলা শেষ কথায় মাথার মধ্যে অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গ অনুভব হলো অরুর,কষ্টের সীমানা পেরিয়ে, মেজাজ চড়ে এসেছে সপ্তম আসমানে। ইচ্ছে করছে আশেপাশের সব কিছুর ভে'ঙে গুড়িয়ে ফেলতে,নিজের অজান্তেই ধপ করে মেঝেতে বসে পরে দু'হাতে নিজের লম্বা চুল গুলো মু'ঠিবদ্ধ করে, নিরবে চোখের জ্বল ফেলতে ফেলতে অস্পষ্ট সুরে অরু বললো,
--- তারমানে মায়ের অবর্তমানে আপাও আমাকে করুনা করে এসেছে। কোনো ভালোবাসা নেই সবটা করুনা, সবাই করুনা করে আমাকে।
*****************************************
এলিসার বাবাকে থাই পুলিশ এ্যা'রেস্ট করেছে, এবার আর প্রমান ছাড়া নয় সুস্পষ্ট প্রমান সমেত তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
---যেহেতু ওর বাবা জেলে আছে সেহেতু এলিসাকে ব্ল্যা'কমেইল করার মতো আপাতত কেউ নেই, বলতে গেলে এলিসা এখন পুরোপুরি নিরাপদ।
সায়রের কথায় অর্নব আর ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।
অর্নবের হ্যা সূচক সম্মতি শুনে সায়র এবার উচ্ছ্বাসিত সুরে বললো,
---তাহলেতো আমাদের মিশন কম্পিলিট, আজ রাতে পার্টি করলে কেমন হয়?
এবার অর্নব বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললো,
--- তুই কি পা'গল? এলিসার মন ভালো নেই, আর তুই আছিস তোর পার্টি নিয়ে।
ক্রীতিক কিছু একটা ভেবে পায়ের উপর পা তুলে বললো,
--- আমার হাতে সময় নেই কাল ভার্সিটিতে এক্সাম ফিরতে হবে।
সায়র হতাশ হয়ে বললো,
---তোরা না থাকলে আমি কি জ্বিন ভুতের সাথে পার্টি করবো নাকি?চল রাতেই ফিরে যাই তাহলে।
কথাটা শেষ করে সায়র কেবলই বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে, ওর সামনের ডিভানটাতে এখনো ক্রীতিক পায়ের উপর পা তুলে বসা, তখনই কোথা থেকে যেন অরু এসে এক প্রকার হামলে পরলে সায়রের উপর, ওর চেহারা বি'ভৎস, চুল গুলো এলোমেলো, চোখদুটো টলছে, সেথা থেকে গড়িয়ে পরছে অস্রুসিক্ত নোনাজল। অরু আশেপাশের কারোর দিকে নজর না দিয়েই, সায়রের কলার দুটো শক্ত করে চেপে ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
--- সায়র ভাইয়া! বিয়ে করবেন আমায়? আপনার তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, তাছাড়া আপনার মাথার সবগুলো তাড় ও ঠিকঠাক আছে, আমার আপনাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই, আমি কারও বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা,কারও করুনার পাত্রীও হতে চাইনা আর এক মূহুর্ত ও না, বিয়ে করবেন আমাকে? হতে পারে আমি আপনার চেয়ে বয়সে একটু বেশিই ছোট তাতে কি আসে যায়?ভালো করে তাকিয়ে দেখুন আমি সুন্দরী।
এদিকে সায়র অরুকে কি দেখবে, অরুর পেছনে দাড়িয়ে থাকা ক্রীতিককে দেখেই ওর গলা শুকিয়ে এসেছে। ক্রীতিকের জ'লন্ত আ'গ্নেয়গিরির দাবানলের মতো চোখ দুটো দেখেই ওর হাত পা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে, চোখ দিয়ে বারবার ক্রীতিককে ইশারা করে বোঝাচ্ছে,
--- ভাই আমি কিছু জানিনা,তোর জানের জান পরানের পরান অরুই আমাকে ইচ্ছে করে ফাঁসা'চ্ছে।
ক্রীতিক একনজর সায়র কে পরখ করে কপালে দু আঙুল ঠেকিয়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর হুট করেই উঠে দাড়িয়ে, অরুর হাতটা শ'ক্ত করে চেপে ধরে ওকে ইচ্ছে মতো টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে ছু'ড়ে মা'রলো, অকস্মাৎ টাল সামলাতে না পেরে অরু হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পরে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। দাঁড়ানো থেকে এভাবে হুট করে মেঝেতে পরায় কনুই আর হাঁটুর অবস্থা বেগতিক। কাঁদ'তে কাঁ'দতে অরু নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে খুব , কিন্তু প্রচন্ড আ'ঘাতে হাত পা গুলো যেন অসার হয়ে পরেছে ওর। ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্রীতিক নিজের দু'পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট কন্ঠে বললো,
--- আমি আসছি ততক্ষণ এখানেই পরে থাক, অন্যকারও শরীরে হাত ছোঁয়ানোর শা'স্তিটা সময় হলে টের পাবি।
*****************************************
অরুকে নিজের রুমে আটকে রেখে ক্রীতিক আবারও ওদের কাছে ফিরে আসে, অর্নব,সায়র, এলিসা তিনজনই ভ'য়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের পানে। সবাইকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে
সায়র একটু সাহস করে বলে ওঠে,
--- কি করেছিস ওর সাথে?
সা'পের ফনা তোলার মতো তরিৎ গতিতে সায়রের দিকে হিং'স্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক বলে,
--- যা ইচ্ছে করেছি, আমাদের প্রাইভেট কথাও তোকে শেয়ার করতে হবে?
সায়র কিছু বলতে যাবে, তার আগেই অর্নব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
--- আর একটাও কথা বলবি না সায়র। নয়তো ক্রীতিকের হাতে আজই তোর খেল খতম।
বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিক নিজের পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে অর্নবের হাতে দিয়ে বলে,
---ডকুমেন্টস গুলো যত দ্রুত সম্ভব বের কর।
পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে,সেটাকে উল্টে পাল্টে দেখে,অর্নব নিজের ঠোঁট কা'মড়ে বললো,
--- একটু বেশি তারাহুরো হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা?
অর্নবের কথায় ওর দিকেও অ'গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক। ক্রীতিকের চোখের হিং'স্রতা দেখে অর্নব চোখ নামিয়ে নিলে, এলিসা এগিয়ে এসে অর্নবের কাধে হাত রেখে বললো,
--- জেকে যা করতে চাইছে,সেটা ওকে করতে দে অর্নব।
অর্নব এলিসার দিকে তাকিয়ে ছলছল নয়নে বলে ওঠে,
--- তুই বললে, আমি সব কিছু করতে রাজি জান, তুই শুধু একবার বল জেকের সাথে আমারটাও...
অর্নব আর কিছু বলবে তার আগেই নিজের তিন ইঞ্চি হাই হিল নিয়ে অর্নবের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পরলো এলিসা, অতঃপর ওর কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে এলিসা শুধায়,
---- কি যেন বলছিলি? আবার একটু বল।
*****************************************
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে, সূর্যের আলো পুব আকাশ থেকে পশ্চিমে গিয়ে ঠেকেছে। অরু এখনো মেঝেতে বসে বিছানায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। অনেকক্ষন ধরে একটানা কাঁ'দার ফলে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে ওর ক্রন্দনরত ছোট্ট শরীরটা। তখন আপার সাথে রাগ করে কি বলতে কি বলেছে, কাকে বলেছে কিছুই মাথায় ঢোকেনি। অথচ এখন সেসব কথা মনে পরলেই ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় নিজেই বা'রি মে'রে বেহুস হয়ে যেতে। সবার সামনে কতোটা নির্লজ্জের মতো সায়রকে গিয়ে বিয়ের কথা বলছে ও। এখন ভাবলেও বিরক্তিতে শরীরটা চিড়বিড়িয়ে উঠছে, সবাই কি ভেবেছে, কে জানে? যে যা ভাবার ভাবুক, তবে অরু ঠিক করেই নিয়েছে সায়রের মুখোমুখি আর এ জীবনে হবে না ও। কি করেই বা হবে, সায়রকে দেখলেই তো নিজের করা মস্তবড় বোকামির কথা বারবার মনে পরে যাবে। সকালের কর্মকান্ডের কথা ভেবেই হাত পা ছড়িয়ে আরও এক দস্তুর কেঁদে ভাসালো অরু।তারপর মনে মনে ভাবলো,
---আপাকে আরেকবার কল করে দেখলে কেমন হয়?এখন তো রাগ কমেও যেতে পারে।
যেই ভাবা সেই কাজ অরু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বিছানার আসেপাশে ক্রীতিকের মোবাইলটা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু মোবাইলের যায়গায় অন্যকিছু হাতে এলো ওর, নরম বিছানায় মাথার পাশেই যে কুশনটা রাখা থাকে তারপাশেই ওর রুপোলি নুপুরটা আঁকাবাকা হয়ে পরে আছে, এতো বছর ধরে পায়ে পরে থাকা নিজের সুপরিচিত নুপুরটা দেখে অরু দ্রুত গিয়ে সেটাকে হাতরে নিলো,হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বললো,
--- আরে এটাতো আমার নুপুর, এলিসা আপুর জন্মদিনের পার্টিতে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এটা ওনার কাছে কি করে এলো? আর ওনার কাছে যদি থাকবেই তাহলে সেদিন কেন জিজ্ঞেস করলো, আমার নুপুর কোথায়? আশ্চর্য মানুষ তো, আমার নুপুর দিয়ে ওনার কি কাজ?
একমনে কথাগুলো বলে অরু পা বাড়িয়ে দেয় নিজ হাতে নুপুরটা পরার জন্য। ঠিক তখনই বাইরে থেকে আগমন ঘটে ক্রীতিকের, ও হুর মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে বেডসাইড টেবিল থেকে কিছু কার্ড নিজের ওয়ালেটে ভরে নেয়, অতঃপর অরুর হাতে হ্যাচকা টান মে'রে ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
-- চল।
অরু ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,
-- চল মানে, কোথায় যাবো?
ক্রীতিক জবাব দেয়না কোনোরূপ, বরং ওকে জোর জ'বরদস্তি করে টা'নতে টান'তে বাইরে নিয়ে যায়,
--- হাত ছাড়ুন লাগছে আমার, আরে আমার নুপুরটা ফেলে এসেছিতো, ছাড়ুউউন।
কে শোনে কার কথা, ক্রীতিকের স্থবির চোখমুখ আর ভাবমূর্তি দেখে মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে ওর শ্রবনশক্তিই হারিয়ে গিয়েছে।
*****************************************
একমনে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে উত্তাল প্রশান্ত মহাসাগরের সামনে এসে দাড়িয়েছে তার হদিস নেই অনুর। মাথার উপর গোল্ডেন গেইট ব্রীজ। তাতে হাজারো মানুষের ঢল আর তার নিচে সুবিশাল সমুদ্র তট। এখানেই তো প্রথমবার প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখেছিল অনু, কতটা প্রশান্তি, আর কতটা আবেগাপ্লুত হয়ে প্রত্যয়ের উপর নিজের ক্লান্ত শরীরের ভার ছেড়েছিল, প্রত্যয়ের আন্তরিকতা মাখা হাসি, মাথায় বুলানো আদুরে হাতের পরশ, রাতের আধারে একান্তে বৃষ্টিস্নান, সব কিছুই কি তাহলে মিথ্যা ছিল? প্রত্যয় তার সাত বছরের ভালোবাসা ভুলে যেতে, কেবলমাত্র ওকে ইউজ করছে এটাই কি সত্যি? তিন্নি নামক মেয়েটা কি সত্যি বলছে? অনু কি তবে শুধুই অন্য একজনার যায়গা পূরন করে ইউজ হয়েছে মাত্র ? "ইউজ" শব্দটা সেই সকাল থেকেই মাথার মধ্যে গেড়ে বসে আছে ওর। কিছুতেই শব্দটাকে সরানো যাচ্ছে না মাথা থেকে। ইউজ শব্দটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই অনুর মনে পরে যায় সকালের কথা, নিজের ব্যাতিগ্রস্থ হৃদয়কে সামাল দিতে না পেরে সকাল বেলা যা নয় তাই বলেছে অরুকে। নিজের ছোট্ট বোনের প্রতি এরূপ জঘ'ন্য আচরণ করে, প্রত্যয়ের উপর জমে থাকা রাগ অরুর উপর ঢেলে এখন অনুশোচনায় বুক ফেটে কা'ন্না আসছে অনুর। কি করছে অরু?ঠিক আছেতো? নাকি আপার উপর অভিমান করে ভুলভাল কিছু করে বসেছে ওর ডানপিঠে বোনটা? হাজারো অজানা প্রশ্ন এসে বারি খাচ্ছে অনুর মস্তিষ্কে, ও আর ভেবে সময় নস্ট করতে পারলো না, তৎক্ষনাৎ অরুর সাথে কথা বলার জন্য দ্রুতই ফোন বের করে কল লাগালো ক্রীতিকের নাম্বারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বারবার ফোন করার পরেও কেউ ফোনটা তুলছে না, কি করে তুলবে? ফোনটা যে সেই সকাল থেকেই মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
এদিকে অরুকে কলে না পেয়ে শব্দ করে কাঁ'দতে কাঁ'দত অনু বসে পরে বালু আস্তরিত স্যাতস্যাতে বেলাভূমিতে।
*****************************************
সন্ধ্যা রাতে রিসোর্টের সামনে বাইক থামিয়ে, অরুর বাহু ধরে একপ্রকার টে'নে বাইক থেকে নামালো ক্রীতিক। অরুর চোখ মুখ বিমর্ষ।ওর গালে পাঁচ আঙুলের দা'গ সুস্পষ্ট। মাথাটা নুইয়ে রেখেছে সেই কখন থেকে। ক্রীতিক নিস্প্রভ চোখে অরুর দিকেই ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে। ওর কাছে এই ফোলা ফোলা চোখের অরুকে বরাবরই সুন্দর লাগে, আজ মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সুন্দর লাগছে। অরুর পরনে ছিল সুতির ঘাগড়া আর ওভার সাইজ টপস,টপস এর উপর বানজারা কারুকাজের কোটি, লম্বা হাটুসম চুল গুলো ঢিলেঢালা করে হাতখোঁপা বাধা, এতোক্ষণ ধরে হেলমেট পরে থাকায় খোঁপাটা মনেহচ্ছে আরও ঢিলে হয়ে গিয়েছে, এখনই খুলে পরবে পরবে ভাব। দুধে আলতা রাঙা মুখটা কেঁ'দে কে'টে লাল বর্ণ ধারণ করেছে, তবে সন্ধ্যারাতের হ্যাজাকের আলোয় এই লাল লাল চেহারায় বরই মায়াবী লাগছে তাকে। যে কেউ দেখে বলবে নতুন বিয়ের ছিড়ি জেগেছে মেয়ের মুখে।
খানিকক্ষণ বাদে ওদের পেছন পেছন উবার থেকে নেমে এলো এলিসা, অর্নব আর সায়র ও। কারও মুখে টু শব্দ নেই ওদের । চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। অরু চুপচাপ মাথা নুয়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকে , গলায় রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে তৈরি তাজা ফুলের মালা, হাতেও একটা ঝুলানো, এটা বোধ হয় ক্রীতিকেরটা। অরুর মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে এলিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, বন্ধুর বেলাতে বরাবরই ওরা সার্থপর হয়ে যায়, আজও তাই হয়েছে। তবে এখন অরুকে ভেতরে নিয়ে কিছু খাওয়ানো উচিৎ মেয়েটা সারাদিন না খেয়ে আছে। তাই চারিদিকের নিরবতা ভেঙে এলিসা বলে ওঠে,
--- তোরা কি সারারাত এখানে দাড়িয়ে থাকার প্ল্যান করেছিস? যদি তাই হয়, তাহলে দাড়িয়ে থাক, আমি আর অরু ভেতরে গেলাম।
ওরা সবাই এখনো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এলিসা অরুকে সাথে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে, পেছন থেকে ক্রীতিক ডেকে ওঠে ওদের,
--- এলিসা শোন।
এলিসা ঘুরে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর পানে চাইলে, ক্রীতিক একটা সাইন করা চেকের পাতা এলিসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
--- এটা অরুর মোহরানার টাকা, ওকে দিয়ে দিস।
এলিসা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চেক টা হাতে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। ওদিকে ক্রীতিকের কান্ডে সায়র আর অর্নব অবাকের চড়ম সীমানায় গিয়ে চোখাচোখি করে দুজনে একই সুরে বলে উঠলো,
--- পৃথিবীতে এটাই বোধ হয় প্রথম বিরল ঘটনা, যেখানে স্বামী তার বউকে মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে মোহরানা উশুল করে দিলো।
ওদের কথায় ধ্যান নেই ক্রীতিকের, ওতো সেই কখন থেকে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে , অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। অরু চলে গিয়েছে বহুক্ষণ আগে, তবুও তাকিয়ে আছে। অদুরে কোনো এক বাঙালি ক্যাফে থেকে তখনও কানে ভেসে আসছে বেসুরো দুটো লাইন,
"আমার কাছে তুমি অন্যরকম
ভালোবাসি বেশি, প্রকাশ করি কম"
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ২২
চারিদিক জনমানবশূন্য হয়ে আছে, বিস্তৃত তিমিরে ঢাকা কালো রাতের ইতি টেনে সবে সবে ভোরের আলো ফুটেছে ধরনীতে। সূর্য এখনো তার তে'জস্ক্রিয়তা ছড়ায়নি পুরোপুরি ,প্রকৃতিতে হীম ধরা শীতল পরিবেশ বিরাজমান।
হাইওয়ে রাস্তার অদূর থেকে ভেসে আসছে দু একখানা কাভার্ড ভ্যানের শাঁইশাঁই আওয়াজ। রাস্তার দু'পাশে স্থীর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারিসারি বৈদ্যুতিক খুঁটির মাথায় বসেছে জোড়ায় জোড়ায় বন্য পাখিদের ঝাঁক। একের পর এক বন্য পাখিদের চোখের আড়াল করে নিভু নিভু ভোরে ফাঁকা রাস্তার মাঝ দিয়েই আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের চার চাকা ব্ল্যাক মার্সিডিজ। গন্তব্য সানফ্রান্সিসকো ছাড়িয়ে নিজের নির্জন ছোট্ট বাড়িটা। এখন অবশ্য শুধু নিজের বলা যায়না, যেহেতু ও একজনের সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়েছে,সেহেতু ক্রীতিকের যা তাতো তারও বটে।
এই হীম ধরা ঠান্ডার মাঝেও গাড়ির জানালার গ্লাস খুলে তাতে দু'হাত রেখে তারউপর চিবুক ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কাঁ'দছে অরু। যদিও ক্রীতিক কা'ন্নাকাটি একদম পছন্দ করেনা, কিন্তু তাতে আপাতত অরুর হেলদোল নেই, জীবনটাই যেখানে এলোমেলো করে ছেড়ে দিয়েছে,সেখানে পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কি আসে যায় আর?ক্রীতিক কি ভাববে সেসব কথা মাথায় না ঢুকিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কেঁদে ভাসাচ্ছে সে। মুখমন্ডল জুড়ে তার আকাশসম দুঃখের ছড়াছড়ি।
অরু প্যাসেঞ্জার সিটে বসা সত্ত্বেও পা'দুটো তুলে রেখেছে সিটের উপর । ও আরাম করে বসে আছে দেখে ক্রীতিকও বুঝে শুনেই গাড়ি ড্রাইভ করছে আপাতত, যাতে অরুর কোথাও না লাগে। অরুর বাধনহারা রেসমের মতো লম্বা সিল্কি চুলগুলো ক্রমাগত উড়ে এসে আঁচড়ে পরছে ক্রীতিকের চোখে মুখে, মাঝেমধ্যে ড্রাইভ করতেও অসুবিধা হচ্ছে খুব, তবুও ক্রীতিক কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না, কারন ওর কাছে এই চুলের মিষ্টি গন্ধটা হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার মতোই প্রশান্তিদায়ক। দরকার পরলে এক ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টায় অতিক্রম করবে তবুও নিজের শরীর থেকে অরুর চুল সরাবে না।
কিন্তু অরুতো সেই ভোর রাত থেকেই বাইরে মুখ দিয়ে বসে আছে, বাইরের হীম ধরা পুরো ঠান্ডাটা ওর চোখেমুখে এসে হা'মলে পরছে, এরকম ঠান্ডার মধ্যে বাইরে মুখ দিয়ে আরও কিছুক্ষন বসে থাকলে বাড়িতে যেতে যেতেই অরুর নিউ'মোনিয়া হয়ে যাবে নিশ্চিত। তাই ক্রীতিক এবার একহাতে ড্রাইভ করতে করতেই অন্যহাত দিয়ে জানালার কাঁচ টা তুলে দিলো।
জানালার কাঁচ টেনে দেওয়াতে একটু পিছিয়ে বসেছে অরু, তবুও কা'ন্না থামায়নি। চোখ দিয়ে তার এখনো গঙ্গা যমুনা বয়ে যাচ্ছে। অরুকে এখনো কাঁদ'তে দেখে সামনে ফোকাস করেই বিরক্ত ভঙ্গিতে কথা ছো'ড়ে ক্রীতিক,
--- কাঁদছিস কেন এভাবে? মে'রেছি তোকে?
ক্রীতিকের কথার পেছনে অরু মৌনতা পালন করে, শুধু মনেমনে বলে,
--- এর থেকে মা'রলে বেশি ভালো হতো।
একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, সেই কখন থেকে চুপ হয়ে আছে অরু, আদৌও উত্তর দেবে বলেও মনে হচ্ছে না। গতকাল থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে মেয়েটা। ক্রীতিক জানে কাকে কিভাবে কথা বলাতে হয়, তাই ও খানিকটা কৌশলী পন্থা'ই অবলম্বন করলো। হুট করেই মাঝরাস্তায় গাড়ির ব্রেক কষলো। এভাবে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অরু হকচকিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
--- এসে গেছি?
কথাটা বলে বাইরে তাকিয়ে যেই দেখলো এটাতো মাঝরাস্তা, তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রীতিকের পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু। ওর চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে,গাড়ির ড্রয়ার থেকে একটা রুপোর নুপুর বের করে সেটাকে চোখের সামনে ধরে ক্রীতিক শুধালো,
---এটা তোর?
ক্রীতিকের প্রশ্নে অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়।
--- চাই এটা?
এবারও অরু উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
--- তাহলে গাড়ি থেকে নাম।
ক্রীতিকের শেষ বারের কথায় অরু চোখ কপালে তুলে বললো,
--- নামবো মানে? এই অচেনা রাস্তায় আপনি আমায় নামিয়ে দিয়ে যাবেন?
--- ইডিয়েট।
অস্ফুটে কথাটা বলে ক্রীতিক নিজেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। অরু ক্রীতিকের যাওয়ার পানে চোখ রেখে বুঝলো এটা একটা পেট্রোল পাম্প। তারপাশেই ছোটখাটো একটা মার্ট, হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে গিয়েছে সে।
.
খানিকক্ষণ বাদে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এলো ক্রীতিক।অতঃপর গাড়িতে বসে সেটা অরুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
--- বাইরে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে আয়, তোকে পেত্নীর মতো দেখাচ্ছে, আমি রীতিমতো ভ'য় পাচ্ছি।
ক্রীতিকের কথাটা অরুর মোটেই পছন্দ না হলেও, এই মূহুর্তে চোখে মুখে আদতে একটু পানি ছিটানো প্রয়োজন, তাই গাইগুই না করে লম্বা চুল গুলোকে হাত খোঁপা বেধে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো অরু। চোখে মুখে ইচ্ছে মতো পানির ঝাপটা দিয়ে, নাক টেনে নিজেকে একটু সাভাবিক বানিয়ে পুনরায় গাড়িতে ফিরে এলো ও। অরু গাড়িতে বসতেই ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো ক্রীতিক। অরু টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
--- এবারতো দিন, নুপুরটা আমার ছোট বেলার স্মৃতি ।
--- নুপুরটা নিয়ে যাওয়া কি খুব দরকার? পরে নিলে হয়না?
ক্রীতিকের কথায় অরু আচমকা দৃষ্টিপাত করলো ওর চোখের দিকে, মনেমনে বললো,
--- আশ্চর্য, আমার নুপুর দিয়ে ওনার কাজটা কি?
অরুর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে একটানে ওর পা দুটো নিজের উরুর উপর তুলে নিলো ক্রীতিক। এভাবে পা তুলে ফেলায় অকস্মাৎ পেছনে ঝুঁকে গেলো অরু, পুরো গাড়ি জুড়ে তখনও পিনপতন নীরবতা বিরাজমান । যার দরুন অরুর তীব্র শ্বাসপ্রশ্বাস আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া হৃদস্পন্দনের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ক্রীতিক ।অরুর এহেন পরিস্থিতিকে গ্রাহ্য না করে, আলতো হাতে ওর পায়ে নুপুর পরানো শুরু করে সে।নিজ পায়ে ক্রীতিকের হাতের নরম স্পর্শ অনুভব হতেই ঠোঁট কামড়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে অরু । নিজের এলোমেলো অজানা অনুভূতিতে বিরক্ত ও। যা সম্ভব নয় তাই সম্ভব করে ছেড়েছে ক্রীতিক। কিন্তু অরুকেই কেনো ব'লির পাঁঠা বানিয়ে এইরকম একটা অসাভাবিক সম্পর্কে জড়ালো সে?কেন অরুর সাথে সাথে নিজের জীবনটাকেও অগ্রহনযোগ্য সম্পর্কের মাঝে ঠেলে দিলো?কি চাইছে ক্রীতিক? এভাবে অরুর জীবনটা নষ্ট করে কোন ভুলের শোধ নিলো সে? একটা দু'টো নয়, অরুর মনে হাজারো দানা বাঁধা প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কিন্তু কে দেবে এতো প্রশ্নের উত্তর?ক্রীতিক তো উত্তর দেওয়ার মতো ছেলেই নয়, অরুর প্রশ্নের তো মোটেই নয়।
অথচ এখন এই মূহুর্তে কি সুন্দর করে মনোযোগ দিয়ে অরুর পায়ে নুপুর পরাচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে প্রয়োজনীয় আর সুক্ষ্ম কাজ কোনোদিন করেনি ক্রীতিক। অরু তখন থেকে হিজিবিজি চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে, চারিপাশে ওর খেয়াল নেই মোটেই । ক্রীতিক নিজের হাতের কাজটা শেষ করে একপলক ভাবুক অরুর চোখের দিকে তাকালো, অতঃপর নিজের হাতের বাধনটা আরও শক্ত করে, ওর পায়ে অকস্মাৎ হ্যাচকা টান মে'রে অরুকে নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে এলো। আচমকা পায়ে টান দেওয়াতে সুতির ঘাগড়াটা অনেকটা উপরে উঠে গিয়ে মোমের মতো সুন্দর পা'দুটো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের চোখের সামনে। ক্রীতিক শুষ্ক ঢোক গিলে সেদিকে একবার পরখ করে, চোখ ঘুরিয়ে অরুর অস্রুসিক্ত নয়নে চোখ রাখলো,তারপর আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওর চোখের জলটুকু মুছিয়ে দিতে দিতে মাদকতায় নিবিষ্ট চাহনী নিক্ষেপ করে, দু'ঠোঁট নাড়িয়ে হাস্কি স্বরে বললো,
--- "বউ"
ক্রীতিক খুব আস্তে করে শব্দটা উচ্চারণ করলেও অরুর শ্রবনেন্দ্রীয়তে তা স্পষ্ট ভাবে পৌঁছেছে, কথাটা শোনা মাত্রই অজানা শিহরণে শরীর ছেয়ে গেলো অরুর। কাটা দিয়ে উঠলো শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ। অজান্তেই তলপেটের মাঝে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে দিলো অসংখ্য প্রজাপতির দল। ইশশ কি অসস্থিদায়ক অনুভূতি। অরুর কেমন কেমন লাগছে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। ক্রীতিক এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে। অরু আমতা আমতা স্বরে বলে উঠলো,
--- আআমি পানি পান করবো।
অরুর কথায় ক্রীতিকের ঘোর কেটে যায়, ও মূহুর্তেই অরুর থেকে দুরত্ব বাড়িয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়, ড্রাইভ করতে করতে মনেমনে ক্রীতিক ভাবছে,
---যাক কান্নাকাটি তো অন্তত থেমেছে।
ওদিকে অরু এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পানি পান করে পুরো বোতল খালি করে ফেলেছে। তবুও কোনো কিছুর তৃষ্ণাতে হাসফাস করছে ভেতরটা, কি অদ্ভুত এই অনুভূতি, ক্রীতিক কি জাদু জানে?
*****************************************
অনু ফ্রন্ট ইয়ার্ডেই দাড়িয়ে ছিলো। অরু অনুকে দেখা মাত্রই ফেঞ্চ গেইট ঠেলে ভেতর প্রবেশ করে দৌড়ে গিয়ে অনুর গলা জড়িয়ে ধরে হাউমা'উ করে কেঁ'দে ওঠে। অনু জানে অরুর এমন কান্নার কারন ও নিজেই। তাই নিজের কাজে বড্ড অনুতপ্ত অনু। অরুর এমন হৃদয় নিংড়ানো কা'ন্নার গতিবেগে অনুও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না,বোনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে , ডুকরে কেঁ'দে উঠে অনু বলে,
---আপার উপর অভিমান করে এভাবে কাঁদিস না সোনা, আপা খুব সরি, আর কখনো তোকে এভাবে বকবো না, আমার ঘাট হয়েছে।
অনুর কথায় ক্রদনরত অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ায়। অরুর ভাব ভঙ্গিমা অনুর বোধগম্য হয়নি, তাই অনু পুনরায় নরম সুরে বললো,
--- বলেছিতো আর কখনো বকবো না এভাবে, এসেছিস থেকে কেঁদেই যাচ্ছিস, কি হয়েছে ক্রীতিক ভাইয়া কিছু বলেছে, দেখি আমার দিকে তাকা?
অরুর গাল দুটো আঁজলা করে ধরে, মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অনু আবারও শুধায়,
---- ক্রীতিক ভাইয়া কিছু বলেছে?
অনুর প্রশ্নে অরু পেছনে দৃষ্টি নিক্ষেপন করে, তাকিয়ে দেখে ক্রীতিক নেই, হয়তো ভেতরে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। তারপর পুনরায় অনুর দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়িয়ে নাক টেনে অরু বলে,
--- কেউ কিচ্ছু বলেনি।
অনু নিশ্চিন্ত হয়ে অরুর দু'চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
--- মায়ের অ'পারেশন হয়ে গিয়েছে, এখন
আই সি ইউ তে আছে, দু'একদিনেই হয়তো চোখ খুলবে মা, তারপর আমরা মায়ের সাথে কথা বলতে পারবো, মাকে নিয়ে দেশেও ফিরে যাবো আর দুঃখ নেই।
এতো বড় একটা খুশির খবরেও কেন যেন খুশি হতে পারলো না অরু, কি করে পারবে? গতকাল রাতেই নিজের সবটা সৎ ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে এসেছে। এসব কথা জানা জানি হলে মা আপা কেউই ওকে মেনে নেবেনা। ভালোবাসবে না। উল্টে নোংরা বলে আখ্যায়িত করবে। এতোগুলো দিন পরে একটু খানি খুশির মুখ দেখেছিল ওর পরিবারটা, অথচ অরু সবার আড়ালে সেটা ধূ'লিসাৎ করে মাটিতে মিশিয়ে এসেছে। ক্রীতিক কেন করলো এমনটা?
নিজের ভাবনার মাঝেই,অরু তৎক্ষনাৎ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে ক্রীতিককে ও প্রশ্ন করবেই করবে, তাতে যা খারাপ হওয়ার হোক। তাছাড়া ক্রীতিক তো ওর সাথে খারাপ কোনো কিছু করার বাদ রাখেনি, তাহলে এতো ভ'য় কিসের?
অরুর অজ্ঞাত ভ্রমকে ভাঙিয়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চ গেইট ঠেলে আগমন ঘটে প্রত্যয়ের। প্রত্যয়কে দেখে অরু এক নজর অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হেটে বাসার ভেতরে চলে যায়। অরু চলে গেলে অনু নিজেও পা বাড়ায় ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই মূহুর্তে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলাতো দূরে থাক, ওর মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না অনুর।
কিন্তু পেছনে ঘুরে কয়েক কদম পা বাড়াতেই প্রত্যয় ওকে টেনে ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে। প্রত্যয়ের এমন কান্ডে অনু রেগেমেগে ঝাঁজিয়ে উঠে বলে,
--- কি অস'ভ্যতা শুরু করেছেন, বাড়িতে ক্রীতিক ভাইয়া আছে।
প্রত্যয় ওর মুখটা শ'ক্ত হাতে চেপে ধরে বললো,
--- শুউউ, ওই জন্যই তো বলছি আস্তে কথা বলো।
অনু ওর হাতটা ঝটকা মে'রে সরিয়ে দিয়ে বললো,
--- কি চাই আপনার, আমাকে ইউজ করে স্বাধ মেটেনি? নাকি তিন্নির সাথে আজ দেখা হয়নি? তাই রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে আমার কাছে এসেছেন।
প্রত্যয় চটে আছে খুব, মেয়েটার তেজের সাথে কিছুতেই পেরে ওঠেনা সে, কিন্তু এই মূহুর্তে অনুর ব্লে'ডের মতো ধারা'লো কথার আ'ঘাতে র'ক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে হৃদয়টা, সেইসাথে মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য।প্রত্যয় নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে, চড়াৎ করে তুঙ্গে উঠে যাওয়া মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো তৎক্ষনাৎ, অনুর হাতদুটো মাথার উপরে তুলে দেওয়ালের সাথে চে'পে ধরে, ওর গলার কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রত্যয় বলে,
--- কথা না শুনলে জা'নে মে'রে ফে'লবো। গত দুদিন ধরে কু'কুরের মতো পিছনে পরে আছি, কিছু একটা এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি। একবারও সুযোগ দিয়েছো আমায়? এতো তেজ কেনো তোমার?
প্রত্যয় এই প্রথমবার অনুকে তুমি করে অধিকার খাটিয়ে কথা বললো। প্রত্যয়ের মুখের তুমি আওয়াজটা যে এতোটা সুমধুর তা অজানাই ছিল অনুর। প্রত্যয়ের মুখে তুমি শুনে হতবাক হয়ে ওর চশমার আড়ালে ধূসর চোখ জোড়ার দিকে বিনাবাক্যে তাকিয়ে আছে অনু।
একটুখানি থেমে প্রত্যয় পুনরায় কঠিন সুরে বললো,
--- আর কি যেন বললে, ইউজ। ইউজ করা কাকে বলে সেটা কি আদৌও বোঝো তুমি? নাকি বুঝেই যাকে তাকে গিয়ে এসব বলো?
অনু এবারও পুরোপুরি নিশ্চুপ, ও ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে প্রত্যয়ের চোখে।
অনুকে তখন থেকে এভাবে অবাক নয়নে চেয়ে থাকতে দেখে রা'গী আওয়াজটা মূহুর্তেই নিচু হয়ে গেলো প্রত্যয়ের, চোখ দুটোতে হিং'স্রতার জ্বল'ন্ত অ'ঙ্গার দপ করে নিভে গিয়ে তাতে জড়ো হলো একরাশ মুগ্ধতা। এলোমেলো অনুভূতি গুলো উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে আঁচড়ে পরছে মনের তটে। অনু এতোটা কাছে দাড়িয়ে আছে, এতোটা কাছে,যে ওর তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো প্রত্যয়ের মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পরছে বারেবারে ।এবার আর কোনো কথা নয় অনুর নিস্প্রভ চোখে একপলক চোখ রেখে প্রত্যয় নিজের খেইর হারিয়ে ফেললো। মূহুর্তেই নিজের ওষ্ঠাগত করে নিলো অনুর তিরতির করে কাঁপতে থাকা অধর যুগল। অনুর ঠোঁটের ছোঁয়ায় হঠাৎ করেই যেন উন্মাদনা ছড়িয়ে পরলো প্রত্যয়ের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনুর দিক থেকে কোনোরূপ বাঁধা না আসাতে, পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো আপনা আপনি।
এদিকে প্রত্যয়ের নরম ঠোঁটের স্পর্শে অনুর জান যায় যায় অবস্থা। খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও পরক্ষণেই দু'হাত দিয়ে প্রত্যয়কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তরিৎ গতিতে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো অনু। অনুর ধাক্কায় প্রত্যয় নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে, নিজের কর্মকান্ডের জন্য লজ্জিত হয়ে নরম সুরে বললো,
--- আ...আ'ম সরি।আসলে..
অনু ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে না ঘুরেই জবাব দিলো,
--- সরি বলতে হবে না আপনি যান এখন।
আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই অনু, একান্তে, আমায় কি একটু খানি সময় দেওয়া যায়না?
অনু এবার ঘুরে দাড়িয়ে প্রত্যয়ের মুখোমুখি হয়ে শুধালো,
--- প্রত্যয় সাহেব, আপনি শুধু আমার তাইতো?
প্রত্যয় সেদিনের মতোই কন্ঠে দৃঢ়তা টেনে বললো,
--- হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
---আগামী কাল বিকেলে সি-বিচে অপেক্ষা করবো।
অনুর এইটুকু আস্কারা পেয়ে প্রত্যয় যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে ওর চোখে মুখে। প্রত্যয়কে এভাবে নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসতে দেখে, অনু ভেতরে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও পেছনে তাকিয়ে বললো,
--- আর হ্যা, বাবল টি আনতে ভুলবেন না যেন।
প্রত্যয়ের নরম হাসি এতোক্ষণে পুরো ঠোঁট জুড়ে প্রসারিত হলো, ও পেছন থেকে হাঁক পেরে বললো,
--- যথাআজ্ঞা মহারানী।
*****************************************
মাঝরাতে ফেইরী লাইটের নিভু নিভু আলো আর সুইমিং পুলের নীলচে পানির কলকলানি মিলেমিশে পুরো ছাঁদ বারান্দা জুড়ে ম্যাজিক্যাল আলোছায়া তৈরি করেছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, আকাশে রুপোর থালার মতো মস্তবড় চাঁদ উঠেছে । কখনো কখনো সেই চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে, পেঁজা তুলোর মতো উড়ো মেঘে। আবার কখনো তীর্যক রুপোলী আলো ছড়াচ্ছে,পুরো ভুবন জুড়ে।
চাঁদের দিকে নিকোটিনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেটাই তখন থেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে পরখ করছে ক্রীতিক। রাত প্রায় দু'টো বেজে পয়ত্রিশ তাও চোখের পাতায় ঘুম আসার নাম নেই, তাইতো রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদ বারান্দায় এসে সিগারেট ধরিয়েছে সে। সিগারেটের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার সাথে সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে নিজের মনে জমানো অজস্র অযাচিত ভাবনা গুলোকে, অবশ্য এখন আর ভেবে লাভটাই বা কি?অরু তো সারাজীবনের জন্য ওর।
অরু নামটা ভাবতে যতটা দেরি হলো অরুর সেখানে উপস্থিত ততটা হতে দেরি হলোনা। নিশুতি রাতে কারও নিস্তব্ধ পায়ের আওয়াজ পেয়ে ক্রীতিক পেছনে ঘুরে দেখলো অরু দাঁড়িয়ে আছে। পরনে খয়েরী রঙের সুতির চুড়িদার লম্বা চুল গুলো দিয়ে টুপটাপ করে পানি ঝড়ে শরীর ভিজে যাচ্ছে, তাতেও হেলদোল নেই অরুর, চোখে মুখে চড়ম বি'ষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। হাত পায়ের ফর্সা ত্বকগুলো ফ্যাকাসে হয়ে কুঁচকে আছে, মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে পানিতে ভিজেছে, অরুর এমন উদভ্রান্তের মতো মুখশ্রী দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
--- এতো রাতে শাওয়ার কেন নিয়েছিস? কি প্রয়োজনে?
অরু জবাব দেয়না, চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে, ক্রীতিকের পরনে কালো হুটি আর ওভার সাইজ ডেনিম। অরু নিস্প্রভ চোখে ক্রীতিকের কালো কুচকুচে হুডিটার দিকে চেয়ে আছে চুপচাপ , ওর কর্মকান্ড দেখে ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
--- এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি? আমার সাথে ঘুমাবি? ঘুমালে চল আমিও একটু আরাম করে ঘুমাই।
ক্রীতিকের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু-হাত দিয়ে ওর পেশিবহুল বুকের উপর ধা'ক্কা দিয়ে অরু কাঁদতে কাঁদত বললো,
--- কেন করলেন এটা? কি দোষ করেছি আমি? কোন দোষের শা'স্তি সরূপ আমার জীবনটা এভাবে তছনছ করে দিলেন আপনি? বলুন কেন? কি হলো বলুন?
এবার, দু'বার, তিনবার যখন ক্রীতিকের বুকের উপর অরু ধা'ক্কা দিতে যাবে, তখনই ওর দু'হাত শক্ত করে চেপে ধরে ক্রীতিক। চেহারায় গাম্ভীর্য টেনে এনে, কঠিন সুরে বলে,
--- যা করেছি, খুব ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় করেছি, এবার এটা যত তারাতাড়ি মেনে নিবি ততই তোর জন্য মঙ্গল।
ক্রীতিকের কথায় অরু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
--- আপনি কি পা'গল? আপনার বাবা জামশেদ জায়ান চৌধুরী আমার মায়ের প্রয়াত স্বামী। সে হিসেবে আপনি আমার সৎ ভাই, কিভাবে ভুলে গেলেন এটা?
অরু কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক টান মে'রে একহাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে শ'ক্ত করে ওর গালদুটো চে'পে ধ'রে বললো,
--- খবরদার নিজেকে আমার বোন বলবি না, একদম মে'রে ফে'লবো, তুই আমার বিয়ে করা বউ, তোর সব কিছু আমার, তোর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এভরিথিং ইজ বিলোংস টু মি।
তীব্র রা'গে কাঁপতে কাঁপতে কথাটুকু শেষ করে অরুকে ধা'ক্কা মে'রে সরিয়ে দেয় ক্রীতিক।
ক্রীতিক ছাড়তেই অরু কাঁ'দতে কাঁ'দতে মেঝেতে বসে পরে, অতঃপর হেঁচকি তুলে অস্পষ্ট সুরে বলে,
----সমাজ কোনোদিনও এই বিয়েকে সীকৃতি দেবেনা।উল্টে আমাকে নোং'রা বলে ধি'ক্কার দেবে।তখন নিশ্চয়ই খুশি হবেন আপনি?
ক্রীতিক হাঁটু গেড়ে ওর মুখোমুখি হয়ে বসে বললো,
--- আমি সমাজ মানিনা, আর যে সমাজ আমার বউয়ের দিকে আঙুল তুলে কথা বলবে আমি সেই সমাজই ধ্বং'স করে দেবো। আই রিপিট ধ্বং'স করে দেবো।
ক্রীতিকের কথা শুনে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু, চোখ তো নয় যেন জ্ব'লন্ত আগ্নে'য়গিরির দাবানল। যে তাকাবে সেই ভস্ম হয়ে যাবে। অথচ ফর্সা পুরুষালী তীক্ষ্ণ চোয়াল জোড়া মুখশ্রীটা কতোটাই না সুদর্শন। এক মূহুর্তের জন্য অরুর মনে হলো, এই অসম্ভব সুদর্শন মানুষটা ওর স্বামী, হুট করেই কেমন ক্রীতিককে অন্য নজরে আবিষ্কার করছে অরু। কয়েক মূহুর্তের জন্য নিজেকে বসিয়ে দিলো ক্রীতিকের বাম পাশে তার পত্নী রূপে। পরবর্তীতেই অন্যমনটা লাফিয়ে উঠে বললো,
---না না এটা কি করে সম্ভব? এমন একটা রা'গী বদ মেজাজী, বেপরোয়া লোকের সাথে সারাজীবন কাটানো অসম্ভব।
কারন আর যাই হোক সারা জীবন ক্রীতিকের হাতে মা'র খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই অরুর।
--- কি হলো?
হঠাৎ করে ক্রীতিকের কথায় ধ্যান ভাঙে অরুর, বেরিয়ে আসে নিজের দিবাস্বপ্ন থেকে। ছোট্ট করে জবাব দেয়,
--কিছু না।
ক্রীতিক ওর ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আসস্থ করে পুনরায় বলে,
--- অনেক রাত হয়ে গিয়েছে ঘুমিয়ে পর। চিন্তা নেই পুরো দুনিয়া আমি দু'হাতে সামলে নেবো, তোর গায়ে কল'ঙ্কের আঁচও আসতে দেবোনা, এটুকু ভরসা রাখতেই পারিস,হার্টবিট।
ক্রীতিকের শেষ কথাতে অরু চকিতে মাথা তুলে বললো,
--- কিহ!
---বলেছি তুই আমার হার্টবিট।
...আআ, অরু কিছু বলবে তার আগেই ওর দিকে চোখ পাকিয়ে ক্রীতিক বললো,
--- আর একটাও প্রশ্ন করবিনা, তাহলে মা'র খাবি।
অপারগ অরু আর কিইবা করবে, মা'রের ভয়ে চুপচাপ পা বাড়ায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে।
ক্রীতিক অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার বিড়বিড়ায়,
--- হার্টবিট।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ২৩
নির্ঝঞ্জাট বিদ্যাপিঠ সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি। সানফ্রান্সিসকোর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত এবং নামকরা হওয়াতে এই ভার্সিটিতে ফরেইনার শিক্ষার্থীদের অভাব নেই। সেই সাথে সাথে ফরেইনার প্রফেসরদেরও। তবে আজ ভার্সিটি ক্যাম্পাসে খুব একটা শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই। এর কারন শীতের শেষ ভাগ চলছে যার দরুন সবাই সি'বিচ, জঙ্গল, পাহাড়, এথায় সেথায় ক্যাম্পিং এ গিয়েছে।
এখানকার শিক্ষার্থীরা বইয়ের পাতায় নয়, হাতে কলমে, কিংবা পর্যবেক্ষন করেও অনেক কিছু শেখে। সারাবছর তাদের ক্লাসরুমের বাইরেও অনেক কার্যক্রম থাকে। অরুও বিগত কয়েকমাসে অনেক কিছুই শিখেছে, অনেক কিছু লক্ষ করেছে,ভালোমন্দ দুটোই। আমেরিকার সংস্কৃতির মধ্যে এমন অনেক কিছুই আছে যা শুনলে বা দেখলে গা ঘিনঘিন করে ওঠে, তার মধ্যে নিখিল ভাইয়ের রিলেশন শীপ অন্যতম। এখনো ক্রীতিকের বলা কথাগুলো মনে পরলে নাক সিকোয় উঠে যাচ্ছে অরুর।
ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে, নরম সবুজ ঘাসগুলোকে পায়ে মারাতে মারাতে হিজিবিজি ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে অরু। ওর পরনে চিকন কারীর সফেদ রঙের লং কুর্তি আর লেগিংস। কুর্তির উপরে এটে আছে লেডিস ডেনিম জ্যাকেট। লম্বা চুলগুলো পোনিটেল করে গার্ডার নিয়ে বাঁধা। ধীরগতিতে হাঁটার জন্য মাথাটাও নিচু হয়ে আছে সেই কখন থেকে।ওই জন্যইতো সায়নী যে সেই কখন থেকে ওর সাথে সাথে হাঁটছে অরুর তাতে হদিস নেই। এতোক্ষণ ধরে পাশেপাশে হাঁটার পরেও মেয়েটা একবার মাথা তুলে তাকালো না অবধি, কি এমন ভাবছে ও? মনেমনে বিরক্ত হয়ে, সোজা গিয়ে অরুর সামনে দাড়িয়ে খানিকটা গাল ফুলিয়ে সায়নী জানালো,
--- কি এমন ভাবছো বলোতো? সেই তখন থেকে তোমার সাথে সাথে হাঁটছি খেয়ালই করছো না।
অরু চট করে ভ্রম থেকে বেরিয়ে মাথা তুলে বললো,
--- আরে সায়নী যে, কেমন আছো বলো?
--- এতোক্ষণে জিজ্ঞেস করার সময় হলো?
--- আ'ম সরি, একটু বেখেয়ালে ছিলাম।
সায়নী এবার বুঝতে পারার মতো করে হ্যা সূচক মাথা দুলিয়ে বললো,
--- ইট’স ওকে, কিন্তু তুমি এতোদিন কই ছিলে?
কতদিন ক্যাম্পাসে আসোনা বলোতো?
সায়নীর কথায় অরুর মনে পরে যায়, সেই নিখিল ভাইয়ের সত্যি জানার পর থেকেই আর ভার্সিটির গেইট মারায়নি ও, তারপর আরও কত কিই'না হয়ে গেলো,জীবনটাই এখন এলোমেলো।
--- আবার কি ভাবতে বসলে?
অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বললো,
--- কিছু না।
সায়নী এবার হাসির দ্বারা ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,
--- এ্যাই অরু, জেকে স্যারের কি খবর?
অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
--- ওনার কথা আমি কি করে জানবো, ওনাকে গিয়েই বরং জিজ্ঞেস করো।
সায়নী এবার ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো,
--- তুমি ওনার স্টেপ সিস্টার ,তুমি জানবে নাতো কে জানবে? ঢং।
সায়নীর কথায় অরু কিঞ্চিত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, পরক্ষণেই সায়নী আবারও শুধালো,
--- বলোনা একটু, এতোদিন স্যার ভার্সিটিতে কেন আসেনি?
--- আমি যতদূর জানি উনি ব্যাংকক গিয়েছিলেন।
অরুর উত্তর শুনে সায়নী বেশ খুশি হয়ে যায়, খুশি হয়ে অরুর হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
--- এই না হলে আমার ননদিনী, তুমি জানো জেকে স্যারকে আমি অনেক পছন্দ করি, কিন্তু বলার সাহস হয়ে ওঠেনা, শুনেছি ব্যাক্তি জীবনে উনি অনেক বেশি রাগী,আসলেই কি তাই?
সায়নীর কথার বিপরীতে অরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর চোখ আটকে যায় ক্যাম্পাসের অন্যপাশে পুলসাইডে কিছু মানুষের ভীরের মাঝে, সেখানে নিখিল ভাই ও উপস্থিত। তারা সবাই কোনো কিছু একটা নিয়ে বেশ উল্লাসে মেতে আছে। কিন্তু কি নিয়ে? অগত্যাই সায়নীর দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন ছোড়ে অরু,
--- আচ্ছা সায়নী ওখানে কি হচ্ছে?
সায়নী অরুর দৃষ্টিপাত অনুসরণ করে,সেদিকে একবার তাকিয়ে বললো,
--- সাইন্টিস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে বাংলাদেশী নিখিল ভাই ওদের গ্রুপের টীম লিডার হয়েছে, সেটারই সেলিব্রেশন করছে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে।
--- ওহ আচ্ছা।
অরুর কথার মাথায় সায়নী অবিশ্বাসের সুরে বলে,
--- হি ইজ আ ভেরি ট্যালেন্টেড গাই। কত অল্প সময়েই কেমন টীম লিডার হয়ে গেলো। তারউপর দুই দুইটা সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড সবদিক থেকে সোনায় সোহাগা, আহা।
অরু মুখ ভঙ্গিমায় বিরক্তির ছাপ টেনে বললো,
--- একজন মানুষের আবার দুইটা গার্লফ্রেন্ড হয় কেমন করে?
সায়নী কুটকুটিয়ে হেঁসে বললো,
--- হয় হয়, আমেরিকাতে সব হয়, চাইলে তুমিও....
সায়নীর কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই,পেছন থেকে ডেকে উঠল কেউ,
--- অরোরা!
অরু জানে এটা কে হতে পারে, এই পুরো ক্যাম্পাসে অরোরা বলে ওকে একজনই ডাকে। কিন্তু ও এখন কিছুতেই এই মানুষটার মুখোমুখি হতে চায়না, তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে, না শোনার ভান করে চোখ খিঁচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।
সায়নী পেছনে ঘুরে বললো,
--- আরে নিখিল ভাই যে আপনি অরুকে চেনেন?
নিখিল হ্যা না কোনো উত্তর না দিয়ে স্মিত হেসে অরুর দিকে তাকিয়ে পুনরায় ডাকলো,
--- অরোরা?
সায়নী সামনে দাড়িয়ে আছে,নিখিল ও এগিয়ে এসেছে, এবার আর ইগনোর করার সুযোগ নেই পেছনে ঘুরতেই হবে, কিছু করার নেই ভেবে নিখিলের মুখোমুখি হতে যাচ্ছিল অরু, এখনো পেছনে ঘোরেনি, ঘুরবে ঘুরবে ভাব, ঠিক তখনই কোত্থেকে যেনো বাজখাঁই কর্কষ আওয়াজ কানে ভেসে এলো ওর,
--- অরুউউউ।
আচমকা ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে কেঁপে উঠলো অরু, তরিৎ গতিতে চোখ দুটো খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো তাকে, খানিক্ষন খোজাখুজির পর দেখলো ভবনের দোতলার অফিসরুমের করিডোরে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক। ক্রীতিকের চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে সায়নীকে উদ্দেশ্য করে অরু বলে,
--- চলো ক্লাসে যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এই বলে সায়নীর হাত ধরেই দ্রুত ক্লাসের দিকে পা বাড়ায় অরু।
পেছন থেকে নিখিল ডেকে বললো,
--- আরে অরোরা কথাটাতো শুনে যাও। নিখিল এখনো অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে, তখনই অন্যদিক থেকে একজন এসে নিখিলের উদ্দেশ্যে বলে,
--- আরে ভাই তুমি এখানে, তোমার গার্ল ফ্রেন্ডদের কেউ ধা'ক্কা মে'রে পুলে ফেলে দিয়েছে। একটাও তো সাঁতার জানেনা, দু’টোই হাবুডুবু খাচ্ছে ।
নিখিল আশ্চর্য হয়ে বললো,
--- কি বলছো? কে ফেললো?
---তাতো জানিনা, ভীরের মাঝে কে কাকে ধা'ক্কা দিয়েছে বলা মুশকিল, তুমি তারাতাড়ি যাও।
নিখিল হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে।
অরু, সায়নী, নিখিল সবাই যে যার মতো চলে গিয়েছে, যার ফলে নরম ঘাস আবৃত্ত যায়গাটা শূন্যই পরে আছে, দোতলার করিডোর দিয়ে ক্রীতিক এখনো সেই শূন্যস্থানের দিকে তাকিয়েই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে।
*****************************************
পায়ের স্যান্ডেল দুটো আঙুলের ভাঁজে নিয়ে খালি পায়ে সাগরের কোল ঘেঁষে হাটছে অনু। প্যান্টটা একটুখানি গুটিয়ে গোড়ালি থেকে উপরে তুলে, প্রত্যয়ও অনুর পাশাপাশি হাঁটছে । সাগর পারের চারিদিকে শঙ্খচিল আর পানকৌড়ির চিউ চিউ আওয়াজ, অনু বাবল টিতে একটা করে সিপ নিচ্ছে আর চোখ বন্ধ করে পাখির কলরব শুনছে। সেই কখন থেকে ওদের মাঝে নিরবতা বিরাজমান, অনেকক্ষণের নিরবতা ভেঙে সর্বপ্রথম প্রত্যয়ই বলে ওঠে ,
--- তুমি না মানে আপনি, ভারী অদ্ভুত জানেন? কখন যে রে'গে যান, আর কখন যে ঠান্ডা হয়ে যান আমি নিজেই বুঝতে পারিনা, এতো মুড সুইং কেন হয়?
প্রত্যয়ের কথায় অনু শব্দ করে হেসে বললো,
--- ইউ ক্যান কল মি "তুমি"। এতো ইতস্তত কেন হচ্ছেন? আফটার অল উই কিসে'স ইচ আদার।
অনুর কথায় কালকের দৃশ্যপট ভেসে উঠলো প্রত্যয়ের চোখে, ও তৎক্ষনাৎ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
--- ইয়ে মানে তোমার কিছু জানার নেই?
অনু গম্ভীর গলায় বললো,
--- হুম আছেতো, অনেক কিছু জানার আছে,
প্রত্যয় শুধালো,
--- বলো কি জানতে চাও? সব বলবো তোমায়।নো লুকোচুরি।
---আমাকে ইউজ করা কেন হলো শুনি?আপনার লং টাইম লাভ হিস্ট্রি। তাহলে আমার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করারই বা কারনটা কি?
অনুর অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে দেওয়ার জন্য প্রত্যয় একটু রয়েসয়ে বললো,
---প্রথমত তিন্নি আমার সাথে ভালোবাসার হাজারো প্রতিস্রুতি দিয়ে বছরের পর বছর চি'ট করেছে, জামাকাপড়ের মতো সুগার ড্যাডি চেঞ্জ করেছে, তাহলে ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা রইলো কোথায়? তাছাড়া ও হাইলি ড্রা'গ এডিক্টেড। এক কথায় বলতে পারও ওর জীবনে শুদ্ধ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এসবের কারনে তিন্নির প্রতি আমার ঘৃ'ন্য মনোভাব তৈরি হয়েছে আরও কয়েকবছর আগেই। আর এখন তো ওকে মনে রাখার প্রশ্নই ওঠেনা। ওকে মাঝে মধ্যেই আমার পা'গল মনে হয়, জানো? এতোদিন খবর ছিলোনা, যেই আমি বছর খানিক ধরে একটু মুভ অন করেছি। এখন আবার আঠার মতো পেছনে লেগে আছে। ওর কাজই বোধ হয় আমার জীবনটাকে অগোছালো করে দেওয়া। তবে হ্যা এরপর ও যদি দ্বিতীয়বার এমন কিছু করে আমি যথাযথ ব্যাবস্থা নেবো, আই প্রমিস।
একটুখানি থেমে বুকের ভেতরের চাপা নিঃশ্বাসটা উগড়ে দিয়ে, প্রত্যয় আবারও বলে,
---এবার তুমি যদি বলো তুমিই কেন? সেটার উত্তর আমার জানা নেই। তোমাদের ভিসা টিকেট প্রসেসিং এ অসংখ্যবার তোমার ছবি দেখেছি আমি, তেমন কিছুই ফিল হয়নি, কিন্তু সেদিন ক্যাফেতে তোমার এক ঝলক হাসির মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। উত্তাল ঢেউয়ের পানে চেয়ে একমনে কথাগুলো বলে অনুর দিকে তাকিয়ে প্রত্যয় শুধালো,
--- প্রেম তো অনেকের সাথেই হয়, ভালোবাসার মানুষ কয়জন হতে পারে বলো? অনু, তুমি কি আমার শেষ ভালোবাসা হবে?
--- জানিনা।
প্রত্যয়ের মুখের উপর কথাটা বলে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট কামড়ে মুখ টিপে হাসছে অনু।
প্রত্যয় ওর পেছন পেছন হেঁটে এসে বললো,
--- এ্যাই মেয়ে, এতো মুড সুইং হয় কেন তোমার?
অনু পেছনে ঘুরে শুধালো ,
--- কেন ভ'য় করছে? সামলাতে পারবেন না?
প্রত্যয় ওর হাতের মাঝে হাত ঢুকিয়ে বললো,
--- তুমি বিশ্বাস হয়ে থেকে গেলে, আমি নিঃশ্বাস দিয়ে হলেও সামলে নেবো।
*****************************************
গোধূলি বেলা চলমান, তবে আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাবস্যা রাত। পুরো আকাশ ঘুটঘুটে কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে ক্ষনে ক্ষনেই পশ্চিম আকাশ র'ক্তিম হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তারসাথে বাতাসের তান্ডব তো আছেই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে সেই বিকেল থেকেই রাতে বোধ হয় ঝড় আসবে।
ভার্সিটির গেইটের সামনে একটা কাক পক্ষিও অবশিষ্ট নেই। সবাই যে যার মতো চলে গিয়েছে। শুধু মাত্র অরুই ছাতা হাতে নিয়ে সেই কখন থেকে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বাসের এখনো সময় হয়নি, কিন্তু এই ঝড়ের মাঝে শেষ বাস আসবে কিনা সন্দেহ। ওদিকে বৃষ্টির তোপ ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে, হাতে ছাতা থাকা সত্বেও পায়ের দিকটা ভিজে গিয়েছে। অরু হাত দিয়ে জামা কাপড় থেকে বারবার বৃষ্টির পানিগুলো ঝেড়ে সরাচ্ছে। তখনই বিকট আওয়াজে হর্ন বাজিয়ে ভার্সিটির গেইট থেকে বের হয়, ক্রীতিকের কালোরঙা মার্সিটিজ। বাইরে ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি। ক্রীতিক অরুর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, জানালার কাঁচ নামিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
--- উঠে আয়, রাত হলে ঝড় আরও বাড়বে আজ আর বাস আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
থাইল্যান্ড থেকে আসার পর থেকেই ক্রীতিকের উপর মহা বিরক্ত অরু, না পারতে কথা বলেনা। এখনো বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই ও দাঁড়িয়ে না থেকে চুপচাপ হাঁটা ধরে বৃষ্টিস্নাত রাস্তার ফুটপাত ধরে। কেন যেন মনের মাঝে জিদ চেপে বসেছে, ক্রীতিকের কথাটা কিছুতেই শুনবে না আজ। সবসময় ক্রীতিকের জিদের কাছে পরাজিত হয়ে ক্লান্ত অরু। ক্রীতিকের জিদের বসে করা কর্মকান্ড মনে পরতেই হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ও। পায়ের জুতা পানিতে ভিজে জপজপ আওয়াজ হচ্ছে, তবুও হনহনিয়ে হাঁটছে অরু। তবে বেশিদূর এগোনোর আগেই পেছন থেকে ওর ছাতাটা টান মে'রে নিয়ে নেয় ক্রীতিক। মাথার উপর থেকে ছাতা সরে যাওয়ায় কয়েকমূহুর্তের মাঝেই ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে যায় অরু। ক্রীতিক ও তাই, ফর্মাল ড্রেসআপ, ব্ল্যাক সুজ,রিস্টওয়াচ সবকিছু ভিজে একাকার। হুট করে ছাতা কেড়ে নেওয়াতে অরু, ভ্রু কুঁচকে পেছনে ঘুরে দেখতে পায়, ওর হ্যালো কিটি ছাতাটার বেহাল দশা করে ছেড়েছে ক্রীতিক। সেটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভে'ঙে ডাস্টবিনে ছু'ড়ে মে'রে ক্রীতিক বললো,
--- এবার যা।
অরুও কম যায়না, ক্রীতিকের বাক্য শ্রবনের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মাঝেই হাটা ধরে সামনের দিকে, তবে দ্বিতীয়বার স্পর্ধা দেখিয়ে আর পার পেলোনা অরু, সামনের দিকে এককদম দিয়েছে কি দেয়নি তার আগেই ওর বুকের কাছের জামাটা খামচে ধরে ক্রীতিক।এভাবে হঠাৎ আ'ক্রমণে কেঁপে উঠে অরু হকচকিয়ে বলে,
--- কি করছেন জামাটা ছিড়ে যাবে তো।
ক্রীতিক ওর কথায় পরোয়া না করে, অরুর চোখের দিকে নিজের বাঁজপাখির মতো তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
--- কথা শুনছিস না,অনেক সাহস বেড়ে গিয়েছে দেখছি,আমার সামনে তেজ দেখাতে এলে, সোজা গাড়িতে নিয়ে বাসর সেরে ফেলবো। আর তুই এটা ভালো করেই জানিস, আমি যা বলি তাই করি, তাই নিজের ভালো চাইলে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বস।
ক্রীতিকের লাগামহীন কথার পাছে গলার স্বর মূহুর্তেই ক্ষীণ হয়ে এলো অরুর। বরাবরের মতো এবারও ক্রীতিকের জিদের কাছে হেরে গিয়ে ভেজা শরীর নিয়ে চুপচাপ গাড়িতে বসে পরলো ও। অরু গাড়িতে বসতেই ক্রীতিক এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
বাইরের বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজ গাড়ির হাই কোয়ালিটির জানালা ভেদ মোটেই ভেতর আসতে পারছে না। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা, শুধু একটু পরপর নিরবতা ভেঙে সশব্দে হাঁচি দিচ্ছে ক্রীতিক। হাঁচি দিতে দিতে চোখ, নাক লালচে বর্ণ ধারণ করেছে তার। সেই কখন থেকে মানুষটা একাধারে হাঁচি দিচ্ছে দেখে অরু একটু আগ বাড়িয়ে বলে,
--- বৃষ্টিতে ভিজে আপনার ঠান্ডা লেগে গেলো বোধ হয়।
ক্রীতিক আবারও হাঁচি দিতে যেয়ে নিজেকে সংবরণ করে বলে,
--- গত দুদিন ধরে জ্বর। তাই হয়তো বৃষ্টির পানিতে পুনরায় ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।
ক্রীতিকের কথায় অরু বেশ অবাক হয়, একই বাড়িতে থাকে ওরা তিনজন, অথচ একটা মানুষের গত দুদিন ধরে জ্বর, ওরা সেটা জানেই না। আর ক্রীতিকই বা কেমন,জ্বর হলে মানুষ এতোটা সাভাবিক কি করে থাকতে পারে? মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে মানুষটার শরীর খারাপ, সবসময় সেই রা'গী রা'গী ভাব।
*****************************************
উত্তাল প্রকৃতি রাত বাড়ার অপেক্ষা করেনি আর।সন্ধ্যা রাতেই শুরু করে দিয়েছে তীব্র ঝড়ের তা'ন্ডব। অনুর সাথে মাত্রই কথা হলো অরুর, সেও ঝড়ের মাঝে কোনো এক ক্যাফেতে আটকা পরেছে,সাথে অবশ্য প্রত্যয় আছে চিন্তা করার কারন নেই।
অনুর সাথে কথা হওয়ার পরপরই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। এভাবে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অরু একটু ভরকে গেলো। অন্য সময় বিদ্যুৎ গেলেও বাইরে থেকে আসা সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত থাকে হলরুম। অথচ আজ নিকোশ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্যাপারটা বোঝার জন্য কাঁচের দেওয়ালে উঁকি দিতেই অরু দেখতে পায়, বাড়ির বাইরের রাস্তায় কোথাও একফোঁটা আলো নেই। হয়তো ঝড় বৃষ্টিতে কোথাও বৈদ্যুতিক তাড় বিচ্যুত হয়ে এমনটা হয়েছে। কিন্তু এই মূহুর্তে চারিদিকের এমন তীব্র অন্ধকারে অরুর কেমন গা ছমছম করছে। ও কোনোমতে অন্ধকারে সিঁড়ি হাতরে ক্রীতিকের রুমের দিকে পা বাড়ায়। ক্রীতিক রুমেই আছে, অথচ ওর রুমটাও পুরোপুরি তিমিরে ঢাকা। একটু সময় নিয়ে খুজতে খুজতে ক্রীতিকের রুমের দরজার বাইরে কয়েকবার টোকা মে'রে অরু মিনমিনিয়ে বললো,
--- একটু ফোনের ফ্ল্যাশটা অন করবেন ভ'য় করছে।
অরু বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে বললো,
--- ভেতরে আয়।
অরু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই মৃদু আলোতে দেখতে পায় ক্রীতিক কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর গতানুগতিকের চেয়ে একটু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অরু জানে ক্রীতিক কখন এমনটা করে, তাই ও এগিয়ে গিয়ে শুধালো
--- জ্ব'র বেড়েছে? আমি কি একটু চেক করে দেখবো?
ক্রীতিক হাস্কি স্বরে জবাব দিলো,
--- নিষেধ করেছি?
অরু এবার একটু সংকোচ নিয়ে ক্রীতিকের কপালে হাত ছোঁয়ায়,অতঃপর বলে,
--- আপনার অনেক জ্বর কি করে ঠিক আছেন বলুন তো?
কথাটা বলে অরু মোবাইল হাতে নিয়ে উঠতে নিলে, ক্রীতিক নিজের তপ্ত হাত দিয়ে অরুর হাত টেনে ধরে শুধায়,
--- কোথায় যাচ্ছিস?
অরু পেছন ঘুরে বলে,
--- কাপড় ভিজিয়ে নিয়ে আসছি, মাথায় জলপট্টি দিলে ভালো লাগবে ততক্ষণ একটু অন্ধকারে থাকুন।
.
সন্ধ্যারাত গড়িয়ে ঘড়ির কাটা গিয়ে ঠেকেছে রাত দশটার কোঠায়। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। আর না অনু ফিরেছে । অরু সেই যে ক্রীতিকের শিওরে বসেছে এখনো বসেই আছে। বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজে চোখদুটো ভার হয়ে এসেছে ঘুমে। এবার মনে হচ্ছে যাওয়া দরকার, তাই ও ক্রীতিকের মাথার জলপট্টিটা উল্টে দিয়ে বললো,
--- আমি এখন যাই, ঘুম পেয়েছে।
তৎক্ষনাৎ ওর হাতটা শ'ক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই ক্রীতিক বলে,
--- কোথাও যাবিনা, এখানেই বসে থাক।
--- বৃষ্টি কমেছে, বিদ্যুৎ, আপা দুটোই চলে আসবে। তাছাড়া আমার ঘুম পেয়েছেতো।
ক্রীতিক অরুর কথায় তোয়াক্কা না করে বললো,
--- ঘুমাতে হবেনা।আমি বলেছি তুই যাবিনা, তার মানে যাবিনা, নয়তো সবাইকে বলে দেবো তুই আমার বউ।
অরু দাঁত কিরমির করে বিরক্ত হয়ে বললো,
--- ব্লা'কমেইলটা আপনি খুব ভালোই করতে পারেন, সব আমাকে শা'স্তি দেওয়ার ধান্দা।
ক্রীতিকের সাথে কথায় না পেরে, অগত্যাই অরু ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়ে টলতে টলতে ক্রীতিকের কাছেই বসে থাকে।
*****************************************
একটা শ্বাসরু'দ্ধ কর পরিস্থিতিতে পরে খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে অরুর। কেমন যেন গরম লাগছে সবকিছু, গলার কাছে গরমটা একটু বেশিই লাগছে। চোখ দুটো তখনও খোলেনি ও। তবে আশেপাশের সুঘ্রাণটা বারবার নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, চন্দনকাঠের স্নিগ্ধ মন মাতানো সুবাস। একটা লম্বা শ্বাস টেনে সুবাসিত বাতাসটা ভেতরে পুরে নিয়ে নড়েচড়ে ওঠে অরু। কিন্তু একি নড়াচড়ার করার কোন উপায়ন্তর নেই। মনে হচ্ছে হাত পা কেউ বে'ধে রেখেছে। কিন্তু কে দেখাবে এই দুঃসাহস?নিজেকে এভাবে বাঁধনে আবিষ্কার করে, আচমকাই চোখ খোলে অরু। চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া দুলে ওঠে ওর।
অরু ক্রীতিকের বিছানায়, ক্রীতিকের সাথে ঘুমিয়ে আছে। ক্রীতিক নিজের হাত পা দিয়ে অরুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। অরুর লম্বা চুলগুলো ক্রীতিকের কালো টিশার্টের সাথে মিলেমিশে একাকার। এভাবে ক্রীতিকের পাশে নিজেকে আবিষ্কার করে অরু ঘাবড়ে গিয়েছে। মনেমনে ভাবছে,
--- আপা জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, আমার এক্ষুনি চলে যাওয়া উচিৎ।
ক্রীতিকের পিঠের নিচ থেকে নিজের চুলগুলো আস্তে করে টেনে বার করতে করতেই অরুর চোখ চলে যায় ক্রীতিকের ঘুমন্ত মুখের দিকে, এতো রা'গ, এতো জিদ, এতো বেপরোয়া সভাব কোনোকিছুর লেশমাত্র নেই ঘুমন্ত মুখটাতে। এখন যা রয়েছে সেটা কেবলই আকর্ষন, যে কেউ এই ঘুমন্ত মুখটা দেখলে তীব্র আকষর্ন অনুভব করবে। কি সুন্দর চেহারা, মাসআল্লাহ। ঘুমের মাঝে ক্রীতিক খানিকটা নড়েচড়ে উঠতেই ভ্রম ছুটে যায় অরুর। ও দ্রুত বিছানা ছেড়ে চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বেড়িয়ে যায়।যাওয়ার আগে কি ভেবে যেনো আরও একবার ফিরে এসে, ঘুমন্ত ক্রীতিকের কপালে হাত ছোঁয়ায়। অতঃপর মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,
--- যাক তীব্র জ্ব'রটা কমে গিয়েছে, এখন আমি দ্রুত ভাগি।
.
রুমে আসতেই পা'দুটো থমকে যায় অরুর, আপা এখনো ঘুমিয়ে আছে, এই ফাঁকে কিছু একটা অজুহাত বানাতে হবে, কিন্তু বানানো যায়?
অরু যখন অজুহাত ভাবতে ভাবতে দাঁত দিয়ে নখ কাঁ'টায় ব্যাস্ত, তখনই আড়মোড়া ভেঙে অনু বলে,
--- কিরে এতো সকালে আবার কোথায় যাচ্ছিস?
অরু ধরা পরে যাওয়া চো'রের মতো আমতা আমতা করে বলে,
--- ককোথাও না এখন আবার কোথায় যাবো।
অরুর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে অনু পুনরায় শুধালো,
--- হ্যারে, কাল কখন এসেছিলি ঘুমাতে?
অরু ভ্রু কুঁচকে বলে,
--- কোথা থেকে আসবো?
-- আরে তুই'তো কাল রাতে ক্রীতিক ভাইয়ার মোবাইল থেকে ম্যাসেজ দিলি আমায়, তুই নাকি পড়ছিস, খুবই ইম্পর্টেন্ট টপিক ঘুমাতে দেরি হবে। ওই জন্যই তো তোকে আর ডিস্টার্ব করিনি, রুমে এসে ঘুমিয়ে পরেছি।
অরু এতোক্ষণে বুঝলো ওর হয়ে ক্রীতিক ম্যাসেজ করেছে অনুকে। এবার ও একটু সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
--- হ্যারে আপা, অনেক কঠিন পড়া ছিল, ওই জন্যই তো ক্রীতিক ভাইয়ার রুমে গিয়েছিলাম পড়া বুঝতে। বাড়িতে স্যার থাকলে যা হয় আরকি।
এক নিঃশ্বাসে কথাটুকু শেষ করে নিজের শরীরের গন্ধ নিলো অরু। পুরো শরীর জুড়ে স্যান্ডাল উড পারফিউমের গন্ধ মো মো করছে। যে কেউ কাছে কাছে এলে বুঝতে পারবে এটা ক্রীতিকের শরীরের গন্ধ। অরু উপায়ন্তর ভেবে না পেয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে অনুর উদ্দেশ্যে বললো,
--- আমি একটু শাওয়ার নিয়ে আসছি তুই থাক।
অনু হাই তুলে আবারও ঘুমাতে ঘুমাতে বললো,
--- এতো সকালে শাওয়ার নেওয়ার কি আছে? পা'গল মেয়ে।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ২৪
রোববারের সকাল। যান্ত্রিক জীবনে অভস্ত্য মানুষগুলোর আজ ছুটির দিন। বাইরে প্রখর রোদের পূর্বাভাস। গত কয়েকদিনের বৃষ্টি শেষে আজই বোধ হয় সূর্যের মুখ দেখতে পাবে ধরনী। ভেজা স্যাতস্যাতে পরিবেশ উবে গিয়ে শুকিয়ে যাবে পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তাঘাট। তবে সেই রাস্তায় পদচারণার তাড়া আজ খুব একটা কারোরই নেই। ছুটির দিন বলে কথা।
যেহেতু ছুটির দিন সেহেতু আজ ভার্সিটি নেই। অরু আজ বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে। এতো বেলা করে উঠেও আজকাল চোখদুটো থেকে ঘুম কাটানো বড্ড দায়।কোনোমতে ঢুলুঢুলু পায়ে রোবটের মতো নিজের সকালের কাজ গুলো সেরে অরু চলে এসেছে হলরুমে। বাড়িতে অরু ব্যতিত কেউ নেই। শুধুমাত্র হলরুমের ডিভানে বসে লেজ নাড়ছে ডোরা। ডোরাকে এভাবে ডিভানের উপর বসে থাকতে দেখেই একঝটকায় ঘুম ছুটে গেলো অরুর। চোখের পাতায় কয়েকবার পলক ফেলে দাঁত দিয়ে জিভ কে'টে এগিয়ে গিয়ে ডোরাকে উদ্দেশ্য করে অরু বললো,
--- কি করেছিস ডোরা? এটা জায়ান ক্রীতিকের বসার যায়গা। তুই এখানে বসেছিস জানলে,তোকে আমাকে দুজনকেই ঘাড় ধা'ক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে প্রফেসর জেকে। ঘর বাড়ি হারিয়ে বনবাসী হতে না চাইলে তাড়াতাড়ি নাম।
অরুর তীব্র চোখ রাঙানো ধমকে বোধ হয় কাজ হলো, তৎক্ষনাৎ লেজ নাড়তে নাড়তে যায়গা ত্যাগ করলো ডোরা। ডোরা মুখ কাচুমাচু করে চলে যাওয়াতে অরু সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
--- রাগ করার কি আছে?আমিতো যা সত্যি তাই বললাম। প্রফেসর জেকে কে তো আর তুই চিনিস না, তাই ওমন রাগ দেখাচ্ছিস। আমি চিনি,চিনবো নাই বা কেন বল? ক্লাসে ম্যাক্রোইকোনমিক্স পড়ায় তো।
ডোরা অরুর এতো হাবিজাবি কথা বুঝলো কি বুঝলোনা তা বোধগম্য নয়,সে চুপচাপ গিয়ে লেজ গুটিয়ে অন্যত্র যায়গা দখল করে নিলো।বসে পরলো কিচেন কাউন্টারের একপাশে। ডোরার কার্যক্রম খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষন করে অরুর চোখ গেলো দোতলায় ক্রীতিকের ঘরের দিকে। আজ উইকএন্ড অথচ ক্রীতিক সকাল সকাল বাড়িতে নেই। কোথায় গিয়েছে সেটাও অরু জানেনা। জানার কথাও নয়, তবুও চোখ দুটো আজকাল হুটহাট তার খোজ করে বসে, কেন করে তা জানা নেই অরুর, মন মস্তিষ্কও তাতে একযোগে সায় জানায়,হৃদয়ের কোনোদিক থেকে কোনো বাঁধা নেই। তবুও অরুর ভ'য় হয় ভীষণ ভ'য়, সেই সাথে ক্রীতিকের উপর একরাশ বিরক্তি আর অভিমান তো আছেই,কি করে পারলো ওকে এভাবে জোর করে বিয়ে করতে? ওর মতামতের কি কোনোদাম নেই?
পরক্ষণেই মনে পরে যায় সেদিন রাতে ক্রীতিকের দেওয়া, গম্ভীর হৃদয় নিংড়ানো আশ্বাসটুকু,
---চিন্তা নেই পুরো দুনিয়া আমি দু'হাতে সামলে নেবো। তোর শরীরে কল'ঙ্কের আঁচ ও লাগতে দেবোনা।
কথাগুলো ছিল ভেলভেট মেঘের মতোই মসৃণ , অথচ প্রত্যেকটা কথায় উপচে পরছিল কি ভীষন পুরুষত্ব্য আর কতৃত্ব। যেন ক্রীতিকের জন্মই হয়েছে অরুকে দু-হাতে আগলে রাখার জন্য।সেদিনের বলা প্রত্যেকটা শব্দ তীব্র ঝঙ্কার তুলেছিল অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মাথার মধ্যে উপচে পড়া চিন্তার জলোচ্ছ্বাসেরা মূহুর্তেই গতিপথ বদলেছিল। চোখ বন্ধ রেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল মানুষটা যা বলছে ঠিক বলছে। বিয়েটা যখন জোর করে করেছে তখন দায়িত্ব অবহেলা করার পাত্র জায়ান ক্রীতিক নয়।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে আবারও মনে হতে লাগলো তাতে কি আসে যায়? ক্রীতিক যতই বলুক।ধর্মে যতই প্রাধান্য থাকুক সৎ ভাইয়ের সাথে বিয়ের সম্পর্ক কোনো সমাজই ভালো চোখে দেখবে না,কোনোদিন না, তারউপর মা আর আপাতো আছেই। অরু যখন নিজের অনিশ্চিত বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে, তখনই ল্যান্ড ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ওর ভাবনার সুতো ছি'ড়ে যায়, ক্রীতিকের শূন্য ঘরের দিক থেকে চোখ নামিয়ে অরু তাকায় সেদিকে, মনেমনে ভাবে,
--- ল্যান্ড লাইনে কল এসেছে তারমানে আমার কল। কিন্তু এই সময় কে কল দিলো?
অরু ঠোঁট কামড়ে ফোনের ওপাশের মানুষটাকে আন্দাজ করতে না পেরে সহসা এগিয়ে গিয়ে ফোন কানে ধরলো, ফোন কানে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ভেসে এলো অনুর উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনরত আওয়াজ, গলায় অসম্ভব খুশি আর চোখে অস্রুসীক্ত নোনাজল ধরে রেখে অনু বললো,
--- অরু দ্রুত নার্সিংহোমে চলে আয়, মা তোকে দেখতে চাইছে।
অনুর কথায় চোখ দুটো বড়বড় করে, অরু অবিশ্বাসের সুরে দ্বিতীয়বার শুধায়,
--- কি বলছিস আপা? সত্যিই মা আমাকে খুজছে?
--- হ্যারে বোন মা তোকে খুঁজছে, এলেই দেখতে পাবি।
অনুর সঙ্গে সঙ্গে অরুও এবার ব্যাথাতুর খুশিতে ডুকরে কেঁদে উঠলো , হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---আমি এক্ষুনি আসছি আপা।এক্ষুনি আসছি।
ওর কথায় সায় জানিয়ে অনু কল কেটে দিলে, অরু দ্রুত ব্যাস্ত হয়ে পরে রেডি হওয়ার জন্য। অ'পারেশনের পরে মায়ের জ্ঞান ফিরেছে বেশ কয়েকদিন আগেই, তবে তখনও এতোবড় অপা'রেশনের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে কথা হয়ে ওঠেনি মায়ের সাথে। আজ বোধ হয় মা পুরোপুরি সুস্থ হলো। অসম্ভব খুশিতে পা'গল পা'গল লাগছে অরুর, আজ আবারও কতগুলো দিন পর মাকে সেই আগের মতো দেখতে পাবে অরু, না আর অপেক্ষা করা যাচ্ছেনা, কোনো মতে পরিপাটি হয়ে, হাতের পার্সটা নিয়ে, দরজা লক করে অরু দৌড়াতে দৌড়াতে বেড়িয়ে গেলো ক্রীতিকের আলীশান বাড়ি থেকে।
*****************************************
হসপিটালে এসে দৌড়াতে দৌড়াতে করিডোর পেরিয়ে মায়ের কেভিনের সামনে এসেই পা দু'টো থমকে গেলো অরুর। ভেতরে মা কথা বলছে, সুস্পষ্ট আওয়াজ, কতদিন পর মায়ের কথা কানে আসছে, হৃদয়টা গুমোট আবহওয়ার মতোই হাসফাস করছে ওর।মনে পরে যাচ্ছে শুরু থেকে সবকিছু।
অতোবড় ক্রীতিক কুঞ্জে দিনের পর দিন দু'বোনের কষ্ট করা, প্রতিদিন ইমেইল পাঠানো, ইমেইলের রিপ্লে না আসার একরাশ আক্ষেপ, গুছিয়ে নেওয়া,মানিয়ে নেওয়া, মামির ছুরিকা'ঘাতের মতো কথার ছোবল,শেষমেশ জায়ান ক্রীতিকের জোরজ'বস্তিতে রাজি হওয়া। এতোকিছুর বিপরীতে এখন এই মূহুর্তে মায়ের দুটো আওয়াজ শুনে মনে হলো সব দুঃখ ভ্যানিস। এ জীবনে দুঃখের কিছুই ঘটেনি। এই যে কেমন সুখ উপচে পড়ছে দুচোখের কার্নিশ বেয়ে। কাঁধ দুটো অসম্ভব হালকা লাগছে, বয়স কমে গিয়ে নিজেকে মায়ের ছোট্ট বাচ্চা মনে হচ্ছে। আর কি চাই?
খানিকক্ষণ কেভিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ভলভলিয়ে ওঠা অশান্ত হৃদয়টাকে শান্ত করে তবেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো অরু। চোখদুটো তখনও অভিমানী জলে টইটম্বুর ওর। কয়েকমিটার দুরত্বে বসে আছে মা, পরনে তার হসপিটালে বরাদ্দকৃত আসমানী রঙের পাজামা সেট। হাতের ক্যানোলা এখনও খোলা হয়নি, তবে চোখে মুখে স্নিগ্ধতার ছড়াছড়ি তার।এমন সুস্থতা দেখে মনে হচ্ছে নতুন করে জন্ম হলো তার। অরুর অবশ্য এমন মনে হওয়ারই কথা, কারণ ও খুব বেশি মায়ের ধারে কাছে থাকেনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুর, ত্যাগ তিতিক্ষার কাছে, অরুর এই সামান্য কষ্ট কিছুই না।
আজমেরী শেখ বরাবরই রাশভারি গোছের মানুষ। খুব একটা আবেগ তিনি দেখাতে পারেননা। কিন্তু এরকম একটা মূহুর্তে নিজেকে ধরে রাখা দায়। তিনিও পারলেন না, একহাতে অনুকে আগলে রেখে অন্যহাত এগিয়ে দিলেন অরুর উদ্দেশ্যে। অরুও আর অপেক্ষা করলো না, ছুটে এসে জাপ্টে ধরলো মাকে।
তিন মা মেয়ের কান্নার রোল পরে গেলো পুরো কেভিন জুড়ে, এতোগুলো দিন পর অনুর মনে হচ্ছে ও আর একা নয়, ওকেও স্নেহ করার মানুষ আছে। এর চেয়ে প্রশান্তির আর কিইবা হতে পারে। আজমেরী শেখ দুই মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
--- সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, সব। আর দুঃখ নেই তোমাদের মা সুস্থ হয়ে গিয়েছে দেখো।
জবাবে অনু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
---তুমি আবারও আমাদের বুকে টেনে নিয়ে আদর করছো এর চেয়ে সুখের আর কিই হতে পারে মা? আমরা পেরেছি, আমি আর অরু হাল ছাড়িনি, আমরা তোমাকে ফিরে পাবার আশা ছাড়িনি। ভবিষ্যতেও ছাড়বো না, তোমার শরীরের একটু ত্রুটিও হতে দেবোনা আমরা।
ওদের কা'ন্নাকাটির মাঝেই চেক-আপের উদ্দেশ্যে কেভিনে প্রবেশ করেন ডক্টর এডওয়ার্ড । ডক্টরের হঠাৎ আগমনে তিনজনেরই কা'ন্নাকাটিতে ভাটি পরলো এতোক্ষণে। তৎক্ষনাৎ ডক্টরকে যায়গা করে দিয়ে দুইবোন দুইদিকে সরে দাড়ালো ওরা।অতঃপর আজমেরী শেখকে ভালোমতো চেকআপ করে, ঠোটের কোনে একটা আন্তরিকতা জড়ানো হাসি ঝুলিয়ে ডক্টর বলেন,
--- কনগ্রাচুলেশন, মিসেস, আজমেরী। আপনার অপা'রেশনের পর আপনি এখন পুরোপুরি ফিট আছেন। আজ বা কালকের মধ্যেই আপনাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে। তবে হ্যা, প্রথম দিকে প্রতি সপ্তাহে এবং পরবর্তীতে প্রতিমাসে একবার করে নার্সিংহোমে এসে হার্টের কন্ডিশন চেক-আপ করতে হবে আপনার , অন্তত ছয়মাস এটা ধারাবাহিক ভাবে করতে হবে। তাই অনুরোধ করবো আগামী ছয়মাসে দেশে না ফেরার। ছয়মাস পরে যখন আপনার হার্টের কন্ডিশন পুরোপুরি স্ট্যাবল হয়ে যাবে, তখন আপনি যে কোনো সময় দেশে ফিরতে পারবেন।
আজমেরী শেখ বরাবরই যথেষ্ট স্মার্ট এবং দক্ষ মহিলা, ইংরেজিতেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী। জামশেদ জায়ানের সাথে দেশবিদেশ ঘুরে ব্যাবসা সামলেছে পারদর্শী হওয়ারই কথা। তাই তিনি নিজ থেকেই ডক্টরকে শুধালেন,
--- ডক্টর এডওয়ার্ড ? ছয়মাসই থাকতে হবে?
ডক্টর এডওয়ার্ড স্মিত হেঁসে জবাব দিলেন,
--- উমম ডিপেন্ড অন ইউর হার্ট। হার্ট যত তারাতাড়ি আপনার শরীরের সাথে খাপখাওয়াতে পারবে, আপনি তত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন।
ডক্টরের কথায়, আজমেরী শেখ হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, ডক্টর অনুকে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে কেভিন থেকে চলে যায়।
ডক্টর বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মাথাতেই একটা ফ্লাওয়ার বুকে নিয়ে কেভিনে ঢুকলো প্রত্যয়। অনু তখনও বসে বসে ডক্টরের বলা কথাগুলো নোট করছিল ডায়েরিতে, অরু মায়ের জন্য কমলার খোসা ছাড়াচ্ছিল। প্রত্যয় এক ঝলক অনুর দিকে তাকিয়ে সোজা গিয়ে আজমেরী শেখের সামনে দাড়িয়ে পরে, হাতের বুকেটা সম্মানের সাথে এগিয়ে দিয়ে বলে,
--- কনগ্রাচুলেশন ম্যাম, আমি প্রত্যয় এহসান সি এফ ও অফ জেকে গ্রুপ।
আজমেরী শেখ বুকেটা গ্রহন করে বললেন,
--- হ্যা জানি, জামশেদ আপনাকে ক্রীতিকের জন্য আমেরিকা পাঠিয়েছিল।
আজমেরী শেখের কথায় অরু অনু দু'জনেই প্রত্যয়ের মুখপানে দৃষ্টিপাত করলো। অনু প্রত্যয়কে দেখে একটু ইতস্তত হলো, কেমন যেন লজ্জা লাগছে ওর। ওদিকে অরু বেচারি ক্রীতিকের নামটা শোনা মাত্রই ভাবছে সারা সকাল ক্রীতিকের দেখা নেই, কোথায় গেলো লোকটা?
আজমেরী শেখের কথায় প্রত্যয় সম্মোহনী হাসি দিয়ে বললো,
--- ইয়েস ম্যাম, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি ক্রীতিক ভাইয়ের এসিসট্যান্ট। ওনার হয়ে কোম্পানির সকল দায়-দায়িত্ব আমিই সামলাই। উনি কখনোই জেকে গ্রুপে হস্তক্ষেপ করেননা। আর না উনি কোম্পানি থেকে কোনোরূপ সম্মানি গ্রহন করেন।
আজমেরী শেখ কিছু একটা ভেবে বললো,
--- যাই হোক, আপনি এসেছেন ভালোই হয়েছে, আমার জন্য ইমিডিয়েট একজন এ্যাসিসট্যান্টের ব্যাবস্থা করুন, আর হ্যা হসপিটালের আসেপাশে একটা এপার্টমেন্ট রেন্ট করুন,যেহেতু আরও ছয়মাস থাকতে হচ্ছে সেহেতু আমি আমার মেয়েদের নিয়ে সেখানেই উঠবো, জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী আমার অবর্তমানে, আমার মেয়েদের সাহায্য করেছে, থাকতে দিয়েছে, আমি তার প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞ, তবে তার সাথে একই ছাঁদের নিচে থাকতে আমি আগ্রহী নই।
প্রত্যয় রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আজমেরী শেখের সকল হুকুম শুনে গেলো। অতঃপর ছোট্ট করে ---ওকে ম্যাম।আমি সব কিছুর ব্যাবস্থা করছি।
বলে কেভিন থেকে বেরিয়ে যায়।
আজমেরী শেখের হুট করেই এতোগুলা সিদ্ধান্তে অনুর কোনোরূপ ভাবান্তর না হলেও, অরুর কেমন যেন ভেতরে ভেতরে সুক্ষ্ম চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। চারদিকে সুখের জোয়ারে পরিপূর্ণ, তবুও কিসের অসম্পূর্ণতায় হৃদয়ের এই চিনচিন ব্যাথা জানা নেই অরুর।
*****************************************
দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা হতেই বাইক রাইডিং ক্লাবগুলো পরিনত হয় নাইট ক্লাবে। উচ্ছনে যাওয়া বড়লোকের বাউন্ডলে ছেলেমেয়েদের সবচেয়ে প্রিয় যায়গা এটি। কলেজ, ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে সারাদিন রাইডিং এর মতো থ্রি'লিং গেইম উপভোগ করে সন্ধ্যা হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় ডিস্কো পার্টি। সাদা ফকফকে আলো নিভিয়ে দিয়ে লাল,নীল, হলুদ ফেইরী লাইটের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে চারিপাশ, এক সাইডে বিভিন্ন দেশ থেকে আনা সারিসারি কাঁচের বোতলে সজ্জিত ব্রান্ডেট বার কাউন্টার। আর অন্যসাইডে ডিজে গানের ধুপধুপ কম্পিত আওয়াজের তালে তালে সকলের ডান্স পার্টি, অবশেষে সারারাত ধরে ম'দ্যপান আর নাচের শেষে ভোর রাতে চড়ম আনন্দে গা ভাসানো। আমেরিকানদের জন্য এরচেয়ে চিয়ারফুল যায়গা আর কোথাও নেই বোধ হয়।
এদের মাঝে ক্রীতিক হলো রাইডিং ক্লাবের সুপার স্টারের মতো, কখন আসে কখন যায় কেউ তা জানেনা। ও সাধারণত ম্যাচ শেষ হতেই নিজের ইচ্ছামতো চলে যায়, কিন্তু আজ কোনো এক অযাচিত কারনে, সন্ধ্যার পরেই ক্লাবে প্রবেশ করেছে ক্রীতিক। ওর সাথে অর্নবও রয়েছে। অর্নবের মুখ ভঙ্গিমা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এইরকম একটা ফালতু যায়গায় ওকে জোর করে টেনেটুনে নিয়ে এসেছে ক্রীতিক। চারিদিকের মিউজিক আর হৈ-হুল্লোড়ে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অর্নব বিরক্ত হয়ে ক্রীতিককে বললো,
--- এখানে কেন নিয়ে এলি? তোর যদি এতোই নাচার শখ হয়ে থাকে তো তোর বউকে নিয়ে আসতি, আমি কি তোর সাথে নাচবো নাকি?
--- চুপ কর শালা।
ক্রীতিক অর্নবকে চুপ করিয়ে টান'তে টা'নতে নিয়ে গেলো বার কাউন্টারে। ওকে বার স্টুলে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরলো পাশের টাতে। সামনে দাড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে দুটো হুইস্কির অর্ডার দিয়ে ক্রীতিক ক্লাবের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
--- এই ক্লাবের সিসিটিভি সিস্টেমটা হ্যা'ক করতে হবে অর্নব।
ক্রীতিকের কথায় অর্নব, ভ্রু কুঁচকে বললো,
--- কিহ তুই আবারও ঝামেলা পাকাবি?
ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে অর্নবের চোখে তীর্যক দৃষ্টিপাত করে বললো,
--- ঝামেলাতো পাকাতেই হবে ব্রো, রিভেঞ্জ নেওয়াটা যে এখনো বাকি। এই ক্লাবেরই একজন খুব দুঃসাহস দেখিয়ে আমার দূর্বলতায় হা'মলা করেছিল। তাঁকে একঝলক নিজের পৈশাচিক রূপটা না দেখালে হয় বল? আমিতো এতোটাও ভদ্রলোক নই।
অর্নব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
--- তুই কি বলছিস আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, কি দেখাবি,কাকে দেখাবি?
অর্নবের কথার পাছে ক্রীতিক কিছু বলতে যাবে,তার আগেই সেখানে আগমন ঘটে ক্লাবের অন্যতম সদস্য জ্যাকসনের। যাকে মাসখানেক আগেই রাস্তায় ফেলে ইচ্ছে মতো মে'রেছিলো ক্রীতিক। তারপর অবশ্য সব সমস্যার সমাধান হয়েছে, ক্লাবের ম্যানিজিং কমিটি ওদের দুজনকে মিলিয়ে দিয়েছে, জ্যাকসন ক্ষমাও চেয়েছে নিজের কর্মকান্ডের জন্য। এখন সম্পর্কটা মোটামুটি ঠিকঠাক। তাইতো ক্রীতিককে দেখা মাত্রই এগিয়ে এসেছে সে। এগিয়ে এসে আরেকটা বারস্টুল টেনে বসতে বসতে ঠোঁটের ভাঁজে সুক্ষ্ম হাসির রেখা টেনে, অবাক হয়ে জ্যাকসন শুধালো,
--- আরে জেকে ব্রো, আপনিতো কখনোই নাইট ক্লাবে থাকেন না, আজ হঠাৎ?
জ্যাকসনের কথায় ক্রীতিক নিজেও ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বললো,
--- তোমাদের সাথে ড্রিংকস করতে মন চাইলো তাই থেকে গেলাম। ভালো করিনি?
--- ওহ,দ্যাটস রিয়েলি গুড ব্রো। লেটস এনজয়।
ওদের মধ্যে জ্যাকসনই প্রথমে পান করা শুরু করে, এক পেগ, দু পেগ, তিন পেগ, অতঃপর অগনিত পেগ। ক্রীতিক আর অর্নব ও কিছুটা টাল হয়েছে, তবে জ্যাকসনের অবস্থা পুরোপুরি টালমাটাল। দুচোখ ঝাপসা, চোখের সামনে বসে থাকা একটা ক্রীতিককে দশটা মনে হচ্ছে, কি রোমাঞ্চকর।
--- লেটস ডু আ রাইড জ্যাকসন।আ'ম শিওর এবার তুমিই চ্যাম্পিয়ন হবে।
জ্যাকসন যখন টলতে টলতে আরও হার্ড ড্রিংকসের অর্ডার দিচ্ছিল, তখনই ক্রীতিক ওকে অফারটা করে বসে।জ্যাকসনের মাথা ঠিক নেই, ওর মাথায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ভুত বহু আগে থেকেই চড়ে বসে আছে, এই মূহুর্তে নিজের শরীরে একটা আলাদাই জোশ অনুভব করছে জ্যাকসন, মনে হচ্ছে ওর উপরে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ নেই, কেউ থাকতেও পারেনা, জেকে কে আজ ও সেটা দেখিয়েই ছাড়বে। ক্রীতিক বলার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পরে জ্যাকসন, নিজের শার্টের কলারে একটা ঝাড়া দিয়ে বাইকের হেলমেট নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বলে,
--- লেটস গো।
ক্রীতিক বাঁকা হেসে বললো,
--- ওয়াও, এতো জলদি?
জ্যাকসন চলে গেলে, ক্রীতিকও নিজের হেলমেট নিয়ে ওর পেছনে পেছনে হাঁটা দিলে, অর্নব ওকে টেনে বলে,
--- তুই কি পা'গল? ও তো পুরাই টাল হয়ে আছে, বাইক স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে এ'ক্সি'ডেন্ট করবে।
ক্রীতিক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
--- সেটাই চাইছি। চল এবার।
পেছন থেকে অর্নব বললো,
--- আর তুই? তুই নিজেও তো ড্রাংক।
--- নিজের উপর কন্ট্রোল আছে আমার অর্নব,তুই চল।
.
নিজেদের সুপরিচিত রাইডিং ম্যাচের রাস্তায় এসে দুজনেই বাইক স্টার্ট করলো ওরা, চারিদিকে রাস্তাটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়, আবার খুব আলোকিত ও নয়, সোডিয়ামের নিয়ন আলোয়, পুরোরাস্তা জুড়ে আলো ছায়া বিরাজমান।জ্যাকসনের মাথায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ভুত কুন্ডলী পাকিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, আজ ও দেখিয়েই ছাড়বে জ্যাকসন কি জিনিস। ওদিকে ক্রীতিক প্রথমেই খুব ধীরগতিতে বাইক স্টার্ট দেয় ।
বাইক স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকসন হাওয়ার বেগে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। এই দেখে অর্নব ভয়ার্ত নজরে তাকিয়ে মনেমনে আওড়ায়,
--- হয় ম'রবে, না-হয় মৃ'ত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে আসবে। কেন যে জেকের মতো পাগ'লের সাথে লাগতে এসেছিল। হু নোজ?
যেহেতু ক্রীতিক নিজেও ড্রাংক ছিল, তাই ও নিজেও কিছুদূর যেতেই উল্টে পরে যায়। পরে গিয়ে সেখানে বসেই শব্দ করে হাসতে থাকে ও। ক্রীতিক পরে গিয়েছে দেখে অর্নব ওর দিকে ছুটে এগিয়ে এসে বললো,
--- আর ইউ ওকে? এটা কেন করলি ভাই? ছেলেটা খুব খা'রাপ ভাবে আ'হত হবে।
ক্রীতিক বাইকটাকে শরীরের উপর থেকে সরিয়ে আস্তেধীরে উঠতে উঠতে বললো,
--- ওই বা'স্টা'র্ডটা আমার অরুকে মাঝরাস্তায় এ্যা'টা'র্ক করেছিল, শুধু মাত্র আমার উপর জিদ ফলাতে গিয়ে ও অরুকে ছু'ড়ি নিয়ে তাড়া করেছে। ইভেন আমি সময় মতো না এলে, কি না কিই হয়ে যেতো, সেটা একমাত্র উপর ওয়ালাই ভালো জানে। তাহলে তুই কি করে ভাবলি? এতো বড় একটা দুঃসাহস দেখানোর পরেও আমি ওকে এতো সহযে ছেড়ে দেবো। কখনো না। তাছাড়া আমি আর কিইবা করলাম, ও নিজেই তো বাইক নিয়ে চলে গেলো। এখন যদি ভালোয় ভালোয় বেঁচে যায় তো যাক। আর যদি না যায়, তাহলে ধরে নেবো ওর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেশাই ওকে খোয়ালো।
শেষ কথাটা বলতে বলতেই একটা তীর্যক কপট হাসিতে প্রসারিত হলো ক্রীতিকের ডার্ক ব্রাউন ঠোঁট জোড়া।
*****************************************
অরুর বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা রাতে গিয়ে ঠেকেছে। অনু আজ আর ফিরবে না,সে মায়ের কাছেই থাকবে। অরুও ফিরতে চায়নি, অনু জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে ওকে। বলেছে, একটা রাতই তো তারপর থেকে তো সবাই একসাথেই থাকবে ওরা, এখন কষ্ট করে হসপিটালে থাকার প্রয়োজন নেই।
অরুর মনটা বেশ ফুরফুরে, হাতের পার্সটাকে আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে মাত্রই পাসওয়ার্ড টিপে ঘরে প্রবেশ করেছে ও। তবে হলরুমের কাউচে ক্রীতিককে বসে থাকতে দেখেই হাঁটার গতি থমকে যায় অরুর , এই তো সেই মানুষটা সারাদিন এতো আনন্দের মাঝেও যার কথা হুটহাট মনে পরেছে , বারবার মনে হয়েছে কোথায় সে?
কাউচের উপর গা ছড়িয়ে দিয়ে দু'পা টি-টেবিলের উপর রেখে বসে আছে ক্রীতিক। নির্ঘুম, নিস্প্রভ, কামুক চোখ দু'টো অরুর পানে নিবদ্ধ। ক্রীতিকের মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অরু দৃষ্টিপাত করে ওর পায়ের দিকে। থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছে ক্রীতিক, যার দরুন ফর্সা লোমশ পা দুটোর এথায় সেথায় থেঁ'তলে গিয়ে র'ক্ত জ'মাট বাঁধা অংশ গুলো দৃশ্যমান, এমন দ'গদগে অবস্থা দেখে যে কারও হৃদয় কেঁপে উঠবে। অথচ ক্রীতিক কতোটা ভাবলেসহীন হয়ে র'ক্ত নিয়েই বসে আছে, যেন কিছুই হয়নি।
অরুকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্রীতিক হাস্কি স্বরে বললো,
--- তোর জন্যই ওয়েট করছি, ট্রিট করে দে।
ক্রীতিকের পা দু'টো পর্যবেক্ষন করে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এসে অরু শুধালো,
--- নিশ্চয়ই বাইক থেকে পরে গিয়েছেন?
ক্রীতিক দু'হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললো,
--- ঠিকই ধরছিস।
-- ফাস্ট এইড বক্স কোথায়?
ক্রীতিক আঙুল দিয়ে নিজের রুমের দিকে দেখিয়ে দিলো। অরু নিজের পার্স্টটা রেখে বললো,
--- থাকুন, নিয়ে আসছি।
এই যাবত ক্রীতিকের রুমে দুএকবার এসেছে অরু, সেদিন ক্রীতিকের রুমে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল টের পায়নি ও নিজেও।তবে তখন তো ঘরময় অন্ধকার ছিল, কিছুই দেখার উপায় ছিল না, ওই জন্যই তো এখন ফাস্ট এইড বক্স খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠেছে অরু। রুমের কোথাও খুজে না পেয়ে একটানে ক্রীতিকের জামাকাপড়ের কাবার্ড খুলে ফেললো ও,কাবার্ডের ড্রয়ারেই ফাস্টএইড বক্স রাখা ছিল। অরু সেটাকে হাতে নিয়ে আরও একটা ছোট বক্স দেখতে পায়, সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের বক্সটা ,
---কি আছে এর মধ্যে?
প্রশ্নটা মনের মাঝে উঁকি দিতেই, এদিক ওদিক তাকিয়ে অনেকটা বিস্ময় আর কৌতুহল নিয়েই বক্সটা খুললো অরু, অরু ভেবেই নিয়েছে এতো সুন্দর বক্সে হয়তো কোনো হিরে-জহরত থাকবে নিশ্চিত । কিন্তু অরুকে পুরোপুরি ভুল প্রমান করে দিয়ে বক্স থেকে বেড়িয়ে এলো একটা লম্বা চুল। অরু আশাহত নজরে চুলটাকে দেখে নাক সিটকে বললো,
--- ইউউ! এটা আবার কি?
পরক্ষণেই ওই চুলটাকে নিজের চুলের সাথে মিলিয়ে অরু বললো,
--- আরে এটাতো মনে হচ্ছে আমার চুল, উনি কি কালো জা'দুটাদু করেন নাকি?
--- অরুউউউউ!
নিচ থেকে ভেসে আসা ক্রীতিকের ঝাঁজালো চিৎকারে লাফিয়ে উঠলো অরু। কোনোমতে যায়গার জিনিস যায়গায় রেখে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে সহসা নেমে গেলো নিচ তলায়। তারপর দৌড়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো ক্রীতিকের পাশে।
--- এতোদিন ধরে এ বাড়িতে অাছিস। এখনো একটা বক্স খুজতে এতোক্ষণ সময় লাগে ?
ক্রীতিকের কথায় অরুর মনে পরে যায় ও আর এই বাড়িতে নেই। কথাটা ভাবতেই ঈশান কোনে মেঘ জমার মতোই মনের কোনে সুপ্ত হাহাকার জমে ওঠে অরুর।
অরু নিশ্চুপ বসে বসে ক্রীতিকের পায়ে হাত চালাচ্ছে দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
--- কি ভাবছিস?
অরু তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে অন-টাইম ব্যান্ডেজ গুলো লাগাতে লাগাতে বললো,
--- ভাবছি আজকে যা বলার বলুন, আমিতো কাল চলেই যাচ্ছি।
ক্রীতিক ডিভানের গায়ে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বললো,
--- আমায় ছেড়ে কোথায় যাবি তুই?
অরু এবার সিরিয়াস হয়ে ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- কাল চলে যাচ্ছি আমরা, মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, আমাদের জন্য সানফ্রান্সিসকোতে এপার্টমেন্ট রেন্ট করা হয়েছে।
অরুর কথাটা বলতে দেরি হলো, শ'ক্ত হাতে ওর গালদু'টো চে'পে ধরতে দেরি হলোনা ক্রীতিকের। হটাৎ চড়াও হওয়া তীব্র রা'গে বেশ শক্ত করেই অরুর গাল দুটো চে'পে ধরেছে ক্রীতিক।
এতোক্ষণের শান্ত মসৃণ রূপটা মূহুর্তেই ধারণ করেছে ভয়'ঙ্কর অ'গ্নিমূর্তি। অরুর মনে হচ্ছে ওর গালের হাড়গোড় এক্ষুনি ভে'ঙে যাবে। অসহিষ্ণু ব্যাথায় চোখ দুটো টলমলে হয়ে উঠলো ওর।তৎক্ষনাৎ অস্পষ্ট সুরে ক্রীতিককে বললো,
---খুব ব্যা'থা লাগছে ছাড়ুন।
ক্রীতিক ছাড়লো না, উল্টে ওকে কাছে টেনে নিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
--- আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল কি জানিস? তোর প্রেমে পরা। সেই শুরু থেকে য'ন্ত্রণা দিতে দিতে লাইফটাকে হেল বানিয়ে ছেড়েছিস। এখনো দিচ্ছিস।
কথাটা বলে পায়ের নিচে থাকা টি-টেবিলটায় সশব্দে লা'ত্থি মারলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন আওয়াজ করে টেবিলটা উল্টে পরলো অন্যপাশে। বোধহয় কাচগুলো ভে'ঙে গু'ড়িয়ে গিয়েছে। ক্রীতিক সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে, অরুর এতোক্ষণ ধরে করা ব্যান্ডেজ গুলোকে টেনে হিঁচড়ে তুলে ফেললো। এভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কি মানে হয়, অরু চেচিয়ে উঠলো,
--- আরে কি করছেন, আবারও র'ক্ত বের হবেতো?
ক্রীতিক অরুর কথায় কর্ণপাত না করে ব্যান্ডেজ গুলো ছু'ড়ে ফেলে ওকে এক প্রকার ধা'ক্কা মে'রে সরিয়ে, হনহন করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়।
ক্রীতিক চলে যেতেই অরু ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। নিজেকেই নিজে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
--- উনি কি বললেন? উনি আমার প্রেমে পরেছেন, কবে, কোথায়, কখন? যেই মানুষটা আমাকে দুই চোখে সহ্যই করতে পারেনা, সে কি করে আমার প্রেমে পরলো? আমিকি ঠিক শুনেছি?
আপনমনে কথাগুলো বলতে বলতেই অরুর হাত চলে যায় বুকের বাম পাশে। আবারও সেই তীক্ষ্ণ চিনচিন ব্যাথা, এটা কি তাহলে জায়ান ক্রীতিকের জন্যই হচ্ছে?
..............................................................................
𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃
***Download NovelToon to enjoy a better reading experience!***
Updated 62 Episodes
Comments