#পর্বঃ১৬
একতরফা ভালোবাসা বরাবরই বিরহের। নিজের অস্তিত্ব জানান না দিয়ে তাকে দিনের পর ভালোবেসে যাওয়া, তার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অভ্যাসটাকে চুপিচুপি আপন করে নেওয়া। কিংবা পুরো মানুষটাকে ঘিরেই অজানা সুখের সপ্নজাল বোনা, এমন আশাতীত সপ্ন বিলাশ সবাই করতে পারেনা।কারন সবাই তো আর ভালোবেসে কষ্ট সইতে চায়না। তাছাড়া হৃদয়ে লুকোনো ভালোবাসার অস্তিত্বের খোজ সচারাচর কয়জনই বা করে? তবে সেই অস্তিত্ব, সেই সপ্ন যদি এক নিমিষে গুড়িয়ে যায়?অন্তরের অন্তস্থলে থাকা মানুষটা যদি সবচেয়ে জঘন্য আর ঘৃণিত মানুষে পরিনত হয়? তাহলে ভুলটা কার? যে ভালোবেসেছিল সেই মানুষটার নিশ্চয়ই? তাইতো অরুও আজকাল নিজেকে অপরাধী ভাবে। ভালোবাসার দোষে অপরাধী।
কিন্তু অরু যেটাকে একপাক্ষিক ভালোবাসা ভেবে বসে আছে সেটা কি আদৌও ভালোবাসার অনুভূতি ছিল? নাকি নিতান্তই টিনএজ ফ্যান্টাসি? যদি তা নাই হবে,তবে নিখিলের বাইরে দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে ক্রীতিকের কাছে আসাটা কেন এতো রোমাঞ্চকর?কেন ডানা ঝাপটানো বন্য পাখির ন্যায় বেসামাল, আর ব্যাতিগ্রস্থ।
আজ আবহাওয়াটা বেশ ভালো।মাথার উপর তীর্যক আলো ছড়াচ্ছে সূর্য কীরন।তবুও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাতাসে ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। ঠান্ডা থাকা সত্বেও অন্যান্য শীতল দিনের সাথে তুলনা করলে বলা যায় আজ গড়ম পরেছে বেশ।
নিয়ন সূর্যতাপ গায়ে মাখাতে মাখাতে রাস্তার ফুটপাত ধরে এলোমেলো পা ফেলে হাটছে অরু। পরনে লংস্কার্ট আর ডেনিম টপস তারউপর পাতলা কালো কোর্ট।হাতের ভাজে পোকেমোন আঁকা কালো রঙা টেটো ব্যাগ।
মাত্রই বাস ধরে হসপিটাল থেকে ফিরেছে সে। আর এখন গন্তব্য ক্রীতিকের জনমানবহীন শুনশান শহরতলী।আজ প্রায় সপ্তাহ খানিক পর বাইরের পৃথিবীর মুখ দেখলো ও। তাও আপার জোরাজোরি তে। গত একসপ্তাহে ভার্সিটি যায়নি অরু, আর নাতো যাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে মনে।সারাদিন কক্ষবন্ধী হয়ে থাকে বলে,আজ জোর করেই অনু হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। মায়ের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আজকালের মধ্যেই অপারেশন হবে। আর তারপর হয়তো সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। অরু অনুর দুঃখের দিন ঘুচে যাবে। কিন্তু আদতে কি ঘুচবে? ভেবে পায়না অরু। কিকরেই বা পাবে? মাত্র কয়েকমাসের ব্যাবধানে ওর হৃদয়টা যে ভে'ঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। একটা জঘন্য চরিত্রের মানুষকে দিনের পর দিন অন্ধের মতো মনেমনে ভালোবেসে গিয়েছে ও,অথচ তার ওই নোংরা চোখের ভাষা টা অবধি বুঝতে পারেনি,ছিহ।
নিজের উপর আরও একবার রাগের নদীতে তে জোয়ার এলো অরুর। ও যে কতবড় আহাম্মক সেটা ভেবে নিজেকেই নিজে হাজারটা চ'ড় থা'প্পড় আর গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে ওর।
অরু যখন হাজারটা দোষী সাব্যস্ত করে বারবার নিজেকেই নিজে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। ঠিক তখনই রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে জেব্রা ক্রসিং পার হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একজন। পুরো শরীর তার কালো দিয়ে আবৃত। এমন কি মুখটাও মাংকি টুপি দিয়ে আটকানো। চোখ দুটোতে হিং'স্রতা জ্বলজ্বল করছে লোকটার। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা বিশ্রী ভাবে হাসছে।
লোকটাকে দেখে ভাবনায় পরে গেলো অরু, ওর মনে হচ্ছে এই চোখ দুটো এর আগেও কোথায় যেন দেখেছে ও। দেখলে দেখেছে কিন্তু এভাবে পথ আটকে দাড়ানোর মানে কি?
নিজ ভ্রু কুঞ্চিত করে অরু বিরক্ত সুরে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো,
--- আপনি আবার কোন ক্ষেতের মুলা? এমনিতেই ভারী অশান্তিতে আছি পথ ছাড়ুন তো।
লোকটা বোধ হয় অরুর কথা বুঝলো না,বিদেশি হবে হয়তো। তাই ও ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলো,
---- হু? হু আর ইউ??
লোকটা জবাব দিলো না নিঃশব্দে, নির্লিপ্ত কপট চোখ দুটো নিক্ষেপ করলো নিজের হাতের দিকে। অরু ও তার চোখ অনুসরণ করলো, আর যা দেখলো তাতে পিলে চমকে উঠলো ওর। লোকটার কালো রঙের গ্লোভস পরা হাতে বেশ বড়সড় একটা ধারালো ছু'রি। দেখে মনে হচ্ছে অরুকে আঘাত করার জন্যই অগ্রসর হচ্ছে তার হাতটা। কিন্তু কেন? আমেরিকার মতো একটা অচেনা, অজানা দেশে অরুর মতো একটা তুচ্ছ দু পয়সার মেয়ের সাথে কিসের এমন শ'ত্রুতা এই ভ'য়ানক লোকটার?
সে যে শ'ত্রুতাই হোকনা কেন,আপাতত এই লোকটার থেকে পালিয়ে প্রানে বাঁচাটা জরুরি। নয়তো এই শুনশান নিরব রাস্তায় ওকে বাঁচানো তো দূরে থাক,ওর লা'শটাও খুঁজতে আসবে না কেউ । অজস্র কুন্ডলি পাঁকানো দুশ্চিন্তারা ঘীরে ধরেছে অরুর মন মস্তিষ্ক। ভেতরের ভয়টা দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে এসেছে। অরু যেন শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। তবে ওর এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলো না লোকটা। বরং তার আগেই ক্ষীপ্ত গতিতে তেড়ে এসে ছু'রিকাঘাত করতে অগ্রসর হলো অরুর পানে। ঘটনাটা এতোই দ্রুত ঘটছে যে, কিছুই ঠাহর করতে পারলো না অরু। লোকটা এগিয়ে আসতেই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে প্রানপনে উল্টো দিকে দৌড় লাগালো ও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো লোকটা ওর পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে না, বরং সাইকোপ্যাথ দের মতো চা'কু হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা জানে অরুর শেষ গন্তব্য কোথায়?
*****************************************
একটানা দিগ্বিদিক দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে অরু। শেষমেশে আর দৌড়াতে না পেরে রাস্তার মাঝেই হাটুতে দু'হাত ভর করে দাঁড়িয়ে পরলো ও। হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে তাকিয়ে খুব সাবধানে পরখ করে নিলো রাস্তার অদূর পর্যন্ত। নাহ, দু একটা চলন্ত গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে অরু ভাবছে,
---- আহ!তার মানে এ যাত্রায় প্রানে বেঁচে গিয়েছি।
ঠিক তখনই ওর খুব কাছ থেকে ভেসে এলো একটা অচেনা অপ্রিতীকর কন্ঠস্বর,
--- জেকে স বেবি গার্ল, আই কট ইউ।
আচমকা এমন একটা ভয়ানক আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সামনে তাকালো অরু, দেখলো তখনকার লোকটা ওর সামনেই, কিচ্ছু বদলায় নি।আগের মতোই বিশ্রী চাহনি দিয়ে ওর পানে তাকিয়ে আছে সে। হুট করে আবারও ওই লোকটাকে দেখে অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠে পেছনের পিচ ঢালা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো অরু। শুষ্ক ঢোক গিলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো এতোক্ষণ দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুরে ফিরে গোলকধাঁধাঁর মতো আবার আগের যায়গাতেই ফিরে এসেছে ও। নিজের মূর্খামির ফল সরূপ আরও একবার ফেঁ'সে গেলো অরু। আপা কতো করে বলেছিল আমি এগিয়ে দিয়ে আসি, অথচ অরু শোনেনি। আর এখন সামনে মৃ'ত্যু খেলা করছে ওর। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।
লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অরুর দিকে। অরু যে উঠে দাড়িয়ে আবারও দৌড়ে পালাবে সেই শক্তি নেই ওর শরীরে, উল্টে হাত পা কন্ঠ সব কিছু রোধ করে রেখেছে এক অজানা আ'তংক। অরুকে ভয় পেতে দেখে লোকটা খিকখিক করে হেঁসে বললো,
--- এ্যান্ড আ'ল কি'ল ইউ, প্রিন্সেস।
অরু এবার ঠোঁট চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতেই দু'হাতে ভর করে পেছাতে লাগলো কুচকুচে পিচঢালা রাস্তা ধরে । তবে লোকটার গতিবেগ ছিল দিগুন। সে এতোক্ষণে ওর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরেছে। মাথাটা এদিক ওদিক কাত করে ঘাড় ফুটিয়ে,তীব্র আক্রোশে উদ্যত হয়েছে অরুকে ছু'ড়িকাঘাত করার জন্য। লোকটার পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভেবেই অরু চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেললো , এই মূহুর্তে প্রিয়জনের মুখগুলো ভাসছে ওর মানসপটে, মা, আাপা, আর তো কেউ নেই। অথচ মানসপট জুড়ে দুটো নয়, বরং তিন তিনটে মুখ ভেসে উঠছে। মা আপা আর সব শেষে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। ওর স্টেপ ব্রাদার, যে ওকে সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, সবার কাছে বাড়ির চাকর হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়, ওর গা'য়ে হা'ত তোলে, ওকে শীতের রাতে ঘরে থেকে বের করে দেয়, মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়, হুটহাট রেগে গিয়ে সবার সামনে অপমান করতেও দু'বার ভাবে না। অথচ এই মূহুর্তে হৃদয়টা তাকে ঘৃণা করতে চাইছে না,মনে হচ্ছে ক্রীতিক নিজেকে ঠিক যতটা খারাপ প্রমান করতে চায়, ততটাও খারাপ সে না, নয়তো তিঁতে হয়ে যাওয়া হৃদয়টা তাকেই কেন স্বরণ করছে বারবার তাও এমন একটা মূহুর্তে? ক্ষনিকের জন্যে হলেও মনে হচ্ছে আজ ক্রীতিক থাকলে ওকে এতোটা বি'পদে পরতে হতো না। কোনো না কোনো ভাবে ঠিক বাঁচিয়ে নিতো সে।
অরু সেই কখন থেকে আজগুবি চিন্তায় বিভোর, অথচ লোকটা ওকে আ'ঘাত না করে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে, তা কি করে হয়?
কপালের উপর তরল জাতীয় কিছু অনুভব হতেই, ভাবনার সুতো ছিড়ে যায় অরুর। জিনিসটা কি তা দেখার জন্য, হাত দিয়ে কপালটা স্পর্শ করে সেটা চোখের সামনে এনে ধীরে ধীরে চোখ খুললো ও । দেখলো ওর হাত ভর্তি তরতাজা র'ক্ত। তাহলে কি লোকটা ওকে আঘাত করেছে? কই ব্যাথা লাগলো না তো? নাকি ইতিমধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেছে অরু?
ব্যাপারটা ঠিক ভাবে আন্দাজ করার জন্য আচমকা মাথা তুলে চাইলো অরু। আর যা দেখলো তাতে ওর দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হলো। বিশ্বাস করতেও খানিকক্ষন কষ্ট হলো।কিন্তু চোখের সামনে ঘটতে থাকা ঘটনা তো আর মিথ্যা হতে পারেনা। তাই চোখে কয়েকবার পলক ছেড়ে আবারও খেয়াল করে তাকালো ও,দেখলো ওই ধারালো ছু'রিটাকে নিজ হাতে মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। এতো জোরেই সেটাকে চেপে ধরেছে যে, ক্রীতিকের হাত কে'টে টুপটুপ করে র'ক্ত অরুর কপাল আর নাক বেয়ে চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে। কারণ ওই লোকটা ক্রীতিকের মধ্যেখানে বসে আছে অরু।
ক্ষনিকের মধ্যে ক্রীতিকের ঝরে পরা র'ক্তে অরুর জামা কাপড়ও র'ক্তরঞ্জিত হয়ে উঠেছে,তবুও ছু'ড়ি কিংবা ওই মুখ ঢাকা ছদ্মবেশি লোকটাকে কিছুতেই ছাড়ছে না ক্রীতিক। এক পর্যায়ে অরু সচকিত হয়ে উঠে দাড়িয়ে ক্রীতিকের ছু'ড়ি চেপে ধরা হাতটা টানতে শুরু করলো, আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
--- কি করছেন ? এটাকে ছাড়ুন, আপনার হাত কে'টে যাচ্ছে তো।
ক্রীতিকের অরুর কথায় কান নেই একটুও।ও তো ওই লোকটার মুখোশ উন্মোচনে ব্যাস্ত। এক পর্যায়ে টানতে টানতে লোকটার মাংকি টুপিটা খুলেই ফেললো ক্রীতিক। এভাবে নিজের ছদ্মবেশ খুলে যেতেই লোকটা নিজের ছু'ড়ি আর টুপি ফেলে রেখেই দু'হাতে মুখ ঢেকে তরিৎ গতিতে দৌড়ে পালালো।
লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে দেখে ক্রীতিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেদিকে। মনে হচ্ছে ও আজ লোকটাকে ধরেই ছাড়বে।কিন্তু সেসব চিন্তার ইতি ঘটিয়ে অরু ওর হাত টেনে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
--- আ..আমার ভয় করছে, যাবেন না দয়াকরে।
ক্রীতিকের পূর্ন দৃষ্টি এবার অরুর দিকে চলে গেলো, যে এই মূহুর্তে ওর র'ক্তে মাখামাখি হয়ে দাড়িয়ে আছে। র'ক্তে ভেজা অরুকে দেখে ক্রীতিকের চোখ জ্বলে উঠলো, কপালে তৈরি হলো দুশ্চিন্তার কয়েক খানা ভাঁজ। ও দ্রুত হাতে অরুর বাহু চেপে ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে, আহত সুরে শুধালো,
--- কোথায় লেখেছে তোর? এতো র'ক্ত কেন?
অরু কাঁদতে কাঁদতে বিস্ময়ে বিমূর্ত হয়ে জবাব দিলো,
--- এগুলো আপনার র'ক্ত। হাত কেটে গিয়েছে আপনার। ভুলে গেলেন?
অরুর কথায় ক্রীতিক সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওকে হুট করেই বুকে চেপে ধরে বললো,
--- ওহ, থ্যাংকস গড।
এবার আর দূর থেকে নয়, ক্রীতিকের শরীরের স্যান্ডালউড পারফিউমের মারাত্মক পুরুষালী গন্ধটা খুব কাছ থেকে এসে সুরসুরি দিলো অরুর নাকে। তবে ও আপাতত এসব কিছু ভাববার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। তাই ক্রীতিকের বাহুতে আগলে ধরাটা নিতান্তই সাভাবিক আর আন্তরিকতার চোখেই দেখলো অরু।
*****************************************
অরুকে পাঠিয়ে দিয়ে সারাদিন হসপিটালেই ছিলো অনু। আজ আর পার্ট টাইমেও যাওয়া হয়নি ওর।খুব শীঘ্রই অপারেশন হবে মায়ের। অনুর জন্য এই মূহুর্তে হসপিটালে থাকাটা খুব জরুরি। তাই অনু ভেবেছে পার্ট টাইম থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে, পুরো সময়টা হসপিটালে কাটাবে ও। এখন সন্ধ্যারাত, অনু কেবলই হসপিটাল থেকে বেরিয়েছে, সারাদিন কিছু না খাওয়ার দরুন শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। হসপিটাল থেকে কিছুদূর হেটে গেলেই একটা গ্রোসারি শপ পাওয়া যায়। অনু হাটতে হাটতে গ্রোসারিতে গিয়ে কিছু খাবার কিনে নিলো। তারপর গিয়ে বসলো রাস্তার পাশের একটা খালি বেঞ্চিতে, সেখানে বসেই খেতে আরম্ভ করলো শুকনো খাবার গুলো । ওর মনটা আজ বড্ড ফুরফুরে,সেই সাথে ভেতরটাও হালকা লাগছে কয়েকগুণ। মনে হচ্ছে এতোদিনের কষ্ট, পরিশ্রম, ত্যাগ কোনোটাই বিফলে যায়নি। অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে ওরা। হাতে থাকা বাবল টিতে একটা লম্বা সিপ টেনে মুচকি হেঁসে অনু আনমনে বলে ওঠে,
--- আপনাকে খুব মিস করছি। প্রত্যয় সাহেব।
তারপর আবারও একটা লম্বা সিপ.... তবে এবার অনু চা'য়ের সিপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা আর গলা থেকে নামাতে পারলো না, তার আগেই ওর দৃষ্টিগত হলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্য।
গ্রোসারি শপের সামনেই প্রত্যয় একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে , ওর হাতেও দুটো বাবল টি এর জার।মেয়েটার ভাবভঙ্গিমা এমন যেন এখনই লাফ দিয়ে কোলে উঠে পরবে প্রত্যয়ের।
অনু বড্ড আত্মসম্মানী, একনজর দেখেছে বলে সারাক্ষণ হ্যাংলার মতো তাকিয়ে তাদের কান্ডকারখানা দেখবে এতোটাও নির্লজ্জ মেয়ে ও নয়। তাই প্রত্যয়ের চোখ এদিকে আসার আগেই অনু হাটা দেয় উল্টো পথে। হাটার সময় রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ছুড়ে মা'রে হাতে থাকা বাবল টি ভরতি জারটাকে। অনুর মতে এটা বারাবাড়ি নয়, এটাই ওর আত্মসম্মান। যা ও খুব সহজে খেলার জন্য কারও হাতে তুলে দেবেনা। যদিও প্রত্যয়কে সেটা তুলে দেওয়ার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছিল হৃদয়টা। তবে এখন মনে হচ্ছে সেটা নিতান্তই ভুল সিদ্ধান্ত
হতো।
*****************************************
অন্যান্য দিনের মতো আজও হল রুমের কাউচে বসে নিচের ক্ষ'ত সারাতে বসেছে ক্রীতিক।
তখন অরু খেয়াল করেনি, ক্রীতিক আগে থেকেই আ'হত ছিল, ওর দু'পা,কপালের কিছুটা অংশ, সব খানেই র'ক্তা'ক্ত ক্ষত ছিল। সেই সাথে বাইকার লেদার জ্যাকেটটাও ছিল ছেড়া।
জামা কাপড় পাল্টে নিজেকে পরিষ্কার করে মাত্রই নিচে এসেছে অরু।আপা বাড়িতে ফেরেনি, বিকেলের ঘটনার পর থেকেই ভেতরে অজানা আ'তংকটা জেনো জেকে বসেছে দিগুণ হারে। রুমের মধ্যেও একাএকা থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করছে ওর। তাইতো রুমের কাজ সেরে দ্রুত নিচে নেমে এসেছে অরু। ক্রীতিক আজও ফার্স্টএইড নিয়ে বসে আছে। তবে ওর মুখ ভঙ্গিমা কেমন যেন অন্যরকম, নিজের শরীরের এতো এতো ক্ষত তে কোনোরূপ খেয়াল নেই ওর।মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে ক্রীতিক। অরু সেদিনের মতো করে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে আগ বাড়িয়ে বললো,
--- দিন আমি ট্রিট করে দিচ্ছি।
হঠাৎ, অরুর আওয়াজে ধ্যান ভাঙে ক্রীতিকের। ও বিরক্ত হয়ে বলে,
--- তুই পারবি না, যাতো নিজের কাজ কর গিয়ে।
অরু পাত্তা দিলোনা ওর কথায়। উল্টে গিয়ে বসলো ক্রীতিকের পায়ের কাছে। মেঝেতে বসে তুলার মধ্যে এন্টিসেফটিক লাগিয়ে ক্রীতিকের হাটুর উপর চেপে ধরতেই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো ক্রীতিক।তবে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হলোনা ওর। অরু বিরক্ত হলো, লোকটার অনুভূতি বলে কিছু নেই নাকি? ও কেন যেন ধূর্ততা অবলম্বন করলো। হুট করেই, হাতের তুলাটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে। এবারও চুপচাপ নির্বিগ্ন সে।
শুধু চোখ বুঝেই হাস্কি স্বরে বললো,
--- আমাকে ব্যাথা দিয়ে শান্তি পাস?
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো অরু, তারমানে ক্রীতিকেরও ব্যাথা লাগে, শুধু মুখে প্রকাশ করে না। ও পুনরায় এন্টিসেফটিক লাগাতে লাগাতে বললো,
--- কি করে ব্যাথা পেলেন?
ক্রীতিক জবাব দেয়,
--- যাস্ট এ মাইনর বাইক এ'ক্সি'ডেন্ট।
--- বাইকে আপনার এতো আসক্তি?এতো ব্যাথা পাওয়ার পরেও বাইক রাইডিং ছাড়েন না।
ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে একটু হেসে বলে,
--- তোর থেকে বহুগুন কম। তাহলে ভাব তোকে কিভাবে ছাড়ি?
পায়ের ক্ষতগুলোতে অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে,ক্রীতিকের পাশে বসে ওর হাতটা দেখতে দেখতে অরু বললো,
--- কি বললেন? শুনিনি।
--- নাথিং, আমি যখন কথা বলি তখন কান কোথায় থাকে তোর?
অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
--- আমি ভাবছি হাতের ক্ষ'তটা অনেক গভীর, এটা আমি কিভাবে ব্যান্ডেজ করবো? দেখেতো মনে হচ্ছে সেলাই লাগবে।
ক্রীতিক নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
--- না পারলে, দুরে সর। নিজেই তো পাকনামি করে এসেছিস সাহায্য করতে।এখন বলছিস পারবো না।আমি বলেছিলাম আসতে?
অরু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিকের হাতটা আবারও টেনে নিয়ে সেখানটায় ব্যাথা নাশক লাগাতে লাগাতে বললো,
--- আপনি এমন কেন?
--- কেমন আমি?
--- ঝগরুটে, তিল কে তাল বানিয়ে ফেলেন, আপনার বউয়ের কপালে দুঃখ আছে।
অরুর কথায় ক্রীতিকের ঠোট বাঁকা হাসিতে প্রসস্থ হয়। তারপর হুট করেই চোখ মুখ কুঁচকে সামনের মনিটরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক বলে,
--- ঠিকই বলেছিস, আমার কথা না শুনলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।
--- হ্যা সেতো জানিই, আপনি ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব কিনা, দুঃখ তো থাকবেই। আচ্ছা তখন হঠাৎ ছু'ড়িটা চেপে ধরতে গেলেন কেন শুনি?
--- চেপে না ধরলে তো তোর আ'ঘাত লাগতো।
ক্রীতিকের হাতের ক্ষ'তটা অনেক বেশি গভীর, অরুর ভেতর ভেতর অনুশোচনা হচ্ছে ওর জন্যই আজ এমনটা হয়েছে। তাই ও ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে হালকা ফু দিয়ে এনসেফটিক লাগাতে লাগাতে নরম সুরে শুধালো,
--- বেশি ব্যাথা লাগছে?
নিজের শরীরটাকে কাউচে উপর ছেড়ে দিয়ে ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে বললো,
--- এখন কম লাগছে।
*****************************************
মাঝরাত চলমান.... দিনের আলো শেষ হতেই তাপমাত্রা নেমে গিয়ে চারিদিকে কনকনে শীতল হাওয়া বইছে, অনু আর অরু বোধ হয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ ছাঁদ বারান্দায় এখনো টিমটিমিয়ে ফেইরী লাইট জ্বলছে। সেখানে গোল হয়ে বসে আছে অর্নব, সায়র, এলিসা। ক্রীতিক ওদের থেকে খানিকটা দুরে দাড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ব্যাস্ত। ওরা সবাই সারারাত ধরে কিছু একটা পরামর্শ করেছে, অর্নব কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে এখনো কি যেন করছে। এলিসা দ আকারে বসে অর্নবকে বললো,
--- তুই কবে এসব বন্ধ করবি অর্নব?
অর্নব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
--- বন্ধ করবো মানে? তোর বাবাকে ওরা আটকে রেখেছে, ভিডিও প্রুফ পাঠিয়েছে, তুই না গেলে ওরা তোর বাবাকে মে'রে ফেলবে, আর তুই ভাবছিস তোকে আমরা ওই রিস্কি যায়গায় একা যেতে দেবো?
সায়র পাশ থেকে বললো,
--- আচ্ছা আমরা পুলিশ কে কেন বলছি না?
অর্নব দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,
--- গর্ধব পুলিশকে জানালে এলিসাও ফেঁসে যাবে, তাছাড়া ক্লাবটা ইউ এস এ'র নয় থাইল্যান্ডের।
ওদের বাকবিতন্ডার মাঝে ক্রীতিক না ঘুরেই বললো,
--- অর্নব প্রাইভেট জেট বুক কর, অরুর ফ্লাইট ফোবিয়া আছে ওকে নিয়ে বিজনেস ক্লাসে যেতে পারবো না।
আশ্চর্য্যের শেষ সীমানায় গিয়ে সায়র, অর্নব, এলিসা সবাই একই সুরে বললো,
--- অরু???
তীরের ছিলার মতো এক ভ্রু উঁচিয়ে ক্রীতিক জবাব দেয়,
--- ইয়েস অরু।
সায়র ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,
-- লাইক সিরিয়াসলি জেকে? আমরা একটা মিশন নিয়ে থাইল্যান্ড যাচ্ছি, আর তুই সেখানে বিপ'দের মধ্যে অরুকে নিয়ে যাবি?
--- আমি যেখানে থাকবো, সেখানে অরুর কোন বি'পদ নেই।
এলিসা শুধালো,
--- কিন্তু হঠাৎ অরুকে, এভাবে?
ক্রীতিক সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ে পিষ্ট করে দাঁত চেপে বললো,
--- ইয়েসটারডে সাম ওয়ান ট্রাইড টু এ্যা'টার্ক হার।
এবারও সবাই তারস্বরে বলল,
-- কিহ?
ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---ঠিকই শুনেছিস, কাল ওই বা'স্টা'র্ড টার ভাগ্য ভালো ছিল যে আমি উইক ছিলাম। তবে চিন্তা নেই খুব শীঘ্রই নিজ কর্ম ফল ভোগ করবে সে। কিন্তু এই মূহুর্তে আমি অরুকে একা রেখে দেশের বাইরে গিয়ে কিছুতেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো না।
--- কিন্তু অনু?ওর উপর কোনো এ্যা'টার্ক আসবে না তার কি গ্যারান্টি?
এলিসার প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক বলে,
--- অনুর জন্য চিন্তার কারন নেই কারন ও বেশির ভাগ সময়ই হসপিটালে থাকে। তাছাড়া প্রত্যয় থাকতে অনুর সাথে খারাপ কিছু হওয়ার চান্স নেই।
এতোক্ষন পর সায়র উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো,
--- ভালোই হবে, তোরা তোদের মিশন, ফিশন শেষ করবি, সেই ফাঁকে আমি আর অরু, একটু ব্যাংককের সমুদ্র বিলাশ সেরে আসবো।নট আ ব্যাড আইডিয়া ।
তৎক্ষনাৎ ওর পশ্চাৎদেশ বরাবর লা'ত্থি মে'রে, কনকনে বরফ শীতল ঠান্ডা পানিতে ফেলে দিয়ে ঠোটের কোনে একটা কপটতা মিশ্রিত হাঁসি ঝুলিয়ে ক্রীতিক বলে,
-- নো চান্স ব্রো, শি ইজ মাইন .....
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১৭
আমেরিকার আবহাওয়া মানেই আধুনিক ভাষায় মুড সুইং। এদেশে আলাদা করে বর্ষা মৌসুম নামে কিছু নেই বলে পুরো বছরের যখন তখনই প্রকৃতি ধারণ করে তীব্র বর্ষারূপ। বিশেষ করে শীতে প্রকান্ড কুয়াশা আবৃত ধরনীকে আরও খানিকটা শীতল কনকনে ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে দিতে নেমে আসে এক পশলা ঝুম বৃষ্টি। আজও তেমন করে অপ্রত্যাশিত ভাবেই প্রকৃতিতে হানা দিয়েছে তীব্রাকার বর্ষাকাল। সকাল সকাল তো ভালোই রোদ উঠেছিল,আর এখন দিনের আকাশ মেঘে ঢেকে ঢুকে সন্ধ্যারাতে পরিনত হয়েছে। জানালার কাঁচ গলিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আচঁড়ে পরছে রুমের মেঝেতে। অনু হাতের কাজ রেখে দ্রুত এগিয়ে দিয়ে জানালার কাঁচটা পুরোপুরি টেনে দিলো। এখন ঠান্ডাও কম লাগছে খানিকটা। সেই কখন থেকে অনুর ডাকাডাকির ফলস্বরূপ এতোক্ষণে উঠে গিয়ে রোবটের মতো সকালের কাজ গুলো সেরে নিলো অরু।
খানিকবাদে ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ঘ্যানঘ্যান করে অনুকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
---- কি দরকার আপা, আমি যেতে চাইনা ওনাদের সাথে, তুই কেন অযথা জামা কাপড় গোছাচ্ছিস?
অরুর জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে সযত্নে ট্রলি ব্যাগে রাখতে রাখতে অনু বলে,
---- যেতে চাস না মানে? সারাদিন তো ঘরে মনমরা হয়ে বসে থাকিস, ভার্সিটিতেও যাচ্ছিস না কিছুদিন ধরে, আমার তো আর তোকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময় হয়ে ওঠেনা,তারচেয়ে বরং ক্রীতিক ভাইয়াদের সাথে ঘুরে আয়। মন ভালো হয়ে যাবে। তাছাড়া ক্রীতিক ভাইয়ার মেয়ে বান্ধবী কি যেন নাম?
অরু ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দেয়,
---- এলিসা আপু।
--- হ্যা, উনি তো তোকে অনেক আদর করে তাহলে তোর চিন্তা কিসের?
নিজের অলস শরীরটাকে বিছানায় ছেড়ে দিয়ে অরু বলে,
----- আমি এখন বড় হয়ে গিয়েছি আপা, কারও আদর করা না করা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই।
অনু সব কিছু ঢুকিয়ে লাগেজের চেইন লাগাতে লাগাতে বললো,
---- তাহলে অযথা যাবোনা যাবোনা বলে কেন ঢং করছিস? দেখ অরু, আগামী কয়েকদিন হসপিটালে অনেক ব্যাস্ত থাকবো আমি, ঠিক মতো বাসায় আসতে পারবো কিনা সন্দেহ। তারচেয়ে বরং তুই এই ফাকে ঘুরে আয়, এসে দেখবি আমাদের মায়ের অপারেশন সাকসেসফুল। তাছাড়া ক্রীতিক ভাইয়াতো বলেছে তারা ঘুরতেই যাচ্ছে।
অরু মুখ ফুটে আর জবাব দিলো না, শুধু মনে মনে ভাবলো,
---- সমস্যাটা তো ওই ক্রীতিক ভাইয়াকে নিয়েই। সে তো এলিসা আপু টাপু কাউকেই মানে না, আর এখন এতো দুরে তার সাথে গেলেতো মাথার উপর উঠে তান্ডব নৃত্য চালাবে। কথার মাথায় উঠাবে আর বসাবে। সারাক্ষণ অর্ডার আর হুকুম, এসব আমি একদম নিতে পারিনা।
--- কিরে কি ভাবছিস? ঘুরে আয় এতে তোরই লাভ। আমার সুযোগ থাকলে তো আমিও যেতাম। তাছাড়া মা সুস্থ হয়ে গেলেতো আবার আগের মতো জীবন কাটাতে হবে, তুুইতো জানিস মা ঘোরাঘুরি একদম পছন্দ করেন'না।
অনুর কথায় অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, দু'হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
----- তুই বেস্ট আপা। ইশশ তুই যদি আমার মা হতি?
অনু অরুর দু'হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে,
----- হয়েছে আর তেল দিতে হবে না, এখন দ্রুত রেডি হয়ে নে, ক্রীতিক ভাইয়া ভার্সিটিতে গিয়েছে সেখান থেকে ফিরে তোকে পিক করে সোজা এয়ারপোর্ট যাবে।
কয়েকমূহুর্ত কথা থামিয়ে আবারও সচকিত নয়নে অনু বলে,
----- তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস অরু?
----- কি জিনিস।
----- ক্রীতিক ভাইয়া বোধ হয় এতোবছর পর অবশেষে আমাদের বোন হিসেবে মেনেই নিয়েছে,নাহলে তোকে সাথে করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা কেন বলবে?
----- অরু নিজ পায়ে স্লিপার পরতে পরতে বললো,সে আমি জানিনা,বাদ দে তো ওনার কথা, এই ভালো এই খারাপ। কই কোনো দিন তো বলতে শুনলাম না," অরু বোন আমার এদিকে আয়"। ওসব করুনা বুঝেছিস?
অরুর কথার পাছে অনুর বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে অজানা দীর্ঘশ্বাস।
অরু উঠে গিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরের বৃষ্টি ভেজা তকতকে রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,
তৎক্ষনাৎ মনে পরে গেলো কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া সেই ভ'য়ানক গা ছমছমে ঘটনার কথা, সেদিন ক্রীতিক সময় মতো না এলে কি হয়ে যেতো? ভাবলে এখনো শরীরের সবকটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় অরুর। আচ্ছা, সেদিনের সবটাই কি ক্রীতিকের করুনা ছিল? নাকি অন্যকিছু? অন্যকে করুনা দেখাতে গিয়ে, মানুষ কোনোদিনও নিজেই আঘাত প্রাপ্ত হয় ?উত্তর জানা নেই অরুর।
চোখের সামনে কালো মার্সিডিজটা দেখেই অরুর ভাবনার সুতোতে টান পরে। তারমানে ক্রীতিক চলে এসেছে, ওদিকে অরু এখনও রেডি না হয়ে আকাশ পাতাল কল্পনায় বিভোর। আনমনা মেয়ে একটা......
*****************************************
খারাপ আবহাওয়া আর ঝুম বৃষ্টির মাঝেই ইউ এস এ ছেড়েছে ওদের প্রাইভেট জেট'টা। তবে ভৌগোলিক দূরত্ব বৃদ্ধি পেতেই ধীরে ধীরে আবহাওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছে এখন।
সেই সন্ধ্যা রাত থেকেই নিজ ক্যাভিনে পরে পরে ঘুমাচ্ছে অরু। এছাড়া অবশ্য করার কিছুই নেই ওর, কারণ চোখ খুললেই কেমন মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। পেট থেকে উগরে বেরিয়ে আসে সব খাবার। অরুর মতে সবার সামনে বমি করে ভাসিয়ে নিজের মানসম্মান খোয়ানোর চেয়ে ঘুমিয়ে থাকাই শ্রেয়, তাতে যে যা ভাবে ভাবুক।
তখন মাঝরাত, আরেকটু পরেই থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে ল্যান্ড করবে ওরা। অরু সারারাত ঘুমিয়ে কাটালেও ওরা চারজনের একজনও ঘুমায়নি, সবাই মিলে রাত জেগে একটা বড়সড় প্রি-প্ল্যান তৈরি করেছে ওরা। মাঝরাত্তিরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শেষ করে, ক্রীতিক এসেছে অরুকে একনজর দেখার জন্য। অরুর কেবিনের দরজাটা হাট করে খোলা ছিলো,যার ফলে নক করতে হয়নি আর, ক্রীতিক সোজা ঢুকে গিয়েছে ভেতরে। অরু তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ড্রিম লাইটের নীল আলোতে আজও ওর সুন্দর লতানো শরীটা দৃশ্যমান। এলোমেলো হয়ে ঘুমানোর দরুন পাজামা উঠে আছে হাঁটুর কাছে, মোমের মতো সুন্দর পা দুটোর একটাতে নুপুর নেই। কি করে থাকবে? সেটাতো বহু আগেই পার্টিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে অরু।
পায়ের দিক থেকে চোখ সরে গিয়ে ক্রীতিকের দৃষ্টিগত হলো অরুর মেদহীন দুধে-আলতা বর্ণের লতানো পেট। পেটের মাঝখানে সেই কুচকুচে কালো তিল। দেখলে মনে হবে অরুর নারীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই তার এমন মাঝ বরাবর অবস্থান।
ঘোর লাগা চোখে খানিকক্ষণ ওই তিলটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরবে শুষ্ক ঢোক গিললো ক্রীতিক।
কোন এক অজানা সংযমের কারনে ওর হাত দুটো মুঠি বদ্ধ হয়ে আছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেভিনের মধ্যেও ঘেমে যাচ্ছে শরীরটা। ক্রীতিকের পরনে ছিল ব্ল্যাক টিশার্ট আর ট্রাউজার,হাতে ক্রোকোডাইল স্কিনের ব্ল্যাক বেল্ট ঘড়ি। জিভ দিয়ে অধর জুগল ভিজিয়ে, এ-সির পাওয়ার আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলো ও। নাহ তবুও ঠান্ডা লাগছে না।
ওদিকে প্রচন্ড ঠান্ডা পেয়ে অরু নরেচরে আরও খানিকটা গুটিশুটি মেরে শুয়েছে। এবার শুধু পেট নয়, পেট পিঠ দুটোই দৃশ্যমান। উন্মুক্ত ফর্সা পিঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রেশমের মতো লম্বা চুল গুলো। ক্রীতিক নিজের অবাধ্য বাসনা গুলোকে বারবার মাথা থেকে দূর করতে চাইছে। মনটাকে রাম ধমক দিয়ে বারবার বলছে, ----ওর পেটের দিকে নয় ওর মুখের দিকে তাকা কি ইনোসেন্ট,মায়ামায়া ঘুমন্ত মুখটা।
অথচ চোখ দুটো আটকে আছে ধবধবে ফর্সা পেটে। ইচ্ছে করছে সেখানটায় আঙুল ঘুরিয়ে হাজারটা আঁকিবুঁকি করতে। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়।
ক্রীতিক খারাপ,রগচটা,বদমেজাজি হতে পারে তবে ক্যারেক্টার লেস কিংবা মেয়েবাজ ছিলোনা কোনোকালেই। ওর হৃদয়ে অরুর প্রতি এই অবাধ্য অনূভুতি গুলো কাজ করা নিতান্তই সাভাবিক। তবে এসব অদম্য অনুভূতিকে এই মূহুর্তে প্রশ্রয় দেওয়াটা ঠিক হবে না মোটেই, তাই ঘুমন্ত অরুকে কয়েকদফা ঝারি দিয়ে দ্রুত ওর কেভিন ত্যাগ করে ক্রীতিক।
অতঃপর মনসংযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য, কেভিনের বাইরে চলে গিয়ে বসে পরে ল্যাপটপ নিয়ে। কিন্তু একি, ল্যাপটপেও একটু আগের দৃশ্য ভাসমান। ক্রীতিক তৎক্ষণাৎ ঠাস করে ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, ছোট্ট জানালা ভেদ করে তিমিরে ঢাকা আকাশ পানে।
তখনই একজন কেভিন ক্রু এসে,খুবই নমনীয় সুরে শুধালো,
---- স্যার ঘন্টা খানিকের মধ্যেই ল্যান্ড করবো আমরা, কোন কোল্ড ড্রিংকস অথবা স্ন্যাক্স খাবেন?
---- পেট।
ক্রীতিকের কথাটা ঠিক বোধগম্য হলোনা লোকটার,তাই তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
---- ইয়ে মানে স্যার,কি খাবেন?
ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে জানালা থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
---- বললাম তো পেট খাবো।
ক্রীতিকের জবাবে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে আশ্চর্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাড়িয়ে আছে। লোকটার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চাহনি দেখে এতোক্ষণে ক্রীতিকের ও বোধগম্য হলো যে ওর জিহ্বা স্লিপ কে'টে ভুল যায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। আর এই মূহুর্তে এমন একটা কথা বলায় কেমন যেন অসস্থি ও হচ্ছে ওর নিজের, তাই তারাহুরো করে বললো,
---- কিছু নেবোনা, ইউ ক্যান গো।
লোকটা বো করে সম্মান জানিয়ে দ্রুত চলে যেতেই। ক্রীতিক দুহাতে নিজের চুল টেনে কটমটিয়ে অস্পষ্ট সুরে বললো,
---- তোর জন্যে কবে যেন আমি, সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাই অরু। দুনিয়াতে আর মানুষ পেলিনা, তোকে আমার স্টেপ সিস্টারই হতে হলো? না পারছি তোকে ধরতে, আর না পারছি ছাড়তে।
*****************************************
ল্যান্ডিং এর পর আরও ঘন্টা খানিক গাড়ির পথ অতিক্রম করে ভোর রাতের দিকে হোটেলে এসে পৌঁছালো ওরা পাঁচ জন। এটা হোটেল কম রিসোর্ট বেশি মনে হচ্ছে, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই রিসোর্টের বিশাল জানালা দিয়ে চাইলে স্পষ্ট চোখে সি-বিচ দেখা যায়। সেই সাথে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছে।
ওরা দুইটা ভিলা বুক করেছে, একটাতে দু'টো রুম। অন্যটাতে পাশাপাশি তিনটা। কিন্তু কে কোন রুমে থাকবে সেই নিয়েই বাধলো বিপত্তি। এলিসা কিছুতেই অর্নবের ধারে কাছে থাকবে না, ওদিকে এলিসার মতামতে অর্নবের ঘোর আপত্তি। এলিসার পাশের রুম ছাড়া কিছুতেই অন্যত্র রুম গ্রহন করবে না সে।
সায়র ওদের লাভ বার্ডের মধ্যে থাকতে নারাজ, এদিকে ক্রীতিকও সায়র কে কোনো মতেই অরুর ধারে কাছে থাকতে দেবেনা। শেষ পর্যায়ে কোনো উপায় না পেয়ে এলিসা, অর্নব, আর সায়র রক পেপার সিজার খেলেই রুম ভাগাভাগি করে নিলো।
অরু এখানে সবার চেয়ে ছোট, তারউপর ক্রীতিকের সাথে এসেছে তাই নিরব দর্শকের মতোই যে রুমটা ওর জন্য বরাদ্দ করা হলো তাতেই গিয়ে ঢুকে পরলো। সারারাতের জার্নিতে বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা, এখন একটু ঘুমানো দরকার, তাই দেরি না করে জামাকাপড় ছেড়ে আবারও এক দস্তর ঘুমিয়ে নিলো অরু।
*****************************************
ভোর রাতে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে রুমে এসে এলিসাও ঘুমিয়ে গিয়েছিল দ্রুতই। তবে ভিডিও গেইমের গো'লাগু'লির কর্কষ আওয়াজে মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাবধানেই সেই ঘুম দৌড়ে পালালো ওর। ঘুম ভেঙে যাওয়ার দরুন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে পাশ ফিরে তাকালো এলিসা।
তখনই দেখতে পায়, অর্নব ওর রুমের ডিভানে শুয়ে শুয়ে ফোনে গেইম খেলছে। অর্নব কে দেখেই এলিসার জিভটা তেঁতো হয়ে উঠলো, ভেতরটা চিড়বিড়িয়ে ফেটে পড়লো রাগে। ও চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
---- এখানে কি করছিস তুই?
অর্নব নরম কন্ঠে বললো,
---- আরে আরে আস্তে, আশেপাশে সবাই ঘুমাচ্ছে।
----- হ্যা তো? আমিওতো ঘুমাচ্ছিলাম, তাহলে তুই এখানে কেন?
----- যদি ক্লাবের লোকজন তোর খোঁজ পেয়ে তোকে ধরে নিয়ে যায়? তাই পাহারা দিতে এসেছি। আমার ঘুমের প্রয়োজন নেই তুই গিয়ে বরং ঘুমা।
----- আমি ওদের সোনার ডিম পারা হাঁস অর্নব ।ধরে নিলেও কোনো ক্ষতি করবে না আমার।
অর্নব ভ্রু কুঁচকে বললো,
---- তোর এতো তেজ কেন বলতো? আমি বলে তোর এতো তেজ সহ্য করছি, অন্য কেউ কোনোদিন সহ্য করবে না দেখিস।
এলিসা ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
---- কে বলেছে তোকে সহ্য করতে? দূর হ তুই।
---- আমাকে এতো বিরক্ত লাগে তোর?
---- হ্যা তোর এসব এক্সট্রা কেয়ার আমার বিরক্ত লাগে।কই সায়র আর জেকে তো এমন করেনা,তাহলে তুই কেন?
অনর্ব উঠে এসে এলিসার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
----- ওরা তোকে বন্ধুর চোখ দিয়ে দেখে তাই, কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখি।
এলিসা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
----- ভালোবাসার আর মানুষ পেলিনা?
এলিসার আহত কন্ঠস্বরে অর্নবের রা'গে ফেটে পরা চোখ দুটো মূহুর্তেই যেন অসহায় হয়ে গেলো। ও একটানে এলিসাকে বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে বললো,
----- ভালোবাসা কি এতো গুনে বেছে হয় বল?তোর অতীত যেমনই হোক আমি তবুও তোকে ভালোবাসি, ভবিষ্যতেও ভালোবাসবো। তুই অবহেলা করলেও বাসবো। তুই যতবার আমায় দুরে সরিয়ে দিবি ঠিক ততবার আমি চুম্বকের মতো তোর টানে চলে আসবো। তুই যদি কখনো আমাকে কাছে টেনে নিস, আমি আরও কাছে গিয়ে তোর অন্তর্আত্নায় মিশে যাবো, তাও কোনোদিন তোর পিছু ছাড়বো না। শুধু একটা অনুরোধ আমার ভালোবাসা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলিস না জান।ভালোবাসতে কারন লাগেনা। এটা ম্যাজিকের মতোই হুট করে হয়ে যায়। আমি শুধু তোর জীবন সঙ্গি হয়ে সারাটাজীবন তোর পাশে থাকতে চাই,এটা কি খুব বেশি চাওয়া বল?
অর্নবের একরাশ ভালোবাসার সীকারোক্তির মাঝেও এলিসা নিশ্চুপ। অথচ অর্নবের শার্টের ভাঁজে অশ্রু ভেজা নয়ন দুটো মুছে যাচ্ছে বারংবার, নিঃশব্দে নির্লিপ্তে......
*****************************************
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে আসা প্রচন্ড পেটের ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে ঘুম ভেঙেছে অরুর। ঘুমের ঘোরেই অস্পষ্ট সুরে অনুকে ডাকছে ও।
---- আপা পেট ব্যাথা করছে, এবার মনে হয় ম'রেই যাবো আমি।
কিন্তু আজ আর বিপরীত দিক থেকে কোন আওয়াজ এলোনা। খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করেও অনুর সারা না পেয়ে অরু যখন চোখ মেলে তাকায়,তখনই মনে পরে যায় ওতো ব্যাংককে আছে, আপা কিকরে আসবে এখানে ? উপয়ান্তর না পেয়ে দু-হাত পেটে চেপে ধরে, অরু নিজেই উঠে গিয়ে ব্যাগ হাতরে প্রয়োজনীয় জিনিস খুজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে পুরো ব্যাগ তন্নতন্ন করে ফেলেছে অরু। কিন্তু সেসব কিছুই নেই। অরুর মনে আছে, আসার সময় অনু ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছিলো, অরু আঁতকে উঠে, অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
----- তারমানে কি আপা সেসব কিছুই দেয়নি? এখন কি করবো আমি? কাকে গিয়ে বলবো?
ওদিকে পেটের ব্যাথাটা ক্ষনিকের মাঝেই হলহলিয়ে ছড়িয়ে পরেছে সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কোমড় আর পা দু'টো অসার হয়ে আসছে। অপারগ অরু প্রচন্ড পেটের ব্যা'থায় মেঝেতে শুয়েই গড়াগড়ি শুরু করে দিয়েছে। এলিসা অন্য ভিলায় আছে, পাশের রুমে কে আছে সেটাও জানা নেই অরুর। সময়ের ব্যাবধানে এতোক্ষণে হয়তো পরনের কাপড় চোপরের অবস্থাও বেগতিক ওর।
কোনোরূপ উপয়ান্তর না পেয়ে এভাবে মেঝেতে পরে থেকে ঠিক কতক্ষন যাবত কাতরাচ্ছিল তা মনে নেই অরুর। তখন দুপুর হয়ে এসেছে, দরজায় সজোরে কড়া নাড়ার ঠকঠক আওয়াজ হতেই কম্পিত হলো অরুর শরীর। মেঝেতে শোয়া অবস্থাতেই দৃষ্টিপাত করলো দরজার দিকে। বাইরে থেকে ক্রীতিকের গভীর কন্ঠ ভেসে আসছে,
------ অরু দরজা খোল।
ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে অরু আরও বেশি গুটিয়ে গেলো, এমন একটা অপ্রিতীকর পরিস্থিতিতে ক্রীতিকের মুখোমুখি হতে চায়না ও। যতই হোক ক্রীতিক ওর চেয়ে গুনেগুনে বারো বছরের বড়। আজ এভাবে দেখে নিলে,এরপর ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইবে কিভাবে ও? ওদিকে ক্রীতিক ডেকেই যাচ্ছে একনাগাড়ে ।
----- অরু দরজা খোল, নয়তো আমি পাসওয়ার্ড চেপে ভেতরে চলে আসলে গুনেগুনে শ খানেক থা'প্প'ড় খাবি তুই।
ক্রীতিকের অতিব মাত্রার হু'মকির মুখে পরে,
অরু মিনমিনিয়ে কাতর কন্ঠে বললো,
---- কিভাবে খুলবো?
ওপাশ থেকে বিরক্তির চড়ম সীমানায় গিয়ে ক্রীতিক বলে
---- কিভাবে খুলবি মানে? হাত দিয়ে খুলবি।
অরু কাঁদো কাঁদো সুরে জবাব দিলো,
---- আপনি ফিরে যান দয়াকরে।
অরুর কথাটা বলতে বাকি তার আগেই পাসওয়ার্ড চেপে ভেতরে প্রবেশ করে ক্রীতিক।
----- তুই নাকি ব্রেকফাস্ট করতে যাসনি? কেন যাসনি?
শাসাতে শাসাতে ভেতরে ঢুকে অরুকে এভাবে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো ক্রীতিক। ওর মাথার কাছে হাটু গেড়ে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
----কি হয়েছে তোর? এভাবে মেঝেতে শুয়ে আছিস কেন?পেট ব্যাথা করছে? শরীর খারাপ লাগছে খুব? ডাক্তার কে কল করবো?
অরু কাচুমাচু হয়ে চোখ খিঁচে বললো,
------ আপনি দয়াকরে চলে যান।
----- যাবো মানে? তুই হুকুম করবি আর আমি চলে যাবো? আমি কি তোর সার্ভেন্ট?
অরু জবাব দিলোনা,একেতো পেটের অসহনীয় ব্যাথা,তার উপর এই লোকের মাথা খারাপ করা ধ'মকা ধ'মকি,না পেরে নিরবে কাঁদছে অরু।
ক্রীতিক অরুকে কোলে নেওয়ার জন্য দু-হাত বাড়াতে যাবে তখন আবারও ঘোর আপত্তি জানিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে অরু,
----নাআআ,ছোবেন না আমায়। অনুরোধ করছি।
ক্রীতিক এবার অ'গ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরুর পানে,অতঃপর চোয়াল শক্ত করে বললো,
---- তোর অনুরোধ কিংবা নিষেধ কোনোটারই ধার ধারিনা আমি, সেটা ভবিষ্যতে আরও ভালো করে বুঝতে পারবি।
কথা শেষ করে একটানে অরুকে কোলে তুলে নিলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ওর একহাত হাত ভিজে এলো তরল জাতীয় কোন পদার্থে। ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে অরুকে কোলে রেখেই নিজের হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে এ জীবনে পরেনি অরু।তাই করনীয় কিছু না পেয়ে ক্রীতিকের কলার চেঁপে ধরে চোখ দুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে ও। লজ্জায়, ভয়ে মনে হচ্ছে মাটিটা ফাঁক হয়ে যাক,আর অরু তাতে ঢুকে আশ্রয় নিক। এ দুনিয়াতে আর কোন কাজ নেই ওর।
---- ওহ শীট,আমাকে কেন বলিস নি? আমি আরও ভাবলাম কি না কি।
নিজের হাতে নজর বুলিয়ে কথাটা বলে,ক্রীতিক অরুর মুখের দিকে চাইলো, যে এখনো চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে,
----- তুই কি এখনো ছোট্ট বাচ্চা অরু? তোর কি ফার্স্ট টাইম পিরিয়ড হয়েছে?
অরু চোখ বুঝে এদিকে ওদিক মাথা নাড়ালো।
ক্রীতিক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
------ তাহলে সারাদিন কেন এভাবে কষ্ট সহ্য করলি? কেন আমাকে বললি না? কি হলো উত্তর দে?
অরুর জবাব নেই, জবাব কি দিবে ওর তো লজ্জায় গলার আওয়াজই নেই।
ক্রীতিক নিজের রাগ সংযত করে অরুকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে এলিসাকে কল করে আসতে বললো।
অরু বিছানায় শুয়ে একচোখ সামান্য খুলে ক্রীতিককে দেখতে চেষ্টা করলো, যার সফেদ রঙা শার্টটা খানিকক্ষণ আগেই নষ্ট করে দিয়েছে অরুর নারী সত্তা। অথচ ক্রীতিকের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে তো এখনো তার বোকা অরুকে বকাঝকা দিতেই ব্যাস্ত।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১৮
পরন্ত বিকেলে জোয়ার এসেছে সুবিশাল সমুদ্র তটে। সমুদ্রের নীলাম্বর জল ভলভলিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে দিগুণ। জোয়ারের তালেতালে নীলরঙা স্বচ্ছ পানির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে আঁচড়ে পরছে বিস্তার বেলাভূমি জুড়ে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে মহাসমুদ্রের গহীন থেকে উঠে তীরে এসে ঠাই নিয়েছে রঙবেরঙের ঝিনুকের দল। হুট করে একনজর দেখলে মনে হবে নীল রঙা অমৃতের মাঝে কেউ চকচকে হীরে-জহরত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। সুক্ষ্ম পায়ে এক কদম করে এগোতে এগোতে সেই অতিব মূল্যবান হিরে জহরতই কুড়িয়ে হাতে থাকা প্লাস্টিকের থলেতে ভরে নিচ্ছে অরু। শীপ থেকে নামার পরেই শুরু হয়ে গিয়েছে ওর এই কর্মকান্ড।ওদিকে বাকি সবাই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, ঝিনুক কুড়াতে গিয়ে একাই পিছিয়ে পরেছে অরু। পরনে ওর ল্যাভেন্ডার কালারের ফিনফিনে লং ফ্রক, যা গোড়ালি অবধি নেমে এসে গাউনে পরিনত হয়েছে। একহাতে মুক্তা আর ঝিনুক দিয়ে তৈরি কিছু ব্যাংঙ্গলস। হাঁটু সমান লম্বা সিল্কি চুল গুলো শুধু একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকানো। এক ঝলকে দেখলে মনে হবে, এই জনমানবহীন ছেড়া দ্বীপের আধিপত্য শুধুই ওর। ওই যুগযুগ ধরে সমুদ্রে বসবাসরত রূপকথার সেই সাগর কন্যা।যে কিনা এখন ঝিনুক কুড়াতে গভীর মনোযোগী।
অরু পিছিয়ে পরেছে দেখে এলিসা পেছন ঘুরে হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠল ওকে,
--- অরু তারাতারি এসো, এতো পিছিয়ে গেলে কি করে?
এলিসার কথার মাথায় ক্রীতিকও এবার সামনে থেকে পেছনে একঝলক চোখ ঘোরালো। চোখে তার বিশাল আকৃতির রোদচশমা, লম্বা স্টাইলিস চুল গুলো সাগর তীরের ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে, বারবার ব্যাকব্রাশ করেও ঠিক রাখা যাচ্ছে না মোটেই। পরনে সাদা টিশার্টের উপর কেলভিন ক্লাইন খচিত ডেনিম ট্রাকস্যুটে গ্লোভাল সুপারস্টার দের মতোই সুপুরুষ লাগছে তাকে ।
এলিসার ডাকে অরু ঝিনুক কুড়ানো বাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওদের থেকে দূরত্ব কমালো। পেছন পেছন হাটতে হাটতে সুক্ষ্ম চোখে পরখ করতে লাগলো সাথে আসা সবাইকে, এলিসা আল্ট্রা মর্ডান ধাঁচের মেয়ে, এরকম জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপে সমুদ্র বিলাশ করতে এসেও তার ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়নি একটুও। স্কিনি লেদার প্যান্ট,পায়ে বুট, গায়ে ট্যাং টপ তার উপর লাল রঙা লম্বা কোটি। এলিসার সাথে রঙ মিলিয়ে অর্নব ও লাল রঙের শার্ট পরেছে। যা নিয়ে সেই কখন থেকে সায়র হাসাহাসি করে খিল্লি উড়াচ্ছে।
ওদের থেকে চোখ সরিয়ে অরুর চোখ গেলো ক্রীতিকের দিকে, যে সমুদ্র বিলাশে এসেও এক মনে ফোন ঘাটছে। তবে মজার বিষয় হলো, সাদা কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙে ক্রীতিককে এই প্রথম দেখলো অরু। এমন ব্যাতিক্রম স্টাইলে মানিয়েছেও তাকে বেশ। এই গ্রুপের মধ্যে সায়রই একমাত্র মানুষ যে কিনা পুরোপুরি অরুর মনের মতো।সায়রের মাথার স্ক্রু ওও সবগুলো ঠিক আছে মনে হচ্ছে। সায়র একজন গ্লোভাল মডেল তাই ওর ফ্যাশন আইডিয়াও বেশ ভালো, থ্রী কোয়ার্টারের সাথে ফ্লোরাল প্রিন্টেট শার্ট পরে এসেছে সে।
সবাইকে একে একে পরখ করা শেষ হলে অরুর চোখ গেলো বিস্তার বেলাভূমি ছাপিয়ে গহীন অরন্যের দিকে। প্রথমে কয়েক ধাপে সারিসারি নারিকেল গাছ তারপর থেকে শুরু হয়েছে গহীন জঙ্গল। লোকালয় থেকে কয়েকক্রোশ সমুদ্রপথ পারি দিয়ে তবেই হদিস মেলে অপার সৌন্দর্য বেস্টিত এই ছেঁড়া দ্বীপের। সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত এখানে দেশি-বিদেশি মানুষের তুমুল জমজমাট লক্ষনীয়। যে যার মতোন করে নিংড়ে নিচ্ছে সমুদ্র তীরের ধুলো ময়লা বিহীন পরিস্কার অক্সিজেন মিশ্রিত বায়ু।কেউ কেউ আবার মেতে উঠেছে ঢেউ খেলানো সমুদ্র স্নানে। চিরাচরিত একঘেয়ে জীবন থেকে খানিকটা ফুরসত পেয়ে চারিদিকের সবাই কেমন শিশু সুলভ আচরণ করছে। তবে এতোক্ষন যাবত একনাগাড়ে হেঁটে হেঁটে ওরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে সেটাই এখন আপাতত দেখার পালা ।
*****************************************
--- আমাদের হাতে সর্বোচ্চ সময় থাকবে দশ মিনিট। এই দশ মিনিটে ওদের ক্লাবের ওয়াইফাই, ইলেকট্রেসিটি,ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর ওদের নিজস্ব ওয়েবসাইট সবগুলো একই সাথে হ্যা'ক করবো আমি। জেকে বাইক নিয়ে ক্লাবের বাইরে থাকবে, আর সায়র, তুই হবি এলিসার এসিসট্যান্ট। যখন সবগুলো সাইট একযোগে হাতছাড়া হয়ে যাবে, তখন ওরাই নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল লাগাবে,সেই ফাঁকে তুই এলিসা আর ওর বাবাকে গিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরে বেরিয়ে আসবি। এইটা হলো শর্টকাট রাস্তা।জেকে ঠিক এই পজিশনে ওয়েট করবে।
কথাটুকু শেষ করে সায়রের দিকে ল্যাপটপ এগিয়ে দিলো অর্নব।
সায়র ল্যাপটপে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
--- সবই বুঝলাম কিন্তু আমি কেন এলিসার এসিসট্যান্ট হতে যাবো, তুই হ,আফটার অল তোর পেয়ারে লাল হলো এলিসা।
এলিসা তখন উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের মালা দেখায় ব্যাস্ত। সেদিকে একনজর তাকিয়ে
দাঁত কটমট করে অর্নব বললো,
--- তাহলে হ্যা'কিং এর কাজটা বরং তুই কর, দেখি কোন ঘোড়ার ডিম পারিস।
ক্রীতিক ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করতে করতে বললো,
--- বাচ্চাদের মতো সিল্যি ঝগড়াঝাটি বন্ধ করে আমার জন্য KTM 390 রেন্ট করার ব্যাবস্থা কর। যেনতেন বাইক রাইড করে মজা পাইনা আমি।
অর্নবের বিরক্তি মাখা চোখ দুটো এবার সায়রের দিক থেকে ঘুরে ক্রীতিকের দিকে গেলো। হেলদোলবিহীন ক্রীতিককে উদ্দেশ্য করে অর্নব তেতে বলে উঠলো,
--- তুই কোনো রাইডিং কম্পিটিশনে আসিসনি জেকে, যে তোকে পছন্দের বাইকটাই রাইড করতে হবে।
--- ক্রীতিক ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ভাবলেশহীন মুখে বললো,
--- দুটো জিনিসে আমি কম্প্রোমাইজ করিনা অর্নব,আর কোনোদিন করবোও না, তারমধ্যে একটা হলো বাইক।
সায়র আগ বারিয়ে জিজ্ঞেস করল,
--- আরেকটা?
ক্রীতিক এবার নিঃশব্দে অরুর দিকে তাকালো, যে এই মূহুর্তে খুবই মনোযোগ সহকারে ভেজা বালুর আস্তর দিয়ে ক্যাস্টল বানাতে ব্যাস্ত। অরুকে বালু দিয়ে ক্যাস্টল বানাতে দেখে সায়রও এগিয়ে গেলো সেদিকে, অরুর পাশে গিয়ে বসে আগ্রহীস্বরে বললো,
--- আমি হেল্প করবো?
অরু উল্টো প্রশ্ন করে শুধালো,
--- সত্যিই করবেন?
সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে অরুর হাতে হাত লাগায়। অরুকে সাহায্য করতে করতে সায়র খেয়ালই করেনি যে, কেউ একজন ওকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। সেই সাথে অরুকেও।
.
বালুর ক্যাস্টলটা তখন প্রায়ই তৈরি হয়ে গিয়েছে, দুজন মিলে মিশে করায় বেশ সুন্দর ভাবেই ফুটে উঠেছে ডিজাইনটা,এবার ফিনিশিং এর পালা। বালুর আস্তরে আলতো করে হাত বুলাতে গিয়ে অরুর হাতে একটুখানি স্পর্শ লেখেছে কি লাগেনি তৎক্ষনাৎ কয়েক মিটার দূর থেকে কর্কষ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো ক্রীতিক।
--- সায়রের বাচ্চাআআ।
আচমকা চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে পেছনে চাইলো সায়র, কয়েক মিটার দূরত্বে হাত মুঠি করে দাড়িয়ে থাকা ক্রীতিকের মুখ ভঙ্গিমা দেখেই ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে। ক্রীতিকের রাগে র'ক্তিম হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় ও গত আধঘন্টা যাবত সুক্ষ্ম নজরে এদিকেই তাকিয়ে ছিল। আর এই মূহুর্তে সায়রের খবর আছে, নিজেকে বি'পদ মুক্ত করতে সায়র তৎক্ষনাৎ বাম হাত দিয়ে টোকা মে'রে এতোক্ষণ ধরে একটু একটু করে সযত্নে তৈরা ক্যাস্টলটা ঠাস করে ভেঙে ফেললো। এবার শুধু ক্রীতিকের নয় অরুর মেজাজও সপ্তম আসমানে চড়ে গেলো। এক ঘু'ষিতে সায়রের নাক ফা'টিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো শালা ভিতুর ডিম একটা।
সায়র ভয়ার্ত চাহনি নিয়ে একবার ক্রীতিকের দিকে তাকালো তো আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে অরুর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিকের আওয়াজ ভেসে এলো,
--- আবার ওইদিকে চোখ দিয়েছিস?
এদের কাহিনি দেখে অরু বিরক্ত হয়ে ধাপ ধাপ পা ফেলে সেখান থেকে চলে গেলো। রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে ওর, সবাই সব সময় ওর মনটাই কেন ভে'ঙে দেয় কে জানে?
আকাশে সূর্যের তীর্যক আলো মিয়িয়ে গিয়ে গোধূলি নেমেছে। সোনালী আলোর ছটায় ঢেউ খেলানো সমুদ্রের পানিগুলো চিকচিক করছে, সাগরের পার ধরে হাটতে হাটতে ওদের থেকে অনেকটা দুরে চলে এসেছে অরু, তবুও হাটার গতি থামায়নি। ভালো লাগছে না ওর,সবাইকে কেমন পর পর লাগছে,ছোট্ট বাচ্চারা যেমন আম্মুর কাছে যাবো বলে বায়না ধরে, অরুরও তেমন বলতে ইচ্ছে করছে আপার কাছে যাবো। কিন্তু ও তো এখন আর ছোট নয়, তাই সেসব বলে নিজের আত্মসম্মানের বারোটা বাজানোরও কোনো ফুরসত নেই।
ওদিকে সায়র কে ইচ্ছেমত কতগুলো ঝাড়ি দিয়ে, অনেকটা দূরত্ব রেখেই অরুর পিছু নিয়েছে ক্রীতিক। মনে মনে বলছে
---দেখি কতদূর যেতে পারিস, আমি আটকাবো না, আটকাতে গেলে তোর খবর আছে আজ।
এরমাঝেই ক্রীতিক মোবাইল চেইক করে দেখতে পায় ওরা নেটওয়ার্কের বাইরে চলে এসেছে,ওদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে তাই ও এবার দ্রুত পা চালাতে লাগলো অরুকে নিয়ে আসবে বলে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই একটা অযাচিত দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলো ক্রীতিক, দেখলো অরু একটা অচেনা থাই লোকের সাথে একটা পার্স ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। টানাটানি বললে ভুল হবে একপ্রকার জোর জ'বরদস্তি করছে লোকটার সাথে । অরুর পাশেই দাড়িয়ে আছে অদ্ভুত দেখতে একটা কুঁজো বৃদ্ধা মহিলা,যার বিনুনি করা সাদা চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কুচকুচে কালো চুল। মহিলার ভাবভঙ্গিমাও ভারী অদ্ভুত । ক্রীতিক খানিকক্ষণ দূর থেকে দাড়িয়েই সবটা বোঝার চেষ্টা করলো, তারপর এগিয়ে গিয়ে ফট করে অরুর হাত টেনে ধরে ব্যাগটা থাই লোকটার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো,
--- আ'ম এক্সট্রিমলি সরি,ইউ ক্যান গো নাও।
লোকটা ক্রীতিককে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতেই, ক্রীতিক তীক্ষ্ণ নজরে ছদ্মবেশী বৃদ্ধার দিকে তাকালো। ওর বাঁজপাখির মতো ধারালো চোখে এক পলক চোখ পরতেই শুষ্ক ঢোক গিলে উল্টো পথে হাটা দিলো বৃদ্ধা।
তৎক্ষনাৎ হিং'স্র বাঘিনীর ন্যায় তেতে উঠলো অরু, কন্ঠে একরাশ বিরক্তি আর ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
--- আপনি কেমন লোক বলুন তো? একটা হাইজ্যা'কারের হাতে ওই বৃদ্ধা মহিলার সব টাকা পয়সা তুলে দিলেন? এতোটা নির্দয় কেন আপনি? উনি আপনার মা হলে এই কাজটা করতে পারতেন কখনো? মায়ের শাষণ বারণ ছাড়া উশৃংখল জীবনে বড় হলে এই হয়।
রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কি থেকে কি বলে ফেলছে অরু তা নিজেও জানেনা। তবে কথার মাঝ পথেই ক্রীতিকের শক্ত হাতের চপেটা'ঘাত এসে আঁচড়ে পরলো ওর নরম তুলতুলে গালে। চ'ড়ের আ'ঘাতটা এতোই জোরে ছিল যে অরুর মনে হলো ওর গালটা এক্ষুনি খসে পড়বে। উরন্ত অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গ বি'স্ফোরণের মতোই ব্যাথায় ঝলসে যাচ্ছে গালটা।
--- আগে মানুষ চিনতে শেখ, পরে জাজ করতে আসিস ইডিয়েট।
নিজ গালে হাত দিয়ে ছলছলে নয়নে ক্রীতিকের অ'গ্নিমূর্তির দিকে তাকালো অরু। অস্ত যাওয়া সূর্যের সিঁদুর রাঙা আলোয় ওর মুখটা ভ'য়ানক দেখাচ্ছে। ফর্সা আকর্ষনীয় গৌড় মুখটা মূহুর্তেই কেমন লালচে বর্ন ধারন করেছে। তীক্ষ্ণ চোয়ালটা জিদের তোপে তিরতির করে কাঁপছে।অরু মুখ উঁচিয়ে ওর কথার পাছে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্রীতিক দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
--- আমার চোখের সামনে থেকে যা অরু, নয়তো আরও মা'র খাবি।এই মূহুর্তে তোর মুখটাও আমি দেখতে চাইনা।
ক্রীতিকের কথায় পারদের মতো তেজ ছড়িয়ে পরলো অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মাথার মধ্যে আ'গ্নেয়গিরির জলন্ত লাভার মতোই রাগ উগরে উঠছে ভলভল করে, রাগের তোপে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ওর কথা শেষ হতে না হতেই হনহন করে উল্টো পথে হাটা দিলো অরু। ক্রীতিকেরও মাথায় আকাসম জিদ চড়ে আছে, তাই ও নিজেও অরুর কথা চিন্তা না করেই হাটা দিলো অরুর বিপরীত দিকে ।
*****************************************
পুরো একটা দিনের ইতি ঘটেছে হাসপাতালের ছোট্ট কামরায় বসে বসে। সারাদিনের ছোটাছুটি শেষে সন্ধ্যা হতেই ঝরঝরিয়ে ক্লান্তি নেমেছে র'ক্ত মাং'সের তৈরি যন্ত্রের মতো শরীরটায়। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে অনু,গন্তব্য ক্রীতিকের ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে ঘুমালে হয়তো ক্লান্তি কাটবে খানিকটা। বাস স্টপেজ থেকে নেমে দ্রুত হেটে ক্যাফিটেরিয়া পর্যন্ত এলেও ক্লান্তিতে এখন হাঁটার গতি ধীর হয়ে গিয়েছে ওর। মনের মাঝে জমে থাকা একরাশ অভিমান,ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর, প্রতিদিন ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো হসপিটালে টু বাড়ি সব কিছু ছাপিয়েও ওর মনে ভেসে বেরাচ্ছে খুশির লাবডুড।আর তো মাত্র কিছুদিন, তারপর মা ঠিক আগের মতো,হাটবে,চলবে,কথা বলবে ওদের দু'বোনকে শাসন করবে, আদর করবে। ও আর অরু আবারও বয়সের মাপকাঠি ভুলে মায়ের আদুরে বাচ্চা হয়ে যাবে।এর চেয়ে খুশির আর কিইবা হতে পারে। এতোসব ভাবনার মাঝেও অনুর অযাচিত মনে এক সুক্ষ্ম কৌতুহল হানা দেয়, মনেমনে ভাবে,
--- আচ্ছা মায়ের সুস্থতার পর সব কিছু একই রকম থাকবে তো?
অনু যখন সোডিয়ামের আলো ছায়াকে পেছনে ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো,তখন আবারও সেদিনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দু'টো সামনে চলে আসে ওর। রাস্তার পাশেই গাড়ির ডিকিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যয়,তার মুখোমুখি সেদিনের সেই সুন্দরী মেয়েটা। বেশভুসা তার অত্যাধুনিক। কার্ল করা ঢেউ খেলানো চুল গুলো বাদামি রঙের হলেও দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা পশ্চিমাদেশের কোনো সাদাচামড়া নয়, বরং এশিয়ান কোনো দেশের হবে হয়তো, প্রত্যয়ের সাথে যেহেতু দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশীও হতে পারে।
অনু কয়েকমূহুর্ত দাড়িয়ে সবটা পরখ করলো,তারপর এমন ভাবে ওদের অতিক্রম করে চলে গেলো যেন প্রত্যয়কে ও চেনেই না। কিন্তু প্রত্যয় অনুকে দেখা মাত্রই ওর পিছু নিয়েছে।প্রত্যয় পেছন পেছন এগিয়ে আসছে দেখে অনু হাটার গতি দিগুন বাড়িয়ে দেয়, তবুও প্রত্যয়ের পুরুষালী কদমের সাথে পেরে উঠলো না অনুর ক্লান্ত শরীরটা, এক পর্যায়ে পেছন থেকেই ওর বাহু টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো প্রত্যয়। অনু ঝাড়ি মে'রে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে বললো,
--- কি সমস্যা?
--- আপনার কি সমস্যা? ইগনোর কেন করছেন?
পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে প্রত্যয়।
অনু একটু তাচ্ছিল্য হেসে নিজের ভেতরের অজ্ঞাত বেড়ে ওঠা রাগটাকে কৌশলে আড়াল করে বললো,
--- আপনার কেন মনে হলো আমি আপনাকে ইগনোর করছি? আপনাকে ইগনোর করার কি যোগ্যতা আছে আমার?
-- কথা এড়াচ্ছেন?
--- মোটেই না, অনন্যা শেখ এতোটাও ভীতু নয়।
প্রত্যয় তীর্যক হেসে বললো,
--- আই লাইক ইট।
অনু আবারও সামনের দিকে হাটা ধরলো, প্রত্যয় ওর পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে শুধালো,
--- ফোন না ধরার কারনটা জানতে পারি?
--- ইচ্ছে করেনি তাই ধরিনি।
--- আপনার ইচ্ছেরা তো খুব বাজে,এই বলে অনুর পাঁচ আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো প্রত্যয়।
অনু হাটা থামিয়ে আবারও বিরক্তি নিয়ে বললো,
--- আবারও হাত ধরেছেন কেন?
প্রত্যয়ের নির্লিপ্ত জবাব
--- ইচ্ছে হয়েছে তাই ধরেছি , আমার ইচ্ছেরাও খুব একটা সুবিধার না বুঝলেন।
প্রত্যয়ের কথার পিঠে অনু লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম কন্ঠে শুধালো,
--- প্রত্যয় সাহেব, আপনি শুধু আমার, তাইতো?
প্রত্যয় হেসে জবাব দেয়,
--- হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
অনুর ফ্যাকাশে ক্লান্ত মুখটায় এতোক্ষণে হাসির ঝলক দেখা দিলো, নিজ হাতটা প্রত্যয়ের আঙুলের ভাজ থেকে বের করে, দুহাতে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে মাথাটা এলিয়ে দিলো প্রত্যয়ের কাঁধের উপর।
প্রত্যয় তার গমগমে পুরুষালী হাস্কি স্বরটা কিছুটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
--- টায়ার্ড লাগছে?
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ওকে দু'হাতে উঁচিয়ে কোলে তুলে নিলো প্রত্যয়। পাকিস্তানি প্লাজো আর কামিজ পরেছিল অনু, দোপাট্টা দিয়ে টেনে রাখা মাথার আধখানা ঘোমটা টা সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো ওর। মাঝরাস্তায় প্রত্যয়ের হঠাৎ কর্মকান্ডে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অনু লজ্জিত কন্ঠে মিনমিনিয়ে বললো,
--- বাড়ির কাছে চলে এসেছিতো,নামিয়ে দিন কেউ দেখে ফেলবে।
প্রত্যয় বাঁকা হেসে জবাব দেয়,
--- বাড়িতে কেউ নেই ডিয়ার।
সেই হাসিতে চিকন ফ্রেমের চশমা পরিহিত প্রত্যয়কে আবারও একদফা নতুন রুপে আবিস্কার করলো অনু।
*****************************************
রাত নয়টা বেজে পয়ত্রিশ, রাতের খাওয়ার সময় হয়েছে। এরপর আবার ঘুমানোর পালা,পরেরদিন সকাল সকাল উঠতে হবে , অথচ অরু এখনো খেতেই আসেনি। অরু যে রুমটায় থাকে তার পাশের রুমটাই ক্রীতিকের। এলিসা অর্নব আর সায়র অন্য ভিলাতে থাকে। তবে খাবারের সিস্টেম বুফে বলে, খাবারের সময় হলে সবাই একই ডাইনিং এ জমায়েত হয় ওরা।
এখন ডিনারের টাইম, ডাইনিং এ সবাই উপস্থিত অথচ অরু নেই। চারদিকে চোখ বুলিয়ে অরুকে না দেখে এলিসা বললো,
--- অরু কোথায়? এখনো খেতে আসেনি?
এলিসার কথায় ক্রীতিকও চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
--- তোরা শুরু কর আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি, মনেমনে ভাবলো,
--- আমি ধ'মক দিয়ে না ডাকলে জীবনেও আসবেনা এই ঘার ত্যারা মেয়ে।
.
অরুকে ডাকতে গিয়ে ক্রীতিক ভিলায় প্রবেশ করতেই ওর ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো, পুরো ভিলা অন্ধকারে ছেয়ে আছে, বিচ থেকে ফিরে সারা সন্ধ্যা আর রুমে আসেনি ক্রীতিক। বাইক ভাড়া করে ব্যাংককের হাউওয়েতে রাইড করে বেড়িয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ এতো রাত হয়ে গেলো এখনো লাইট জ্বালায়নি অরু আশ্চর্য।
ক্রীতিক দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রত্যেকটা রুমের লাইট জ্বালালো, অতঃপর অরুর রুমের সামনে গিয়ে ওকে ডাকতে আরম্ভ করলো। ভেতর থেকে কোন সারাশব্দ না পেয়ে ক্রীতিক বিস্মিত হয়ে পরলো, মনে মনে ভাবলো,
--- কালকের মতো কিছু হয়নিতো আবার?
কালকের কথা মনে পরতেই পাসওয়ার্ড টিপে তৎক্ষনাৎ ভেতরে প্রবেশ করলো ক্রীতিক। ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওর শীরদাড়া বেয়ে যেনো শীতল স্রোত নেমে গেলো। মনে হলো কলিজাটা কেউ খাঁ'মচে ধরেছে। পুরো রুম ফাঁকা, তাহলে অরু কোথায়?
.
এলিসা, অর্নব,সায়র কালকের ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছে আর খাবার খাচ্ছে, এলিসা ভুক্তভোগী অথচ টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে অর্নবের।সেই নিয়েই কখন থেকে হাসছে সায়র। সায়র যখন অর্নবকে নিয়ে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খাবে খাবে ভাব সেই মূহুর্তেই ছো মে'রে ওর কলার চেপে ধরে, ক্রীতিক হুংকার দিয়ে শুধালো,
--- অরু কোথায়?
সায়র অসহায়ের মতো বললো,
--- অরু কোথায় মানে? সেই যে বিকেলে উত্তম মাধ্যম দিলি তারপর আর আমি অরুর ধারে কাছেও যাইনি, বিলিভ মি, গড প্রমিস। নিজের কন্ঠানালীতে হাত ছুয়িয়ে কথাটা বললো সায়র।
ক্রীতিক আস্তে করে সায়র কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়, কপালের সবগুলো রগ ফুলে আছে ওর। চোয়াল হয়ে আছে ইস্পাতের ন্যায় শক্ত, সেভাবে থেকেই ক্রীতিক সবার উদ্দেশ্যে বললো,
--- অরুকে তোরা নিয়ে আসিস নি?
এলিসা আর অর্নব চোখাচোখি করে মিনমিনিয়ে বললো,
--- তুইতো আমাদের আগেই চলে এসেছিস, আমরা আরও ভাবলাম অরুকেও সাথে করে নিয়ে এসেছিস।
--ড্যাময়েট।
সশব্দে শক্ত কাঠের ডাইনিং এ পাঞ্চ বসিয়ে দিলো ক্রীতিক। অতঃপর চেয়ারে ঝুলানো নিজের হুডিটা টা গায়ে চড়িয়ে সায়রের উদ্দেশ্যে বললো,
--- সায়র কয়টা বাজে চেইক করতো।আমি দ্বীপে যাবো।
সায়র দ্রুত ঘড়ি দেখে বললো,
--- প্রায় দশটার কাছাকাছি, এ সময় অতদূরের দ্বীপে কোন শীপই যেতে রাজি হবেনা। তাছাড়া দ্বীপের শেষ ফেরী সন্ধ্যা সাতটায়।
--- তাহলে ইমারজেন্সী হেলিকপ্টার বুক কর।
সায়র একটু আমতাআমতা করে বললো,
-- ইয়ে মানে, এতো রাতে হেলিকপ্টার বুক করাটা কিছুটা কস্টলি হয়ে যাবে।
ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ সায়রের দিকে অ'গ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
--- সো হোয়াট? টাকা কি তুই দিবি?
*****************************************
তিমিরে ঢাকা গভীর অরন্যে পথ হাড়িয়ে পায়ে কাঁ'টা ফুটিয়ে জটলা পাকানো দানবাকৃতির বট গাছের নিচে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অরু। তখন রাগের তোপে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে একমনে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এসেছে, কোন রাস্তা দিয়ে এসেছে কিছুই মনে নেই ওর। যখন মস্তিষ্কে নাড়া দিলো যে ও গহীন জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছে তখন ঘোর আধারে ছেয়ে গিয়েছে ধরনী। আমাবস্যার রাতে জঙ্গলের মধ্যে এতোই অন্ধকার যে নিজের হাত পা পর্যন্ত খালি চোখে দেখার যো নেই। অরু যখন বুঝেছে যে ও পথ হারিয়ে ফেলেছে, তখন মতিভ্রম হারিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই দিগ্বিদিক ছুটেছে ও। যার ফলে বনবিঁচুডিতে বেধে জুতো সহ পায়ের বিভিন্ন অংশ ছি'ড়ে র'ক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে পা দুটো। হাটতে না পেরে অন্ধকারের মাঝেই অসহায়ের মতো গলা ফাটিয়ে ডেকেছে সবাইকে। অথচ নিরব বেলাভূমিতে একটা মানুষের আওয়াজ ও শোনা যায়নি, বরং ওর ডাকের বিপরীতে ভেসে এসেছে রাত জাগা বন্য প্রানী আর হুতুম পেচাঁর গা গুলানো ভ'য়ানক আওয়াজ। এক পর্যায়ে ডাকতে ডাকতে গলার স্বর ভে'ঙে গিয়েছে ওর। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে শরীর আর মনের জমাট বাঁধা ব্যাথা নিয়েই গাছের নিছে বসে পরেছে অরু। ফুপিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে নিস্তব্ধ অরন্য। কান্নার তালেতালে কেঁপে উঠছে ওর ছোট্ট শরীরটা।
এভাবেই কিছু সময় অতিবাহিত হয়, অরু এখনো হাটুতে মুখ গুঁজে কাদঁছে।চারিদিকে তাকাতেও কেমন গা ছমছম করছে ওর, সেসময় হঠাৎ শুকনো পাতার মরমর আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে সামনে চাইলো অরু, চারিদিকে অন্ধকার সামনে পেছনে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা অথচ পায়ের কাছে কোনোকিছুর উপস্থিতি সুস্পষ্ট। কিন্তু কি? ব্যাপারটা বোঝার জন্য নিজের একপায়ের ছেড়া জুতোটা দুরে ছুড়ে মারলো অরু, সঙ্গে সঙ্গে ফনা তুলে হিসহিসিয়ে উঠলো, জংলী এক সরীসৃপ। হঠাৎ করে নিজের এতো কাছে সাপের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্রন্দনরত মুখটাকে দু-হাতে চেপে চোখ মুখ খিঁচে দৌড় লাগালো অরু। অন্ধকারে দৌড়াতে গিয়ে বনবিচুঁডিতে বেধে বারবার হুমড়ি খেয়ে পরছে ও,তবুও শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পুনঃরায় দৌড়াতে লাগলো অরু। একপর্যায়ে চোখের সামনে জলন্ত দুটো চোখের উপস্থিতি টের পেয়ে সে ছোটার গতি আবারও থমকে গেলো ওর। হঠাৎ করে অন্ধকার জঙ্গলে এমন জলন্ত চোখ দেখে, ভ'য় আ'তঙ্কে জর্জরিত হয়ে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো অরু। মনে মনে ভাবলো,
---এটা আবার কি? কোনো বাঘ ভাল্লুক নয়তো? এবার আমি কোন পথে যাবো? কাল সকাল অবধি আদৌও বেঁচে থাকবো তো?
ওই ভয়'ঙ্কর চোখ দুটো ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে , ব্যাপরটা বুঝতে পেরে আবারও উল্টো পথে ছুট লাগালো অরু। দৌড়াতে গিয়ে গাছের সাথে লেগে জামার হাতাটা ছিড়ে পিঠ অবধি নেমে এসেছে, তবুও থামলো না অরু, জীবন বাজি রেখে দৌড়াতে লাগলো যেদিকে দু'চোখ যায়, সেদিকে। এভাবে ছুটতে ছুটতে মাঝপথে হঠাৎ করেই আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ওর। দ্রুত বেগে দুহাত চলে গেলো চোখের উপর।তীব্র ঘূর্ণন বাতাসে হাটু সমান লম্বা চুল গুলো উড়ে যেতে চাইছে যেন। এতোবেশি তীব্র বাতাস আর শব্দতে মনে হচ্ছে, শুধু চুল নয়, রোগা পাতলা গড়নের অরুও বোধ হয় উড়ে যাবে উচ্ছিষ্ট আবর্জনার ন্যায়।
কিসের এতো বাতাস, আর শব্দ?সাগর পারে কি ঘূর্নিঝড় শুরু হলো কিনা, বোধগম্য হলোনা অরুর, এতোক্ষণ অন্ধকারে থাকা চোখ দুটো হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যেন এখন পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বেশ কিছুক্ষন বাদে একটু রয়েসয়ে চোখ দুটো খুললো অরু, আর চোখ খোলা মাত্রই মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে যেন ধরেপ্রান চলে এলো ওর।
হেলিকপ্টারের নিয়ন আলোতে অরু দেখলো, ওর থেকে বেশ অনেকটা দুরে বিশাল হেলিকপ্টারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা মতো একজন। পরনে তার কালো হুডি। নিস্প্রভ চোখ দুটো অাহতদের মতো অরুর দিকেই নিবদ্ধ তার। চারিদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে এতোক্ষনে অরু খেয়াল করলো ও দৌড়াতে দৌড়াতে সাগরপাড়ে চলে এসেছে। আর চোখের সামনে যে মানুষটা নিস্প্রভ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সে আর কেউ নয় সয়ং ক্রীতিক। ওর সেভিয়র। মানুষটা ক্রীতিক এটা বোধগম্য হতেই দৌড়ে গিয়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো অরু। অরু এতোটা জোরেই ক্রীতিকের বুকে ঝাপিয়ে পড়েছিল যে ক্রীতিকের পেশিবহুল শরীরটাও কম্পিত হয়ে ওঠে । কা'দঁতে কা'দঁতে একহাতে ক্রীতিকের হুডি খামঁচে ধরে অন্যহাত দিয়ে ক্রমাগত ওর বুকে আ'ঘাত করে যাচ্ছে অরু। বিপরীতে ক্রীতিক টু শব্দও করছে না, চুপচাপ চোখ বন্ধকরে দাঁড়িয়ে আছে। কারন এই মূহুর্তে উপরওয়ালার কাছে ওর চেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ হয় আর কেউ নেই।
.
ক্রন্দনরত অরু এখনো ওকে ইচ্ছে মতো কি'লঘু'ষি দিয়ে যাচ্ছে, ক্রীতিক তাতে নজর না দিয়ে আলতো হাত বুলিয়ে দিলো অরুর নরম তুলতুলে গালে, যেখানটায় ওর পাঁচ আঙুলের ছাপ এখনো দৃশ্যমান। ইচ্ছেতো করছে আরও গভীর ভাবে আদর করে দিতে।কিন্তু তাতো সম্ভব নয়, তাই নিজের হুডিটা খুলে, সেটা দ্বারা অরুর পুরো শরীর ঢেকে দিয়ে,ওকে কোলে নিয়েই উঠে গেলো চলন্ত হেলিকপ্টারে।
অরু এখনো ক্রীতিকের কলার ছাড়েনি, একইভাবে ধরে রেখেছে, ওর বোধ হয় বিশ্বাস ছিল ক্রীতিক ওকে রেখে দ্বীপ ছেড়ে যাবেনা,কিছুতেই যাবেনা।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১৯
পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দোচালা আলিশান ভিলার গা ডাবিয়ে দেওয়া নরম বিছানাতে এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুম নামছে না দু'চোখের পাতায়। অবাধ্য মনটা ক্রমাগত অন্যকারো নাম জপে যাচ্ছে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পর থেকেই। রুমের এক পাশে স্থীর মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খোলা। সেথা থেকে পাতলা ফিনফিনে সফেদ পর্দা ছাপিয়ে হুহু করে বাসন্তিক হিমেল হাওয়া এসে শরীর নাড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার , তবুও ঘুম কুমারীর দেখা নেই।
হুট করে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে আকর্ষনীয় স্টাইলিশ চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতেই দক্ষিণ জানালার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো ক্রীতিক। কপালে তার গভীর চিন্তার ভাঁজ।ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট ধরিয়ে, মুখে বিড়বিড়ানো অস্পষ্ট আওয়াজ,
--- কি করবো আমি?দিনে দিনে আমার আনহেলদি্ অবসেশনে পরিনত হচ্ছিস তুই । পাশ ফিরেই তোকে দেখতে পাবো এমন দিনের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমায়?তোকে যে আমার চাইই চাই।
এইটুকু বলেই ক্রীতিকের সাভাবিক মুখভঙ্গিমা অনেকটা কাঠিন্য রূপ ধারণ করে, ব্লে'ডের মতো তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত করে পুনরায় বিড়বিড়ালো সে,
--- যেই মূহুর্তে মনটাকে আর মানাতে না পারবো, ঠিক সেই মূহুর্তে এসব ফা'কিং বয়সের পার্থক্য, সম্পর্কের জটিলতা কিংবা এর চেয়েও আরও বড় কোনো বাধা, সব কিছুকে জাস্ট উপড়ে ফেলে দেবো আমি। মাইন্ড ইট অরোরা শেখ। সেদিন আমার কাছে কেঁদে কেটেও লাভ হবেনা, আমি এতোটাও সদয় নই। নিজের জিনিস আমি চেয়ে নয় কেড়ে নিই।
একমনে হাজারো কথা আওড়ে কাবার্ড থেকে শার্ট বের করে সেটাকে টিশার্টের উপর পরে, শার্টের হাতাদুটো ভাজ করতে করতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় ক্রীতিক।
*****************************************
গভীর আমাবস্যা রাত। মাথার উপর আজ আর চাঁদের দেখা নেই। ছোট বড় তারকারাজিরাও মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। চারিদিকে ঘুম ঘুম পরিবেশ বিরাজমান। এই মূহুর্তে সবাই হয়তো ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে।কিংবা কেউ কেউ মেতে উঠেছে ভালোবাসা আদান প্রদানের চড়ম প্রতিযোগীতায়। অথচ অরুর রুমে চকচক করছে ইলেকট্রনিক বাল্বের চোখ ধাঁধানো আলো, শরীরটা ক্লান্তিতে ভার হয়ে আসছে,চোখ জোড়াও ঘুমাতে যাওয়ার জন্য নিসপিস করছে সেই কখন থেকে, কিন্তু তার উপায় কোথায়? এই অবস্থায় ঘুমাতে গেলে হাত পায়ের কাঁ'টা ছেড়া যায়গা গুলোতে মলম কে লাগাবে? তাছাড়া জঙ্গলে দৌড়াতে গিয়ে পিঠের কাছেও অনেকটা কেঁ'টে গিয়েছে। সেখানটাতেই আপাতত কটন দিয়ে একটু একটু করে এন্টিসেফটিক লাগাচ্ছে অরু, আর খানিকবাদে বাদে চোখ ঘুরিয়ে জানালা গলিয়ে নিশুতি আধার রাতে হাতড়ে বেড়ানো জোনাকিপোকা পরখ করছে ,যাতে কাজ করতে করতে ঘুম না পেয়ে যায় আবার। অরু যখন নিজেকেই নিজে সারিয়ে তোলার কাছে প্রচন্ড মনোযোগী ঠিক তখনই কোনোরূপ নক না করেই পাসওয়ার্ড টিপে ওর রুমের ভেতর প্রবেশ করে ক্রীতিক।
এতো রাতে আচমকা কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অসাবধানতায় লাফিয়ে ওঠে অরু, মাথা তুলে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত নিজের কাধ থেকে জামাটা তুলে ফেলে মিনমিনিয়ে বলে,
--- মেয়ে মানুষের রুমে নক করে ঢুকতে হয়,সেটাও জানেন না? ম্যানারলেস লোক কোথাগার।
--- তোর রুমে আবার আমাকে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে? পিচ্চি মেয়ে একটা, দেখি কোথায় লেগেছে?
কথা বলতে বলতেই অরুর কাছে এগিয়ে যায় ক্রীতিক। হাত বাড়িয়ে দেয় অরুর ঘাড়ের কাছে। অরু দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে নিজের জামাটা চেপে ধরে বললো,
--- আপনার চেয়ে ছোট হতে পারি,তবে বয়সের দিক দিয়ে আমি অতোটাও ছোট নই।
নিজের গোপনীয় ক্ষতটা ক্রীতিককে দেখাতে অরু সংকোচ বোধ করছে বুঝতে পেরে, ক্রীতিক হাঁটু গেড়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে ওর এক পা তুলে নেয় নিজের উরুর উপর,তারপর সেটাকে মনোযোগ সহকারে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলে,
--- তাই নাকি? বিয়ের বয়স হয়েছে?
--কিহ!
ক্রীতিক চোখ তুলে অরুর চোখে চোখ রেখে পুনরায় শুধালো,
--- বিয়ের বয়স হয়েছে? বরকে সামলাতে পারবি?
ক্রীতিকের হঠাৎ করা ছো'বলের মতো প্রশ্নে অরুর লজ্জায় চোখ বুঝে আসছে, ও দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
--- ব্যাথা পায়ে হাত কেন দিয়েছেন?
--- আরো ব্যাথা দেবো বলে।
ক্রীতিকের উত্তরে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর,অবিশ্বাস্য কন্ঠে নিজের পা'টা ক্রীতিকের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, ও বললো,
--- সত্যিই আবার ব্যাথা দেবেন?
অরুর কথাটা বলতে যতক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে পুরোরুমে ঝঙ্কার তুলে শব্দ করে হেসে উঠলো ক্রীতিক। ক্রীতিককে এভাবে হাসতে দেখে আপনা আপনি ফাঁক হয়ে গিয়েছে অরুর ওষ্ঠাধর। চোখ দুটো হয়ে উঠেছে হাঁসের ডিমের মতো গোল গোল। ও কি সত্যি দেখছে,নাকি সবই স্বপ্ন বুঝে উঠতে পারছে না অরু। অরু কে সেই কখন থেকে হা হয়ে থাকতে দেখে ক্রীতিক নিজের চিরাচরিত রূপে ফিরে এসে, গম্ভীর মুখে বলে,
--- হা করে আছিস কেন? মাছি খাওয়ার শখ হয়েছে?
ক্রীতিকের কথার পাছে অরু অবিশ্বাসের সুরে বলে ওঠে,
--- আপনি হাসতেও পারেন?
অরুর কথায় কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না করে ক্রীতিক হাত বাড়িয়ে বলে,
--- ওই পা দেখি।
অরু সামান্য উঁকি দিয়ে দেখলো, ওর একটা পায়ে খুব সুন্দর করে ব্যান্ডেজ বেধে ফাস্টএইড করে দিয়েছে ক্রীতিক, এরপর আরেকটা পা-ও নিজের উরুর উপর রেখে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
--- এই পায়ের নুপুর কোথায়?
অরু ঠোঁট উল্টে অসহায় সুরে বললো,
--- হারিয়ে ফেলেছি।এই নুপুরটা আমার খুব পছন্দের ছিল জানেন, তাইতো একটা হারিয়ে যাওয়ার পরেও আরেকটা খুলিনি।
নুপুরের প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য পায়ে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে হঠাৎ করেই ক্রীতিক শুধালো,
--- আচ্ছা অরু, সেদিন ক্যাথলিন তোকে রেগেমেগে কি এমন বলেছিল?
প্রথমে অরু একটু সময় নিয়ে ভাবে,তারপর মনে পরার মতো চট করেই মিনমিনিয়ে ঠোঁট টিপে হেঁসে ওঠে ও।
--- কি ব্যাপার হাসছিস কেন?
অরু হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,
--- হাসবো না? এলিসা আপুর কাজিনতো তো আপনার জন্য এক কথায় ফিদা, রাগে গজগজ করতে করতে আমাকে কতোকথাই না শোনালো সেদিন।বলে কিনা, আমাকে যাতে আপনার ধারে কাছেও আর না দেখা যায়। আমি আসার পর থেকে নাকি আপনি বদলে গিয়েছেন।
কথাটুকু বলে আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অরু, হাসতে হাসতে বলে,
--- উনিতো আর জানেনা, আমি আপনার চিরাচরিত শ'ত্রু, জানলে বোধ হয় এসব কথা জীবনেও বলতো না। আমার কি মনে হয় জানেন? এলিসা আপুর কাজিনের মাথা নির্ঘাত সমস্যা আছে।
ক্রীতিক নিজের হাতের কাজ থামিয়ে বললো,
--- এমন কেন মনে হলো তোর?
--- তো মনে হবে না? আপনার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছে আপুর কাজিন,আর মানুষ পেলোনা আমি আর আপনি?সাপ আর বেজি, নানা দা আর কুমড়ো!!কথা বলতে বলতে আবারও কুটকুটিয়ে হেসে ওঠে অরু।
এতোক্ষণ ধরে বসে বসে অরুর কথার বহর শুনে গেলেও ওর শেষ কথাটা বোধ হয় পছন্দ হয়নি ক্রীতিকের। অরুর হাসি মুখের দিকে এক নজর বি'ভৎস চাহনি নিক্ষেপ করে সঙ্গে সঙ্গে ওর ব্যান্ডেজ করা ক্ষ'ত পা'টা শক্ত হাতে চেপে ধরলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের হাতের বাধনটা এতোটাই বেশি শক্ত ছিল যে হুট করেই অরুর মনে হলো, ওর কলিজা ধরে টান দিয়েছে কেউ, হঠাৎ করে এমন প্রচন্ড ব্যাথায় আঁতকে উঠে শব্দ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো অরু,
--- আহহহ, কি করছেন?ব্যাথা কেন দিচ্ছেন?
ক্রীতিক ওর পা'টা ধা'ক্কা মে'রে সরিয়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,
--- আমি তোর নার্স কিংবা সার্ভেন্ট নই যে রাত যেগে বসেবসে তোর ক্ষ'ততে মলম লাগাবো।
ধা'ক্কা লেগে ক্ষত থেকে পুনরায় তরতাজা র'ক্ত বেরিয়ে এসে সাদা ব্যান্ডেজ র'ক্তরাঙা হয়ে ভিজে উঠেছে, অরু সেখানটায় হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখ খিঁচে রেখেছে। বন্ধ চোখ জোড়া থেকে নিঃশব্দে গড়িয়ে পরছে অস্রুসিক্ত নোনাজল।
ক্রীতিক তাতে নজর না দিয়েই হনহন করে বেরিয়ে যায়, যাওয়ার আগে শেষবারের মতো পেছন ঘুরে মনেমনে আওড়ায়,
--- তোর ভুল ধারনা খুব শীঘ্রই ভেঙে যাবে অরু। তুই আমার না হলে, অন্য কারোর না।
****************************************
সন্ধ্যা হতে না হতেই স্ফটিকের লাল,নীল, বেগুনি আলোর ঝলকানিতে চিকচিক করছে সুবিশাল ক্লাবের চারিদিক। ভেতর থেকে ডিজে গানের ধিমধিম আওয়াজ ভেসে আসছে রাস্তা পর্যন্ত। একে একে ভেতরে প্রবেশ করছে,ক্যাডিলাক,মার্সিডিজের মতো নামি দামি গাড়ির বহর। পৃথিবীতে হাতে গোনা নামি-দামি যে কয়েকটা ক্যা'সিনো ক্লাব রয়েছে তার মধ্যে ব্যাংককের কিং ক্লাব একটি। বছরের বিভিন্ন সময়ই পৃথিবীর নামি-দামি পকার প্লেয়াররা জু'য়ায় টাকা জেতার জন্য জমায়েত হয় এখানে। একের পর বেট ধরে জিতে নেয় কোটি কোটি টাকা। এলিসাও তাদের মধ্যে একজন,সবার প্রিয় নাম্বার থার্টিন। এই নামেই সবাই ওকে চেনে। সবার ভালোমতোই জানা যেই ক্লাব ওকে নিতে পারবে তারাই তরতর করে সবচেয়ে ধনী ক্যা'সিনো ক্লাবে পরিনত হবে। কিন্তু এলিসাতো আর এসবে জড়াবে না,আজকেই এই পা'পের দুনিয়াতে ওর শেষ দিন। শুধু একবার ভালোয় ভালোয় বাবাকে নিয়ে ফিরতে পারলেই হলো।
স্ফটিকের আলোতে জ্বলজ্বল করতে থাকা কিং ক্লাবের নেইম-প্লেটের সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন।
চারিপাশের পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে এলিসার বেশভূষা ও চোখ ধাঁধানো আজ। ঝিকিমিকি টপস আর লেগিংসের সাথে পায়ে এটে আছে কয়েক ইঞ্চি লম্বা পেন্সিল হীল। মেকআপের আস্তরনের সাথে ম্যাচিং করে ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক,চোখে কালো সানগ্লাস। ওর পাশেই স্যুট বুট পরে ফর্মাল লুকে দাড়িয়ে আছে সায়র,চোখে পরেছে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখতে তাকে পুরোপুরি এ্যাসিসট্যান্টের মতোই লাগছে। সায়রের পাশেই বাইকে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লেদার জ্যাকেট আর হেলমেট পরিহিত জেকে। চারিদিকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সবটা পরখ করে, অর্নব এগিয়ে এসে বললো,
--- গাইস সব ঠিকঠাক, এলিসা তুই সায়রকে নিয়ে ফ্রন্ট গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ কর। আমি বেজমেন্টে ঢোকার সাথে সাথেই কাজ শুরু করবো, মনে রাখিস হাতে মাত্র দশমিনিট সময়।আই রিপিট মাত্র দশমিনিট। এরপর আর এতোগুলা সার্ভার একসাথে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে পারবো না আমি।আর জেকে তুই এখানেই ওয়েট কর, এলিসা ওর বাবাকে নিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে তুই এলিসাকে নিয়ে চলে যাবি, ওর বাবাকে আমরা ম্যানেজ করবো।
কথাটুকু শেষ করে সবার কানে একটা করে ব্লুটুথ লাগিয়ে দিলো অর্নব।
--- নাও গো....
.
দশমিনিট প্রায় শেষ হতে চললো, ক্রীতিক সুক্ষ্ম নজরে কাচের দেওয়াল বেস্টিত ক্লাবের দিকে তাকিয়ে আছে, এতদূর থেকে ভেতরের কোনো কিছুই ঠাহর করার উপায় নেই, শুধু বোঝা যাচ্ছে এতোক্ষণ ধরে জ্বলতে নিভতে থাকা ঝিকিমিকি আলোর বহর হুট করেই পুরোপুরি নিভে গিয়েছে। ভেতরের মিউজিক আলো দুটোই নিভে যাওয়ার দরুন ক্রীতিক সচকিত হয়ে ব্লুটুথে মনোযোগ দিলো, কিন্তু না ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। তৎক্ষনাৎ কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো অর্নব, আশেপাশে একনজর চোখ বুলিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
--- দশ মিনিট শেষ হতে চললো, ওরা কোথায়?
ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে বললো,
--- ঠিক বুঝতে পারছি না, কোনো বড় বি'পদ হওয়ার আগে আমাদের ভেতরে যাওয়া দরকার, সায়র যা ভীতুর ডিম ওকে ভরসা নেই।
ক্রীতিকের কথায় সায় জানিয়ে অর্নব তৎক্ষনাৎ ক্লাবের দিকে হাটা দেয়, পেছন থেকে ক্রীতিক আবারও ডেকে ওঠে ওকে,ক্রীতিকের ডাকে সারা দিতে অর্নব ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলে, ওর দিকে একটা রি'ভলবার ছুড়ে দিয়ে ক্রীতিক বললো,
--- ক্যাচ ইট।
অর্নব রি'ভলবারটা ক্যাচ করে, হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো, নিজের কোমড়ের খাঁজে আরও একটা রি'ভলবার গুঁজতে গুঁজতে হালকা চোখ টিপে ক্রীতিক বলে,
--- ফর সেইফটি পারপাস, আফটার অল ভেতরের সবার কাছেই এটা আছে।
.
এলিভেটর দিয়ে ওরা দুজন যখন ক্লাবের সবচেয়ে বড় হলরুমটাতে প্রবেশ করে,তখন চারিদিকে নিস্তব্ধতায় ঘেরা, এতো মানুষ এতো হইহট্টগোল সব কেমন হাওয়ায় উবে গিয়েছে, বাইরে থেকে আসা নিয়ন আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারিদিকের টেবিল চেয়ার গুলো উল্টেপাল্টে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, অর্নব আর ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চন করে চোখাচোখি করলো, অর্নব নিচু স্বরে বললো,
--- হোয়াটস রং? সবাই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো?
--- যে যেখানে খুশি যাক, এলিসার বাবাকে আমার মোটেও সুবিধার মনে হয় না, লোকটা চরম ধূর্ত। এই মূহুর্তে এলিসা আর সায়রকে সেফ রাখাই আমাদের মেইন টার্গেট।
ক্রীতিকের কথায় অর্নব হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। তখনই ওর পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে একটা কাঁচের ক্যা'সিনো সাজানো টেবিল ঝনঝন করে মেঝেতে পরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হল রুমের লাইট জ্বলে ওঠে, ভেতরের রুম থেকে একে একে বেরিয়ে আসে সবাই। সায়র আর এলিসার কপালে ব'ন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে সয়ং এলিসার বাবা। ওদের দুজনকে দেখা মাত্রই খু'নখুনিয়ে কেঁদে ওঠে সায়র,
অর্নব ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত সুরে বলে,
--- মেয়েদের মতো কাঁদছিস কেন হাদারাম, তোদের বাঁচাতেই তো এলাম।
ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে এলিসার বাবার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
--- আবারও নিজের মেয়ের সাথেই নোংরা চাল চাললেন মি.ত্রিপিটক।
ক্রীতিকের কথায় লোকটা কপট হেঁসে বললো,
--- এতো কথা ভাল্লাগছে না, চলো সহজ ডিলে আসি, তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে চলে যাও, আর আমার মেয়েকে আমার কাছে রেখে যাও, ওকে ছাড়া আমার ক্যাসিনো বিজনেসটা একেবারে নড়বড়ে হয়ে আছে।
লোকটার কথায় ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে একটু তাচ্ছিল্য করে হাসলো, অতঃপর ঘাড় কাত করে বললো,
--- গেলে আমরা চারজনই যাবো। প্রয়োজন পরলে আপনাকে উপরে পাঠিয়ে যাবো,কারন আপনাদের মতো মানুষের প্যারেন্টস হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই।
কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলিসাকে টান দিয়ে ওর মাথায় রি'ভলবার ঠেকালো ক্রীতিক। ক্রীতিকের কান্ডে এবার অর্নব ও কিছুটা ভরকে গিয়ে বললো,
--- জেকে কি করছিস ?
অর্নবের কথায় কান না দিয়ে ক্রীতিক এলিসার বাবাকে বলে, আপনি ওকে মা'রতে পারতেন না ত্রিপিটক , কারন এলিসা আপনার সোনার ডিম পারা হাঁস, বাট আমি পারবো,কারন ও আমার দুই পয়সার কাজেও আসেনা,ইভেন নিজেকে বাঁচানো জন্য শুধু এলিসা কেন ওদের সবাইকে মা'রতেও আমার এক মিনিটও টাইম লাগবে না।যাস্ট পয়েন্ট আর তারপর শ্যু'ট।
এলিসার বাবা হেঁসে বললো,
--- ভয় দেখাচ্ছো?
ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ সায়রের পা বরাবর একটা গু'লি করে দেয়, গু'লির আওয়াজে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে সায়র। এলিসা অর্নব ওরাও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের দিকে। নিজের বন্ধুকে এভাবে উইথআউট ও'য়ার্নিং গু'লি করাতে এলিসার বাবাও খানিকটা ভরকে গিয়েছে মনে মনে ভাবছে,
--- এই ছেলে যে যখন তখন এলিসাকে গু'লি করে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
চারিদিকে গুমোট পরিবেশ বিরাজমান। ক্রীতিক এলিসাকে নিয়েই এক পা দু'পা করে মেইন গেইটের কাছে চলে এসেছে। সায়র এখনো বসে বসে কাঁদছে, ক্রীতিক অর্নবকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই অর্নবও ধীরে ধীরে দরজার কাছে চলে যায়, ওদিকে এলিসার মাথায় গা'ন পয়েন্ট করে রাখায় এলিসার বাবা নরতেও পারছে না চরতেও পারছে না, অর্নব কাছে এগিয়ে আসতেই ক্রীতিক স্পষ্ট বাংলায় বলে,
--- দরজার গুপ্তমন্ত্র বদলে ফেল অর্নব।
ক্রীতিকের কথার আগামাথা বুঝতে না পেলে, অর্নব ভ্রু কুঁচকে বললো,
--- কি বদলে ফেলবো?
--- গুপ্তমন্ত্র, গুপ্তমন্ত্র, দরজার গুপ্তমন্ত্র।
অর্নব বিরক্ত হয়ে বললো,
--- আরে ভাই গুপ্তমন্ত্রটা আবার কি?
ক্রীতিক দাঁত কটমটিয়ে বললো,
--- ইংলিশে যদি বলি দরজার পাসওয়ার্ড চেঞ্জ কর তাহলে তো ওরা বুঝে যাবে ছাগল।
ক্রীতিকের কথায় অর্নব দ্রুত পাসওয়ার্ড বদলানোর কাজে লেগে পরে, ওদিকে অর্নব কে বুঝাতে গিয়ে, এলিসার বাবা সহ সকলেই ক্রীতিকের পালানোর উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছে, তাই তারাও ধীর পায়ে ওদের ধরার জন্য এগিয়ে আসছে, সায়র এখনো পা ধরে বসে বসে কাঁদছে।
--- ডান।
অর্নব শব্দটা উচ্চারণ করতেই দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায় ওরা তিনজন, যাওয়ার আগে দরজা ঠেলে সায়রের উদ্দেশ্যে ক্রীতিক চেঁচিয়ে বললো,
--- দ্রুত আয় গাঁধা তোর পায়ে কিছু হয়নি, তাকিয়ে দেখ গু'লিটা প্যান্টে লেগেছে।
ক্রীতিকের কথা কানে পৌঁছাতেই সচকিত হয়ে তখনি তরিৎ বেগে দৌড়ে দরজার বাইরে চলে এলো সায়র। এবং আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দরজাটা সশব্দে লাগিয়ে দিলো ক্রীতিক। যেহেতু অর্নব পাসওয়ার্ড বদলে দিয়েছে তাই এলিসার বাবা সহ ক্লাবের সবাই কক্ষের মধ্যেই আটকা পরে গিয়েছে। বাইরে এসে এলিসাকে ধা'ক্কা মে'রে অর্নবের বুকে ঠেলে দিয়ে সায়রের হাত টেনে, ওকে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো ক্রীতিক।
হঠাৎ এলিসাকে এতো কাছে আবিষ্কার করে ওর গালে টুপ টুপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো অর্নব। এলিসা বিরক্ত হয়ে কটমটিয়ে কিছু বলবে তার ফুরসত না দিয়েই ওর হাত ধরে অর্নব ও দৌড়াতে লাগলো স্ব গতিতে ।
পেছনে একবার চোখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষন করে দৌড়াতে দৌড়াতেই ক্রীতিক বললো,
--- তারাতারি চল, অরু ভিলাতে একা আছে।
সায়র ছোটার গতি কমিয়ে দিয়ে বললো,
--- তারাতারি যাওয়ার কি আছে ভাই, অর্নব তো পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়ে এলো।
ক্রীতিক অর্নবের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
-- অর্নব কঠিন পাসওয়ার্ড দিয়েছিস তো?
দৌড়াতে দৌড়াতেই অর্নব মিনিমিনিয়ে জবাব দিল, তারাহুরোয় মাথায় কিছু আসেনি তাই এলিসার নাম দিয়ে এসেছি।
অর্নবের কথায় ওরা সবাই আহাম্মক বনে গেলো, ক্রীতিক দাঁত কিরমির করে বললো,
--- ইডিয়েট, আগে বলবি না? জলদি দৌড়া।
ক্লাবের নিচেই বাইক রাখা ছিল, একটা বাইকে ক্রীতিক আর সায়র উঠে পরে, অন্যটাতে এলিসা আর অর্নব। অর্নব রাইড করতে পারেনা,তাই এলিসাই ওদের বাইকটা রাইড করছে।
রাইড করে কিছুদূর যেতেই পুলিশে কল দিয়ে সায়র নিজের নাম পরিচয় গোপন করে ক্যা'সিনো ক্লাবের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। ওরা এখন পুরোপুরি আশঙ্কা মুক্ত ব্যাপারটা বুঝে আসতেই, বাইকে বসেই গুনগুনিয়ে গান ধরেছে সায়র। ক্রীতিক রাইড করতে করতেই বললো,
--- কিরে, এমন একটা সময় তোর গানও মনে পরছে? একটু আগেই তো ভ্যা ভ্যা করে মেয়েদের মতো কেঁদে ফেলেছিলি।
--- তা কাঁদবোনা? তুই কিভাবে পারলি আমাকে পয়েন্ট করে গু'লি ছু'ড়তে?
--- তোর গায়ে তো আর লাগেনি।আমার নিশানার উপর আমার কনফিডেন্স আছে।
--- কি করে শিখলি এতো ভালো গান পয়েন্টিং?
ক্রীতিক মৃদু হেসে বললো,
--- মন্ত্রীর ছেলে বলে সেল্ফ প্রটেকশনের জন্য বাবা স্পেশাল ট্রেইনার দিয়ে শিখিয়েছিলেন।
ক্রীতিকের কথায় সায়র ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো।
বাংলাদেশের কথা মনে পরতেই সব রেখে ক্রীতিকের মস্তিষ্কে হানা দেয় শুধু মাত্র অরু, অরুর কথা মাথায় আসতেই ক্রীতিক বলে,
--- সায়র ধরে বস।
--- আমাকে কি তোর মেয়ে মনে হয়? যে সিনেমাটিক ওয়েতে ধরে বসবো?
--- না ধরলে নাই।আমি জাস্ট ওয়া'র্ন করলাম।
কথাটা বলেই হাওয়ার বেগে বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ওর কোমড় চেপে ধরে সায়র কাঁপতে কাঁপতে বলে,
--- একটু স্পীড কমা ভাই, ভয় করছে। বমি করে দেবোতো।
--- পসিবল না অরু একা আছে। এই বলে আবারও ফ্লাই ওভারে টার্ন নিলো ক্রীতিক।
*****************************************
সামনে পেছনে চারিদিকের সবকিছু ঘোলাটে লাগছে, মাথাটা চলন্ত ফ্যানের ন্যায় ভনভন করে ঘুরছে। পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি দলা পাকিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে। হাত পা থরথরিয়ে কাপছে। বাইক থেকে নেমে হেলেদুলে কেবলই নিজের রুমে এসেছে সায়র, তবুও এখনো হৃদপিন্ডটা কেমন ধুকপুক করছে ওর। হাই স্পীডে বাইক রাইড দিয়ে ওকে এক প্রকার রোগী বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ক্রীতিক। রুমে এসে মনেমনে ক্রীতিকের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে সায়র, হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে জোরে শ্বাস নিতে নিতেই কটমট করে সায়র বললো,
---কোন অলক্ষুণে ওর মতো মানুষ আমার বন্ধু হয়েছিল কে জানে? কখনো ঠাস করে গু'লি মে'রে দিচ্ছে, তো কখনো বাইকে চড়িয়ে কলিজা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, সাইকো একটা। সায়র কথাটা শেষ করতে পারলো না, তৎক্ষনাৎ ধাপ ধাপ করে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে ওর কলার চেপে ধরে ক্রীতিক দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
--- আমার অরু কই?
আচমকা আ'ক্রমণে লাফিয়ে উঠে বসলো সায়র কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
--- তোর সমস্যা কি জেকে? অরু হারিয়ে গেলেই তুই সব সময় আমাকে তে'ড়ে আসিস, কেন ভাই? আমিকি তোর অরুকে পকেটে লুকিয়ে রাখি? তারপর নিজের পকেট ক্রীতিকের চোখের সামনে ধরে বললো,
--- দেখ, এই দেখ কোথাও তোর অরু নেই।
সায়রের ফাজলামো গায়ে না মেখে ক্রীতিক পুনরায় শুধালো,
--- দেখেছিস কিনা সেটা বল।
ক্রীতিকের অ'গ্নিমূর্তি লক্ষ্য করে, শুষ্ক ঢোক গিলে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো সায়র।
ক্রীতিক সায়রকে ছেড়ে এলিসা আর অর্নবের দরজায় গিয়ে সশব্দে কড়া নাড়লো। ওরা ও মাত্রই রুমে প্রবেশ করেছিল, ক্রীতিকের ডাকে দ্রুত বেরিয়ে এসে এলিসা শুধালো
---কি হয়েছে জেকে?
এলিসার মুখটা মলিন, নিজের বাবার বি'পদের কথা চিন্তা করতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ঠকেছে মেয়েটা, বাবার হাতেই ম'রতে ম'রতে কোনো মনে বেঁচে ফিরেছে আজ। তাই নিজের রাগ ঢাক ভেতরে পুরে শান্ত স্বরে ক্রীতিক বললো,
--- অরুকে দেখেছিস এলিসা?
এলিসা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
--- কেন রুমে নেই? এতো রাতে কোথায় যাবে?
--- কোথাও নেই দেখেই তো তোদের জিজ্ঞেস করছি।
ততক্ষণে অর্নবও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে, সবটা শুনে ও বললো,
--- চল রিসিপশনে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি, কোথাও বেরোলে তো ওখান থেকেই বেরিয়েছে।
অর্নবের কথা যুক্তিসঙ্গত মনে করে, হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলো ক্রীতিক।
.
ওরা চারজন রিসিপশনে এসে জানতে পারে খানিকক্ষণ আগেই বেরিয়েছে অরু, কোথায় বেরিয়েছে সেটা তারা জানেনা।
রিসিপশনিস্টের কথায় মাথায় র'ক্ত চড়ে গিয়েছে ক্রীতিকের, মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে আজ অরুকে পেলে ওর হাতের মা'র খেতে খেতে অরুর খবর আছে।
অর্নব, সায়র এগিয়ে এসে বললো,
--- এখন কি করবি?
ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
--- ইডিয়েট একটা আমাকে চিন্তায় না রাখলে শান্তি হয়না মেয়েটার ,আজ খুঁজে পেলে খবর আছে ওর।
নিজের অর্ধেক বয়সী স্টেপ সিস্টারের জন্য ক্রীতিকের এমন বেসামাল, উদ্বিগ্নতা দেখে আবারও নতুন করে প্রশ্ন জাগে ওদের তিনজনার মনে, কেন এতো উন্মাদনা,কিসেরই বা এতো আসক্তি?
*****************************************
প্রায় ঘন্টা খানিক সি-বিচের এ মাথা ওমাথা হাতরে বেরিয়েছে ক্রীতিক। সেই সাথে সায়র অর্নবও অরুকে খুঁজেছে হন্যে হয়ে, রাত তখন প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। চারিদিকের ঘুটঘুটে আঁধার ছাপিয়ে সাগরের তীর আলোকিত হয়ে জ্বলছে সোডিয়ামের নিয়ন আলো, নিস্তব্ধতায় ঘেরা সমুদ্রতীরে ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে বারেবারে, রাত গভীর হয়ে যাওয়ায় একে একে মানুষ ফিরে গিয়েছে স্ব গন্তব্যে, ক্রীতিকের বেজায় অস্থির লাগছে চোখ দুটো বারবার এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, এভাবে ঘুরপাক করতে গিয়েই ওর চোখ আটকে যায় অদূর থেকে হেঁটে আসা লম্বা চুলের মেয়েটার দিকে। ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে ওই মেয়েটাই অরু। তাই ও আর স্থীর না থেকে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো অরুর পানে। অনেকটা দূরত্ব ঘুচে গিয়ে ক্রীতিক যখন পুরোপুরি অরুর মুখোমুখি,ঠিক তখনই ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো অরু। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো অজানা আ'তঙ্কে। মনেমনে ভাবলো,
-- আজ আমি শেষ। রিপ অরোরা শেখ।
অরুর পেছনে আরও দুইটা থাই মেয়ে ছিল হাতে তাদের ঘুড়ি আর লাটাই। ক্রীতিক তাদেরকে এক নজর পরখ করে অরুর কাছে এসে ওকে সজোরে চ'ড় মা'রতে উদ্যত হয়েও থমকে যায়, উল্টে দু'হাত দিয়ে টান মে'রে আচমকা টেনে নেয় নিজ বুকের মধ্যিখানে।
এক্ষুনি গালে চ'ড় হামলে পরবে, সেই ভ'য়ে চোখ মুখ খিঁচেই রেখেছিল অরু। কিন্তু কিছু সময় যেতেই শরীরে শিহরণ জাগানো সেই স্যান্ডাল উড পারফিউমের ঘ্রানটা নাকের খুব কাছে অনুভব হতেই পিটপিট করে চোখ খুললো ও।আবারও একই ঘোর লাগানো অনুভূতি, ক্রীতিকের শরীরের শুকিয়ে যাওয়া ঘাম, পারফিউম, ধুলোবালি মিশ্রিত এই মাতাল মাতাল পুরুষালি সুঘ্রাণটা কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা অরু, হাত পা কেমন অসার হয়ে আসে, কান গাল সব কিছু ছুঁয়ে যায় অজানা উষ্ণতায়। বারবার বেসামাল হয়ে ওঠে ভেতরের সুপ্ত নারীসত্তাটা। অথচ ক্রীতিক ওকে নিজের বুকের মাঝে এমন ভাবে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে যে ক্রীতিকের শরীরের নেশা ধরানো সুঘ্রাণটা ক্রমাগত অরুর হৃদয়ে গিয়ে ঠেকছে। খানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে ক্রীতিক উদ্বিগ্ন সুরে শুধালো,
--- অরু তোর বয়স কতো?
কোথায় গিয়েছিলি, কেন গিয়েছিল, কিভাবে গিয়েছিলি কোনোরূপ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন না করে এমন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করায়, অবাক হয়ে মুখ উঁচিয়ে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো অরু। পরক্ষণেই ওর চোখ গেলো ক্রীতিকের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরও তিন জোড়া চোখের দিকে, যারা এই মূহুর্তে রিয়েলিটি শো দেখার মতো করে অষ্টাদশীর প্রেমে বেসামাল হয়ে ওঠা জায়ান ক্রীতিক চৌধুরীকে দেখছে।
সবাইকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু মুখ কাচুমাচু করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
--- ছাড়ুন সবাই কি ভাবছে।
--- আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি অরু।
ক্রীতিকের স্পষ্ট আদেশে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরু বলে,
--- আঠারো বছর, ছয়মাস, তেরোদিন। এবার ছাড়ুন।
--- পার্ফেক্ট।
নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে অরুর চোখ গেলো এবার ক্রীতিকের পায়ের দিকে, গোড়ালি থেকে খানিকটা উপরে ফোল্ড করা ডেনিম প্যান্ট পরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্রীতিক। তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে অরু বলে ওঠে,
--- একি আপনার জুতা কোথায়?
পেছন থেকে হাঁক পেরে একজোড়া স্নিকারস দেখিয়ে সায়র বলে,
--- এই যে আমার হাতে।তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটু পা'গল পা'গল হয়ে গিয়েছিলাম কিনা।
অরু দ্রুত সায়রের সামনে গিয়ে মিনতির সুরে বললো,
--- সরি ভাইয়া আপনারা কেউ ছিলেন না বলে, না বলেই বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি রিসিপশনিস্ট কে বলে এসেছিলাম কিন্তু উনি আমার ইংলিশ পুরোপুরি বুঝতে পারেনি বোধ হয় ।
--- অরু যা, এলিসার সাথে রিসোর্টে গিয়ে ঘুমিয়ে পর।
এমনিতেই মাঝরাতে সবাইকে চিন্তাগ্রস্থ করে ছেড়েছে, তাই ক্রীতিকের কড়া আদেশে আর নাকোচ করতে পারেনি অরু চুপচাপ চলে গিয়েছে এলিসার হাত ধরে।
ওদিকে সায়র, অর্নব আর ক্রীতিক বসে পরেছে উত্তাল ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়ে, আজ বোধ হয় ওরা আর ঘুমাবে না।
..............................................................................
𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃
***Download NovelToon to enjoy a better reading experience!***
Updated 62 Episodes
Comments