সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]

#পর্বঃ২৯

বন্ধুর আকাশ ছুঁই ছুঁই পর্বতমালার নিম্নভাগে জোছনা রাতের রুপোলী ঝকঝকে আলো এসে পৌঁছাতে পারেনা কোনোকালেই। সেথায় এখনো ঘোর আমাবস্যা বিরাজমান। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর তমসাচ্ছন্ন,শুধুমাত্র পাহাড়ের এককোণে গুহার মধ্যে যে গুপ্তঘরটা রয়েছে, সেখান থেকেই জেনারেটর চালিত বৈদ্যুতিক বাল্বের নিয়ন আলোর ছটা এসে ঠেকছে নরম সবুজ কচি ঘাসের উপর। অতীব সুন্দর সেই ম্যাজিকাল আলোছায়া আর ঘাসের আস্তরকে পায়ে মাড়িয়ে তরিৎ বেগে এদিক ওদিক পায়চারি করছে নিখিল। কপালে তার দুশ্চিন্তার গভীর ভাজ, শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপা, শার্টের উপর পরা সফেদ রঙা এ্যাপ্রোনটার এথায় সেথায় শুকিয়ে যাওয়া র'ক্তের ছোপ ছোপ দাগ।

কুঁচকে রাখা ছোট ছোট চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে, একটু আগেই কোনো অপকর্ম করে ধরা খেয়েছে সে।এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতেই দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে একমনে কি যেন বিরবির করছে একনাগাড়ে ।দেখলে মনে হবে কোনো কিছুর হিসেবে কষছে।

নিখিলের এমন উদভ্রান্তের মতো কর্মকান্ড দেখতে পেয়ে গুপ্তঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে লিও। এক ছুটে বেরিয়ে আসাতে তার স্থুলকায় দেহটা হাঁপিয়ে ওঠে, সে নিখিলের সামনে দাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে শুধায়,

---- কি হয়েছে, এখনো কাজ শুরু করছো না যে? রাত শেষ হয়ে যাবে তো।

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ফট করে দু'হাতে লিওর কলার খা'মচে ধরলো নিখিল, অতঃপর চোয়াল শক্ত করে দাঁত খিচিয়ে বললো,

--- তোমাকে আগেই বলেছিলাম এই কয়জনে হবেনা, সবকিছুর একটা পরিমাণ রয়েছে, পরিমাণের বাইরে ওদের শরীর থেকে অতিরিক্ত হরমোন বের করলে সবগুলো মা'রা পরবে। তখন ধনকুব হওয়ার বদলে জেলে পঁচে ম'রতে হবে আমাদের।

নিখিলের কথায় লিও শুষ্ক ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠে শুধালো,

--- এএখন কি করবো?

নিখিল পুনরায় পায়চারি করতে করতে বিড়বিড়িয়ে বলে,

--- জানিনা, রাশিয়ান মাফিয়াদের থেকে এডভান্স ডলার নিয়ে ফেলেছি, যে করেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

লিও মুখ কাচুমাচু করে বললো,

--- কিন্তু এই সময় নতুন করে টিনএজ হরমোন কোথায় পাবো?

লিওর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিখিলের হাটার গতি সহসা থেমে যায়, ও আঙুল উঁচিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় জ্বলতে থাকা ফেইরী লাইট আর মাঝ আকাশে উড়তে থাকা নিভু নিভু জ্বলন্ত ফানুস গুলো দেখিয়ে লিওকে শুধালো,

--- ওখানে কি হচ্ছে?

লিও ঠোঁট উল্টে বললো,

--- মেইবি কোনো গ্রুপ ক্যাম্পিং এ এসেছে।

নিখিল তৎক্ষনাৎ গটগটিয়ে যায়গা ত্যাগ করে, বড়বড় পা ফেলে উঠতে থাকে পাহাড়ের চূড়ায় ।ওর কান্ডে পেছন থেকে লিও হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠে বললো,

--- আরে কোথায় যাচ্ছো?

নিখিল যেতে যেতে পেছনে না তাকিয়েই ক্রুর হেসে বললো,

--- সব কিছু রেডি করো, আসছি আমি।

*****************************************

আজকাল স্টুডেন্টরাও হয়েছে ফাজিল একেকটা, কথা নেই বার্তা নেই যখন তখন কল দিয়ে কনভার্সেশন শুরু করে দেয়, আর থামার নামই নেই। প্রথমে পড়াশোনা দিয়ে শুরু করবে, তারপর সুযোগ বুঝে ধীরে ধীরে ঢুকে যাবে ব্যক্তিগত আলাপে। আমেরিকান মেয়েরা এতো নির্লজ্জ আর বেহায়া কেন কে জানে?

স্টুডেন্টের বাড়তি প্যাচাল প্রথমে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলেও এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছে রগচটা, বদ মেজাজী ক্রীতিক। একেতো চড়ম মূহুর্তে কল দিয়ে মুডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, তারউপর রাত বিরাতে কল দিয়ে ঢংয়ের আলাপ, অসহ্য।স্টুডেন্টদের কাছে ক্রীতিক বরাবরই চুপচাপ, হুম,হা ছাড়া উত্তর দেওয়া ওর ধাঁচে নেই, তাইতো কথা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখের উপর ফোন বন্ধ করে দিয়েছে একদম । এবার হাজারটা কল দিলেও আর ক্রীতিকের নাগাল পাওয়া যাবেনা, সে যতই প্রয়োজনীয় আলাপ হোকনা কেন।

কিছুক্ষন নিরিবিলি দাড়িয়ে থেকে, নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝ থেকে একবুক বাতাস ভরে নিয়ে, ক্রীতিক পুনরায় এগিয়ে গেলো ক্যাম্পিং ভ্যানের দিকে। ওদিকে সবাই মহা আনন্দে ফানুস উড়াচ্ছে। ক্রীতিক ভাবলো অরুকেও দেখাতে হবে এই রোমাঞ্চকর দৃশ্যটা, নয়তো এতো দূরে ক্যাম্পিং এ আসার মজাটাই মিস করে যাবে মেয়েটা, তাই ভেতরে না গিয়ে বাইরে থেকেই অরুকে ডেকে উঠল ক্রীতিক,

--- অরু বাইরে আয়,যাস্ট লুক সামথিং স্পেশাল ইজ হ্যাপেনিং হেয়ার। কাম ফাস্ট,অরুউউ?

ভেতর থেকে অরুর কোনোরূপ সারা শব্দ না পেয়ে এবার ক্রীতিক নিজেই ধীর গতিতে ক্যাম্পিং ভ্যানের ভেতরে প্রবেশ করলো।

.

চারিদিকে ফানুসের ছড়াছড়ি। একের পর এক উড়ন্ত ফানুসের টিমটিমে আলোয় পুরো পাহাড়টাকে অপার্থিব সুন্দর লাগছে। ক্যাম্প ফায়ারের পাশেই চাঁদের পাহাড় গান বেজে চলেছে সেই তখন থেকে, পুরোই এডভেঞ্চারাস পরিবেশ। পাহাড়ের এককোনে দাড়িয়ে এলিসা উরন্ত ফানুস গুলোকে সুক্ষ্ম নজর দিয়ে পরখ করছে। তা দেখে, অর্ণব একটা ফানুস নিয়ে এগিয়ে এসে এলিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

---- এলি, ফানুস উড়াবি আয়।

এলিসা তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে অর্ণবের হাতে হাত রাখে। তারপর দুজন মিলে এগিয়ে যায় ফানুসটাকে উন্মুক্ত করে দিতে। ফানুসের মধ্যে জ্বলতে থাকা সোনালী আলোয় এলিসার হাতের হিরে খচিত আংটিটা চকচক করছে করছে খুব। অর্ণব সেটার দিকে একবার পরখ করে ওর চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। এলিসার ধূসর চোখ দুটোতেও জ্বলন্ত ফানুসের নিদারুণ প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান। স্থির চোখে মুখে ধামাচাঁপা পরে আছে একরাশ খুশির ঝিলিক। অর্ণব সেই খুশিকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,

--- আই লাভ ইউ এলি। শুধু আজ বা কাল নয় জনম জনমের ভালোবাসা তুই আমার।

অর্ণবের কথার প্রতিউত্তরে এলিসাও লাজুক হেসে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই কোথা থেকে যেন ছুটে এসে এক থা'বায় সায়রের কলার টেনে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে ক্রীতিক বললো,

--- আমার অরু কই?

সায়র বেচারা বসে পপকর্ন চিবুতে চিবুতে অর্ণব এলিসার সিনেমাটিক প্রেম নিবেদন দেখছিল, হঠাৎ এমন অতর্কিত আ'ক্রমণে তৎক্ষনাৎ পপকর্ন ওর গলাতেই আটকে গেলো। কাশি দিতে দিতে ক্রীতিককে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কোনো মতে ফ্যাসফ্যাসিয়ে বললো,

--- ছাড় ভাই, আমি সত্যিই জানিনা অরু কই। তোরা দুজন তো হুট করেই একসাথে উধাও হয়ে গেলি। তোরা স্বামী স্ত্রী তোদের প্রাইভেসির ব্যাপার আছে, ওই জন্য আর ডাকিও নি আমরা।

সায়রের কথায় ক্রীতিক নিজেকে সংবরণ করে ওর কলার ছেড়ে দেয়।তখনই ওপাশ থেকে এলিসা আর অর্ণব এগিয়ে এসে শুধালো,

--- কি হয়েছে জেকে।

ক্রীতিক থমথমে মুখে এদিক ওদিক হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো,

--- ডোন্ট নো, অরু কোথাও নেই।

এলিসা উদ্বিগ্ন সুরে বললো,

--- কোথাও নেই মানে? ও তো তোর সাথেই ছিল।

ক্রীতিক জিভ দিয়ে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে চিন্তিত গলায় বললো,

--- হ্যা তখন তো ছিল, আমি নিজেই ওকে ক্যাম্পিং ভ্যানে রেখে একটা ফোন কল রিসিভ করতে একটু দূরে গিয়েছিলাম আর তারপর.....

ক্রীতিক নিজের তেঁতো গলার অযথা সীকারোক্তি শেষ না করেই চট করে সায়রকে বললো,

--- সায়র, তুইনা এলিসা অর্ণবের সারপ্রাইজ মোমেন্ট ধারণ করার জন্য হিডেন ক্যামেরা সেট করেছিলি?

সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে,ক্রীতিক পুনরায় বলে,

---- কোথায় কোথায় সেট করেছিলি, সব গুলো বের কর, কুইক।

এবার শুধু সায়র নয়, ওর সাথে সাথে অর্ণবও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ক্যামেরা গুলো খুঁজে বের করতে।এই মূহুর্তে ক্রীতিকের মাথা ফে'টে যাচ্ছে দু'শ্চিন্তায়। অতিরিক্ত দু'শ্চিন্তার ফলে সুকৌশলী মস্তিষ্কটাও হ্যাং করছে বারংবার। রাতের আধারে এমন অচেনা অজানা পার্বত্য এলাকায় হঠাৎ করেই কোথায় চলে যেতে পারে মেয়েটা। তাও ক্রীতিককে না জানিয়ে?

কিছুক্ষণ আগেই তো সবকিছু কতোটা মসৃণ হয়ে উঠেছিল ওদের মাঝে। অরু বারবার বলেছিল,

--- আমি শুধু আপনাকেই চাই। নিজ স্বামীরূপে আপনি ছাড়া অন্য কারও মুখ আমি কল্পনাও করতে পারিনা।

সেসব কথা ভাবলে এখনো ক্রীতিকের হৃদয়টা এক অজানা উষ্ণতায় ছেয়ে যায়।মস্তিষ্ক ঘীরে ধরে কাল্পনিক সুখের ভাবনারা।অথচ এখন এভাবে হুট করে হারিয়ে গিয়ে কেমন দুশ্চিন্তায় পাগ'ল বানিয়ে দিচ্ছে ওকে। এটা কি ঠিক হলো?খানিকক্ষণ আগে কাটানো ভালো সময় গুলোর কথা মনে পরতেই মূহুর্তের মধ্যে আ'গ্নেয়গিরির অ'গ্নি'স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পরলো ক্রীতিকের পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ।ও আর চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো না, ধাপ ধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেলো ক্যামেরা গুলোর দিকে।

মনিটরের স্ক্রিনে একে একে সবগুলো ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ চেক করা হলে শেষ ক্যামেরাতে এসে চোখ আটকে গেলো ওদের সবার,শুধু চোখ আটকে গেলো বললে ভুল হবে রীতিমতো কাশাকাশি শুরু হয়ে গিয়েছে সবার। ভিডিওতে অরুর সাথে করা ক্রীতিকের একান্ত মূহুর্তের পাগলামি গুলো দেখে এলিসা, অর্ণব, সায়র তিনজনই ক্রীতিকের পানে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করে, একই সুরে বলে ওঠে,

--- তোরা একটু আগে এসব করছিলি?

সায়র বড়বড় চোখ করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললো,

--- সি, হি ইজ সো ডেস্পারেট, মেয়েটাকে শ্বাস পর্যন্ত নিতে দিচ্ছে না।

সায়রের কথায় এলিসা অর্ণব মুখ টিপে হেঁসে দিলো।

ওদের খিল্লি আর মজা মাস্তিকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে ক্রীতিক বললো,

--- জাস্ট শাট আপ, টেনশনে আমার মাথা ফে'টে যাচ্ছে, আর তোরা এখানে মজা নিচ্ছিস। তাছাড়া অরু আমার বিয়ে করা বউ, যা খুশি, যেভাবে খুশি,যেখানে খুশি করবো তোদের বাপের কি?

ওদের তর্কবিতর্কের মাঝেই ভিডিওর একটা যায়গাতে অর্নব পজ করে বললো,

--- গাইস লুক।

তৎক্ষনাৎ ক্রীতিক সচকিত হয়ে এগিয়ে এসে স্ক্রিনে চোখ রাখলো। অর্ণবকে সরিয়ে দিয়ে , রিপিট করে ওই একই সিন টুকু বারবার টেনে টেনে দেখছে ক্রীতিক। চার সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এ্যাপ্রোন পরা কেউ একজন এসে অরুর সাথে হেঁসে কুশলাদি বিনিময়ের মতো করে কথা বলছে, অতঃপর অরু তার পেছন পেছন অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে।

অর্ণব পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,

--- কে হতে পারে এই এ্যাপ্রোন পরা লোকটা?

সায়র সহসা এগিয়ে এসে ভালো করে নজর বুলিয়ে বললো,

--- আরে এটাতো নিখিল অরুর ক্রাশ।

--- অরুর বাচ্চাআআআ!

অকস্মাৎ ক্রীতিকের গর্জনে কেঁপে উঠলো ওরা সবাই। ক্রীতিক উঠে দাড়িয়ে ভ্যানের সামনে রাখা স্টুলটাকে সজোরে লা'ত্থি মে'রে রাগে থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,

--- ওকে একবার খুঁজে পাই, মেরে ওর গাল ফাটিয়ে দেবো আমি, তখন সারাজীবনের মতো ক্রাশ খাওয়া ভুলে যাবে।

অর্ণব এগিয়ে এসে ক্রীতিকের কাঁধে হাত রেখে বললো,

--- ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাব জেকে, এটাকি আদৌও পসিবল? অরুতো তোর সাথে এসেছিল, একটু আগে তোরা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছিলি, তাহলে হঠাৎ করে অরু কেন নিখিলের সাথে চলে যাবে? তাও কাউকে কিছু না জানিয়ে?

তাছাড়া অরু এডাল্ট, বিয়ের মর্ম কতটুকু সেটা ও ভালো করেই বোঝে,তাও তোকে না জানিয়ে কেন যাবে? আর সবচেয়ে বড় কথা।

অর্ণব কথা শেষ করার আগেই পাশ থেকে এলিসা গুরুগম্ভীর গলায় বললো,

--- নিখিল এখানে কি করছে?

অর্ণব এলিসার দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে বললো,

--- রাইট, এই না হলে আমার সোনা।

অর্ণবের আহ্লাদী কথায় এলিসা দাঁত কিরমিরিয়ে উঠে বললো,

--- চুপ করবি তুই? সিরিয়াস কনভার্সেশন চলছে এখানে।

ক্রীতিক ওদের কথায় কান না দিয়ে দ্রুত নিজের মোবাইল বের করে লোকেশন ট্র্যাকারে ঢুকে পরলো।

সায়র শুধালো

---কি খুঁজছিস?

ক্রীতিক কিছু একটা সার্চ করতে করতে বললো,

--- কিছুদিন আগে আমি অরুকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলাম, সেটার লোকেশনই আমার ফোনে কানেক্ট করে রেখেছিলাম।যদি কখনো প্রয়োজন হয় সেটা ভেবে।

সায়র দাঁত কটমটিয়ে বললো,

--- সেটা আগে বলবিনা?

ক্রীতিকের এই মূহুর্তে কোনোকিছু ঠিক নেই, চোখ দুটো ঝাপসা লাগছে অগত্যাই, আঙুলের ভাঁজে ধরে রাখা ফোনটা তিরতিরিয়ে কাঁপছে। ও বারবার নিজের ফোকাস ধরে রাখতে চাইছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না।অনবরত হাতের পিঠ দিয়ে নাকের ডগা মুছছে, কিছুই নেই তবুও মুছছে। এলিসা, অর্ণব, সায়র সবাই ক্রীতিকের অতিরিক্ত অবসাদগ্রস্থতার কথা জানে, তার উপর অরু মিসিং ক্রীতিক নিশ্চয়ই এখন নিজের মধ্যে নেই। মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগে ক্রীতিকের বারবার ঘাড় ফুটানো আর নাকের ডগা মোছা দেখে এলিসা এগিয়ে শান্ত গলায় শুধালো,

---- কিছু পেলি? কোনো লোকেশন?

ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- লাস্ট লোকেশন দেখে তো এই পাহাড়েরই আশেপাশে কোনো একটা যায়গা মনে হচ্ছে।

তৎক্ষনাৎ অর্নব আর সায়র ছুটে এসে ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,

--- কই দেখি?

মোবাইলের লোকেশনটা ভালো মতো পরখ করে চোখ কপালে উঠে গেলো অর্ণবের,অবিশ্বাসের সুরে ক্রীতিককে শুধালো,

--- এটা কি আসলেই অরুর লোকেশন?

ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- কেন কি হয়েছে?

অর্ণব শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,

--- আমার জানা মতে এই গুহাটা পরিত্যক্ত, বহুবছর আগে আমেরিকান একটা রিসার্চ টীম এখানে কিছু অ'বৈধ রিসার্চ চালাতো, ওরা টিনএজ ছেলেমেয়েদের হরমোন সংগ্রহ করে সেটাকে প্রসেস করে মৃ'তদেহের স্নায়ু সচল রাখতে ব্যবহার করতো। ইটস আ হিউজ ডে'ঞ্জার। পরবর্তীতে আমেরিকান গভমেন্টের নজরে এলে, তারা পুরোপুরি নিষেধা'জ্ঞা জারি করে দেয় এই রিসার্চের উপর। এছাড়া ওই টীমের সবাইকে শা'স্তির আওতায় আনা হয়েছিল তখন।

অর্ণবের কথা শেষ হতেই এলিসা চট করে বললো,

--- অরুও তো টিনএজ? সি ইজ অনলি এইটিন প্লাস।

এলিসার কথাটা পুরোই বি'স্ফোরণের মতো গিয়ে হাম'লে পরলো ক্রীতিকের উদ্বিগ্ন মস্তিষ্কে। ওর সচিকত চোখ দেখে মনে হচ্ছে ও যেন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলেছে। দু-হাতে নিজের লম্বা চুল গুলো সজোরে টেনে ধরে, কিছু একটা ভেবে ক্রীতিক অস্ফুটে বললো,

--- নিখিল ইজ আ বায়োলজিকাল সাইন্টিস্ট, ওহ নো! দিস মা*** ফা***বা***। ওকে আমি জ্য'ন্ত ক'বর দেবো আজ।

ক্রীতিকের চড়ম ক্ষীপ্রতায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওরা তিনজন একই সুরে শুধালো,

--- কি হয়েছে?

ক্রীতিক আর জবাব দিলোনা মোবাইলের লোকেশনে চোখ বুলাতে বুলাতে অন্ধকারের মাঝেই পাহাড়ি আঁকাবাকা সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো পরিত্যক্ত গুহার দিকে।

পেছনে আলো জালিয়ে রাস্তা পরিস্কার করে ওর পথ অনুসরণ করে স্ব গতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো আরও তিন জোড়া পা। তারা আর কেউ না,ওর জীবন মর'নের বেস্টফ্রেন্ডস, ওর দুঃসময়ের সাথী অর্ণব, এলিসা আর সায়র।

*****************************************

পাহাড়ের ঢালে এসে গুহার মুখোমুখি হতেই থমকে গেলো ওরা। গুহার মুখে পাহারাদারের দাঁড়িয়ে আছে এক বিশালাকৃতির লৌহগেইট। তাতে আবার পাসওয়ার্ড লাগানো। অর্নব এলিসার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বললো,

--- জান ফ্ল্যাশ ধর আমি এটার ব্যবস্থা করছি।

সায়র পেছন থেকে ভীত স্বরে বলে ওঠে,

--- আমার কেমন যেন ভ'য় করছে ভাই, যদি ওরা আমাকেও ধরে নিয়ে রিসার্চ করতে বসিয়ে দেয়।

অর্ণব পাসওয়ার্ডের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে বললো,

--- তুই কি টিনএজ শালা? বয়স ত্রিশ পার হয়ে গেলো এখনো ভীতুর ডিমই রয়ে গেলি।

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- তোরা প্লিজ তাড়াতাড়ি কর, দম আটকে আসছে আমার।

--- হয়ে গিয়েছে।

পাসওয়ার্ড আনলকড এর পিক পিক আওয়াজ হতেই সবাইকে ঠেলে ভেতরে চলে গেলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের পেছন পেছন ওরা তিনজনও ঢুকে পরলো গুপ্তঘরে। ঘরটাতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা উৎকট গন্ধে চোখমুখ কুঁচকে এলো ওদের সবার। শুধু মাত্র ক্রীতিকেরই কিছুতে কিছু হচ্ছে না। ও হন্তদন্ত হয়ে উদভ্রান্তের মতো চারিদিক হাতরে বেরাচ্ছে।

বাইরে থেকে যায়গাটাকে যতটা অন্ধকার আর ভুতুড়ে লাগছিল, ভেতরে তেমন কিছুই নয়, বাল্বের আলোয় চারিদিক ফকফকে পরিস্কার। রুমের মধ্যে যত্রতত্র বিভিন্ন মেশিন আর ক্যা'মিক্যালের শিশি দিয়ে পরিপূর্ণ। ক্রীতিকের অবশ্য এতোকিছুতে নজর নেই, ও একটা একটা করে পর্দা,সেলফ, মেশিন সবকিছু তচনচ করে অরুকে খুঁজছে। খুঁজতে খুজঁতে ভেতরের রুমে ঢুকতেই সেই উৎকট গন্ধটা যেন দিগুণ বেড়ে গেলো এবার।মনে হচ্ছে এখনই গলা দিয়ে খাবার উগড়ে আসবে। ক্রীতিক কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই সামনে এগিয়ে যায়। ভেতরের দিকে এগিয়ে গিয়ে চারিদিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পায় কিছু কাচের তৈরি কফিন, যেগুলো স্বচ্ছ পানি দিয়ে ভর্তি, তারমধ্যেই ভাসছে অল্পবয়স্কা মেয়েদের দেহগুলো। একেকটা কফিনে একেকটা মেয়ে। পানির মধ্যে ভাসমান মেয়েগুলোকে দেখতে কি ভ'য়ানকই লাগছে।

---আচ্ছা এদের মধ্যে অরু নেইতো?

প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ক্রীতিক হকচকিয়ে ছুটে এসে প্রত্যেকটা কফিন চেক করতে শুরু করলো। কিন্তু না একটাতেও অরু নেই।

স্বচ্ছ কাচের কফিন গুলো চেক করতে করতেই ওর কানে ভেসে এলো অস্পষ্ট এক গোঙানির আওয়াজ, হঠাৎ রিনরিনে আওয়াজে ক্রীতিক সচকিত হলো, ভাবতে থাকলো কোন দিক থেকে আসছে শব্দটা।রুমের মাঝ বরাবর টানানো পর্দার ওপাশ থেকেই আসছে বোধহয় আওয়াজটা। ক্রীতিক দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই অজানা আত'ঙ্ক আর মা'ত্রাতিরিক্ত উ'দ্বেগে কয়েক মূহুর্তের জন্য মস্তিষ্কটা হ্যাং করলো ওর, আবারও মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো পুরোদস্তুর । চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগছে, বারকয়েক চোখের পাতা ফেলে, দৃশ্যপট স্পষ্ট করে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় এগিয়ে গিয়ে একটানে পর্দাটা সরিয়ে ফেললো ক্রীতিক,সঙ্গে সঙ্গে পুরো দুনিয়া দুলে উঠলো ওর।

ক্রীতিকের থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে পানি ভর্তি কাঁচের কফিনের উপর হাত পা, মুখ বে'ধে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে অরুকে। কপালের দুপাশে লাগিয়ে রাখা হয়েছে কি সব যন্ত্রপাতি। কানের পাশে একটু খানি কা'টা দাগ।হাঁটু সমান লম্বাচুল গুলো কফিন ছাড়িয়ে মেঝেতে পরে আছে। চোখের সামনে নিজের হৃৎস্পন্দনের এমন বি'দ্ধস্ত রূপ দেখে বারবার যেন দুনিয়া দুলে উঠছে ক্রীতিকের।মুখের মাঝে কোনো তরল অবশিষ্ট নেই গলা ভেজানোর জন্য, এ্যাংসাইটি,ডিপ্রেশন, ওভার থিংকিং আর তীব্র ক্রো'ধ তিনে মিলে ক্রীতিকের গলা চেপে ধরেছে, সেই সাথে বাকশক্তি ও রোধ করে রেখেছে অজানা এক শক্তিবল। তবুও বহু চেষ্টার ফলস্বরূপ অস্পষ্ট সুরে ঠোঁট কাঁপিয়ে ক্রীতিক ডাকলো,

--- হার্টবিট।

ক্রীতিকের কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই, সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁ'ধা অবস্থাতেই খু'নখুনিয়ে কেঁদে উঠলো অরু। তীব্র কান্নার জোয়ারে কেঁপে উঠলো ওর পুরো শরীর। সবচেয়ে কাছের মানুষের আগমনে নির্বাক কাতরতা, আর অভিমানী কান্নায় চোখের কার্নিশ ভিজে উঠেছে মেয়েটার। ক্রীতিক স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর চোখের ভাষা, যেখানে অরু বারবার ফুঁপিয়ে উঠে আকুতির সুরে বলছে,

--- তুমি আসবে আমি জানতাম। কিন্তু এতো দেরি করে কেনো এলে? আমার বুঝি কষ্ট হয়নি?

অরুর চোখের সাথে চোখ মিলিয়ে নির্বাক ধ্বনিতে ক্রীতিকও একই সুরে জবাব দিল।

--- আ'ম সরি হার্টবিট। আ'ম রিয়েলি সরি, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে।

ওদিকে অরুর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কান্নার রোল শুনতে পেয়ে রিসার্চ রুম থেকে বেরিয়ে এসে অকস্মাৎ ওদের সবাইকে দেখে পিলে চমকে গেলো নিখিলের। একসাথে এভাবে এতো জনকে দেখে নিখিলের হা'র্টএ্যা'টার্ক হওয়ার উপক্রম। ও এখন সবার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত ঢোক গিলছে শুধু। মনেমনে খুজছে পালানোর পন্থা।

নতুন করে কারোও পদচারনা টের পেয়ে, ক্রীতিক পেছনে ঘুরতেই নিখিলকে দেখতে পায়, ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দমে যাওয়া ক্রো'ধটা দিগুন হারে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো ক্রীতিকের । কপালের রগ গুলো ফুলে উঠে, চোখের সাদা অংশ র'ক্তিম হয়ে উঠলো আপনাআপনি। তীক্ষ্ণ ব্লে'ডের মতো ধারা'লো চোয়ালটায় গাম্ভীর্য টেনে ক্রীতিক তে'ড়ে এসে ওর কলার চেপে ধরে চোখমুখ খিঁচে উইথ আউট ওয়া'র্নিং একেরপর আ'ঘাত করতে থাকে নিখিলের নাক বরাবর। সেই সাথে অ'স্রাব্য গা'লি তো আছেই। ক্রীতিকের এই ভয়'ঙ্কর দানবীয় রূপটা সবাই দেখতে পায়না, হুটহাট বেরিয়েও আসে না, তবে যদি একবার বেরোয় তো সেটা জ্বলন্ত অ'ঙ্গারের মতোই বিভৎ'স আর নি'কৃষ্ট।

---- শু**** বাচ্চা তোকে আজ এই পরিত্যক্ত গুহার মধ্যেই জ্যন্ত কবর দেবো আমি, আর নয়তো আমার নাম জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী নয়।

ক্রীতিক কি উত্তেজিত? মোটেই না, সবসময়ের মতোই বাচনভঙ্গিমা এখনো মসৃণ ওর, তবে গলার স্বরে ভয়ানক ক্ষী'প্রতা স্পষ্ট।

ক্রীতিকের করা প্রত্যেকটা আ'ঘাত একেবারে চোখে মুখে এসে হা'মলে পরছে নিখিলের। ও দম নেওয়ার ফুরসত টুকুও পাচ্ছে। এভাবে আর কিছুক্ষণ মা'র খেলে নিজের জীবন এখানেই খোয়াতে হবে,ব্যাপারটা বুঝতে পেরে,তৎক্ষনাৎ নিজের সর্বশেষ চালটা চাললো নিখিল, কোনো মতে হাতরে বেরিয়ে, হাতের কাছে থাকা সুইচবোর্ডটায় প্রেস করে অন্যদের মতো অরুকেও ফেলে দিলো ক্যা'মিক্যাল মিশ্রিত পানি ভর্তি কফিনের মধ্যে।

সঙ্গে সঙ্গে পানির মধ্যে পরে গিয়ে তীব্র ছটফটানি শুরু করে দিলো অরু। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে পেছনে ঘুরে অরুকে ছটফট করতে দেখে নিখিলকে ছু'ড়ে মে'রে, অরুর নিকট ছুটে গেলো ক্রীতিক। তখনও বদ্ধ কফিনে গলা কাঁ'টা মু'রগীর মতোই ছটফট করছে অরু। পুরো কফিন জুড়ে মোটা স্বচ্ছ কাচের আস্তর কোথাও কোনো খোলার যায়গা নেই, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কফিনের সামনে হাটু গেড়ে বসে, কাচের আস্তরটাকে ভা'ঙার উদ্দেশ্যে কফিনের উপরই নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে এলোপাথাড়ি পাঞ্চ বসাতে লাগলো ক্রীতিক। ওদিকে সময়ের ব্যবধানে অরু ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

ক্রীতিক সেদিকে নজর দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

--- হোল্ড অন,ওয়ান মিনিট, যাস্ট ওয়ান মিনিট বেইবি। প্লিজ হোল্ড অন, আমি এটাকে এক্ষুনি ভে'ঙে গুড়িয়ে ফেলবো।

এভাবে ক্রমাগত পাঞ্চ করতে করতে ওর হাত থেঁ'তলে গিয়ে কখন যে পুরো কফিন র'ক্তাক্ত হয়ে উঠেছে তার হদিস নেই ক্রীতিকের, ওর দৃষ্টিতো কেবল স্থির হয়ে আছে অরুর নিভু নিভু চোখ দুটোর পানে। একনাগারে পাঞ্চ করতে করতে হাতের অবস্থা বেগতিক,তবুও এক সেকেন্ডের জন্যও থামেনি ক্রীতিক। যতক্ষণ না র'ক্তাক্ত কাচের আস্তরে ফা'টল ধরে চৌচির হয়েছে, ঠিক ততক্ষণ একই উদ্যমে অনবরত কাচের কফিনে আ'ঘাত করেছে সে।

অন্যদিকে অরুর জন্য ক্রীতিকের এমন উন্মাদনায় আবিষ্ট বেপরোয়া ভয়'ঙ্কর রূপ দেখে, ভ'য়ে জর্জরিত হয়ে নিজের আহত শরীরটাকে টেনেটুনে নিয়েই সুযোগ বুঝে কেটে পরলো নিখিল, ওর আফ্রিকান বন্ধু লিও পালিয়েছে বহুক্ষণ আগেই। তবে মনে হয়না এই শরীর নিয়ে বেশিদূর যেতে পারবে নিখিল। কারন ওর পিছু নিয়েছে এ্যাথলেটিক টম বয় খ্যাত গার্ল এলিসা ক্রিস্টিয়ান।

অবশেষে জায়ান ক্রীতিকের মতো বেপরোয়া,জিদি,রগচটা মানুষের কাছে হার মেনে নিয়েছে কাঁচের তৈরি কফিনটা। কফিনটাকে ভে'ঙে চৌচির করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে ক্রীতিক। কফিন ভে'ঙে যেতেই অরুকে টেনে বের করে ওর হাত পা মুখের বাঁ'ধন খুলে বারবার সিপিআর দিতে থাকে ক্রীতিক।

একনাগাড়ে সিপিআর দিতে দিতে একপর্যায়ে এসে অরু লম্বা করে দম নেয়। অরুর শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেয়েই, নিশ্বাসের শব্দ ক্ষীন হয়ে এলো ক্রীতিকের নিজেরও, তৎক্ষনাৎ অরুর মাথাটা কাছে টেনে এনে ওর ঠান্ডা ফ্যাকাশে ঠোঁটে অনবরত চুমু খেতে থাকে ক্রীতিক। নিঃশব্দে নির্লিপ্তে.....

তবে অরুর শরীরটা এখনো নেতিয়ে রয়েছে, চোখ মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে আছে ,দেখে মনে হচ্ছে শরীরে একরত্তিও শক্তি অবশিষ্ট নেই। শুধু আলতো করে চোখের পলক ফেলছে মাত্র। অরুর হালকাপাতলা নড়নচড়ন দেখে ক্রীতিক বুক ভরে সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওকে কোলে তুলে দাঁড়িয়ে পরলো, সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো ওর। অরুকে কোলে নিয়েই বারবার হাতের পেছন দিয়ে ডাকের ডগা ঘষছে ক্রীতিক। চোখের সামনে স্থীর দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণব আর সায়র কে কেমন ঝাপসা লাগছে দেখতে, বারবার চোখের পলক ফেলেও সেই দৃষ্টি স্পষ্ট হচ্ছেনা মোটেই।তবুও অরুকে কোলে নিয়েই সামনে পা বাড়ালো ক্রীতিক। সামনে এগোতে এগোতে ক্রীতিক দেখলো, সায়র আর অর্ণব উদ্বিগ্ন নজরে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, ওদেরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্রীতিক নাক টেনে বললো,

--- কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

--- তোর নোজ ব্লে'ডিং হচ্ছে জেকে!

সায়রের কথায় ক্রীতিক এবার হাতের পিঠ দিয়ে নাকে ঘষা দিয়ে চোখের সামনে এনে দেখলো, ওর নাক থেকে ফি'নকি দিয়ে র'ক্ত গড়িয়ে পরছে।

ক্রীতিক হাতের পিঠ দিয়ে র'ক্তটুকু পরিষ্কার করতে করতে বললো,

--- ইটস ফর এ্যাংসাইটি। কিচ্ছু হবে না চল।

কথাটা বলে দুকদম এগোতেই হাঁটু গেড়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো ক্রীতিক। ওর কোলে এখনো অরুর নেতিয়ে পরা ছোট্ট শরীরটা। নিজে বসে পরলেও অরুকে শক্ত করে ধরে রেখেছে বুকের মধ্যে ।এবার সত্যিই সামনের সবকিছু পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। অসার হয়ে আসছে শরীরের মাংসপেশি গুলোও, ক্রীতিকের নোজ ব্লে'ডিংএর ঘটনা নতুন কিছু নয়, প্রথম প্রথম আমেরিকায় আসার পরে অতিরিক্ত অব'সাদগ্রস্থতা, আর দু'শ্চিন্তার ফলে প্রায়ই এমনটা হতো। ডাক্তার বলেছিল মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপে এমনটা হচ্ছে। কিন্তু গত কয়েকবছর দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ফলস্বরূপ এটা পুরোপুরি বন্ধ ছিল, অথচ আজ অরুর একটুখানি বিপ'দে, এতো বছর ধরে একটু একটু করে উন্নতি করা ক্রীতিকের মানসিক স্বাস্থ্যে ধস নেমে এলো মূহুর্তেই । তাহলে ক্রীতিক আদতে কতোটা ডেস্পারেট ওর এইটুকুনি হাটুর বয়সী সৎ বোনের জন্য? এ কেমন প্রেম আর কেমন আসক্তি? সেটাই আপাতত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে অর্ণব আর সায়র।

ক্রীতিক হাঁটু গেড়ে বসে নাক থেকে গড়িয়ে পরা র'ক্তগুলো হুডির হাতায় মুছতে মুছতে অস্পষ্ট সুরে বললো,

--- অর্ণব, আমি বোধহয় সে'ন্স লেস হয়ে পরবো। তুই অরুকে কোলে নে। প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট দিয়ে ওকে সেইফলি বাসায় পৌঁছে দিবি, আর সায়র তুই ভুলেও অরুকে টাচ করবি না। জ্ঞান ফিরে আমি যদি শুনেছি তুই অরুকে টাচ করেছিস, তাহলে তুই আর এ জীবনে বাচ্চার বাপ হতে পারবি না, সেই ব্যবস্থা আমি নিজ হাতে করবো।

সায়র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- টাচ করবো না তোর অরুকে, কিন্তু এটলিস্ট তোকে তো ধরতে দে। পরে যাচ্ছিস তুই।

ক্রীতিক সে কথা আদৌও শুনেছে কি শোনেনি কে জানে?

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩০

পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশ আর নিরিবিলি নেই। সকাল সকালই শান্ত,প্রানজুড়ানো,নিরিবিলি পরিবেশ ধারণ করেছে বিধ্বং'সীরূপ।প্রচন্ত বাতাসের তান্ডব আর বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে চারিপাশ, সেই সাথে গাছপালা ভে'ঙে পরার মরমর আওয়াজ তো আছেই। তবে নির্জন পাহাড়ি এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ি করে শহরের দিকে এগিয়ে আসতেই বাতাস, বর্ষন দুটোই উধাও, যদিও পাহাড়ী ঝড়ের তান্ডবে চারিদিকের পরিবেশ গুমোট হয়ে আছে, সেই সাথে ভ্যাপসা গরমটাও বেড়েছে আজ। অতিরিক্ত ভ্যাপসা গরমে অরু হাসফাস করছে দেখে অর্ণব সহসা বাটন প্রেস করে গাড়ির টিন্ডেট জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে নিদারুন মেঘ ভেজা বাতাস এসে আঁচড়ে পরলো অরুর চোখেমুখে।এবার সত্যিই একটু শান্তি লাগছে। ঠান্ডা বাতাসে একটা বড়সড় নিঃশ্বাস ছেড়ে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে অরু বলে,

---- ধন্যবাদ।

অর্ণব অরুর কথায় নিঃশব্দে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে,অরু পুনরায় শুধালো,

--- উনি এখন কেমন আছেন?

অর্ণব স্টিয়ারিংএ দক্ষ হাত চালাতে চালাতে বললো,

--- জ্ঞান ফেরেনি এখনো, জ্ঞান ফিরলে সুস্থ হয়ে যাবে, ইটস নট আ বিগ ডিল, দুশ্চিন্তা করোনা।

অর্ণবের কথায় অরু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,

--- নিজের প্রতি এতো কেয়ারলেস কেন উনি?

অরুর আনমনে বলা কথাটা বোধহয় অর্ণব শুনেছে, তাই ও সামনে তাকিয়েই বললো,

--- নিজের প্রতি কেয়ারলেস হতে পারে, তোমার প্রতি নয়।

অর্ণবের কথায় অরু সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওর পানে, পরবর্তীতে কথার পাছে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অর্ণব বললো,

--- এসে গিয়েছি।

চলে আসার দরুন,অরুর আর কথা বাড়ানো হলোনা,তাই চুপচাপ নেমে গেলো গাড়ি থেকে। গাড়ি থেকে নেমে অর্ণব কে বিদায় জানিয়ে অপটু পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো ভবনের লিফটের দুয়ারে।

শরীরে প্রচন্ড জ্বর আর মাথাব্যাথা। হাত পা গুলো শক্তিহীন অসার হয়ে আছে। সুন্দর লম্বা চুলগুলো জটলা পাকিয়ে কোনোমতে পিঠে পরে আছে, সুন্দর মাখনের মতো মসৃন মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারন করেছে , চোখদুটো ঢুকে আছে কোটরে।শরীরের এহেন অবস্থা নিয়েই লিফট থেকে বেরিয়ে, এগিয়ে এসে এ্যাপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপলো অরু।

তবে কলিংবেল চাপার সঙ্গে সঙ্গেই সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা আর তার পেছন পেছন আজমেরী শেখের নতুন এসিস্ট্যান্ট রাজ। হুট করেই নিজের বাসা থেকে অপরিচিত কাউকে বেরোতে দেখে অরু খানিকটা অপ্রস্তত হয়ে পরলো, কারন ওর মাথা থেকে পা অবধি সবকিছু এলোমেলো আর অগোছালো । হুট করে কেউ প্রথম দেখে পাগল বলে সম্মোধন করলেও ভুল কিছু হবেনা বৈকি। কিন্তু অরুকে একটা বিশাল ঝটকা দিয়ে, ওর অযাচিত চিন্তায় একবালতি জল ঢেলে মহিলাটি অরুর চিবুকে আদুরে হাত ছুয়িয়ে বললো,

--- মাস আল্লাহ।

বয়স্ক মহিলার এহেন কথায় চোয়ালঝুলে পরলো অরুর। মনেমনে ভাবলো,

--- আমি কি ঠিক শুনলাম? নাকি জ্বরের ঘোরে আসতাগফিরুল্লাহ কে মাসআল্লাহ শুনলাম?

অরু যখন বাইরে দাড়িয়ে একমনে হিজিবিজি ভাবছিল, তখনই মহিলা দ্বিতীয়বার মুখ খুললেন, নিজে নিজেই আগ বাড়িয়ে বললেন,

--- আসি তাহলে মা? আগামী রোববার দেখা হবে।

মহিলার কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে অগত্যাই জোরপূর্বক হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো অরু। অরুর সম্মতি পেয়ে মহিলাটি চলে গেলে পেছন থেকে রাজ এসে হিসিয়ে উঠে বললো,

--- একি অবস্থা তোমার? একটু পরিপাটি হয়ে চলা যায়না?

এমনিতেই অরুর মানসিক অবস্থা বিদ্ধ'স্ত, তারউপর রাজের এমন অধিকার দেখিয়ে কথা বলা, ব্যাপারটা মোটেই সহ্য হলোনা অরুর, মাথার মধ্যে অযাচিত রাগটা হুট করেই কুন্ডলী পাকিয়ে উঠলো কেন যেন। মূহুর্তেই মেজাজ হারালো অরু, রাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচে বললো,

--- আমি কিভাবে চলবো না চলবো সেটাও আপনি আমাকে শিখিয়ে দেবেন? কে হই আপনার? দেখুন রাজ, অযথা গায়ে পরা স্বভাব আমার একদম পছন্দ নয়। ছেলেমানুষের এতো গদোগদো ভাব মানায় না, এটলিস্ট আমার চোখে তো বি'চ্ছিরি লাগে।

অরুর কাঠকাঠ কথাগুলো বোধ হয় রাজের গা থেকে পিছলে চলে গেলো, ও অরুর দিকে তাকিয়ে মারাত্মক হেঁসে বললো,

--- কেমন ছেলে পছন্দ তোমার? আমিকি হতে পারিনা তেমনটা?

--- না পারেন না, তার নখের যোগ্যতাও আপনার নেই,এটলিস্ট পুরুষ মানুষ হিসেবে তো নেই।

অরুর ছু'রির ফলার মতো ধা'রালো কথা শেষ হলে রাজ পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভেতর থেকে ছুটে আসে অনু। এগিয়ে আসতে আসতে উদ্বিগ্ন সুরে বলে,

--- কি ব্যাপার কার সাথে তর্ক করছিস বাইরে দাড়িয়ে? মা শুনতে পাচ্ছে তো।

অনু চলে আসাতে অরু ভেতরে যেতে যেতে রাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,

--- রিডিকিউলাস।

রাগে ফোঁসফাস করতে করতে সদর দরজা ঠেলে অরু ভেতরের রুমে দু'কদম দিয়েছে কি দেয়নি তার আগেই গম্ভীর গলায় ডেকে উঠলেন আজমেরী শেখ।

--- অরু দাঁড়াও।

অরু ভ'য়ে তটস্থ হয়ে আছে বহুক্ষণ আগে থেকেই। তবে এই মূহুর্তে মেজাজটাও বিগড়ে আছে ওর, তাই কোনোরূপ হাপিত্যেশ না করেই পেছনে ঘুরে মায়ের দিকে চাইলো ও। আজমেরী শেখ মোটা থানের ছাই রঙা শাড়ী আর কালো রঙের চুড়িহাতা ব্লাউজ পড়ে আছেন। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা। শাড়ীর প্রত্যেকটা ভাঁজ অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে সেট করা, দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো টিভিসেটের সংবাদ পাঠিকা।

অরুর চোখে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়, আজকাল মা প্রায়ই এভাবে পরিপাটি হয়ে অফিসে যান। নিজের মরচে পরা আধিপত্যতে একটু খানি ঝালাই করে দিতে।

সাইড ব্যাগটাকে শক্ত হাতে চেপে ধরে মাথা নিচু করে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে অরু,আজমেরী শেখ ওর আগাগোড়া পরখ করে স্পষ্ট আওয়াজে শুধালেন,

--- কোন ছেলের সাথে গিয়েছিলে?

মায়ের কথায় অরুর পিলে চমকে উঠলো,নিজের সুপ্ত ভ'য়টাকে দূরে সরিয়ে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে গলায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে অরু বললো,

--- কি বলছো মা? ককোন ছেলের সাথে আবার যাবো? আমি কাউকে চিনি নাকি এখানে?

আজমেরী শেখ অরুর দিকে নিখুঁত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

--- এক বছর অসুস্থ ছিলাম আমি,মা'রা যায়নি, তাতেই মিথ্যে কথা শিখে গেলে?

অরুর না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে ওঠে,

--- মা বিশ্বাস করো...

আজমেরী শেখ ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন,

---- রাজ খোঁজ নিয়েছে, তোমাদের ক্লাস থেকে কোনো গ্রুপ ক্যাম্পিং এ যায়নি, তাহলে গত চব্বিশ কোথায় ছিলে তুমি?

এখানেও রাজ, বিরক্ত লাগছে অরুর তবুও মাথা নিচু করে গলা খাদে নামিয়ে অরু বললো,

--- আসলে মা, আমি অন্য গ্রুপ...

--- থাক।

আজমেরী শেখ এবারও সহসা থামিয়ে দিলেন অরুকে। অতঃপর বললেন,

--- আমি আর মিথ্যে অজুহাত শুনতে চাইছি না অরু, আর না আমার এসব চেঁচামেচি কৈফিয়ত দেওয়া নেওয়া পছন্দ। আমি শুধু সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করি।

মায়ের রহস্যেঘেরা কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না অরু। তবে ওর মা যে একশো তে একশো পাক্কা খিলাড়ী সেটা অরু ভালো করেই জানে। কখন কোন চালে আটকে ফেলবে সেটা অরুর কল্পনাতীতই থেকে যাবে। এবারও তাই হলো।আজমেরী শেখ হঠাৎ করে অরুর সামনেই অনুকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন,

--- এখন এই মূহুর্তে অরুর পুরো ঘর তল্লাশি করে ওর কাছ থেকে সমস্ত ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস গুলো নিয়ে নাও। আর হ্যা আজ থেকে অরুর সাথে সর্বক্ষন থাকবে তুমি। আমি যদি ঘুনাক্ষরেও শুনেছি বোনের প্রতি দরদ দেখিয়ে আমাকে বোকা বানাচ্ছো তাহলে তোমার ব্যাবস্থাও আমি করবো। নাও সার্চ হার।

মায়ের কথায় অরু ফুপিয়ে কেঁদে উঠে অাহত সুরে বললো,

-- মা, কি বলছো?

অনু একটু সাহস করে মাকে বললো,

--- মা, মাত্রই তো এলো একটু ফ্রেস হয়ে নিক, তারপর না হয়...

আজমেরী শেখ থমথমে গলায় বললেন,

--- ফ্রেস হওয়ার অনেক সময় রয়েছে, আগে ওকে সার্চ করো।

মায়ের কঠোর আদেশ, অনুর আর কিছু করার ছিলোনা অগত্যাই অরুর ব্যাগ হাতরে আইফোন ফিফটিন প্রো-ম্যাক্স মোবাইলটা নিয়ে নিলো অনু। যদিও মোবাইলটা বন্ধ ছিল। তবুও অনুরও এবার ভেতরে ভেতরে সন্দেহের দানা প্রখর হয়, মনেমনে ভাবে,

--- হুট করে এতো দামি ফোন কোথায় পেলো অরু? তাহলে কি মা'ই ঠিক? অরু খারাপ কোনো পথে পা বাড়িয়েছে?

ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে গেলে অরু ব্যাগটাকে ফ্লোরেই ছু'ড়ে মে'রে হনহনিয়ে রুমে চলে যায়।অরু চড়ম কষ্ট পেয়েছে ভেবে, অনু মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বললো,

--- মা অরুতো ছোট ভুল করতেই পারে, তাই বলে এতোটা কঠোর হওয়া কি ঠিক হবে?

অনুর কথায় আজমেরী শেখ বললেন,

---আপাতত যেটা বলেছি সেটা করো। সময় হলে সব কিছু আমি নিজেই আবার আগের মতো করে দেবো। কিন্তু এখন নয়।

*****************************************

সারাদিন রুম আটকে ম'রার মতো পরে থাকলেও সন্ধ্যা হতে না হতেই অরুর একা থাকার শখ ঘুচিয়ে দিয়ে রুমে প্রবেশ করে অনু। অনুর অবশ্য কিছু করার নেই মায়ের আদেশ আসতেই হতো। অনু আসতেই অরু মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পরলো। অনুর হাতে খাবারের থালা। ও সেটাকে বেডসাইড টেবিলে রেখে দিয়ে নরম গলায় বললো ,

--- অরু খাবার এনেছি, খাবি আয়।

অরু নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিল,

--- খিদে নেই, নিয়ে যা।

--- সারাদিন না খেয়ে, রুম আটকে পরে আছিস, তাও খিদে নেই? কি হয়েছে বলতো তোর?

অনুর কথায় অরু শক্ত গলায় বললো,

--- না নেই, আর কি হয়েছে, কি হয়েছে, এই প্রশ্নটা করা বন্ধ কর আপা। কি হবে আমার?

অনুও এবার ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,

--- কিছু না হলে, মিথ্যে বলে কোথায় গিয়েছিলি? আর অতো দামি ফোনই বা কোথায় পেলি?

অরু এবার শোয়া থেকে উঠে , অনুর মুখোমুখি হয়ে বসে কন্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বললো,

--- তোর কি মনে হয় আমি খারাপ মেয়ে?

অরুর কথার পাছে অনু বললো,

--- এখন আর মনে হওয়া না হওয়া দিয়ে কি যায় আসে? যা করার তাতো মা করে ফেলেছে।

অনুর একটু কথার আঁচে অরুর হৃদয় কামড়ে উঠলো, ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের কিনে দেওয়া সিল্কের পাজামা সেট। মাথার চুলগুলো এলোমেলো ভাবে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকানো, বুকের মধ্যে অজানা আত'ঙ্কের দল হাতুড়ি পেটা করছে খুব, তবুও একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বুকের মাঝে সাহস সঞ্চয় করে অরু শুধালো,

--- কি করেছে মা?

অনু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানায়,

--- আগামী রোববার রাজ তার পরিবার সমেত তোকে দেখতে আসছে। আজকেই তো ওর মা এসে আমাদের মায়ের সাথে কথা বলে গেলো।

অনুর কথায় অরুর মাথায় যেন আকাশ ভে'ঙে পরলো। দুনিয়া দুলে ওঠার মতোই আচমকা ঘুরে উঠলো মাথাটা। অরু ভেবেছিল মা ওর জন্য কোনো কঠিন শা'স্তির ব্যাবস্থা করেছে, হয়তোবা ভার্সিটিতে যেতে দেবে না, কিংবা নজরবন্দি করে রাখবে সারাক্ষণ , তাই বলে এমন কিছু? অরুর কল্পনার ও বাইরে ছিল এটা। অরু তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো। অবিশ্বাসের সুরে অনুকে শুধালো,

--- কি বলছিস আপা এটা? তুই থাকতে আমি কেন?

অরুর কথায় অনুর মেজাজ চড়ে এলো, ও রুষ্ট কন্ঠে বললো,

--- আমি থাকতে মানে? তুই প্রত্যয় সাহেবের কথা জানিস না? তাছাড়া রাজ তোকে পছন্দ করেছে আমাকে নয়।

অনুর কথায় একটা অসহ্য য'ন্ত্রনা ছড়িয়ে পরলো অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অকস্মাৎ ফ্লোরে ধপ করে বসে হুহু করে কান্নায় ভেঙে পরলো অরু, শরীরে ব্যাথা, হৃদয়ে ব্যাথা, মস্তিষ্কে ও একরাশ য'ন্ত্রনা, সবকিছু মিলমিশে অরুর এক করুন অবস্থা এই মূহুর্তে । মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে হাজারবার আহাজারি করতে করতে অরু বললো,

--- তোকে আমি কি করে বোঝাই আপা, তোর যেমন প্রত্যয় সাহেব আছে, আমারও তো একজন আছে, সে আমার স্বামী, জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। আমি বিবাহিত, আমার শরীর মন সবকিছুর দখলদারী শুধু মাত্র তার। আমি তাকে মেনে নিয়েছি। তার ভালোবাসাকে গ্রহন করেছি। তাহলে কিভাবে আমি অন্য একজন পুরুষের সামনে গিয়ে আইবুড়ো সেজে বসবো? কি করে?

এই কথার একটু খানি আঁচ ও জায়ান ক্রীতিকের কানে গেলে সবকিছু তচনচ করে ফেলবে সে। সেই সাথে আমাকেও কে'টে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি এখন কি করবো? কিভাবে সবাইকে বলবো যে আমি আমার সৎ ভাই জায়ান ক্রীতিকের বিয়ে করা বউ?

অরু সেই কখন থেকে মেঝেতে বসে শব্দ করে কাঁদছে দেখে অনু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- এতো কাঁদছিস কেন অরু? দেখতেই তো আসছে, বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না? ভালোয় ভালোয় সবটা মিটে গেলে তুইও তো বেঁচে যাবি। মা আর তোকে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখবে না।

কথাটা শেষ করে কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরলো অনু। অনুর মাত্র বলা কথাগুলো বারবার মস্তিষ্কে বারি খাচ্ছে অরুর।

---দেখতেই তো আসছে, বিয়েতো আর হচ্ছে না।

"বিয়ে"শব্দটা অসংখ্যবার প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে এসে লাগছে অরুর,ওর তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেবার থাইল্যান্ড বসেই। ধর্মীয়, সামাজিক দুইভাবেই বিয়ে হয়েছে জায়ান ক্রীতিকের সঙ্গে। তাহলে এখন আর নতুন করে কিভাবে বিয়ে হবে? আর তাছাড়া চোখ দুটো বন্ধ করলে স্বামী রুপে ওই সুদর্শন মানবের মুখটা ছাড়া আর কিছুই তো কল্পনায় আসছে না।

মনেমনে হাজার কথা ভাবতে ভাবতেই অরু চলে গেলো টানা বারান্দায়। বাইরে ভারী বর্ষন হচ্ছে। আকাশ বাতাস ছাপিয়ে মেঘ গলিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধরনীতে। বাতাসের তোপে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে অরুর চোখে মুখে, তবুও সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পরলো ও।

উদাসীন বারীধারার পানে চেয়ে ভাবতে লাগলো নিজের থেকে বয়সে গুনগুনে বারো বছরের বড় সুদর্শন পুরুষটির কথা, যে ওর ব্যক্তিগত পুরুষ। কোনোদিন কি অরু কল্পনা করেছিল ওর সাথে এমনটা হবে? আমেরিকাতে কেউ ওর জন্য এভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনবে? এরকম হুট করেই নিজের নামের পাশে মানুষটার টাইটেল এঁটে যাবে? ভাবেনিতো, কল্পনাতেও ভাবেনি। কিন্তু ভবিতব্য এটাই ছিল।

অরু মেনে নিয়েছে নিজের ডেসটিনি। অবশ্য না মেনে কোথায় যাবে? কি নেই জায়ান ক্রীতিকের? সবচাইতে যেটা বেশি আছে, সেটা অরুর প্রতি এক আকাশসম আসক্তি। মানুষটার পাগলামি, আসক্তি, রাগ, বিরক্তি, একান্ত গোপনীয় চাহিদা সবকিছু অরুকে ঘীরেই। তাহলে অরু কীভাবে ক্রীতিকের মায়ায় না পরে থাকতো? অরুর কাছে ক্রীতিকের মায়ায় জড়ানোর প্রথম ধাপ ছিল ওদের বিয়ে।

হয়তোবা বিয়ের পরে উপরওয়ালা প্রদত্ত একধরনের টান তৈরি হয়ে যায় হৃদয়ে, অরুর বারবার মনে হতে থাকে,একটা মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন পুরুষ, আধুনিক ভাষায় বলতে গেলে হ্যান্ডসাম। লম্বা, চওড়া, গৌড় বর্ণের কথায় কথায় ভ্রু কুঁচকানো লোকটা ওর স্বামী। এই কথাটা দিনের আলোর মতোই সত্যি। অরুর স্পষ্ট মনে আছে বিয়ের পরে সবার জোরাজোরি তে স্বামী রুপি ক্রীতিকের দু-হাতে চুমু খাওয়ার কথা। তখন তো অরুও হৃদ মাঝারে ভীষণ টান অনুভব করেছিল।

বিয়ের কথা মাথায় আসতেই অরু চলে গেলো সেদিনের ভাবনায়,যেদিন নিজের সবটুকু ক্রীতিকের নামে লিখে দিয়ে এসেছিল ও। জায়ান ক্রীতিক ওয়েডস অরু। ভাবতে ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফোটে অরুর ঠোঁটে।

আজকের মতো সেদিন বৃষ্টি ছিলোনা, এশিয়ান দেশ হওয়াতে আমেরিকার মতো কনকনে শীতও ছিল না ব্যাংকক শহরে । তবে আবহাওয়াটা বেশ গুমোট ছিল।অনুর সাথে রাগ করে অরুর করা চড়ম বোকামির ফলসরূপ ওর উপর বেজায় চটেছিল ক্রীতিক। চোখেমুখে সে কি রাগ তার।যে রাগের কাছে প্রত্যেকবারই হার মেনে যায় অরু। সেবারও মেনেছিল।

সকাল বেলা ওকে আটকে রাখলেও বিকালে এসে কোনোরূপ কথাবার্তা না বলেই টা'নতে টান'তে অরুকে নিয়ে বাইকে বসায় ক্রীতিক। ওদের পেছনে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এলিসা, অর্ণব আর সায়রও। অরু কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এলিসাকে বললো,

--- কি ব্যাপার আপু, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন উনি আমায়?

এলিসা অরুকে আস্বস্ত করে ওর কানের পেছনে চুল গুঁজে দিতে দিতে বলে,

--- ইটস ওকে, আমরাও আসছি, ভয় পেওনা, ও তোমাকে কিচ্ছু বলবে না।

এলিসার কথার পাছে অরু আর কিছু বলার সুযোগ পেলোনা, তার আগেই বাইকে টান দেয় ক্রীতিক। অগত্যাই নিজেকে সামলানোর জন্য ক্রীতিকের জ্যাকেট টেনে ধরলো অরু।

ক্রীতিক সামনে ফোকাস করেই অরুকে ডেকে বললো,

--- অরু, তুই কি জানিস আজ তোর মায়ের অপা'রেশন?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বললো,

--- তুই কি এটা জানিস আমি ডক্টরকে বলে তোর মায়ের সব ট্রিটমেন্ট বন্ধ করে রেখেছি।

আমি না বলার আগ পর্যন্ত ওরা তোর মায়ের অ'পারেশনে হাত ও ছোঁয়াবে না।

ক্রীতিকের কথায় অরুর মুখ থেকে যেন র'ক্ত সরে গেলো। ও বাইকে বসেই স্তম্ভিত গলায় বললো,

--- আপনি কি মজা করছেন?

--- তোর কি মনে হয় আমি মজা করার মুডে আছি?

অরু নাক ফুলিয়ে বললো,

--- তাহলে এসব কথা কেন বলছেন?

ক্রীতিক একটা পুরাতন গলির মাথায় বাইক থামিয়ে অরুর হাত ধরে বললো,

--- বলছি চল।

অরু চারিদিকে তাকালো, দুপাশে পুরাতন ইটের চালার ঘর,তার মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা, ঘর গুলোর মধ্যে বেশির ভাগই থাইল্যান্ডের স্থানীয় মানুষজনের পুরাতন দোকানপাট, ছোটখাটো স্ট্রীট মার্কেট,হকারী আর ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের দোকান দিয়ে ভর্তি গলিটা। সরু রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে অরু খেয়াল করলো আশেপাশের সবাই ওদের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে। যেমনটা আমরা ভিনদেশীদের দেখলে করি। অরু বড়বড় চোখ করে এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করলেও ক্রীতিক সোজা হাটছে। হাটছে তো হাটছেই। ক্রীতিকের পুরুষালী কদমের সাথে পা মিলিয়ে হাটতে হাটতে অরুর পা ব্যথা করছে এখন। গোড়ালি ভে'ঙে মাটিতেই বসে পরতে ইচ্ছে করছে, উপায়ন্তর না পেয়ে অরু শুধালো,

--- আর কতদূর?

ক্রীতিক ক্রুর হেসে বললো,

--- বাবাহ এতো তাড়া?

--- কিসের তাড়া? আর আপনি একটু আগে কি বললেন? আমার মায়ের অপা'রেশন বন্ধ কেন করেছেন? কি সমস্যা বলুন?

ক্রীতিক যেতে যেতে বললো,

--- সমস্যা তো তুই।

--- মানে?

গলির শেষ প্রান্তে একটা পুরাতন মসজিদের সামনে দাড়িয়ে ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- ভেতরে গিয়ে যা করতে বলবো,যেভাবে করতে বলবো, তাই করবি,নয়তো তোর মায়ের অ'পারেশন আর হচ্ছে না।

অরু তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের থেকে নিজের হাতটা ঝটকা মে'রে ছাড়িয়ে বললো,

--- মশকরা পেয়েছেন? অপা'রেশন হবেনা মানে? আপনি বলবেন আর অপা'রেশন হবে না এতো সোজা?

ক্রীতিক কপট হেসে অরুর দিকে ঝু্ঁকে এসে বললো,

--- ছোট্ট মানুষ মেমোরি লস হতেই পারে।কোনো সমস্যা নেই, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি, মনে আছে আমার এপ্রোভালের জন্য তোর মা দীর্ঘ একবছর বাংলাদেশে পরেছিলো?

অরু এবার গলার স্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললো,

--- কি বলতে চাইছেন?

ক্রীতিক সামনে তাকিয়ে বললো,

--- আজ, এই মূহুর্তে এখানে আমাদের বিয়ে হবে।

ক্রীতিকের কথায় অরুর মাথা ঘুরে উঠলো। কি বলে এই লোক? জীবনটা কি ছেলে খেলা?যাকে ইচ্ছে হলো তাকে ধরে আনলাম আর জিদ দেখিয়ে বিয়ে করে নিলাম। ক্রীতিকের উপর মেজাজ চড়াও হয়ে গিয়েছে অরুর, ও হিং'স্র বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বললো,

--- আপনি একটা পা'গল, উন্মা'দ, সাইকো।

নয়তো নিজের সৎ বোনের জীবন নিয়ে এভাবে ছেলে খেলা করতে পারতেন না।

অরু কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে এক থা'বায় ওর বুকের কাছের জামাটা খা'মচে ধরলো ক্রীতিক। ফিনফিনে জামাটায় একটান দিয়ে নিজের কাছে টেনে এনে অরুর দিকে চোখ রাঙিয়ে ক্রীতিক দাঁত খিঁচে হিসহিসিয়ে বললো,

--- তুই আমার কেমন বোন? কোন হিসেবে বোন, উত্তর দে? তোর বাপ আর বাপ এক নয়, তোর মা আমার মা এক নয়, তাহলে নিজেকে আমার বোন দাবি করিস কোন সাহসে ?

শেষ কথাটা বলে অরুকে ধা'ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ক্রীতিক। ক্রীতিকের যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে অরুও এবার চুপ হয়ে যায়। চোখ মুখে অসহায় ছাপ টেনে, গলার মাঝে কান্না আটকে রেখে টলমলে চোখে ক্রীতিককে বলে,

--- তাই বলে আপনি আমাকে জো'র করে বিয়ে করবেন? সমাজ কি বলবে? দুনিয়া কি বলবে?

আপনার সাথে আমি সেটাও কি সম্ভব? কোন ভুলের রা'গ ঝাড়ছেন আমার উপর, বলুন তো?

ক্রীতিকের দৃষ্টিতে কোনো করুনার ছিটে ফোঁটাও নেই, ও এগিয়ে এসে পুনরায় অরুর হাত চেপে ধরে বললো,

--- উপর ওয়ালা যার প্রাধান্য দিয়েছে সমাজ তাতে বাঁধা দেওয়ার অধিকার রাখেনা, আর না আমি এসবে পরোয়া করি।

অরু পুনরায় নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,

--- আমার জীবনটা এভাবে কেন নষ্ট করছেন? কি করেছি আমি?

ক্রীতিক অরুর দিকে তাকিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,

--- বিলিভ মি অরু, একটা সময় আসবে, যখন তুই এই সম্পর্কটার জন্য জীবন দিয়ে দিতেও রাজি থাকবি। তখন তুই নিজ মুখে বলবি সেদিন যা হয়েছিল খুব ভালো হয়েছিল। আমি এখন পরিপূর্ণ । আর সেই দিন বেশিদূরে নয়। এখন চুপচাপ ভেতরে চল।

অরু তেতে উঠে বললো,

--- আমি যাবোনা, মা আপাকে না জানিয়ে এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে আমি জীবনেও করবো না।

--- জায়ান ক্রীতিক লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করেনা, আমার মন চেয়েছে আমি এখন এই মূহুর্তে তোকে বিয়ে করবো, মানে করবোই। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করিস,তাহলে তোর মাকে আজই প্লেনে করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবো। ইভেন উইথ আউট এনি ট্রিটমেন্ট।

--নাহ!

ক্রীতিকের শেষ কথাতে অরু শব্দ করে না বলে ওঠে।

অরুকে কাঁদতে দেখে ক্রীতিক ওর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,

--- মায়ের ভালো চাইলে ভেতরে চল। তুই শুধু তোর নামটা আমার নামে লিখে দিবি ব্যাস। বাকিটা জীবন তোকে সামলে নেওয়ার দায়িত্ব শুধু আমার।

অরু কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি টেনে বললো,

--- আগে ডক্টর কে কল করে বলুন মায়ের ট্রিটমেন্ট শুরু করতে।

ক্রীতিক যেতে যেতে বললো,

--- ফোন রিসোর্টে ফেলে এসেছি, বিয়েটা হয়ে যাক অর্ণবের ফোন থেকে কন্ট্রাক্ট করে বলে দেবো।

-- ততক্ষণে যদি মায়ের কোনোক্ষতি হয়ে যায়?

ক্রীতিক এবার হাটার গতি থামিয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,

--- আমি বলেছি যখন পরে, তারমানে পরেই, আগে বিয়ে হবে, তারপর সব।

*****************************************

পুরাতন ছোট্ট মসজিদটার ইটের চালা ক্ষয়ে যায়যায় অবস্থা। ধর্মভিত্তিক দেশ না হওয়াতে এদেশে হুজুর কিংবা মুসলিম খুজে পাওয়া বেশ কষ্ট সাধ্য। তবুও কোথা থেকে যেন অর্ণব আর সায়র মিলে একজন ইন্দোনেশিয়ান হুজুর খুজে এনেছে।

অরু আর ক্রীতিক ভেতরে ঢুকতেই অর্ণব ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,

--- এতোক্ষণ লাগে তোদের? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।

ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,

--- বউকে রাজি করাতে দেরি হয়ে গেলো। তা তোর লইয়ার আর হুজুর কই?

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব পাশে সরে গিয়ে বললো,

--- এই যে আমেরিকান লইয়ার।যেহেতু তুই অরু দুজনই আমেরিকা থেকে বিলোং করিস তাই উনিই তোদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা আমেরিকান কোর্টে তুলবে।

অর্ণবের বুদ্ধি দেখে সায়র এগিয়ে এসে বললো,

--- ওরে শালা,এই ব্যাংকক বসে আমেরিকান লইয়ার কই পেলি তুই?

অর্ণব নিজের কাঁধ ঝাড়া দিয়ে একটু ভাব নিয়ে বললো,

--- পেয়েছি, পেয়েছি, টাকা থাকলে বাঘের চোখও মেলে বন্ধু।

সায়র নাক সিকোয় তুলে বললো,

--- তা এতোই যখন টাকা তাহলে একটা বাঙালি হুজুর ধরে আনতে পারলি না? এ কোন দেশী হুজুর নিয়ে এলি, কথা বুঝিনা কিছুনা। কবুল কোন ভাষায় বলবে ওরা?

অর্ণব দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,

--- আহাম্মক, বিয়ের সময় সব দেশেই কবুল বলে, তোর এতো চিন্তা করতে হবেনা হুজুর হলেই হলো, তাছাড়া এলিসা মোটামুটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষা জানে।

সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পাশে সরে গেলে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে বললো,

--- তোদের গবেষণা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার বিয়েটা করি?

সায়র ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- তোর দেখি তড় সইছে না জেকে। দাড়া এলিসা ফুলের মালাটা নিয়ে আসুক।

অর্ণব লইয়ারের সাথে কথা বলে কাগজ পত্র রেডি করে ক্রীতিককে ডেকে বলে,

--- জেকে অরুকে নিয়ে আয় সাইন করবি।

ক্রীতিক এবার অরুর পাঁচ আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে বললো,

--- আয় আমার সাথে।

লইয়ারের সামনের চেয়ার দুটোতে পাশাপাশি বসে আছে অরু আর ক্রীতিক।

অরুর নিস্তব্ধ চোখের জলে রেজিষ্ট্রি পেপার ভিজে আঠা আঠা হয়ে গিয়েছে, তবুও কলম হাতে নিয়ে বসে আছে সে।

অরুর এহেন কান্ডে বিরক্ত হয়ে ক্রীতিক আস্তে করে অর্ণবকে বললো,

--- অর্ণব প্রাইভেট জেট বুক কর। অরুর মা দেশে ফিরবে।

ক্রীতিকের কথার আগামাথা অর্ণবের বুঝে না এলেও অরু তৎক্ষনাৎ বললো,

--- করছি করছি, সাইন করছি।

চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরা নোনাজল টুকু হাতের পিঠ দিয়ে মুছে, কাঁপা কাঁপা হাতে অস্পষ্ট অক্ষরে অরোরা শেখ নামটা লিখে দিলো অরু।

অরুর সিগনেচারের পর্ব শেষ হলে ক্রীতিক নিজেও গুটিগুটি অক্ষরে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী নামটা লিখে দেয়। সিগনেচার করার সময় ক্রীতিকের মুখটা ছিল থমথমে আর গম্ভীর। দেখে মনে হচ্ছিল অরুকে নয়, বরং ওকেই অরু জোর করে ধরে বিয়ে করাচ্ছে। তবে ওর মনে চলছিল অন্য সুর,

----কথা দিয়েছিলাম খুব বেশি না একটু খানি বড় হ, তোকে আমি আমার করে নেবো। আজ কথা রেখেছি, তুই আজ থেকে আমার অরু। পুরোটাই আমার।

রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করা শেষ হলে এলিসা একটা তাজা ফুলের মালা অরুর হাত ধরিয়ে দিলো, অন্যটা ক্রীতিকের হাতে, তারপর মোবাইলের ভিডিও অন করতে করতে বললো,

--- জেকে বউকে মালা পরা।

ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

--- এসবের দরকার নেই তো এলিসা।

--- দরকার আছে তুই পরা।

এলিসার কথায় ক্রীতিক অরুর নত করে রাখা মাথার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,

--- মাথা তোল মালা পরাবো।

সায়র চোখমুখ কুঁচকে বললো,

--- সিরিয়াসলি জেকে? তোর বউ হয়ে গিয়েছে মেয়েটা, এখনতো একটু সম্মান দে।

ক্রীতিক এবার সত্যি সত্যিই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- অরু মাথা তোলো মালা পরাবো।

"তোলো" শব্দটা বলতে গিয়ে ক্রীতিকের বোধহয় জিভ খসে পরার উপক্রম, ওকে দিয়ে এসব হয়না মোটেই। এবার এলিসাও পাশ থেকে তাড়া দিয়ে অরুকে বললো,

---অরু মাথা তোলো।

সবার জোরাজোরিতে অরু এবার মাথাটা তুলে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো। সেই ঝড় তোলা কামুক চাহনি, চোখ দেখে মনেই হচ্ছেনা এই লোকটা একটু আগে এতোবড় ভয়া'বহ কান্ড ঘটিয়েছে। অথচ সবার মধ্যে থেকে ফে'সে গিয়েছে অরু।

অরুর ভাবনার মাঝেই ওর গলায় মালা পরিয়ে দিলো ক্রীতিক। এবার অরুর পালা। কিন্তু অরুর মতো একরত্তি চুনোপুঁটির মতো মেয়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা গ্রীকগড খ্যাত ক্রীতিকের লাগাম কি করেই বা পাবে? তাই সহসাই পা উচিয়ে আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে মুখ কাচুমাচু অরু বললো,

--- পারছিনাতো।

অরুর কথায় এলিসা মুখ টিপে হাসি সংবরণ করে বললো,

--- জেকে কি সমস্যা? তোর বউ তো তোর নাগাল পাচ্ছে না।

ক্রীতিক কিছু না বলেই এবার মাথা নুইয়ে দিলো অরুর সামনে,তৎক্ষনাৎ ওকে মালা পরিয়ে দেয় অরু।

ঠিক সেই মূহুর্তটাই মুঠোফোনের ক্যামেরায় ব'ন্ধী করে নেয় এলিসা। এরপর ধর্মীয় মতে ওদের আরও একবার বিয়ে হয়।অরু আর ক্রীতিক দুজনই কবুল বলে বিয়েটা সম্পন্ন করে।

অরু কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। নাক, চোখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। ওর পরনে ছিল লংস্কার্ট আর সুতির টপস। চেহারায় কৃত্তিম প্রসাধনীর লেশমাত্র নেই,তবুও বিয়ের মালা পরিহিত সদ্যবিবাহিতা অরুকে দেখতে অপরূপা লাগছে। চেহারাতে অন্যরকম লাবন্যতা এসেছে মেয়েটার। এটা বোধ নতুন নতুন বিয়ের পর সব মেয়েদেরই আসে, তাই অরুরও এসেছে।

বিয়ের পালা শেষ হলে ছোট্ট একটা নিয়মের মাঝে আটকে পরে ওরা। এটা ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতি। বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীর ঘোমটা খুলে মুখ দেখবে অতঃপর স্ত্রী তার স্বামীর দু-হাতে চুমু খেয়ে হাতদুটো চোখে ছুয়িয়ে সম্মান জানাবে। আর স্বামী স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে সেই আন্তরিকতা টুকু সাদরে গ্রহন করবে। দারুন ট্রেন্ড। হুজুরের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে এলিসা, অর্ণব, সায়র একপ্রকার ঝুলে পরেছে ওদের দিয়ে এই ট্রেন্ড পালন করাবেই করাবে। সব নিয়ম পালন করা হয়েছে এটুকু কেন বাকি থাকবে?

ওদের জোরাজোরিতে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে বললো,

--- অনেককিছু করেছি, আর পারবো না। এখন যা করার তোরা কর।

এলিসা ওর দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,

--- পারবিনা মানে? মেয়েটাকে জোরজব'রদস্তি করে বিয়ে করেছিস, আর এখন বলছিস নিয়ম পালন করতে পারবি না? মগের মুল্লুক নাকি?

--- ভাই কেন বুজছিস না,এটা বাঙালি নিয়ম না,কোথাগার ইন্দোনেশিয়ান নিয়ম। আমরা কেন পালন করতে যাবো?

এলিসা ক্রীতিকের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,

---শোন জেকে, নিয়ম ইজ নিয়ম, অতো দেশটেশ বুঝিনা আমরা। সো চুপচাপ পালন করে ফেলো।

পাশ থেকে অর্ণব বললো,

--- শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস জেকে, অরুতো এখন তোর বউই যা নিয়ম আছে সব করে ফেল। এলিসা হলেতো আমি নাচতে নাচতে ট্রেন্ড পালন করতাম। শুধুমাত্র নিজের দেশ কেন পুরো এশিয়ান সবগুলো কান্ট্রি থেকে নিয়ম ধার করে এনে এনে পালন করতাম।

এলিসা অর্ণবকে চোখ রাঙিয়ে বললো,

--- থামবি তুই?

ক্রীতিক এবার ওদের সবাইকে একসাথে থামিয়ে দিয়ে বললো,

--- আচ্ছা চুপ কর তোরা। করছি, যা যা নিয়ম আছে সব পালন করছি, তবুও চেঁচামেচি থামা।

*****************************************

ক্রীতিকের সম্মতি পেয়ে এলিসা এগিয়ে এসে অরুর পাতলা ফিনফিনে দোপাট্টা দিয়ে ওর মাথায় বড়সড় একটা ঘোমটা টেনে দিলো। এখন আর অরুর মুখ দেখা যাচ্ছেনা। ক্রীতিক কয়েক সেকেন্ড ঘোমটা টানা অরুর দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো ধীরে ধীরে অরুর ঘোমটা সরানোর উদ্দেশ্যে। ভেতরের উত্তেজনা, উৎফুল্লতায় এবার সত্যি সত্যি ওর হাত কাঁপছে। নিজেকে বারবার দাড় করাচ্ছে সপ্ন দুয়ারে, অরু এখন আক্ষরিক অর্থে ক্রীতিকের বউ। মিসেস অরোরা জায়ান। আর এই মূহুর্তে ক্রীতিক তার বউয়ের ঘোমটা সরাচ্ছে মুখ দেখার উদ্দেশ্যে এটা কি আদৌও সত্যি? নাকি সপ্ন?

ক্রীতিক ধীরে ধীরে ঘোমটা তুলে অরুর, নানা তার নতুন বউয়ের মুখের দিকে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। ওর পুরো পৃথিবীটা এখানেই থমকে গিয়েছে, অরুকে আজ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। তাইতো ক্রীতিকের মতো শক্ত পোক্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষটাও কেমন গলে গলে যাচ্ছে ওর মায়াবী মুখখানা দেখে। ঘোমটা তোলা হয়ে গেলে এলিসা আর হুজুরের নির্দেশে কাঁপা কাঁপা হাতে ক্রীতিকের জিম করা পেশিবহুল সাদা ফর্সা হাতদুটো হাতের মধ্যে নিয়ে নেয় অরু। অতঃপর হেঁচকি দিতে দিতে ওর দু'হাতের পিঠে নিজের ভেজা নরম তুলতুলে অধর খানি ছুয়িয়ে দেয় নির্লিপ্তে,অতঃপর তা মাথা নুয়িয়ে স্পর্শ করায় নিজের দুচোখে।

অরুর এই নিয়ম পালনে কি মোটেও আন্তরিকতা ছিলোনা? ছিলোতো, যত যাই হোক বিয়ের পরে মেয়েদের হৃদয়টা স্বামীর প্রতি আপনাআপনি দূর্বল হয়ে যায়। ওই মূহুর্তে অরুরও বোধ হয় তাই হয়েছিল। অরু যখন ক্রীতিকের হাতদুটো দুচোখে স্পর্শ করায় তখন ক্রীতিক তার একহাত নিয়ে অরুর মাথার উপর রেখে অন্যহাতের বাহুতে টেনে নেয় অরুর ছোট্ট শরীরটাকে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিকের সাদা শার্টটা খামচে ধরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কা'ন্নায় ভেঙে পরে অরু।কি জানি কেন এতো কেঁদেছিল সেদিন? আর কাঁদবেই যখন তখন ক্রীতিকের বুকেই কেন? তখন তো ক্রীতিকই আসল কার্লপিট ছিল।তবুও ক্রীতিকের বুকেই কেঁদে ভাসিয়েছিল অরু।

এসব অযথা নিয়মকানুন পালনের পর ক্রীতিক আর দাঁড়ালো না, অরুকে কোলে তুলে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো মসজিদ থেকে। তারপর বাইকে বসে বরাবরের মতোই নিজের ওয়ালেট, সিগারেটের বক্স, এমনকি একটু আগের মালাটাও অরুর হাতে ধরিয়ে দিলো সে। অরুও চুপচাপ সেগুলো হাতে নিয়েই বসে পরলো বাইকের পেছনে।

অরুর ভেতর তখন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতি থাকলেও আজ ওর অনুভূতি গুলো তুঙ্গে। এখন মনে হচ্ছে বিয়ের পরে স্বামীর সাথে ওর প্রথম বাইক রাইড বোধ হয় সেটাই ছিল।

সেদিনের ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করে আরও একবার লাজুকতায় মুড়িয়ে গেলো অরু। সেই লাজে রাঙা হলো নরম তুলতুলে কপোল দুখানা।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩১

ইদানীং প্রায়শই শেষ রাতে ঝড় হয়। প্রকট ঝড়ে গাছপালা ভেঙেচুরে শহরতলীর হাইওয়ে রাস্তাঘাট পর্যন্ত ব্লক হয়ে থাকে নিমিষেই ।অতঃপর ভোর হতেই সেই ঝড়বৃষ্টি দমে গিয়ে নতুন করে উদীয়মান হয় সোনালী রঙা সূর্য কীরন। এখন সন্ধ্যারাত চলমান, তবুও শেষ রাতে ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে হুহু করে এলোপাথাড়ি বইতে থাকা মেঘ ভেজা ঘূর্ণি বায়ু। সেই তীব্র ঝড়হওয়ার উল্টো পথে বাতাস কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের ব্ল্যাক মার্সিডিজটা। চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজমান, পুরো রাস্তাটা খালি পরে আছে, এই যায়গাটা বরাবরই এমন, সন্ধ্যে হতে না হতেই মানুষ জনের আনাগোনা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়।

ড্রাইভিং সিটে বসে দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে ক্রীতিক নিজেই। ভার্সিটির কিছু জরুরি কাজ সম্পন্ন করে আজকেই নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিসকো ফিরেছে সে। চোখে তার ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। সব সময় সেট হয়ে থাকা আন্ডারকাটিং স্টাইলিশ চুলগুলোও এখন এলোমেলো ভাবে কপালে পরে আছে। ড্রাইভ করতে করতে প্রায়শই কপালে পরে থাকা অবিন্যস্ত চুলগুলোকে একহাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে পেছনে ঠেলছে ক্রীতিক। তবে এই মূহুর্তে ওর ক্লান্ত মুখ ভঙ্গিমা খুব একটা ঠাওর করা যাচ্ছে না। চোখের ভাষা পড়ার উপায় নেই। দেখলে মনে হবে অনুভূতিহীন নির্জীব এক কাঠের পুতুল। অথচ হাতদুটো চলছে নির্বিগ্নে, ক্রীতিক যখন স্পিডোমিটারের সর্বোচ্চ গতিতে নিজের গাড়িটাকে বাতাসের বিপরীতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই খানিকটা ফুরসত দিয়ে ভাইব্রেট ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে ওর। ক্রীতিক কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে স্পিডোমিটারের গতি সামান্য ধীর করে ফোনটা রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অর্ণব হন্তদন্ত হয়ে বলে ওঠে,

--- ভাই খবর শুনেছিস?

ক্রীতিক শুধালো,

--- কি খবর।

গলার আওয়াজে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে অর্ণব বললো,

--- নিখিল কে সার্চ করার জন্য পুলিশ সহকারে ওর এ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিখিল কোথাও নেই। কোথাও নেই মানে কোথাও না।ভার্সিটি, ক্যাম্পাস, সাইনটিস্ট টীম কেউ ওর খবর জানেনা, কেউ না, এমন কি ওর গার্ল ফ্রেন্ডরাও না। কোথায় পালালো বলতো এই হতচ্ছাড়া?

ক্রীতিক স্পষ্ট আওয়াজে বললো,

--- কোথাও না।

--কিহ!

অর্ণবের কথার প্রতিউত্তরে ক্রীতিক বললো,

--- ওকে রাশিয়ান মাফিয়ারা গু'ম করে নিয়ে গেছে, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছিল কিনা,দেখ গিয়ে এতোক্ষণে হয়তো পিস পিস করে ওর লি'ভার কি'ডনি গুলো অন্যদেশে পা'চার করে দিয়েছে তারা।

ক্রীতিক এমন ভাবে নিরুদ্বেগে কথাগুলো বলছিল যেন সামান্য একটা মুরগী কা'টার কথা বলা হচ্ছে এখানে, কি আশ্চর্য!

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব আঁতকে উঠে বললো,

--- কি বলছিস? তুই কি করে জানলি এতোসব?

ক্রীতিক ড্রাইভ করতে করতে ঠোঁটের কোনে একটা বিন্যাস্ত কপট হাসি ধরে রেখে বললো,

--- আমিইতো ওকে মাফিয়াদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছি,কৌশলে।

অর্ণব তেতে উঠে বললো,

--- এটা মোটেও হেলাফেলার কথা নয় জেকে। ছেলেটা ইয়ং, বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভুল করে বসেছে, আমরা ওকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারতাম, হয়তো শুধরে যেতো, নিজের ভুলটা বুঝতে পারতো, তা-না তুই ওকে ডিরেক্ট মৃ'ত্যুর দিকে ঠেলে দিলি? এভাবে কৌশলে আর কত মানুষকে মা'র'বি তুই? সেদিন এ্যা'ক্সিডেন্টের পর জ্যাকসন হসপিটালে ধুঁকে ধুঁকে মা'রা গিয়েছে, আর আজ নিখিল।

অর্ণবের কথায় ক্রীতিকের মোটেও হেলদোল হলোনা, বরঞ্চ নিজের চোয়াল খানা শক্ত করে ও বললো,

--- যে যার কর্মফল ভোগ করলে আমার তো কিছু করার নেই।

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- ওদের একমাত্র দোষ কি? ওরা অরুর দিকে হাত বাড়িয়েছিল তাইতো?

ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,

---এক্স্যাকলি।

--- এতো অবসেশন ভালো নয় জেকে। বাই এনি চান্স তোর এই অতিরিক্ত আসক্তি অরুর উপর চড়াও হলে তখন? মেয়েটাকে তো রেগেমেগে মে'রে ফেলবি তুই।

অর্ণবের কথার পাছে ক্রীতিক বললো,

--- কখনো এমন পরিস্থিতি এলে নিজেকেই নিজে আ'ঘাত করবো আমি। তবুও ওকে নয়। আফটার অল,সি ইজ মাই প্রোপার্টি,হার্টবিট, এন্ড মাই এভরিথিং।

অর্ণব ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

---বুঝেছি তোকে আবার সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। নয়তো তুই শুধরাবি না।

ক্রীতিক ওর কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,

--- জ্ঞানদান পর্ব শেষ হলে বল, কলটা রেখে দেই, আমি ড্রাইভ করছি।

এরপর ওপাশ থেকে কল কাটার পিক পিক আওয়াজ ভেসে এলো কানে। অর্ণব কল রেখে দিলে ক্রীতিক আবারও মন দেয় ড্রাইভিং এ।

সেদিনের পাহাড়ের ঘটনার আজ প্রায় একসপ্তাহ হতে চললো, অথচ গত একসপ্তাহে একবারও অরুর সাথে দেখা কিংবা কথা কোনোটাই হয়ে ওঠেনি ওর।কারন গত একসপ্তাহ ধরেই শহরের বাইরে ছিল ক্রীতিক। আর আজ যখন সানফ্রান্সিসকো ফিরে অরুকে কল দিলো তখন বারবারই ফোনটা বন্ধ বলছে। এতোক্ষণ তো ক্রীতিক ভেবেছে ব্যাপারটা খুবই সাভাবিক ফোন বন্ধ থাকতেই পারে, কিন্তু অর্ণবের সাথে কথা বলার পর থেকেই অরুকে দেখার জন্য হৃদয়টা কেমন আনচান করছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে দেখা না হোক এটলিস্ট অরুর তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দটুকু যদি শোনা যেত তাহলে রাতে অন্তত নিশ্চিন্তে ঘুমানো যেত।

খানিকক্ষন ধরে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মাঝ পথেই ব্রেক কষলো ক্রীতিক। অতঃপর ফোন হাতে নিয়ে দ্রুততার সাথে ডায়াল করলো অরুর নাম্বারে। কিন্তু না অরু কল তুললো না। গত কয়েকবারের মতো এবারও ফোনটা বন্ধ বলছে।এহেন কান্ডে ক্রীতিক বেশ বিরক্ত হলো, উগ্র মেজাজটা হুট করেই চড়াও হলো অরুর উপর। রাগের তোপে মনেমনে দাঁত খিঁচে বললো,

--- তোকে একবার চোখের সামনে পেয়ে নেই অরু। তারপর বুঝাবো ফোন বন্ধ করে রাখার শা'স্তি কাকে বলে।

বারবার কল দিয়েও কোনোভাবেই অরুকে কলে না পেয়ে, বিরক্তিতে ফোঁসফাস করতে করতে শেষ মেশ ক্রীতিক কল লাগালো প্রত্যয়ের নাম্বারে।

দুএকবার রিং হওয়ার পরেই কল তুললো প্রত্যয়, তবে ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই ক্রীতিক তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন ছু'ড়লো ওকে,

--- অরুর কোনো খবর জানো প্রত্যয়?

ওপাশ থেকে বোধ হয় প্রত্যয়ের শুষ্ক ঢোক গেলার আওয়াজ ভেসে এলো, অগত্যাই আমতাআমতা করতে লাগলো ও।

প্রত্যয় আমতাআমতা করছে দেখে ক্রীতিক হুংকার দিয়ে বললো,

--- কি হয়েছে? এরকম মেয়েদের মতো মিনমিন করছো কেন? যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলো, হোএয়ার ইজ অরু?

প্রত্যয় উল্টো প্রশ্ন করে শুধালো,

--- ভাই আপনি কি ফিরেছেন?

ক্রীতিক বললো,

--- হ্যা একটু আগেই ফিরেছি, এখন বাড়ির দিকে যাচ্ছি, কেন বলোতো?

প্রত্যয় ভয়ার্ত গলায় গাইগুই করে বললো,

--- তাহলে বোধ হয় আমাদের একবার অরুদের বাসায় উচিৎ। আমি শুনেছি, না মানে সিওর না, শুনেছি কেবল, অরুর মা,মমানে আজমেরী ম্যাম বোধ হয় অরুকে বববিয়ে দিতে চাইছেন, আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসার কথা।

প্রত্যয়ের কথা শুনে ক্রীতিকের মাথায় ভলভলিয়ে র'ক্ত উঠে গেলো, নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরে ক্রীতিক গর্জে উঠে বললো,

--- হোয়াট? এমন একটা কথা তুমি আমাকে এখন বলছো? ব্রেইন কোথায় তোমার?

প্রত্যয় থতমত খেয়ে বললো,

--- ইয়ে মানে, আমি নিজেই একটু আগে শুনলাম ভাই।

ক্রীতিক আর অযথা কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না, তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটায় একশোর উপর গতি তুলে হাওয়ার বেগে হুঁশশ করে চলে গেলো উল্টো পথে।

*****************************************

বাইরের ঝড়হাওয়া ক্ষনে ক্ষনে বেড়েই চলেছে। প্রচন্ড বাতাসের তান্ডবে বারবার জানালার ভারী পাল্লা গুলো বারি খাচ্ছে আর বিকট আওয়াজ তৈরি করছে, এই দানবীয় শব্দ সইতে না পেরে অরু এগিয়ে গিয়ে রুমের সবগুলো জানালার গ্লাস টেনে দিলো। গ্লাস টেনে দেওয়াতে গ্লাসের সাথে বাতাস বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে এখন আরও ভ'য়ানক আওয়াজ তৈরি হচ্ছে রুমের মাঝে। সেদিকে অবশ্য খেয়াল নেই অরুর। ওতো সেই কখন থেকে রুমের দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে, চোখের সামনে যে ছোট্ট বেডসাইড টেবিলটা,তারউপর পিচ কালারের জামদানী শাড়ি আর কিছু গহনা রাখা আছে। এগুলো সেই বিকেলে এসে দিয়ে গিয়েছিল অনু। বলেছে সবকিছু পরে রেডি হয়ে থাকতে। সন্ধ্যা নাগাদ রাজের পরিবার আসবে ওকে দেখতে। রাজরা দুইতলায় থাকে, তাই মনে হয়না সন্ধ্যা হওয়ার পর আর দেরি করেছে তারা, বাইরে একাধিক মানুষের কথাবার্তা আর শোরগোল শুনে মনে হচ্ছে সবাই চলে এসেছে এতোক্ষনে অথচ অরু এখনো ক্রীতিকের দেওয়া পাজামা সেট পরেই বসে বসে ঠোঁট উল্টে কাঁদছে। কিভাবে কি ভেস্তে দেওয়া যায় সেটাই ভাবছে তখন থেকে। এতো অল্প বয়সে এরকম সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সেটা বোধ হয় কল্পনাতেও ভাবেনি অরু। অথচ যার জন্য এতো হৃদয়ের হাহাকার, গত একসপ্তাহ ধরে তার কোনো খবরই নেই। ফোন নেই তো কি হয়েছে? একটা বার কি বাসার নিচে আসা যেতো না?

অভিমান হলো অরুর, বেজায় অভিমান। অভিমানের জোয়ারে গলায় আটকে আছে বুক ফাটা কান্নার দল। ক্রীতিকের উপর অভিমানের ঘট যখন পরিপূর্ন ওর হৃদয়ে, তখনই অরুর মনে হলো,

----না এসেছে ভালোই হয়েছে, ভুলেও যদি এসব কাহিনি জানতে পারতো তাহলে রাজের সাথে সাথে আমাকেও থা'পরিয়ে চান্দে পাঠিয়ে দিতো নিশ্চিত। যা হয়, তা বোধ হয় ভালোর জন্যই হয়, এবার আজকের দিনটা কোনোমতে বিগড়ে দিতে পারলেই হলো, পরে নাহয় রাজকে আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। আর তারপর মাকেও।

অরুর ভাবনার সুতো ছিড়লো বাইরে থেকে অনুর ডাকে, দরজার বাইরে বারবার ক'রাঘাত করতে করতে অনু বললো,

--- কিরে অরু, রেডি হয়েছিস? দরজাটা খোল, তোকে যেতে হবেতো।

অনুর উপস্থিতি টের পেয়ে অরু মনেমনে চিন্তা করলো,

--- আপাকে একবার বুঝিয়ে বললে কেমন হয়? আপাও তো একজনকে ভালোবাসে, ও নিশ্চয়ই বুঝবে।

--- অরু দরজা খোল, সবাই অপেক্ষা করছে তো।

পুনরায় অনুর খাদে নামানো কন্ঠ কানে এলে, অরু এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

ভেতরে প্রবেশ করে অরুর এমন অগোছালো বিমূর্ষ রূপ দেখে অনুর চোখ কপালে উঠে যায়, ও তৎক্ষনাৎ দরজাটা লাগিয়ে অরুর কাছে এগিয়ে এসে ঝাঁজিয়ে বললো,

--- রেডি হসনি কেন এখনো?কি চাইছিস? মা আবারও তোর উপর রেগে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরুক? আবারও এতিম হতে মন চাইছে?

অরু এবার কান্না ভেজা গলায় অনুকে অনুরোধ করে বললো,

--- আমি এসব দেখাদেখি করতে চাইনা আপা, তুই প্লিজ মাকে একটু বোঝা, তোকে আমি সব বলবো, তার আগে তুই কিছু কর।

অনু অরুর চিকন বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

--- আমাকে কিচ্ছু বলতে হবেনা, এখানে মায়ের সম্মান জড়িয়ে আছে, মা নিজে ওদেরকে ইনভাইট করেছে তোকে দেখার জন্য, আর এখন তুই বলছিস যেতে পারবি না?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,

--- যদি বলি আমি কাউকে ভালোবাসি?

অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

--- কে সে, শুনি?

অষ্টাদশী অপারগ অরু নিজের মায়ের সৎ ছেলের নামটা উচ্চারণ করার সাহস আর পেলোনা, সব তচনচ হয়ে যাবে সেকথা ভেবে।

অরু চুপ হয়ে আছে দেখে অনু খিটমিটিয়ে উঠে বললো,

--- মিথ্যে কথা বলার আর যায়গা পাস না?আমাকে বোকা না বানিয়ে চুপচাপ রেডি হ।

--- আপা বিশ্বাস কর আমি মিথ্যা বলছিনা, তুই কিছু একটা কর আপা। আমাকে এভাবে ভরা নদীতে ঠেলে দিস না।

বোনের এরূপ কাকুতি মিনতি দেখে মন গললো অনুর, কিন্তু মায়ের সম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে,তারউপর মা অসুস্থ এসপারওসপার হয়ে গেলে মায়ের যদি শারীরিক কিছু ক্ষতি হয়ে যায়? সেই ভয়ে তটস্থ অনু। তাই ও নিজের কঠিন সুরটা একটু নরম করে অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

--- দেখ বোন, আগেও বলেছি এখনো বলছি, দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায়না। ওরা শুধু দেখে যাবে এই যা। তাছাড়া আজকের দিনটা কোনোমতে চলে গেলেই দেখবি সব সমস্যার সমাধান, পরে না হয় রাজ কে একান্তে বুঝিয়ে বলিস তোর সমস্যা গুলো। এখন দেরি না করে চল।মা সেই কখন থেকে অতিথিদের সামনে বসে আছে।

আপার কথায় বেশ আস্বস্ত হলো অরু। বুকের ভেতরটা অনেক হালকাও লাগছে এখন। ঠিকই তো আজকের রাতটা মানে-মানে চলে গেলে রাজকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলতে হবে। তাহলে রাজই সব কিছু মিটিয়ে ফেলতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে অরুর কান্নাকাটিতে একটু ভাটি পরলে অনু শাড়ি হাতে নিয়ে বললো,

--- আয় পরিয়ে দিই।

*****************************************

অনু অরুকে আনতে রুমে গিয়েছে, এদিকে অনবরত কলিং বেলের আওয়াজ ভেসে আসছে তখন থেকে। কি জানি কে এমন ভাবে কলিং বেলে চাপছে। অনু ধারেকাছে নেই বলে আজমেরী শেখ এবার নিজেই উঠে গেলেন দরজা খুলতে। অতিথিরা সবাই গোল হয়ে কাউচে বসে আছে, রাজ ও আছে, অফ হোয়াইট কালারের প্রিন্স কোর্টে তাকে বেশ সুদর্শনই লাগছে। রাজ ছোট বেলা থেকেই আমেরিকাতে বড় হয়েছে। ওর পুরো চোদ্দগোষ্ঠী আমেরিকান নাগরিক , সবাইই এখানকার বড়বড় ব্যাবসায়ী কিংবা চাকুরীজীবি। সেই হিসেবে পাত্রী দেখতে আসায় কোনোরূপ ত্রুটি রাখেননি তারা ভরপুর এনেছেন, তারউপর এসেছেও অনেকজন। পুরো বসার ঘর মানুষে গিজগিজ করছে এই মূহুর্তে ।

ঠিক সেই সময়ই আগমন ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত একজনার, সে আর কেউ না, মিসেস অরোরা জায়ানের লিগ্যাল গার্ডিয়ান,মি. জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

আজমেরী শেখ দরজা খুলতেই চোখের সামনে প্রত্যয়কে দেখতে পায়, প্রত্যয়কে দেখে তিনি ভেবেছেন হয়তো কোনোরূপ অফিসিয়াল কাজেই তার আগমন, কিন্তু তারপর পরই প্রত্যয়ের পেছন থেকে বেড়িয়ে আসে আরেকজন। যদিও এটাই প্রথম সাক্ষাৎ, তবুও এই লম্বা সুদর্শন ছেলেটাকে চিনতে খুব একটা সমস্যা হলোনা আজমেরী শেখের, তিনি ক্রীতিককে দেখা মাত্রই তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,

--- জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, এইখানে? অহংকার ভাঙলো তবে? তা আগমনের কারনটা জানতে পারি?

ক্রীতিক আজমেরী শেখের একটা কথারও জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো, ওর পেছন পেছন প্রত্যয়ও। ভেতরের সবাই ক্রীতিককে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো বটে, সবার মনে একটাই প্রশ্ন,

--- এ আবার কে? আদৌও বাঙালি, নাকি বিদেশি? চেহারা দেখেতো মনে হচ্ছে দুটোর মিক্সড।

ক্রীতিক জিভ দিয়ে গাল ঠেলে এগিয়ে গিয়ে আজমেরী শেখের ব্যক্তিগত ডিভানের উপর পায়ে পা তুলে বসে পরলো। ক্রীতিকের বে'য়াদবি দেখে আজমেরী শেখ এগিয়ে এসে অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড়িয়ে ক্রীতিকের উদ্দেশ্যে বললেন,

--- এটা আমার বসার যায়গা, গেট আপ।

ক্রীতিক পা দুলাতে দুলাতে বললো,

---আমার কোম্পানির টাকায় কেনা। ইনভেস্ট ফ্রম জেকে গ্রুপ? এম আই রাইট?

--- কোম্পানির ধারে কাছেও তো আসোনা, আমার নিজের কোম্পানি দাবি করছো?

ক্রীতিক রহস্যের হাসি হেসে বললো,

--- আমি যদি সারাজীবনও কোম্পানির ধারে কাছে না যাই, তাও জেকে গ্রুপ আমারই থাকবে।

আজমেরী শেখ নিজের রাগ টুকু সংবরণ করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,

--- কি চাইছো কি তুমি ক্রীতিক, কেন আমার বাসায় অহেতুক এসে ঝামেলা পাকাচ্ছো?

জবাবে ক্রীতিক বললো,

--- ঝামেলা পাকাবো কেন আশ্চর্য ? কি প্রোগ্রাম হচ্ছিল এখানে? প্রোগ্রাম করুন না, আমার কোনো অসুবিধা নেই আমিও দেখছি।

ক্রীতিকের কথায় আজমেরী শেখ ওর দিকে বিরক্তির দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,

---কেন, আমি ইনভাইটেড না? তাছাড়া ইনভাইট দিয়ে করবো টা কি?আফটার অল উই আর ফ্যামিলি। রাইট মামুনি?

আজমেরী ঠিকই বুঝলেন, যেই ছেলে সারাজীবন উনি উনি করে কথা বলেছে। জীবনে এইটুকু সম্মান পর্যন্ত দেয়নি, তার হটাৎ করে মামুনি ডাকে নিশ্চয়ই কোনো ঘাবলা আছে। তবুও চোখের সামনে এতোগুলা মেহমান দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন তিনি। ঠিক তখনই সবার কৌতুহল, অযাচিত প্রশ্ন সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে অরুকে নিয়ে অনু প্রবেশ করে বসার ঘরে। অরুর পরনে পিচ কালারের জামদানী শাড়ি, হাতে স্বর্ণের বালা। মাথায় ছোট্ট করে ঘোমটা টানা, দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।

কিন্তু অরুর এই সৌন্দর্য দেখে ক্রীতিকের র'ক্ত গরম হয়ে উঠেছে মূহুর্তেই। শরীরের শিরা উপশিরায় সেই টগবগে র'ক্তের উত্তাল ক্রোধ কোনোমতে ধামাচাপা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে অনবরত পা দোলাচ্ছে সে।

অনু এগিয়ে এসে অরুকে রাজের মুখোমুখি কাউচে বসিয়ে দেয়। এতোক্ষণ মাথা নুয়িয়ে রাখার জন্য ক্রীতিককে খেয়াল না করলেও কাউচে বসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিককে দেখে অরুর মুখ যেনো থেকে র'ক্ত সরে গেলো। প্রকট আতঙ্কে অজান্তেই নিজেই খামচে ধরলো নিজের শাড়ি। ক্রীতিক এই মূহুর্তে দু আঙুলে কপাল ঘষতে ঘষতে অরুর দিকেই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরনে তার সিলভার কালারের ব্র্যান্ডেট শার্ট। শার্ট গলিয়ে শক্ত হয়ে থাকা হাতের জিম করা পুরুষালী পেশিগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। ক্রীতিককে এভাবে হুট করে এই সময় দেখতে পেয়ে, ক্রীতিকের আ'গুন চোখে চোখ রেখেই তিরতিরিয়ে কাপছে অরু।

ওকে এভাবে কাঁপতে দেখে রাজের মা অরুর পাশে এসে বসে ওকে আসস্থ করে বললেন,

--- কাঁপছো কেন মা? আমরা আমরাইতো। এক সময় এরাই তোমার আসল পরিবার হবে এতো ভয়' পাওয়ার তো কিছু নেই।

কে শোনে কার কথা? এই মূহুর্তে কারোর কথায় কোনোরূপ খেয়াল নেই অরুর, ওতো এখনো ক্রীতিকের দিকেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্রীতিক কি থেকে কি করবে সেই ভয়েই তটস্থ অরু।

ক্রীতিক প্রথমে অরুর থেকে চোখ সরিয়ে চারিদিকে একবার চোখ বোলালো, অতঃপর চট করে উঠে দাড়িয়ে অরুর হাতটা শ'ক্ত করে চেপে ধরে, ওকে টা'নতে টান'তে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। ক্রীতিকের হঠাৎ এমন বি'স্ফোরিত কান্ডে সবাই হতভম্ব। কারও মুখে কোনো বাক্য নেই, কি করছে এই ছেলে। ক্রীতিক যখন অরুকে নিয়ে রুমে যাচ্ছিল ঠিক তখনই অরুর অন্য হাত টেনে ধরে রাজ। ক্রীতিক রাজের দিক অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তীর্যক স্বরে বললো,

--- হাউ ডেয়ার ইউ।

রাজ একটু সাহস দেখিয়ে বললো,

--- সি ইজ নট ইওর প্রোপার্টি।

ক্রীতিক শক্ত গলায় জবাব দিল,

--- ইয়েস সি ইজ।

কথাটা বলে ক্রীতিক রাজকে মা'রতে উদ্যত হবে, তার আগেই প্রত্যয় অরুর থেকে রাজের হাত ছাড়িয়ে বললো,

--- জানে বাঁচতে চাইলে ছাড়ো রাজ। অরু বিবাহিত। ক্রীতিক ভাই অরুর হাসবেন্ড।

প্রত্যয়ের শেষ কথাতে রুমের প্রত্যেকটা মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভে'ঙে পরলো। কি বললো প্রত্যয় মাত্র এটা? আদৌও ঠিক শুনেছে তো সবাই? আজমেরী শেখ আর অনুতো বাকরুদ্ধ পুরোপুরি। ক্রীতিক সেসবের দু পয়সা তোয়াক্কা না করে প্রত্যয়কে বললো,

--- আবর্জনা গুলো পরিষ্কার করো, এস সুন এস পসিবল। আর যেন এদের চোখের সামনে না দেখি আমি।

প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক অরুকে নিয়ে রুমে গিয়ে ঠাস করে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। অরু জানে ওর কপালে শনি নৃত্য করছে, তাই ভয়ের চোটে কুকরে আছে মেয়েটা।

ভেতরে এসে অরুকে সোজা দাঁড় করিয়ে শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ওর গালে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চপেটাঘা'ত করলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ছি'টকে মেঝেতে গিয়ে পরলো অরু। ঢিলে খোপা করা লম্বা চুলগুলো বাধন হারা হয়ে পরলো মূহুর্তেই। মেঝেতে বসে নিজের মুখটা দু-হাতে চেপে ধরে তীব্র কা'ন্না সংবরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে অরু। ক্রীতিককে দেখতে কি ভ'য়ান'কই না লাগছে। আগুনের শিখার মতো চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে আজ ওর খবর করে ছাড়বে ক্রীতিক। ক্রীতিক নিজের অন্য হাতাটা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে এসে অরুকে বললো,

--- এটা কেন দিলাম জানিস? আমার বউ হয়েও অন্যকারও সামনে বউ সেজে বসার স্পর্ধা দেখানোর জন্য।

অরুকে শক্ত হাতে টেনে তুলে ক্রীতিক ওর অন্যগালে থা'প্পড় দিতে উদ্যত হলে, অরু চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,

--- ব্যাথা পাচ্ছি, কষ্ট হচ্ছে আমার, আর মা'রবেন না, আআমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, আপা বলেছিল দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায়না। তাছাড়া আপনিও তো আসেননি এই কদিন কি করতাম আমি?

ক্রীতিক আর মা'রলো না ওকে, হাত নামিয়ে রেগেমেগে ওর গলাটা চেঁ'পে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,

--- একবার ফোন করতে পারতি না? আমি আদৌও বেঁচে আছি কি ম'রে গিয়েছি সেটা অন্তত খোঁজ নিতে পারতি। বিধবা হওয়ার এতো শখ?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,

--- কি বলছেন এসব, ফোন তো আমার কাছে ছিলোই না মা নিয়ে গেছে সেই কবে।

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুর গলা ছেড়ে দেয়। ফর্সা গলাটা আঙুলের চাপে র'ক্তিম হয়ে উঠেছে। ক্রীতিক তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে একবার নজর দিলো, তারপর অরুর বাহু ধরে ওকে কাছে নিয়ে এসে ওর সুন্দর কারুকাজ করা ব্লাউজের দুটো হাতাই একটানে ছি'ড়ে ফেললো ক্রীতিক। ওকে রেখে হঠাৎ ওর জামাকাপড় টেনে ছিঁ'ড়ছে দেখে অরু আঁতকে উঠে বললো,

--- কি করছেন এটা?

ক্রীতিক অরুর চুলের গার্ডার, ঠোঁটের লিপস্টিক, চোখের কাজল সব কিছু নিজ হাত দিয়ে একেএকে লেপ্টে দিতে দিতে চোয়াল শক্ত করে বললো,

--- অন্যকারোর সামনে নিজের সৌন্দর্য বিলাতে কেন গেলি অরু? আমার রা'গ কমছে না কিছুতেই, তোকে মার'তেও পারছি না, কলিজায় লাগছে। উল্টে আমিই ব্যাথা পাচ্ছি, ইচ্ছেতো করছে নিজেকে নিজেই...

ক্রীতিক কথা শেষ করার আগেই নিজের নরম তুলতুলে হাত দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরলো অরু, অতঃপর ক্রীতিকের চোখে চেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ালো।

অরুর এমন প্রতিক্রিয়ায় ক্রীতিকের কি না কি হলো কে জানে? ও হুট করেই অরুকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে ওর লালচে হয়ে যাওয়া র'ক্তাক্ত গলায় স্ব-গতিতে মুখ ডুবিয়ে দিলো। ক্রীতিক জিদের বশবর্তী হয়ে ক্রো'ধটা একটু বেশিই ঢালছিল অরুর উপর, তবুও চোখ মুখ খিঁচে পুরোটাই সহ্য করে নিলো অরু। এই মিষ্টি যন্ত্রনাটুকু বোধ হয় ওর পাওনা ছিল।

ওদিকে বাইরে থেকে দরজা ধা'ক্কাতে ধা'ক্কাতে হয়রান হয়ে উঠেছেন আজমেরী শেখ। প্রচন্ড মানসিক চাপ আর হঠাৎ রেগে যাওয়ার ফলপ্রসূ শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে গিয়েছে তার। মাকে এভাবে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে অনু তরিঘরি হয়ে মাকে বসার ঘরে নিয়ে এসে বললো,

--- তুমি একটু বসো মা, আমি ডাকছি ওদের।

প্রত্যয়ও বাইরেই দাড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ, মাত্র অনুকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ও নিজেও এগিয়ে গেলো অনুর পিছু পিছু । যেতে যেতে পেছন থেকে প্রত্যয় বললো,

--- এখন না ডাকলেই ভালো হবে ভাই খুব রেগে আছে।

প্রত্যয়ের কথায় অনু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,

--- খবরদার আর একটাও কথা যদি বলেছেন, আপনি সব জানতেন, অথচ আমাকে বোকা ভেবে দিনের পর দিন ভালোবাসা দেখিয়ে আমার পিঠেই ছু'রি মে'রেছেন।

প্রত্যয় আশ্চর্য হয়ে বললো,

--- আমি কি করলাম আজিব?

--- আপনি আমাকে বলেননি কেন যে অরু এতোবড় একটা অন্যায় কাজ করেছে।

প্রত্যয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

--- কি অন্যায় করেছে অরু?

অনু এবার হাটার গতি থামিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,

--- সৎ ভাইকে বিয়ে করা অন্যায় নয়? অরু নাহয় ছোট মানুষ, কিন্তু ক্রীতিক ভাইয়া? সে তো ছোট নয়, তাহলে তিনি এটা কিভাবে করলেন? কিসের প্র'তিশোধ নিতে উনি আমাদের মুখে এভাবে চুনকালি মাখালেন? আমার বোনের জীবনটা ন'ষ্ট করলেন?

প্রত্যয় এবার একটু রেগে গিয়ে বললো,

--- ধর্মে, কিংবা আইনে ওদের বিয়ের সম্পূর্ণ বৈধতা আছে, তাহলে চুনকালির কথা কোথা থেকে আসছে অনু?

অনু তেতে উঠে বললো,

--- আপনি সমাজ বোঝেন? সারাজীবন তো থেকেছেন অসামাজিক জায়ান ক্রীতিকের সাথে সাথে , তাহলে কি করে বুঝবেন সমাজের মর্ম? আজ বাদে কাল যখন পুরো সমাজ আমাদের পেছনে কথা বলবে,ছি ছি বুলি আওড়াবে, সবাই কানাঘুষা করবে, যে আজমেরী শেখ টাকার জন্য নিজের সৎ ছেলের গলায় নিজেরই মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছেন। তখন আপনাদের মতো মানুষের গায়ে না লাগলেও সমাজের অ'পমান আর বিদ্রুপে আমাদের তিন মা মেয়ের ম'রে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কারণ সমাজে এক ঘরেদের কোনো স্থান নেই।

অনুর একনাগাড়ে বলা হাজারটা যুক্তির পাছে প্রত্যয় আর কোনো যুক্তিই খুঁজে পেলোনা অনুকে ঘায়েল করার জন্য, তাই ও সহসা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। আর অনু গটগটিয়ে এগিয়ে গেলো অরুর রুমের দিকে।

*****************************************

দুইপাশে দুটো ডিভানের উপর পায়ে পা তুলে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে আজমেরী শেখ আর জায়ান ক্রীতিক। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের মাঝে পুরোদস্তুর নিরবতা বিরাজমান। ওদের থেকে একটু খানি দূরে দাড়িয়ে আছে অনু, প্রত্যয়, আর অরু। জামা কাপড় পাল্টে, ওড়না দিয়ে গলার কলার বোনগুলো খুব সাবধানে ঢেকে তবেই বেরিয়েছে অরু , নয়তো খানিকক্ষণ আগে পুরো গলায় ক্রীতিকের জিদের তোপে করা দাগগুলো সবার সামনে উন্মুক্ত বই হয়ে যাবে অনায়াসে । এই মূহুর্তে অরু সবার আড়ালে মাথা নুয়িয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওই মস্ত বড় অ'পরাধী, আর এখানে ওর বিচার সভা বসেছে।

চারিদিকের থমথমে পরিবেশটাকে আরও খানিকটা গুমোট করে দিয়ে আজমেরী শেখ বললেন,

--- আমার মেয়েটাকে বলির পাঁঠা কেন বানালে ক্রীতিক?

ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,

--- ফার্স্ট অফ অল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি, বলির পাঁঠা বানায়নি, আর সেকেন্ডলি আই থিংক সি ইজ মাই হার্টবিট।

ক্রীতিকের কথায় চটে গেলেন আজমেরী শেখ, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

--- মজা করছো আমার সাথে? নিজের সৎ বোনকে বিয়ে করতে লজ্জা করলো না তোমার?

ক্রীতিক বাঁকা হেসে নিজের ঠোঁট কামড়ে বললো,

--- শুধু বিয়ে নয়, আরও অনেক কিছু করেছি , এই যে একটু আগেও করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন একটুও লজ্জা লাগেনি, কেনইবা লজ্জা লাগবে বলুন? বউ হয় তো। যেই পুরুষ বউয়ের সামনে লজ্জা পায় সে আবার কেমন পুরুষ?

ক্রীতিকের কথায়, অনু আর আজমেরী শেখ দুজনই অ'গ্নি দৃষ্টিতে তাকালো অরুর পানে, যে এই মূহুর্তে মাথা নিচু করে ফোপাঁচ্ছে।

--- ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, আমার বউকে আমি যেটা বলবো ও সেটাই করবে।

ক্রীতিকের কথায় আজমেরী শেখ চোখ ঘুরিয়ে বললেন,

--- তুমি একা একা থেকে, আমেরিকান কালচারে বড় হয়ে একটা বেহায়া তৈরি হয়েছো। আর তুমি যেটাকে বিয়ে, ভালোবাসা বলছো না? এটা আসলে ভালোবাসাই নয়, ইটস ইওর অবসেশন, আনহেলদি অবসেশন, যার স্বীকার হয়েছে আমার মেয়েটা। নয়তো নিজের হাটুর বয়সী একটা মেয়েকে কে ভালোবাসে?

আজমেরী শেখের কথায় ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে বাহবা দিয়ে বললো,

--- আপনি সত্যিই জিনিয়াস, না হলে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে বুঝে গেলেন জিনিসটা? আর আমি কখন বললাম যে আমি অরুকে ভালোবাসি? আমি ওর প্রতি অবসেশট আনহেলদি রকম অবসেশন। আর এটাই সত্যি।

এখন আপনি সেটা ভালোয় ভালোয় নেবেন, নাকি নেবেন না, সেটা একান্ত আপনার ব্যাপার, বাট আমার বউকে আমি চাই, ব্যাস।

কথাটা শেষ করে তরাগ করে দাঁড়িয়ে পরে ক্রীতিক।

অতঃপর অরুর দিকে একপলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিক বলে,

--- কিছুদিন সময় নিন, মন দিয়ে ভাবুন, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গিয়েছে তারমানে, সি বিলোংস টু মি। তাই আপনাকে জোরজবর'দস্তি করে অরুকে কষ্ট দিতে চাইছি না।

তবে হ্যা আমার বউকে অন্যকারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এন্ড আই মিন ইট। কথাটুকু শেষ করে গটগটিয়ে যায়গা ত্যাগ করে ক্রীতিক।

অরুর বিয়ে হয়ে গেছে, আজমেরী শেখ চাইলেও আর মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকাতে পারবেননা,কোথাও বিয়ে দিতে পারবেন না, ক্রীতিক যা চাইবে তাই করতে হবে, ব্যাপারটা বুঝে আসতেই অকস্মাৎ ক্ষে'পে গেলেন তিনি, তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়িয়ে টেনে এনে এলোপাথারি চ'ড় বসাতে লাগলেন মেয়ের দুইগালে। হঠাৎ এভাবে এলোপাথাড়ি থা'প্পড়ে অরুর মাথায় চ'ক্কর দিচ্ছে বারবার, ও কাঁদতে কাঁদতে মাকে আকুতি করে থামতে বলছে, তবুও আজমেরী শেখের হাত থামছে না, ওকে মা'রতে মা'রতে তিনি কাঠিন্য সুরে বললেন,

--- একটা নোংরা কীট জন্ম দিয়েছি আমি, বেহায়া, নির্লজ্জ,নষ্টা, নিজের থেকে বারো বছরের বড় সৎ ভাইয়ের সাথে শুতে একটুও লজ্জা করলো না তোর?

মায়ের কথায় অরু যেন আকাশ থেকে পরলো, কি বলছে মা এসব? তার আর জায়ান ক্রীতিকের সম্পর্ক তো এতোটাও গভীরে যায়নি, আর মা কিনা এতো নোংরা চিন্তা করে ফেলেছে?ছিহ!

কথাটা ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো অরু। ওদিকে অরুর কান্নার আওয়াজ কানে পৌঁছতেই দরজার কাছে থেকে পুনরায় তরিৎ বেগে ফিরে এলো ক্রীতিক, হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রেগেমেগে এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রীতিক, তা দেখে মায়ের হাত চালানোকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দৌড়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে ক্রীতিকের পায়ের সামনে বসে পরলো অরু, ওর সামনে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

--- হাত জোর করছি, আর অশান্তি করবেন না, মা এমনিতেই অসুস্থ।এতো চাপ নিতে পারবেন না তিনি। আমি কথা দিচ্ছি আপনি ছাড়া এই জীবনে অন্য কোনো পুরুষের সামনে আর নিজেকে উপস্থাপন করবো না আমি।কোনোদিনও না।তাও আপনি ফিরে যান দয়া করে।

ক্রীতিক অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে সকলের সামনে অরুর ঠোঁটে আর কপালে আলতো চুমু খেলো, তারপর ওর গালে হাত বুলিয়ে বললো,

--- তুই কেন পায়ে পরছিস জান? তোর জায়গাতো আমার বুকে।

ক্রীতিকের আদুরে আওয়াজে আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো অরু, ক্রীতিক নিজের অন্য হাতটা অরুর আরেকগালে ছুয়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,

--- বিশ্বাস কর অরু, তোর কষ্ট দেখে আমার হৃদয় ছি'ড়ে যাচ্ছে, একবার শুধু বল, তুই আমার সাথে যাবি, বাকিটা আমি বুঝে নেবো।প্লিজ বল।

অরু নিজের হাত দিয়ে ক্রীতিকের হাত ধরে বললো,

--- একটু সময় দিন আমাকে, আমি আপা আর মাকে ঠিক বোঝাতে পারবো।

অরুর কথায় ক্রীতিকের সাভাবিক মুখশ্রীটা মূহুর্তেই কঠিন হয়ে উঠলো, ও অরুর দিকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছু'ড়ে বললো,

--- মা আর আপা যদি তোর কাছে এতোটাই প্রয়োজনীয় হয়, আমার কথা যদি তোর কাছে এতোটাই অগ্রাহ্য মনে হয়, তাহলে আমিও তোকে আর জোর করবো না।আমার কাছে যেতে হবেনা তোকে, থাকতে হবে না আমার সাথে। তবে হ্যা, আমাকে খুজে না পেলে আবার কান্না করিস না যেন। বিকজ আই হেইটস ইউর টিয়ারস বেইবি।

নিজের কথা শেষ করে এক মূহুর্তও ফুরসত না দিয়ে বাসা থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্রীতিক।

অরু এখনো অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে, ক্রীতিকের শরীরের মাতাল করা স্যান্ডাল উডের গন্ধটা এখনো চারিপাশে ম ম করছে। এইতো একটু আগেও দু'হাত দিয়ে অরুকে ছুঁয়েছিল সে, আর এখন কোথাও নেই সবকিছু কেমন শূন্য। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে আছে অজস্র কান্নারা,যার দরুন নাকের ডগাটা বারবার ফুলে উঠছে অরুর । ওর ছোট্ট মস্তিষ্কটা এখনো ঠিক ধরতে পারছে না, একটু আগে কি বলে গেলো ক্রীতিক? কিইবা বোঝালো ওই কঠিন কথাগুলো দ্বারা?

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩২

রাতের শেষ ভাগ চলমান, চারিদিক ছেয়ে আছে শুনশান নিস্তব্ধতায়। বিশাল আকাশ ছুঁই ছুঁই কংক্রিটের ভবনটার বেশির ভাগ এ্যাপার্টমেন্টেরই আলো নিভানো। ভবনের পেছনে অবস্থিত মানুষ যাতায়াতের সরু রাস্তায় গাড়ি তো দূরে থাক একটা সাইকেল চলারও টুংটাং আওয়াজ নেই পর্যন্ত,কি করেইবা থাকবে? এখনতো সবার ঘুমের সময়। রাতের এই শেষ প্রহরে মানুষ তো দূরে থাক রাত জাগা পাখিরাও বোধ হয় ঘুমিয়ে পরে ক্লান্তিতে ।

আমেরিকার এই স্টেটে ভালোই বাঙালি চোখে পরে, তাই হয়তো এখানে নাইট ক্লাব, কিংবা বার এসব বিদেশি আমোদ ফূর্তির জোয়ার অতো বেশি নেই,তারউপর পাশেই হাসপাতাল। তাইতো চারিদিকে এমন শান্তি শান্তি পরিবেশ বিরাজমান।

এই শুনশান নিস্তব্ধতা, মৃদু হিমেল হাওয়া,কিংবা শান্তিদায়ক পরিবেশ কোনোটাই উপভোগ করার লেশমাত্র আগ্রহ নেই অরুর মাঝে, আর না আছে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত নিভু নিভু চোখ দুটোর পাতায় একরত্তি ঘুম। সেই সন্ধ্যা বেলাতে টানা বারান্দায় এসে বসেছিল, আর এখন রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে চললো, তাও একই ভাবে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বারান্দায় বসে আছে অরু। আজকাল এটা ওর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গত কয়েকদিন যাবত নামমাত্র খাবার আর পানি খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে মেয়েটা। কি করেই বা খাবার মুখে তুলবে ও? মা, আপা কেউ ওর সাথে কথা বলাতো দূরে থাক ওর দিকে ভালো করে ফিরেও তাকায় না, চোখের সামনে দেখলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কেমন যেন সবার মাঝে উপস্থিত থেকেও নেই অরু। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে, হঠাৎ করেই ওর সুন্দর সাজানো গোছানো জীবনটা হয়ে উঠেছে দূর্বিষহ আর অসাভাবিক।

এতোকিছুর পরেও যার জন্য এতোটা কষ্টসাধ্য করা, যার জন্য এতো ধৈর্য ধারণ করা, যার কথা ভেবে ভেবে এই নির্ঘুম রাত কাটানো, সে যদি অন্তত মনের খবরটা বুঝতো। কিন্তু না ক্রীতিক সেই যে রেগেমেগে চলে গেলো আজ প্রায় একসপ্তাহ হতে চললো, আর আসেনি সে।

ওদিকে মা আর আপার খুশির জন্য ঘরের বাইরে পা মারায়না অরু, কারণ ও জানে ঘরের চৌকাঠ মারালেই সবাই ভাববে অরু ক্রীতিকের কাছে গিয়েছে, তারপর শুরু হবে আরেক অশান্তি। অরু আর অশান্তি চায়না। ওর এইটুকু জীবন দিয়ে কম তো আর ধকল গেলোনা। গত একসপ্তাহের অনাহার আর অবহেলায় সুন্দর লাবন্যময় মুখটা হুট করেই কেমন ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে , না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখের কোটরে কালি জমেছে, লম্বা চুলগুলোতে চিরুনি চলেনি বেশ কয়েকদিন, শরীরের সাথে ফিটিং হয়ে থাকা জামাটাও গলা থেকে নেমে যাচ্ছে নিঃসংকোচে। আর কিছুদিন এভাবে থাকলে অরুকে অ'সুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে নিশ্চিত।

জীবনে প্রথমবার প্রেমে পরলে বুঝি এমনটাই হয়? তার দহনে হৃদয় ছি'ড়ে যায়। কিন্তু ওর এই বিভীষিকা ময় অবস্থা করে দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো ক্রীতিক?

ভেবে পায়না অরু। দিনে অন্তত একশোবার এসে টানা বারান্দায় উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে কেউ আসলো কিনা দেখার উদ্দেশ্যে, কিন্ত না অরুর জন্য এখন আর কেউ আসেনা, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েও থাকেনা কেউ। অরু কষ্ট পায়, ওর হৃদয়টা ব্যাথায় টনটন করে ওঠে, অভিমানি কা'ন্নায় ভিজে ওঠে চোখের পাতা। ক্রীতিকের উপর একরাশ অভিমান করে, অরু নিজেকেই নিজে কঠিন শর্ত এঁটে দিয়ে বলে,

---- আর কখনো আপনার জন্য অপেক্ষা করবোনা আমি, আপনি একটা নিষ্ঠুর মানব, হৃদয়ে মায়া দয়া বলে কিছুই নেই আপনার। নয়তো কিভাবে পারছেন আমাকে না দেখে থাকতে? আপনার কি একটুও খারাপ লাগে না? আমাকে একটুও দেখতে ইচ্ছা করেনা? যদি দেখতে না-ই ইচ্ছে করে তাহলে আপনি কেন আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক করেন সারাক্ষণ? আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি, সাভাবিক হতে পারছি না, আপা- মাকে বুঝাতেও পারছি না, অথচ ভেতরটা আপনার দহনে পু'রে যাচ্ছে সারাক্ষণ । কেন এই দহন? উত্তরটা অন্তত দিয়ে যান।

অরুর অযাচিত অভিমানী মনের উত্তর দিয়ে যায়না কেউই, তাই পরক্ষণেই আবার রেগেমেগে অরু নিজেই বলে,

---যেহেতু আপনি আমার কথা ভাবেননা, তাই এবার থেকে আমিও আর আপনার কথা ভাববো না, একটুও ভাববো না।

ঠিকই তো সে যদি অরুকে না দেখে ভালো থাকতে পারে,এতোগুলা দিন চলে গেলো তাও যদি অরুকে একটাবার মনে না পরে, তবে অরুও থাকতে পারবে। কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু হায় প্রেমে পড়লে কি আর এতো শর্ত মনে থাকে? অষ্টাদশী যে ভীষণ ভাবে প্রেমে পড়েছে ওই উগ্র, বেপরোয়া লোকটার। তাইতো ফেটে পরা অভিমানের কয়েকমূহু পরেই নিজেকে নিজে দেওয়া শর্তফর্ত জলাঞ্জলি দিয়ে পুনরায় ছুটে যায় টানা বারান্দায়, অতঃপর সেই চেনা মুখ, চেনা কামুক চোখ, চেনা বাইক কিছুই দেখতে না পেয়ে তীব্র কা'ন্নার জোয়ারে সেখানেই বসে পরে অরু। প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়, অরুর অপেক্ষা শেষ হয়না, তাকে একটাবার দেখার জন্য আনচান করতে থাকা হৃদয়টা অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ঝিমিয়ে পরে তবুও আশা হারায়না অরু। ওর মনে হচ্ছে ক্রীতিক সেদিনের ঘটনায় একটু রেগে আছে, তাই হয়তো আসছে না, রাগ পরে গেলে ঠিক চলে আসবে। কিন্তু আর কত? ক্রীতিকের বি'ষের মতো জ্বালাময় প্রেম যে অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথমবার কারও সত্যিকারে প্রেমে পরে শেষ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, সবার অজান্তে একটু একটু করে নিজেই খু'ন করছে নিজেকে, শুধু মাত্র জায়ান ক্রীতিকের জন্য।

*****************************************

সময় চলমান, দিনের আলো আর রাতের মাঝেই তার প্রবাহ বিদ্যমান । এই আসে তো এই যায়, দেখতে দেখতে চোখের পলকেই কেমন দশদিন পার হয়ে গেলো, তবুও দেখা মেলেনি ক্রীতিকের। এখন আর অভিমান হয়না অরুর বরং কষ্ট হয়, ভীষন কষ্ট।যেই কষ্টে ওর হৃদয়টা ক্রমাগত দুমরে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। অনু আর আজমেরী শেখ ভেবেই নিয়েছে যেহেতু দেখা সাক্ষাৎ, যোগাযোগ কিছুই নেই সেহেতু ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসবে অরু, একবার শুধু মনটা ঘুরে গেলেই কেল্লাফতে, তারপর সোজা ডি'ভোর্স। কিন্তু তারা তো আর জানেনা,ক্রীতিকের এই অনুপস্তিতি ছিল অরুর হৃদয়ে এক নিদারুণ প্রেমের জোয়ার। অষ্টাদশীর মনে দা'গ কেটে গিয়েছে এই দূরত্ব। জায়ান ক্রীতিক আর নিখিল দু'জনকে ভালোবাসার পার্থক্যটা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে সে। নিখিলের মাসের পর মাস অনুপস্থিতি কিংবা দূরত্ব কোনো কিছুই এভাবে পো'ড়ায় নি অরুকে। অথচ ক্রীতিকের এই দশদিনের দূরত্ব অরুকে বুঝিয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা কি?

ক্রীতিকের হাস্কি কন্ঠস্বর, ক্রীতিকের রাগ,ক্রীতিকের হাসি, ক্রীতিকের ছোঁয়া, ক্রীতিকের শরীরের মাতাল করা সুবাস কিইনা মিস করে অরু? এখন আর ভাবতে ইচ্ছে হয়না ক্রীতিক কেন আসেনা, এখন তো অরুর নিজেরই সবকিছু ভে'ঙেচুরে ক্রীতিকের বুকে গিয়ে ঝাপিয়ে পরতে মন চায় অনায়েসে । হৃদয়টা যে এই দহন আর সহ্য করতে পারছে না। ক্রীতিকের ও কি ঠিক এই রকমই য'ন্ত্রনা হতো অরুর অনুপস্থিতিতে? ভাবছে অরু। মনেমনে বলছে,

----- আপনি তো এই দহন, এই য'ন্ত্রণা বোঝেন, তাহলে জেনেশুনে কেন আমাকে এই দহনে পো'ড়াচ্ছেন? কি দোষ করেছি আমি? আমার কষ্টে নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হচ্ছে আপনার? হাসি পাচ্ছে খুব নিশ্চয়ই?

হাহ, অষ্টাদশীর অবুঝ অভিমান.....

অলস দুপুরে খাওয়া নাওয়া ছেড়ে অরু যখন শুয়ে শুয়ে ক্রীতিকের কথায়ই ভাবছিল তখনই রুমে প্রবেশ করে অনু। আজকাল অনু আর অরুর মাঝে খুব একটা ভাব নেই, যতটুকু প্রয়োজন পরে কেবল ততটুকুই কথা বলে ওরা। এর বাইরে চোখাচোখি হলেও কোনো এক অজানা অপরাধ বোধ ঘীরে ধরে দুজনকে।

অনু রুমে এসে দেখতে পায় অরু বিছানায় উপুর হয়ে ম'রার মতো পরে আছে, লম্বা সিল্কি বাঁধন হারা চুলো গুলো পুরো খাটে ছড়িয়ে, শরীরটা শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে মেয়েটার। কিসের এতো কষ্ট এই একরত্তি মেয়ের বুঝে পায়না অনু। হয়তো বুঝতে চায়ও না, তাই ও আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেকে উঠলো অরুকে,

--- অরু খেতে আয়।

অনুর ডাকে শুয়ে শুয়েই জবাব দিল অরু,

--- রেখে দে, পরে খাবো।

অনু বলে,

--- রেখে দিলে ঠান্ডা হয়ে যাবে, এখনই খেয়ে যা, তাছাড়া মা বাসায় নেই, কেউ কিছু বলবে না তোকে।

মা বাসায় নেই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো অরু। অতঃপর অনুর কাছে এগিয়ে এসে জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে একটু সাহস করে বললো,

--- আপা আমার ফোনটা একটু দিবি? খুব বেশি না মাত্র পাঁচ মিনিট, তারপর আবার নিয়ে নিস, দে না আপা।

অনু গম্ভীর গলায় বললো,

--- তোর ফোন মা লকারে ঢুকিয়ে তালা মে'রে রেখেছে, আমি কিভাবে দেবো?

অরু একটু ভেবে বললো,

--- তাহলে তোর টা দে।

অনু স্ব ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধালো,

--- কি করবি ফোন দিয়ে তুই?

অরু স্পষ্ট গলায় জবাব দিল,

--- জায়ান ক্রীতিক কে কল করবো।

অরুর কথায় ঝাঁজিয়ে উঠলো অনু, ও তৎক্ষনাৎ অরুর দিকে ক্ষী'প্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তেঁতো গলায় বললো,

---- জায়ান ক্রীতিক, জায়ান ক্রীতিক বলা বন্ধ কর অরু, কানে লাগছে আমার। উনি আমাদের ভাই হয়।

অরু শক্ত গলায় বললো,

--- উনি আমার স্বামী, ওনাকে আমি শুধু ক্রীতিক ও বলতে পারি, স্বামীকে ভাইয়া কেন বলতে যাবো?

--- এরকম একটা সম্পর্কের কথা মুখে আনতে লজ্জা করেনা তোর? যেখানে মানুষটার বাবা আমাদের মায়ের প্রয়াত স্বামী।

অনুর ধা'রালো কথায় অরু ঘাবড়ালো না, বরঞ্চ সোজাসাপটা ভাবে বললো,

--- আমাদের বিয়ের সম্পূর্ণ বৈধতা আছে আপা, সমাজ যা বলে বলুক আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি, আমি আর পেছাতে পারবো না, তাহলে ম'রে যাবো।

অনু দাঁত কটমটিয়ে বললো,

--- তাই বলে জায়ান ক্রীতিককে? মানুষটা একটা উগ্র মেজাজী লোক, ছেলে বুড়ো কাউকে এইটুকুনি রেসপেক্ট দেয়না, আমাদের মাকে তো দেয়ই না। তাকেই ভালোবাসতে হলো তোকে? আমি যতটুকু দেখেছি তোর সাথে তো ভালো ভাবে কথাও বলেনা সে, তাহলে ভালোবাসাটা এলো কোথা থেকে?

অনুর কথায় অরু মনেমনে হাসে, অতঃপর মনেমনেই বলে,

--- জায়ান ক্রীতিক রহস্যময় মানব আপা, উনি সামনে যা দেখায় ভেতরে পুরোপুরি তার বিপরীত। একদিন সেটা তোরাও বুঝবি।

অরু চুপ হয়ে আছে দেখে, অনু বিরক্তি জড়ানো গলায় বললো,

--- শোন অরু ভালোবাসিস আর যাই করিস, তবে তোর এসব অ'স্বাস্থ্যকর ভালোবাসা আর পা'গলামিতে মায়ের শরীরের যদি এইটুকুনি ত্রুটি হয়েছে, কিংবা মা আবার অসুস্থ হয়েছে তাহলে তোর খবর আছে।

অরু সঙ্গে সঙ্গে বললো,

--- তাহলে সম্পর্কটা মেনে নিলেই তো পারিস।

অরুর কথায় অনু তেতে উঠে বললো,

--- জায়ান ক্রীতিককে বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে বে'য়াদবের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছিস দেখছি। আর কি মেনে নেব? মেনে নেওয়ার মতো সম্পর্কে জড়িয়েছিস তুই?

---- তাহলে সেধে সেধে দরদ দেখাতে আসিস না, আমাকে একা ছেড়ে দে।

অনু দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,

--- আমাকে আর মাকে না জানিয়ে বিয়ে করতে তোর একটুও বাঁধলো না অরু? আরও কি কি করেছিস কে জানে? নয়তো দামি ফোন, এতো বড় এ্যামাউন্টের চেক, এতোসব কোত্থেকে আসছে?

অনুর শেষ কথায় র'ক্ত চড়ে গেলো অরুর মস্তিষ্কে, সেদিন মা-ও একই কথা বলেছে, আর আজ আপাও আকারে ইঙ্গিতে বোঝালো, কি ভাবে ওকে এরা? আজ আর চুপ থাকলো না অরু, তেঁতো গলায় বললো,

--- যদি করেও থাকি স্বামীর সাথে করেছি,পাপ তো আর করিনি। তাহলে কেন শুধু শুধু কথার আ'ঘাত করছিস আপা?

অরু মিথ্যে কিছু বলেনি, কথাটা ভেবেই দমে গেলো অনু। নিজেকে বারবার বসালো অরুর যায়গাতে, আজ প্রত্যয় যদি বৈধ ভাবে কিছুর দাবি করতো, তাহলে কি অনু ফিরিয়ে দিতো? কখনোই না। অরুর বেলায় কেন সবাই বিমাতাসূলভ আচরণ করছে তাহলে?ওর দো'ষটা কোথায়? ভালোইতো বেসেছে অপ'রাধ তো আর করেনি, তাহলে ওকে বারবার অপরা'ধীর মতো কেন জাজ করা হচ্ছে?

অনু চুপচাপ মলিন মুখে কিছু ভাবছে দেখে, অরু কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুতে শুতে বললো,

--- তোর কিছু বলার না থাকলে যেতে পারিস, আমি ঘুমাবো।

অনু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিরব পদধ্বনিতে বেরিয়ে যেতে যেতে ছোট্ট করে বললো,

--- খেয়ে নিস।

*****************************************

আজ বহুদিন বাদে আবারও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছে অরু। লম্বা চুলে চিরুনি টেনে টেনে চুলগুলো পরিপাটি করে নিচ্ছে সযত্নে। গায়ে পরেছে ডার্ক কফি কালারের ফতুয়া আর লংস্কাট। নিজেকে এতোটা গোছানোর পরেও চোখেমুখে কি বি'ষন্নতা মেয়েটার। ফর্সা উজ্জল চেহারাটা গত পনেরোটা দিনে কয়েক শেড ফর্সা হয়ে গিয়েছে, ফ্যাকাসে মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে র'ক্তশূণ্যতায় ভুগছে বহুদিন। নিজের মলিন চেহারাটার দিকে খানিকক্ষণ একই ভাবে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো অরু, তারপর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার হাতরে একটা লিপ বাম বের করে আলতো করে লাগিয়ে নিলো দু ঠোঁটে। এখন একটু ভালো লাগছে দেখতে। নিজেকে আরও একবার আয়নায় দেখে নিয়ে পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো অরু।

আজ পনেরোটা দিন হলো ক্রীতিকের দেখা নেই, কোনো খোঁজ নেই।এখনতো অরুর অভিমানের চেয়ে চিন্তা বেশি হচ্ছে, কোথায় গেলো লোকটা? কেনইবা অরুর থেকে নিজেকে এতোটা আড়াল করে রেখেছে? তাহলে কি সে আর অরুকে চায়না? কিন্তু ক্রীতিক যে বলেছিল,

--- তুই শুধু বিয়েটা কর,বাকিটা জীবন আমি সামলে নেবো।

এই তার সামলানো? এসব কথা ভেবেই গত রাতে অরু ঠিক করেছে ও ভার্সিটিতে যাবে। তাতে মা যা বলার বলুক, আর যা করার করে নিক। এভাবে চার দেওয়ালের মাঝে বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলে নির্ঘাত দম আটকে ম'রে যাবে ও। তার চেয়ে একটা রি'স্ক নিয়ে ক্রীতিকের সামনা সামনি হওয়াটা বেশি জরুরি। এভাবে ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে কষ্ট দেওয়ার মানে কি? জানতে চায় অরু। সেই উদ্দেশ্যেই সকাল সকাল আজ বেরিয়েছে ও। মা অফিসে, আপা বোধ হয় নিজের রুমে সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পা টিপেটিপে এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে অরু।

.

ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পা রাখতেই, সবার আগে আজও দেখা হয়ে গেল সায়নীর সাথে। অরু সায়নীকে দেখে ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে আসতেই, সায়নী অরুকে দেখা মাত্রই মুখ ঘুরিয়ে সোজা হাটা দিলো বিপরীত দিকে। সায়নীর এমন বিরূপ আচরণে ঘাবড়ালো না অরু, কারন সেদিন অরুও সায়নীর সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেনি, তারউপর সায়নী জেনে গিয়েছে ওর পছন্দের জেকে স্যার আর কেউ নয় সয়ং অরুর হাসবেন্ড। এতোকিছু একসাথে জানার পর একটু আধটু রাগ হওয়ারই কথা, তাই সায়নীর পেছন পেছন এগিয়ে আসতে আসতে অরু বললো,

--- সায়নী দাঁড়াও, একটাবার আমার কথা শোনো প্লিইইজ। খুব বিপ'দে পরেছি আমি।

অরুর শেষ কথায় পা থেমে গেলো সায়নীর, ও চোখ মুখ শক্ত করে বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাড়াতেই আশ্চর্য হয়ে গেলো। আপনাআপনি হাত চলে গেলো মুখের উপর, মনেমনে বললো,

---এ কি হাল হয়েছে গুলুমুলু মেয়েটার? এতোটা শুকিয়ে গিয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে বাতাসের ধা'ক্কায় উড়ে যাবে এক্ষুনি ।

সায়নী দাড়িয়ে পরতেই অরু ছুটে এসে বললো,

--- রাগ করে আছো এখনো?

সায়নী বেশ ম্যাচিউরড, অরুর থেকে বয়সেও কয়েক বছরের সিনিয়রই হবে, স্কলারশীপ নিয়ে এসেছে কিইনা। তাই রাগ হলেও প্রকাশ করার প্রশ্নই ওঠে না, অগত্যাই সায়নী বললো,

--- রাগ করিনি, কিন্তু এ কি হাল হয়েছে তোমার, এতোটা শুকিয়ে গেলে কি করে?

অরু সায়নীর কথাটা পুরোপুরি এরিয়ে গিয়ে বললো,

--- বলবো, সব বলবো, তার আগে তুমি প্লিজ আমাকে বলো তোমার জেকে স্যার কোথায়?

অরুর কথায় সায়নী তাচ্ছিল্যের হাসি

হেঁসে বললো,

--- নাইস জোক অরু, তোমার হাসবেন্ড অথচ খোজ জিজ্ঞেস করছো আমার কাছে? ইজন্ট ইট ফানি?

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে অনুনয় করে বললো,

--- আমি মজা করার অবস্থায় নেই সায়নী, প্লিজ বলো, আচ্ছা থাক তোমার বলতে হবেনা, আরেকটু পরেই তো ওনার ক্লাস আমই বরং খুজে নেবো।

অরুকে হয়রান আর ব্যতিগ্রস্থ দেখাচ্ছে, চোখে মুখে দারুণ কষ্টের ছাপ, ওর এমন অবস্থা দেখে মন টললো সায়নীর, ও আস্তে করে বললো,

--- কি হয়েছে বলোতো তোমাদের? জেকে স্যার তো প্রায় পনেরো দিন ধরে ভার্সিটিতে আসেন না, আর তুমিতো তারও আগে থেকে।

সায়নীর কথায় অরুর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো, ও মনেমনে বললো,

--- কি বলছে সায়নী এটা? ক্রীতিক পনেরো দিন ধরে ভার্সিটিতে আসেন না? কিন্তু উনিতো কাজে ফাঁকি দেওয়ার লোক নন, আমিতো অন্তত দেখিনি। তাহলে হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলেন উনি?

অরু ভাবছে দেখে সায়নী বললো,

--- তোমার সাথে কথা হয় নি স্যারের? এখন আবার বলোনা যে নিজের হাসবেন্ডের কোনো খোঁজই জানোনা তুমি।

অরু একটা শুষ্ক ঢোক গিলে অপ'রাধীর সুরে বললো,

--- ঠিকই বলেছো তুমি সায়নী, আমি ওনার কোনো খোঁজই জানিনা।

পরক্ষণেই কিছু একটা মাথায় আসতেই চট করে অরু বলে ওঠে,

---তোমার ফোনটা একটু দাওনা সায়নী।

সায়নী হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ফোন বাড়িয়ে দেয় অরুর হাতে, ফোন পেয়ে অরু কাঁপা হাতে মুখস্ত নাম্বারটা ফোনে তুলে ডায়াল করলো তাতে। কিন্তু এবারও অরুকে নিরাশ করে দিয়ে কলটা কেটে গেলো। কেটে গেলো বললে ভুল হবে, ফোনটা পুরো পুরি বন্ধ। নিভু নিভু শেষ আশা টুকুও হাত ছাড়া হয়ে যাওয়াতে অরুর বুক কাঁপছে, কা'ন্নারা দলা পাকিয়ে আটঁকে আছে গলায়। বাকশক্তি ক্ষীণ, জিহ্বাটা অযথাই তেঁতো হয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পরেছে, অরু একবার দুবার করে উদভ্রান্তের মতো অসংখ্য বার ডায়াল করলো ক্রীতিকের নাম্বারে, কিন্তু প্রতেয়কবার সেই একই বিরক্তিকর কথা,

--- দা নাম্বার ইজ ক্লোজড।

অরুকে এমন দিশেহারা হতে দেখে সায়নী শুধালো,

--- আর ইউ ওকে?

অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,

---ঠিক নেই, কিচ্ছু ঠিক নেই, আমি আমার মন, মস্তিষ্ক, হৃদয় কিচ্ছু ঠিক নেই ।

****************************************

ভার্সিটি ক্লাস সব কিছু সিকোয় তুলে শেষমেশ অরু গিয়েছিল ক্রীতিকের বাড়িতে, কিন্তু না বাড়িটাও ফাঁকা পরে আছে, কোথাও নেই ক্রীতিক। অগত্যাই একবুক ব্যাথা আর অভিমান নিয়ে ঘরে ফিরেছে অরু। ক্রীতিকের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে পুরোদস্তুর।

প্রায় দু'ঘন্টার রাস্তা জার্নি করে এসে বড্ড ক্লান্ত লাগছে অরুর, তারউপর সারাদিন না খেয়ে আছে। কিন্তু এখন খাওয়া যাবেনা, চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে হবে, নয়তো মা দেখলে হাজারটা প্রশ্ন তুলবে, কড়া কথা শোনাবে।সেই ভেবে সদর দরজা খুলে চুপচাপ মাথা নুয়িয়ে নিজের রুমে পা বাড়ালো অরু।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলোনা, রুমে প্রবেশের আগেই বাধ সাধলেন আজমেরী শেখ, গলা উঁচিয়ে বললেন,

--- ন'ষ্টামো করতে গিয়েছিলে বুঝি?

অরু হকচকিয়ে উঠে পেছনে তাকিয়ে বললো,

--- কি বলছো মা?

আজমেরী শেখ দুহাত বুকের উপর ভাজ করে সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন,

--- আমার কাছে খবর আছে তুমি জায়ান ক্রীতিকের বাড়িতে গিয়েছিলে।

মায়ের কথায় অরু চো'রের মতো মাথাটা নিচু করে ফেললো, অতঃপর বললো,

---- আসলে মা, তুমি যা ভাবছো তা নয়।

--- একদম চুপ করো। তোমার নোংরা মুখে মা ডাকবে না আমাকে।

অরু কান্না জড়িত কন্ঠে চেচিয়ে উঠে বললো,

--- বারবার নোংরা নোংরা কেন বলছো? কি নোংরামো করেছি আমি?

আজমেরী শেখ কাঠকাঠ গলায় বললেন,

--- সেটা মুখে বলতে হবে?

ওদিকে মা মেয়ের তর্ক শুনে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো অনু। অরুকে এভাবে মায়ের সাথে ঝাঁজিয়ে কথা বলতে দেখে চটে গেলো সে, অগত্যাই অরুর দিকে এগিয়ে এসে বললো,

--- আবার শুরু করেছিস অশান্তি? তুই চাইছিস টা কি অরু? আমাদের মা ম'রে যাক?

অনুর কথায় অরু আহত সুরে বললো,

--- কি বলছিস আপা?

--- তাহলে সকালে উঠে কোথায় গিয়েছিলি, আর সন্ধ্যা বেলাতেই বা কেন ফিরলি?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,

--- তোরা আমার সাথে কেন এমন করছিস? কেন এতো মানসিক য'ন্ত্রনা দিচ্ছিস? আমি ঠিক নেই আপা ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছি, প্লিজ আমাকে একটু সস্থি দে।আমাকে একটু বাঁচতে দে।

অনু চোয়াল শক্ত করে বললো,

--- তুই আগে আমাদের বাঁচতে দে, মাকে সুস্থ থাকতে দে।

অরু বললো,

--- কি করতে বলছিস আমাকে?

অনু স্পষ্ট আওয়াজে বললো,

--- ক্রীতিক ভাইয়াকে নিজের স্বামী দাবি করা বন্ধ কর। ভুলে যা তাকে।

অরু কিছুক্ষন নিরব চোখে মা আর আপার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর কাঠকাঠ আওয়াজে বললো,

--- পারবোনা।

সঙ্গে সঙ্গে ওর নরম তুলতুলে গালে এসে হা'মলে পরলো আরও একখানা চ'ড়ের আ'ঘাত। অরু এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল, এটা খাওয়া হয়ে গেলে রুমে চলে যাবে সে। তাইই করলো, গালে হাত দিয়ে টলমলে চোখের পানিটুকু আড়ালে মুছে রুমে গিয়ে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো।

অরু চলে গেলে অনুও নিজের রুমে গিয়ে দরজায় কপাট আটে,ওর মনটা যে খুব ভালো তাতো নয়, বরং অতিরিক্ত খারাপ, গত পনেরোটা দিন ধরে প্রত্যয়ের সাথে কথা নেই। অনু না হয় রাগ করেছে, তাই বলে প্রত্যয় কি একটাবার কল দিয়ে ওর খোজ নেবেনা? এ কেমন ভালোবাসা তার?

প্রত্যয়ের উপর গভীর রাগটা যখন গভীরতর হয়েছিল, তখনই ঘটে গিয়েছে এই ঘটনা, অনু নিজের একরাশ রাগ আর বিরক্তি অজান্তেই ঝেড়ে ফেলেছে ছোট্ট বোনটার উপর। এটা অবশ্য নতুন নয়, অনু বরাবরই রগচটা স্বভাবের, হুটহাট রাগ উঠে যায় ওর, আর তার বহিঃপ্রকাশটাও হয় ভুল ভাবে। সেই ভুল বহিঃপ্রকাশের বেশির ভাগ স্বীকারই হয় অরু।

কিন্তু আজ একটু বেশি বেশি হয়ে গিয়েছে। অনু নিজেই সেটা এখন বুঝতে পারছে, অনুশোচনা, অপরাধ বোধে গলা ধরে আসছে ওর। ও পরেছে মহা দোটানায় একদিকে বোনের অসহায়ত্ব আর অন্যদিকে মায়ের স্বাস্থ্য। কোন দিকে যাবে অনু?

তাও মা কিংবা জায়ান ক্রীতিক কেউ যদি একটু নরম মনের হতো, দুইজনই হচ্ছে টিট ফর ট্যাট। কেউ কাউকে এক বিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়, ওদিকে এসবের মাঝে পিষে যাচ্ছে, ছোট্ট অরুটা। অরুর জন্য এবার সত্যি সত্যি ভেতরটা পু'ড়তে লাগলো অনুর। অনু যখন অরুকে নিয়ে একরাশ অনুশোচনায় ডুবে আছে, ঠিক তখনই অযত্নে পরে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে তারস্বরে।

অনু স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখতে পায় প্রত্যয়ের নাম্বার। এতোগুলা দিন বাদে আজ হঠাৎ প্রত্যয়ের কল পেয়ে ভেতরে ভেতরে খুশির হিড়িক পরে গেলো অনুর, ও তৎক্ষনাৎ ফোনটা রিসিভ করে, কানে ধরে চুপ হয়ে রইল। এপাশ থেকে সারাশব্দ না পেয়ে ওপাশ থেকে প্রত্যয় ডাকলো,

--- হ্যালো, অনু শুনতে পাচ্ছো?

--- হুম বলুন।

অনুর নরমসরম আওয়াজ পেয়ে প্রত্যয়ের ও বোধ হয় ভালো লাগলো, ও খানিকটা আদুরে গলায় বললো,

--- কেমন আছো সোনা?

অনু অভিমানী সুরে বললো,

--- কে খোঁজ নেয়?

প্রত্যয় নিজের অপরাধ টুকু স্বীকার করে বললো,

--- খুব বেশি ঝামেলায় ছিলাম, সব বলবো তোমায়, তার আগে ফোনটা অরুকে দাও।

অনু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

--- অরুর সাথে কি কাজ আপনার?

প্রত্যয় শাসন করার সুরে বললো,

--- দিতে বলেছি দাও। ওর সাথে জরুরি কথা আছে।

অনু নাক ফুলিয়ে বললো,

--- আপনি এতোদিন পরে বকা দেওয়ার জন্য কল দিয়েছেন তাইনা?

প্রত্যয় বুঝলো অনুর অভিমানের ঘট পূর্ণ। প্রেমিক হিসেবে প্রত্যয়ের ও তো একটা দায়িত্ব আছে প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর, কিন্তু এখন তো হাতে সময় নেই। তাই ও খুব বেশি আদর দেখিয়ে বললো,

--- আমার জান, আমার প্রান, আমার অনু, প্লিজ কথা শোনো,ফোনটা অরুকে দাও, তারপর আমি তোমার সাথেই সারারাত কথা বলবো প্রমিস, আজ আর ঘুমাতে দেবোনা তোমায়।

প্রত্যয়ের এমন আহ্লাদী কথায় গদোগদো হয়ে উঠলো অনু, এতোক্ষণের রাগ ঢাগ সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো মূহুর্তেই, ও লাজুক সুরে বললো,

--- ঠিক আছে এটাই কিন্তু শেষ বার, তারপর আর এরকম রিকোয়েস্ট করবেন না, মা জানলে খুব চটে যাবে আমার উপর।

প্রত্যয় সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

--- আচ্ছা করবো না এবার দাও।

--- একটু ধরুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।

........................................................................

𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃

Episodes
1 List of stories...
2
3 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43 এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44 এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45 এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46 এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47 এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48 এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49 এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50 এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51 এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52 এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53 এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54 এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55 এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56 এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57 এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58 এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59 এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60 এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62 ইট পাটকেল [Part.1]
Episodes

Updated 62 Episodes

1
List of stories...
2
3
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43
এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44
এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45
এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46
এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47
এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48
এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49
এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50
এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51
এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52
এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53
এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54
এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55
এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56
এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57
এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58
এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59
এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60
এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62
ইট পাটকেল [Part.1]

Download

Like this story? Download the app to keep your reading history.
Download

Bonus

New users downloading the APP can read 10 episodes for free

Receive
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download MangaToon APP on App Store and Google Play