#পর্বঃ৪১
সন্ধ্যা রাতের মিটিমিটি শুক তারা ঢাকা পরেছে মেঘের আড়ালে। চাঁদের ও একই অবস্থা, পেঁজা তুলোর মতোন নরম শুভ্র মেঘের আড়ালে বারবার লুকিয়ে পরছে সে। মেঘের এই লুকোচুরি খেলায় পুরো রাস্তা জুড়ে কোমল আলো ছাঁয়া বিরাজ করছে।
একনজরে দেখলে মনে হবে কেউ অবিন্যস্ত হাতে শিউলি ফুল ছড়িয়ে রেখেছে পুরো রাস্তার আনাচে-কানাচে। গলির মোড় থেকে সেই শিউলি ফুলের রাস্তা দ্রুত পায়ে মাড়িয়ে মাত্রই ক্রীতিক কুঞ্জে প্রবেশ করলো নীলিমা।
ওর পরনে কালো পাড়ের খয়েরী তাঁতের শাড়ি। শাড়ি পড়ার খুব একটা অভ্যেস নেই নীলিমার। ওই জন্যই বারবার মনে হচ্ছে খুলে খুলে যাচ্ছে। একদিক থেকে চুল সামলাচ্ছে তো একদিকে শাড়ি।আলগোছে কুঁচি সামলাতে সামলাতেই মহলে প্রবেশ করে নীলিমা।
ঠিক সেই মূহুর্তেই আচমকা ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ঝিল ধরে উঠলো ওর দু'চোখ। হঠাৎ আলোক রশ্মির তীক্ষ্ণতা সামলাতে না পেরে নীলিমা চোখ মুখ কুঁচকে দাড়িয়ে পরলো তৎক্ষনাৎ।
ওদিকে নীলিমা দাঁড়িয়ে পরতেই চোখের সামনে এসে কেউ একজন আপসোসের সুরে বললো,
---- গেলো, গেলো, রাগিণীর রাগে ক্যামেরাটা ঝ'লসে গেলো।
এতোক্ষণে নীলিমা বেশ সামলেছে নিজেকে, সামলাতে গিয়ে সামনের ব্যক্তির কথা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই তরাগ করে চোখ খুলে নিলো ও, চোখ খোলা মাত্রই সেদিনের সেই বাঁ'দরটাকে আবারও দেখতে পেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ও বললো,
----- আজকেও আপনি? সত্যি করে বলুন তো এই বাড়িতে ঘুরঘুর করেন কেন? ধা'ন্দাটা কি?
সায়র নীলিমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
----- এইংগেজমেন্ট খাওয়া দাওয়া সব শেষ, এখন কি সবার ফেলে রাখা ঝুটাঝাটা খেতে এসেছো নাকি?
লোকটার কথায় মেজাজ চড়াও হয়ে গেলো নীলিমার, ও কটমটিয়ে বললো,
---- দরকার পরলে তাই খাবো, তবুও আপনার মতো অমন চিকন আলী হবোনা। ফটোগ্রাফার ওয়ালা, ফটোগ্রাফার ওয়ালার মতোন থাকুন, যান গিয়ে ওদিকে ডেকোরেশনের ছবি তুলুন।
নীলিমা কথার পাছে, সায়র ভাব নিয়ে নিজের উপর থেকে নিচ অবধি আঙুলের ইশারা করে গম্ভীর গলায় বললো,
----- ইটস কলড মডেলিং ফিগার। এটা মেইনটেইন করতে আমাকে কতো ডায়েট করতে হয় তা তুমি জানো?
নীলিমা মুখ ঝা'মটি দিয়ে সায়র কে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো,
---- জানতেও চাইছি না, রাস্তা ছাড়ুন তো।
সায়র তৎক্ষনাৎ বাঁধ সেধে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে ,
----- আরে আরে ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?
--- সেটাও আপনাকে বলতে হবে?
---- ওদিকে যেও না, অরু তার হাসবেন্ডের রা'গ কমাচ্ছে,তুমি গেলে ডিস্টার্ব হবে।
সায়রের কথায় সিঁড়ির মাঝে আটকে গেলো নীলিমার পা দু'টো । ও সেখান থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্তির নজরে সায়রের দিকে চেয়ে মনেমনে বলে,
---- লোকটা শুধু বাঁ'দর নয়, পা'গল ও বটে,নইলে নিখিল ভাইয়ের শোকে যে অরু সেই কবে থেকে ডিপ্রেশনে ডুবে আছে, বলে কিনা সে নাকি স্বামীর রা'গ ভাঙাচ্ছে? যেখানে নিখিল ভাইই নেই, সেখানে স্বামীটা কি আকাশ চিড়ে বের হবে?আশ্চর্য।
নীলিমা সেই তখন থেকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে, তা টের পেয়ে সায়র চিবুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে মিটিমিটি হেসে বলে,
---- ক্রাশ খেলে নাকি?
তারপর নিজেই নিজেকে বাহবা দেওয়ার মতো করে বললো,
----অবশ্য সবাই খায় তুমি নতুন কিছু নও, যাও তোমার ক্রাশ রিকোয়েস্ট এক্সেপ্টেড।
নীলিমা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে, আবারও সিঁড়ি ভেঙে উপরে যেতে পেছন ঘুরে বললো,
---- আপনি একটা পা'গলু, সেই সাথে হা'দারাম ও।
সায়র পেছন দিক থেকে সামান্য মাথা চুলকে বিড়বিড়িয়ে বললো,
---- নো ম্যাটার, সবাই বলে।
দোতলায় গিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়েই অরুর নাম ধরে ডাকতে শুরু করলো নীলিমা,
--- অরুউউ, এ্যাই অরুউ?
নীলিমার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই ক্রীতিককে জো'র জব'রদস্তি করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে কোনো মতে গায়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করে তরিঘরি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অরু।
অরুকে দেখা মাত্রই নীলিমা ওর কাছে এগিয়ে এসে অবাক হয়ে শুধালো,
---- এ্যাই! তোর ঘর না ওইটা?
তাহলে এই ঘরে কি করিস?
অরু শুষ্ক ঢোক গিলে নীলিমার দিকে চোরা চাহনি নিক্ষেপ করলো, খানিকটা ভেবে চিন্তে দোনোমোনো করে বললো,
---- না মানে ধুধলো, ময়লা পরেছিল, আজ আবার অতিথি এলোনা ওই জন্যই তো পরিস্কার করতে এলাম মাত্র ।
---- তাই বল আমি আরও ভাবলাম আজকের দিনেও রুম আটকে কেঁ'দে ভাসাচ্ছিস বুঝি।
নীলিমার কথায় অরু দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে কিছুটা মেকি হাসলো।
ঠিক তখনই নীলিমা মুখ কালো করে পুনরায় বললো,
---- আংটি বদল,সকল রিচুয়াল শেষ হয়ে গেলো, অথচ তোরা কেউ একটু আমার জন্য অপেক্ষা করলি না, আমিকি কেউ না?
অরু নিজেও এবার একটু লজ্জিত হলো, ওই বা কি করতো? ক্রীতিক আর মা দুজন মিলে ওকে নিয়ে যা শুরু করেছে, দুজনার চোখ রাঙানি খেতে খেতেই জীবন অতিষ্ট অরুর।
তবুও নীলিমাকে ধাতস্ত করে অসহায় কন্ঠে অরু বলে,
---- আসলে প্রত্যয় ভাইয়ার কাজিন অমিত ভাই পা ভে'ঙে হসপিটালে ভর্তি। ওই জন্য প্রত্যয় ভাইয়ার বাবা অনুরোধ করেছেন সকল নিয়ম কানুন যাতে তাড়াতাড়ি আর ঘরোয়া আয়োজনে শেষ হয়, যাতে তারা একবার হসপিটালে গিয়ে অমিত ভাইকেও দেখে যেতে পারেন।
নীলিমা একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
--- কোন অমিত ভাই? তোদের বাংলা একাডেমির অমিত ভাই নয়তো?
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---- হ্যা উনিই।
অরুর কথায় আপনা-আপনি হাত চলে গেলো নীলিমার হতবাক মুখের উপর, ও আরোষ্ঠ গলায় বললো,
----- হায় আল্লাহ! অমিত ভাইয়ের সাথেই এটা হওয়ার ছিল?
আজকে অমিতকে নিয়ে বাড়িতে ঝামেলা হয়েছে, ক্রীতিক হিং'স্র হা'য়নার মতোই ক্ষে'পে উঠেছিল অরুর উপর। সময় মতো আপসে না এলে, আজকে না জানি রে'গেমেগে আরও কি কি করে ফেলতো এই উন্মাদ লোকটা।
পুরো ব্যাপারটা আরও একবার স্বরণ করে একটা ভ'য়ার্ত ঢোক গিলে,অমিতের টপিক টা তৎক্ষনাৎ পাল্টে ফেললো অরু। নীলিমার দিকে তাকিয়ে সহসা হেসে বললো,
------ চল নিচে গিয়ে ডিনার করবি, আমিও খাইনি, একসাথে খাবো।
নীলিমা অরুর কথায় গু'রুতর নাকোচ করে বললো,
---- যাবোনা, নিচে একটা বাঁ'দর দাঁড়িয়ে আছে।
অরু ভ্রু কুঁচকে বললো,
---- সারা ঘরে লাইট জ্বলছে, এর মাঝে বাঁদর কোথায় পেলি তুই?
নীলিমা আঙুলের ইশারা করে ডিভানে বসে বসে রসগোল্লা চিবুতে থাকা সায়রকে দেখিয়ে বললো,
----- ওই যে দেখ বসে বসে রসগোল্লা খাচ্ছে, ওটাই বাঁদর। শুধু বাঁদর নয় পাশাপাশি হনুমানও। দুই জাতির মিশ্রন।
নীলিমা সায়রের নাম মুখে নিতে না নিতেই সায়র রসগোল্লা সমেত অকস্মাৎ বিষম খেলো। এলিসা ওর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে ওর পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বললো,
----- একটু আস্তে খাবিতো।
সায়র এক ঢোক পানি পান করে এলিসার দিকে ছলছলে নয়নে তাকিয়ে বললো,
---- হঠাৎ করে কে এতো মনে করছে আমায়, বলতো?
এলিসা স্ন্যাক্স চিবুতে চিবুতে ফোনের দিকে নজর দিয়ে রুষ্ট গলায় বললো,
----- তোর ক্লায়েন্ট রা ছাড়া আর কে?
নীলিমার মুখ থেকে সায়রকে নিয়ে এরূপ সম্মোধন শুনে তৎক্ষনাৎ দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো অরু।
অতঃপর নীলিমা কে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
---- কাকে কি বলছিস ভাই? আমেরিকাতে উনি সেলিব্রিটি। ওনার বড় বড় ছবি, পোস্টার পুরো শহরের বিলবোর্ড জুড়ে থাকে তুই জানিস?
নীলিমা ঠোঁট বাকিয়ে ভেংচি কেটে,অরুর কথায় পুরো দস্তুর অনাগ্রহ প্রকাশ করে বললো,
---- সে যাই হোক, কিন্তু এই সেলিব্রিটি বাঁদর তোদের বাড়িতে কি করে?
---- আরেহ উনি, ওনার না মানে ক্রীতিক ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। ক্রীতিক ভাইয়ার সাথেই বাংলাদেশ বেড়াতে এসেছেন, উনি আসলে ইন্ডিয়ান।
অরুর কথা শুনে নীলিমা চোখ মুখ কুঁচকে জোরালো কন্ঠে বললো,
---- কিহ! তোর সেই পা'ষণ্ড ভাইটা দেশে এসেছে? তুই ঠিকই বলেছিলি অরু, ওই শালা এক নম্বরের ব'জ্জাত, নয়তো তার বন্ধু এমন বাঁদরামো করে কেন? বিদেশে বসে এসব হনুমানদের সাথে মিশে মিশেই তোর ভাইটা গোল্লায় গিয়েছে। উমমমম...
নীলিমা ভাষনের মতো করে গলা উঁচিয়ে ক্রীতিকের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করার আগেই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো অরু।
তারপর ওকে টে'নে হিঁ'চড়ে নিচে নিয়ে যেতে যেতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
----- নীলিমার বাচ্চারে থাম এবার, এমনিতেই সন্ধ্যা থেকে আমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে, এখন আবার তুই তুফান বয়ে আনিস না।
*****************************************
প্রত্যয় আর অনুর বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই বেশ ঘটা করে আয়োজন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তবে পরিবারের থেকেও একধাপ এগিয়ে ক্রীতিকের বন্ধু মহল।এই বিয়ে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যেহেতু অরু ক্রীতিকের বিয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিত আর বিরল ভাবে হয়েছে,সেহেতু অনু প্রত্যয়ের বিয়েতে প্রি ওয়েডিং পার্টি থেকে শুরু করে,মেহেন্দী,রং খেলা, হলুদ সব রকম আনুষ্ঠানিকতা করে তবেই বিয়ের স্বাদ পুরোপুরি আস্বাদন করবে ওরা।
বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আর সামনে এতো এতো আয়োজন। সেই কথা মাথায় রেখেই ওরা সকলে রেডি সেডি হয়ে বেরিয়েছে শপিং করার উদ্দেশ্যে। ওদের একেক জনার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে পুরো শপিংমলটাই আজ ওরা তুলে নিয়ে ফিরবে ক্রীতিক কুঞ্জে।
পরন্ত বিকেল রৌদ্রতাপ কমে এসেছে কিছুটা।চারিদিকে নাতিশীতোষ্ণ গুমোট হাওয়া বইছে। এর মাঝেই বাড়ির পুরাতন সদস্য ব্ল্যাক কেডিলাকের সামনে হাজির হয়েছে এলিসা, অর্ণব,সায়র,ক্যাথলিন,অনু,আর মোখলেস চাচা।
প্রত্যয় ওদের বাড়ি থেকে সরাসরি শপিং মলে আসবে। একটু পর অরুও হাজির হয় ওদের মাঝে।
অরুকে গাড়ির নিকট এগিয়ে আসতে দেখে সায়র চোখ ছোট ছোট বানিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
----- আরেহ, হি'টলারের বউ তুমি এখানে কেন? আমাদের কি যাত্রা পথে মাঝ রাস্তায় উড়িয়ে দেওয়ার শখ হয়েছে তোমার? তুমি চাচ্ছো শপিং মলে না গিয়ে, আমরা সরাসরি উপরে চলে যাই তাইতো?
সায়রের ধ'মক খেয়ে ঠোঁট উল্টে অনুর দিকে অসহায় দৃষ্টিপাত করে অরু বলে,
---- আপা দেখনা,
অনু উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
---- হ্যারে অরু,ক্রীতিক ভাইয়া কি যাবে না আমাদের সাথে?
অরু বিরক্ত হয়ে রুষ্ট আওয়াজে বললো,
---- আশ্চর্য, তোরা সবাই এমন ভাব করছিস যেন আমিই স্বয়ং জায়ান ক্রীতিক। উনি কি করবেন, না করবেন আমি কিভাবে বলবো? তাছাড়া উনিকি আমার সাথে সব কথা শেয়ার করে? তোদের কি মনে হয়?
অনু বলতে চাইলো,
----তাহলে জায়ান ক্রীতিকের মতো এমন অ'স্বাদু পুরুষের জন্য এতো পা'গল হওয়ারই বা কি ছিল?
কিন্তু ও সে-সব বললো না, বরং অরুর কথায় ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। ওদিকে এলিসা সকলকে ডেকে বললো,
----- হয়েছে আর গবেষণা করতে হবেনা ওই যে জেকে আসছে।
এলিসার কথা শুনে ঘুরে গেইটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত করলো সকলে,দেখলো আঙুলের ডগায় বাইকের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রীতিক।
পরনের অফ হোয়াইট ফুল স্লিভ টিশার্ট, আর সাথে ম্যাচিং ওভার সাইজ অফ হোয়াইট প্যান্টে তাকে আজ আদতে কাল্পনিক গ্রীক গডের মতোই সুদর্শন লাগছে। ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলোকে সেট করার জন্য মাথায় লাগিয়ে রেখেছে বাকেট হ্যাট।
পরনের সবকিছু ধবধবে সাদা হলেও মুখটা কালো আর গম্ভীর হয়ে আছে ক্রীতিকের। গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবে জেকে গ্রুপে জয়েন করার ইচ্ছে ছিল আজকেই। সে হিসেবে গভর্নিং বডির অন্য সদস্যদের ও আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল তাদের নতুন বসের জয়েনিং মিটিং এ। কত কত ইম্পর্টেন্ট ক্লায়েন্টদের ইনভাইট করা হয়েছিল।
অথচ এই বদের হাড্ডি বন্ধু গুলোর জন্য অফিশিয়াল সব প্ল্যান ক্যান্সেল। কাজকর্ম ঠিকেয় তুলে এখন এদের সাথে না চাইতেও শপিং এ বেরোতে হচ্ছে ক্রীতিককে।
ক্রীতিক যতক্ষনে গাড়ির কাছে এসেছে, ততক্ষণে সিট ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে ওরা।
অরু আর অনু দু বোন শুকনো মুখে দাড়িয়ে বড়দের ঝগড়া দেখছে।
এলিসা অর্ণব পুরো দস্তুর যু'দ্ধ লাগিয়েছে সিট নিয়ে। দেখলে কে বলবে এরা কাপল? একজন যে আরেক জনের প্রান ভোমড়া? ওদের ঝগড়া ঝাটির মাঝখানে সায়র একটুখানি মাথা চুলকে বললো,
---- মোখলেস চাচাকে না নিলেই তো হয়।
এলিসা তৎক্ষনাৎ ক্ষ্যা'পাটে কন্ঠে বললো,
---- খবরদার!মোখলেস চাচাকে আমার ভালো লেগেছে, ওনাকে আমি শপিং করিয়ে দেবো।
অর্ণব দাঁত খিঁচে বললো,
---- এতোই যদি চাচাকে ভালো লাগে তাহলে আমি কে?হ্যা?
অতঃপর মোখলেস চাচার দিকে তাকিয়ে অর্ণব কটমটিয়ে বলে,
---- এই চাচা আপনি যান তো আপনাকে নেওয়া হবেনা৷ ভাগুন।
মোখলেস চাচা অপ্রস্তুত হেসে বললো,
---- ইয়ে মানে, আমাকে ডিকিতে তুলে দিলেও হবে।কোনো সমস্যা নেই বাবা।
----- তবুও আপনার শপিং এ যেতে হবে তাইতো?
সায়রের কথার পাছে ক্রীতিক এগিয়ে এসে রাশভারি আওয়াজে শুধালো,
----- কি হয়েছে?
সায়র পিছনে ঘুরে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে বিরক্ত হয়ে বললো,
----- যায়গা সংকট, তোর বউ কে নিতে পারছি না, সরি।
সায়রের কথায় ক্রীতিক আড় চোখে অরুর দিকে তাকালো , যে এই মূহুর্তে ভীত হরিণীর মতো ডাগর চোখে ক্রীতিকের দিকেই তাকিয়ে,ক্রমাগত আঙুলে ওড়না পেচাচ্ছে।
কাল অমন কাছাকাছি আসা,আবেশিত আলিঙ্গনের মাঝেও দুজনার একবারও কথা হয়ে ওঠেনি । তখন আবার নীলিমার ডাকে ক্রীতিককে ধা'ক্কা মে'রে চলে গিয়েছিল অরু। সেই মূহুর্ত থেকেই ক্রীতিক দিগুণ ক্ষেপে আছে অরুর উপর।
রিজেকশন ওর একদম পছন্দ নয়। কুক্ষণেও এই মেয়েকে একা পেলে যে কি করবে সেটা ও নিজেও জানেনা।
ক্রীতিক সেই তখন থেকে ক্ষ্যা'পাটে বা'ঘের মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে, বিষয়টা নজরে আসতেই আড়ালে শুষ্ক ঢোক গিললো অরু।
সায়র ক্রীতিকের সামনে হাত নাড়িয়ে বললো,
----- এক্সকিউজ মি, কথা এদিকে হচ্ছে ওদিকে না।
ক্রীতিক গমগমে আওয়াজে বললো,
---- অরুকে রেখে তোরা চলে যা। আর অনু একটু পরে আসুক, আমি প্রত্যয়কে বলে দিচ্ছি ও অনুকে পিক করে নেবে।
ক্রীতিকের কথায় অরু আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো, কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,
----- নাহ!আপা আমি ওনার সাথে যাবোনা, আমার ভ'য় করছে।
সায়র ক্যাথলিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
---- ক্যাথ তাহলে তুমি যাও জেকের সাথে।
সায়রের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ এলিসার পেছনে লুকিয়ে পরলো ক্যাথলিন। সেবার চুল কা'টার ঘটনার পর থেকেই ক্রীতিককে ভু'তের মতো ভ'য় পায় ক্যাথলিন। সেই ভয়'ঙ্কর রূপ দেখার পর, ক্রীতিকের সাথে কথা বলা তো দূরে থাক, ওর চোখের দিকে পর্যন্ত চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়না মেয়েটা।
আর ওকে কিনা বলা হচ্ছে সেই যমরাজের সাথে বাইকে বসতে, অসম্ভব।
ক্রীতিকের চেঁচামেচি, অতিরিক্ত কথা মোটেই পছন্দ নয়। এখন এই মূহুর্তে ওদের সবার বাক বিতন্ডায় মেজাজ চড়ে উঠলো ওর। নিজের বিগড়ানো মেজাজটাকে সংবরণ করতে না পেরে সহসা ধমকে উঠলো ক্রীতিক,
----- কি বলেছি কানে যায়নি? অরু বাইকে বস, রাইট নাও।
এবার আর ওরা অপেক্ষা করেনা, বরং ক্রীতিকের কথা মতো, অরু আর অনুকে রেখেই তৎক্ষনাৎ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় ক্রীতিক কুঞ্জের গেইট দিয়ে ।
অনুও প্রত্যয়ের জন্য অপেক্ষা করবে বলে, অরুকে রেখে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
পাছে শুধু অসহায়ের মতো পরে রইলো একলা অরু। ওর ভীত সন্ত্রস্ত চাহনি দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বা'ঘের খাঁ'চায় হরিণ শাবক আমানত রেখে গিয়েছে। আর সেই জীবন পন অসহায় হরিণী শাবকখানা ও নিজেই।
----- কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ক্রীতিকের ভরাট আওয়াজে কম্পিত হয়ে ওঠে অরুর এইটুকুনি তনু শরীর। ও মাথা উঁচিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
----- আপনাকে ভ'য় করছে।
---- আমিকি কি বা'ঘ না ভা'ল্লুক? নাকি কাছে এলে কি তোকে খেয়ে ফেলবো,কোনটা?
ক্রীতিকের কথায় অরু নিশ্চুপ, নির্বিকার ওর ভঙ্গিমা, ওর এহেন নিরবতা দেখে ক্রীতিক শান্ত স্বরে বললো,
----- আমি কিছু বলেছি অরু।তুই আসবি নাকি আমি আসবো, কোনটা?
অরু তৎক্ষনাৎ বাঁধ সেধে দ্রুত পায়ে ক্রীতিকের নিকট এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
--- না থাক।
অরু কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে ওর নরম তুলতুলে মোলায়েম হাতটা খপ করে নিজের শক্ত হাতে চেপে ধরলো ক্রীতিক। ওর হাতের বাঁধন এতোটাই শক্ত ছিল যে চোখ মুখ খিঁচিয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো অরু,
--- আহ! লাগছে ছাড়ুন।
ক্রীতিক ছাড়েনা, উল্টে অরুকে বাইকের সাথে চেঁপে ধরে নিজের মুখটা অরুর দিকে বাড়িয়ে দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে ক্রীতিক বলে,
---- হাউ ফা'কিং ডেয়ার ইউ অরু?কাল আমাকে ধা'ক্কা মা'রার সাহস কোথায় পেলি তুই? কতবার বলেছি তোকে? আমার রিজেকশন একদম পছন্দ নয়, আদর করতে চাইলে চুপচাপ সেটা করতে দিবি, চুমু খেতে চাইলে চুপচাপ সেটা খেতে দিবি। তখন আমাকে ডির্স্টাব করার দুঃসাহস দেখাবি না। প্রথমবার গাড়িতে বসে যা যা শিখিয়েছিলাম এরমধ্যে ভুলে গিয়েছিস?
অরু অস্রুশিক্ত চোখের পাতায় পলক ফেলে, দু'ফোঁটা নোনাজল ছেড়ে দিয়ে আরোষ্ঠ গলায় বললো,
---- ছাড়ুন না ব্য'থা লাগছে। কষ্ট হচ্ছে তো আমার।
অরুর ভেজা চোখ আর কম্পিত ঠোঁটের শিহরণ দেখে মূহুর্তেই স্বাভাবিক হয়ে উঠলো ক্রীতিকের শক্ত চোয়াল। দুচোখের অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গ দপ করে নিভে গিয়ে ঘনীভূত হলো তীব্র কামনা। অরুর কেঁপে ওঠা নরম তুলতুলে ঠোঁট জোড়া চৌম্বকীয় আকর্ষনে টানছে ওকে।
এই ভীত সন্ত্রস্ত ডাগর চোখ, , এই কম্পিত ঠোঁট,এই অভিমানী পান পাতার মতো স্নিগ্ধ মুখ, এই লতানো ছোট্ট শরীর, এসবের মাঝেই বারবার আটকে যায় ক্রীতিক। ক্রো'ধান্বিত মস্তিষ্কটা শান্ত নীড় হয়ে যায় মূহুর্তেই। তীব্র মা'দকতা মিশিয়ে হৃদয়ে ঢেউ তোলে কামনার প্লাবন।
মাঝে মাঝে ক্রীতিকের মনে হয় এ কোনো সাধারণ অষ্টাদশী নয়,বরং এ মেয়ে মায়াবিনী, জা'দুকরিনী,হৃদয়হরনী,যার ছোঁয়া তো দূরে থাক উষ্ণ চাহনিতেও জলোচ্ছ্বাসের সূত্রপাত হয় বছর ত্রিশেক ম্যাচিউরিটি খ্যাত হৃদ গহীনে।
ক্রীতিক সেই তখন থেকে একই ভাবে তাকিয়ে আছে, নিস্প্রভ ওর চাহনী, একবার পলকও ফেলছে না। সামান্য চোখের চাহনি দিয়েই যেন অরুর সুপ্ত নারী সত্তাকে ক্রমশ জাগ্রত করছে নির্লজ্জ লোকটা। ওর কামুক চোখের চাওনিতে বারে বারে আরোষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে অরু। ব্যাপারটা লজ্জাজনক। অরু ও লজ্জা পেলো ভীষণ। সহসা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে জড়তা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
---- চলুন যাওয়া যাক।
অরুর কথায় ভ্রম কেটে গেলো ক্রীতিকের, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ ওরা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই, চিরাচরিত ফর্মে ফিরে এসে, নিজের হ্যাট,মোবাইল, সিগারেট, ওয়ালেট সবকিছু অরুকে বুঝিয়ে দিয়ে হেলমেট পরে বাইকে বসে পরলো ক্রীতিক।
অরুও নিঃসংকোচে ক্রীতিকের কাঁধে হাত রেখে বসে পরলো বাইকে। অরু বসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক বলে ওঠে,
----ধরে বস।
ক্রীতিকের কথায় অরু এবার নিজের হাতের বাঁধন শক্ত করলো কিছুটা।
পরমূহুর্তেই শাঁই শাঁই আওয়াজ তুলে ক্রীতিক কুঞ্জের বিশাল গেইট ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ইয়ামাহা খচিত ব্র্যান্ডেট বাইকটা।
এই পুরো কাহিনী দোতলার বারান্দা থেকেই সুক্ষ্ম নজরে পরখ করলো অরুর মামাতো ভাই রেজা। পরক্ষনেই ব্যতিগ্রস্থ হাতে আঙুল চালালো মোবাইলে। কাউকে ম্যাসেজ করলো বোধ হয় ।
*****************************************
সন্ধ্যা সারে সাতটা, সোডিয়াম আর চলন্ত গাড়ির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ঢাকা শহর। শপিং কমপ্লেক্সের তিনতলা জুড়ে বিশাল ক্যাফেটেরিয়া, তার একপাশে থাই লাগানো বিস্তার দেওয়াল। সেখান থেকে সামান্য উঁকি দিলে পাখির চোখে পুরো শহরটা দেখা যায়।
রাতের শহরের লাল, নীল, সোনালী চকচকে আলো বাদ দিলে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি যা দেখা যায় তা হলো ট্রাফিক জ্যাম। সেই তখন থেকে পুরো রাস্তাটা জ্যামে আটকে আছে, একনাগাড়ে হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে শয়ে শয়ে গাড়ির বহর।
হর্ণের আওয়াজে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম। কি বিদঘুটে অনুভূতি, যদিওবা এতোদূর থেকে সেই আওয়াজ কানে ভেসে আসছে না, তবুও কোল্ট কফির স্ট্র টাকে আঙুলের সাহায্যে ঘুরাতে ঘুরাতে দূর্বিষহ জ্যামের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে নীলিমা।
নিজের মাঝে অনুভব করতে চাইছে রাস্তার মানুষ গুলোর বি'ষাদময় তিক্ত অনুভূতিকে।
সেই তখন থেকে একইভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে দেখে তিথি এবার ডেকে উঠলো ওকে,
-----এ্যাই নীলিমা, তখন থেকে বাইরে তাকিয়ে আছিস কি দেখছিস বলতো?
তিথির ডাকে চোখ ঘুরালো নীলিমা, পুনরায় কোল্ড কফিতে সিপ নিয়ে বললো,
----- কেমন আছিস বল, তোর তো খবরই নেই,বিয়ে-শাদি করে ফেললি নাকি?
নীলিমার কথায় তিথি মুঁচকি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, নীলিমা আবার শুধায়,
---- তা জিজু কোথায়?
এবার তিথি আঙুলের ইশারায় কাউকে দেখাবে,তার আগেই নীলিমার চোখ গেলো তিথির পেছনে এক আগন্তুকের দিকে।যে এই মূহুর্তে চিকেন ফ্রাই আর কোকের ট্রে হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফাঁকা সিট খোঁজায় ভীষণ ব্যস্ত।
----- এখানেও পাগলু?
বিড়বিড়িয়ে কথাটা বলে মেনু কার্ডের আড়ালে তাড়াহুড়ো করে মুখ লুকালো নীলিমা। যা দেখে তিথি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
---- কি হয়েছে,হুট করে এমন চো'রের মতো বিহেভ করছিস কেন?
নীলিমা হিসহিসিয়ে বলে,
------ চুপ কর বিদেশি বাঁদরটা এদিকেই আসছে, একবার দেখে ফেললে বকবক করে মাথা খেয়ে ফেলবে।
----- এক্সকিউজ মি, কে বাঁদর?
আচমকা পুরুষালী রাশভারী আওয়াজে লাফিয়ে উঠলো নীলিমা, থতমত খেয়ে মুখের সামনের মেনু কার্ডটা সরাতেই দৃষ্টিস্থাপন হলো সায়রের কুঁচকানো ভ্রুর ভাজে।
সায়র নীলিমার পাশেই বসেছে, যার দরুন মেনু কার্ডটা সরাতেই চকিতে পেছনে সরে গেলো নীলিমা। কোনো মতে নিজের ভ'য় টাকে আড়াল করে চোখে মুখে মিথ্যে আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে তেঁতো গলায় নীলিমা বললো,
---- আপনি এখানে কি করছেন, এটা আমার সিট চোখে দেখতে পাচ্ছেন না?
সায়র এগিয়ে গিয়ে নীলিমার কফিতে একটা সিপ দিয়ে বললো,
---- দেখাও দেখি কোথায় লেখা আছে এটা তোমার সিট? আমি যতদূর জানি সিটটা ক্যাফের কতৃপক্ষের , এবং এটা সকল কাস্টমারের জন্য বরাদ্দ। মানুষের জিনিস কে নিজের বলা বন্ধ করো লো'ভী মেয়ে। কোনদিন না অন্যের জামাইকে দেখিয়ে বলো, এই জামাই আমার।
তিল কে তাল, আর ক কে কলিকাতা বানিয়ে ফেলবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে সায়রের মাঝে, সেটা বেশ ভালো মতোই টের পেলো নীলিমা। তাই আপাতত কিছু না বলে অগত্যাই চুমুক দিলো কফিতে।
সায়র কিঞ্চিৎ বাঁকা হেসে বললো,
---- হাউ ইজ ইট?
----- মানে?
সায়র কফির স্ট্র টাকে ইশারা করে বললো,
----- আমার লিপস টেস্ট।
নীলিমার এতোক্ষণে মাথায় ঘুরলো একটু আগে এই একই স্ট্র দিয়ে সায়র ওর কফি পান করছে,আর এখন ও নিজেও খেলো। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই টিস্যু দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে নীলিমা নাক মুখ কুঁচকে বললো,
----- অ'সভ্য লোক, কি চান আপনি?
---- আপাতত এক চুমুক কফি নিয়ে,সেটাকে কুলকুচি করে সরাসরি তোমার মুখে পুরে দিতে চাই।
সায়রের এমন বিদঘুটে কথায় গা গুলিয়ে এলো নীলিমার, ও অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
----- আপনি আসলেই একটা পা'গলু। পঁ'চা,বা'সি, ন'ষ্ট, উৎকৃষ্ট। সব আপনি।
প্রতিউত্তরে সায়র আরও গা গুলানো কিছু কথা ছুঁড়বে, তার আগেই নীলিমার নাম ধরে ডেকে ওঠে অরু।
নীলিমা পেছনে চেয়ে অরুকে দেখে আশ্চর্য কন্ঠে বলে,
----- অরু তুই?
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৪১ (বর্ধিতাংশ)
----- অরু তুই?
অরু এগিয়ে এসে সহসা হেসে বলে,
----- আপা দের বিয়ের শপিং এ এসেছি, তুই কি....
বাকি কথা বাড়ানোর আগেই ওর সাথে চোখাচোখি হলো তিথির ।
তিথি অরুকে দেখে সংকোচ কিংবা অ'পরাধ বোধ করা তো দূরে থাক, উল্টে একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো,
------ তাহলে শেষ মেশ ফিরেই এলি আমেরিকা থেকে? তোকে আগেই বলেছিলাম নিখিল ভাইয়ের পেছনে পরে থাকা বন্ধ কর, তোকে দু’পয়সার ও পাত্তা দেবে না নিখিল ভাইয়ের মতো মানুষ ।শুধু শুধু এতো গুলা দিন ধরে মিথ্যে আশা নিয়ে বেঁচে আছিস। হাউ শেইম।
নীলিমা তৎক্ষনাৎ তিথিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো,
----- থামবি তুই তিথি? অরুর মনটা এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না।
অরু এবার মুখ খুললো, তিথির দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
----- তোকে কে বলেছে আমি মিথ্যে আশায় বেঁচে আছি? আমাকে দেখে কোন দিক দিয়ে তোর অসুখী মনে হচ্ছে?
তিথি তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,
---- দেখতেই তো পাচ্ছি, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিস, আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস?
ওদের ত'র্কের ফাঁকে বাম হাত ঢুকিয়ে, অরুর দিকে ঘুরে আশ্চর্য হয়ে সায়র শুধালো,
---- জেকের মতো আস্ত একটা প্যারা জীবনে উপস্থিত থাকতে, তুমি আবার কার জন্যে শুকিয়ে গেলে এলোকেশী?
সবার উদ্ভট কথা শুনে আ'হাম্মকের মতো ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে অরু, প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন উদ্যমে তিথিকে কিছু বলার।
ঠিক সেই সময়ে, সবার আকর্ষন কেড়ে নিয়ে বয়জেষ্ঠ একজন ওদের মাঝে চলে এসে তিথির কাঁধে নিঃসংকোচে হাত রেখে বললো,
----- হ্যালো এভরি ওয়ান। কি অবস্থা সবার?
লোকটা স্মার্ট, বেশভূষা দেখেই বোঝা বেশ যাচ্ছে বেশ ধনাঢ্যশালী ব্যক্তি হবে হয়তো। তবে বয়সে ওদের চেয়ে চোখবুঁজে কয়েকগুণ বড় তো হবেই।
সায়র লোকটাকে দেখে জোর পূর্বক হেসে বললো,
----কে আপনি দাদু?
তিথি তৎক্ষনাৎ লোকটার বেড়ে ওঠা ভূড়িতে আবেশিত হাত ছুয়িয়ে একগাল হেসে বললো,
----- মিট মাই বিলোভট হাসবেন্ড, খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
তিথির কথায় ওরা সবাই মুখ টিপে হাসি সংবরণ করলো। সায়র তো কুলিয়ে উঠতে না পেরে মিনিমিনিয়ে বলেই ফেললো,
----- এই দাদু আবার হাসবেন্ড হয় কি ভাবে? দেখে তো মনে হচ্ছে সারাদিন হাঁচি কাশিতেই দিন শেষ হয়ে যায় ওনার, তাহলে বউ সামলায় কখন?
সায়র নীলিমার পাশেই বসা ছিলো বিধায়, নীলিমা ওর উরুতে চিমটি কেটে সহসা থামিয়ে দিয়ে বললো,
----- চুপ করুন, অন্যের অনুভূতিকে সম্মান করতে শিখুন।
নীলিমার শেষ কথাটা সায়রের হৃদয়ে গিয়ে লাগলো, আসলে মেয়েটাকে যতটা রা'গী আর বেয়ারা মনে হয়, ততটাও নয়। মনটা ভালো আছে।
অরু এখনো তিথি আর তার দাদু ওরফে হাসবেন্ডের গদোগদো প্রেম দেখে সার্কাস দেখার মতোই হা করে তাকিয়ে আছে, মনে মনে ভাবছে,
---- ইশ এই দাদুটাও কি রোমান্টিক, অথচ আমার বর কে দেখো,সারাদিন মেজাজ আর মেজাজ। এমন করে একটু লোকের সামনে গদোগদো ভালোবাসা দেখালে কি হয়?
তিথি তার বিলোভট হাসবেন্ডের থেকে চোখ সরিয়ে, অরুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
---- এখনো সময় আছে, এরকম একজন দেখে বিয়ে করে নে, পুরো লাইফ আরামছে পায়ের উপর পা তুলে কেটে যাবে।আ...
তিথির কথা মাঝপথেই আটকে গেলো যখন চমৎকার এক পুরুষালী কন্ঠে পেছন থেকে খুব অধিকার নিয়ে অরুকে ডেকে উঠলো কেউ,
------ মিসেস অরোরা জায়ান!
ক্রীতিক হঠাৎ করে পুরো নাম ধরে ডেকে ওঠায়,অরু হকচকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
----- এইতো আমি।
চলতি ক্লাইমেক্সে আরও খানিকটা আকর্ষন ঢেলে দিতে, সবার মাঝে এসে দাড়ালো ক্রীতিক।সুদর্শন ক্রীতিককে দেখে অকস্মাৎ চিকচিক করে উঠলো তিথির দু'চোখ, ও তব্দা খেয়ে কিছুটা লাজুক হেসে শুধালো,
---- আপনি কে ভাইয়া?
ক্রীতিক বাহুর মাঝে অরুকে নিয়ে বললো,
----- হার বিলোভট হাসবেন্ড, জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
অরুর স্বামী কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চুপসে এইটুকুনি হয়ে গেলো তিথির মুখ, ও পুনরায় অবিশ্বাসের সুরে বললো,
---- ক্রীতিক কুঞ্জের মালিক জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী?
তিথির সম্মোধনে ক্রীতিক অরুর দিকে তাকিয়ে সহসা হাসলো, যার অর্থ হ্যা।
এই মূহুর্তে তিথির থমথমে মুখ খানা দেখে মনে হচ্ছে, কেউ কয়েকশ অ'পমানের চ'পেটা'ঘাতে লাল করে দিয়েছে ওর মুখ।
নীলিমা হতবাক হয়ে অরুকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বললো,
---- জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী না তোর সৎ ভাই?
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।
---- তাহলে হাসবেন্ড কি করে হলো?
অরু নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
---- বিয়ে করেছে তাই হাসবেন্ড হয়েছে।
নীলিমা হাসফাস করতে করতে বললো,
---- আমি না কিছু মিলাতে পারছি না অরু,তুইতো সেদিনও নিখিল ভাইয়ের জন্য কা'ন্নাকাটি করলি, তাকে ছাড়া নাকি তুই আর কাউকে তোর জীবনে ভাবতে পারিস না, তাহলে হঠাৎ?
অরু ঠোঁট উল্টে ভ্রু কুঁচকে বললো,
----- তোকে কে বললো, আমি নিখিল ভাইয়ের জন্য কেঁদেছি? আমি তো ওনার জন্য কাঁদছিলাম। অরু চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখালো ক্রীতিক কে।
নীলিমা হতবিহ্বল কন্ঠে বললো,
---- কিহ! তুই ওনার জন্য কাঁদছিলি?
অরু ঠোঁট ফুলিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে নীলিমা পুনরায় বলে,
---- উনি কেন তোকে হঠাৎ বিয়ে করতে গেলো ?আর তুইই বা কি করে, না মানে আসলে কি বলতো সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে, আচ্ছা অরু, উনি কি আসলেই তোকে নিজ ইচ্ছেতে বিয়ে করেছে? মানে উনিকি তোর, সত্যিকারের, আপন স্বামী?
অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে ক্রীতিকের দিকে অভিমানী চোখে তাকিয়ে বললো,
---- নিজ ইচ্ছেতে নয় বরং জো'র করে বিয়ে করেছে! নি'র্দয় পা'ষান লোক একটা।
অরুর কথা শুনে নীলিমা হা হয়ে গেলো, হতবিহ্বল কন্ঠে শুধালো ,
----- কি বলিস! ওনার মতো মানুষ তোর মতো পুচকে মেয়েকে জো'র করে বিয়ে করে নিলো? আমি সত্যিই এখন কনফিউজড অরু, কি এমন আছে তোর মাঝে?
অরু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
---- জানিনা, ওনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
----- আচ্ছা তুই ওনাকে ভালোবাসিস?
নীলিমার কথায় অরু তাকায় ক্রীতিকের দিকে, যে এই মূহুর্তে সায়র আর অর্ণবের সাথে কফিতে মন দিয়েছে, অরু এভাবে তাকিয়ে আছে দেখে হুট করেই চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনার, অরু তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে মুচঁকি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।
নীলিমা কৌতুহল বশত শুধালো,
---- আর উনি?
অরু জবাব দেয়,
----- উনি কখনো মুখে ভালোবাসি বলেন না, তবে ওনার মহাসমুদ্রের মতো গভীর ভালোবাসা স্পষ্ট উপলব্ধি করি আমি, যে ভালোবাসার অতলে যাওয়ার সাধ্যি আমার নেই। আছে শুধু এক সমুদ্র ভালোবাসায় নিরন্তর সাঁতার কেটে বেড়ানোর অদম্য ইচ্ছে।
আমি বুঝতে পারি উনি আমার জন্য ঠিক কতটা উ'ন্মাদ।ওনার পা'গলের মতো ভালোবাসা, এতগুলো বছরের অপেক্ষা, সবার আড়ালে দিনের পর দিন আমাকে ছায়ার মতো আগলে রাখা, আমার কষ্টে নিজেকে ভে'ঙেচুরে ফেলার মতো য'ন্ত্রনাদ্বায়ক কাজগুলো, আমাকে ওনার প্রেমে পরতে বাধ্য করেছে নীলিমা। আর যখন সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে গেলাম, তখন আমিও বুঝলাম সত্যিকারের প্রেমে পড়লে ঠিক কতোটা পু'ড়'তে হয়, কতটা য'ন্ত্রনা সহ্য করতে হয়।
আমি সবটা সহ্য করেছি, ওই জন্যই হয়তো এখন এই মূহুর্তে উনি আমার কাছেই রয়েছেন । এখনের এই জায়ান ক্রীতিক আর একান্ত গোপনীয় আমার জায়ান ক্রীতিকের মাঝে রাতদিন ফারাক । ওনার না বলা গোপন ভালোবাসায় এতোটাই আবিষ্ট আমি,যে আর কারোর হাজার বার উচ্চারিত ভালোবাসায়ও এখন আর পোষাবে না আমার নীলিমা। সত্যিই পোষাবে না।
এক নাগাড়ে কথা গুলো শেষ করে, আবারও ক্রীতিকের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপন করে অরু। যে এই মূহুর্তে গভীর মনোযোগে ফোন স্ক্রল করছে, আবার মাঝে মাঝেই অরুর দিকে তাকিয়ে দক্ষ অভিভাবকের ন্যায় পর্যবেক্ষন, করছে অরুর গতিবিধি।
*****************************************
--- আরে! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সবাইতো অন্যদিকে যাচ্ছে।
শপিং শেষ করে,বাড়ি যাওয়ার পথে মাঝরাস্তায় হঠাৎ বাইকের টার্ন অন্যদিকে ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠলো অরু। ওর কথার পাছে ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বললো,
---- সো হোয়াট?
---- সো হোয়াট মানে? এতো রাত হয়ে গিয়েছে বাড়ি যাবোনা?
---- আমিতো এখানেই, তাহলে বাড়ি যাওয়ার এতো তাড়া কিসের তোর?
কে আছে বাড়িতে?
অরু মুখ কালো করে বললো,
---- সবাই আমাদের রেখে চলে যাচ্ছে তাই আর কি...
ক্রীতিক অরুকে থামিয়ে দিয়ে স্পিডোমিটারের গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
---- সবার কথা বাদ, ফোকাস অন মি, আমি যদি না ফেরার দেশে নিয়ে যাই, তবে তুই সেখানেই যাবি, ইভেন উইথ আউট এনি ফা'কিং কোশ্চেন। এখন ধরে বস।
অরু বললো,
---- ধরলাম তো।
ক্রীতিক তীর্যক কন্ঠে বললো,
---- আরও শক্ত করে ধর আমার হচ্ছে না, তোকে ফিল করতে পারছি না।
ক্রীতিকের কথায় অরু লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরে, পরক্ষণেই মাথাটা এলিয়ে দেয় ক্রীতিকের কাঁধের উপর।
ক্রীতিক রাইড করতে করতেই মৃদু হেসে বললো,
---- নাও পার্ফেক্ট বেইবি।
ওদিকে রাস্তা ছেড়ে বে-রাস্তায় মোড় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে বসেই চেঁচিয়ে উঠলো সায়র,
----- আরে ওদিকে কই যাচ্ছিস তোরা? রাস্তা তো এদিকে।
ক্রীতিক জবাব দেয়না, সায়রের দিকে তাকিয়ে একটু ভাব নিয়ে হেলমেটের গ্লাসটা টান মে'রে নামিয়ে দিয়ে ওদের থেকে দিগুণ গতিতে বাইক নিয়ে হারিয়ে যায় রাস্তার অদূরে।
অরু যখন বাইক থেকে নামলো তখন দেখতে পেলো এটা এয়ারপোর্ট গেইট। ক্রীতিক অরুর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ওকে একটা সেফ যায়গায় দাড় করিয়ে দিয়ে বললো,
----- বেইবি, ওয়েট কর আমি আসছি।
অরু তৎক্ষনাৎ দু-হাতে ক্রীতিকের বলিষ্ঠ হাতটা টেনে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
---- এয়ারপোর্টের মধ্যে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আমায় রেখে কোথায় চলে যাবেন সত্যি করে বলুন?
ক্রীতিক মৃদু হেসে অরুর দিকে সামান্য ঝুঁকে হাস্কিটোনে বললো,
---- তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো আমি?
---- এই যে যাচ্ছেন।
ক্রীতিক অরুকে আস্বস্ত করে বললো,
---- দু মিনিটে ফিরে আসছি।ওকে?
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, ওর হাতে হেলমেটটা ধরিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে যায় ক্রীতিক।
তারপর যখন ফিরে আসে তখন ক্রীতিককে দেখে উৎকন্ঠায় বড়বড় হয়ে যায় অরুর দু'চোখ, আপনা আপনি ফাঁকা হয়ে যায় ওষ্ঠাধর।
চোখ দুটোতে বারবার পলক ছেড়েও নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না অরু। তাই ক্রীতিকের হাতের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটেই অরু বলে ওঠে ,
---- ডোরা?
ক্রীতিক ডোরার বাস্কেটটা অরুর হাতে তুলে দিলো। অরু সহসাই বাস্কেট খুলে ডোরাকে কোলে নিয়ে বললো,
------ আপনি সত্যিই ডোরাকে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন?
ক্রীতিক পুনরায় হেলমেট পরতে পরতে বলে,
----- ডোরা এডপ্টেড ছিল না, তাই ফর্মালিটিস পালন করতে করতে দেরি হয়ে গেলো, নয়তো আমার সাথেই নিয়ে আসতাম।
অরু ডোরার গলায় আদুরে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললো,
---- কার নামে এডপ্ট করলেন?
ক্রীতিক অরুকে হেলমেট পরিয়ে দিয়ে বললো,
----- দুজনার, মহামান্য পিতা মি. জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, আর মহোদয়া মাতা মিসেস অরোরা জায়ান।
ক্রীতিকের কথায় ফিক করে হেসে দিয়ে ডোরাকে নিয়েই বাইকে উঠে বসলো অরু।
*
কিছুদূর গিয়ে একটা ফাঁকা রাস্তায় ব্রেক কষলো ক্রীতিক। ঘড়ির কাটা তখন বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই, চারিদিক নিস্তব্ধ আর শুনশান, পুরো পুরি নিরবতার মাঝে কর্ণকূহরে এসে বাড়ি খাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার অক্লান্ত আওয়াজ।
এমন একটা যায়গায়, এতো রাতে বাইক থামানোর দরুন, উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো অরু, বললো,
----- কিছু হয়েছে?
ক্রীতিক বাইক স্ট্যান্ড করিয়ে বললো,
---- কিছু হয়নি নাম এক্ষুনি।
অরু নেমে দাঁড়ালো, পুনরায় তৎপর হয়ে শুধালো,
----কি হয়েছে, রাগ করেছেন?
ক্রীতিক জবাব না দিয়ে নিজে বাইকে হেলান দিয়ে অরুকে টান মে'রে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
ক্রীতিকের কর্মকান্ডে অরু বিস্ময়ে হতবাক, ও আশ্চর্য বনে গিয়ে বললো্,
----- কি করছেন?
ক্রীতিক একটানে অরুর চুলের গার্টারটা খুলে, ওর চুল গুলো বাঁধন হারা করে দেয়, অতঃপর হিসহিসিয়ে বলে,
---- দেনা পাওনা শোধ করছি, যেটা এয়ারপোর্ট বসেই করতাম। তোর ডোরাকে এনে দিয়েছি, এবার আমি যা চাইবো, সেটা তুই আমাকে দিবি।
অরু ক্রীতিকের বাঁধনের মধ্যে থেকেই কাইকুই করে বলে ওঠে ,
---- ছাড়ুন এটা মাঝরাস্তা।
------ চুপচাপ আমার কাজ করতে দে, নয়তো সারারাতেও ছাড়া পাবিনা।
অরু গলা খাদে নামিয়ে বললো,
---- কি করবেন আপনি?
ক্রীতিক অরুকে আরও কিছুটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে এসে বললো,
---- আগে আমাকে তুমি করে বল তারপর করছি।
অরু চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
----পারবো না।
----- জাস্ট সে, তুমি।
ক্রীতিকের কড়া আদেশ, তারউপর মাঝরাস্তায় এভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে, অগত্যাই উপয়ান্তর না পেয়ে অরু বলে ওঠে ,
---- তুমি।
ক্রীতিক পুনরায় বলে,
--- আবার বল।
অরু কা্ঁপা স্বরে বললো,
---- তুমি।
ক্রীতিক অরুর গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
---- বারবার বল হার্টবিট, তোর মুখে তুমি ডাক শুনলে পা'গল হয়ে যাই আমি। যখন আমি খুব রে'গে যাবো, তখন তুই এই ট্রিকস টা প্রয়োগ করতে পারিস। আমি শান্ত হয়ে যাবো, প্রমিস।
ক্রীতিকের ভালোবাসায় কাতর অরু, পা দুটো ভে'ঙে আসছে, কোনোমতে ক্রীতিকের উপর নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।
কিন্তু ক্রীতিকের বোধ হয় সেটাও সহ্য হলোনা, ও তৎক্ষনাৎ ঘুরে গিয়ে অরুকে তুলে বাইকের সিটে বসিয়ে দিয়ে,তরিৎ বেগে নিজের অধর ডুবিয়ে দিলো অরুর নরম তুলতুলে ওষ্ঠাধরের ফাঁকে।
ক্রীতিকের হঠাৎ পদক্ষেপে কেঁপে উঠল অরু, চুপসানো শরীরটাকে একটু সস্থি দিতে শক্ত হাতে খা'মচে ধরলো পুরুষালী চওড়া বুকে লেপ্টে থাকা টি -শার্ট খানা।
রাত বাড়ছে, সেই সাথে চু'ম্বনের গভীরতা ও। তীব্র আ'লিঙ্গনের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমশ দলিত মথিত হচ্ছে অষ্টাদশীর ফিনফিনে কোমল ওষ্ঠাধর। আবেশিত নয়নে নয়ন এঁটে রাখা, মাতাল করা এই নির্ভীক, বেপ'রোয়া পুরুষই কেবল জানে এই গভীরতার শেষ কোথায়।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৪২
নিশুতি রাতে গাড়ি ঘোড়ার চাপ কমে এসেছে কিছুটা। পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখন কেবলই দোকানীর শাটার টানার ঝনঝন আওয়াজ। ফুটপাত গুলোও মানব শূন্য, পথচারী যারা আছেন তারা ও দ্রুত পদচারণায় বাড়ি ফেরার পায়তারা করছেন।
ক্রীতিকের বন্ধুমহল কেনাকাটা শেষ করে বাড়িতে ফিরলেও, অনু আর প্রত্যয়ের বাড়ির বড়দের জন্য উপহার সামগ্রী কিনতে কিনতে সন্ধ্যা গড়িয়ে মাঝরাতে গিয়ে ঠেকেছে।
আজ বহুদিন বাদে আবারও ওরা হাতে হাত ধরে বাবল টি এর সিপ নিয়েছে। আমেরিকাতে বসে দু'জন দু'টো জারে টি পান করলেও, এখন সময় ভিন্ন, অতএব প্রত্যয়ের ঘোর আপত্তি আলাদা করে বাবল টি নেওয়ার।
ও যদি খায় তবে অনুর টা থেকেই খাবে। অনুও আর বাধসাঁধে নি,কোনোরূপ বাকবি'তন্ডা ছাড়াই প্রত্যয়ের সাথে ভাগাভাগি করেছে নিজের পছন্দের বাবল টি।
এরপর দু'জনে হাতে হাত ধরে হাতিরঝিলে বসে একটা প্রানোচ্ছল সুন্দর সন্ধ্যা পার করে মাত্রই বাড়ির গলিতে প্রবেশ করলো ওরা।
প্রত্যয় মনোযোগী ভঙ্গিতে ড্রাইভ করছে, আর অনু কেনাকাটার লিস্ট গুলো আরও একবার মিলিয়ে নিচ্ছে।
আজমেরী শেখ অসুস্থ মানুষ, তারউপর কোম্পানির চেয়ার ওয়েম্যান। এতোকিছু সামলানোর পর কেনাকাটা কিংবা বাড়তি ঝামেলার চাপ মায়ের উপর পরুক সেটা মোটেই চায়না অনু। ওই জন্যই আজ নিজের বিয়ের শপিং এ নিজেরই আসতে হলো ওকে।
এছাড়া ক্রীতিকের বন্ধুরাও সবাই যথেষ্ট দ্বায়িত্ব পালন করেছে, দ্বায়িত্ব নিয়ে অনু আর প্রত্যয়ের বিয়ের জন্য সকল কেনাকাটা তারাই করেছে।
এমনকি বাড়ির পুরাতন কেয়ারটেকার মোখলেস চাচাকে পর্যন্ত নিয়ে এসেছে যাতে টুকিটাকি কোনোকিছু বাদ না পরে। এসবের পেছনে অবশ্য এলিসার অবদান সর্বাগ্রে। মেয়েটা আসলেই সর্বদিকে পটু। কি না জানে সে?
ক্যারাটে, বক্সিন, মেকআপ, পকার প্লে,রান্নাবান্না, ঘর গোছানো,অর্ণবের প্রফেশনাল কাজে সাহায্য করা, এখন আবার কর্পোরেট সেক্টরে চাকরির জন্য এপ্লাই করছে, হয়তো কনফার্ম হয়েও যাবে খুব শীঘ্রই।
এতো গুণ সম্পন্ন মেয়ে এলিসাকে বিশ্লেষণ করলে এককথায় কি বলা যায়? অনু একটু ভাবে, পরক্ষনেই মনেমনে আওরায়,
---- মেইবি, মিস্টার পার্ফেক্টের ফিমেল ভার্ষনই হলো এলিসা।
---- এসে পরেছি।
প্রত্যয়ের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁ'ড়লো অনুর। ও চোখ উঁচিয়ে দেখলো গাড়িটা ক্রীতিক কুঞ্জের সামনে দাড়িয়ে।
প্রত্যয় অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,
---- পেছনের ব্যাগ গুলো মোখলেস চাচা নিয়ে যাবে, তুমি একাই চলে যাও।
প্রত্যয়ের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সহসা নেমে গিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিলো অনু, ঠিক তখনই পিছু ডেকে প্রত্যয় বলে,
---- এই যে বউ!
নতুন সম্মোধন, সেই সাথে চমকপ্রদ শিহরণ, অনু থমকালো, অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে প্রত্যয়কে শুধালো,
---- কিছু বলবেন?
প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে একটা দুই বাই দুই ইঞ্চি সাইজের চৌকো বক্স অনুর দিকে এগিয়ে দিলো। জিনিস টা কি বুঝতে না পেরে অনু ইতস্তত বোধ করে বললো,
---- কি আছে এতে?
প্রত্যয় অনুর হাতে বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
---- তোমার স্বপ্ন, তবে এটা এখন খোলা যাবেনা, আমাদের বিয়ের পরে খুলবে। এখন এটাকে নিয়ে সুন্দর করে আলমারিতে তুলে রাখবে, সাবধান ভুলেও যাতে হারিয়ে না যায়।
প্রত্যয় এমন ভাবে স'তর্কবানী প্রয়োগ করেছে যে নিজের কৌতুহল দমাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে অনুর। দুষ্ট মনটা বারবার লাফিয়ে উঠে বলছে,
---এক্ষুনি খুলে ফেল, দেখে নে এইটুকুনি বক্সের ভেতর কি এমন স্বপ্ন জমা রেখেছে প্রত্যয়?
পরক্ষনেই ভদ্র সভ্য,সংযমি মনটা হাত গুটিয়ে বলে ওঠে,
---- মোটেই না, উনি যেহেতু বলেছেন বিয়ের পরে খুলতে, তাহলে সেটাই হবে, এই ক’দিনের জন্য সানন্দে ধৈর্য ধরবো আমি।
অনু বক্সের উপরিভাগ হাতদিয়ে স্পর্শ করতে করতেই অন্দর মহলে প্রবেশ করে, পুরোপুরি মনোযোগ ওই ছোট্ট বক্সের দিকে নিবদ্ধ থাকায়, সামনে এগোতে গিয়ে হুট করেই কারও শক্ত বাহুতে ধা'ক্কা খেয়ে দু'কদম পিছিয়ে গেলো অনু।
ধা'ক্কার জোরটা বেশ ভালোই ছিল,এমতাবস্থায় প্রচন্ত ব্যথায় চোখ খিঁচিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলো অনু, দেখলো ওর থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে রা'গে ফুঁসছে রেজা। রেজা কি তাহলে হসপিটাল থেকে বাড়িতে না গিয়ে, সোজা ক্রীতিক কুঞ্জে ফিরলো? কিন্তু কেন?
এ বাড়ির ছোট সাহেবের হাতে মা'র খেয়ে আবার এই বাড়িতেই ফিরেছে বিষয়টা বোধগম্য হতেই বিস্ময় জড়িত কন্ঠে অনু বলে ওঠে,
---- রেজা ভাই আপনি?
রেজা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো তৎক্ষনাৎ,
---- তোমার সৎ ভাই আমাদের তোমার বিয়ে খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে অনু। যে অনুকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে এসেছি সেই অনুর বিয়ে খেতে। ভাবতে পারছো?
অনুর মুখ চুপসে গেলো, কিছুটা শান্ত গলায় বললো,
---- দেখুন রেজা ভাই, আপনাকে ভাই ব্যতিত অন্য কোনো নজরে কখনোই দেখিনি, না আপনার সাথে আমার কোনোকালে সহজ কথোপকথন হয়েছে। তাহলে স্বপ্নটা দেখলেন কোথা থেকে? আর বাকি রইলো বিয়ের কথা? ওটা আপনার মা'ই সারাজীবন আপনার মস্তিষ্কে ব্যা'ক্টেরিয়ার মতো প্রয়োগ করেছে। যার ফলরূপ আপনি আমাকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে এসেছেন।
অনুর শান্ত গলায় করা তি'রস্কারে রেজার কপালে ক্রুর ভাঁজ প্রতিস্থাপিত হলো, ও রুষ্ট কন্ঠে বললো,
--- জায়ান ক্রীতিকের আশকারায় এতো কিছু বলছো তো? আজকে দেখো জায়ান ক্রীতিকের কি হাল হয়, সাথে অবশ্য তোমার বোনটাও ফাঁ'সবে, কাল সকালের মধ্যে জায়ান ক্রীতিকের মান সম্মান যদি আমি ধুলোয় মিশিয়ে না দিয়েছি তবে আমার নাম ও রেজা নয়।
রেজার কথায় অনু আ'তঙ্কিত হলোনা, উল্টে গলার জো'র বাড়িয়ে বললো,
---- প্রথমত আমার মা এই বিয়েতে মত না দিলে, অন্য কারও আশকারায় আমার কিছু যায় আসতো না রেজা ভাই। আপনার ফুপিই সরাসরি বিয়েটা দিচ্ছেন,তাই আশকারা তো একটু পাবোই বলুন? আর জায়ান ক্রীতিকের সম্মানের কথা বলছেন? সেতো সমাজেরই পরোয়া করেনা, সম্মান তো দূরছাই। উল্টে তার পেছনে কলকাঠি নেড়ে আপনি কতোটা সেফ থাকবেন সেটা নিয়েই আমি আপাতত দুশ্চিন্তা গ্রস্থ।
রেজা অনুর দিকে দু কদম এগিয়ে এসে একটা তাচ্ছ্যিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
--- আমার হাত ঠিক কতোটা লম্বা, তা তো তুমি কল্পনাও করতে পারবে না অনু, তোমাকে আমি দেখে নেবো... কাল প্রেসের লোকেরা এসে যখন বাড়ি ভর্তি করে ফেলবে একই প্রশ্নে মাথা খারাপ করে দেবে যে,
---- আজমেরী শেখ আদতে কোন সার্থ হাসিলের জন্য নিজেরই সৎ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন, নিজের স্বামীর পদবী নিজের মেয়ের গায়েও এঁটে দিলেন, তখন দেখবো তোমার ওপেন হা'র্ট সা'র্জারী ফেরত মা, আর তোমার বিয়ে, দুটোরই কি হাল হয়?
দেখা যাবে মান সম্মানের ভয়ে তোমার বিলেত ফেরত স্বামী আর তার পরিবার বিয়েটাই ভে'ঙে দিলো। তখন তোমার মা মান সম্মান বাঁচাতে আবারও আমার মায়ের হাত পা ধরে তোমাকে আমার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে উদ্যত হবেন। মার্ক মাই ওয়ার্ড অনন্যা শেখ।
রেজার এতোগুলা কথায় থমথমে হয়ে গেলো অনুর চোয়াল, রাগে র'ক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ওর সমগ্র মুখশ্রী, এক্ষুনি রেজার গালে চ'ড় না বসালে খুব বড় অ'ন্যায় হয়ে যাবে, সেই অ'ন্যায়ের ভাগিদার হতে চায়না অনু, যার ফলস্বরূপ কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে ক্ষ্যা'পাটে বাঘিনীর মতো রেজার গালে শ'ক্ত চ'পেটাঘা'ত বসাতে উদ্যত হলো অনু।
তবে চ'ড় টা আর বসাতে পারলো না, তার আগেই শি'কার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঝড়ের বেগে অনুর সামনে থেকে রেজার কলার ধরে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো ক্রীতিক।
অনু ভড়কালো, মাথার মধ্যে টগবগিয়ে বেড়ে ওঠা ক্রো'ধটা মূহুর্তেই বিস্ময়ে পরিনত হলো, ও ঘাড় ঘুরিয়ে সাইডে তাকাতেই দেখতে পেলো, রেজাকে মেঝেতে ফে'লে ওর বুকের উপর হাটু গেড়ে বসে এলোপাথারি ঘু'ষি দিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিক। ক্রো'ধান্বিত প্রতিটি ঘু''ষি আঁচড়ে পরছে রেজার চোখে মুখে।
এভাবে ক্রমাগত এলোপাথারি মা'রের তোপে একদন্ড শ্বাস ফেলছে পারছে না রেজা, অথচ ক্রীতিক থামার নামই নিচ্ছে না, উল্টে মা'রের সাথে সাথে চোয়াল শক্ত করে অ'স্রাব্য গা'লিতে পিষ্ট করছে রেজাকে।
ক্রীতিকের কর্মকান্ডে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ভয়ার্ত চোখে অরুর দিকে চাইলো অনু, দেখলো অরুর একহাতে হাতে গজের ব্যন্ডেজ প্যাঁচানো অন্য হাতে ডোরার বাস্কেট। ও নিজেও ক্রীতিকের এমন রা'গ দেখে থরথরিয়ে কাঁপছে।
কিন্তু এখন তো কাঁপাকাপির সময় নয়, ক্রীতিককে থামাতে হবে নয়তো রেজাকে আজ মে'রেই ফেলবে লোকটা, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই, অরু ছুটে গিয়ে ক্রীতিকের হাত টেনে ধরলো, তবুও থামছে না ক্রীতিক, অরু পারছে না ক্রীতিকের পুরুষালী শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে, তাও জো'র জব'রদস্তি করে কোনোমতে রেজার বুকের উপর থেকে সরিয়ে দাড় করালো ওকে।তবুও হিং'স্র সিংহের ন্যায় গর্জন করতে করতে রেজাকে পা দিয়ে ক্রমাগত আ'ঘাত করে যাচ্ছে ক্রীতিক। ওর র'ক্তিম চোখ, আর তীব্র ক্রো'ধ দেখে মনে হচ্ছে ও আজ রেজাকে মে'রেই ফেলবে।
হলরুমে হঠাৎ এতো চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দোতলার করিডোর দিয়ে উঁকি দিলো সায়র, অর্ণব আর এলিসাও। ক্রীতিককে হঠাৎ করে এমন রে'গে যেতে দেখে ওরাও হতবাক, কি এমন হলো হুট করে? সন্ধ্যা বেলাতেও তো সব ঠিক ঠাকই ছিল। বেশ শান্ত সাবলীল ছিল ক্রীতিক।
ক্রীতিকের গর্জন শুনে আজমেরী শেখ আর জাহানারা ও অন্য দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, সবাই নিরব দর্শক, কেউ ক্রীতিকের রা'গের কারণ ধরতে পারছে না, শুধু মাত্র জাহানারা বেগম সিঁড়ি ভেঙে ছুটে নিচে নেমে এলেন, তিনি কা'ন্না জড়িত কন্ঠে একপ্রকার কাকুতি মিনতি করেই অরুকে বলতে লাগলেন,
--- ও অরু, দয়াকরে থামা তোর স্বামীকে, আমার ছেলেটাকে মে'রে ফেললো তো।
অনু জানেনা কি হয়েছে, কেনই বা ক্রীতিক এতো ক্ষে'পেছে, তবুও খারাপ কিছু যে ঘটেছে সেটা অরুর ব্যান্ডেজ করা হাত দেখেই আঁচ করতে পারছে ও, কিন্তু এখন ক্রীতিককে থামানোটা জরুরি, নয়তো রেজার খুব খারাপ পরিনতি হবে, তাই অনু নিজেও উদ্বিগ্ন স্বরে অরুকে বললো,
---- ক্রীতিক ভাইয়াকে আটকা অরু, রেজা ভাইয়ের না'ক মুখ দিয়ে র'ক্ত বেরোচ্ছে ম'রে যাবে তো।
আপার কথা কর্ণকূহরে পৌঁছালে অরু এক প্রকার হন্যে হয়ে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ক্রীতিক কে। পর মূহুর্তেই ওর মনে পরে গেলো ক্রীতিকের বলা তখনকার কথাগুলো,
---- বারবার বল হার্টবিট, তোর মুখে তুমি ডাক শুনলে পা'গল হয়ে যাই আমি। যখন আমি খুব রে'গে যাবো, তখন তুই এই ট্রিকস টা প্রয়োগ করতে পারিস । আমি শান্ত হয়ে যাবো, প্রমিস।
অরু এবার তাই করলো, সবার সামনেই দু-হাতে পেছন থেকে শক্ত করে ক্রীতিককে জড়িয়ে ধরে বললো,
---- প্লিজ থামো, একটু শান্ত হও, আর না। দয়া করে আর মে'রোনা, ম'রে যাবেতো।
অরুর ট্রিকস বোধ হয় কাজে লাগলো, ক্রীতিক তার কথা রেখেছে, অরুর করা তুমি সম্মোধনে মূহুর্তেই মস্তিষ্কে জ্বলতে থাকা বি'ধ্বংসী ক্রো'ধটাকে সামলে নিয়েছে ও।
পরমূহুর্তেই নিজের মেদহীন এ্যাবসে শক্ত করে জড়িয়ে রাখা অরুর ব্যান্ডেজ করা হাতটাতে নজর দিয়ে, বাঁজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো, মু'মূর্ষু রেজার দিকে, সেভাবেই তাকিয়ে থেকে ধা'রালো আওয়াজে বললো,
---- বা'স্টা'র্ড, আমার মতো অভদ্রের পেছনে লাগতে এসে মোটেই ঠিক কাজ করিস নি তুই, আজকে ইন্ট্রো দিলাম খুব শীঘ্রই তোর খেল খতম করবো আমি। সময় হলে টের পাবি জায়ান ক্রীতিক আদতে কতটা জ'ঘন্য আর ট'ক্সিক।
অরু আবারও হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ বন্ধ রেখেই রিনরিনে আওয়াজে বললো,
---- প্লিজ শান্ত হও একটু, প্লিইইজ।
ক্রীতিক অরুর ব্যন্ডেজ করা হাতে আলতো স্পর্শ করে ঘাড় ঘুরিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
---- এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছিস, হাতে ব্যথা করছে না?
অনিমেষ কথাগুলো কানে ভেসে আসতেই অরু পুরোপুরি বাঁধন হারা করে দিলো ক্রীতিককে, ওকে ছেড়ে দিতেই চারিদিকের বিস্মিত হতবাক কয়েক জোড়া চোখ দেখে, লজ্জিত হয়ে দ্রুত মাথা নিচু করে নিলো অরু।
আজমেরী শেখ করিডোরের কার্নিশে হাত রেখে এতোক্ষণ জীবন্ত পুতুলের মতোন দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছু করার নেই এই মূহুর্তে। অরুকে নিজের বশে এনে ক্রীতিক অদৃশ্য শেকলে বে'ধে ফেলছে আজমেরী শেখের হাত, পা। তারউপর বাড়িটা ক্রীতিকের, এখন তিনি চাইলেও চুপচাপ নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারছেন না।
----- রিডিকিউলাস।
ক্রীতিক থেমে যাওয়ার এক পর্যায়ে, চোখে চশমা এটে গটগটিয়ে রুমে যেতে যেতে, দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়ালেন আজমেরী শেখ।
*****************************************
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে, একটা সিল্কের পাজামা গায়ে চড়িয়ে,সতর্ক হাতে ডোরাকে কোলে নিয়ে মাত্রই বিছানায় বসেছে অরু।
মাঝরাত তখন শেষ রাতে গিয়ে ঠেকেছে, আরেকটু পরে হয়তো ফজরের আজান হবে। অথচ বাড়ির সবাই মাত্র কিছুক্ষণ হলো যে যার রুমে ঢুকেছে, ক্রীতিকের সাথে সায়র অর্ণব ও ওর রুমে। এতো রাতে কি নিয়ে কথা বলছে তারা, কে জানে?
আগের রাতের সব ঘটনা ভুলে গিয়ে অরু যখন ডোরাকে আদর করায় মন দিয়েছে, ঠিক তখনই ওর রুমে কড়া নারে অনু। দরজা খোলাই ছিল, তবুও অরু কিছুটা গলা উঁচিয়ে বললো,
---- দরজা খোলাই আছে।
অনু রুমে ঢুকলো, তবে এগিয়ে গিয়ে বসে কথা বলার অপেক্ষা করলো না,বরং অরুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
---- হ্যারে অরু, কি হয়েছে বলতো?
ক্রীতিক ভাইয়া হঠাৎ করে রেজা ভাইকে এভাবে মা'রলো কেন?
তারউপর তোর হাতে ব্যান্ডেজ, তোকেও মা'রেনি তো?
অনুর কথায় অরু নিজের হাতের দিকে তাকালো, হাতের কব্জিটা ঘুরিয়ে ব্যান্ডেজ করা, নিজের হাতটা ভালো মতো পরখ করে, অরু নরম স্বরে বললো,
--- রেজা ভাই ঠিক আছে?
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---- ক্লিনিক থেকে প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট নিয়ে, মামী সহ তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছে।
--- ওহ, ভালো।
অরুকে কেমন উদাসীন লাগছে, তাই অনু আবারও আগ বাড়িয়ে বললো,
---- কি হয়েছে বললি নাতো?
অনুর কথায়, অরুও ভাবনায় পরে গেলো, মনেমনে ভাবতে লাগলো তখনকার ঘটনা, একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জের ধরে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কতটা দূ'র্বিষহ আর আ'তঙ্কিত হয়ে উঠেছিল ওদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মূহুর্তটা। আর সবচেয়ে বড় কথা সেই পুরো ঘটনার পেছনে ছিল ওরই মামাতো ভাই রেজা। এখনো সেসব কথা ভাবতে গেলে, রেজার উপর মেজাজ চড়ে ওঠে অরুর।
মাঝরাতে শুনশান নিস্তব্ধতার মাঝে, নিরিবিলি রাস্তায় ক্রীতিক যখন শুধুই অরুর হৃদস্পন্দন বাড়ানোর পায়তারা করছিল, ক্রমশ নিজের ঠোঁটের খেলায় অরুকে মাতিয়ে তুলছিল,ঠিক সেসময় খুব কাছ থেকে অযাচিত কিছু হিসহিসানির আওয়াজ কানে বিট করতেই অকস্মাৎ গতি হারায় তীব্র গভীরতর চুম্বন।
ক্রীতিক তরিৎ গতিতে চোখ খুলে দেখতে পায়, রাস্তার অপর পাশের বন্ধ টং দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুক্ষ্ম হাতে গো'পন ক্যা'মেরায় ওদের একান্ত মূহুর্তগুলো ভিডিও করছে কেউ।
এহেন অবস্থায় ক্রীতিক কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করলো না, উল্টো অরুকে ছেড়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
--- আমি আসছি বেইবি, তুই বস।
কথাটা শেষ করে টি-শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে রাস্তার ওপাশে গিয়ে, এক টাকে কলার ধরে টেনে বের করলো ক্রীতিক। তারপর শুরু করলো একের পর শক্ত হাতের থা'প্পড় দেওয়া।
এভাবে হঠাৎ করে মাঝরাস্তায় ক্যামেরা হাতে লোকটাকে দেখতে পেয়ে ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো অরুর। তার উপর এমন একটা খোলামেলা যায়গায় বসে ক্রীতিক লোকটাকে বেধ'ড়ক মা'রছে।
আচ্ছা, লোকটা যদি প্রেসের কেউ হয়? কিংবা কোনো গ্যাং এর সদস্য হয় তখন? তখন তো বেশ ঝামেলায় পরে যাবে ক্রীতিক। তার চেয়েও বড় কথা,এখানে যে একজনই আছে তার নিশ্চয়তা কোথায়? এক্ষুনি যদি অন্ধকার ছাপিয়ে আরও কয়েকজন চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসে?
তখন তো ক্রীতিক একা তাদের সাথে পারবে না।
এলোমেলো চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে অরুর, অথচ ক্রীতিক থামছেই না, প্রথমে ওর হাতের ক্যামেরাটাকে আ'ছাড় মে'রে গুড়িয়ে ফেলেছে। অতঃপর ক্রমাগত ওর চো'য়াল বরাবর পা'ঞ্চ বসাতে বসাতে বলছে,
--- জা'নো'য়ার, কিসের ভিডিও করছিলি,বল কে পাঠিয়েছে? সাফ সাফ বল নয়তো আজ রাতই তোর জীবনের শেষ, দিনের আলো আর দেখতে পাবিনা। তার গ্যারান্টি সয়ং আমি।
কথা শেষ করে আবারও লোকটাকে মা'রতে উদ্যত হলে,লোকটা কোনো মতে নিঃশ্বাস ধরে রেখে হাপিত্যেশ করে কাঁদতে কাঁদতে দু'হাত জোর করে বললো,
---- বলছি! ঢাকা দক্ষিণ ছাত্রলীগের সহ সভাপতি রেজা ভাই আমাদের কল করেছিল, বলেছিল তরতাজা নিউজ আছে, জেকে গ্রুপের নতুন এম ডি নাকি তার আপন সৎ বোনের সাথে অ'ন্তরঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তার কথা বিশ্বাস করে টি আর পি বাড়ানোর আশায় সেই সন্ধ্যা থেকে আপনাকে স্ট'ক করছিলাম আমরা। আআসলে আমরা মিডিয়া থেকে এসেছি ।
ক্রীতিক নতুন উদ্যমে লোকটাকে মা'রতে মা'রতে বললো,
---- হা'রামজাদা, ব'দমাশ, আমি আমার বউকে চুমু খাই কি তোদের টিআরপি বাড়ানোর জন্য?
জিদের বসে লোকটাকে মা'রতে গিয়ে ক্রীতিকের একটা কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে যায়,লোকটা বলেছিল আমরা আপনাকে স্টক করছি, তারমানে ওরা একজন নয়।
কিন্তু হঠাৎ করেই যখন পেছন থেকে অরুর আচমকা চিৎকার ভেসে এলো কানে,তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলো ক্রীতিক।দেখলো অরু থরথরিয়ে কাঁপছে, সেই সাথে ওর কব্জি বেয়ে গড়িয়ে পরছে অনর্গল র'ক্তধারা ।
অরুর পেছনে ক্যামেরার একটা ভাঙা অংশ নিয়ে দাড়িয়ে আছে আরেকটা লোক। লোকটার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে ও শীঘ্রই অরুকে আবারও আ'ঘাত করবে, তবে তার আর ফুরসত দিলোনা ক্রীতিক, ছুটে গিয়ে ক্যামেরার ধা'রালো টুকরোটা ছিনিয়ে নিয়ে লোকটাকেই কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো ও।
লোকটার বাহুতে মে'রে, ক্রীতিক যখন ওর গলায় আ'ঘাত করবে, ঠিক সেই মূহুর্তে কাঁপা হাতে ওর হাতটা টেনে ধরে, না সূচক মাথা নাড়ালো অরু।
অরু সেই তখন থেকে ভয়ের তোপে থরথরিয়ে কাঁপছে দেখে, ক্রীতিক সব ফেলে দু'হাত দিয়ে আগলে ধরলো অরুকে। ওর মাথাটা শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে ক্রীতিক ভয়ার্ত গলায় বললো,
---- জানবাচ্চা, হার্টবিট, আর ইউ ওকে না?
অরু কাঁপতে কাঁপতে ক্রীতিকের টি-শার্টে ভেজা চোখ নাক মুছতে মুছতে বললো,
--- ভ'য় করছে, আপনি এখানেই থাকুন। কোথায় যাবেন না।
ক্রীতিক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
---- কোথাও যাবো না আমি, ব্যাগ থেকে আমার ফোনটা দে, ট্রিপল নাইনে কল করতে হবে।
অরু বললো,
---- আমি আপনার ফোন থেকে করে দিয়েছি কল।
অরুর কথায় সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওর কপালে শব্দ করে চুমু খেলো ক্রীতিক, তারপর ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- দেখি হাতটা?
কাহিনীর এই পর্যায়ে এসে থামলো অরু। এতোক্ষন যাবত অরুর কথা শুনে অনুও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, আলগোছে কানের পেছনে লম্বা চুল গুলো গুঁজে দিয়ে শুধালো,
----- তারপর কি পুলিশ কে'ইস হলো?
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, বললো,
--- হ্যা, তখনই আমাদের থানায় যেতে হয়েছে, ওনারা জায়ান ক্রীতিকের হাত পা ধরে নিজেদের কর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেও, প্রেসের লোকদের গায়ে হাত তোলার ফলস্বরূপ ওনাকে অনেকগুলো টাকা জ'রিমানা দিতে হয়েছে।
অনু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, কেন যেন এতো ঝামেলার জন্য কোথাও একটা নিজেকেই অ'পরাধী মনে হচ্ছে ওর। মনেমনে ভাবলো,
---- সবকিছুর মূলে হয়তোবা আমিই ছিলাম।আজ আমার বিয়েটা অন্য কোথাও হচ্ছে বলেই রেজা ভাই সবার উপর এতোটা ক্ষে'পেছে। বিয়ে হতে হতে আরও যে কি কি ঝামেলা পাঁকাবে তা কেবল উপর ওয়ালাই জানে।
*****************************************
---- আস্তে ভাই আস্তে, সামলে, আরে আরে ওদিকে না এদিকে।
অর্ণবের ডিরেকশনে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো সায়রের, ও এবার না পেরে বিরক্ত হয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলেই উঠলো,
---- বাইক টা কি তুই চালাচ্ছিস না আমি?
অর্ণব পেছনে বসা অবস্থায় সামনে মুখ বাড়িয়ে কটমটিয়ে বললো,
---- জীবনে প্রথমবার লাইসে'ন্স ছাড়া বাইক চালাতে এসেছিস, তাও আবার এমন রেসিং বাইক। তাই তোকে ডিরেকশন দিচ্ছি, বেশি কথা না বলে চুপচাপ মন দিয়ে শোন, নয়তো বিয়ের আগেই তোর বউ বিধবা হবে, সাথে আমারটাও।
সায়র কাঁপা কাঁপা হাতে বাইকের ব্রেক সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তবুও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে সামনে মনোযোগ নিবেশ করে বললো,
--- মানুষ মন দিয়ে নয়, কান দিয়ে শোনে হাঁদারাম। তাছাড়া, এমন ভাব দেখাচ্ছিস যেন তুই রাইডিং এ খুব এক্সপার্ট, আয় তাহলে চালা একটু।
----- বিয়ের আগে বিধবা হওয়ার শখ নেই আমার, তোর এতো শখ জাগলো কেন কে জানে? জাগলো তো জাগলো আবার আমাকে সাথে করে নিয়ে ম'রার শখ জাগলো, কি আশ্চর্য শখ!
অর্ণবের কথার পাছে সায়রের কথা বলার ফুরসত নেই, ও আপাতত বাইকের ব্রেক সামলাতে ব্যস্ত। তবুও ক্ষনে ক্ষনে এদিক ওদিক ঘুরে যাচ্ছে ব্রেক।যার দরুন বাইকটাও হেলে দুলে উঠছে ক্রমশ।
বাইক যখনই হেলেদুলে উঠছে, অর্ণব তখনই বুকে মাথায় ক্রুশ একে বারবার ঈশ্বরকে ডাকছে। ওর হা-হুতাশে বিরক্ত হয়ে সায়র ধমকে উঠে বললো,
---- চুপ করবি? বাসায় গিয়ে ঈশ্বরকে ডাকিস, আগে আমাকে ডিরেকশন দে।
অর্ণব বলে,
---- যাচ্ছিটা কোথায় সেটা তো আগে বল?
---- আমার না হওয়া শশুর বাড়ি, ভেবেছি বিয়েটা বাংলাদেশেই করবো বুঝলি।
অর্ণব হতবিহ্বল কন্ঠে বললো,
---- এই পুরান ঢাকার চিপা গলিতে তুই শশুর বাড়ি কোথায় খুজে পেলি?
সায়র দুষ্ট হেসে বললো,
---- চিরুনি তল্লাশি করে পেয়েছি, চল তোকে দেখাবো।
কথা শেষ করে সায়র বাইকে টান দিতেই, আবারও ঈশ্বর নাম জপতে জপতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেললো অর্ণব।
আজ ক্রীতিক অফিস জয়েন করেছে, সেই সুযোগে গোধূলি বিকেলে ক্রীতিকের বাইক নিয়ে সায়রের না হওয়া শশুর বাড়ি খুজতে বেরিয়েছি ওরা দুজন। কিন্তু এই গাদানো সারিসারি ছোট বড় শ্যাওলা পরা বিল্ডিং এর মাঝে আদতে সায়রের না হওয়া শশুর বাড়ি যে কোনটা সেটাই বুঝতে পারছে না ওরা।
বাইক থামিয়ে দু'জন মিলে যখন এদিক ওদিক সুক্ষ্ম নজরে পরখ করছিল, ঠিক তখনই সায়রের দৃষ্টিগত হলো এক অপার্থিব দৃশ্যপট, ওদের থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে যে পুরাতন কংক্রিটের দোতলা বিল্ডিংটা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ছাঁদেই ত্রীভঙ্গ আকারে নাচের তালিম নিচ্ছে সদ্য যৌবনে পা রাখা এক অষ্টাদশী রমনী। পরনে তার কুচকুচে কালো চুরিদার,পায়ে ঘুঙুর, ওড়নাটা কাঁধ ছাড়িয়ে কোমড়ের কাছে বাঁধা। কাঁধ অবধি রিভন্ডিং করা সিল্কি চুল গুলো পাঞ্চ ক্লিপে বাঁধা পরেছে। চেহারা স্পষ্ট নয়, তবুও গোধূলির আভায় নৃত্যরত মেয়েটাকে মায়াবী অপ্সরীর মতোই স্নিগ্ধ লাগছে। আর সায়র? সে তো সেই তখন থেকেই হা করে তাকিয়ে দেখছে,তার গোধূলি বেলার অপ্সরীটাকে। অপ্সরীর অস্পষ্ট মুখশ্রী দেখেও সায়র চোখ বন্ধ করে বলতে পারে এটাই তার রাগীনি ।
*****************************************
গ্রীষ্মের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে পু'ড়তে থাকা জনমানকে একটু খানি সস্থি দিতে সন্ধ্যা নেমেছে ধরনীতে। বাইরের উষ্ণ বাতাস এতোক্ষণে হিমেল হাওয়ায় পরিনত হয়েছে। চারিদিক এখন বেশ শীতল। শুধু মাত্র শীতল নয় ক্রীতিকের মস্তিষ্ক।
ওর মাথাটা গরম হয়ে আছে, সারাদিন অফিস শেষে যখন বাড়িতে ঢুকে অরুকে না পেলো, তখনই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে ক্রীতিকের, বিগড়ানোর মেজাজের অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গতে আরও খানিকটা জোয়ার দিতে অরুর মামি এসে জানায়, তাকে বাড়িতে রেখে আজমেরী শেখ তার দুই মেয়েকে নিয়ে অমিতকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছেন, সদ্য হওয়া আত্নীয়তার সম্পর্কে আরও খানিকটা শখ্যতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।
সেই কথা শোনার পরে আর এক দন্ডও অপেক্ষা করেনি ক্রীতিক, গটগটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে। আর এখন হসপিটালের করিডোর ধরে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে অমিতের কেভিনের দিকে। ক্লান্ত ঘামে ভেজা শরীর হাতরিয়ে টাইয়ের নট'টা ঢিলে করতে করতে মনেমনে ভাবছে,
অনেক হয়েছে আজ অরুকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে ও।
ক্রীতিক যখন দু পকেটে হাত গুঁজে কেভিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই অরুর সাথে চোখাচোখি হলো ওর। অরু ভেতরেই ছিল, হঠাৎ করে এভাবে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে তরিঘরি করে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলো ও।
অরু বাইরে বেরোনোর সাথে সাথে, ওর ব্যান্ডেজ করা হাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরলো ক্রীতিক, অতঃপর রুষ্ট গলায় বললো,
---- চল।
অরু ক্রীতিকের সাথে তাল না মিলিয়ে উল্টো হাতে টান দিয়ে বললো,
---- আরেহ! কোথায় যাবো, মা আর আপা ভেতরে তো।
ক্রীতিক অ'গ্নিদৃষ্টিতে পেছনে তাকিয়ে বললো,
---- সো হোয়াট?
ক্রীতিকের এমন আ'গুন ঝড়া নিস্প্রভ চাহনি দেখে অরু বুঝলো ক্রীতিক রে'গে আছে, তাই খুব একটা কথা না বাড়িয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,
---- না মানে, ওদেরকে অন্তত বলে তো আসি।
--- দরকার নেই।
গমগমে আওয়াজে কথাটা বলে আবারও অরুকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দেয় ক্রীতিক। তবে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার পর পরই সামনে এসে দাড়ায় অমিতের বাবা মা।
অমিতের বাবা মা মুরব্বি মানুষ, তার উপর নতুন আত্মীয়, সে হিসেবে তাদের সম্মান প্রাপ্য। কিন্তু মাথা খারাপ ক্রীতিক সেসবের ধারে কাছেও গেলো, উল্টে চোখমুখে বিরক্তির ভাঁজ টেনে অমিতের বাবাকে বললো,
---- কি হয়েছে? সামনে দাড়ালেন যে?
অমিতের বাবা সহসা হেঁসে বললেন,
---- বাবা তুমি অনু অরুর ভাইয়া না?
ক্রীতিক একঝলক অরুর মুখের দিকে চাইলো, যে এই মূহুর্তে চোখ দিয়ে হাজারো কাকুতি মিনতি করছে, ক্রীতিক যাতে উল্টো পাল্টা কিছু না বলে।
ক্রীতিক চোখ সরিয়ে নেয়, তারপর অমিতের বাবার দিকে তাকিয়ে অনুভূতি হীন গলায় বলে,
---- হ্যা ভাইয়া, শুধুমাত্র অনুর ভাইয়া।
অমিতের বাবা এতো কিছু খেয়াল করলেন না, বরং হাসিমুখে বললেন,
---- তা বাবা তুমি কি বাসায় যাচ্ছো? আর অরুও কি তোমার সাথেই যাবে নাকি?
ক্রীতিক এবার গম্ভীর কন্ঠে বললো,
---- আমার বউ যেহেতু, আমার সাথেই তো যাবে, অন্য কারও সাথে নিশ্চয়ই নয়?ভালো থাকবেন আঙ্কেল আসছি।
বাক্য শেষ করে ক্রীতিক হাটা ধরলে, অমিতের মা পিছু ডেকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
---- এখানে কিছু খাবার দাবার আছে বাবা, অরু যেহেতু চলেই যাচ্ছে, তাহলে তোমরা বরং এটা নিয়েই যাও।
মেজাজের মাত্রা তাপমাত্রার মতোই ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রীতিকের, তবুও ভেতরের উ'গ্রতাকে সামলে রেখে, প্যাকেট হাতে নিয়ে, ক্রীতিক ছোট করে বললো,
--- ঠিক আছে।
তারপর আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ালো না, অরুকে টা'নতে টা'নতে নিয়ে গেলো সবার দৃষ্টি সীমার আড়ালে।
***************************************
বাড়িতে এসে ক্রীতিক সবার আগে খাবারের প্যাকেটটা ছু'ড়ে মা'রলো মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো হলরুমে ছড়িয়ে পরলো,ফলমূল সহ সুস্বাদু সব খাবার গুলো।
ক্রীতিক এভাবে খাবার ছু'ড়ে ফেলেছে দেখে এবার অরুর ও বেশ রা'গ হলো। ও তৎক্ষনাৎ নিজের হাতটা ঝাড়ি মে'রে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
---- লাগছে আমার ছাড়ুন।
ক্রীতিক দ্বিগুণ শক্তিতে আবারও চেপে ধরলো অরুর হাত, তারপর কাঠিন্য গলায় বললো,
--- লাগলে লাগুক, লাগার জন্যই তো ধরেছি।
কেঁ'টে যাওয়া হাতটা এভাবে বারবার চেপে ধরাতে ব্যথায় টনটন করছে ওর, কিন্তু ব্যথার চেয়েও বেশি এই মূহুর্তে বিরক্ত লাগছে অরুর।
অ'সভ্যতা, বে'য়াদবির একটা সীমা থাকে,ক্রীতিক আজ সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। শুধু শুধু সবার সামনে সিনক্রিয়েট করলো, আর এখন খাবার গুলো সব ফেলে দিলো। এলোমেলো খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে ঝাঁজিয়ে উঠলো অরুর মস্তিষ্ক, ও সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে ক্রীতিকের হাতটা আবারও ঝটকা মে'রে ছাড়িয়ে দিয়ে তেঁতো গলায় বললো,
---- আপনি একটা উ'ন্মাদ, সা'ইকো। সারাজীবন একা থেকে থেকে নিজে তো একরোখা, আর অসামাজিক হয়েছেনই এখন আবার আমাকেও আপনার মতো নি'র্দয় বানানোর পায়তারা করছেন।
ক্রীতিক অরুর পানে র'ক্তিম চাহনি নি'ক্ষেপ করে ওর চোয়াল টা দু আঙুলে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
--- কাকে কি বলছিস, বুঝে বলছিস? মেজাজ বিগড়ে আছে অরু, এক্ষুনি থাম নয়তো তোর শরীরে আজ মা'রের নয় অন্য কিছুর দা'গ বসাবো আমি।
অরু তেজ দেখিয়ে ক্রীতিকের হাত ছাড়িয়ে বললো,
----- যা বলেছি ঠিক বলেছি, কোনো স্বাভাবিক মানুষ এতোটা নি'র্দয় হতে পারে, আপনিই বলুন? আপনি যদি বদ্ধ উ'ন্মাদ নাই হবেন, তাহলে একটা অসুস্থ পা ভা'ঙা মানুষকে নিয়ে কিসের এতো সমস্যা আপনার?
একাতো যাইনি, মা আপার সাথে সম্মান রক্ষার্থে গিয়েছি। তারউপর মুরব্বি বয়জেষ্ঠদের ও যা খুশি তাই বলে এসেছেন, কেন?
----- আমার সামনে অমিতের হয়ে ওকালতি করা বন্ধ কর অরু, ভুলে যাসনা আমি তোর স্বামী, সেদিন আমার সামনে, আমার বাড়িতে অমিত তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ভুলে গিয়েছিস?আর তুই কিনা আজ ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে সেই অমিতকে দেখতে চলে গেলি? হাউ ফা'কিং ডেয়ার ইউ অরু!
ক্রীতিকের ক'ঠিন ধমকে এবার একটু গলা খাদে নামিয়ে অরু বললো,
---- আমি আগেও বলেছি মা আর আপার সাথে গিয়েছি। তাছাড়া অমিত ভাই ভালো একজন মানুষ, ওনার পরিবার কেন এসব বলেছে তা জানিনা, আমার জানা মতে উনি আমাকে বোনের নজরে দেখেন।
আসলে সমস্যাটা আপনার মধ্যে , একারোখা জীবন কাটাতে কাটাতে সমাজ, নিয়ম কানুন সবকিছু ভুলতে বসেছেন। হয়েছেন চড়ম অ'সভ্য।
অরু কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থেকে ওর ঘাড়টা চে'পে ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এলো ক্রীতিক,অতঃপর থমথমে ব্যথাতুর গলায় বললো,
----- ভুলে যাসনা আমার একরোখা হওয়ার পেছনে দায়ী কিন্তু একমাত্র তুই, তোর জন্যই এই বাড়ি, কাছের মানুষ, দলীয় পদ সব ছাড়তে হয়েছিল আমাকে। আর আজ তুই আমার দিকেই আঙুল তুললি, ইজন্ট ইট ফেইট?
আর কি যেন বললি,মা আর আপা রাইট? তোর কাছে যদি মা আর আপা এতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়, ওদের তুলনায় আমার অস্তিত্ব যদি এতোটাই ম্লান হয়, তবে চাইনা আমার তোকে।
কথাটা বলে অরুকে সজোরে ধা'ক্কা মে'রে ডিভানের উপর ফেলে দিলো ক্রীতিক।
তারপর আবারও কঠিন কিন্ত মসৃণ গলায় বললো,
---- আমি যেদিন পাশে না থাকবো সেদিন তুই বুঝবি পৃথিবীটা আদতে কতটা সা'র্থপর আর কতটা জ'ঘন্য। আমি তোকে ঠিক কিভাবে খারাপ দুনিয়া থেকে বুকে আগলে আড়াল করে রেখেছি, তখন তুই হারে হারে টের পাবি।
যদিও বা তখন তোর ক'ষ্ট দূর করার জন্য আমি আদৌও এক্সিস্ট করবো কিনা সন্দেহ ।
কিছু তিক্ত অথচ চরম সত্য কথা বলে, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে যায় ক্রীতিক।
ক্রীতিকের শেষ কথাগুলো এবার আর অরুর মস্তিষ্কে নয়, হৃদয়ে গিয়ে লাগলো। আচমকা মনে হলো হৃদয়টাকে ন'খড় হাতে খামচে ধরেছে কেউ, ক্রীতিককে ছাড়া পৃথিবী এও সম্ভব? অরু ভাবতে পারেনা।
ভাবতে চায়ও না, নিজের করা প্রকট ভুলটাকে শুধরে নিতে তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের পেছন পেছন উঠে যায় সিঁড়ি ভে'ঙে। অতঃপর করিডোর পেরিয়ে সোজা ক্রীতিকের রুমে, কেবল মাত্র এই আশায় যে, ক্রীতিক হয়তো ওকে ক্ষমা করলেও করতে পারে,কিন্তু তেমন কিছুই হয়না। অরু রুমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে, তীব্র গর্জনে,
---- জাস্ট গেট লস্ট।
বলে হাত ধরে অরুকে রুমের বাইরে ছুঁ'ড়ে মা'রে ক্রীতিক। তারপর ধাপ করে লাগিয়ে দেয় দরজাটা।
অরু কাঁদতে কাঁদতে দরজার বাইরেই হাঁটু ভে'ঙে বসে পরলো। কিছু তিক্ত সত্যি কথা যে মানুষের হৃদয়কে এই ভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে, তা বোধ হয় কা"ন্নারত অরুকে না দেখলে বোঝা যেত না মোটেই। অরু কাঁদছে তখন থেকে, তা দেখে অরুর মামি জাহানারা এগিয়ে এসে কিছুটা পৈচাশিক হাসি দিয়ে বললো,
----- ঠিক হয়েছে একদম, টাকা হা'তানোর লোভে আরও বিয়ে কর বড়লোকের ছেলেকে। একদিন, দুদিন, তার পর ঠিকই মজা নিয়ে পথে ছেড়ে দেবে। মিলিয়ে নিস আমার কথা।
অরুর ক'ষ্টে মামির বোধ হয় বেশ আনন্দই হলো, তবে অরুর আপাতত সে সবে মন নেই। ও নিজের দু হাঁটুতে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়িবিড়ালো,
---- জায়ান ক্রীতিক তুমি কি জানো? তুমি সেই গু"প্তঘা'তক যে খু'ন করে একটা পরাসৈন্য তৈরী করার উদ্দেশ্যে, আর আমি হলাম সেই ধ'র্মা'ন্ধ যে ওই গু'প্তঘা'তকের ছু'রির ইশারাতে নাচি।
তুমি আমার জীবনে এমন এক ভালোবাসার গোলকধাঁধা, যার থেকে হাজার বছর ছুটলেও আর পরিত্রান নেই আমার। না নেই..
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৪৩
পরন্ত বিকেলে মিয়িয়ে যাওয়া সূর্য কীরণ তীরের ফলার মতোই তীর্যক আকার ধারন করেছে। সেই তীর্যক সূর্য কীরণের সোনালী আলোক রশ্মিটুকু আঁচড়ে পরছে নীলিমাদের দোতলা ভবনের ছাঁদে। যেখানে এই মূহুর্তে নির্দিধায় নৃত্য করতে সয়ং নীলিমা।
নাচে ওর বাধ্যবাধকতা নেই, শখ করেই নাচ শেখা। যেমনটা চারুকলায় গিয়ে আঁকাআকির ক্ষেত্রে। আব্বাজানের একমাত্র মেয়ে হওয়ায়,মেয়ের কোনোরূপ শখ আহ্লাদের ত্রুটি রাখেন না নীলিমার বাবা তাইয়েব জামান।
ছোটবেলা থেকেই বাবার আহ্লাদ পেয়ে পেয়ে নীলিমা ও হয়েছে একরোখা আর বড্ড বেয়ারা। যাকে দেবে তো হৃদয় উজাড় করে দেবে, আর যাকে দেবে না তাকে একরত্তি ও না। পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রেও একই স্বভাব নীলিমার। তবে বর্তমানে ওর অপছন্দের শীর্ষে রয়েছে সায়র, এক কথায় ক্রীতিক কুঞ্জের সেই বিদেশি বাঁদর টা। অতো নাম মনে রাখার সময় আছে নাকি নীলিমার?
অপছন্দের শীর্ষ তালিকার মানুষটার কথা ভাবতেই গিয়েই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে গেলো নীলিমার, মনমনে ভাবলো,
---- মানুষ এতোটা বি'রক্তিকর আর অ'সহ্য কি করে হতে পারে? কি করে?
সায়রের কথা ভাবতে গিয়ে নীলিমা যখন বারবার নাচের মূদ্রায় ভুল করছিল আর চোখ মুখ খিঁচিয়ে সায়রের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল, ঠিক তখনই বাড়ির সামনে স্ট্যান্ড করা বাইক দেখে চোখ আটকে গেলো নীলিমার।
ও নাচ বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাড়াতেই দেখতে পেলো সায়র দাঁড়িয়ে আছে। সায়রকে দেখে নীলিমা কটমটিয়ে বললো,
--- এখন বুঝেছি, শনি তাকিয়ে ছিল বলেই তখন বারবার ভুল করছিলাম।
আপাতত ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাত নাড়ছে সায়র, আর সায়রের থেকে কিছুটা দূরে অন্যদিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে অর্ণব। নীলিমাকে উঁকি দিতে দেখেই সায়র নিচ থেকে কথা ছুড়লো,
--- উপরে আসবো কি?
নীলিমাদের ছোট্ট বাড়ি, ছাঁদে আসার সিঁড়ি টাও বাইরের দিকে, যে কেউ চাইলেই ফট করে উঠে আসতে পারবে,আপাতত সেসব কথা বাদ, এই বাঁদরটা কি করে ওর ঠিকানা খুঁজে পেলো সেটাই ভাবনার মোক্ষম বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে নীলিমা মস্তিষ্কে।
নীলিমাকে নিস্প্রভ চোখে ধ্যান মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়র আর অনুমতির অপেক্ষা করলো না, তরতর করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে এলো নীলিমাদের ছাঁদে।
সায়র উপরে এসে নীলিমার চুলে টোকা মা'রতেই ভ্রম ছুটে গেলো নীলিমার, ও তৎক্ষনাৎ সায়রের দিকে অ'গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
---- ব'দমাশ পুরুষ, আপনি এখানে কি করছেন? আমাদের বাসার ঠিকানাই বা খুঁজে পেলেন কি করে?
সায়র একটা চমৎকার হাসি দিয়ে বললো,
--- কি যে বলোনা, আমার না হওয়া শশুর বাড়ি আর আমি খুঁজে পাবোনা?
সায়রের কথায় নীলিমার চোখ কপালে, ও হতবাক হয়ে বললো,
---- আশ্চর্য, কে আপনার শশুর?
--- কেন, তোমার আব্বাজান।
নীলিমা এবার মেকি হাসলো, সায়রের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
--- ওহ তাই বুঝি? আমার আব্বাজান বুঝি আপনার শশুর? তা একটু ডেকে পাঠাই, বলি তার একমাত্র জামাই কে একটুখানি জামাই আদর করে যেতে?
সায়র নিজের শার্টের কলারটা পেছনে ঠেলে বললো,
--- হ্যা হ্যা বলো। আই এপ্রেসিয়েট।
সায়রের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে নীলিমা তৎক্ষনাৎ গলা ছেড়ে ডেকে ওঠে,
--- আব্বাজান, হুনতাছেন?
তৎক্ষনাৎ নিচ তলা থেকে এক গুরুগম্ভীর কর্কষ আওয়াজ ভেসে এলো,
---- কিতা অইছে আম্মাজান, ডাক পারতাছেন ক্যালা?
নীলিমা আবারও চেচিয়ে বলে ওঠে,
---- ছাঁদে আইয়েন, দেইখা যান বালা, আমগো ছাঁদে বিদেশি বাঁন্দর লাফাইয়াছে।
---- কি কইতাছেন আম্মাজান এসব? লাঠি নিয়া আমুনি?
---- না আব্বাজান, বাঁশ নিয়া আহেন, আছোলা বাঁশ।
নীলিমার কথায় সায়র হতবিহ্বল, হতভম্ব হয়ে মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে, শেষমেশ হবু শশুরের কাছ থেকে কিনা আছোলা বাঁশ খাওয়ার হু'মকি এলো? এ কেমন দস্যি মেয়ে?
নীলিমা মিটিমিটি হেসে আবারও গলা উঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগেই তরিৎ বেগে এগিয়ে এসে আলতো হাতে ওর মুখটা চেঁপে ধরলো সায়র। নীলিমার ডাগর ডাগর কৌতহলী চোখের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
---- এ্যাই মেয়ে, তুমিকি সত্যি সত্যি আমাকে মা'র খাওয়ানোর প্ল্যান করছো নাকি?
নীলিমা সায়রের হাতের মধ্যে থেকেই বোকা বোকা চোখে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।
নীলিমার চোখের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ ফিক করে হেঁসে দিলো সায়র, হাসতে হাসতে বললো,
---- তুমি বুঝি বাড়িতে এভাবে কথা বলো? ইটস সো ফানি ইয়ার।
সায়রের কথা শুনে নীলিমার ম্লান হয়ে যাওয়া উ'গ্র মেজাজ টা আবারও তরতরিয়ে মাথায় চড়ে উঠলো, ও সায়রকে ধা'ক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
---- ভাষা নিয়ে মশকরা করলে সত্যি সত্যি আজ আব্বাজানকে দিয়ে আপনার শশুর বাড়ি আসার শখ মিটিয়ে দেবো, বলে দিলাম।
সায়র চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান গলায় বলে,
---- তারমানে তুমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে হলেও সীকার করছো যে আমি আমার হবু শশুর বাড়িতে এসে পরেছি। তাইতো?
নীলিমা কটমটিয়ে বললো,
---- আপনি চাইছেন টা কি বলুন তো?
সায়র দুষ্ট হেসে বললো,
--- তেমন কিছু নয়, আপাতত একটু জামাই আদর খেতে চাচ্ছি ,খাওয়াবে নাকি?
নীলিমা রাগী নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
---- একটু দাড়ান খাওয়াচ্ছি আপনাকে জামাই আদর, পরক্ষনেই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ও,
----- আব্বাজান, হুনতাছেন!
সায়র বোধ হয় কুক্ষণেও আশা করেনি যে, নীলিমা আবারও চেঁচাবে। হঠাৎ এভাবে চেঁচিয়ে ওঠাতে সায়র নিজেও ভড়কে গিয়েছে,
ওদিকে ভেতরের সিঁড়ি থেকে ধাপ ধাপ আওয়াজ ভেসে আসছে, কেউ একজন এগিয়ে আসতে আসতে বলছে,
--- আইতাছি আম্মা, বাঁশ খান জোগাড় করতে দেরি অয়া গেলোগা।
এ কথা শুনে সায়র চোখ বড়বড় করে উপরওয়ালার নাম জপে বলে উঠলো ,
---- হে খোদা এ কাদের পাল্লায় পরলাম আমি? যেমন মেয়ে তার তেমন বাপ, মেয়ে বাঁশ জোগাড় করতে বললো, অমনি বাপ বাঁশ নিয়ে হাজির?
তাইয়েব জামান সিঁড়ি ঘরের কাছাকাছি চলে আসাতে নীলিমা সায়রের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
--- এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান'না। আব্বা দেখে ফেললে খবর আছে।
সায়র নিচে যেতে যেতে অভিমানী সুরে বললো,
---- আব্বাজানকে বাঁশ দিতে ডেকে এনে এখন আর দরদ দেখাতে হবে না। আসছি বায়।
*****************************************
সন্ধ্যা থেকেই তীব্র বর্ষন। বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে মুখরিত চারিপাশ। রৌদ্রের খাঁ খাঁ বিকেলের ইতি টেনে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে ,
এ বুঝি জৈষ্ঠ্যের পূর্বাভাস?
পুরো ঢাকা শহরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে, যার দরুন, চারিদিক ধোঁয়াসা আর মানব শূন। সেই শেষ বিকেল থেকে বাংলা একাডেমির গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অরু, অথচ এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে জলোচ্ছ্বাসিত রাত।
অনুর বিয়ের কত কত আয়োজন, মন খারাপের পশরা, সবকিছুকে একপাশে ঠেলে সকাল সকাল বাংলা একাডেমিতে এসেছিল অরু। এর কারণ, আজকেই ওর প্রথম লেখা সাবমিট করার শেষ দিন ছিল। পুরো উপন্যাস নয়,একাংশ মাত্র।
ক্রীতিকের হাজার মাইল দূরত্ব যখন অরুকে খুব পো'ড়াতো, একাকীত্বের য'ন্ত্রনায় ডু'বিয়ে দিতো, সে'সময়টাতেই এক সমুদ্র য'ন্ত্রনায় হাবুডুবু খেতে খেতে একাডেমির সবার উৎসাহে লেখা শুরু করেছিল অরু।
পুরোপুরি শেষ না হলেও যেটুকু লেখা হয়েছে সেটাই আজ জমা দিতে আসা। প্রতীক্ষা একটাই প্রথম বার না হলেও কয়েকবার চেষ্টা করলে প্রকাশনীদের নজরে আসলেও তো আসতে পারে।
কিন্তু দিন শেষে কি হলো? বৃষ্টির মাঝে পুরো দস্তুর আটকে পরলো অরু। শেষ বিকেলে যখন ঝুম বৃষ্টি নামলো তখন রিকশা কিংবা গাড়ি নিয়ে একে একে সবাই একাডেমি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অরুর বুদ্ধি বরাবরই কম, কিংবা বেশি বলেই ,বারবার ভুল করে বসে থাকে মেয়েটা, আজও সেটাই হলো, ঝুম বৃষ্টির মাঝে অরু আর রিকশা নিলোনা, মনেমনে ভাবলো,
---- বৈশাখের ঝড়, একটু বাদেই থেমে যাবে নিশ্চয়ই। কষ্ট করে খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে, বৃষ্টি কমার সাথে সাথে রিকশা সিএনজি সব হাতের কাছে পাওয়া যাবে। এখন গায়ে বৃষ্টি লাগিয়ে কি লাভ? শুধু শুধু।
কিন্তু বলেনা, অভাগা যেদিকে যায়, দূ-কুল শুকিয়ে যায়, অরুর ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে নিশুতি রাতে ছেয়ে গেলো ধরনী,
তবুও বৃষ্টি তো কমলোই না উল্টে ঝড়ের তান্ডবে চারিদিক লন্ডভন্ড।
একাডেমির গেইট বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষন আগে। চারিদিকে মানুষ তো দূরে থাক একটা নেড়ি কুকুরের ও আওয়াজ নেই। রাস্তায় অবশিষ্ট সোডিয়ামের নিয়ন আলোটুকু তীর্যক আলো ছড়াচ্ছে চারিপাশে, তবে ঝড়ের তান্ডবে সেটাও ক্ষীণ মনে হচ্ছে।
প্রথমে ঝুম বৃষ্টি আর এখন দা'নবীয় ঝড়, বিদ্যুৎ এর ঝলকানিতে ক্ষনে ক্ষনে গ'র্জে উঠছে আকাশ। তারউপর ঘূ'র্নিবায়ু। অরুর মনে হচ্ছে এই দূ'র্যোগের মাঝে আশেপাশের জড়বস্তুর মতোই ও নিজেও উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও ছি'টকে পড়বে। কারণ বাতাসের তান্ডবে অরুর রোগা পাতলা তনু শরীরটা ভে'ঙে চু'ড়ে যাওয়ার উপক্রম।
ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়ে বারংবার গগন কাঁপানো বিকট ব'জ্রপাতে কেঁপে উঠছে অরু। ঝড়বৃষ্টি যাও সহনীয় ছিল। কিন্তু এই ব'জ্রপাতের আওয়াজ অরুর কলিজায় গিয়ে লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ওর মাথার উপরেই এসে পরলো বুঝি ভয়'ঙ্কর বিদ্যুৎের হল্কাখানি।
এই ঝড়ের মধ্যে একা একা এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তীব্র ভ'য়ে আর আ'তঙ্কে অরুর গলা শুকিয়ে কাঠ, বুকের কাছটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে, মাথাটা ঝিমুনি দিয়ে উঠছে ক্রমশ।
গেইটের সামান্য সরু ছাউনি ওকে বৃষ্টি কিংবা বজ্রপাত কোনোকিছুর হাত থেকেই রক্ষা করতে পারছে না। প্রকৃতির এমন দান'বীয় বি'ধ্বংসী রূপ দেখে অকস্মাৎ বসে পরে কানে দু'হাত দিয়ে শব্দ করে কেঁ'দে উঠলো অরু। বসার সঙ্গে সঙ্গেই এক তীব্র জলো'চ্ছ্বাসের ছাঁট এসে আঁচড়ে পরলো ওর চোখেমুখে, এমতাবস্থায় না চাইতেও আ'তঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলো অরু,
---- মা, ভয় করছে!!
চারিদিকে প্র'লয়ঙ্কারী ঝড়ের তান্ডব। না চাইতেও ক্রীতিকের চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছে অরুর মানস্পটে। অথচ অরু জানে ক্রীতিক যেই পরিমাণ রে'গে আছে, আজ ভ'য় পাওয়া তো দূরে থাক, অরু ম'রে গেলেও ক্রীতিক নিজের জিদ খুয়িয়ে ওকে নিতে আসবে না, কখনোই না।
ক্রীতিক যদি অরুর খোজ করতো কিংবা অরুর জন্য কোনোরূপ চিন্তাই হতো ওর মনে, তাহলে তো যখন ঝড় শুরু হলো তখনই নিতে আসতো, এতো দেরী করতো না নিশ্চয়ই?
অরু বারবার ভুল প্রমানিত হয়, মিথ্যে আশায় বুক বাধে,মানুষটা ওর উপর রেগে আছে যেনেও তার পথ চেয়ে বসেছিল, এবার হলোতো? ঝ'ড়বৃষ্টির তা'ন্ডবে ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেলো অথচ অরুকে নিতে কেউ এলোনা, কেউ না।
এই পর্যায়ে এসে অরুর মনে হচ্ছে ও আসলেই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়। ক্রীতিকের জীবনে তো অন্তত নয়। কিছু অযাচিত ভাবনায় পরতে পরতে আকাশের প্র'কান্ড গ'র্জনে আবারও কম্পিত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলো অরু,
----আ'মা ভয় করছে!
চিৎকার দেওয়ার পরপরই গা ছেড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো অরু, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
---- আমি বাড়ি যাবো, আমি মায়ের কাছে যাবো,আপার কাছে যাবো, কোথায় তুমি জায়ান ক্রীতিক? এই বিদ্যুৎের আলোতে আমার খুব ভ'য় করছে।
আবারও মুখের উপর জলো'চ্ছ্বাসের ছাট পরার সঙ্গে সঙ্গে আহাজারী বন্ধ হয়ে গেলো অরুর। মনে হচ্ছে চারিদিকের শ'ত্রুরদল ঘিরে রেখে আছে ওকে, অরু একটা টু শব্দ করলে আবারও ওকে মা'রতে এগিয়ে আসবে ওরা। সেই ভেবেই ভয়ের চোটে শুকনো ঢোক গিলে চুপসে গেলো মেয়েটা, অরুর এখন সন্দেহ হচ্ছে কাল সকাল অবধি আদৌও ও বেঁচে থাকবে তো?
এটাই ছিল মূর্ছা যাওয়ার আগে অরুর শেষ ভাবনা, কারন অরুর এখন মনে হচ্ছে ও চেতনা হারাবে খুব শীঘ্রই।
তবে হারালো না, গল্পের পেছনেও যেমন গল্প থাকে, তেমনই অরুর ছোট্ট মস্তিষ্কের ভাবনা যেখানে গিয়ে শেষ হয়, ক্রীতিকের ভাবনা সেখান থেকেই শুরু। অরুর আধোও আধোও চোখ জোড়া শেষবারের মতোন যখন চারিদিকে কাউকে খুজে না পেয়ে সর্বশান্ত, ঠিক সেই সময় দিশেহারা কন্ঠে পেছন থেকে চিৎকার দিয়ে ওকে ডেকে উঠলো কেউ,
---- অরুউউউ!
চেনা পরিচিত আন্তরিকতা জড়ানো পুরুষালী কন্ঠস্বরটা কর্ণগহ্বরে পৌঁছাতেই অকস্মাৎ পেছনে চাইলো অরু, ক্ষনিকের বিদ্যুৎ হল্কানির আলোয় দেখতে পেলো ঝড়ের মাঝে ফুল ফর্মাল গেটাপে বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ওর স্বামী, ওর ব্যক্তিগত পুরুষ, ওর ব'দমেজাজি লোকটা, ওর জায়ান ক্রীতিক।
ক্রীতিক এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু অরু একনজর ক্রীতিকের মুখশ্রী পরখ করেই,মাথাটা নুয়িয়ে তীব্র অভিমানে খুনখুনিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো, ওর কা'ন্নারা ক্রীতিককে স্পষ্ট জানান দিচ্ছে,
---- আরও আগে কেন এলেনা? তুমি জানো আমি কতোটা ভ'য় পেয়েছি?
ক্রীতিকের ঠান্ডার ধাঁচ আছে, একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়, তার উপর ঝড়বৃষ্টির মাঝে শাপলা চত্বরের জ্যামে পরে গাড়িটা ওখানেই ফেলে রেখে হেটে হেঁটে এতোদূর এসেছে।
এখন আবার তার ছোট্ট বউটা অভিমান করে বসে আছে। তাই কয়েকদফা হাঁচি দিয়ে, অরুর কাছে এগিয়ে গেলো ক্রীতিক। প্রথমে অরুর ব্যাগটা নিজের গলায় ঝোলালো, তারপর একটানে অরুকেও কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলো ঝড়ের মাঝেই।
এখনো আগের মতোই ঝড় হচ্ছে, গগন কাঁপানো বজ্রপাতে কম্পিত হচ্ছে ধরনী, অথচ অরু একটুও ভ'য় পাচ্ছে না কি আশ্চর্য!
ভয়ের বদলে এখন ওর মাথায় যেটা ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো কেবলই অভিমান, অভিমানের তোপে হৃদয়টা শক্ত হয়ে আছে ওর, অগত্যাই ক্রীতিকের কোলে বসে সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো অরু, নিজের ছোট ছোট কোমল হাতে ওর চওড়া বুকে ধা'ক্কা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ওঠে ,
---- ছেড়ে দিন যাবোনা আপনার সাথে। আমি একাই যেতে পারবো।
ক্রীতিক নিজের হাঁচি সংবরন করে বললো,
---- বেইবি, দেখ আমার ঠান্ডা লেগে গিয়েছে, যা বলার বাড়িতে গিয়ে বলিস, আমাকে মা'রিস তখন, আমি কিচ্ছু বলবো না, চুপচাপ সহ্য করবো । কিন্তু এখন নামিয়ে তোর রা'গ ভাঙাতে পারবো না, অলরেডি অনেক ভিজেছি। আমার নি'উমোনিয়া হলে তখন কিন্তু তুইই সবথেকে বেশি কা'ন্নাকাটি করবি।
ক্রীতিকের ইমোশনাল ব্লাকমেইলে অরু চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়, অগত্যাই ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে চুপচাপ ফোপাঁতে থাকে অরু।
অতঃপর হেটে মেইন রাস্তায় গিয়ে তবেই একটা সিএনজির দেখা পায় ওরা, সেটাকে বলে কয়ে ডাবল ভাড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই ক্রীতিক কুঞ্জের রাস্তা ধরানো হলো। ক্রীতিক একা থাকলে হয়তো এতো কসরত করতে যেতোনা, মূলত অরুর সেইফটির জন্যই এতো খাটুনি।
*****************************************
রুমে এসে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই অরু এক ছুটে বারান্দায় চলে যায়। পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে, বাইরে তীব্র বর্ষন। অরু, ক্রীতিক দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।
অথচ অরু রাগের চোটে আবারও ছুটে বেলকনিতে চলে গেলো। ক্রীতিক আলো জ্বালানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
বরং দ্রুত হাতে দরজা লক করে, অরুর তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলো বারান্দার কাছে। অরু বৃষ্টির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, ওর পরনে ভেজা টপস আর স্কার্ট। ক্রীতিকের ইন করা সফেদ শার্টটাও ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। ও সে'সবে পরোয়া করলো না,উল্টে এগিয়ে গিয়ে অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন দিক থেকে অরুর ভেজা চুলে ক্রমাগত চুমু খেতে খেতে কাতর গলায় বললো,
---- আ'ম সরি হার্টবিট, ইট’স মাই ফল্ট, আর কখনো এমন হবে না, কখনো তোমাকে এতোটা ক'ষ্ট দেবো না, কালকের জন্য আ'ম রিয়েলি সরি। আর আজ আমি বুঝিনি তুমি এতোটা ভ'য় পাবে, তাহলে আর জ্যামে বসে সময় নষ্ট করতাম না তখনই হাটা ধরতাম।
একান্ত ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে ক্রীতিক অরুকে তুমি করে ডাকছে, তারউপর এভাবে কাকুতি মিনতি করে সরি বলছে। অরু কল্পনাতেও হয়তো ক্রীতিকের এই রূপ আবিষ্কার করেনি কোনোদিন, অথচ আজকে এসব অরুর চোখের সামনে ঘটছে। ভালোবাসা মানুষকে কতটা দূর্বল আর কতটা অপারগ বানিয়ে দেয় তার জলজ্যান্ত প্রমান জায়ান ক্রীতিক।
কাল নিজেই রাগ করলো আর আজ নিজেই সরি চাচ্ছে। ক্রীতিকের এহেন ভালোবাসায় মাখামাখি আওয়াজে নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না অরু।কোনোরূপ ছলচা'তুরী না করেই ক্রীতিকের দিকে ঘুরে ওর চওড়া ঢেউ খেলানো বুকে মাথা এলিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো ও। কাঁদতে কাঁদতে ক্রীতিকের ভেজা শার্টটা খা'মচে ধরে বললো,
---- আমি ভেবেছিলাম আপনি আজ আর আসবেন না, এই ঝড়ের মাঝেই ম'রে পরে থাকবো আমি।
ক্রীতিক গ্রীবাটা নিচে নামিয়ে একহাতে অরুর ভেজা চুল গুলো কানে গুঁজে দিতে দিতে হাস্কিটোনে বললো,
--- না এসে কি করে থাকতাম?আমার আত্নাটা যে তোর মাঝে। হাজার বার বিচ্ছেদের পরেও উপসংহারে আমি তোকেই চাই অরু, শুধু তোকে। নো ওয়ান এলস।
অরু আবারও ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ওঠে, কাঁদতে কাঁদতে শুধায়,
---- কি আছে আমার মাঝে?কেন এতো ভালোবাসা?
ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
---- জানিনা তো, তবে হ্যা, একটা জিনিস আছে যা আমার এখনই চাই, রাইট নাও।
মূহুর্তেই ক্রীতিকের কথার ধরন পাল্টে গিয়েছে, কন্ঠে ভর কাছাকাছি আসার প্রখর আকুতি, তা অরু স্পষ্ট টের পেয়েছে। টের পাওয়ার দরুন, ক্রীতিকের কাছ থেকে ছুটে গিয়ে কয়েক কদম দূরে সরে গেলো অরু।
অরু দূরে সরে যাওয়াতে ক্রীতিক খানিকটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
---- কি হয়েছে?
অরু মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
---- আপনাকে ভ'য় করছে, সেবারের মতো যদি আমাকে হ্যা'ন্ডকাফ্.....
অরুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো ক্রীতিক, অতঃপর ওর লম্বা চুলগুলো সরিয়ে আলতো হাতে অরুর ওড়নাটা টেনে খুলতে খুলতে বললো,
---- এখানে হ্যা'ন্ডকাফ্ কোথায় পাবো হুম? শুধু একটু কথা শুনবি তাহলেই হবে।
অরু আবারও ক্রীতিকের থেকে সরে তারাহুরো পায়ে বেতের সোফায় গিয়ে বসে পরে। অরুর কান্ডে এবার বিরক্ত হয়ে গেলো ক্রীতিক, কিছুটা ধমকে উঠে বললো,
---- কি হয়েছে, রা'গাচ্ছিস কেন আমাকে?
অরু অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ক্রীতিকের পানে, ওর ঠোঁট জুগল তিরতিরিয়ে কাঁপছে। চোখের কোটর নতুন উদ্যমে ভিজে উঠেছে অশ্রুজলে। এমন একটা মূহুর্তে অরুকে কাঁদতে দেখে ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে, অরুকে নিজের উরুর উপর বসিয়ে গভীর গলায় শুধালো,
---- আমার টাচ খারাপ লাগছে? চলে যাবো আমি?
অরু মাথা নুইয়ে না সূচক মাথা নাড়ালো।
ক্রীতিক বললো,
---- তাহলে কাঁদছিস কেন? হোয়াই?
অরু এবার মুখ খুললো, ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
---- সবাই বলে আমি শুকিয়ে গিয়েছি, আগের মতো সৌন্দর্য নেই আমার। ভয় হচ্ছে এখন আপনিও যদি আমাকে অসুন্দর আবিষ্কার করেন, আমার উপর আপনার অনীহা চলে আসে তখন?
ক্রীতিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,এই মেয়ে কেন তার অবসেশনটা বুঝতে পারেনা কে জানে? অরু সুন্দর, অসুন্দর, শুকিয়ে গেলো না মোটা হলো, তা নিয়ে ক্রীতিকের বিন্দু মাত্র মাথা ব্যথা নেই। তার চেয়েও বড় কথা সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করা তো দূরে থাক, অন্য মেয়েদের দিকে ওই চোখে তাকানোর মতোও ধৈর্য নেই ক্রীতিকের, কি করেইবা থাকবে? এক অরুকে দেখতে দেখতেই তো ওর জীবন পার।
ক্রীতিক চুপচাপ বসে আছে দেখে অরু নাক টেনে পেছনে তাকিয়ে শুধালো,
---- রাগ করেছেন?
ক্রীতিক হ্যা না কিছুই বলেনা,কোনোরূপ ও'য়ার্নিং ছাড়াই একটানে অরুর সম্ভ্রমটুকু খুলে ছু'ড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে, সাথে নিজের শার্টটাও, তারপর ওকে কোলে নিয়ে বেডের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
---- আজ আমিও দেখবো কি কমতি আছে তোর মাঝে, যা আমাকে উ'ন্মাদ করে দিতে ব্যর্থ। জায়ান ক্রীতিক যদি তোর সৌন্দর্যে আবিষ্ট হয়ে তোর মাঝে ডুব দেওয়ার জন্য একবার উ'ন্মাদ হয়ে পরে,তবে পৃথিবীর সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে তুই তুলনাহীন বেইবি।
আমাকে যতদিন এভাবে উ'ন্মাদ করতে পারবি, ঠিক ততোদিন তুই অতুলনীয় সৌন্দর্যে আবৃত থাকবি। আর বারবার সেই সৌন্দর্যের সবটুকু পরম আবেশে আহরণ করবো আমি, শুধুই আমি। ইউ ক্যান মার্ক মাই ওয়ার্ড।
ক্রীতিকের এতো ভারী ভারী কথা বোঝার সাধ্যি নেই অরুর। আপাতত ও এসব বোঝার অবস্থাতেও নেই। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া মিষ্টি য'ন্ত্রনায় এলোমেলো অরু, সেই সাথে পরিপূর্ণ ও।
বর্ষনের শেষ রাতে অরুর চোখের কার্ণিশ বেয়ে আবারও গড়িয়ে পরলো কয়েকফোঁটা তপ্ত নোনাজল, তবে এই জলে দুঃখ ছিলোনা, ছিল একরাশ ভ'য়াভহ পূর্ণতা।
*****************************************
বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শেষে আজ সকাল সকালই সূর্যি মামার দেখা মিললো পূবের আকাশে। দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খুলে রাখায় সূর্যের আলোয় ফকফক করছে চারিপাশ। তীক্ষ্ণ আলোতে খুব সকালেই ঘুম ছুটে গেলো অরুর। ঘুম ছুটে যাওয়ায় কিছুটা আড়মোড়া ভেঙে চারিদিকে চোখ ঘুরাতেই ও নিজেকে আবিষ্কার করলো ক্রীতিকের শরীরের নিচে।
ক্রীতিক উপুর হয়ে অরুর বুকে মাথা রেখে,দু-হাতে অরুর কোমড় জড়িয়ে ধরে নির্বিগ্নে ঘুমুচ্ছে। অরু ঘুমু ঘুমু চোখে লাজুক হেসে খানিকক্ষণ ক্রীতিকের সিল্কি চুলের ভাঁজে হাত বোলালো, তারপর আস্তে করে রয়ে সয়ে উঠে গেলো বিছানা থেকে।
শরীরটা ব্য'থায় টনটন করছে, মনে হচ্ছে অতি শীঘ্রই জ্বর আসবে, অরু সেসব ব্যথাকে পাত্তা দিলোনা। বিশাল হাই তুলে, খাট থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ড্রেসিন টেবিলের সামনে। মেঝেতে এখনো ওদের ভেজা জামা কাপড় গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরু সেদিকে একনজর পরখ করে, চোখ ঘুরিয়ে আয়নায় তাকালো, ওর পড়নে ক্রীতিকের গ্রে রঙের ওভার সাইজ টিশার্ট।
কাল গভীর রাতে এলিসাকে কল দিয়ে নিজের ক্লজেট থেকে কিছু জামা কাপড় আনিয়েছিল ক্রীতিক। অরু আবার তাতেও ভাগ বসিয়েছে, ট্রাউজারটা ক্রীতিককে দিলেও টিশার্ট টা নিজেই পরে নিয়েছে। আর এখন সেটাকে নাকের কাছে নিয়ে বারবার নাক টেনে সুঘ্রাণ নিচ্ছে, ওর পছন্দের স্যান্ডাল উড পারফিউমের মন মাতানো সুঘ্রাণ।
---- কিসের ঘ্রান নিচ্ছিস এভাবে?
ক্রীতিকের ঘুমন্ত হাস্কিস্বরে লাফিয়ে উঠলো অরু। চকিতে পেছনে চেয়ে দেখলো হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ক্রীতিক। অরু নিজের কান্ড এড়াতে এগিয়ে গিয়ে নিজের কালসিটে কলার বোন গুলো দেখিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,
---- দেখুন তো কি করেছেন কাল রাতে, সব জ্ব'লে যাচ্ছে।
ক্রীতিক দু'হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
---- বুকে আয়।
অরু গেলো। ক্রীতিক অরুর গলায় কয়েকদফা চুমু খেয়ে বললো,
---- কমে যাবে এন্টিসেফটিক লাগিয়ে নিস।
অরু ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে কোনো কথা নেই। ক্রীতিক অরুকে বাহুর মধ্যে নিয়েই পকেট থেকে দুটো আঙটি বের করলো, একটাতে পাথর বসানো, পাথরের চিকচিক দেখে মনে হচ্ছে দামি কোনো হিরে। অন্যটা শুধু হোয়াইট গোল্ডের গোলাকার রিং।
ক্রীতিক একটা রিং নিজের আঙুলে পরে অন্যটা অরুর অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিলো। অরু চিকচিক করতে থাকা হাতের আংটি টা নাড়িয়ে চাড়িয়ে শুধালো,
----- এটা কেন?
ক্রীতিক বললো,
---- তুই যে বিবাহিত তার প্রমান, তাছাড়া বিয়ের পর থেকেই এতো এতো ঝামেলা যে তোকে একটা আংটি কিনে দেওয়ার সুযোগ ও হয়নি আমার, তাই কাল শপিং এ গিয়ে কিনে ফেললাম, পছন্দ হয়েছে?
অরু মুচকি হেসে জবাব দিলো,
--- খুউউব।
----তাহলে চুমু খা।
ক্রীতিকের কথায় অরু ভড়কে গিয়ে বললো,
---- কিহ।
---- চুমু খেতে বলেছি তোকে, আমার টাইম নেই অরু, যেতে হবে।সায়র আর অর্ণব কল করতে করতে ফোনের মাথা খেয়ে ফেলছে। এই রুমে এভাবে দেখে ফেললে হুলস্থুল লাগিয়ে দেবে ওরা দুজন । তুই কি চাস আমাদের এভাবে দেখুক ওরা?
অরু শুকনো মুখে না সূচক মাথা নাড়ালো।
ক্রীতিক পুনরায় বললো,
---- তাহলে যা বলছি তাই কর, দ্রুত।
অরুর আর কিইবা করবে স্বামী মহোদয়কে খুশি করার এক আকাশ ইচ্ছে সরূপ ছোট্ট করে হামি দিয়ে দিলো গালে। ক্রীতিক অরুর কপালে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
------ ডোন্ট ফরগেট টু টেইক ইউর পেইন কিলার বেইবি।
*****************************************
ফ্রেশ হয়ে এসে ক্রীতিকের টিশার্ট ছেড়ে মাত্রই নিজের জামা কাপড় গায়ে চড়িয়েছে অরু, ওড়নাটা এখনো নেয়নি যার দরুন গলার দা'গ গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। অরু সেগুলোতে আলতো হাতে এন্টিসেফটিক লাগাচ্ছিল,ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে অনু। ভেতরে আসতে আসতে অনু বলে,
----- শুনেছিস রূপাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাও কাল রাত থেকে।
অরু হাতের কাজ রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
---- কি বলিস আপা?
অনু আর কথা আগানোর সুযোগ পেলোনা, উল্টো চোখ ছোট ছোট করে অরুর দিকে সন্দিহান হয়ে তাকিয়ে বললো,
---- কাল রাতে ক্রীতিক ভাইয়া তোর রুমে ছিল?
আপার প্রশ্নে অরু হা না কিছুই বললো না, ধরা খেয়ে যাওয়া চোরের মতো শুধু উপর নিচ মাথা ঝাকালো কিছুক্ষণ ।
অনু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবলীল ভঙ্গিতে বলে,
---- জানি, কাল আমিই ক্রীতিক ভাইয়াকে কল করেছিলাম, তুই বাড়িতে ফিরছিলি না দেখে।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৪৪
কাল সারা রাত বৈশাখী ঝড় দা'নবীয় তান্ডব চালিয়েছে পুরো শহর জুড়ে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, গাছপালা উপড়ে পরে বিভিন্ন লেনের যান চলাচল বন্ধ। অতিরিক্ত বৃষ্টি পাতে পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে, থোঁকায় থোঁকায় বাগান বিলাশ গুলো ঝড়ে পরে আছে পিচে ঢাকা ফ্রন্ট ইয়ার্ড জুড়ে।
অনুর সন্দিহান দৃষ্টিপাত এড়াতে লাজুক অরু খোলা জানালা গলিয়ে বাইরে চেয়ে আছে সেই তখন থেকে, সারারাত ঝড়ের তোপে কেমন নেতিয়ে পরেছে সৌন্দর্য বর্ধক গাছপালা গুলো। আজ সূর্য উঠেছে,গাঢ় তার সোনালী কীরণ। খুব সম্ভবত দুপুর গড়াতেই গাছগুলো আবার আগের রূপ ধারণ করবে।
এই মূহুর্তে অনুর নিজেরও বেশ ইতস্তত বোধ হচ্ছে অরুর সাথে কথা বলতে, কি বলতে কি বলে ফেলেছে । ওই জন্যই তখন থেকে ওদের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান।
এই অসস্থিদায়ক মূহুর্তটাকে কোনো মতে এরিয়ে যাওয়ার দরুন হাতের আঙুলে ওড়না প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে অনুই ডেকে উঠলো প্রথমে,
---- বলছিলাম যে অরু, ইয়ে মানে,বলছিলাম...
---- এ্যাই আপা, আজকে তোদের প্রি ওয়েডিং পার্টি না? রাতে কতো মজা হবে বলতো?
অনুকে কথা বাড়ানোর কোনোরূপ ফুরসত না দিয়েই পেছনে তাকিয়ে ফট করে কথাটা বলে উঠলো অরু। ভাবটা এমন যেন ও নিস্পাপ একটা বাচ্চা, বিয়ে,বাসর, কিংবা জায়ান ক্রীতিক এসবের কোনোদিন নাম ও শোনেনি ও।
অরুর কথায় সস্থি পেলো অনু, তৎক্ষনাৎ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---- হ্যা এলিসা আপুরা আয়োজন করছে শুনলাম, আমাদের দেশে আবার এসব হয় নাকি? কিন্তু...
মূহুর্তেই ভার হয়ে এলো অনুর মুখশ্রী, আধার ঘনালো পান পাতার মতো উজ্জ্বল মুখটাতে।
অরু এগিয়ে এসে শুধালো,
---- কিন্তু কি আপা?
অরুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির পাছে অনু জবাবের উৎস খুঁজে পেয়েছে কি পায়নি, তার আগেই, নিচতলা থেকে প্রচন্ড চেঁচামেচির আওয়াজে দু'বোন হকচকিয়ে উঠলো ওরা।
আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে কেউ কাউকে মা'রছে খুব , সকাল সকাল আবার ক্রীতিক কারোও সাথে ঝা'মেলা শুরু করলো নাতো? কথাটা বোধগম্য হতেই কলিজার পানি শুকিয়ে এলো অরুর। এই মানুষটা ঝামেলা মা'রামা'রি এসব না করে অরুকে একদন্ড শান্তি দিতে পারেনা নাকি?
না পারেনা, কারণ সে তো দ্য গ্রেট অ'সভ্য, উ'গ্র, বে'পরোয়া, ছ'ন্নছাড়া,জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। যার কাজই হলো সকাল সন্ধ্যা ঝামেলা পাকানো।
অরুর নিস্ফল ভাবনার ছেদ ঘটে আবারও নিচ তলার তীব্র শোরগোলের আওয়াজে। ভ্রম ছুটে গেলে অরু আর এক মূহুর্ত ও অপেক্ষা করেনা, ওড়নাটা কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে, দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অনুকে বলে,
---- আপা চলতো, আবার কি হলো দেখে আসি।
অরুর কথায় উপুর নিচ মাথা নাড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে দোতলা ছাড়লো অনুও।
ওরা দু'বোন যখন প্রচন্ত চিন্তায় উদ্বিগ্ন মস্তিষ্কে দ্রুত কদমে নিচে নেমে এলো, তখন অন্দরমহল পুরোপুরি নিরব।
অরু, অনু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে, হলরুমের মাঝ বরাবর পায়ের উপর পা তুলে ডিভানে বসে আছে ক্রীতিক। ওর আশেপাশে সায়র, অর্ণব, এলিসা,ক্যাথলিন, মোখলেস চাচা সবাই আছে। আজমেরী শেখ ও অন্য একটা কাউচে বসে আছেন।
সবার সামনে চরম অ'পরাধীর ন্যায় মেঝেতে বসে বসে কাঁদছে রুপা। দেখে মনে হচ্ছে এতোক্ষণের ঝ'ড় টা ওর উপর দিয়েই বয়ে গিয়েছে।
কারণ ওর দিকে তাকিয়ে এখনো রা'গে ফো'সফাস করছেন জাহানারা। তার আ'গুনের ফু'লকির মতো চোখজোড়া দেখে মনে হচ্ছে পারলে আরও কয়েক ঘাঁ বসিয়ে দেয় রুপাকে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে তার হাত আটকে আছে, শক্তি বলটা কি তাহলে জায়ান ক্রীতিক? ভাবছে অরু।
চারিদিক অবলোকন করে অরু হিসহিসিয়ে অনুকে শুধালো,
--- আপা, কি হয়েছে বলতো?
অনু জবাব দেয়,
---- কাল সন্ধ্যা বেলায় টিউশনে গিয়ে সারারাতেও আর বাড়িতে ফেরেনি রুপা, রেজা ভাই গিয়েছিল ওকে আনতে, কিন্তু গিয়ে শোনে রুপা নাকি টিউশনিতেই যায়নি। কোনো এক ছেলের সাথে ভেগেছে, তাই সকাল সকাল মামি এসেছিল ক্রীতিক কুঞ্জে, মাকে বলে কয়ে কিছু একটা উপায় বের করানোর জন্যে। সেটা জানাতেই তো আমি তোর রুমে গেলাম তখন। আর এখন এসব।
ওদের কথোপকথনের মাঝেই অন্দরমহলে প্রবেশ করেন অরুর মামা, তিনি চারিদিকের থমথমে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উঠতে না পেরে তার স্ত্রী জাহানারার দিকে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
---- কি হয়েছে, মেয়েটা এভাবে মেঝেতে বসে কাঁদছে কেন?
স্বামীর কথায় গর্জে উঠলেন জাহানারা, রুষ্ট গলায় বললেন,
---- সেটা তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো, সারারাত একটা ছেলের সাথে ফ'ষ্টিন'ষ্টি করে, মান সম্মান খুয়িয়ে এখন ঘরের চৌকাঠ মাড়িয়েছে, ওকে মে'রে ফেলো রেজার বাবা, নইলে আমি মহল্লায় মুখ দেখাতে পারবোনা। যেই জাহানারা সবাইকে কথায় দাবিয়ে রাখে, মুখের জোরে সবাইকে ওঠায় বসায়, আজ তার মেয়ে হয়ে ও কিনা এমন একটা নোং'রা কাজ করে ফিরলো? ছিহ!
এখন আমি ওকে দিয়ে করবো টা কি বলতে পারো?
অরুর মামা কিছুটা শান্তস্বরে বললেন,
--- আহ, এভাবে বলছো কেন?
জাহানারা পুনরায় ঝাঁজিয়ে উঠে বললেন,
---- বলবোনা তো কি করবো? তোমার মেয়েকে গাড়ি করে কয়েকটা ছেলে মহল্লার মাঝখানে ফেলে রেখে গেছে। সবাই দেখেছে, কানাঘু'ষায় পুরো মহল্লা গরম, তোমার কি মনে হয়, এই মেয়ের আর বিয়ে হবে কোনোদিন? মুখপু'ড়ি সব খুয়িয়ে এখন আবার ফিরলি কেন?
এই বলে জাহানারা আবারও রূপাকে মা'রতে উদ্যত হবেন, ঠিক তখনই জাহানারা বরাবর কথার তী'র ছো'ড়ে ক্রীতিক,
---- স্টপ ইট,আই হেইট নয়েজ।
ক্রীতিকের গর্জনে থেমে গেলেন জাহানারা, জাহানারা থেমে যেতেই ক্রীতিক তীর্যক কন্ঠে পুনরায় বললো,
---- ঠিকই বলেছেন আপনি,আপনার মেয়ের কোথাও বিয়ে হবেনা, লোকজন আপনার সম্মুখে ছি ছি বুলি আওরাবে, এর কারণ অবশ্য আপনি নিজেই, লোকজনের হাঁড়ির খবর ঘেঁটে কাসুন্দি বানিয়েছেন এতোদিন। এখন সয়ং আপনার মেয়ের পালা,তারা তো এবার আপনাকে আখমাড়াই করবেই। এতে কোনো ভুল নেই।
ক্রীতিকের কথায় জাহানারা জবাব খুঁজে পেলোনা, জবাব দেওয়ার মতো কিই'বা আছে? কথা তো সত্য।
আজমেরী শেখ এখনো চুপচাপ, তিনি ক্রীতিকের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়, আসলে চাইছেটা কি ক্রীতিক? সেটাই আপাতত ভাবছেন তিনি। অনু, অরু এখনো চুপচাপ শুকনো মুখে ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রীতিক স্পষ্ট চোখে একনজর অরুর দিকে তাকালো, অতঃপর সবার সামনেই ওকে ডেকে বললো,
---- বেইবি, একগ্লাস পানি নিয়ে আয়তো, সকালে ব্রেকফাস্ট করে পানিটাও খেতে পারিনি।
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলে,ক্রীতিকের কথায় মোখলেস চাচা হকচকিয়ে বলে ওঠেন,
---- আমি নিয়ে আসছি বাবা।
ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বাঁধ সেধে বললো,
---- আমার বউ আছেতো এখানে, আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।
মোখলেস চাচাকে হুকুম করে, পরক্ষণেই জাহানারার দিকে তাকিয়ে ক্রীতিক বলে,
---- রূপাকে মোখলেস চাচার সাথে বিয়ে দিয়ে দিন। মোখলেস এখনো অবিবাহিত বয়স খুব বেশি না মাত্র পয়তাল্লিশ বছর।
ক্রীতিকের কথায় যেন বাজ পড়লো পুরো হলরুম জুড়ে। আজমেরী শেখ তৎক্ষনাৎ তেতে উঠে বললেন,
----- ক্রীতিক!এবার একটু বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, অফিসেও তুমি আমার অমতে ইচ্ছে মতো রুলস দিয়ে যাচ্ছ আর এখন বাড়িতেও?
ক্রীতিক হাতের ইশারায় আজমেরী শেখকে থামিয়ে জিভ দিয়ে গাল ঠেলে বললো,
---- আমার কথা এখনো শেষ হয়নি মাদার ইন ল্। তাছাড়া ডিল টা আপনার আমার মাঝে হচ্ছে না, ডিল হচ্ছে আমার আর ওনার মাঝে, চোখ দিয়ে জাহানারাকে ইশারা করে ক্রীতিক।
---- তাই আপাতত আপনার মতামত গ্রহনযোগ্য নয়।
আজমেরী শেখ আর কথা না বাড়িয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেলে জাহানারা রেগেমেগে বলেন,
---- তাই বলে বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে আপনি আমার মেয়ে....
জাহানারা কথা শেষ করার আগেই কথা ছুড়লো ক্রীতিক, বললো,
----- বিয়ে হয়ে গেলে আমার বনানীর ফ্ল্যাটটা আমি মোখলেস চাচা আর রুপার নামে উইল করে দেবো।এছাড়া মোখলেস চাচাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী জেকে গ্রুপে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হবে।আফটার অল আপনারা আমার বউয়ের পরম আত্নীয় এতোটুকু দায়বদ্ধতা তো আমার আছেই, রাইট?
ক্রীতিকের ছু'ড়ে মা'রা মেঘ না চাইতে জলের মতোন অফার শুনে জাহানারার চোখ বিস্ময়ে চিকচিক করে উঠলো। বনানীতে নিজস্ব ফ্ল্যাট তো তার বাবা দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর ও সাধ্যের বাইরে, সেখানে ক্রীতিক কিনা এমনি এমনি দিয়ে দেবে? জাহানারার চোখেমুখে লোভাতুর দৃশ্য ভেসে উঠেছে, ভেতরে ভেতরে টগবগ করছে কামনার লাবডুড। জাহানারা তখন থেকে চুপ হয়ে আছেন দেখে অরুর মামা এবার ক্রীতিকের কথায় নাকোচ করে বললো,
---- অসম্ভব, তাই বলে মেয়েকে এমন চল্লিশোর্ধ লোকের সাথে বিয়ে দেবো নাকি?
অরুর মামার রাশভারী কথা তখনই থেমে গেলো, যখন পাশ থেকে জাহানারা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
---- তুমি চুপ করো একদম, কে বিয়ে করবে তোমার এই অ'পয়া, হত'চ্ছা'ড়া, ন'ষ্টা মেয়েকে? যা হয় ভালোর জন্যই, উনি আমাদের ভালোর জন্যই একথা বলেছেন, চুপচাপ বিয়েতে মত দাও। তাছাড়া ওমন বিশাল ফ্ল্যাটের মালিক হলে মোখলেস কে জামাই বানাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।
এদিকে এই কাহিনির মূল চরিত্র মোখলেস চাচা এখনো হতবিহ্বল চোখে একে একে সবার কথা শুনে যাচ্ছে, ক্রীতিক কি আসলেই তাঁকে বিয়ে দিয়ে, তার এতো বছরের বি'ষাদময় আইবুড়ো নাম ঘোঁচাবে নাকি? সেটাই আপাতত ভাবছে মোখলেস চাচা।
সবার মাঝে নিরবতা বিরাজমান, শুধু মাত্র রুপা মায়ের হাত পা ধরে কা'ন্নাকাটি করছে, যাতে তাকে মোখলেস চাচার কাছে বিয়ে না দেওয়া হয়। অনু আর অরু মামিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জাহানারা তার সিদ্ধান্তে অনর, তিনি উল্টে খানিকটা দোনোমোনো করে ক্রীতিককে প্রশ্ন করেই বলেন,
---- বলছি যে,বিয়েটা হয়ে গেলে সত্যি ফ্ল্যাট পাবেতো ওরা?
ক্রীতিক গভীর গলায় বললো,
---- এখন বিয়ে হলে, উইলটাও এখনই হবে, আমার কাগজ পত্র সব রেডি।
ক্রীতিকের কথায় জাহানারা পুলকিত হয়ে নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো,
---- ওগো তাহলে আর দেরি কেন? কাজী আনার ব্যবস্থা করো,
আজকেই বিয়ে হবে ওদের।
অরুর মামা খুব যে সৎ মানুষ তা নয়, টাকা,অধিপত্য এসবের লো'ভ তারও আছে, মেয়ের সূত্র ধরে যদি এভাবে রাতারাতি লাখ পতি হয়ে যাওয়া যায় তো ক্ষতি কি? হোক বিয়ে, মেয়ে তো আর পানিতে পরে যাচ্ছে না, উল্টো মোখলেস কে জামাই বানিয়ে নাকের ডগায় দড়ি দিয়ে ঘুরানো যাবে, ব্যাপারটা মন্দ হবেনা।
অবশেষে মনেমনে হাজারো লাভ লসের হিসেব কষিয়ে তবেই তিনি চললেন কাজী খোঁজার উদ্দেশ্যে।
শেষমেশ নানান জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে রুপার বিয়ে হতে-হতে সকাল গড়িয়ে বিকেল হলো। একহাতে রুপাদের বিয়ে হয়েছে, আর অন্যহাতে ফ্ল্যাটের চাবি উঠেছে জাহানারার কোমরের গোছায়।
আজমেরী শেখের কিছু বলার ছিলোনা, বললেও হয়তো জাহানারা পাত্তা দিতেন না। তাই নিজের গুরুগম্ভীরতা ধরে রাখতে চুপই রয়েছিলেন তিনি। আজকাল ক্রীতিকের কর্মকান্ডে তিনি শুধুই নিরব দর্শক মাত্র। কোনো কিছু বলার বা ক্রীতিককের বাইরে গিয়ে কোনো সিন্ধান্ত নেওয়ার হেতু রাখেনা ক্রীতিক। ব্যাপারটা আজমেরী শেখের নিকট চ'রম বি'রক্তির পর্যায়ে উঠে এসেছে, তাও তিনি নিশ্চুপ।কারন একটাই, অনুর বিয়ে। অনুর বিয়েটা সর্বোত্তম পন্থায় দিতে চান তিনি। তারপর না হয় একে একে দান চালা যাবে। তাড়াহুরোর কিছু নেই। তাছাড়া আজমেরী শেখের তাড়াহুড়ো জিনিসটা পছন্দও নয় মোটে ।
আজ যেহেতু বিয়ের প্রথম দিন তাই মেয়ে জামাইকে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছেন জাহানারা।
কে জানে? হয়তোবা অনুর বিয়ে উপলক্ষে দুয়েক একদিন বাদে আবারও পুরো পরিবার শুদ্ধ ক্রীতিক কুঞ্জে হাজির হবেন তিনি।
* অরু তরিঘরি পায়ে মাত্রই প্রবেশ করেছে ক্রীতিকের রুমে।রাগের তোপে শরীরটা রি রি করছে ওর। এখানে আসতে আসতেই ঠিক করে নিয়েছে যা হওয়ার হয়ে যাক আজকে ক্রীতিক কে কিছু কড়া শুনিয়ে তবেই এখান থেকে যাবে ও।
ক্রীতিক তখন রুমেই ছিল, আপাতত তার মনোযোগ ল্যাপটপে নিবদ্ধ। অরু ভেতরে গিয়ে আচমকা ক্রীতিকের মুখের সামনেই ল্যাপটপটা ঠাস করে বন্ধ দিলো।
অরুর কান্ডে ক্রীতিক কিছুটা রাগী গলায় বললো,
----- হোয়াট্স রং অরু?কাজ করছি তো।
অরুর এক অগাধ বিশ্বাস ক্রীতিক ওকে পা'গ'লের মতো ভালোবাসে, অন্য সবার সাথে যাই করুক না কেন,তবে অরু যদি ক্রীতিকের কলিজাটাও চি'বিয়ে খে'য়ে নে'য় তবুও ক্রীতিক টু শব্দটাও করবে না, সেই সাহস থেকেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ও বললো,
---- কাজ পরে করবেন, আগে বলুন এতো বড় একটা অ'ন্যায় কেন করলেন? মামীকে লো'ভ দেখিয়ে কেন মোখলেস চাচার মতো একটা চল্লিশোর্ধ লোকের সাথে রুপার বিয়ে দিলেন?বিয়ে কি একটা ছেলে খেলা?যে যার সাথে খুশি যেভাবে খুশি বিয়ে দিয়ে দিলেন?
আমি খুব ভালো করে জানি রুপা উধাও হওয়া থেকে শুরু করে এতো কাহিনীর পেছনে নিশ্চয়ই আপনার হাত আছে, বলুন কেন করেছেন এসব?
অরুর একাধারে বলে যাওয়া ননস্টপ কথার বহরে কান না দিয়ে পুনরায় ল্যাপটপে মন দিয়ে ক্রীতিক শান্ত স্বরে বললো,
---- বড়দের কথা এতো জানতে হয়না অরু, ভুলে গিয়েছিস আমি যে তোর বারো বছরের বড়?
ক্রীতিকের কথায় অরু বিরক্ত হয়ে বললো,
----- তা এতোই যখন আপনি বড়, আমি যে আপনার বারো বছরের ছোট সেটা কাল রাতে মনে ছিলোনা? এতো করে বলেছিলাম ছাড় দিয়েছিলেন একটুও? তখন তো নো ওয়ে, নো ওয়ে, করছিলেন।
অরু রাগে ফোসফাস করছে। কি বলছে, না বলছে, কিচ্ছু খেয়াল নেই ওর। তাই ক্রীতিক এবার উঠে গিয়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে সটান দাঁড়িয়ে পরলো, অতঃপর ঘাড়টা একটু নিচু করে নরম, শান্ত, গলায় শুধালো,
----- কি হয়েছে, এতো রেগে আছিস কেন?
অরু ঠোঁট উল্টিয়ে শক্ত গলায় বললো ,
---- কেন করলেন এটা?
রাগের তোপে তিড়তিড়িয়ে কাঁপতে থাকা অরুর ফিনফিনে ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
----- তুই আমাকে না বললেও তোর শরীর আমাকে বলে দেয় অরু, আমার অবর্তমানে তোর উপর দিয়ে ঠিক কতটা ঝ'ড়ঝাপটা গিয়েছে। শুধু মাত্র আমাকে ভালোবাসার অ'পরাধে, আমাদের বিয়েটা মেনে নেওয়ার অ'পরাধে, তোর আশেপাশের মানুষ গুলো তোকে ঠিক কি পরিপান মানসিক য'ন্ত্রনায় ভুগিয়েছে সেটা তোর চেহারা, তোর শরীর দেখেই বুঝিয়ে গিয়েছি আমি।
ইউ এস এ থেকে আসার পর তোর অবস্থা দেখে নিজেকেই নিজের শা'স্তি দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। তোকে যতবার চোখের সামনে দেখছিলাম ততবারই নিজের রা'গ সামলাতে পারছিলাম না আমি।মস্তিষ্ক আ'গুন হয়ে উঠছিল আমার। ইচ্ছে করছিল আরও আগে দেশে না ফেরার শা'স্তি সরূপ নিজেকেই নিজে শেষ করে দিই। ফলস্বরূপ তোকে বারবার এড়িয়ে গিয়েছি।
অরু এখনো প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ডাগর ডাগর চোখ দুটো কৌতুহলে পরিপূর্ণ। ওর কৌতুহলের জোয়ারে কিছুটা ভাটি দিতে আবারও বলা শুরু করে ক্রীতিক,
----- মনে আছে অরু? আমি বলেছিলাম, তুই নিশ্চিন্তে থাক পুরো দুনিয়া আমি দু'হাতে সামলে নেবো। যে সমাজ আমার বউয়ের দিকে আঙুল তুলবে সেই সমাজের নিয়মই আমি পাল্টে দেবো।
হয়তো কিছুটা দেরী হয়েছে,কিন্তু আমি সেটাই করেছি, সমাজের রিপ্রেজেন্টার হিসেবে তোর মামী তোর দিকে বারবার আঙুল তুলেছে, তোর আমার বয়সের পার্থক্য নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। তোর শরীরে আমার করা ভালোবাসার স্পর্শ গুলোকে নোং'রা বলে আখ্যায়িত করেছে। ওই জন্যই আমি ওনার কথার বান ওনাকে দিয়েই কাটিয়েছি।
আজ প্রথমে ওনার মেয়ের শরীরে নোং'রা স্পর্শের ক'লঙ্ক উঠেছে, পুরো মহল্লার কাছে খা'রাপ আ'খ্যায়িত হয়েছে, তারপর দিন শেষে লো'ভের তাড়নায় উনিই আবার ওনার মেয়েকে এমন একজন লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছেন, যার সাথে ওনার মেয়ের বয়সের পার্থক্য এক, দুই, কিংবা বারো বছর নয়, গুনে গুনে ছাব্বিশ বছর।
আজ থেকে তোর মামী আর তোর সামনে, সমাজ নিয়ে টু শব্দও করবে না অরু। কারন আমি সমাজের নিয়মটাই ভে'ঙে দিয়েছি।
ক্রীতিকের কথায় হতবাক হয়ে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে অরু, চোখ দুটো আগের চেয়েও বৃহৎ আকৃতি ধারণ করেছে, মনেমনে ভাবছে,
---- মানুষ এতোটা গভীর আর সুকৌশলি চিন্তা কিভাবে করতে পারে?
অরু তখন থেকে হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
---- কি বউ? সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলোতো?
অরু নির্লিপ্ত চোখে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক ওকে বুকের মধ্যে টেনে এনে বললো,
---- চিন্তা নেই,মোখলেস চাচা মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তাছাড়া ওরা যাতে ভালো থাকে সে সব ব্যবস্থা আমি নিজ হাতে করবো। তারচেয়েও বড় কথা রুপা যার সাথে পালিয়েছিল সেই ছেলেটা মোটেও সুবিধার না এক কথায় ডা'কা'ত বলতে পারিস। আ'ম সিওর ও রুপাকে দূরে কোথাও নিয়ে পাঁ'চা'র করে দিতো।
অরু নিজের নরম দু'হাতে ক্রীতিকের চওড়া পিঠখানা আঁকড়ে ধরে ওর শক্ত বুকের মাঝ বরাবর মুখ দাবিয়ে দিয়ে বললো,
----- আপনি কি জানেন? আপনি একটা বেস্ট হাসবেন্ড? সবার থেকে বেস্ট। আজ থেকে আপনি যে নিশানা ধরে পথ এগোবেন, আপনার ফেলে যাওয়া সেই পায়ের ছাপে পা রেখে চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যাবো আমি, প্রমিস। এই যে পিংকি প্রমিস।
মিষ্টি হেসে কথাটা বলে ক্রীতিকের খরখরে কনু আঙুলের ভাঁজে নিজের কোমল তুলতুলে কনু আঙুলটা প্রবেশ করালো অরু।
........................................................................
𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃
***Download NovelToon to enjoy a better reading experience!***
Updated 62 Episodes
Comments