সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]

#পর্বঃ৪৪

যেহেতু নিজেরা নিজেরা, এদেশে ওদের চেনা পরিচিত তেমন কেউ নেই, তাই প্রি ওয়েডিং এর পার্টিটা ক্রীতিক কুঞ্জের ছাদেই আয়োজন করা হয়েছে।

মাত্রই কেক টেক কেটে মাদুর পেতে আড্ডা দিতে বসেছে সবাই। আগামী কাল অনু প্রত্যয়ের গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে, তারপর সারা জীবনের জন্য এই পরিবারের অতিথি হয়ে যাবে অনু।

অরুর তো তাও বাড়িতেই বিয়ে হয়েছে, তারউপর ক্রীতিক ওকে বাচ্চাদের মতো করে আগলে রাখে, কিন্তু অনুকে তো শশুর বাড়ি যেতে হবে, পুরো একটা আলাদা পরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে, দিন রাত সংসার সামলাতে হবে, সেসব ভাবতে গেলেই প্রত্যয়কে নিজের করে পাওয়া, বিয়ের আনন্দ সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে অনুর হৃদয়ে।

এই আড্ডাতে অনু ছাড়াও আরও একজনার মুখটা মলিন হয়ে আছে, সে হলো এলিসা। যার কিনা এই বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল,সেই সকাল থেকে মুখ ভার করে বসে আছে। প্রয়োজনের বাইরে কারও সাথে একটা কথাও বলছে না, কি অদ্ভুত?

অনুর মন খারাপের কারন জানে অরু, কিন্তু এলিসার এই মাত্রাতিরিক্ত বি'ষন্নতা কিছুতেই ধরতে পারছে না ও। অরু যখন চোখ মুখ কালো করে এলিসার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে এসব ভাবছিল,তখনই কনুই দিয়ে সামান্য খোঁ'চা মে'রে ওকে ডেকে উঠলো নীলিমা, শুধালো,

---- কি ভাবছিস বলতো তখন থেকে?

নীলিমার ডাকে ধ্যান ভাঙে অরুর, ও না সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,

----- কিছুনা।

অতঃপর পুনরায় মন দিলো সবার সাথে আলাপ চারিতায়। আপাতত সায়রই বকবক করে যাচ্ছে সবার মাঝে। অর্ণব গিটার নিয়ে বসেছে গান গাইবে বলে। অনু আর প্রত্যয় চোখে চোখে হাজারো কথা আদান-প্রদান করছে।

ক্রীতিক সবার সাথে আড্ডা দিতে বসেছে ঠিকই, তবে তার ধ্যান জ্ঞান সবকিছুই ম্যাকবুকে নিবদ্ধ। নতুন নতুন অফিস জয়েন করার পর থেকেই সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে ও। কি জানি, কি করে?

ক্যাথলিন এলিসার কাধে মাথা রেখে অর্ণবের করা গিটারের টুংটাং আওয়াজে মন দিয়েছে। নীলিমা অরুর পাশে বসেই সায়রের সাথে একের পর এক যুক্তিবিদ্যায় ব্যস্ত।

একমাত্র অরুই চুপচাপ সবাইকে গভীর চোখে কে পরখ করছে। সায়র কি ভেবে যেন কথার একপর্যায়ে হুট করেই বললো,

---- গাইস চলো সবাই ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলা যাক।

আশেপাসের উৎসুক জনতা সবাই একে একে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেও ক্রীতিক কিবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে গভীর গলায় বললো,

----- আমাকে এসব ডেয়ার ফেয়ার দিলে খবর আছে তোর সায়র।

ক্রীতিকের কথায় সায়র বিরক্ত কন্ঠে বললো,

---- এখানে আছিস মানে তোর খেলায় অংশগ্রহন করতে হবে নো ক'ম্প্রোমাইজ।

কথা শেষ করে একটা খালি হুইস্কির বোতল সবার মাঝে ঘোরালো সায়র, বোতল ঘোরাতেই সবার আগে ফেঁ'সে গেলো বেচারি নীলিমা। সায়র নীলিমার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

---- কি সাহসী আব্বাজানের সাহসী কন্যা, ট্রুথ না ডেয়ার?

নীলিমা ঠোঁট বেকিয়ে বললো,

---- ডেয়ার ফেয়ার পারবো না, ট্রুথ।

সায়র নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

---- ঠিকাছে বলো তাহলে, বয়ফ্রেন্ড আছে?

নীলিমা দাঁত কটমটিয়ে মনে মনে বললো,

---- ব'দমা'শ, বিদেশি বা'ন্দর, জানতাম তুই ভুলভাল কোশ্চেনই করবি আমায়।

---- কি ভয় পেয়ে গেলে নাকি রাগীনি?

নীলিমা থমথমে গলায় উত্তর দিলো,

---- না নেই।

নীলিমা জবাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তেতে উঠলো সায়র,সবার সামনেই ঝড়ের গতিতে নীলিমার দিকে ঝুঁকে গিয়ে চোখ মুখ খিঁচিয়ে বললো,

----- বিএফ নেই তো আমাকে একটা চান্স দিতে পারতে, শুধু শুধু আব্বাজানকে দিয়ে তাড়া খাওয়ানোর মানেটা কি ছিল? তোমাদের মেয়েদের এতো ভাব কেন বলোতো?

সায়রের কান্ডে নীলিমা খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে, শুষ্ক ঢোক গিললো।

ওদিকে সায়রের ভাবসাব এমন যে আজকে নীলিমার সাথে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে ও। কেন ওকে আছোলা বাঁ'শ নিয়ে তাড়া করা হলো সেই প্র'তিবাদ সরূপ। কিন্তু ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে অর্ণব বললো,

----- থাম ভাই, খেলার মাঝখানে কি শুরু করলি? খেলাটা কন্টিনিউ কর নয়তো চললাম, অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবো।

সায়র নিজেকে সংবরণ করে ফোসফাস করতে করতে পুনরায় বোতল ঘোরালো, এবার গিয়ে বোতল থামলো ক্রীতিকের সামনে। ক্রীতিক সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই, অর্ণব বললো,

---- কি নিবি ট্রুথ না ডেয়ার?

ক্রীতিক নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,

---- ট্রুথ, তবে কোনোরূপ ফা'জলামো করবি না বলে দিলাম।

অর্ণব ক্রীতিকের স'র্তক বার্তায় দু’পয়সার তোয়াক্কা না করে, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছু'ড়লো ওকে,

---- অরুকে তোর দেওয়া ফার্স্ট গিফট কি ছিল? আর এমন কি স্পেশাল গিফট যা তুই ওকে দিতে চাস এখনো দেওয়া হয়নি?

অর্ণবের কথা শেষ হলে ক্রীতিক ম্যাকবুক থেকে চোখ সরিয়ে অরুকে পর্যবেক্ষন করলো, যে লাজুক লতা হয়ে হাত দিয়ে কানের পেছনে চুল গুঁজে ক্রীতিকের দৃষ্টি এড়াতে বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ক্রীতিক অরুর দিকে দৃষ্টি রেখেই একটু ভেবে বললো,

----- আই থিংক ফার্স্ট গিফ্ট ছিলো কিছু পাজামা সেট। আর স্পেশাল গিফট যদি বলিস, দেন আই ওয়ান্না গিভ হার মাই বেস্ট ডি এন এ।

এ কি ঠোঁট কা'টা কথা!!ক্রীতিকের কথা শুনে কাশি উঠে গেলো সবার। অরু লজ্জা টজ্জা ঠিকেয় তুলে, ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,

---- নি'র্লজ্জ লোক।

ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

----- আশ্চর্য ট্রুথ আর ডেয়ার খেলা হচ্ছে, তাইতো সত্যিটা বললাম।

অরু চোখ মুখ খিঁচিয়ে বললো,

---- এই সত্যি কে বলতে বলেছে আপনাকে?

ওদের স্বামী স্ত্রীর বা'কবিত'ন্ডার মাঝে সায়র হো হো করে হেসে বললো,

----- শুনেছিস অর্ণন? জেকে এখনো বাসরটাই করতে পারলো না, এদিকে বাচ্চা উপহার দিয়ে দিচ্ছে? হাউ ফানি।হেহ হেহ।

ক্রীতিক সায়রের মেলে যাওয়া চোয়ালখানা আলতো হাতে বন্ধ করে দিয়ে বললো,

---- আপাতত মুখটা বন্ধ কর, যখন হবে তখন ঠিকই টের পাবি, আদৌও বাসর করেছি কি করিনি।

অরু তৎক্ষনাৎ সবার মধ্যে থেকে উঠে গিয়ে, গটগটিয়ে নিচে চলে গেলো।

সায়র হাঁক ছেড়ে বললো,

---- আরে এলোকেশী কোথায় চলে যাচ্ছো? খেলা তো শেষ হয়নি।

সায়র কথাটা উচ্চারন করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক আচমকা সায়রের গলা চে'পে ধরে বললো,

----- শা'লা তোকে কতবার বলেছি আমার বউকে তুই ডাকবি না কখনো। আবার ঢং করে এলোকেশী ডাকা হচ্ছে? আজ তোর খবর আছে। এই বলে ক্রীতিক সায়রের গলাটা গায়ের জো'রে চে'পে ধরে।

সায়র কোনো মতে শ্বাস টেনে অস্পষ্ট আওয়াজে অর্ণব কে ডেকে বলে,

----- ভাই থামা এটাকে, বিয়ের আগেই আমার হবু বউটা বি'ধবা হয়ে যাবে তো।

এলিসা ওদের ঝামেলার মাঝখানে অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, বেশ চড়া গলায় বললো,

---- থামবি তোরা? অসহ্য লাগছে আমার।

অর্ণব সায়রকে রেখে এলিসার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় আলতো হাত ছুঁয়িয়ে বললো,

---- এলি, কি হয়েছে জান? মন খারাপ?

এলিসা জবাব দিলোনা এক ঝটকায় অর্ণবের হাতটা ঝা'ড়ি মে'রে সরিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো ছাঁদ থেকে।

*****************************************

গোধূলি শেষে সন্ধ্যা তিমিরে মুড়িয়ে গিয়েছে চারিপাশ। আজ বোধহয় আমাবস্যা তাই সন্ধ্যাক্ষনেই রাতের মতো নিকোশ কালো আধার নেমেছে ধরনী জুড়ে। তবেই সেই আধারের এক চিলতে নিকোশ কালোও অবশিষ্ট নেই ক্রীতিক কুঞ্জে। কি করেই বা থাকবে? পুরো বাড়িটা ফেইরী লাইট আর ল্যান্টটার্নের আলোয় ঝিকমিক করছে।

সন্ধ্যা হতেই যেন পুরো মহল্লা জ্বলে উঠেছে ক্রীতিক কুঞ্জের চকচকে আলোয়। অদূর সদরঘাট থেকেও সেই আলোর ছটা পাখির চোখে দেখা যাচ্ছে। মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছে আর ভাবছে কি হচ্ছে ওখানে, এতো আলোই বা কেন?

আজমেরী শেখ কোনোরূপ ক্রুটি রাখতে চাননা মেয়ের বিয়েতে, ওই জন্যই হয়তো এতো আয়োজন, ধুমধামের কোনোশেষ নেই।

সন্ধ্যার পরপরই গেইট ছাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে নামি-দামি গাড়ির বহর। এরা কেউ কেউ জেকে গ্রুপের ভিআইপি ক্লায়েন্ট, নয়তো জামশেদ জায়ানের রাজনৈতিক সূত্রে পূর্ব পরিচিতরা। যাদের আপাতত আজমেরী শেখ আর ক্রীতিক দুজন মিলেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। যদিওবা দুজন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনা, কিন্তু এই মূহুর্তে ক্লায়েন্টদের সামনে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই সামলাচ্ছে তারা। ইটস কলড প্রফেশনাল রিলেশন, যেটা ক্রীতিক আর আজমেরী শেখ দুজনই বেশ ভালো মতো রপ্ত করতে পারে।

প্রত্যয় অনু স্টেজে বসে আছে। ওদেরকে মেহমানরা টুকটাক উপহার সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছে। এখনো গায়ে হলুদ পর্ব শুরু হয়নি। গেস্টরা সবাই সফ্ট ডিংকস পান করছে। ক্রীতিক অনেক বছর পর দেশে ফেরার দরুন অনেকেই এগিয়ে এসে ওর সাথে কুশল বিনিময় করে যাচ্ছে।

এলিসা মাত্রই অন্দর মহল থেকে বেরিয়েছে ওর পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের লেহেঙ্গা। গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হলেও আলাদা কোনো ড্রেসকোর্ট ছিলনা বলে, যে যার মতো জামাকাপড় পরে নিয়েছে ওরা। তবে অর্ণব এলিসার সাথে মিলিয়ে ল্যাভেন্ডার কালারেরই পাঞ্জাবি চড়িয়েছে গায়ে। সায়রের আপাতত দেখা মিলছে না।

ক্রীতিক মেরুন ভেলভেট প্রিন্স কোর্ট পরেছে,

সেই সাথে ব্ল্যাক স্কিনি ডেনিম। ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো আজ বেশ অনেকটা ছোট করা হয়েছে।

এলিসাকে বেরোতে দেখে অর্ণব ওর হাত টেনে আহত সুরে বললো,

---- কথা বলছিস না কেন এলি, কি হয়েছে?

এলিসা কঠোর গলায় বললো,

---- হাত ছাড় অর্ণব ভাল্লাগছে না।

---- না ছাড়বো না।

ওদের এই বা'কবিত'ন্ডার মাঝেই হুট করে, একদম হুট করেই, স্টেজে এন্ট্রি নিলো দুজন ব্রাইডমেট, প্রথমে লাল নীল চোখ ধাঁধানো লাইট, অতঃপর হঠাৎ করেই বেজে ওঠে সবার প্রিয় গান।

এলিসা অর্ণব তৎক্ষনাৎ, নিজেদের তর্কবির্তকের ইতি টেনে অবাক চোখে স্টেজে তাকালো।

সায়র মাত্রই কিছু মিষ্টি আর দধি নিয়ে একসাইডের টেবিলে বসেছিল। ও সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে এই বিয়েতে ও ডায়েট ফায়েট ভুলে সব খাবে।

তারপর আমেরিকা ফিরে যা হবে দেখা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ এক চামচ দধি মুখেও নিয়েছিল কেবল, কিন্তু সেই দধি গলা দিয়ে নামার আগেই ওর চোখ আটকে গেলো স্টেজে।

দেখলো ফেইরী টেল থেকে নেমে আসা দুটো জলজ্যান্ত পরী স্টেজে হিন্দি গানের সাথে কোমড় দোলাচ্ছে। তাদের হাসির ফোয়ারা যেন চারিদিকে মুক্ত দানার ন্যায় ঝরে পরছে।

সেদিকে তাকিয়ে কয়েকবার পলক ফেলে অস্ফুটেই সায়র বললো,

----- এটাকি আসলেই আমার রাগীনিটা নাকি? হায় আল্লাহ, এতো সুন্দর কেন লাগছে, নজর লেগে যাবেতো সবার। পঁ'চা মেয়েটাকে কে বলেছে এভাবে নাচতে? আমার তো হার্টবিট ফে'ইল করছে, ওহ গড।

ক্রীতিক তখনও ক্লায়েন্টদের সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। একজনের পর একজন আসছেই, চারিদিকে তাকানোর ফুরসত নেই ওর।

নেই স্টেজের দিকেও মন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর কেন যেন মনে হলো, স্টেজে এই মূহুর্তে যে মেয়েটা গানের তালে পা দোলাচ্ছে, সুন্দর সুন্দর ভঙ্গিমাতে হেলেদুলে নাচ করছে, সেই মেয়েটাকে ও চেনে।

কেন যেন উষ্ণ হৃদয়টা বলছে একবার ফিরে তাকা ক্রীতিক, শুধু একবার, এন্ড দেন, ইউ উইল বি ফা'কিং স্পিচ লেস।

ক্রীতিক তাকালো, হুট করে নয়, আস্তে আস্তে সময় নিয়ে নজর ঘোরালো, আর তারপর?

ওর হৃদয়টা ওখানেই থমকে গেলো। অরুকে এতোটা হাসিখুশি বোধ হয় এই জীবনে দেখেনি ক্রীতিক। তারউপর এমন মাতাল করা নাচ?

অরু এতো সুন্দর করে নাচতেও পারে? ক্রীতিক হা হয়ে তাকিয়ে আছে স্টেজে নৃত্যরত ওই অষ্টাদশীর দিকে। পরনে অফ হোয়াইট লেহেঙ্গা, হাঁটু সমান লম্বা চুল গুলো পুরোপুরি বাঁধন হারা তার। গলায়, কানে, সিঁথিতে সাদা পাথরের ছোট ছোট জুয়েলারীতে অরুকে দেখে চোখ জ্বলে যাচ্ছে ক্রীতিকের।

এই মেয়েটা ওর হৃদয়হরনী, সেই ছোট্ট বেলা থেকে নিজের মায়াবলে ক্রীতিককে ব'শ করে রেখেছে।

আজকে মনে হচ্ছে অরুকে নতুন করে আবিষ্কার করলো ক্রীতিক। যে অরু নিজেকে মেলে ধরতে জানে, খিলখিলিয়ে হাসতে জানে, বুক ভরে শ্বাস নিতে জানে।

কিন্তু ক্রীতিক তো শ্বাস নিতে পারছে না, ওর তো দ'ম ব'ন্ধ হয়ে আসছে। এই অরুকে দেখে ওর মোটেই সস্থি লাগছে না, কেমন হাসফাস লাগছে, বুকের ভেতরটা সুক্ষ্ম ব্য'থায় চিনচিন করছে, বারবার মনে হচ্ছে আমার বউটা এতো কেন সুন্দর? এতো কেন নিখুঁত? উপর ওয়ালা কি একটু খানি খুঁত রাখতে পারতো না? ক্রীতিককে একটুখানি সস্থি দেওয়ার জন্য?

এখন যে ক্রীতিকের মাতাল মাতাল লাগছে খুব, ইচ্ছে করছে নৃত্যরত অরুর পাশে দাড়িয়ে সবাইকে এনাউন্সমেন্ট করে বলতে, দেখো সবাই এই মিষ্টি মেয়েটা আমার বউ, আমার হার্টবিট, আমার সবকিছু, শুধু আমার। ওর নেশায় আমি আসক্ত, সঙ্গিন প্রনয়াসক্ত।

কিন্তু ক্রীতিক তো সেসব বলতে পারেনা, কারন হৃদয়ের কথা মুখ ফুটে বলে বেড়ানো ওর ধাঁচে নেই। তাই অরুর নাচ শেষ হতেই ওকে টেনে টুনে মহলের মধ্যে নিয়ে গেলো ক্রীতিক।

করিডোরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অরু একটু ভয়ার্ত গলায় শুধালো,

---- কি হয়েছে? এভাবে টানছেন কেন?

ক্রীতিক অরুর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাস্কিটোনে বললো,

---- কি করেছিস এটা? আমি তো ঠিক নেই অরু, আ'ম নট ওকে?

অরু ক্রীতিকের কপালে হাত ছুয়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে ,

---- কেন কি হয়েছে? সেদিন বৃষ্টিতে ভিজলেন বলে জ্বর আসেনি তো আবার, দেখি?

ক্রীতিক অরুর হাত সরিয়ে দিয়ে, নিজের একহাত, অরুর আঁচলের ফাঁক গলিয়ে ওর মেদহীন উদরে ছোঁয়ালো। ক্রীতিকের শক্ত হাতের স্পর্শে তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠল অরু। কম্পিত কন্ঠে বললো,

--- কি করছেন, আঁচলটা এলোমেলো হয়ে যাবে তো।

---- হলে হোক, তুই যে আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিস তার কি হবে? এভাবে কেন নাচতে গেলি অরু? আমার যে এখন বুকে ব্য'থা করছে খুব, মনে হচ্ছে ম'রে যাবো। তোকে একান্তে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সেটাতো এই মূহুর্তে সম্ভব নয়।

কারন বাইরে সবাই আমার সাথে মিট করার জন্য ওয়েট করে বসে আছে।

তাহলে এখন কি করবো আমি? তোর প্রতি এতো কেন আ'সক্তি আমার? কেন এতো সুন্দর তুই?বলনা?

তোকে কাছে না পেয়ে আমি যদি বুকের ব্যথায় ম'রে যাই? তখন সব দোষ তোর।

ক্রীতিক উ'দভ্রান্তের একের পর এক বুলি আওড়ে যাচ্ছিল। ওর চোখে মুখে ভীষণ কাতরতা,ভীষণ অসহায়ত্ব।

কিন্তু এই পর্যায়ে এসে ওর মুখটা হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো অরু।

অতঃপর ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে না সূচক মাথা নাড়ালো।

ক্রীতিকের একটা হাত তখন ও পেছনে লুকোনো। অরু চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক এবার বিনা দ্বিধায় হাঁটু ভে'ঙে বসে পরলো ওর সামনে,আলতো হাতে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে নির্লিপ্তে ঠোঁট ছোঁয়ালো অরুর তুলতুলে কোমল উদরে, এরপর অন্য হাতটা সামনে বাড়িয়ে কাঁচা হলুদের রঙে রাঙিয়ে দিলো অরুর সমগ্র উদর।

ক্রীতিকের একেক'টা কাজে প্রত্যেক বারই বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পরে অরু,এবারও তার বিপরীত নয়। তবে এই মূহুর্তে বিস্ময়ের চেয়েও লজ্জায় চুপসে গিয়েছে ও। ক্রীতিক কি করলো এটা? কারও চোখে পরলে নিশ্চয়ই অরুকে পা'গল ভাববে? তারা'তো আর জানেনা যে অরুর একটা পা'গল স্বামী আছে।

অরু আপন মনে হিজিবিজি ভাবছে,ক্রীতিকের ঘোর কাটেনি তখনও। ও উঠে দাড়িয়ে অরুকে এক ঝটকায় পেছনে ঘুরিয়ে, অরুর লম্বা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দেয়, এবং এর পরপরই পুনরায় নিজ হাতে হলুদ রঙে রাঙিয়ে দিলো ওর কোমল পৃষ্ঠদেশ। অতঃপর সেভাবেই পেছন থেকে দু'হাতে শক্ত করে অরুর কোমড় জড়িয়ে ধরে,ওর হলুদ লাগানো পৃষ্ঠদেশে নিজের গাল ঘষে দিলো পরম আবেশে।

ক্রীতিকের খড় দাঁড়ির সূঁচালো অনুভূতি আর ঠোঁটের স্পর্শে আরও একদফা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে অরুর সর্বাঙ্গ। ও আর সহ্য করতে পারলো না ক্রীতিকের এমন এলোমেলো স্পর্শ। অগত্যাই ক্রীতিকের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে, একছুটে পালিয়ে চলে গেলো ক্রীতিকের দৃষ্টির অগোচরে।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৪৫

মস্ত বড় আলিশান বাড়িটা আজ ষাটের দশকের নামি-দামি রাজ প্রাসাদের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে সেজে উঠেছে ।

এটাকে একঝলক দেখায় কে বলবে? যে এ বাড়িটাই গত কয়েক বছর যাবত মানব শূন্য হয়ে দিনাতিপাত করেছে। তখন অরু আর অনু ব্যতিত পুরো বাড়িটাই ছিল ভূতুড়ে বাড়ির ন্যায় শুনশান জনমানবহীন।

যদিও বা মামিরা আসতো কম বেশি, তবে সেটাও তাদের প্রয়োজনে। তাছাড়া মামিদের আগমন অরু অনুর নিকট সর্বদাই ছিল মোক্ষম আ'তঙ্কের কারণ। এক কথায় এরা আসার চেয়ে না আসাটাই ছিল বহুল কাম্য।

আজ বাড়িতে কোনো আ'তঙ্ক নেই। চারিদিকে খুশির ফোয়ারা বইছে। প্রত্যয় অনুর গায়ে হলুদের আয়োজন এ বাড়িতেই করা হয়েছে যার ফলসরূপ প্রত্যয়দের বাড়ির সবাইও এখানেই উপস্থিত। অমিতের আজ ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে তাই আসতে পারেনি, কাল হয়তো অমিতও আসবে।

স্টেজে মন মাতানো গানের তালে একে একে নাচ করছে নাচের দলের মেয়েরা। ভিআইপি অতিথি থেকে শুরু করে,সকলের মনোনিবেশ আপাতত স্টেজেই আটকে আছে।

হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে স্টেজে প্রত্যয়ের পাশেই বসে আছে অনু, চোখের সামনে মজার মজার খাবার, অথচ কিছুই খেতে পারছে না মেয়েটা, ওদিকে সকাল থেকে না খাওয়ার দরুন পেটটাও কেমন গুড়গুড়াচ্ছে ওর।

পেটে ক্ষুদা থাকলে সবকিছুই যেমন বিষাদে পরিপূর্ণ,ঠিক তেমনি অনুর কাছেও আপাতত এই নাচগান হৈ-হুল্লোড় সবকিছু জঘন্য রকম তেঁতো লাগছে, বড্ড তেঁতো ।

অথচ অরুটা এন্ট্রি সং এ কোমড় দুলিয়ে সেই যে তখন উধাও হলো আর খবর নেই। অনু তখন থেকে কেমন হাসফাস করছে, ওর পাশেই বসেছিল প্রত্যয়।

কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এসে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে প্রত্যয়কে, কিন্তু অনুর তাতে কোনো আগ্রহ নেই, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই প্রত্যয় অনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে সামান্য নিচু স্বরে প্রশ্ন করলো,

---- কি হয়েছে তোমার? তখন থেকে খেয়াল করছি অন্য মনস্ক হয়ে আছো।

অনু বরাবরই পরিস্থিতি সামলানো দ্বায়িত্বশীলা বড় মেয়ে, নিজের বিয়েতে অতিথি সকলের খাওয়ার আগেই, নিজের ক্ষিদে পাওয়ার মতো লজ্জা জনক কথাটা কৌশলেই প্রত্যয়ের কাছ থেকে চেপে গেলো ও।সামান্য হাসার চেষ্টা করে মুখ ফুটে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,

---- কই,কিছু হয়নিতো।

কিন্তু প্রত্যয় তো এতোটাও বোকা, কিংবা দ্বায়িত্বজ্ঞান হীন ছেলে নয়। অনুকে সে যথেষ্ট ভালোভাবে চেনে। তাই অনু বলা সত্ত্বেও সবার মাঝে থেকে স্টেজ খালি করে অনুকে নিয়ে সরাসরি অন্দরমহলের ভেতরে চলে যায় প্রত্যয়। যাওয়ার আগে নিজের বড় আপুকে ডেকে বলে অনুর রুমে যাতে এক প্লেট কাচ্চি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

একটু পরেই ওরা আসছে, তখন না হয় হলুদ লাগানো যাবে।

*****************************************

রুমের ভেতরে প্রবেশ করে অনু ঠোঁট উল্টে বললো,

---- এতো মেহমানদের বসিয়ে রেখে আমাদের এভাবে চলে আসা কি ঠিক হলো?

প্রত্যয় হাত ধুয়ে এসে, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে অনুর মুখে পোলাও এর লোকমা তুলে দিতে দিতে বললো,

---- যাবো তো,তার আগে খেয়ে নাও। নয়তো তোমার পেটের গুড়গুড় আওয়াজ আমি একা নই পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ শুনে ফেলবে।

অনু খাবার চিবুতে চিবুতে নরম স্বরে বললো,

----- আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে?

প্রত্যয় অনুর চোখে অনিমেষ চেয়ে থেকে বললো,

---- আমি কিভাবে বুঝলাম সেটা ম্যাটার করেনা, ম্যাটার হলো সেদিন এতো করে বুঝানোর পরেও তুমি আমাকে কিছুই শেয়ার করছো না, নিজের ভেতরের কথা ভেতরেই আটকে রাখছো।

আচ্ছা অনু,একবারও ভেবে দেখেছো? আজ রাত পেরোলে কাল যে আমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে যাবো। তুমি, আমি আমরা হয়ে যাবো।

তোমার সকল ভয়, লজ্জা আমি নির্দ্বিধায় হরণ করে নেবো? তোমার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হবো আমি, অথচ সেই আমার কাছেই তুমি ইজি হতে পারছো না এখনো।সামান্য ক্ষিদে পেয়েছে এই কথাটুকুও বলতে দ্বিধাবোধ করছো, কেন?

অনু প্রত্যয়কে মানানোর চেষ্টা করলো, কিঞ্চিৎ আদুরে গলায় বললো,

---- আমিতো ভেবেছি সবার সামনে ক্ষিদে পেয়েছে বলাটা ভালো দেখাবে না, এতো লোকজন কে কি ভাববে...

অনুর বাকি কথা জিহ্বাতেই আটকে রইলো, তার আগেই প্রত্যয় কিছুটা শক্ত গলায় বললো,

-----কতবার বলেছি আমার সামনে এতো ম্যাচিউরিটি, এতো দ্বায়িত্ববোধ দেখাতে হবে না, আমি আছিতো তোমাকে সামলানোর জন্যে, একটা প্রত্যয় আছে তো তোমাকে নিজের কাঁধে ঠায় দেওয়ার জন্য, তবুও কেন যে এতো ওভার থিংক করো কে জানে?

ওর কথা শুনে ফিক করে হেঁসে দিলো অনু, অতঃপর প্রত্যয়ের গলাটা মেহেদী শুকানো দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,

----- এতো আস্কারা দিচ্ছেন? আমি কিন্তু আপনার মাথায় চড়ে বসবো, তখন বুঝবেন বউয়ের কি জ্বালা।

অনুর শরীর থেকে মিষ্টি একটা বউ বউ গন্ধ বেরোচ্ছে, প্রত্যয় ভালোভাবে টের পাচ্ছে সেই সুঘ্রান, ও প্রথমে অনুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে আস্বাদন করলো অনু অনু মিষ্টি মেয়েলী সুগন্ধটুকু, তারপর ওর নাকে নাক ঘষে হিসহিসিয়ে বললো,

----- আমিতো চাই তুমি আমাকে জ্বা'লাও, পো'ড়াও। জ্বা'লিয়ে পু'ড়িয়ে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নাও। এই দূরত্ব যে আর ভাল্লাগছে না অনু, একটুও ভাল্লাগছে না।

*****************************************

বাড়ি ভর্তি মানুষ হলেও, সেই মানুষের কোনোরূপ আনাগোনা নেই অন্দরমহলের চারিদিকে । সবাই আপাতত স্টেজের ওখানে নাচ গান নিয়ে মেতে আছে।

দোতলার করিডোরটা পুরোপুরি নিরব। চারিদিক ল্যাভেন্ডার মোমের আলোয় চিকচিক করছে, সেই সাথে ওয়াইল্ড জেসমিনের সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে।ক্ষনে ক্ষনে প্রবল ভেগে ধেয়ে আসছে বৈশাখী দমকা হাওয়া। হাওয়ার তালে দুলে উঠছে সৌন্দর্য বর্ধক লাল, নীল, হলুদ নেটের উপর কারুকার্য করা ফিনফিনে পর্দাগুলো। বাইরে থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট গানের লাইন,

" নেশা নেশা একি নেশা চোখে,

ভুলে থাকতে পারিনা তোকে,

অচেনা স্বপ্নগুলো তোকে ছুঁতে চায়"

আর এদিকে একের পর এক নেটের পর্দার আড়ালে আলগোছে গা ঢাকা দিচ্ছে অরু। ক্রীতিক যখনই সেই পর্দাটা দ্রুত হাতে সরিয়ে দিচ্ছে, তৎক্ষনাৎ একই ভাবে ছুটে গিয়ে অন্য একটা পর্দার আড়ালে ঠায় নিচ্ছে অরু।

এভাবেই করিডোরের এমাথা ওমাথা করছে ওরা দুজন। একজন চোখের লজ্জা আর মনের সংকোচ আলগোছে লুকোতে নিঃশব্দে আড়াল হচ্ছে, তো আরেকজন মনের কামনায় চোখের যাতনায় বারবার তাকে উন্মুক্ত করছে।

নিরব রাত নিস্তব্ধ পদধ্বনি অথচ দুজনার হৃদ মাঝারে বয়ে যাচ্ছে উত্তাল সমুদ্রাগত তীব্র জ'লোচ্ছ্বাসিত জোয়ার । যার নাম "প্রেম"।

অরু পারছে না ক্রীতিকের সাথে, পারছে না নিজের লজ্জাটুকু আড়াল করে লুকিয়ে থাকতে, বারবার ওকে কাছে টানার পায়তারা করে যাচ্ছে ক্রীতিক। বেহায়া পুরুষ ক্রীতিক।

আজ কি এমন হলো লোকটার? বুঝে উঠতে পারছে না অরু। ওদিকে সফেদ লেহেঙ্গাটা হলুদে মাখামাখি, সেই সাথে ক্ষনিক আগের ক্রীতিকের অবাধ্য স্পর্শ গুলো এখনো জীবন্ত, কি শিহরণ, কি উথালপাথাল পা'গলপারা অনুভূতি ভাবতে গেলে এখনো শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে যাচ্ছে অরুর ।

ক্রীতিক যেভাবে ওর পেটে পিঠে হলুদ মেখে দিয়েছে মনে হচ্ছে গায়ে হলুদটা অনুর নয়,বরং অরুরই।আর ক্রীতিক হলো একমাত্র ব্যক্তি যে অরুকে হলুদ মাখিয়ে গায়ে হলুদ সম্পন্ন করেছে আর কারোর হলুদ লাগানোর প্রয়োজন নেই ওর বউয়ের শরীরের ভাজে।

ক্রীতিকের সাথে লুকোচুরি প্রেমে এবার সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছে অরু, একপর্যায়ে উপয়ান্তর না পেয়ে তিনতলার সিঁড়ি ধরে দৌড়ে ছাঁদে উঠে গেলো ও। অরুকে এভাবে দিশেহারা হয়ে ছুটতে দেখে ভ্রম ছুটে গেলো ক্রীতিকের। মাতাল ভাবটা মস্তিষ্ক থেকে সরে যেতেই ক্রীতিক হাঁক ছেড়ে অরুকে বললো,

----- আস্তে, সাবধানে বেইবি, তুই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে আমি ডিএনএ কাকে দেবো বলতো?

*****************************************

ছাদেঁর পাঁচিলে দু-হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এলিসা। ওর দু'চোখ দূর আকাশে নিবদ্ধ, যেখানে আলো নেই, চাঁদের দেখা নেই, আছে কেবল একফালি কালচে মেঘের ঘনঘটা।

আজকেও বোধ হয় সেদিনের মতো দা'নবীয় ঝড় আসবে ভূবণ ভুলিয়ে।সেই সাথে আকাশ ফুটো হয়ে ঝমঝম বৃষ্টি। এলিসা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর চাঁদের মতো ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা মুখের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে অর্ণব।

একটু আগেও ওর সাথে যা নয় তাই ব্যবহার করেছে এলিসা, ওর প্রতিটি কথা ছিল বি'ষাক্ত তীরের ফলার মতোই বে'দনাদায়ক আর অ'পমান জনক।

কিন্তু অর্ণব তো বরাবরই নির্লজ্জ, এলিসার কাছে দু’পয়সার দাম না পেলেও ওর ইমেজে এইটুকু ভা'ঙন ধরেনা, এটা আজ বা কাল থেকে নয়, বরং বহু বছর আগে থেকেই। তাইতো এলিসার বলা তি'ক্ত কথা গুলোকে একপাশে সরিয়ে অকস্মাৎ পেছন থেকে দু'হাতে শক্ত করে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলো অর্ণব।

গ্রীবা নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ওর ঘাড়ের উপর। অর্ণব ধরেছে থেকেই এলিসা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে। কিন্তু অর্ণব তাতে এক ফোঁটাও বিরক্ত নয়, উল্টো এলিসাকে আরও কাছাকাছি এনে ওর ঘাড়ে গলায় উ'ন্মাদের মতো সামান্য জো'র খাটিয়ে দাঁত বসাতে বসাতে অর্ণব শুধালো,

---- কি হয়েছে জান,কে কি বলেছে? এক্ষুনি বল, নয়তো, নয়তো আমি তোকে ব্যথা দিতে বাধ্য হবো। আমার কা'মড় গুলো জোরালো হবে, তোর ফর্সা শরীরটা র'ক্তিম হয়ে উঠবে।আর....

অর্ণব কথা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই নিজেকে ছাড়িয়ে ওর শক্ত হাতে অর্ণবের তীক্ষ্ণ ফর্সা গালে আচমকা চ'ড় বসালো এলিসা। অর্ণব নিজেও বোধহয় আশা করেনি এলিসা হুট করে এমন কিছু করবে।

ওদিকে চ'ড় খেয়ে পাশ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অরুর সাথে চোখাচোখি হলো অর্ণবের। অরুকে দেখা মাত্র ও আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ালোনা। থমথমে মুখ নিয়ে, অরুকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পায়ে ত্যাগ করলো সিঁড়ি ঘর।

অর্ণব চলে যেতেই অরু এগিয়ে এলো এলিসার নিকট, কিছুটা ইতস্তত আর ভয়ার্ত কন্ঠে অস্ফুটে শুধালো,

---- কিছু হয়েছে আপু? তুমি কি কোনো কারনে ডি'স্টার্ব?

অরুর কথায় এলিসা আড় চোখে তাকালো ওর দিকে। অরু শুষ্ক ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও বললো,

----- না মানে, আমাদের বাড়িতে কেউ যদি কিছু....

অরুর কথা এখানেই আটকে গেলো, বাকি কথাটুকু গ্রাস করে নিলো হতবিহ্বল এক অনাকাঙ্খিত পরিবেশ। হুট করেই অরুর কথার মাঝে ওকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো এলিসা। এলিসার মতো শক্ত আর কঠোর মানবী যে কাঁদতেও পারে, তা আগে জানা ছিলোনা অরুর।

এই ক্রীতিকের বন্ধু মহলটাই কেমন রহস্যে ঘেরা এক দূর্লভ প্রাচূর্য, যার উপরটা চকচকে আর আকর্ষনীয় হলেও ভেতরটা রহস্যের জালে মোড়ানো, কখনো সেখানে ধরা দেয় প্রকট অসহায়ত্ব, কখনো বা কিঞ্চিৎ অপারগতা।

কি অদ্ভুত হাতের কাছে টাকার পাহাড় থাকতেও কিছু মানুষ অসুখী, বড্ড অসুখী । কি এতো না পাওয়া তাদের? বুঝতে পারেনা অরু, আপাতত বোঝার মতো সময়ও না, ও তৎক্ষনাৎ নিজের হিজিবিজি ভাবনার ইতি ঘটিয়ে এলিসার পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বললো,

---- কি হয়েছে আপু, বলা যাবে?

এলিসা পুনরায় সটান হয়ে দাঁড়ালো, চোখের পানিটুকু আঙুলের ডগা দিয়ে তাড়াহুড়ো মুছতে গিয়ে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো। অরু বুঝলো এলিসা নিজেকে জোরকদমে সামলাতে চাচ্ছে, কিন্তু কোনো কারনে পারছে না।

---- বলোনা আপু কি হয়েছে? অর্ণব ভাইয়া কি?

অরুর কথার মাঝখানে এলিসা বলে ওঠে,

---- ওর কোনো দোষ নেই অরু, সব দোষ আমার, আমিইতো বেবিটাকে.....

কান্নার তোপে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে এলিসার, অরু একটা বড়সড় দম নিয়ে আস্তে করে প্রশ্ন ছু'ড়লো,

----- তুমি কি প্রেগন্যান্ট আপু?

এলিসা কাঁদতে কাঁদতে শুধু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।

অরু ঝটকা খেলো না, ও তো মনেমনে এটাই সন্দেহ করেছিল,তারপর আবারও বললো,

----বাচ্চাটা নিশ্চয়ই অর্ণব ভাইয়ার?

এলিসা এবার জবাব দিলো,

----- হ্যা, সেদিন যখন জেকে এল এ থেকে ফিরলো, অর্ণব হুট করেই জেকের জবাবদিহীতার ভ'য়ে আমার বাসায় চলে এসে ফোন টোন বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ কয়েকদিন ও আমার বাসাতেই ছিল।

অরু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে গলায় অসহায়ত্ব ধরে রেখে বললো,

----- তাহলে এটা অর্ণব ভাইয়াকে কেন জানাচ্ছো না? ওনার সন্তান ওনার তো জানার অধিকার রয়েছে।

এলিসা নাক টেনে বললো,

---- তোমার কি মনে হয়, বিয়ের আগে এই বাচ্চাকে ও কখনো স্বীকৃতি দেবে? শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই বলবে অষুধ খেয়ে ন'ষ্ট করে ফেলতে।যেটা আমি পারছি না, আমার দ্বারা হচ্ছে না, গত ওয়ান উইক যাবত এটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি। কিন্তু আমি পারছি না অরু, মাতৃত্ব আমাকে বারবার অ'পরাধীর কাঠগ'ড়ায় দাঁড় করাচ্ছে, আমার মতো শক্ত হার না মানা মেয়েটাকেও তীব্র ভাবে হারিয়ে দিচ্ছে এই দুই মাসের ভ্রুণটা। কি করবো আমি?

অরুর চোখ দুটো অভিমানে ছলছল করছে, এলিসা এমন একটা কথা ভাবলো কি করে সেই অভিমান? নাকি অর্ণবকে কষ্ট দিলো সেই অভিমান? জানা নেই অরুর, যা হোক ও নিজেকে সামলালো, অতঃপর আস্তে ধীরে ছাঁদের পাঁচিলে অহেতুক আঙুল ঘষতে ঘষতে বড়বড় শ্বাস ফেলে বললো,

---- আমি বিবাহিতা আপু, জায়ান ক্রীতিকের মতো ঘা'ড়ত্যা'ড়া লোকটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি, ওনার বড্ড বেশি মুড সুইং হয়। যখন মেজাজ বিগড়ে যায়, তখন কি বলে, না বলে নিজেও খেয়াল করে উঠতে পারেনা। সেসময় ওনার মাঝে যেন উনি থাকেনা,বরং জেগে ওঠে এক হিং'স্র পশু সত্তা।

তবুও আমি ওনার মাঝেই সুখ হাতরে বেড়াই, নিজের মাঝে ওনার রাগ ঢাক সবটা সহ্য করার ক্ষমতা ধারণ করি, দিনশেষে উনিই আমার শান্তি নিকেতন, কারন উনি হলেন আমার প্রেমিক পুরুষ, আমার জনম জনমের ভালোবাসা, আমার জায়ান ক্রীতিক।

এতো কিছু কেন বলছি জানো আপু?কারন আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই মানুষটা আর যাই হোক, নিজের প্রান পণ উজাড় করে হলেও, আমাকে বি'পদ, আপদ, দোটানা, পিছুটান এবং সবরকম অশু'ভ থেকে খ'ঞ্জরের মতো রক্ষা করতে কোনোদিন কার্পন্য করবেনা।

আর না কোনোদিন পিছুপা হবে। সেটা যদি মৃ'ত্যুর দুয়ারও হয় তবুও না।

আর সেখানে তুমি অর্ণব ভাইয়ার ভালোবাসায় আঙুল তুলছো আপু? আমিতো বহুদূর থেকেও দেখতে পাই তোমার প্রতি ওনার এক আকাশসম মায়া, এক মহাসমুদ্র ভালোবাসা, এক পৃথিবীসম হৃদয়ের টান। তাহলে তুমি কেন দেখতে পেলেনা আপু?

উনিতো কষ্ট পেলেন, যে তোমাকে বছরের পর বছর শর্তহীন ভালোবেসে গিয়েছে সে কষ্ট পেলো।তোমার বাচ্চার বাবা কষ্ট পেলো। যার অংশ তোমার উদরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে সেই মানুষটা কষ্ট পেলো। যে তোমাকে জীবনে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করিয়েছে সেই মানুষটা আ'ঘা'ত পেলো,.....

অরু গড়গড়িয়ে আরও কিছু বলবে,তার আগেই ওর দু'হাত শক্ত করে চেপে ধরে ফুপিয়ে উঠলো এলিসা, কা'ন্না জড়ানো কন্ঠে ঠোঁট ভেঙে বললো,

----- থামো অরু, আর নিতে পারছি না আমি, অর্ণব কোথায়? ও কোথায়?আমার বাচ্চার বাবা কোথায়? ওকে ডেকে আনো, বলো যে আমাকে যতদ্রুত সম্ভব বিয়ে করে নিজের বক্ষস্থলে ঠায় দিতে।আমি আর পারছি না,ওকে ছাড়া আর এক মূহুর্তও থাকতে পারছি না।

কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে ধপ মাটিতে লুটিয়ে পরলো এলিসা। অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে এলিসাকে শান্ত করে বললো,

---- তুমি এখানেই থাকো আপু, আমি এক্ষুনি আসছি।

*****************************************

অরু নিচে নেমে অর্ণবের ঘর তালাশ করে দেখলো অর্ণব ঘরে নেই, তাই একটু সন্দেহ বশত এগিয়ে গেলো ক্রীতিকের ঘরের দিকে। কারন এই সময় অর্ণবের ক্রীতিক আর সায়রের কাছে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

হলোও তাই, অরু কোনোরূপ কড়ানাড়া ছাড়াই ক্রীতিকের রুমে প্রবেশ করলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো ওদের তিনজনার, ক্রীতিক ভিডিও গেইমটাকে পজ করে থমথমে মুখ নিয়ে গেমিং চেয়ারটাতে বসে আছে, অর্ণব আর সায়র ও তাই, চুপচাপ বসে আছে বেডের উপর। দেখে মনে হচ্ছে অরুকে দেখামাত্র ওরা একটু অসস্থিতেই পরলো বটে। অরুর অবশ্য তাতে যায় আসেনা, কিন্তু ও ভেতরে প্রবেশ করার আগেই বাঁধসেধে ক্রীতিক বলে,

----- কি হয়েছে অরু, কিছু বলবি?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বলে,

---- রাতে শুনবো, এখন রুমে যা।

ক্রীতিকের কথায় ঘোর আপত্তি জানালো অরু, ওর কথায় কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে ভেতরে আসতে আসতে অরু বলে,

----- আমার জরুরি কথা আছে।

ক্রীতিক একটু শা'সানোর সুরে বললো,

---- বলেছিতো এখন না পরে শুনবো, দেখছিস না এখানে বড় রা কথা বলছে?

----- আপনাদের কথা পরে শুনবো, আগে আমার কথা শুনুন।

ক্রীতিক বুকের ভেতরের তপ্ত দীর্ঘঃশ্বাসটা নাক দিয়ে বের করে, একটু গম্ভীর গলায় বললো,

----- বেইবি রাগ উঠাস না, রুমে যা, রাতে তোর সব কথা শুনবো, দরকার পরলে সারারাত না ঘুমিয়ে শুনবো, বাট নট নাও।

এখানে বড়রা কথা বলছে, যদি

আমার রুম থেকে যেতে ইচ্ছে না করে তো চুপচাপ বসে থাক। নো মোর সাউন্ড ওকে?

অরু বুঝলো ক্রীতিক নাছোড়বান্দা, ওকে কিছুতেই আলাদা কথা বলতে দেবে না এই নি'র্দয় লোকটা, তাই এবার উপয়ান্তর না পেয়ে অর্ণবের দিকে দৃষ্টিপাত করে, অরু সবার সামনে বলেই ফেললো,

----- ভাইয়া, এলিসা আপু অন্তঃসত্ত্বা ।

অরুর কথাতে যেন ঘরময় ব'জ্রপাতের আওয়াজ হলো। সায়র,অর্ণব, এমনকি ক্রীতিক পর্যন্ত হতভম্বের মতো চেয়ে আছে অরুর পানে। সবাই এখনো ভ্রম থেকে বেরোতে পারেনি বিধায়, অরু পুনরায় অর্ণবকে ডেকে বললো,

----- আপু ছাঁদে অপেক্ষা করছে।

এবার একে একে টনক নড়লো সবার, এই মূহুর্তে ওদের চোখে সবচেয়ে বড় অ'পরাধী অর্ণব। সায়র তো রা'গ দমাতে না পেরে কটমটিয়ে বলেই উঠলো,

----- শালা ধা'ন্ধাবা'জ, বাসর ফাসর সেরে বাচ্চা পয়দা করে, এখন এখানে এসে ইনোসেন্ট সাজা হচ্ছে?

বেচারা অর্ণব চরম অসহায়ের মতো চুপসানো মুখে সায়রকে ঝাড়ি মে'রে বললো,

---- আমি কি জানতাম নাকি?যে এক বাসরেই বাচ্চা হয়ে যায়? তাহলে অন্তত গেস করা যেত।

তৎক্ষনাৎ বিরক্তি প্রকাশ পেলো সায়রের চোখে মুখে, ওর চোখে এই মূহুর্তে মী'রজাফরের চেয়েও বড় বে'ঈমান এই বন্ধুগুলো। নিজের ইমোশন সামাল দিতে না পেরে ও ক্রীতিক আর অর্ণবকে তর্জনী দিয়ে ইশারা করে ব্যথাতুর স্বরে বলে উঠলো ,

---- তোদের একটাকেও আমি আর বিশ্বাস করিনা, আমাকে না নিয়ে কিভাবে বাসর সেরে ফেললি তোরা? একটু ও মনে পরলো না আমার কথা?এই সিঙ্গেল ছেলেটার কথা?

ক্রীতিক ওর কথায় দু পয়সার পাত্তা দিলোনা, উল্টে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস হয়ে শুধালো,

----- কি করবি এখন?

অর্ণব মৃদু হেসে একটু লাজুক হওয়ার ভান ধরে বললো,

----- কি আর করবো, বাচ্চার মাকে বউ বানাবো।

ক্রীতিক অর্ণবের কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো,

---- ওকে ফাইন, প্রত্যয় অনুর গায়ে হলুদটা শেষ হোক দেন আমরা কোনো একটা রেজিষ্ট্রি অফিসে যাবো, রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গেলে তারপর না হয় কোনো একটা চার্চে নিয়ে ফাদারের আশির্বাদ নিয়ে আসবি তোরা।

সায়র উৎসুক হয়ে ক্রীতিকের কথায় বাম হাত ঢুকিয়ে বললো,

---- ভাই এতো রাতে রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ? কে খুলে রাখবে তোদের জন্য রেজিষ্ট্রি অফিস?

ক্রীতিক বসা ছেড়ে উঠে এলো, অতঃপর সায়রের কাঁধে হাত রেখে বললো,

---- বাংলাদেশে একধরণের কাগজের প্রচলন আছে বন্ধু,যেটার মাধ্যমে শুধু রেজিষ্ট্রি অফিস কেন? গন ভবন ও চব্বিশ ঘণ্টা খুলে রাখা যায়।

অর্ণব আর সায়র মাত্রই ক্রীতিকের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, অরু এখনো এককোনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রীতিকের এতোক্ষণে নজর গেলো অরুর দিকে, যে ঠৌঁট, নাক ফুলিয়ে কপাল কুঁচকে দাড়িয়ে আছে। অরুকে দেখে ক্রীতিক এগিয়ে এসে আলতো হাতে ওর নাক টেনে দিয়ে শুধালো,

---- হোয়াট হ্যাপেন্ড হার্টবিট? খেয়ে ফে'লবি নাকি? নিজেকে লবন ম'রিচ মাখিয়ে প্রিপেয়ার করে আনবো কিনা বল ?

ক্রীতিকের এই মধুর আওয়াজ তেঁতো ঠেকলো অরুর নিকট, এই লোক ওকে ভাবে টা কি আসলে? পিচ্চি বাচ্চা? নাকি ফিডার খাওয়া দুধের শিশু? কোনো কথায়ই বলতে দেয়না আশ্চর্য! তৎক্ষনাৎ মনে মনে ক্রীতিকের সঙ্গে কোনোরূপ কথা আদান-প্রদান না করার দৃঢ় প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হলো অরু।

অতঃপর নিজের প্রতীজ্ঞায় অটল থাকার উদ্দেশ্যে ওর প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই ফোসফাস করতে করতে ক্রীতিকের রুম

ত্যাগ করলো অরু।

*****************************************

---- আগে হলুদ না লাগিয়ে এখান থেকে আমি এক পা'ও নড়বো না, ব্যাস।

সায়র ভ্রু কুঞ্জিত করে বললো,

---- নড়বে না মানে? তোমার আব্বাজান নড়বে,রেম্প ওয়াক থেকে বিলবোর্ড, সায়র কখনো লাস্ট হয়না,আর এই সামান্য হলুদের অনুষ্ঠানে আমি লাস্ট হবো? নো ওয়ে। তাছাড়া বউ জাতি সবসময় বর জাতির পেছনেই অবস্থান করে, দেখলে না তখন অরু জেকের পরে এসে হলুদ লাগালো।

----বউ জাতি আর বর জাতি বলতে যে কোনো এলিয়েন জাতি হয়,সেটা আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম, অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার সেরকম কিছু নেই, আপনি তো পাগলু একটা।

---- হ্যা শুধু তোমার পাগলু, ঝিঙ্কু!

সায়র মাথায় হাত বুলিয়ে দেবের মতো একটু ভাব ধরতেই।নীলিমা চোখ গরম করে বলে,

---- এ্যাই কি বললেন আপনি?

সন্ধ্যা রাতের ইতি টেনে গভীর রাত ঘনিয়ে আসছে। চারিদিকে জোরকদম হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় খানিক বাদেই ঝুম বৃষ্টিতে মুখরিত হবে ধরনী, অথচ অনু আর প্রত্যয়ের হলুদ সন্ধ্যার এখনো ইতি ঘটেনি। এর কারণ একটাই সায়র আর নীলিমা তখন থেকে যায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে, একজন বলছে আমি আগে হলুদ লাগাবো,তো আরেকজন বলছে না আমি আগে।

কেউ কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ তারা। এদিকে নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে অন্য অতিথিদের ও সময় খেয়ে দিচ্ছে ওরা দুজন । পেছনের অতিথি সমাজ বেশ বিরক্ত ওদের কান্ডে, এক পর্যায়ে একজন বয়জেষ্ঠ অতিথি না পেরে এগিয়ে এসে, ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

----- বাচ্চারা, তোমরা বরং একটা কাজ করো ওই পাশে গিয়ে আগে নিজেদের ঝামেলা মিটিয়ে আসো, দরকার পরলে সময় নাও,সুপ্রিম কোর্টে যাও,মা'মলা করো,ইনভেস্টিগেশন করে জাজের থেকে অনুমতি নিয়ে ফিরে আসো, আসলেই কার আগে হলুদ দেওয়া উচিৎ। তবুও এই বৃদ্ধের উপর দয়া ধরে যায়গা ছাড়ো ভাই, সেই তখন থেকে তোমাদের ঝগড়া দেখে দেখে সুগার বেড়ে গেলো আমার, বাড়ি গিয়ে ইনসুলিন লাগাতে হবে,তাড়া আছে সর,দেখি বাপু।

সায়র নীলিমাকে নিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে সন্দিহান গলায় বললো,

----- আশ্চর্য কথা বললেন তো দাদু, কোর্টে যাবো,মা'মলা করবো, রায় হবে, ততক্ষণ কি ওরা দুজন বিয়ে না করে আইবুড়ো হয়ে এক চিমটি গায়ে হলুদ লাগানোর জন্য এখানে বসে থাকবে নাকি?

বৃদ্ধ এবার দাঁত খিঁচিয়ে সায়রের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ বললেন,

---- এতোই যখন বুঝিস হতচ্ছাড়া, তাহলে সেই তখন এক চিমটি হলুদ লাগানো নিয়ে এতো নাটক করলি কেন? দুইটা মানুষ চারটা গাল, যার যেখানে খুশি হলুদ লাগাতি, তা-না তখন থেকে যুক্তি দিয়ে দিয়ে কানের মাথা খেয়ে ফেলেছিস। তোরা দুজন এই হলুদ অনুষ্ঠান থেকে বয়'কট এক্ষুনি বিদেয় হ।

সায়র নীলিমাকে নিয়ে স্টেজ ছেড়ে নেমে যেতে যেতে গম্ভীর মুখে বিড়বিড়িয়ে বললো,

----- এ নিশ্চয়ই অরুর মায়ের বংশের কেউ হবে। নয়তো দাঁত না থাকা সত্ত্বেও মুখের ভাষা এতো তেঁতো কেন?আজিব!

*****************************************

অবশেষে অনুর গায়ে হলুদের রাতে অর্ণব এলিসার রেজিষ্ট্রিটা হয়েই যায়। ক্রীতিক নিজ উদ্যগেই ওদের বিয়েটা দিয়েছে। আর এই মূহুর্তে রেজিষ্ট্রি অফিসের বাইরের করিডোরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা ক'জন।

বাইরে আকাশ ভে'ঙে বৃষ্টি হচ্ছে। নীলিমা আর অরু হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রীতিক একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে সিগারেটের শলাকা ধরিয়েছে। আর এলিসা এখনো অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। এলিসা কাঁদছে দেখে অর্ণব উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,

---- এভাবে কাঁদছিস কেন এলি? ভুলে গিয়েছিস ইউ আর প্রেগি উইথ মাই বেবি? তুই এভাবে কাঁদলে আমার বাচ্চাটার ক'ষ্ট হবে,সাথে আমারও। সো স্টপ ক্রাইং রাইট নাও।

সায়র দু'হাতে কয়েকটা ছাতা নিয়ে ওদের নিকট এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

---- হয়েছে আদিখ্যেতা বন্ধ কর, আমাদের হার্ড ওয়ার্কিং এলিসাটাকে দিলি তো অসুস্থ বানিয়ে। এখন আর দরদ দেখাতে হবেনা।

অর্ণব জোর গলায় সায়রকে শাসিয়ে উঠে বললো,

---- খবরদার আমাদের বাপ ব্যাটাকে কিছু বলবিনা সায়র, তাহলে তোর কপালে সারাজীবন আইবুড়ো থাকার সিল লেগে যাবে, বলে দিলাম।

অর্ণবের কথায় এলিসা মৃদু হেসে ফেলে। এলিসা হেসেছে দেখে অর্ণব ওর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে,

---- এই তো লক্ষী বউ আমার।

এলিসা চারিদিকে চোরা চোখে চেয়ে অর্ণবকে সামান্য ধা'ক্কা মে'রে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো,

---- হয়েছে, ছাতা এসে গেছে চল এবার। কাল বিয়েতে অনেক কাজ। আর আমরা এখনো এখানে।

অর্ণব এলিসাকে কোলে নিয়ে একহাতে ছাতা ধরে এগোতে এগোতে বললো,

---- তোর বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছি, এখনো তুই করেই ডাকবি জান?

এলিসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু'হাতে অর্ণবের গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভাবুক হয়ে বললো,

---- কি ডাকা যায় বলতো তোকে? আমার তো তুমি আসছে না। ভাবতেই কেমন হাসি পাচ্ছে।

অর্ণব এলিসা পায়ে পায়ে গাড়ির পর্যন্ত চলে গিয়েছে, ওরা যাওয়ার পরে ক্রীতিক একটা ছাতা ধরে অরুর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে,

---- বেইবি কোলে আয়।

---- মোটেই না, আপনার কোলে আপনিই উঠুন।

কথাটা বলে মুখ ঝামটি দিয়ে বৃষ্টির মাঝেই তরতরিয়ে এগিয়ে যায় অরু।অরুর কান্ডে ক্রীতিক গম্ভীর মুখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

সায়র একটুখানি সরে দাড়িয়ে নীলিমাকে নিজের ছাতায় আমন্ত্রণ জানালে নীলিমাও উপায়ন্তর না পেয়ে সহসা এগিয়ে এসে ওর পাশেই ছাতার তলায় দাড়িয়ে পরে।

সায়র নীলিমা সমেত গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্রীতিকের দিকে হতবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ দিয়ে চু চু উচ্চারন করে ওকে টিপ্পনী কেটে বললো,

---- তুই আসলেই জেকে তো? বিয়ে করে কি হাল হয়েছে ছেলেটার,বেচারা!

তৎক্ষনাৎ ক্রীতিক নিজের পায়ের স্লিপারটা ওর দিকে ছু'ড়ে মে'রে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,

---- শালা যাবি এখান থেকে?

সায়র ওকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যায়, ক্রীতিকের চোখমুখ এখনো রাগের তোপে র'ক্তিম হয়ে আছে, অথচ অরু কি হাসি মজাটাই না করছে সকলের সাথে।শুধু ক্রীতিককেই ইগ্নোর করছে। ক্রীতিক অরুর দিকে তাকিয়ে দু'হাত মুঠি বদ্ধ করে, মনেমনে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললো,

---- অরুর বাচ্চা তোকে একবার হাতের কাছে পেয়ে নিই। তারপর তোর হচ্ছে।

নীলিমা লেহেঙ্গা সামলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, সায়র বারবার ঘাড় নামিয়ে নীলিমার দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। দুজন একই ছাতার নিচে হওয়ায় দূরত্ব বেশ স্বল্প।আপাতত তারই সুযোগের সৎ ব্যবহার করছে সায়র। নীলিমা লেহেঙ্গা সামলে যেই না মাথা তুলবে ঠিক তখনই সায়রের চিবুকের সঙ্গে অকস্মাৎ ধা'ক্কা খেলো ও। সায়র এমন ঝুঁকে আছে দেখে চিড়িবিড়িয়ে উঠলো নীলিমার মস্তিষ্ক, মুখ দিয়ে বিরক্তির প্রতিক্রিয়া জানালো তৎক্ষনাৎ,

---- এভাবে ঝুঁকে আছেন কেন? আমি কি চিড়িয়া? যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে না দেখলে মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যাবে?

সায়র নীলিমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে দিতে শুধালো,

---- এতো সুন্দর স্মেল কেনো? কি শ্যাম্পু লাগাও চুলে হ্যা?

নীলিমা চোখ খিঁচিয়ে বললো,

---- আপনি আবার ইভ'টি'জিং করছেন? আমি কিন্তু আব্বাজান কে বলে দেবো।

নীলিমা ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাটছে, সায়র কিছুটা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে আবারও নীলিমার মাথায় ছাতা ধরে রাশভারি গলায় বললো,

---- এ্যাই মেয়ে, সমস্যাটা কি? আমি যে তোমার বড়, বড়দের কথা শুনতে হয়, সে জ্ঞান কি বিয়ে বাড়ির বোরহানির সঙ্গে গুলে খেয়েছো নাকি?

নীলিমা হাঁটার গতি পুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে সায়রের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বললো,

---- ওই জন্যই তো বলছি বড় বড়দের মতো থাকুন। সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে বাচ্চাদের পেছনে ঘুরঘুর করছেন কেন শুনি?

সায়র এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে নীলিমার সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, তারপর ঘাড়টা কিঞ্চিৎ নিচে নামিয়ে গলার আওয়াজ ক্ষীণ করে বললো,

----- মনের সাথে মন মিলাতে চাই বলে, তোমার আব্বাজান কে শশুর বানাতে চাই বলে।

সায়রের কথা শুনে নীলিমা একটুখানি পিছিয়ে গিয়ে ঠোঁট টিপে বলে ওঠে,

---- আব্বাজান কিন্তু এখনো আ'ছোলা বাঁশ হাতে নিয়ে বাড়ির আশেপাশে বিদেশি বাঁদরটা খুঁজে বেড়ায়।

নীলিমার কথা শুনে ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো সায়রের মুখখানা। নীলিমা দাঁড়ালোনা, সায়রের হাত থেকে ছাতাটা কেঁ'ড়ে নিয়ে সহসা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে, সায়র পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে বললো,

---- তবুও তোমার আব্বাজানকেই শশুর বানাবো আমি, কথাটা মনে রেখো।

পরক্ষণেই মুখ কাচুমাচু করে একাই বিড়বিড়ালো,

---- একটু আধটু বাঁ'শ খেলে কিছু হয়না।

*****************************************

রাতের শেষ প্রহর চলমান... পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ ভীষন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, ঘুমের ঘোরে সবাই বিভোর। বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে হিমেল হাওয়া বইছে। ঠান্ডা হাওয়ায় ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে ঘুমন্ত অরু। শেষ রাতে আর জানালাটা বন্ধ করা হয়নি,ওই জন্যই এতো হাওয়া দিচ্ছে । কিন্তু ঘুমের মধ্যে উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করার মতো শক্তিও নেই অরুর, তাই শীতল হাওয়া গায়ে মাখিয়ে কিছুটা জড়োসড়ো হয়েই নির্বিগ্নে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা।

শীতল ঠান্ডা আর কোমলতার মাঝে একখন্ড খরখরে হাতের উষ্ণ পরশে আচমকাই কম্পিত হয়ে উঠলো ঘুমন্ত অরুর তনু শরীরটা। অরু ঘুমের মাঝেও স্পষ্ট টের পাচ্ছে কেউ একজন ওর তুলতুলে নরম উদরে আবেশিত আঙুল বুলাচ্ছে। সেইসাথে টুকরো টুকরো চুমুতে ভিজিয়ে তুলছে সর্বাঙ্গ। লোকটা অরুর কপাল,ঠোঁট, গলা, এরপর আরেকটু নিম্নভাগে স্পর্শ করতেই হকচকিয়ে চোখ খুললো অরু।

চারিদিক নিকোশ আধারে তলিয়ে আছে, অন্ধকারে কারোর মুখ দেখার যো নেই, তবুও স্যান্ডাল উড পারফিউমের সুবাসটা নাকে ঠেকতেই সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো অরু। অতঃপর গলা খাদে নামিয়ে শুধালো,

---- আপনি এখানে?

ক্রীতিক জবাব দেয়না, নিঃশব্দে অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়ায় রুমের বাইরে। ক্রীতিক এভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে অরু উদ্বিগ্ন আওয়াজ অথচ বেশ নিচুস্বরে বললো,

---- আরেহ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এই রাত দুপুরে?

ক্রীতিক একহাত দিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জড়ানো গলায় বললো,

---- বউকে ছাড়া ঘুম আসছে না।

অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

---- আপনি আবার ড্রিং'ক করেছেন?

ক্রীতিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,

---- ওরা সেলিব্রেশন করেছে,কিন্তু বিশ্বাস কর আমার একটুও নে'শা হয়নি, আমিতো এখন নে'শা করবো।

কথা শেষ করে অরুকে বিছানায় ছু'ড়ে মা'রলো ক্রীতিক। অরু হকচকিয়ে উঠে বসে ব্যথাতুর গলায় বললো,

---- আহ!ব্যথা পেলাম তো।

ক্রীতিক নিজের টিশার্ট খুলে মেঝেতে ছু'ড়ে ফেলে দিয়ে, ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাস্কিটোনে বললো,

-----ইউ নো হোয়াট বেইবি? ইউ আর ইয়াম্মি।টু মাচ ইয়াম্মি। লাইক মাই পার্সোনাল drug.

অরু ঝাঁজিয়ে উঠে নাক সিকোয় তুলে বললো,

---- আপনার মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গিয়েছে। এক্ষুনি লেবু পানি খাওয়াতে হবে। দাঁড়ান নিয়ে আসছি।

অরুকে এক পা'ও নড়তে দিলোনা ক্রীতিক, উল্টো অরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে মুখটাকে অরুর গলায় ডুবিয়ে দিতে দিতে হিসহিসিয়ে বললো,

----- আজকে রাতে একটু খা'রাপ এলাউ কর, কালকে একদম ভদ্র হয়ে যাবো। প্রমিস।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৪৬

রয়েল প্যালেসের ন্যায় লাইট গোল্ডেন থীমে সাজানো হয়েছে পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ। সকাল সকাল ভৃত্যরা কাজে লেগে পরেছে। গেইট থেকে শুরু করে ব্যাক ইয়ার্ড পর্যন্ত এমন কোন যায়গা নেই যেখানে সৌন্দর্যের কৃত্রিম ছোঁয়া পরেনি। চারিদিক গোল্ডেন ফেইরী লাইট আর হ্যাজাকের আলোয় ঝিকমিক করছে।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কোনো ড্রেসকোর্ট থীম না থাকলেও বিয়েতে বর কনের সঙ্গে মিলিয়ে ড্রেসকোর্ট থীম দেওয়া হয়েছে বেবি পিংক কালারের যে কোন দেশীয় পোশাক।

অতিথিদের বহুলাংশই রাতে আসবেন। তবে সন্ধ্যা নাগাদই বাড়িতে মানুষের কলরব শুরু হয়ে গিয়েছে। বিয়ে বাড়ির স্বাদ আস্বাদনে সবাই ব্যস্ত,সেই সাথে হাতে হাতে কোমল পানীয় তো আছেই। সায়র,অর্ণব এলিসা,ক্যাথলিন ওরা একসাথে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে, একই রঙের বিভিন্ন কারুকাজের জাঁকজমক পোশাকে বিয়ে বাড়ির সবার নজর কাড়তে সক্ষম ওরা ক'জন।

সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে তারা ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেবের বিলেত ফেরত বন্ধুবান্ধব। এক কথায় আজকের অতিথিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষন তারাই।

এছাড়াও মামির বাড়ির সবাই এসেছে আজ, এমনকি রেজাও, আজ রেজাকে বেশ হাসি খুশি লাগছে,চোখেমুখে গম্ভীরতা কপটতা কোনো কিছুর লেশমাত্র নেই ওর। রুপা আজ শাড়ি পরেছে, আর মোখলেস চাচা পাঞ্জাবি। বিয়ে উপলক্ষে ওদের জন্য আলাদা ভাবে এই উপহার গুলো পাঠিয়েছিল ক্রীতিক নিজেই।

মোখলেস চাচা কিছুটা হাসিখুশি থাকলেও রুপার চোখ মুখ থমথমে,সমগ্র মুখশ্রীতে মলিনতা বিরাজমান। হয়তো এখনো বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না মেয়েটা।অবশ্য নিতে পারার কথাও নয়।

তবে তাতে যায় আসেনা জাহানারার, তিনি চাবির গোছা কোমড়ে ঝুলিয়ে বেশ খুশিতেই দিব্যি ঘুরে ঘুরে এর ওর সাথে গল্প করে বেড়াচ্ছেন।

সন্ধ্যা নাগাদ তিথিও এসেছে নিজেকে দামি দামি শাড়ি গহনায় মুড়িয়ে পটের বিবি টি সেজে। সাথে তার বিলোভড হাসবেন্ড খন্দকার সাহেব ও আছেন। বড় বড় ভিআইপি গেস্টরা এখনো অনুপস্থিত। হয়তো সময়ের সাথে সাথে তাড়াও চলে আসবেন।

যে সকল টুকটাক ভিআইপি অতিথিরা উপস্থিত হয়েছেন, তাদেরকেই আপাতত সময় দিচ্ছেন আজমেরী শেখ।

বেশ কয়েকজন অফিস ক্লায়েন্টদের সাথে কুশল বিনিময় করায় তিনি যখন বেশ ব্যস্ত, ঠিক সে সময় হুট করেই একজন প্রতিবেশি এসে তাদের কথার মাঝখানে ঢুকে কিছুটা উৎসুক হয়ে আজমেরী শেখকে জিজ্ঞেস করলো ,

----- আচ্ছা আপা, আপনার ছোট মেয়েটাকে তো দেখলাম না, ওকে দেখার খুব ইচ্ছে জানেন? আমাদের ছেলে আছে ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।যদি বিয়ে দিতেন....

মহিলা কথা শেষ করার আগেই আজমেরী শেখ অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের এসিসট্যান্ট কে শুধালেন,

---- ক্রীতিক কোথায়? এখানে নেইতো? আমি চাইনা অনুর বিয়েতে কোনোরূপ ঝামেলা ঝাটি হোক।

আজমেরী শেখের এহেন অগ্রাহ্য ভঙ্গিমায় মহিলাটি হতবাক, অপমান ও বোধ করলেন কিছুটা, মনেমনে ভাবলেন, তিনি কি জিজ্ঞেস করলেন আর আজমেরী শেখ কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া করলো, এ আবার কেমন আতিথেয়তা? আজিব!

নীলিমা সেজেগুজে এসে মাত্রই অরুর রুমে প্রবেশ করলো। দরজা খোলাই ছিল, খাটের উপর বসে লেজ নাড়ছে ডোরা। ওকে একটা সুন্দর বার্বি ড্রেস পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

নীলিমা রুমে এসে প্রথমে ডোরাকে একটু আদর করে অরুর দিকে চাইলো, অরু এখনো কানে টানা ঝুমকো পড়া নিয়ে বেশ কসরত করে যাচ্ছে।

নীলিমা এগিয়ে গিয়ে অরুর হাত থেকে দুলটা নিয়ে ওকে পড়িয়ে দিতে দিতে ওর প্রশংসা করে বললো,

--- তোকে মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছেরে অরু। আর এই লম্বা চুল গুলো, ইশ কি সুন্দর! কারও নজর না লাগুক।

তারপর একটু দুষ্টমি করে বললো,

--- অবশ্য যার নজর লাগার, সে অলরেডি লাগিয়ে দিয়েছে।

অরু মৃদু হেসে নীলিমাকে অভিবাদন জানিয়ে বললো,

--- তোকে বুঝি কম সুন্দর লাগছে? হবু দুলাভাই তোর রূপের আ'গুনে ঝ'লসে গেলো বলে।

---- যাক, ঝ'লসে বারবিকিউ হয়ে যাক হাতে আমার কি?

কথাটা বলে, নীলিমা একফালি মুঁচকি হাসি ফেরত দেয় , পরক্ষণেই ভাবুক হয়ে অরুকে শুধায়,

---- হ্যারে নিচে সবাইকে দেখলাম কিন্তু তোর বর মহাশয়কে তো দেখলাম না। সে কোথায়?

প্রতিউত্তরে অরু ঠোঁট উল্টে কিছুটা অন্য মনস্ক হয়ে বলে,

---- উনিতো সকাল বেলা অফিসে গিয়েছে কি দরকারি কাজ আছে বলে, বলেছিল তো সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে, কি জানি এখনো আসলোনা কেন?

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

---- বুঝলাম, কিন্তু অনু আপা কোথায় বলতো?

অরু ঘুরে দাঁড়িয়ে ডোরাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

---- আপাকে তো সেই বিকেল বেলায় মেয়েরা সাজাতে এসেছিল, তারপর তো আর বের হলোনা, চল গিয়ে দেখে আসি। তাছাড়া এমনিতেও আপা সেই সকাল থেকে কা'ন্নাকাটি করছে, আমি সামনে গেলে আমারও কেমন কা'ন্না পেয়ে যাচ্ছে।

নীলিমা অরুর সাথে আর মন খারাপের নদীতে জোয়ার দিলোনা, উল্টো স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

---- চল গিয়ে দেখে আসি, আপাকে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে, বর যাত্রী এলো বলে।

*****************************************

নীলিমা আর অরু করিডোর পেরিয়ে অনুর রুমে প্রবেশ করতে যাবে ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অনু।

অকস্মাৎ বেরিয়ে আসায় ওরা তিনজন ধাক্কা খেতে খেতেও সামলে নিলো। অনুর পরনে ভারী বিয়ের সাজ, বেবি পিংক ভারী লেহেঙ্গাটা দু'হাতে ধরে উদ্বিগ্ন মুখে দাড়িয়ে আছে অনু। সাজানো গোছানো প্রতিমার মতো মুখটায় ভর করেছে অযাচিত আ'ত'ঙ্ক। তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তালে হাপরের ওঠানামা করছে ওর বুক।

অনুকে এমন বিভ্রান্ত চেহারায় দেখে, ভাঁজ পড়লো অরুর কপালে। নীলিমাও আশ্চর্য বনে গিয়ে শুধালো,

---- কি হয়েছে অনু আপা? তুমি ঠিক আছো?

নীলিমার কথার জবাব দেয় না অনু, উল্টো শুষ্ক ঢোক গিলে অরুকে জিজ্ঞেস করে,

---- অরু মা কোথায়?

অরু ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু জবাব দিতে যাবে, তখনই পেছন থেকে আজমেরী শেখ পেছন থেকে কথা ছো'ড়েন ফের,

---- কি প্রয়োজন? বর যাত্রী এসে পরেছে তোমাকে নিচে যেতে হবে।

অনু ওদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে, এগিয়ে এসে আজমেরী শেখের দু বাহু ধরে গলা খাদে নামিয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,

---- ম...মা, আমার মনে হলো আমি ওই লোকটাকে দেখেছি। জানালা দিয়ে দেখেছি, অতিথিদের মাঝে দিব্যি দাঁড়িয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হুট করে দেখে আমার আত্মা কেঁপে উঠেছে। আর..

আজমেরী শেখ মেয়েকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,

---- অযথা কথা রাখো অনু, এমন একটা শুভ দিনে একটা শ'য়তা'নের কথা মুখে আনলে কোন আক্কেলে? তাছাড়া পুরো বাড়ি বডিগার্ড দ্বারা সুরক্ষিত, স'ন্দেহভাজন কেউ এলে নিশ্চয়ই আমাকে ইনফর্ম করা হতো। শুধু শুধু এসব ভেবে নিজের স্পেশাল দিনটাকে মাটি করোনা তো। আমি আসছি নিচে অতিথিরা অপেক্ষা করছেন।

আজমেরী শেখ সামনে কয়েক কদম পা বাড়িয়ে ফের ঘুরে তাকিয়ে অরু আর নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

----অনুকে নিয়ে জলদি এসো।

*****************************************

প্রত্যয় বসে আছে ফুল সজ্জিত স্টেজে। চারিদিকে বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি আমেজ, অতিথিরা সবাই কনেকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে,অমিত ও হাজির, তাকে কিঞ্চিৎ ক্লান্ত দেখালেও মুখে লেগে আছে এক চিলতে প্রানোচ্ছল হাসি।

কালকে সবাই নাচ গান করলেও আজকে কেমন মনমরা হয়ে বসে আছে ক্রীতিকের বন্ধু মহল। বউ সাজে কনেকে দেখার চেয়েও দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে সামনের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে সায়র, হয়তোবা প্রিয় মানবীকে এক ঝলক দেখার উদ্দেশ্যে, তার রাগীনির চাহনীতে আরও একবার ভ'স্ম হতে হতে প্রানে বেঁচে যেতে।

সায়র নিজেও বুঝতে পারছে না, এইটুকু হাঁটুর বয়সী মেয়েটার সাথে মজার ছলে ঝগড়া করতে করতে কখন যেন তী'রের ফলার মতোই হুট করে মনে গেঁথে গেলো পুরান ঢাকার এই শ্যামলতা রাগীনি। এখন তো আমেরিকা ফিরে গিয়েও শান্তি নেই, বারবার মনে হবে রাগীনিটা থাকলে ভালো হতো একটু ঝগড়া করে সময় কাটানো যেত।

সবার মাঝে থেকেও শুধুমাত্র নীলিমাকেই দেখতে চাইছে সায়রের তৃষ্ণার্থ ব্যাকুল দু'চোখ। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষন ঘনিয়ে এলো, সকল জল্পনা কল্পনা শেষে স্টেজের দিকে পা বাড়ালো, আজকের মোক্ষম চরিত্র। সবার দৃষ্টি যার দিকে নিক্ষিপ্ত, আজকের অনুষ্ঠানের সবচেয়ে সুন্দর রমনীটি,প্রত্যয়ের হবু স্ত্রী, ওর মনের রানী, ওর হৃদয় হরনী মিসেস অনন্যা এহসান।

অরু আর নীলিমা সাথেই ছিল অনুর। সেই সাথে আরও ছিল প্রত্যয়ের বোন আর আত্মীয় স্বজনরাও। অনু ধীর পায়ে লেহেঙ্গা সামলে প্রত্যয়ের নিকট এগিয়ে আসছে, ফিনফিনে দোপাট্টা দিয়ে মাথায় একহাত ঘোমটা টানা,তার আড়াল থেকেই অপার সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ছে মেয়েটার। প্রত্যয় দাঁড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে, অনুর একেকটা পদধ্বনি যেন প্রত্যয়ের বুকে আনন্দ আর উত্তেজনার ঝড় বইয়ে দিতে সক্ষম।

অবশেষে প্রত্যয়ের ঝড়ো হাওয়া মনে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামিয়ে স্টেজে উঠে আসে অনু। প্রত্যয় নিজের একহাত বাড়িয়ে তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। অনু তা গ্রহন করে এগিয়ে গিয়ে প্রত্যয়ের পাশের রাজকীয় ডিভানে বসে পরে। যদিও বা ওদের দুজনার মাঝে ফুলের এক বিস্তার পর্দা ঝুলানো, কেবল তিন কবুলের পরই তা তোলা হবে আর বর তখনই বউয়ের মুখ দেখবে। তার সত্যিকারের বউয়ের মুখ।

*****************************************

ক্যাটারিং এর এদিকে সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ম ম করছে চারিপাশ । ওদিকে এই মূহুর্তে কনের মুখ দেখা নিয়ে বরের বাড়ির সবাই ব্যস্ত। আর এদিকে বরের একপায়ের জুতোটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে চোরের মতো চারিপাশে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে নীলিমা।

নীলিমা এককোণে দাড়িয়ে অনবরত দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল, তখন হুট করেই কে যেন নিঃশব্দে কাঁধে হাত রাখলো ওর।অকস্মাৎ ঘটনায় চকিতে লাফিয়ে উঠে পেছনে চোখ ঘোরালো নীলিমা।দেখতে পেলো, ওর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সায়র।

সায়র কে দেখা মাত্রই নীলিমা ঝাঁজিয়ে ওঠে, তৎক্ষনাৎ দাঁত খিঁচিয়ে বলে,

---- এখানে কি চাই?

সায়র নিজ গ্রীবাটা আরেকটু সামনে বাড়িয়ে নীলিমার ডাগর চোখের পাতায় সন্দিহান চোখ দুটো রেখে শুধালো,

--- কাউকে খুজঁছো?

নীলিমা ঠোঁট বাকিয়ে জবাব দিলো,

----জ্বি না, আর খুঁজলেও আপনাকে খুঁজিনি, যান তো, আজাইরা।

নীলিমার কথা গায়ে মাখালো না সায়র, মেয়েরা এমন একটু আধটু ঝাঁজিয়ে কথা বলে ওতে বেশ কিছু অসুবিধা নেই, অর্ণব কত শুনেছে এমন। থা'প্পড় খেতে খেতে ওর গালটাই বোধ হয় বেঁকিয়ে গিয়েছে , তবুও তো শেষমেশ এলিসাকেই পেয়ে গেলো। নীলিমা আর যাই হোক থা'প্পড় মা'রার সাহস নিশ্চয়ই দেখাবে না,উহুম কখনোই না।

যায়গাটা সরু এদিক দিয়ে ক্যাটারিং এর লোকজন আসা যাওয়া করছে হরদম। নীলিমা সেখানেই ঘাপটি মে'রে দাড়িয়ে আছে সেই সাথে সায়র ও। নীলিমা চুপচাপ শান্ত মস্তিষ্কে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সায়র ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে নরম স্বরে শুধালো,

--- এ্যাই মেয়ে, আমেরিকা যাবে আমার সাথে?

নীলিমা নিজ ভ্রু জুগল কুঞ্চিত করে বললো,

--- কিহ!

সায়র ফের আওড়ালো,

--- বলেছি আমার সাথে নিয়ে যাবো তোমায়, নয়তো এতো রাগ কাকে দেখাবে তুমি হ্যা?

তুমিতো রীতিমতো আমাকে মিস করবে, দেখা যাবে আমার উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে তোমার বদ হজম হয়ে গেলো, তারপর ব'মি, আর পর ডি'সি'ন্ট্রি।

কথাটুকু শেষ করে চকিতে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো সায়র, পরক্ষণেই এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে মুখমন্ডলে কৃত্তিম গম্ভীর ভাব টেনে বললো,

--- নো ওয়ে, আমার জন্য কারও ডি'সিন্ট্রি হবে?সেটা তো হতে পারে না, পুরো আমেরিকা জানে আমি ভারী সদয় হৃদয়ের মানুষ,তাহলে এই নি'র্দয় কাজটা কি করে করবো আমি? কিছুতেই না, তোমাকে এমন ঘোর ডি'সিন্ট্রি আ'শঙ্কার মধ্যে রেখে আমি তো কখনোই ও দেশে গিয়ে শান্তি পাবো না রাগীনি। তার চেয়ে তুমি বরং আমার সাথে.....

সায়র টেপরেকর্ডারের মতো এক নাগাড়ে কথা বলছে তো বলছেই, থামা থামির নামই নিচ্ছে না, এই পর্যায়ে এসে ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিলো নীলিমা, ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কটমটিয়ে বললো,

----- চুপ করবেন আপনি? তখন থেকে ডি'সিন্ট্র ডিসি'ন্ট্রি বলে আমার পেট খারাপ করে দিলেন, বলি এসব বলতে আপনার কি মুখে বাঁধে না একটু ও?

সায়র বলতে চাইলো,

---- ডি'সিন্ট্রি একটা প্রাকৃতিক সমস্যা, সেটা আবার মুখে বাঁধার কি আছে?

তবে কথা এগোতে পারলো না আর, তার আগেই ক্যাটারিং এর লোকের ধা'ক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে আচমকা পা ফসকে উল্টে পরলো নীলিমার শরীরের উপর। অ সাবধানতায় ওর হাতটা গিয়ে ঠেকলো নীলিমা মেদহীন লতানো উন্মুক্ত কোমড়ের ভাঁজে।

নীলিমা সায়রকে সামলালো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই চরম সাহসীকতা আর জিদের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সায়রের গালে ঠাটিয়ে চ'ড় বসালো ও। আচমকা চ'ড় খেয়ে সায়র অ'গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নীলিমার পানে,কিন্তু তার চেয়েও বেশি অ'ঙ্গার দেখা গেলো নীলিমার চোখে মুখে।

একপর্যায়ে সায়রের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কেঁদে উঠলো নীলিমা।

কিছু মানুষ আছে রাগ দেখাতে গিয়ে কা'ন্না পেয়ে যায়, নীলিমা বোধ হয় ওই ক্যাটাগরিতেই পরে।

নীলিমা কাঁদছে দেখে চোখমুখ কিছুটা স্থীর করলো সায়র, চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নরম কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

---- কাঁদছো কেন, কি হয়েছে? আ'ম সরি এটা ইচ্ছে করে হয়নি,আমি ইচ্ছে করে তোমার ওখানে...

সায়রের কথা না শুনে মাঝপথেই চোখ মুছতে মুছতে গটগট পায়ে ওখান থেকে চলে গেলো নীলিমা। নীলিমা চলে যেতেই কোথা থেকে যেন অরু এসে চারিদিকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বলে ওঠে,

---- আরেহ জুতোটা তো এখানেই পরে আছে তাহলে নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?

সায়র তখনো সেখানেই দাড়িয়ে এক ধ্যানে নীলিমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিল , অরু জুতোটা হাতে নিয়ে সায়রের দিকে তাকিয়ে অসহায় সুরে বললো,

---- আর বলবেন না ভাইয়া, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই মেয়েটা শুধু শুধু কাঁদে। আশ্চর্য!

অরুর কথায় যেন আকাশ থেকে পরলো সায়র, তৎক্ষনাৎ চোখ বড়বড় করে শুধালো,

---- কি বললে তুমি? নীলিমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? কবে, কোথায়, কখন?

অরু ঠোঁট উল্টে ভাবলেশহীন কন্ঠে জানালো,

--- এইতো আাপার বিয়ের দুই তিন দিন পরেই আকদ হবে, পরবর্তীতে পড়াশোনা শেষ হলে তুলে দেওয়া হবে।

সায়রের গলাটা ধরে এসেছে,অরুর কথার পাছে ও আর দ্বিতীয় প্রশ্নটা করে উঠতে পারলো না সাহস দেখিয়ে। কেমন যেন পুরো দুনিয়া দুলছে ওর চোখের সামনে।

তাই অরুও আর দাঁড়ালো না জুতোটা নিয়ে হেলেদুলে চলে গেলো অন্দর মহলের দিকে।

*****************************************

অন্দরমহলের ভেতর প্রবেশ করে, সিঁড়ি ছাপিয়ে দোতলার করিডোরে পা রাখতেই থমকে গেলো অরু। পা দুটো আটকে রইলো সেখানেই, দক্ষিণের বাতাসে দোদুল্যমান জানালার দিকের মোমবাতি গুলো সব নিভে পরে আছে, সেখানেই সটান দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ছে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। লোকটা উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবে অরুর তাকে চিনতে অসুবিধে হলোনা খুব একটা । তাই খুব বেশি না চিন্তা করেই সহসা এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে লোকটাকে ডেকে উঠলো অরু,

---- অমিত ভাই?

অমিতের বন্ধুত্বসুলভ আচরণে বরাবরই বিমোহিত অরু। কখনো এমন কোন ঘটনা কিংবা আচরণ ওর নজরে পরেনি যার কারনে অমিতকে এরিয়ে যেতে হবে কিংবা ঘৃ'ণ্য নজরে দেখতে হবে। তবুও সেদিনের ঘটনার পর থেকে ক্রীতিকের ভয়ে বলা চলে অমিতকে একপ্রকার এরিয়েই চলেছে অরু।

কিন্তু আজ তো সে বাড়ি বয়ে এসেছে, তারউপর বহুদিনের অসু'স্থতা ছাপিয়ে একটুখানি সুস্থ হয়েছে লোকটা, সেই সুবাদেই অমিতের সাথে নিজ থেকে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলো অরু।অমিত ঘুরে তাকালে অরু আন্তরিক হেসে শুধালো,

--- অমিত ভাই এখন ঠিক আছেন? পায়ের কি অবস্থা?

অরুর প্রশ্নে একটুকরো হাসি ঠোঁটের আগায় খেলা করে গেলো অমিতেরও, অতঃপর হেসে'ই জবাব দিলো অমিত,

---- এখন ঠিক ঠাক। তোমার কি খবর?

নোবেলটা কতদূর এগোলে?

অমিতের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সুযোগ হলোনা অরুর, তার আগেই ওর চোখ গেলো দমকা হাওয়ায় নিভে যাওয়া মোমবাতি গুলোর দিকে, ও তাড়াহুড়ো করে অন্যপাশ থেকে আরেকটা জ্বলন্ত মোম নিয়ে এসে লম্বা চুল গুলোকে কাঁধের একপাশে রেখে , জানালার কাছে আয়েশ করে বসে নতুন উদ্যমে জ্বালাতে শুরু করলো মোমবাতি গুলো।

কাঁচা হাতে মোম জ্বালাতে জ্বালাতে অরু আর খেয়ালই করেনি অমিত এখনো আছে না চলে গিয়েছে। চুল সরানোর দরুন মোমের নরম আলোটুকু ঠিকরে পড়ছে অরুর ধবধবে কোমল পৃষ্ঠদেশে, নতুন লেহেঙ্গার এই ব্লাউজের গলাটা বেশ বড়, এতোই বড় যে ক্রীতিকের হলুদ লাগানো অংশ স্পষ্ট দৃশ্যমান।

এরকম অপ্রত্যাশিত অথচ আকাঙ্খিত দৃশ্য দেখেই চোখ আটকে গেলো অমিতের। লোভাতুর কামুক চোখ দুটো ঘুরে ফিরে আটকে যাচ্ছে ওই একই যায়গাতে। অরুর প্রতি খারাপ আগ্রহ, লালসিত কিংবা দু'শ্চরিত্র মনোভাব কোনোকালেই ছিলোনা অমিতের।

বরাবরই মনের এক কোনে অরুকে নিজের সহধর্মিণী, নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস করেছে আড়ালে আবডালে। কিন্তু এই মূহুর্তে নিস্তব্ধ রাতে ওর সভ্য পুরুষ সত্তাটা কোথায় যেন যাচ্ছে ক্রমশ, অমিত নি'র্লজ্জের মতো অরুর দিকে তাকিয়ে আছে,আর শুষ্ক ঢোক গিলছে বারে বারে।

শুধু ভাবছে অরুর ওই নরম তুলতুলে শরীর অবধি পৌঁছাতে গেলে কতটা বাঁধা অতিক্রম করতে হতে পারে, ঠিক কতটা? অমিত যখন অরুর দিকে তাকিয়ে আবেশিত ঘোরে বিভোর, সেই ঘোরের মাঝেই হুট করে কপাল কুঁচকে গেলো ওর,অস্ফুটেই অমিত অরুর পিঠের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে ওঠে,

---- কি লেগে আছে হলুদ হলুদ? এখানে হলুদ কে লাগালো?

অমিতের হাতটা অরুর পিঠে ছুঁই ছুঁই হয়তোবা মেগা সেন্টিমিটার দূরত্ব এখনো অবশিষ্ট,আবার তার কমও হতো পারে,ঠিক তখনই, হুট করে, একদম অকস্মাৎ ঝ'ড়ের গতিতে, বাঁজপাখির মতো ছো মে'রে ওর হাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরলো কেউ।

আচমকা ঘটনাতে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো অমিত, সেই সাথে কিছুটা ভয় ও পেলো। ভ্রম কেটে যেতেই অরুর থেকে চোখ সরিয়ে হাতের চাপে ওর কব্জিটা ভা'ঙার জন্য উদ্যত হওয়া লোকটাকে দেখার উদ্দেশ্যে সামনে দৃষ্টিপাত করলো অমিত।

পিঠের উপর অচেনা হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব হতেই ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে তাড়াহুরো করে চুল গুলো পিঠে ছেড়ে দিলো অরু। তারপর হকচকিয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অজানা ভয়ে হৃদয় নেড়ে উঠলো ওর।

তৎক্ষনাৎ শুকনো ঢোক গিলে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো অরু, দেখলো ওরই সামনের অমিতের কব্জিটা চে'পে ধ'রে চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে আছে সয়ং ক্রীতিক।

পুরো বাড়ি ভর্তি সকলে বেবি পিংক থীমের জামা কাপড় পড়ে থাকলেও ক্রীতিকের পড়নে এখনো ব্ল্যাক স্যুট, একহাতে কিছু ফাইল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে সে। আর এই মূহুর্তে আ'গ্নেয়গিরির দা'বানলের মতোই হুর হুর করে আ'গুনের লে'লিহান জ্ব'লে উঠেছে ওর সবগ্র মস্তিষ্কে জুড়ে ।

কিন্তু ক্রীতিক সুকৌশলি,যার ফলসরূপ নিজের মেজাজ টাকে সুকৌশলেই সামলালো ও। কয়েক মূহুর্ত বাদে অমিতের হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে গভীর অথচ মসৃণ আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো অমিতকে,

---- কি করছিলে তুমি এখানে? অতিথিরা তো সব নিচে অপেক্ষা করছে।

ক্রীতিকের কথার পেছনে অমিত আমতা আমতা করে মাথা চুলকে বললো,

--- এইতো স্মোক করতে এসেছিলাম, তারপর হুট করেই অরুর সাথে দেখা হয়ে গেলো, তাই না অরু?

অরুর দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসলো অমিত।

পরক্ষণেই ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে পুনরায় অমিত বলে,

---- আমি নিচে গিয়ে দেখছি কাজি সাহেব এলো কিনা, তোমরা ও চলে এসো।কেমন?

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কথাটুকু শেষ করে দ্রুত পদধ্বনিতে দোতলা ত্যাগ করে অমিত। অমিত চলে গিয়েছে কি যায়নি, নিজের ঘাড় ফুটিয়ে অরুর সামনে এসে কোনোরূপ কথা, কিংবা জবাবদিহিতা ছাড়াই ওর গালে নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে চ'ড় বসালো ক্রীতিক। চ'ড়টা এতো জোরেই ছিল যে অরুর চুলের পাঞ্চ ক্লিপটা ছি'টকে পরলো অদূরে। থা'প্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে কাঁপা গলায় কাই কুই করে অরু বলে,

---আ..আম..আমি..

---এই চুউউপ.. শাট ইউর ফা'কিং মাউথ।

ক্রীতিকের র'ক্তিম চোখ আর কঠোর ধমকে আরেক দফা কেঁপে উঠল অরুর ছোট্ট শরীরটা।

এই মূহুর্তে জবাব দেওয়া কিংবা ক'ষ্টে নয়,বরং ভয়ে কাঁপছে অরু। তবে ওর তো কোন দোষ নেই,সেটা ক্রীতিককে বোঝাতে হবেতো।

কিন্তু ক্রীতিক বুঝলো না, উল্টো অরুর চোয়ালটা শক্ত হাতে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

--- ওই বা'স্টা'র্ড টা তোর শরীরের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস কোথায় পেলো? জবাব দে?

ওই নোং'রা হাতটা আমার জিনিসকে স্পর্শ করেছে, আমিতো তোকে আজ মে'রেই ফেলবো অরু। তুই জানতিস আমি কতোটা খারাপ, তাহলে কলিজায় এতো সাহস কোথা থেকে এলো? হাউ ফা'কিং ডেয়ার ইউ টু টক উইথ সামওয়ান লাইক অমিত?

গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলো ক্রীতিক।

অরু ব্যথায় জর্জরিত সেই সাথে ভয়ে তটস্থ, কথা বলার কোনো পরিস্থিতি অবশিষ্ট রাখেনি ক্রীতিক, তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ফোপাঁতে ফোপাঁতে চোখের জল ফেলছে মেয়েটা।

হৃদয়টা ওর ভে'ঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, শেষ পর্যন্ত কিনা অমিত ও এমন একটা কাজ করে বসলো?

ক্রীতিক দমলো না, একই ভাবে অরুর গালটা চেপে ধরে বললো,

---- আমি জানি তুই কিছু করিসনি, তুই বুঝতেও পারিসনি এমন কিছু হবে, কিন্তু তুই অন্যা'য় করেছিস অরু, ঘোর অ'ন্যায় করেছিস। আমি বারণ করা সত্ত্বেও অমিতের সাথে কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছিস, তোকে আমি কতবার স'তর্ক করেছি আপন ভাই ছাড়া আর কোনো ভাই'ই আদতে ভাই নয়, বলিনি বল?আন্সার মি!

রাগে আক্ষেপে অরুকে ঝাঁকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ক্রীতিক।

অরুর কা'ন্নার আওয়াজ জোড়ালো হলো, ক্রীতিক তীব্র রা'গে অরুকে সামান্য ধা'ক্কা মে'রে দূরে সরিয়ে দিয়ে পরনের ব্লেজার আর ফাইল গুলো করিডোরের মেঝেতেই ছু'ড়ে মা'রলো। পুরো অন্দলমহল খাঁ খাঁ করছে, এদিকে একটা কাক পক্ষি ও নেই। বাইরে সবার আনন্দ উল্লাসের শোরগোল শোনা যাচ্ছে, হয়তো বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এটার জন্যই তো এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিল ক্রীতিক। বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরুকে ওর রুমে আটকে রেখে,হাতে একটা হ'কিস্টিক নিয়ে নিজের সফেদ রঙা শার্টের হাতাটা গুটাতে গুটাতে নিচে চলে যায় ক্রীতিক, যাওয়ার আগে অরুকে উদ্দেশ্য করে তীর্যক কন্ঠে বলে,

--- আমি ফেরার আগ পর্যন্ত এখান থেকে এক পা ও ন'ড়লে তোর খবর আছে, এই দেহে প্রা'ন থাকবে না।

*****************************************

ক্রীতিক হকি'স্টিক সমেত নিচে এসে সরাসরি প্রত্যয়ের মাকে জিজ্ঞেস করলো,

--- অমিত কোথায়?

প্রত্যয়ের মা বিয়ে বাড়িতে ব্যস্ত সময় পার করছেন, তাই কোনো কিছু খেয়াল না করেই তিনি বললেন,

--- ও তো বাবা মাত্রই বেরিয়ে গেলো, কি জরুরি কাজ আছে বললো।

ক্রীতিক ও আর দাড়ালো না সেখানে, বড় বড় পা ফেলে বাইক নিয়ে সোজা বেড়িয়ে গেলো ক্রীতিক কুঞ্জ থেকে।

আর কেউ খেয়াল না করলেও এই পুরো ঘটনাটা খেয়াল করলো ক্রীতিকের বন্ধুরা। ক্রীতিক বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলিসা তরিঘরি করে বলে উঠলো,

---- অর্ণব, সায়র ওকে আটকা জলদি, নয়তো যাকে মা'রতে যাচ্ছে তাকে আজ মে'রেই ফেলবে।

অর্ণব সায়র আর ঘটনা বোঝার জন্য অপেক্ষা করেনা,কোনোকিছু না ভেবেই ওরাও বাড়ির গাড়িটা নিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে পরে ক্রীতিকের পিছু পিছু।

জোস্ন্যা মাখা রাত, অমিত কে পাওয়ার জন্য খুব বেশিদূর যেতে হলোনা ক্রীতিকের, মহল্লা ছাড়ানোর আগেই অমিতের সাদা টয়োটা গাড়িটা ধরে ফেললো ও।

ক্রীতিকের চোখে গাড়িটা পরার সঙ্গে সঙ্গে কোনোকিছুর আশ'ঙ্কা না করেই একেবারে অমিতের গাড়ির সামনে গিয়ে স্ট্যান্ড করালো বাইক, মাথার হেলমেট টা খুলে বাইকের পেছন থেকে হকি'স্টিক নিয়ে গাড়ির জানালায় কড়া নাড়তেই জানালার কাচ নামালো অমিত, জানালার কাচ নামাতেই ক্রীতিকের থমথমে মুখটা দেখে কিছুটা হতবাক চাহনি নিক্ষেপ করে অমিত বলে ওঠে,

---- ক্রীতিক তুমি এখানে?

--- গাড়ি থেকে নামো আগে, বলছি।

অমিত কিছু না ভেবেই ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো অতঃপর ক্রীতিকের হাতের হকি'স্টিকি'কের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললো,

---- কি হয়েছে?

ক্রীতিক জবাব দিলো ,

---- আ'ম সরি অমিত।

এরপর আর কোনো কথা নয় সরাসরি অমিত কে হ'কিস্টিক দিয়ে আ'ক্রম'ন করে বসলো ক্রীতিক। কয়েক ঘাঁ শক্ত প্র'হার শরীরে আঁচড়ে পরতেই কিছুটা টলে পরলো অমিত। কিন্তু ও নিজেও তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়,যথেষ্ট বলবান পুরুষ অমিত।

কিছুদিন আগের এ্যা'ক্সিডে'ন্টের কারনে শক্তির কিছুটা ক্ষয় হলেও এতোটাও দূর্বল নয় যে,ক্রীতিকের হ'কিস্টি'কিকের প্র'হারের বিপরীতে ও চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।

এবং সে-ই শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো অমিত, উঠে গিয়ে শক্ত হাতের ঘু'ষি ছাড়লো ক্রীতিকের নাক বরাবর, তৎক্ষনাৎ নাক ফে'টে র'ক্ত বেরিয়ে এলে ওর।

ক্রীতিক সেটা আলগোছে মুছে নিয়ে, ঠোঁট কামড়ে আঙুলের ইশারায় অমিত কে বললো,

--- গুড জব,জাস্ট হিট মি। নাহলে তোমাকে মা'রতে আমার অনুশোচনা হচ্ছে।

---- ইউ ফা'কিং সাই'কো'প্যাথ,

কথা টা আওড়ে ওকে মা'রতে গিয়েও মা'রলো না অমিত, থেমে গিয়ে উল্টো চিল্লিয়ে উঠে বললো,

---- কেন মা'রছো তাহলে? কিসের শ'ত্রু'তা আমার সাথে তোমার?

ক্রীতিক অমিতকে পুনরায় হ'কি'স্টিক দিয়ে মা'র'তে মা'র'তে বললো,

---- আ'ম সরি অমিত, বাট তুমি খুব বড় মিসটেক করে ফেলেছো, জানতে চাও সেটা কি?

অমিতের শরীর ফেটে র'ক্ত বেরোচ্ছে, তবুও চোখে মুখে একরাশ কৌতুহল নিয়ে ক্রীতিকের পানে চাইলো অমিত।

ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,

---- আজ যে মেয়েটার দিকে তুমি নোং'রা চোখে চেয়েছিলে, যার শরীরে লালসা করে হাত বাড়িয়ে ছিলে, ওই মেয়েটা আমার বিয়ে করা বউ!!

আমার সম্পত্তি, আমার হার্টবিট, ইভেন সি ইজ মাই এভ্রিথিং, বা'স্টা'র্ড।

ক্রীতিকের কথা শুনে চমকে ওঠে অমিত, এই তাহলে ক্রীতিকের রা'গের কারণ? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? অমিতের জানা মতে অরুর মা ক্রীতিকের ও সৎ মা, তাহলে সৎ বোন কি করে বউ হয়?ও এম জি! ইটস আ হিউজ ব্লা'ন্ডার। কিন্তু এখন? ক্রীতিক নিশ্চয়ই এতো বড় ভুলের জন্য অমিতকে ছে'ড়ে দেবেনা?

অমিত চুপচাপ শুষ্ক ঢোক গিলছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বলে,

--- আগের বার সতর্ক বার্তা হিসেবে শুধু গাড়ি এ্যা'ক্সি'ডেন্ট করিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম, তারপরেও ক্রমাগত একই ভুল করে গিয়েছো তুমি অমিত।

ক্রীতিকের শেষ কথাটা শোনা মাত্র অমিত হতবিহ্বল হয়ে পরে, মনেমনে ভাবে আগের বারও অরুর ব্যাপারে কথা বলে যাওয়ার সময়ই অনা'ঙ্ক্ষিত দূর্ঘ'টনা'র স্বীকার হতে হয়েছিল ওকে। আর এখনও।

নিজের কথা শেষ করে ক্রীতিক পুনরায় অমিতকে হকি'স্টিক দিয়ে প্রহার করতে যাবে, ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন ছুটে এসে সায়র অর্ণব দুজন মিলে তাড়াহুড়ো করে ধরে ফেললো হকি'স্টি'কটা। সেই সাথে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো উ'গ্র মেজাজী ক্রীতিক কেও।

*****************************************

অন্দরমহল এখনো নিস্তব্ধ, কারও কোনো সারাশব্দ নেই, হয়তো এখনো সবাই বাইরে স্টেজের ওখানে বর কনে নিয়ে মেতে আছে, অথচ অরু এখানে একা রুমে বসে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে চোখের জল ফেলছে।

লম্বা পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, থা'প্প'ড়ের আ'ঘা'তে গালটা জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হা করলেও ব্যথায় টনটন করে উঠছে। ক্রীতিকের মুখের আগেই হাত উঠে যায় শরীরে, যা অরু প্রচন্ড ভ'য় পায়, ওই জন্যই তো সবসময় ওইসব কাজ এরিয়ে চলে যেগুলো ক্রীতিকের অপছন্দ, কিন্তু আজ না চাইতেও সেই একই কাজ করলো ও।

আর অমিত? যে মানুষটাকে অরু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলো, ভাইয়ের মতো ভরসা করলো, এমনকি ক্রীতিকের সাথে পর্যন্ত যাকে নিয়ে ত'র্ক করলো, সে কিনা এভাবে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলো ছিহ, ভাবলেই গা গিনগিন করে উঠছে অরুর।

কাঁদতে কাঁদতে মাথাটা ধরে এসেছে ওর,একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, তারউপর নিচে আপা কি করছে কে জানে?

অরুর মস্তিষ্কে প্রবাহমান হাজারো ভাবনার ছেদ ঘটলো ক্রীতিকের আগমনে, ক্রীতিক রুমে প্রবেশ করতেই ঝকঝকে লাইটের আলোয় অরু দেখলো ওর নাকে মুখে র'ক্ত লেগে আছে, নিজের স্বামীর এহেন অবস্থা দেখে অরু উদ্বিগ্ন হলো বটে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না তীব্র অভিমানে। ক্রীতিক কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার ফুরসত ও দিলোনা, এগিয়ে এসে অরুর হাতটা ধরে টা'নতে টা'নতে নিয়ে নিয়ে গেলো রুমের বাইরে অতঃপর কোলে তুলে সিঁড়ি ভেঙে একে বারে নিচে বিয়ের আসরে।

বিয়ে বাড়িতে তখনো ওদের দুজনকে কেউ খুব একটা খেয়াল করেনি , কিন্তু যখন ক্রীতিক অরুকে টেনে এনে সবার মাঝে দাড় করিয়ে ওর সমগ্র মুখ মন্ডলটা চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো, ঠিক তখনই পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল উপস্থিত সকলের।

ছোট বড় সবাই উপস্থিত এখানে, অথচ সবার মাঝখানে দাড়িয়ে দ্য গ্রেট অ'সভ্য খ্যাত জায়ান ক্রীতিক অরুর সমস্ত মুখে টুকরো টুকরো চুমু খেয়ে তবেই থামলো।

ওদিকে আজমেরী শেখের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে, অনু প্রত্যয়কে আয়না দেখানো হচ্ছিলো এতোক্ষন, কিন্তু এই মূহুর্তে আয়না দেখা বাদ দিয়ে ওরা ক্রীতিক অরুকে দেখায় ব্যতিগ্রস্থ হয়ে পরলো।

অরুর অবস্থা ম'রি ম'রি, চারিদিকের জোড়া জোড়া কৌতুহলী আর সন্দিহান চোখ গুলো এড়াতে নিজের চোখ দুটোই খিঁচিয়ে বন্ধ করে মাথাটা নুয়িয়ে রেখেছে অরু।

ক্রীতিক প্রথমে অরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকালো, তারপর শক্ত গলায় বললো,

---- মাথা উঁচু কর অরু, রাইট নাও।

চারিপাশের সকলে এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তা দেখে ক্রীতিক সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ,

---- এভরি ওয়ান এটেনশন প্লিজ, ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন ইটস আ বিগেস্ট মিসটেক কি আমি সবাইকে জানিয়ে শুনিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করতে পারিনি।

বাট আ'ম নট সিঙ্গেল এনি মোর, আই হ্যাভ আ ওয়াইফ।আর এখন, এই মূহুর্তে আমি সবাইকে জানাচ্ছি, আমার পাশে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী, মিসেস জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

হ্যা জানি, এখনো অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে , আমি সেটাও ক্লিয়ার করছি, আমার স্ত্রী আমারই সৎ মায়ের আগের পক্ষের সন্তান। এবং আমি জেনে শুনেই তাকে বিয়ে করেছি, উই আর হ্যাপিলি ম্যারেড নাও।

আশা করছি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কারোর মাঝে আর কোনো সন্দেহ কিংবা জটিলতা নেই এখন আর। যদি থেকে থাকে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা, কারন জেকে কখনো সোসাইটির ধার ধারেনা। নেভার এভার।

এক নাগাড়ে কথা শেষ করে গলা কিছুটা খাদে নামিয়ে ক্রীতিক পুনরায় বলে,

---- থ্যাংকস ফর ইউর ভ্যালুয়েবল টাইম গাইস, নাও ইউ ক্যান এনজয় দ্য ওয়েডিং পার্টি।

শেষ বাক্যটার ইতি টেনে অরুকে এক প্রকার ফেলে রেখেই হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেলো ক্রীতিক। আজ বোধ হয় আর অরুর উপর থেকে রা'গ কমবে না ওর।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৪৭

চন্দ্রদীপ্ত মধ্যরাত, রুপোর থালার মতো চাঁদটা তীর্যক রুপোলী আলোতে ভূবণ ভরিয়ে তুলছে, তারপরেও ঈশান কোনে কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর জ্বলে ওরা বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর চারিদিকের তীব্র হিমেল হাওয়ায় মনে হচ্ছে শেষ রাতে বৈশাখী ঝড়ে লন্ড ভন্ড হবে প্রকৃতি।

প্রত্যয়দের বাড়িটা ক্রীতিক কুঞ্জের তুলনায় কুঁড়েঘর ই বলা চলে। ছোট মতো একটা দু'তলা বাড়ি। নিচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘর, আর অতিথিদের জন্য গেস্টরুম। আর উপর তলায় প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু আর বড় আপুর শোবার ঘর। যদিও বা বড় আপু বেশির ভাগই তার শশুর বাড়িতেই থাকেন।

কালেভদ্রে যখন এ বাড়িতে আসা হয় তখনই কেবল তার রুমে মানুষের আনাগোনা লক্ষ করা যায়।

প্রত্যয় নিজেও আমেরিকা থেকে বছর অন্তর ছাড়া দেশে ফেরেনা, যার ফলরূপ মুরব্বি দুজন ছাড়া পুরো বাড়িটা শূন্যই থাকে বলা চলে।

প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু অমায়িক মানুষ। বিয়ের আগে শশুর শাশুড়ী নিয়ে অনুর মন গহীনে যে অযাচিত আ'তঙ্ক'রা ঘুরে বেড়াতো, চোখ বুজলেই শশুর বাড়ি নামক যায়গাটা কে যেন মহাযজ্ঞ স্থল ঠেকতো, সেই সকল ভুল ধারনাকে এক দর্শনেই বিনা'শ করেছেন প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু।

আজ এই বাড়িতে পা রাখার পরে অরু আর ক্রীতিকের বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেশী আত্নীয় স্বজনদের মুখ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি অনুর।

কিন্তু প্রত্যয়ের আব্বুর কান অবধি সে সব কথা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করেছেন, নিজের আত্নীয় স্বজন হোক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী সবার উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় একটাই কথা বলেছেন,

----- বউমা যেহেতু আমার, বউয়ের পরিবারটাও আমারই, আর আমার পরিবার নিয়ে যারা কুৎসিত মন্তব্য করার স্পর্ধা দেখাবে, তারা কখনোই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেনা। তাছাড়া ধর্মীয় আইন কানুন বাদ দিয়ে সমাজের কুসংস্কারে গা ভাসানোর মানুষ আমি নই। ধর্মে যে সম্পর্কের প্রাধান্য আছে, আমার নিকট ও তার যথাযথ সম্মান রয়েছে । দ্বিতীয়বার বউমার বোনকে নিয়ে আর একটাও কথা যাতে না হয় এ বাড়িতে ।

কথা শেষ করে তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে দৃঢ় গলায় আদেশ করে বলেন,

---- প্রত্যয়ের আম্মু, তুমি খেয়াল রেখো। বউমার সম্মানহানী হয় এমন কোন কথা যাতে দ্বিতীয়বার আমার কান অবধি না আসে।

নতুন শশুর শাশুরির কাছ থেকে এতোটা প্রাধান্য, এতোটা আন্তরিকতা পেয়ে সত্যিই তখন গর্বে বুকটা ফুলে ফেঁপে উঠছিল অনুর, বারবার মনে হচ্ছিল প্রত্যয়ের মতো একজন ভদ্র সভ্য, শান্ত ছেলে জন্ম দেওয়া কেবল তাদের মতো অমায়িক আর স্বচ্ছ হৃদয়ের মা বাবার দ্বারাই সম্ভব।

রুমের কোনে অবস্থিত লম্বাটে পুরনো সেগুন কাঠের ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে সন্ধ্যা রাতের সেসব কথা ভেবে আরও একবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অনুর চিত্ত চিড়ে।

প্রত্যয়ের রুমটা একতলা কিংবা দোতলায় নয়। বাড়ির একমাত্র ছেলে হিসেবে সম্পূর্ণ আলাদা ডেকোরেশন করে চিলেকোঠার ঘরটাই প্রত্যয়ের রুম হিসেবে বরাদ্দ করা। প্রত্যয় যখন দেশে ছিল তখন থেকেই এই চিলেকোঠার ঘরটা ওর। আর এখন ওদের বিয়ের প্রথম বাসর রাতের আয়োজন ও এ ঘরেই করা হয়েছে।

পুরো ঘরটাতে ভুর ভুর করে সুঘ্রান ছড়াচ্ছে পুরনো খাটে নতুন করে সাজানো তাজা রজনীগন্ধা আর থোকা থোকা গোলাপের আস্তরণ। সাদা চাদরে মোড়ানো বিছানা জুড়েও গোলাপের ছড়াছড়ি। সেদিকে তাকালেও কেমন অপার স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে মন প্রান।

পুষ্প সজ্জিত স্নিগ্ধ সেই রুমের এক কোনে দাড়িয়ে নির্বিগ্নে চুলে তোয়ালে চালাচ্ছে এই ঘরের নতুন ঘরনি, প্রত্যয়ের সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ। যেন এই ঘরে আগমন তার নতুন কিছু নয়, সেভাবেই বিয়ের ভারী গহনা,পোশাক আশাক ছেড়ে একটা কালো পাড়ের খয়েরী তাঁতের শাড়িতে নিজেকে নতুন বউ রুপে আবিষ্কার করলো অনু।

ঠান্ডা পানি দিয়ে লম্বা শাওয়ার শেষে সারাদিনের ধকল কে ধুয়ে মুছে সাফ করে একেবারে সতেজ হয়ে বেরিয়েছে অনু। আর এখন এই হাল্কা শাড়িটা গায়ে চড়িয়ে আরও বেশি আরাম লাগছে ওর।

শাড়ির ব্লাউজটা ব্যাকলেস, যার দরুন একটু একটু অসস্থি ও হচ্ছে। এমন একটা আটপৌরে শাড়ির সাথে এমন শরীর উন্মুক্ত ব্লাউজ কে কিনলো ভেবে পায়না অনু, ভাবার মতো সময় ও নষ্ট করে না অবশ্য, তার কারণ ওর মাথায় এই মূহুর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য একটা প্রশ্ন, বারংবার মানস্পটে ভেসে উঠছে সেই তীক্ষ্ণ ক্রুর ভ'য়ানক চোখ দুটো।

অনুর মনে আছে ছোট বেলায় এই চোখ দুটোকে ভীষণ ভ'য় পেতো ও, আর এখনো পায়, কিন্তু হঠাৎ করেই এতো গুলো বছর পর কোথা থেকে উদয় হলো সেই মানব? কেনই বা ফিরে এলো ওদের শান্তশিষ্ট নিরিবিলি জীবনে?

ওদের জীবনে তো মানুষটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই, তাহলে আজকের দিনেই কেনো এভাবে দেখা দিলো সে? এটা কি কেবলই অনুর মতিভ্রম নাকি অন্য কিছু?

অনুর ভাবনার জগতের পর্দা টেনে যায় প্রত্যয়ের আগমনে, প্রত্যয় একটু অন্যমনস্ক হয়েই রুমে প্রবেশ করে। আত্নীয় স্বজনদের অধিকাংশই কর্মজীবি হওয়াতে যে যার মতো ফিরে গিয়েছে সবাই, বাড়িতে আপাতত আপু আর তার হাসবেন্ড ছাড়া আর তেমন কেউ রয়ে যায়নি। সবাইকে একেক করে বিদায় দিতে দিতেই রুমে আসতে এতো রাত হয়ে গেলো প্রত্যয়ের।

তারউপর ক্রীতিক কল করেছে কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও কাল অফিস যেতে হবে ওকে, শেয়ার হোল্ডারদের সাথে ইম্পর্টেন্ট মিটিং রয়েছে , তার চেয়েও বেশি চিন্তার বিষয় হলো কাল জামাই শাশুড়ী একই সাথে নিজেদের প্রজেক্ট লঞ্চ করবে, কি জানি কি হবে? কি করেইবা এই দু'জন হট টেম্পার কে একই সাথে সামলাবে ও? চিন্তায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছে প্রত্যয়ের।

প্রত্যয় রুমে ঢুকতেই অসম্ভব মিষ্টি সুঘ্রাণে ওর চোখ দুটো আবেশে বন্ধ হয়ে এলো, ফুল,মোমবাতি, সেই সাথে পরিচিত নারীর গায়ের গন্ধ মিলে মিশে পুরো ঘরটা সৌরভে ম ম করছে। অনু অনু সেই গন্ধটা আরও একবার নাক চিড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাহায্যে ভেতরে পুরে নিলো প্রত্যয়।তবে আজ আর এই সৌরভ ওর নাকে নয় ওর হৃদয় গিয়ে লাগছে।

খানিকক্ষন চোখ বুঁজে রেখে নিজেকে সামলালো প্রত্যয়, তারপর আস্তে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলো ওর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে অনু,হাতে তার সেদিনের সেই ছোট্ট বক্সটা।

প্রত্যয় বক্সটার দিকে ভ্রু কুঞ্চন করে তাকালে অনু শুধায়,

---- আপনার কি ঘুম পেয়েছে প্রত্যয় সাহেব? চশমাটাও দেখি পরেন নি, ঠিকঠাক দেখছেন তো আমায়?

অনুর কথায় এক চিলতে হাসি খেলে গেলো প্রত্যয়ের ঠোঁটের আগায়, ও অনুকে আগাগোড়া পরখ করে বললো,

---- তোমাকে দেখতে আমার চশমার প্রয়োজন নেই অপরিচিতা, চোখ বন্ধ করলে সর্বদাই তুমি আমার দু'চোখের পাতায় রাজত্ব করে বেড়াও, আর এখন চোখ খুললেও তুমি।

প্রত্যয়ের এসব প্রেম প্রেম কথা ভালোই লাগে অনুর, মাঝেমধ্যে লজ্জাও পায় বেশ, কিন্তু এই মূহুর্তে পেলোনা, উল্টো প্রত্যয়ের কথাকে দু আনা প্রশ্রয় না দিয়েই হাত বাড়িয়ে বক্সটা দেখিয়ে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে,

---- বিয়ে হয়েছে গিয়েছে, আজ প্রথম রাত, তাহলে এবার বলুন,কি আছে এতে? আমি আর পারছিনা চুপ হয়ে থাকতে, কৌতুহলে মাথাটা কিলবিল করছে আমার।

প্রত্যয় এবারও অনুকে মসৃণ হাসি ফেরত দিয়ে বলে,

---- প্রথম রাতে স্বামীকে সালাম না করেই উপহার দেখতে চাইছো? ইট’স নট ফেয়ার অনু।

অনু তৎক্ষনাৎ দাঁত দিয়ে জিভ কাটে, মনেমনে বলে,

---- এইরে ভুলেই গিয়েছিলাম।

পরক্ষণেই শাড়ির আঁচলটা পিঠের উপর দিক দিয়ে টেনে এনে সামান্য নিচু হয়ে সালাম করলো প্রত্যয়কে। তারপর আবারও সেই একই বুলি,

---- এবার বলুন এতে কি আছে?

অনুর উন্মুক্ত মসৃণ মোমের মতো পিঠের দিকে চেয়ে প্রত্যয় ঘোর লাগা গলায় বললো,

---- কি পরেছো এটা? সব দেখা যাচ্ছে।

অনু বলে,

---- আগে আমার কথার উত্তর দিন তারপর বলছি।

অনুর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এতে কি আছে না জানা অবধি প্রত্যয়কে এক দন্ড বসতেও দেবেনা ও,আর প্রত্যয় কিনা এইটুকু সময়ে কত কিছুরই না স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। সিল্যি ফিলিংস, হাহ!

প্রত্যয়ের দুচোখে এখন সেই সব অব্যক্ত,নেশাতুর অনুভূতি গুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু অনুকে বোঝানো মুশকিল। তাই এবার আর কোনোরূপ কথা না পেঁচিয়েই বক্সটা খুলে অনুর হাতে ধরিয়ে দিলো প্রত্যয়।

অনু অবাক চাহনিতে বক্সের ভেতর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে, হবে হয়তো কোনো দামি জুয়েলারি, কিংবা কোনো হানিমুন টিকেটস।

অনুর জানা মতে বাসর রাতে তো স্বামীরা এসবই উপহার দেয়। কিন্তু এখানে তেমন কিছুই দেখতে না পেয়ে আশাহত হলো অনু, ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রত্যয়কে শুধালো,

--- কই?

প্রত্যয় কাবার্ড থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করতে করতে বললো,

--- কি কই?

--- কেন উপহার?

অনুর কালো হয়ে যাওয়া চুপসানো মুখটা দেখে প্রত্যয় অনেকটা কাছে এগিয়ে এসে ওর চিবুক তুলে হিসহিসিয়ে বলে,

---- কি বলেছিলাম আমি? এর মাঝে তোমার স্বপ্ন আছে, আর সেটাই আমার তরফ থেকে তোমার জন্য বাসর রাতের বেস্ট গিফট।

অনু ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- স্বপ্ন মানে? কেমন স্বপ্ন?

প্রত্যয় কিঞ্চিত ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে বক্স থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে অনুর গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো,

---- এই যে আমার বউ সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।

এতোক্ষণে অনুর টনক নড়েছে, চোখ দুটো ছলছল করছে, ও সেই ছলছলে চোখ নিয়েই প্রথমে প্রত্যয়ের দিকে অবিশ্বাসের চাউনি নিক্ষেপ করলো, অতঃপর কাঁপা হাতে আইডি কার্ডটা চোখের সামনে তুলে ধরলো, যেখানে গুটি গুটি ইংরেজি অক্ষরে অনুর নাম আর ছবি বসানো,

অনন্যা শেখ নামের পাশেই ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে পরপর তিনটে অক্ষরে লেখা, L.L.B অনার্স।

এতো ঝড়ঝাপটা, এতো উত্থানপতনে অনু তো ভুলেই গিয়েছিল, নতুন করে পড়াশোনা শুরু করাটা যে ওর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। মায়ের অসুস্থতায়, যা না চাইতেও বিসর্জন দিতে হয়েছিল ওকে, মস্তবড় গেইট পেরিয়ে ভার্সিটিতে প্রবেশ করার স্বপ্ন তো অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল।

মনের টানাপোড়েন তো কম হয়নি এককালে, কিন্তু অনু নিজেকে বুঝিয়েছিল বড় মেয়ে হতে গেলে দ্বায়িত্ব নিতে হয়,বাড়ির বড় সন্তান কে এতো নিজের কথা ভাবলে চলেনা,তাদের পৃথিবীতে পাঠানোই হয়েছে পরিবারের সর্বসকল্যের সুখ নির্ধারন করার জন্যে।

কিন্তু আজ, এই মূহুর্তে প্রত্যয় নিজ হাতে অনুর স্বপ্নকে অনুর হাতে ধরে দিলো, নতুন করে মনে করিয়ে দিলো অনু এখন আর একা নয়, ওরও নির্বিগ্নে মাথা রাখার জন্য একটা কাঁধ রয়েছে, যার নাম "প্রত্যয় এহসান"।

---- তোমার এখনো অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি অনু, এগিয়ে যাও আমি তোমার পাশে আছি। তোমার স্বামী, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী সবসময় তোমার পাশে আছে।

প্রত্যয়ের কথায় এতোক্ষণের ভ্রমটা কেটে গেলো অনুর,মতিভ্রম থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়ের উপর ঝাপিয়ে পরে ওর গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চিৎকার করে কেঁদে উঠলো অনু, কাঁদতে কাঁদতে বললো,

----- এটা কি করেছেন আপনি, কি করেছেন? এতো ভালোবাসা কেন দিচ্ছেন? পা'গল হয়ে যাবো তো আমি। আপনি আমাকে আজকে যা দিয়েছেন তা এই দুনিয়ার কেউ দেয়নি আমাকে, কেউ না।

অনু সরল মনে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বললেও, ওর বলা কথা আর চিৎকারে প্রত্যয়ের চক্ষু চড়কগাছ। প্রত্যয় তৎক্ষনাৎ চোখ মুখ খিঁচিয়ে অনুর মুখটা হালকা চেপে ধরে বললো,

---- আরেহ, কি বলছো এসব? নিচের সবাই শুনলে কি ভাববে? আস্তে বলো জান,আস্তে।

অনু নিজের নাকের পানিটুকু প্রত্যয়ের এক্সক্লুসিভ শেরওয়ানিতে মুছে নতুন উদ্যমে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

---- আস্তে বলবো মানে? আমিতো সবাইকে জানিয়ে বলবো আপনি আমাকে কি দিয়েছেন এটা, কয়জন স্বামী দিতে পারে এটা? কার এমন আত্মা আছে, শুনি? কয়জন স্বামী পারে বিয়ের প্রথম রাতেই বউকে এতোটা ভালোবাসা দিতে, বলুন?...

তারপর আবারও কান্নার আওয়াজ।

প্রত্যয়দের ঠিক নিচের রুমটাই ওর আপু দুলাভাইয়ের রুম, অনুর এমন কান্নাকাটি আর আহাজারি শুনে প্রত্যয়ের দুলাভাই আপুকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বললেন,

---- তোমার ভাইয়ের একটু সংযত হওয়া উচিৎ ছিল অন্তুর আম্মু। মেয়েটার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে, এতো কান্নাকাটি করছে। বিয়ের প্রথম রাতেই এভাবে পশুর মতো আচরণ কেউ করে?

স্বামীর কথাকে মুখ বাঁকিয়ে অগ্রাহ করে প্রত্যয়ের আপু ঝাঁজিয়ে বলে উঠলো,

---- নিজে কি করেছিলে সে কথা ভুলে গিয়েছো? এখন আবার আমার ভাইকে দোষারোপ করা হচ্ছে, চুপচাপ ঘুমাও, ওদেরটা ওরা বুঝে নিবে।

*****************************************

অনেকক্ষন হলো রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদে

দাঁড়িয়ে আছে অনু। প্রত্যয় গিয়েছে ফ্রেশ হতে, তাই অনু একাই দাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে আপাতত ।ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার ঝাপটা ওর ক্রন্দনরত মুখ মন্ডলে আঁচড়ে পরছে ক্রমশ।

হাওয়ার তালে তালে আধ ভেজা রেসমের মতো চুলগুলোও ইতি উতি উড়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের আঙিনায় জ্বলতে থাকা মরিচ বাতির রোশনাইএ ছাঁদটাও আলোকিত। আকাশের উজ্জ্বল হাসি হাসি চাঁদখানা এতোক্ষণে মেঘের আড়ালে ঢাকা পরেছে। কালো মেঘের গা থেকে খসে খসে পরছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বাতাসের তোপে সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি খুব একটা গায়ে লাগছে না যদিও।

বৃষ্টি ঝরা ফুটো আকাশের দিকে তাকিয়ে অনু আজ তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে, ভীষণ তৃপ্তিতে অজানা তারকারাজিদের উদ্দেশ্যে মনটা বারবার চিৎকার দিয়ে বলতে চাইছে,

---- শুনছো তোমরা, পৃথিবীটা এতোটাও খারাপ নয়, শুধু বদলে দেওয়ার জন্য একটা মানুষ প্রয়োজন, এই যা।

অনু যখন অদূরে আকাশ পানে চেয়ে মনের খুশিতে মন দিয়েই চিৎকার করছিল, ঠিক সেই মূহুর্তেই নিজের উন্মুক্ত বাঁকানো কোমড়ের খাঁজে শীতল দুটো হাতের স্পর্শে শিরশির করে উঠলো অনুর সর্বাঙ্গ। একটু কেঁপে উঠে অনু পেছনে ঘুরবে, তার ফুরসত দিলোনা প্রত্যয়,বরং আরও শক্ত করে ওর কোমড়টা চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করালো অনুকে,তারপর ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বললো,

---- তোমার ইমোশনের পাল্লায় পরে রাত তো শেষ হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম। এবার একটু ইমোশন টাকে সামলাও, আমি যে বেসামাল।

অনু সাদা মনে বললো,

---- রাত তো শেষ হবেই, রাত না শেষ হলে দিনের আলো ফুটবে কি করে শুনি?

প্রত্যয় অনুর কাঁধে টুকরো চুমু খেয়ে ভারী নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

---- আজকের রাতটা যে আমাদের বহু আকাঙ্খিত রাত জান , থাকনা একটু বেশি সময় ধরে এই আধার টুকু। ক্ষ'তি কি?

অনু নির্বাক, প্রত্যয়ের অবাধ্য স্পর্শে ওর গলা জড়িয়ে আসছে, শরীরের তোরনে তোরনে বয়ে যাচ্ছে শিহরণ জাগানো নাম না জানা এক সাইক্লোন। ও খুব করে চাইছে প্রত্যয়ের হাত দু'টোকে স্থির রাখতে কিন্তু পারছে না, প্রত্যয়ের হাতদুটো অবাধে বিচরণ করছে অনুর সমস্তটা জুড়ে। অনু কোনোমতে ছাঁদের পাঁচিলটা শক্ত করে দু'হাতে খামচে ধরে মাথা নুইয়ে রেখেছে। প্রত্যয় দু'চোখ বুঁজে অনুর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিতেই এক পর্যায়ে তীব্র সংকোচে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রত্যয়ের বুকেই মুখ লুকালো অনু।

প্রত্যয়ের বোধ হয় আজ এসব লজ্জা টজ্জা পছন্দ হচ্ছে না, তাই অনুকে খুব একটা আস্কারা না দিয়ে ওর ঠোঁটের ভাঁজে নিঃসংকোচে নিজের আধিপত্য বিস্তার করলো প্রত্যয়,এরপর সেভাবেই অনুকে কোলে তুলে নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ওদের সাজানো গোছানো চিলে কোঠার ঘরের দিকে। অনু বেশ কসরত করে প্রত্যয়ের ঠোঁট দুটো থেকে ছাড়া পেয়ে অস্ফুটে শুধালো,

---- কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন?

প্রত্যয় দ্রুত গতিতে পুনরায় অনুর অধর জুগলে অধর ডুবিয়ে হিসহিসিয়ে জবাব দিলো,

---- তোমার লজ্জা ভাঙাতে।

*****************************************

শেষ রাতের তীব্র বর্ষনে চারিদিক কর্দমাক্ত। আজকেও আবহাওয়া বেশ শীতল। হয়তোবা এই বর্ষা বর্ষা আবহাওয়াটা এবার বেশ কয়েকদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে।

স্টেট আমেরিকার মতো দেশ থেকে ফিরে পুরান ঢাকার এই ভাঙাচোরা পিচ ঢালা রাস্তা ধরে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সায়রের। স্পঞ্চার শীপ থেকে পাওয়া পায়ের লাল সবুজ ট্যাগ লাগানো গুচ্ছি ব্র্যান্ডের জুতোটাও কাঁদায় মাখামাখি,যা দেখে এই মূহুর্তে এই কাঁদায় বসেই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সায়রের।

চিপাগলি নিবাসী ওই ঝাঁজ ওয়ালা মেয়েটাকে কান ধরে টেনে এনে৷ এসব দেখিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,

--- দেখ রাগীনির বাচ্চা, দেখ। তোর জন্য আমার লেটেস্ট ব্র্যান্ডের জুতোটার মান ইজ্জত কাঁদায় ডুবে গড়াগড়ি খাচ্ছে , তবুও রাগ দেখাবি? কথায় কথায় মুখ ঝামটি দিবি? কিসের এতো তেজ তোর? এই টুকুনি চুনোপুঁটির মতো শরীর আবার আমাকে তেজ দেখায়।হুহ!

একমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে চিপাগলি নিবাসী সেই রাগীনির বাড়ির সামনে এসেই থামলো, তা টের পায়নি সায়র নিজেও যখন। গন্তব্য যখন এখানেই তাহলে জানা অজানা দিয়ে কিই বা আসে যায়?

সায়রের ও যায় আসলো না। ও আজ আর উঁকি ঝুঁকিও দিলোনা, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে গিয়ে বাইরের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠে গেলো নীলিমাদের শ্যাওলা পরা ছাঁদে।

আজকে আর নীলিমা নাচ করছে না, ঘুঙুর সমেত ছাদে এলেও সেগুলো আপাতত অযত্নে ছাদের এককোনায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, আর নীলিমা ছাদের পাঁচিলে কনুই দিয়ে ভর করে দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে, দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক অস্থির ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে মেয়েটা।

নীলিমা কি নিয়ে ভাবছে তা বোধগম্য হলোনা সায়রের, তাই ও পেছন থেকে আচমকা ডেকে উঠে নরম গলায় বললো,

---- নাচবে না আজ আর? আমিতো দেখতে এলাম।

নীলিমা চমকে উঠলো না, তরিঘরি করে পেছনেও চাইলো না, ভাবটা এমন যেন ও সায়রের উপস্থিতি টের পেয়েছে। বাতাসের সাথে ভাসমান সায়র সায়র গন্ধটা নীলিমা বুঝতে পেরেছে। আদতে তেমন কিছু কিনা কে জানে?

তবে নীলিমা আপাতত আস্তে ধীরে ঘুরে তাকিয়ে চোয়ালটা শক্ত করে সায়র কে বলে ওঠে,

---- কি চাই, আবার কেন এসেছেন?

সায়রের গায়ে লাগলো না নীলিমার চরম তিক্ত কথাগুলো, ওর এতোদিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে অর্ণব কেন এতো নি'র্লজ্জ।

সায়র নিজেও এই মূহুর্তে অর্ণবের পন্থাটাই অবলম্বন করলো, নীলিমার কথাতে ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে গিয়ে নীলিমার সামনে দাড়িয়ে বুকের বাম পাশে হাত রাখলো। অতঃপর কোনোরূপ কপটতা না করেই কাতর কন্ঠে বললো,

---- কেন যেন সকাল থেকে বুকটা জ্বলে যাচ্ছিল, অযথাই দম আটকে আসছিল,চোখ দুটোও দারুন তৃষ্ণার্থ, কেন যেন মন বলছিল তোমার দেখা পেলে সব অসুখ এক নিমিষে সেরে যাবে, তাই সবার অগোচরেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি নীলিমা। কেউ জানেনা আমি এখানে।

সায়র নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে এই প্রথম নীলিমার নামটা উচ্চারণ করলো, যা নীলিমাকে অবাক করে দিতে সক্ষম।

নীলিমা অবাক হয়ে চট করে সায়রের চোখ চোখ রাখলে, সায়র আবার বলে,

---- চেয়ে দেখো, এখন আমি পুরোপুরি ফিট, আই থিংক আমার অসুস্থতার মোক্ষম কারন টা ই তুমি, তোমাকে বোধ হয় আমার লাগবে।

সায়রের কথায় নীলিমার কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরলো, ও তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছু'ড়ে শুধালো,

---- লাগবে মানে? আমি কি জড়বস্তু নাকি? আর তাছাড়া আমার....

নীলিমার কথাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে সায়র শান্ত চোখে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,

---- আমি বলেছি লাগবে, তার মানে লাগবে, তুমি আমাদের ফ্রেন্ডস জোনটাকে যতটা শান্ত আর নিরিবিলি ভাবো আমরা ততটাও সভ্য প্রজাতির নই। সব কটার ব্যাকরাউন্ড উত্তপ্ত কয়লার মতোই দ'গ্ধ। খুব বেশি নাড়াচাড়া করতে এসোনা পু'ড়ে যাবে তাহলে।

নীলিমা বুঝলোনা সায়রের কথার আগামাথা, তবে সায়র যে বেশ সাবলীল ভাষায় শান্ত স্বরে ওকে হু'মকি দিয়েছে সেটা খুব ভালো মতোই ধরতে পেরেছে ও।

এই মূহুর্তে কারও মুখে রা নেই, দুজনই দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে নিরবতা পালন করছে ওরা, হয়তোবা দু'জন দুজনার চোখের ভাষা পড়ে ফেলার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।

তবে ওদের এই দীর্ঘক্ষনের চোখাচোখির অবসান ঘটিয়ে হুট করেই ছাঁদে চলে আসে নীলিমার আব্বাজান তাইয়েব জামান।

তিনি ভেতরের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে হাঁপানো সুরে বলেন,

---- আম্মাজান,বাজার নিয়া আইছি, রাতের খাওন টা....

তিনি বাক শক্তি হারিয়ে ফেললেন তখন যখন দেখলেন, অচেনা এক সুদর্শন যুবক তার ছাদে দাঁড়িয়ে তার দিকেই হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে এই মূহুর্তে ।

তাইয়েব জামান মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক গলিয়ে সায়রকে আগা গোড়া পরখ করে গম্ভীর গলায় বললেন,

---- ওই মিয়া তুমি ক্যাঠা? এই মহল্লায় তো তোমারে আগে দেখি নাই। মাগার চেনা চেনা লাগতাছে।

সায়র তাইয়েব জামানের কড়া গলার প্রশ্নে জবাব দেওয়ার আগে নীলিমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে শুধালো,

---- এই তোমার আব্বাজান?

নীলিমা হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, সায়র আবার তাকালো তাইয়েব জামানের দিকে,

সবুজ পাঞ্জাবি পরিহিত ছিপছিপে গড়নের লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এক সভ্য পুরুষ, চোখ মুখে কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য আর রাশভারি ভাব থাকলেও, এ মোটেও সায়রের ভাবনার ধারে কাছেও নেই।

সায়র তো ভেবেছিল নীলিমার আব্বাজান নিশ্চয়ই পেট মোটা, গোঁফ ওয়ালা, কুচকুচে কালো দেখতে কোনো পালোয়ান হবে হয়তো। যে সারাদিন সাদা লুঙ্গি ধরে ধরে পান চিবোয়, আর একে ওকে ধরে মে'রে তক্তা বানিয়ে ছেড়ে দেয়।

কিন্তু এই লোকটাকে তো যথেষ্ট ভদ্রলোক মনে হচ্ছে, নাহ মিললো না। সায়র হতাশ, ভারী হতাশ। সেই হতাশা থেকেই সায়র মলিন মুখে অবিশ্বাসের সুরে ঠোঁট উল্টে আরও একবার প্রশ্ন করলো নীলিমাকে,

---- উনি আসলেই তোমার বাবা তো?

সায়রের কথায় এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো নীলিমা, তেঁতো গলায় বললো,

---- আশ্চর্য! এ আবার কেমন কথা? দেখছেন আমার আব্বাজান, তাও ভুলভাল বকে যাচ্ছেন?

---- ওই মিঁয়া, আমার লগে কথা কও তুমি? আমগো ছাঁদে কি কাম তোমার?

নীলিমার আব্বাজানের প্রশ্নে সায়র একটু গলা খাঁকারী দিয়ে বললো,

---- ইয়ে মানে আঙ্কেল, পানি খেতে আসছিলাম, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তো।

তাইয়েব জামান বুঝতে পারার মতো করে হালকা মাথা নাড়িয়ে বললেন,

----অহ, এইডা আগে কইবা না? আহো তাইলে নিচে আইসা পানি খায়া যাও।

এরপর নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,

----আম্মাজান, মেহমানরে পানি দাও।

নীলিমা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, সায়রের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বললো,

--- আসুন।

নিচে গিয়ে সায়র সবার আগেই নীলিমার রুমে প্রবেশ করে, পুরো রুমটা গার্লি জিনিস পত্র দিয়ে ভরা। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সায়র বুঝতে পারে নীলিমার এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিস অনেক। তার চেয়েও বেশি গোছানো আর পরিপাটি ওর রুম।

ছবি আঁকার ক্যানভাস ও রয়েছে রুমের এক কোনে, যেখানে সূর্যাস্থের অর্ধেক পেইন্টিং এখনো অসম্পন্ন। অসম্পন্ন ক্যানভাস দেখে সায়রের বোধগম্য হলো, দেওয়াল জোরা পোট্রেড গুলো তাহলে নীলিমার নিজের হাতেই আঁকা। মেয়েটা আসলেই ট্যালেন্টেড, এই পর্যায়ে এসে নীলিমাকে সূর্যের সঙ্গেই তুলনা করে বসলো সায়র, মনে মনে হাজারটা বাহবা দিয়ে বললো,

---- যেমন তেজ, তেমন তার গুণ। কিন্তু নীলিমার আম্মা কোথায়?

সায়রের মাথায় প্রশ্নটা আসতেই রুমে প্রবেশ করে নীলিমা, হাতে ছোট্ট ট্রে, তাতে একবাটি ক্ষীর আর এক গ্লাস পানি।

নীলিমা সামনে এসে দাড়ালে সায়র পানির গ্লাসটা নিতে নিতে বললো,

--- ক্ষীর কে বানিয়েছে?

নীলিমা থমথমে মুখে উত্তর দিলো,

--- আমিই।

তৎক্ষনাৎ পানির গ্লাস রেখে ক্ষীরের বাটিতে হাত দিলো সায়র, নীলিমা চেয়ে আছে এক ধ্যানে, সায়র গপাগপ করে ক্ষীর খেতে খেতে মৃদু হেসে বলে,

----- উমম!আমার লাইফের বেস্ট ক্ষীর এটা।

এবার নীলিমাও ঠোঁট কামড়ে সামান্য হাসলো, যা সায়রের দৃশ্যগত হওয়ার আগেই আবার উবে গেলো।

সায়র খেতে খেতে আবারও প্রশ্ন করে বললো,

---- আচ্ছা শাশুড়ী আম্মা, না মানে তোমার আম্মা কোথায়?

নীলিমা কোনোরূপ দুঃখ প্রকাশ না করেই স্বাভাবিক ভাবে বললো,

---- আম্মা নেই, আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময়ই আম্মা দুনিয়া ত্যাগ করে, তারপর থেকেই আমি আব্বা আর নয়ন মিলেই আমাদের পরিবার। ওই জন্যই তো আমি দূরে কোথাও...

নীলিমা মাঝপথেই কি ভেবে যেন থেমে গেলো। সায়র ওকে আস্বস্ত করে বললো,

--- হ্যা বলো?

নীলিমা পুনরায় বলতে আরম্ভ করে,

---- ওই জন্য আব্বা আর ভাইকে ছেড়ে আমি দূরে কোথাও যেতে পারবো না, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আমার মহল্লারই.. এতো কাছাকাছি দেখেই বিয়ের প্রস্তাবে আর না করিনি।

---- হয়েছে থাক, বিয়ের পরে এতো বাপের বাড়ি নিয়ে ভাবলে হয়না, দরকার পরলে তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী আমেরিকা নিয়ে যাবো।

--- কিহ!!

ক্ষীরের বাটিটা ঠাস করে ট্রেতে রেখে, কথাগুলো বললো সায়র, অতঃপর ঢকঢক করে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে উঠে দাড়িয়ে নীলিমাকে শুধালো,

---- তোমার আব্বাজান কোথায়?

নীলিমা আঙুল উঁচিয়ে বসার ঘরের দিকে দেখিয়ে দিলে, সায়র বড়বড় পা ফেলে তাইয়েব জামানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

তাইয়েব জামান তখন পেপার পড়ায় ভীষণ মনোযোগী, সায়র তার হাত থেকে ছো মে"রে পেপারটা টেনে নিয়ে পাশের টি-টেবিলে রেখে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে করতে মনেমনে বললো,

---- খুব শীঘ্রই আপনাকে বড়সড় একটা ঝটকা দিতে যাচ্ছি আব্বাজান, আশা করি আল্লাহ আপনাকে ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করবেন,আমিন।

........................................................................

𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃

Episodes
1 List of stories...
2
3 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43 এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44 এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45 এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46 এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47 এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48 এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49 এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50 এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51 এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52 এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53 এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54 এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55 এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56 এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57 এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58 এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59 এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60 এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62 ইট পাটকেল [Part.1]
Episodes

Updated 62 Episodes

1
List of stories...
2
3
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43
এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44
এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45
এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46
এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47
এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48
এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49
এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50
এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51
এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52
এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53
এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54
এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55
এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56
এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57
এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58
এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59
এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60
এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62
ইট পাটকেল [Part.1]

Download

Like this story? Download the app to keep your reading history.
Download

Bonus

New users downloading the APP can read 10 episodes for free

Receive
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download MangaToon APP on App Store and Google Play