#পর্বঃ৩৭
অনুজা ছোট্ট বোনটার উদভ্রান্ত ভগ্নহৃদয়ের কা'ন্না আর কষ্ট দেখে অবশেষে কিছুটা হলেও হৃদয় টললো অনুর। মনের মনিকোঠায় কোথায় যেন চিনচিনিয়ে নাড়া দিয়ে উঠলো ওর। যেখানে মানুষ দুইটা একজন আরেকজনকে ছাড়া ম'রে যাচ্ছে, সেখানে এতো সমাজ বিবেচনা করে কি লাভ? বুঝে আসেনা অনুর।তাছাড়া ধর্মে যেই সম্পর্কের পুরোপুরি বৈধতা আছে, সেখানে সামান্য সমাজ আর সমাজের কটুক্তির দোহাই দেওয়াটা নিছকই ছেলে মানুষি নয় কি?
জায়ান ক্রীতিক কবেই বা মেনেছে এই সমাজের নিয়ম কানুন? তার মতো মানুষকে সমাজের শেকলে ব'দ্ধ করা কেবলই কল্পনা মাত্র। অথচ এসবের মাঝে পরে শুধু শুধু পাহাড় সমান ক'ষ্টে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওইটুকুনি মেয়েটা।
এতোদিন যেমন তেমন ছিল, দেশে ফেরার পরে এখন আবার শুরু হয়েছে মামি আর রেজা ভাইয়ের উপদ্রপ। সবমিলিয়ে নিজের ছোট্ট বোনের এমন হৃদয় নিংড়ানো কা'ন্নার জোয়ার চোখের সামনে আর দেখতে পারলো না অনু। করিডোরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কিছু ক্ষী'প্র সিদ্ধান্ত সমেত, নিজের সকল সংশয় ভুলে ছুটে যেতে লাগলো মায়ের কক্ষের দিকে।
চৈত্র মাসের ভ্যাপসা গরম, মাথার উপর অনবরত ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটার জীবন ফুরিয়ে এসেছে বোধহয়,তবুও কর্মক্ষেত্রে অটল সে। পুরাতন আমলের পাখা মজবুত তো হবেই।
রাতের বেলাতেও এইটুকুনি ঠান্ডা হাওয়া নেই, তাই রুমের মাঝে এয়ারকুলার মেশিন চালিয়ে ইজি চেয়ারে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন আজমেরী শেখ। সেই প্রথম জীবন থেকেই সাহিত্যে তার ভীষণ আগ্রহ, জামশেদ জায়ানের সাথে বিয়ে হওয়ার পরে তিনিই মহলের এককোনে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরী উপহার দিয়েছিলেন আজমেরী শেখকে। ভালোবাসা প্রকাশের ফলস্বরূপ লাইব্রেরীর নাম দিয়েছিলেন "মেরীর রংমহল"।
কিছু বছর আগেও ব্যবসায়ী কাজে স্বামীকে সাহায্য করার পরে যেই ফুরসত টুকু মিলতো সেই সময়টা লাইব্রেরিতেই কাটাতেন আজমেরী শেখ। খুব মনদিয়ে নাড়াচাড়া করতেন পছন্দের বইগুলো, একে একে পাতা উল্টে বুক ফুলিয়ে নিতেন নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ ।
মাঝখানে অবশ্য অসুস্থতায় কেটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর,এখন আর আগের মতো চোখের তীক্ষ্ণ পাওয়ারটা অবশিষ্ট নেই, তাই চোখের উপর মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়েই বহুবছরের অভ্যেসে কিছুটা শান দিতে বসেছেন তিনি আজ।
আজমেরী শেখ যখন বইয়ের পাথায় বুদ হয়ে আছেন, তখনই হুড়মুড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করে অনু। অনুর এমন অকস্মাৎ আগমনে ভ্রুকুটি করে আজমেরী শেখ বলেন,
----এটা কি ধরনের আচরণ অনু? কারও রুমে ঢুকতে হলে আগে নক করতে হয়, এখনো শিখাতে পারিনি কেন?
মায়ের কথায় কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে, অনু হাতের মাঝে হাত দিয়ে কচলাতে কচলাতে বললো,
---- মামি কেন অরুর রুমের দরজায় তালা লাগিয়েছে মা? তুমি কিছু বলোনি?
আজমেরী শেখ কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
---- তালা লাগিয়েছে মানে?
মায়ের কথার পাছে অনু কিছু বলবে তার আগেই রুমের মাঝে আগমন ঘটে অনুর মামি জাহানারার। অনু রা আমেরিকা থেকে ফেরার পরেই পুরো পরিবার শুদ্ধ এসে ক্রীতিক কুঞ্জে হাজির হয়েছে তারা। উদ্দেশ্য আজমেরী শেখের দেখভাল করা। অনুর মামা ভূমি অফিসের ছোটখাটো কর্মকর্তা, তিনি মেয়েলী ঝুট-ঝামেলায় খুব কমই থাকেন।
তবে ক্রীতিক কুঞ্জের মতো আলিশান বাড়িতে একমাস কেন একবছর বেড়াতেও তার কোনো অসুবিধা নেই। তারউপর এখন তার বোনও সুস্থ সবল হয়ে ফিরেছে,আগেতো ধিঙ্গি মেয়ে দু'টোর সাথে জাহানারার সারাদিন কথা কাটাকাটি লেগেই থাকতো, এখন আর সেই সুযোগ নেই। কারন মামির সাথে বে'য়াদবি করলে কিভাবে মেয়েদের সু-শিক্ষা দিতে হয় সেটা তার বোন ভালো করেই জানে।
ওই জন্যই তো, বউয়ের এক কথাতেই এখানে বেড়াতে চলে আসা। জাহানারার অবশ্য অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটা ফলিয়ে তবেই এ বাড়ি থেকে বিদেয় হবে সে, তার আগে নয়।
অনুর কথায় আশ্চর্য হয়ে আজমেরী শেখ কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবেন তার আগেই জাহানারা এগিয়ে এসে বলেন,
---- কি করবো বলো আজমেরী, তোমার ছোট মেয়েটা অসহ্য রকম চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছিল, তারউপর অন্দরমহলের সব দামিদামি জিনিস গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছে।বিশ্বাস না হলে নিচে গিয়ে দেখো একবার।
মামির কথায় তেতে উঠে অনু বললো,
----- ভাঙলে ওর স্বামীর টাকায় কেনা জিনিস ভেঙেছে, তাতে তোমার কি মামি?
অনুর মুখে ক্রীতিকের গুনগান শুনেই গর্জে উঠলেন আজমেরী শেখ,মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,
------ চুপ করো, কে কার স্বামী? কোথাকার কোন থাইল্যান্ড বসে বিয়ে পরিয়েছে, রেজিষ্ট্রি করেছে ওসব আমি মানিনা।
---- কেন মানোনা মা? অস্বীকার করতে পারবে অরু যে ক্রীতিক ভাইয়ার বিবাহিতা স্ত্রী? তাছাড়া অরু চারদিন যাবৎ ক্রীতিক ভাইয়ার সাথে ছিল, একসাথে একই ছাদের নিচে, আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা একজন আরেকজন কে ভালোবাসে।তাহলে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?
অনুর কথার পাছে, আজমেরী শেখ কিছু বলার আগেই জাহানারা মুখ দিয়ে বিরক্তিকর ছ্যাহ ছ্যাহ উচ্চারণ করে বলে ওঠে ,
----- কতটা লজ্জা শরমের মাথা খেলে মানুষ এই কাজ করতে পারে বাপু? শেষ পর্যন্ত কিনা নিজের মায়ের সৎ ছেলের গলায় ঝুলে পরলো ছ্যাহ। আমার তো মনে হয় ওই ছেলে ফূর্তি করার জন্যই এতো নাটক করেছে, ফূর্তি করা শেষ এখন আর এদিকে ফিরেও তাকাবে না।
মামির কথায় শক্ত হয়ে এলো অনুর চোয়াল, এরা ভাবেটা কি নিজেকে যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে। ওদিকে আজমেরী শেখের ও কানে লেগেছে কথাগুলো, নিজের সন্তানকে নিয়ে কেউ এসব বললে কানে লাগারই কথা। আজ নিজের ভাইয়ের বউ বলছে, দুদিন পর মহল্লার লোকেরাও বলবে,তারপর ধীরে ধীরে পার্টি অফিসের সবাই পিঠ পিছে খিল্লি ওড়াবে।তার মেয়েকে নিয়ে বাজে কু'রুচিকর মন্তব্য করবে,খুব গভীর আর অন্তরঙ্গ ব্যাপার গুলো নিয়ে হাসাহাসি করবে।এখনই সেসব কথা ভাবতে গেলে মেজাজ সপ্তম আসমানে চড়ে যায় আজমেরী শেখের।
তিনি ক্ষ্যা'পাটে অনুকে তৎক্ষনাৎ ধমকের সুরে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
---- অরু যদি একটা রাস্তার ছেলেকেও ভালোবাসতো তবুও তার অন্যান্য যোগ্যতা বিচার করে মেনে নিতাম আমি,কিন্তু জায়ান ক্রীতিক কে মানা যায়না। তাই এসব বিষয় নিয়ে আর একটাও কথা বাড়াবে না অনু, চুপচাপ থাকবে,সবার সব কিছু জানাজানি হয়ে যাওয়ার আগেই অরুর জন্য উপযুক্ত একটা ব্যাবস্থা করবো আমি।
অনু বিচলিত হয়ে তেঁতো গলায় বললো,
---- জায়ান ক্রীতিকের দোষটা কোথায় মা?
তখন থেকে অনু ক্রমাগত মুখেমুখে তর্ক করছে তাও এরকম একটা জটিল বিষয় নিয়ে, ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগছে না আজমেরী শেখের।তাই তিনি এবার মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
----- আমি বলেছি মেনে নেওয়া যায়না,তারমানে যায়না। আর কোনো প্রশ্ন করবে না এক্ষুনি নিজের রুমে যাও।
অনু থমথমে গলায় বললো,
--- যা ইচ্ছে করো মা, তবে নিজের জিদ আর অহমিকাকে এতোটাও বড় করে দেখতে যেও না যার ফলসরূপ তোমার মেয়ের না আবার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়।
কথাটুকু বলে মামির কোমরের গোছা থেকে টান মে'রে অরুর রুমের চাবিটা নিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় অনু।
অনু চলে যেতেই শুরু হয়ে যায় জাহানারার ব্রে'নওয়াশ। তিনি এগিয়ে গিয়ে আজমেরী শেখের উদ্দেশ্যে বলেন,
---- সেই কবে থেকে বলছি তোমায় আজমেরী, অনু বড় হয়েছে,আমার রেজাও মাসআল্লাহ নামদাম কামিয়েছে অনেক, পুরো ঢাকা দক্ষিণের ছাত্রলীগের সহসভাপতি হয়েছে এবছর। রেজার কথায় বড়বড় মাথা ওয়ালা লোকেরাও এখন ওঠে বসে।
তাছাড়া আমার ছেলের ক্ষমতা তো তোমরা নিজের চোখেই দেখলে, তোমাদের সকল বন্দোবস্ত সেরে হুট করেই কেমন আমেরিকা থেকে নিয়ে এলো। ক্ষমতা না থাকলে কি এসব হয়? তাই এখনো সময় আছে অরুর মতো উচ্ছনে গিয়ে ভুলভাল কাহিনী ঘটানোর আগেই অনু আর রেজার গাঁটছড়াটা বেধে দাও। তাহলে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকলো,মাঝখান থেকে তোমার একটা ছেলেও জুটলো।
একসাথে অনেকগুলো কথা শেষ করে,রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে জাহানারা পুনরায় বললেন,
----আমি যা বলি তোমার ভালোর জন্যই বলি বোন।
অন্যের কথায় প্রভাবিত হওয়ার মতো মানুষ আজমেরী শেখ নয়। কিন্তু অরু এবার ইউ এস এ তে গিয়ে যা যা ঘটালো তাতে অনুর প্রতি সন্দেহ আর শঙ্কা দুটোই তার মনেও দানা বেঁধেছে কিছুটা।
এক মেয়ের জন্য মান সম্মান খোয়া যাচ্ছে, এই সময়ে অন্য মেয়েকে সম্মানের সাথে উপযুক্ত গুনাগুন সম্পন্ন পাত্রস্থ করা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতোই। তাই আপাতত আজমেরী শেখের মাথায় জাহানারার কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঠিকই তো এভাবে শর্ট নোটিশে কত সহজে দ্বায়িত্ব নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছে রেজা। তাছারা আরেকটা কথাও তো ঠিক, এখন আর সেই এলাকার নেতাদের লেজ ধরে ঘুরে বেড়ানো পাতি নেতা নেই রেজা। নিজের যোগ্যতায় বেশ ভালোই নামদাম কামিয়েছে সে। দেখতে শুনতেও খারাপ না। এককথায় পাত্র হিসেবে ভালো, শুধু ভালো নয় বরং বেশ ভালো।
*****************************************
মামির কাছ থেকে চাবিটা ছিনিয়ে নিয়ে অনু যখন দ্রুত পা ফেলে অরুর রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই হুট করে সামনে চলে আসে রেজা আর ওর ছোট বোন রুপা।
না, রেজা অনুর পথ আটকে দাঁড়ায়নি, বরং দু'জন দুদিক থেকে আসছিল বলেই পথিমধ্যে দেখা। আমেরিকা থেকে আসার পর এটাই বোধ হয় প্রথম সাক্ষাৎ ওদের। যার ফলস্বরূপ অনুকে দেখা মাত্রই পা দুটো থমকে যায় রেজার। রেজার পেছনে ওর ছোট বোন রুপাও ছিল, মাত্রই সন্ধ্যার টিউশন থেকে ফিরেছে সে, এখন রুমেই যেতো।কিন্তু পথিমধ্যে ভাইকে এভাবে আচমকা দাঁড়িয়ে পরতে দেখে,তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের আগন্তুক কে দেখার জন্য একটু খানি উঁকি দেয় রুপা।
উঁকি দিতেই চোখের সামনে অনুকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে রুপা বললো,
---- আরে ভাবি যে, কতদিন পর দেখা হলো তোমার সাথে।
এমনিতেই মেজাজ চড়াও হয়ে আছে,মাথাটা য'ন্ত্রণায় ধিরিম ধিরিম আওয়াজ করছে,তারউপর রুপার এমন অহেতুক ভাবি সম্মোধনে বেশ বিরক্ত হলো অনু, তৎক্ষনাৎ রুপাকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
---- কে তোর ভাবি? আপু বল।
অনুর ধমকে রুপা মুখ কালো করে চলে যেতেই রেজা খানিকটা এগিয়ে এসে শুধালো,
----- কেমন আছো অনু?
অনু বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠে বললো,
---- ভালো নেই।
---কেন?
অনু এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া পরখ করলো রেজাকে,আগের চেয়ে বেশভূষায় বেশ পরিবর্তন হয়েছে তার । চেহারায় এখন আগের মতো মদন মদন ভাবটা আর নেই, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর মুখভর্তি খড় দাড়িতে ভালোই লাগছে দেখতে,কোথাও যেন একটা গু'ন্ডা মা'স্তান ভাইব আছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনুর চোখে রেজাকে সেই আগের মতোই মদন মদন লাগছে। রেজা এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে দেখে অনু নিজের ভ্রম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বললো,
---- আপনার মা ভালো থাকতে দিলেতো?
অনুর কথার পাছে রেজা স্নেহের স্বর বুলিয়ে বললো,
------এভাবে কেন বলছো অনু? এখন একটু সহ্য করো বিয়ের পর মাকে সামলানোর দ্বায়িত্ব আমার।
অনু অবাকের চরম শিখরে পৌঁছে বলে,
---- কিসের বিয়ে, কার বিয়ে? কি বলছেন যা-তা?
রেজা ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বললো,
---- এবার আমাদের বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে "প্রিয়া আমার"। একটু আগে শুনে এলাম মা আর ফুপি বিয়ে নিয়ে আলাপ করছে। আরেকটু সবুর করো তোমাকে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে বউ করে নিয়ে যাবো আমি।
রেজার পকর পকর অনু এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে অরুর ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বজ্র কন্ঠে বললো,
---- রিডিকিউলাস।
রেজা লাজুক হেঁসে হালকা মাথা চুলকে বলে ওঠে,
----- হ্যা ওইটাই।
রেজার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখ ভঙ্গিমা পাল্টে গেলো অনুর, রাগি রাগি চেহারাটা মূহুর্তেই ধারণ করলো অসহায় রূপ। মুখশ্রী জুড়ে জমা হলো একরাশ ঘন কালো আত'ঙ্কের মেঘ, দেখে মনে হচ্ছে টলটলে চোখ দুটো থেকে এখনই নেমে আসবে অসহায় অপারগ বারিধারা। তপ্ত রাশভারি ব্যথাতুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড়ালো অনু,
----- শুনেছি বাড়ির বড় মেয়েরা সবসময় স্যাক্রিফাইস করে, আমি যদি নিজের ভালোবাসার বেলায় একটু খানি স্বার্থপর হই তাহলে কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? আমিও কি অরুর মতো খারাপ আর অবাধ্য মেয়ে হয়ে যাবো?
*****************************************
ক্রীতিক কুঞ্জের হলরুমে টাঙানো দেয়াল জোড়া বিশাল ঘড়িটায় ঢংঢং আওয়াজ করে সকাল আটটার জানান দিচ্ছে।
তবে এখনো পর্যন্ত বিছানা ছাড়েনি কেউ। নিচে ডাইনিং এর যায়গাটাও পুরোপুরি ফাঁকা, সেই সুযোগে সবার আড়ালে অরুকে একটু খানি মাংস ভাত মাখিয়ে খায়িয়ে দিচ্ছে অনু।
খাবারের লোকমা মুখে নিয়েই বসে বসে ফোপাঁচ্ছে অরু, কিছুতেই মুখ থেকে গলায় নামাচ্ছে না। সেই তখন থেকে একই ভাবে বসে আছে দেখে অনু এবার ধমকে উঠে বললো,
---- কি ব্যাপার খাচ্ছিস না কেন?
অরু হেঁচকি তুলে বলে,
---- খাবার গলা দিয়ে নামছে না আপা,আমি ওনার কাছে যাবো।বিশ্বাস কর ওনার থেকে এতোটা দূরে চলে এসেছি, সেটা ভাবলেও আমার কলিজা ছিঁ'ড়ে যাচ্ছে, গ'লা কাঁ'টা মুরগীর মতো ছটফট করে উঠছে হৃদয়টা।
আমাদের কি আর কখনো দেখা হবেনা আপা? উনিতো আমাকে না দেখে থাকতে পারেনা,প্রচুর রেগে যায়। আচ্ছা, অতিরিক্ত টেনশনে ওনার যদি আবারও প্যানিক এ্যা'টাক হয়, আবারও যদি নাক দিয়ে র'ক্ত পরে, তাহলে? উনিতো তখন পুরোপুরি সেন্সলেস হয়ে যায়, ওনার অনেক কষ্ট হয় আপা।
খাবার মুখে নিয়ে একত্রিশ বছরের ক্রীতিকের জন্য মাত্র উনিশে পা দেওয়া অরুর এমন দুশ্চিন্তা দেখে অনু হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর ছোট বোনের দিকে, ঠিক কতোটা ভালোবাসলে সামান্য ভৌগোলিক দূরত্বে মানুষ এতোটা ছটফট আর আহাজারি করে জানা নেই অনুর,তাই বলার আর কিছু ভেবে না পেয়ে অরুকে স্বান্তনা দিয়ে অনু বলে,
---- সব ঠিক হয়ে যাবে বোন আমার, ক্রীতিক ভাইয়া ঠিক কোনো একদিন চলে আসবে,এখন খেয়ে নে।
অনু কথাটা বলেছে কি বলেনি,তখনই ওর মুখের কথা ছো মে'রে নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে এসে জাহানারা বললেন,
----- খাওয়া খাওয়া, বেশি করে খাওয়া, শরীর ভে'ঙে চুড়ে যা হাল হয়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ বাড়ির ছোট সাহেব সর্বনাশের আর কিচ্ছুটি আর বাদ রাখেনি।
মামির আকারে ইঙ্গিতে করা নোং'রা তি'রস্কারে থমথমে হয়ে ওঠে অনুর মুখ। এসবের কারনেই তো অরুকে মামির সামনে খুব একটা পরতে দেয়না ও।
অনুর এসব রাগ ঢাকের দু'পয়সা তোয়াক্কা না করে জাহানারা এগিয়ে এসে,আঙুল উঁচিয়ে অরুর ঢিলে হয়ে যাওয়া জামাটা দেখিয়ে বললো,
---- দেখ দেখ জামাটা পর্যন্ত কাঁধ থেকে খুলে পরছে, কি ধকলটাই না গিয়েছে মেয়ের উপর দিয়ে, আগে তো এমন ছিলিস না। অথচ এবাড়ির ছেলের সাথে কদিন থেকেই এই হাল?
হ্যারে অরু হাঁটুর বয়সী মেয়ে হয়ে বয়সে ওমন বড় সৎ ভাইয়ের সাথে থাকতে তোর একটুও ভয় করলো না?
মামি এখন ইচ্ছে করে লাগাম ছাড়া কথা বলে ঝামেলা পাকাতে চাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝে আসতেই চেঁচিয়ে উঠলো অনু,
----মামি চুপ করবে তুমি?
মামির বলা নোংরা কথার মাথায় এতোক্ষণে নিজের শরীরের দিকে চাইলো অরু, আসলেই ও আগের চেয়ে অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে, তবে এটা আজ বা কাল নয়, প্রায় মাস খানিক আগে ক্রীতিক যখন হুট করেই ওর সাথে দেখা করতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল তখনকার ঘটনা।
ঘুরিয়ে পেচিয়ে হলেও কথাটা সত্যি, ক্রীতিকের জন্যই শারীরিক এই অধপতন অরুর। তাই অরু নিজের জামাটা ঠিকঠাক করে খাবার চিবুতে চিবুতে মামির উদ্দেশ্যে বললো,
---- স্বামীর সাথে থাকতে ভ'য় কিসের মামি?বিয়ের পরে মামার সাথে থাকতে তোমার বুঝি খুব ভ'য় হতো? শুনেছি তোমার আর মামার বয়সের পার্থক্য প্রায় পনেরো বছর, সেখানে আমিতো আমার স্বামীর চেয়ে বারো বছরের ছোট মাত্র।
এইটুকুনি মেয়ের মুখে এতো বড় অপ'মান জনক কথা শুনে ঝাঁজিয়ে উঠলেন জাহানারা, আশেপাশের কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই খিটমিটিয়ে বললেন,
----- বিদেশে গিয়ে ন'ষ্টা হয়ে ফিরেছিস আবার বড়বড় কথা বলা হচ্ছে? মহল্লার মানুষকে বলে দিলে তখন বুঝবি অপ'মান কাকে বলে।
--- মামি, কি সমস্যা তোমার? কেন গায়ে পরে শুধু শুধু ঝ'গড়া করছো, আর কাকে কি বলছো তুমি? যে গদিতে বসে পায়ে পা দোলাচ্ছো সেটা ওর স্বামীর টাকায় কেনা, তাই ভালোয় ভালোয় বলছি মুখ সামলাও। পরিনাম খারাপ হতে পারে।জায়ান ক্রীতিক কে চেনোনা তুমি।
অনুর কথা শেষ হতেই,জাহানারার তীরের ফলার মতো দৃষ্টি ভস্ম করলো অনুকে, তিনি সেভাবেই তাকিয়ে বললেন,
---- ক'দিন পর ছেলের বউ হবি বলে তোক কিছু বলছি না অনু, তাই বলে এইনা যে মুখেমুখে তর্ক করলে তোকে ছে'ড়ে দেবো আমি।
অনু আশ্চর্য হয়ে শুধালো,
---- কি বলছো, কার ছেলের বউ?
---- তোমার আর রেজার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।
মায়ের মুখ থেকে ভেসে আসা অকস্মাৎ কথাটা ধূমকেতুর হলকার মতো ছুটে এসে কর্ণকূহরে ঝঙ্কার তুললো অনুর, ও তৎক্ষনাৎ পাশ ঘুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে আহত সুরে ডাকলো,
---- মা!
আজমেরী সিঁড়ির রেলিং ধরে নামতে নামতে বললেন,
---- আশা করি তোমার কোনো আপত্তি নেই।
অনু কাতরে উঠে বললো,
---- এতো তাড়াহুড়ো কেন মা? মাত্র কদিনই তো হলো আমরা দেশে ফিরলাম, তুমি এখনো সুস্থ হওনি পুরোপুরি, তোমাকে এখনো মাসে মাসে চেকআপের জন্য ইউ এস এ যেতে হবে।আর এখনই কিনা....
---- ওই জন্যই তো তাড়াহুড়ো, তোমাদের জন্য করনীয় দ্বায়িত্বটুকু ভালোয় ভালোয় পালন করতে পারলে তবেই আমার শান্তি। তাছাড়া তোমার বিয়ে না হলে অরুকে বিয়ে দেওয়া যাবেনা,এই মূহুর্তে অরুর বিয়ে হওয়াটা জরুরি, কিন্তু বড় বোনের আগে ছোট বোনকে বিয়ে দিতে গেলেই মানুষ পেছনের কাহিনি খোঁচাতে শুরু করবে,এটাতো আর আমেরিকা নয়। তাই আপাতত অরুর নয়, তোমার বিয়েটাই মোক্ষম আমার কাছে, আশা করি এবার আর কোনো আপত্তি নেই?
মায়ের কথা শেষ হতেই চেঁচিয়ে উঠলো অনু, জড়ানো কন্ঠে বললো,
---- হ্যা,হ্যা অনেক আপত্তি আছে, আমি এই বিয়েটা কিছুতেই করতে পারবো না মা।
অনুর প্রতিক্রিয়া শুনে আজমেরী শেখ মুখে কিছুই বললেন না, চুপ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মেয়ের মুখের দিকে অতঃপর আহত সুরে বলে উঠলেন,
----- ইদানীং আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে অনু, যখন তখন আবারও পরে যেতে পারি, তবে মনে হয়না এইবার পরে গেলে আর কোনোদিন উঠতে পারবো। সুস্থ থাকতে কথা শোনো মায়ের, নয়তো পরে আপসোস করবে।
মায়ের কথায় অনু, অরু দু'বোনেরই মুখ থেকেই র'ক্ত সরে গেলো, ওরা কি মায়ের সাথে বেশি বেশি করে ফেললো? সেটাই ভাবছে আপাতত।
অনুর হাত পা কাঁপছে, মনে হয়না আর শেষ রক্ষা হবে।অরুতো তাও কয়েকটা দিনের জন্য হলেও ক্রীতিকের হতে পেরেছিল, ওদের ভালোবাসা পূর্নতা পেয়েছিল, কিন্তু অনুদের অপূর্ণ ভালোবাসার কি হবে?
এই "কি হবে",ভাবতেই গিয়েই বুকের ভেতরে এলোপাথারি ঝড় উঠেছে অনুর,সেই ঝড়ে একে একে ভে'ঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে আশা, ভরসা,প্রতিশ্রুতি সব। প্রত্যয়ের সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত মানস্পটে খচিত প্রতিটা সুন্দর মূহুর্তে যেন হুট করেই দা'উদাউ করে অ'গ্নি শিখা জ্বা'লিয়ে দিয়েছে কেউ।
অনু আর এভাবে ভেজা চোখ নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না সবার সামনে, এঁটো হাত সহ'ই ছুটে চলে গেলো নিজের রুমে। অতঃপর দরজা লাগানোর কর্কষ আওয়াজ ভেসে এলো দোতলার কোনো একটা ঘর থেকে।
*****************************************
সন্ধ্যে হতেই ল্যানটার্ন আর স্ফটিকের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে হিরিকো খচিত বারের চারিপাশ। ভেতরে সফ্ট গানের তালে তালে শরীর দোলাচ্ছে তরুণ তরুণীর দল।হাতে থাকা হুইস্কি আর রেড ও'য়াইনের প্রভাবে কেউ মাতাল আবার কেউ বা অর্ধ মাতাল। তবুও মিউজিকের তালে তালে পায়ে পা মিলিয়ে কোমর দোলাতে মোটেও অপারগ নয় তারা।
বিশাল বারের এককোনে যে বার কাউন্টার রয়েছে, সেখানেই বারস্টুল পেতে ডোরাকে কোলে নিয়ে বসে বসে রেড ও'য়াইনে চুমুক দিচ্ছে ক্রীতিক, পরনে এখনো পুরোপুরি ফর্মাল ড্রেস। দেখে মনে হচ্ছে ভার্সিটি থেকেই এখানে এসেছে সে। ক্রীতিকের মোটেই ডিস্কোবার কিংবা হইহট্টগোল পছন্দ নয়। তাই নিজের মতো করে একটু খানি সময় কাটাতে হলে এখানেই চলে আসে ও।
ছোট্ট ডোরা নিজের নরম তুলতুলে গা টা পুরোপুরি ক্রীতিকের হাতে ছেড়ে দিয়ে আধো আধো চোখ খুলে ঝিমাচ্ছে, মনে হয় অ্যা'লকোহলের গন্ধে ওরও নেশা ধরে এসেছে। ক্রীতিক ডোরার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
----- তোর মালিকের মতো ঢং করা বন্ধ কর, নয়তো মাথায় তুলে একটা আ'ছাড় দেবো।
ডোরা বেচারী হয়তো জানেই না আসলে ওর দোষটা কোথায়,তাই সহসা চুপচাপ বসে রইলো ও।
ডোরাকে ধমক দিয়ে ক্রীতিক যখন আবারও ওয়াইনে মন দেয়, তখনই বারের মধ্যে একে একে আগমন ঘটে অর্ণব, এলিসা, আর সায়রের।
ওরা আজকাল ক্রীতিককে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকে, ওই জন্যই নিজেদের অবসর হলেই, হুটহাট লোকেশন ট্র্যাক করে চলে আসে ক্রীতিকের কাছে,ওকে একটু সময় দেওয়ার জন্য, ঠিক আগের মতো।
ওদেরকে দেখে ক্রীতিক ভালোমন্দ কিছুই বললো না,বরং ভাবলেশহীন হয়ে বসে রইলো আগের ন্যায়।
অর্ণব এগিয়ে এসে বারস্টুল টেনে বসতে বসতে অবাক হয়ে শুধালো,
---- দেখে তো মনে হচ্ছে ভার্সিটি থেকে ফিরেছিস, তাহলে বিড়ালের বাচ্চা কোলে নিয়ে বারে কি করিস তুই?
ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
--- জানিনা।
সায়র একটু ভালো করে নজর বুলিয়ে বললো,
----- আরে এটাতো অরুর বিড়াল।
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
---- তোকে জিজ্ঞেস করেছি? কতবার বলেছি ওর নাম মুখে নিবিনা তুই।
এলিসা ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো,
----- থামনা তোরা, জেকে তুই তো বিড়াল দেখলেই এ'লার্জি এ'লার্জি বলে নাক সিটকাস, এখন তাহলে বিড়াল নিয়ে বারে কি করিস তুই? আর কতক্ষণ ধরেই বা এখানে বসে আছিস? আদৌও ভার্সিটিতে গিয়েছিলি?
ক্রীতিক কোনোরূপ জবাব না দিয়ে নির্লিপ্ত মুখে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলের উপর রেখে পুনরায় চুমুক দিলো ওয়াইনের গ্লাসে।
কাগজে কি আছে দেখার জন্য অর্ণব তাড়াহুড়ো করে কাগজটা লুফে নিয়ে সেটাতে চোখ বুলিয়ে আশ্চর্য কন্ঠে বলে ওঠে,
------ তুই রিজাইন দিয়েছিস মানে? এটা তোর শখের জব ছিল।
ক্রীতিক সামান্য হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,
----- আই নো।
এলিসা রেগেমেগে বললো,
---- তাহলে হুট করে রিজাইন দিয়েছিস কেন? অরুর জন্য? সবকিছুর একটা লিমিট থাকতে হয় জেকে, এভাবে লিমিটক্রস করে কেউ লাইফ লিড করতে পারেনা, তুই আজকাল যা শুরু করেছিস, তাতে খুব শীঘ্রই ম'রে যাবি তুই।
সায়র নাক চোখ সিকোয় তুলে বললো,
---- গাইস ওর সাথে থাকতে থাকতে বিড়ালটাও অসভ্য আর উগ্র হয়ে যাচ্ছে, আমাদের উচিৎ বিড়ালটাকে হেফাজতে নিয়ে নেওয়া। নয়তো কোন দিন দেখবো বিড়ালটারও অতিরিক্ত ডি'প্রেশনে নোজ ব্লে'ডিং হচ্ছে ।
ওদের একেক জনার যুক্তি শুনে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে কর্কষ আওয়াজে বলে উঠলো ,
----- আহ,চুপ করবি তোরা, আমি ডিপ্রেশড হয়ে ঘরে বসে থাকার জন্য মোটেই জব ছাড়িনি, বিডি তে যাওয়ার জন্য ছেড়েছি।
এবার অর্ণব,এলিসা, সায়র একযোগে বললো,
---- কিহ, তুই অবশেষে বিডি তে ফিরছিস?
ক্রীতিক ওয়াইনের গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে বললো,
---- একেবারের জন্য যাচ্ছি না, বেশকিছু হিসেব নিকেশ বাকি পরে আছে,সেগুলো শুধে আসলে মিলাতে যাচ্ছি। তাছাড়া আরও একজনকে খুব কাছ থেকে শা'স্তি দেওয়াটাও বাকি পরে আছে। আমি আবার বাকির খাতা খুব বেশিদিন ফেলে রাখিনা।
তীর্যক ছু'ড়ির ফলার মতো কথাগুলো উগরে দিয়ে ডোরাকে নিয়ে উঠে যায় ক্রীতিক, যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
---- বাই দা ওয়ে, সি ইজ নট বিড়ালের বাচ্চা, হার নেইম ইজ" ডোরা"।
ক্রীতিক চলে গেলে সায়র, অর্ণব আর এলিসার কাঁধ হাত দিয়ে অস্ফুটেই বলে ওঠে,
---- দোস্ত এবারের ভ্যাকেসনটা বাংলাদেশে কাটালে কেমন হয়?
অর্ণব দাঁত কটমটিয়ে সায়রের একহাত ঝাড়া মে'রে এলিসার কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
---- কেমন হয় সেটা পরে বলছি, তার আগে তুই আমার বউয়ের কাঁধ থেকে হাত সরা গর্ধব।
সায়র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গালে হাতদিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
---- আজ একটা বউ নেই বলে বন্ধুরাও মীরজাফরের মতো আচরন করে, হাহ!!
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৩৮
দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পাচ্ছি না, ভুলতে পারছি না,তবুও তুমি আছো, এ তোমার কেমন থাকা জায়ান ক্রীতিক??
ল্যাপটপের কিবোর্ডে এতটুকু টাইপ করে থামলো অরু, অতঃপর "জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী" খচিত যে ইমেইল একাউন্ট টা এখনো সেভ করা রয়েছে, সেটার সেন্ড অপশনে ক্লিক করে চোখ বোলালো মেইল একাউন্টের পাশে এটে থাকা ছোট্ট ডিপিতে।
ডিপিতে দেখা যাচ্ছে রোদচশমা আর ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট পরিহিত ক্রীতিক কে, যে বাইকে হেলান দিয়ে উরুর উপর হেলমেট নিয়ে নির্বিগ্নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর মুখ খানাও কি স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।
এই ছবিটা বেশ কিছু বছর আগের হবে হয়তো, অন্তত হেয়ার স্টাইল তো তাই বলছে। দেশে ফেরার পর আজ প্রায় সাত দিন যাবত এই একই কাজ ক্রমাগত করে যাচ্ছে অরু। ও জানেনা এই মেইল একাউন্ট আদৌও ক্রীতিক ব্যবহার করে কিনা।কিন্তু ওই যে আশায় বাঁচে চাষা। সেরকমই বুকের মাঝে জমে থাকা তীব্র দহন আর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আশাকে সামনে রেখে প্রতিদিন ক্রীতিকের একাউন্টে মেইল পাঠায় অরু।
কি জানি হুট করে ক্রীতিকের চোখে পরলেও তো পরতে পারে। কারণ একটাই ক্রীতিক নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে এ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো উপায় জানা নেই অরুর ।
মেইল পাঠানো শেষ হলেও সেই কখন থেকে এক ধ্যানে ক্রীতিকের ছবির দিকে তৃষ্ণার্থ চাতকের ন্যায় তাকিয়ে আছে অরু, মনেমনে ভাবছে,
----- কতদিন আপনাকে দেখিনা, আপনি কত দূরেএএ।আপনার ছবির দিকে তাকালে হৃদয় কেঁপে ওঠে আমার,বারবার মনে হয় হাজার মাইল দূরত্বে নিজের অতি মূল্যবান কি যেন ফেলে এসেছি আমি, যখন মস্তিষ্কটা গভীর ভাবে ভাবতে থাকে কি সেই জিনিস? তখনই মনে পরে যায়, আমার আত্মাটাকেই তো আপনার মাঝে ফেলে রেখে এসেছি আমি। এখন আপনি হীন আমার আমিটার অস্তিত্ব যে পৃথিবীর বুকে থেকেও নেই। ছয়মাস আগে যখন আমেরিকাতে প্রথম পা রেখেছিলাম তখনও কি জানতাম? কেউ একজন আমার জন্য বুকের ভেতর ভালোবাসার পাহাড় জমিয়ে দিন রাত নিদারুণ কষ্টে অতিবাহিত করছে। আর এখন সেই কষ্টটা শুধে আসলে ফেরত দিচ্ছেন আপনি আমাকে। আপনি সত্যিই পা'ষাণ, আর নি'র্দয়। আপনি আমাকে না দেখে বেশ ভালোই থাকতে পারেন। শুধু শুধু সামনে এলে আমাকে ব্যথা দেওয়ার জন্যই পা'গলামি আর রা'গ দেখানোর নাটক করেন।এখন সব বুঝতে পারছি আমি।
প্রথমে ভালোবাসা, তারপর অভিমান অতঃপর সবশেষে বুকভা'ঙা কাতর কা'ন্না, এভাবেই যাচ্ছে অরুণ দিন। অরু ভালো নেই, ভালো থাকার কথাও নয়।এক অষ্টাদশীকে নিজের প্রেমে পা'গল করে দিয়ে ক্রীতিকের আর খোঁজ নেই।
যে ক্রীতিক জিদের তোপে গত আট বছর ধরে বাংলাদেশে আসেনি সে কখনোই হুট করে শুধুমাত্র অরুর টানে বাংলাদেশ চলে আসবে না নিশ্চয়ই?অরু হলফ করে বলতে পারে, ক্রীতিক আসবে না, আর এখানেই হয়তো অরুর অপারগতা,অসহায়ত্ব আর দুঃখের দিনের সূচনা।
অরু তখনও টেবিলের উপর মাথা এলিয়ে রেখে ল্যাপটপে ক্রীতিকের ছবির দিকে তাকিয়ে অযাচিত চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল। চোখের কার্নিশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল অশ্রুসিক্ত নোনাজল। ঠিক সে সময় হুট করেই রুমে প্রবেশ করে অনু। রুমের মাঝে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে তরিঘরি করে ল্যাপটপ বন্ধ করে চোখ মুছে পেছনে চাইলো অরু। দেখলো দরজার কাছে অনু দাড়িয়ে।
আজকাল অনুর মুখের দিকে তাকানো যায়না আর, সবসময় এইটুকুনি হয়ে থাকে শুকিয়ে । অনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে গলা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো অরু,
---- কিছু বলবি আপা?
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---- তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, ছাদে গিয়ে দেখ অপেক্ষা করছে বোধ হয়।
প্রেমিক পুরুষের হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে নেতিয়ে যাওয়া মনটা হুট করেই লাফিয়ে উঠলো অরুর, হৃদ গহীনের কোথাও যেন প্রদীপ শিখার ন্যায় দপ করেই জ্বলে উঠলো একফালি আশার আলো। অনুর সাথে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করায় সায় দিলোনা অরুর মন, ও তৎক্ষনাৎ গায়ে কোনোরকম ওড়নাটা জড়িয়ে ছুট লাগালো মহলের ছাদের দিকে।
ক্রীতিক কুঞ্জের তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল মহলের লম্বা করিডোর পেরিয়ে চিলেকোঠার কাছে আসতেই হাঁপিয়ে উঠলো অরু।
দিনের দ্বিপ্রহর চলমান। তবুও চারিদিকে চৈত্র মাসের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে চোখ জ্বলে যাচ্ছে। এই সময়ে ছাদের দিকে তাকালেও কেমন গলা শুকিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পু'ড়ে ফো'সকা পরে চামড়া উঠে আসবে।বুড়িগঙ্গা ছাপিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে যা ও একটু শীতল হাওয়া দিচ্ছে তাও রোদ পেরিয়ে এদিকে আসতে আসতেই হিটারের উত্তাপে পরিনত হচ্ছে।
অনেক গুলো দিন আমেরিকার বরফশীতল ঠান্ডা আবহাওয়ায় থেকে এসে এই রোদকে অরুর চোখে ঝ'লসানো অ'গ্নিদাহের মতোই ভ'য়ানক লাগছে। তাই কিছুক্ষণ চিলেকোঠার ঘরের সামনে দাড়িয়ে থেকে সেখান থেকেই গলা ছেড়ে ডাকলো অরু,
----- শুনছেন এদিকে আমি।
ওর প্রিয় আগন্তুক কোন দিকে দিয়ে আসবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না, তাই সহসা এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অরু। কিছু সময় যেতেই ওর চোখের সামনে দৃশ্যগত হলো সেই আগন্তুক। কিন্তু এতো জায়ান ক্রীতিক নয়, জায়ান ক্রীতিকের ধারে কাছের কেউ ও নয়। অকস্মাৎ ঝটকা টাকে সামাল দিতে না পেরে হতবিহ্বল হয়ে সামনের মানুষটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে অরু।
----- কেমন আছিস অরু?
চঞ্চলা হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে প্রশ্ন ছুড়লো নীলিমা।
অনেকদিন বাদে দেখা, তাও অবাক না হয়েই মেকি হেসে অরু বলে,
---- হ্যা ভালো আছি।
চিরাচরিত মিথ্যে কথা, যা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে, তাও বলতে হয় তাই বলা।
----কিন্তু তুই হঠাৎ ক্রীতিক কুঞ্জে?
অরুর করা দ্বিতীয় প্রশ্নে নীলিমা সহসা হেসে উত্তর দিলো,
---- তোর সাথেই দেখা করতে এলাম, অনু আপা ডেকে পাঠিয়েছে তোর নাকি মন মেজাজ ভালো নেই।
অরু মৃদু হেসে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো,
---- তেমন কিছুনা আমি ঠিক আছি।
অরুর কথার পাছে নীলিমা কিছুই বললো না, শুধু নির্লিপ্ত চাহনীতে আগাগোড়া পরখ করলো ওর, মনেমনে ভাবলো,
----- এক নিখিল ভাইয়ের জন্য কি হাল হয়েছে মেয়েটার। নাদুস নুদুস মাখনের মতো শরীরটা শুকিয়ে চোদ্দ বছরের না বালিকাদের মতো লাগছে। গলার হাড় হাড্ডি সব বোঝা যাচ্ছে। তাও বলছে ও নাকি ঠিক আছে। নিখিল ভাই যে কেন অরুর একতরফা ভালোবাসা বুঝলো না, কে জানে?
নীলিমা সেই তখন থেকে চুপ হয়ে আছে দেখে অরু বললো,
---- দাঁড়িয়ে থাকবি চল নিচে যাই, এ বাড়িতে প্রথম এলি, তোকে ক্রীতিক কুঞ্জ ঘুরিয়ে দেখাই।
নীলিমা না সূচক মাথা নাড়িয়ে, অরুর হাতে হাত রেখে বললো,
---- তোকে আমার সামনে খুশি থাকার ভান করতে হবে না অরু, আমি জানি তুই পু'ড়ছিস।তবে আমি জিজ্ঞেস করবো না কেন এই দহন, সেটা না হয় তোর ভেতরেই থাকুক। আমি শুধু বলতে এসেছি, এভাবে মনমরা হয়ে ঘরে বসে আর কতদিন থাকবি বল? যে যাওয়ার সে তো গিয়েছে, তাই বলে তো আর জীবন থেমে থাকবে না,তাই না? আমি বলি কি তুই আবার পড়াশোনায় মন দে।
অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
----- এই মূহুর্তে একাডেমিক পড়াশোনায় মন বসানোর মতো মন কিংবা মস্তিষ্কের অবস্থা নেই আমার নীলিমা। আমার একটু সময় লাগবে। তাছাড়া ইউ এস এ তে আমি ইকোনমিকস এ পড়তাম। এখন আবার হুট করে এখানে কি নিয়ে শুরু করবো তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
অরুর কথাগুলো শুনে নীলিমা মাথা নাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, পরক্ষণেই চট করে বলে উঠলো,
----- অরু, তোর তো সাহিত্যে বেশ আগ্রহ, তুই নোবেল পড়তে ভালোবাসিস।তুই একটা কাজ করতে পারিস, তুই বাংলা একাডেমির সাহিত্যকলায় ভর্তি হয়ে যা না। ওখানে প্রতিদিন সাহিত্যের আসর বসে, বিভিন্ন বয়সের কবি,সাহিত্যিক, গল্পকার রা ওখানে এসে নিজের লেখা কবিতা, গদ্য,উপন্যাস এসব পাঠ করে অন্যদের উৎসাহিত করেন।
ভেতরে পাবলিক লাইব্রেরীও আছে,একেবারে মনোরম শান্তি শান্তি পরিবেশ। যারা একটু নিরিবিলিতে সাহিত্য চর্চা কিংবা উপন্যাস লেখায় মনদিতে চায়,তারাই সকল ডিপ্রেশন ভুলে একাডেমিতে গিয়ে বইয়ের মাঝে কিংবা সাহিত্য আড্ডায় ডুব দেয় ।
তাছাড়া পাশের চারুকলা একাডেমিতে আমি প্রতিদিন আঁকাআঁকি আর স্কাল্পচারের কাজ শিখতে যাই, তুই যদি সাহিত্যকলায় ভর্তি হোস তাহলে দুজন মিলে প্রতিদিন একসাথে যাওয়া যাবে।
নীলিমার কথাটা একেবারেই ফেলনা নয়, বরং অরুর ভা'ঙাচোরা মনটা ভালোই আগ্রহ পেলো ওর প্রস্তাবে। সেইসাথে অরুর মস্তিষ্কে খেলে গেলো আরও একটা কৌশলী পরিকল্পনা, মনেমনে ভাবলো,
----- এটাই সুযোগ মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পড়াশোনার নাম করে বিয়ে দেখা থেকে আটকানো যাবে। তাছাড়া সাহিত্যে মায়ের বেশ আগ্রহ আমি একাডেমিতে ভর্তি হতে চাই শুনলে না করবে না নিশ্চয়ই?
অরু কিছু একটা ভাবছে থেকে নীলিমা ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,
---- একটু সময় নে, তারপর না হয় সিন্ধান্ত নিস। আর হ্যা ওসব পেছনের কথা ভুলে যা, দেখবি তোর জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোর চোখের দিকে তাকালেও ভালোবাসার গভীরতা মাপতে পারবে, হাত বাড়িয়ে নয় বরং হৃদয় বাড়িয়ে স্পর্শ করবে তোর সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে।
নীলিমার কথায় অরু আশ্চর্য হয়ে বললো,
----- কি বলছিস এসব নীলিমা? আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছু উনিই।সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়িয়েছে,এখন আর ওনাকে ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষকে আমি আমার জীবনে কল্পনাও করতে পারিনা। উনি ছাড়া অন্যকেউ ভালোবেসে স্পর্শ করার আগে ম'রণ হোক আমার।
নীলিমা বুঝতে পারে মেয়েটা নিখিল ভাইয়ের প্রতি খুবই সিরিয়াস।তাই এসব ভুলে যাওয়া টাওয়ার কথা বাড়িয়ে আর মন খারাপ করলো না অরুর, সহসা কথা ঘুরিয়ে শুধালো,
---- রাখ এসব মন খারাপের কথা, আমেরিকাতে কি কি করলি তাই বল?
গোধূলী বেলায় বিকেলের অসহিষ্ণু তীব্র রোদ, এখন অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে, অদূরে কান ফাটানো হুইসেল বাজিয়ে একে একে সদরঘাট ছাড়ছে লঞ্চ গুলো। বুড়িগঙ্গা পারের নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ার বেগ বেড়েছে, সেই সাথে বড় আমগাছটার ছায়ায় ঢাকা পরেছে শেষ বিকেলের ম'রা রোদ। অরু এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা কাঁচা আম ছিড়ে, ছাঁদের পাঁচিলে পা দুলিয়ে বসতে বসতে বললো,
----- আয় বলছি।
*****************************************
নিকোশ আধারে ছেয়ে গেছে সন্ধ্যার আকাশ। সূর্যের শেষ লালিমা টুকুও অবশিষ্ট নেই আর। চারদিকে ভ্যাপসা গরম, শেষ রাতে কালবৈশাখী ঝড় হলেও হতে পারে,পশ্চিম আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর গতিবেগ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। অরু মাত্রই নীলিমাকে গেইট থেকে রিকশায় তুলে দিয়ে ফিরে এলো।
ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ট, তারউপর হাঁটু সমান লম্বা চুল। অনেকটা শুকিয়ে যাওয়াতে এতো লম্বা চুলের ভার বইতেও আজকাল কষ্ট হয়ে যায় অরুর। ও কোনো রকম চুলগুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাধতে বাঁধতে অন্দরমহলের দিকেই যাচ্ছিল। তখনই ওপাশের বাগান বিলাশের ঝোপের আড়াল থেকে ওর কানে ভেসে আসে ক্রন্দনরত অনুর অস্পষ্ট কিছু কথা। অনুর কথাগুলো ভালো মতো ঠাওর করার জন্য এগিয়ে গিয়ে বাগানবিলাশের অন্যপাশে দাঁড়াতেই অরু শুনতে পেলো কা'ন্নারত অনুর শেষ কথা,
----- আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে প্রত্যয় সাহেব। আমি আপনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি, আমার জন্য দ্বিতীয়বার আপনাকে কষ্ট পেতে হলো, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মোটেই ভালো মেয়ে নই,খুব খারাপ, সব ছেলের সাথেই এমন ভালোবাসার নাটক করি, আমি আপনার এক্স তিন্নির থেকেও খারাপ। আমাকে বিয়ে করে আপনি একটুও ভালো থাকতেন না, তাই যা হয় ভালোর জন্যই হয়। ভবিতব্য মেনে নিন।আর আমাকে ভুলে যান।
ওপাশ থেকে প্রত্যয় কি বললো না বললো কিছুই শোনা গেলো না, উল্টো অনু তাড়া দিয়ে বললো,
---- আমার স্বামী ডাকছে প্রত্যয় সাহেব, আমাকে যেতে হবে। কাল বাসর রাত ছিলো কিনা, ডাকবেই তো। এখন রাখছি, আর কখনো কথা হবেনা আমাদের।দোয়া করি, আপনি আমেরিকাতে সত্যিকারের সোলমেট কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবেন।তখন আমাকে কিংবা আমার দেওয়া পাথরের মতো আ'ঘাত গুলোকে মনে পরবে না আর।আপনি খুব সুখি হবেন।
এরপর কল কাটার পিক পিক আওয়াজ হলো, বোধ প্রত্যয়ই লাইনটা কেঁটে দিলো।
----আর আমি এও জানি আপনার মতো পিওর হার্ট কে কষ্ট দিয়ে আমি কোনোদিনও সুখের মুখ দেখতে পাবো না, আর না আপনাকে কখনো ভুলতে পারবো।
অস্ফুটে কথাটা বলেই শুকনো মর্মরে পাতার উপর ধপ করে বসে পরে বোবা কা'ন্নায় ভেঙে পরলো অনু।
অনুর এহেন হাল না হলে অরু হয়তো ছুটে গিয়ে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলতে চাইতো,প্রত্যয়ের মাধ্যমে ক্রীতিকের খোজ নিতো। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। আপাতত সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে রাগে ফুঁসছে অরু। বোনের উপর রাগটা যেন পাহাড় সমান উঠে এসেছে, আ'গ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভার মতোই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কটা।
অরু নিজের রাগ দমাতে না পেরে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অনুর সামনে দাড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,
-----এভাবে শুধু শুধু মিথ্যে বলে একজনকে কষ্টের সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার কি মানে ছিল আপা?
অনু দু'হাতে মুখ চেপে কা'ন্নার আওয়াজ সংবরণ করছে ঠিকই কিন্তু ওদিকে হৃদয়টা ছি'ন্নভি'ন্ন হয়ে যাচ্ছে অপারগ কা'ন্নার তালে।
বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে মন টললো না অরুর, ও দিগুন আওয়াজে বললো,
---- কি হলো বল আপা? কেন করলি এটা? যে মানুষটা হাজার মাইল দূরে থেকেও নাম্বার সংগ্রহ করে তোকে কল দিয়ে তোর খোঁজ নিতে ভুললো না, তাকে তুই এভাবে ফিরিয়ে দিলি?
অথচ আমাকে দেখ চাতক পাখির মতো ছটফট করছি জায়ান ক্রীতিকের একটুখানি খবর পাবো বলে, কিন্তু জায়ান ক্রীতিক তো প্রত্যয় ভাইয়ার মতো এতোটা সদয় নয়। তাহলে কেন করলি এটা?
অরুর কথার পাছে অনু এবার হেঁচকি তুলে বললো,
---- যা করেছি চিন্তা ভাবনা করে, বুঝে শুনে করেছি,তোর টেনশনে এমনিতেই মায়ের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। বাড়িতে প্রতিনিয়ত একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। এখন যদি আমিও এসব বলে মা'কে নিরাশ করি তাহলে মা'কে আর বাঁচাতে পারবো না অরু। পরিবারের বড় সন্তানের জন্মই হয় স্যাক্রিফাইস করার জন্য, আমিও নাহয় মায়ের কথা ভেবে নিজের ভালোবাসাকে স্যাক্রিফাইস করলাম। এ আর এমন কি?
কথা শেষ করে পুনরায় কা'ন্নায় ভে'ঙে পরলো অনু।
অনুর কথার যুক্তি আছে,কিন্তু অনুর ভালোবাসা না মানার মতো তো কোনো কারন নেই? অনু তো আর নিজের সৎ ভাইয়ের প্রেমে পরেনি। আর না ক্রীতিকের মতো প্রত্যয়ের সাথে মায়ের কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা আছে, তাহলে মাকে একবার খুলে বলতে সমস্যা কি?
অনুর কান্নাকা'টি দেখে অরু তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলো ও গিয়ে মাকে সত্যিটা বলবে, নরম সুরেই বলবে বোঝানোর চেষ্টা করবে তারপর যা হওয়ার হোক। নিজের সিদ্ধান্তকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে অনুকে রেখেই দ্রুত যায়গা ত্যাগ করলো অরু। দ্রুত পদধ্বনিতে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনেমনে ভাবলো,
------ আমি না হয় জায়ান ক্রীতিকের প্রেমে পরে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি,কিন্তু আপা তো আর তেমন কিছু করেনি, তাহলে আপা কেন নিজের ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাবেনা?
*****************************************
ভর সন্ধ্যা বেলা এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আজমেরী শেখ।
বাংলাদেশে ফিরে আজকেই প্রথম অফিসে গিয়েছিলেন তিনি, অফিস থেকে ফিরে সব ফাইল পত্র গুছিয়ে কেবলই শুতে যাবেন তখনই হুরমুরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো অরু।
অরুর সাথে আজকাল খুব একটা কথা বলেন না আজমেরী শেখ, অরুর চোখের দিকে চাইলেই ক্রীতিকের জন্য এক অদম্য ব্যথাতুর ভালোবাসার জোয়ার দেখতে পান তিনি। যা আজমেরী শেখের মোটেই পছন্দ নয়।নিজের সৎ ছেলের সঙ্গে কিভাবে তার মেয়ে ছি ছি। ভাবলেও বিরক্ত লাগে তার, অগত্যাই সেসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে, হেড বোর্ডে গা এলিয়ে দিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ দুটো নিবদ্ধ রেখে মেয়েকে শুধালেন,
---- কি প্রয়োজন?
অরু প্রথমে কিছুক্ষন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই পুনরায় আওয়াজ ভেসে এলো ওদিক থেকে,
----কিছু বলার না থাকলে যেতে পারো, আমি একটু রেস্ট করবো।
মনের মাঝের সকল শঙ্কাকে হটিয়ে অরু এবার চট করে বলেই ফেললো,
----- মা আপা একজন ভালোবাসে, তুমি রেজা ভাইয়ের সাথে আপার বিয়েটা দিওনা,আপা মুখ ফুটে কিছু বলবে না তোমাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক'ষ্টের বোঝা বইতে বইতে আপা হয়তো ম'রেই যাবে।
অরুর কথায় তৎক্ষনাৎ হাতের বইটা ডিভানে ছু'ড়ে মে'রে গভীর গলায় প্রশ্ন করলেন আজমেরী শেখ,
---- সে আবার কার সাথে ন'ষ্টামো করে বেরিয়েছে?
নোংরা কথাটা যে আকারে ইঙ্গিতে অরুকে বলা হয়েছে, সেটা অরু ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে,তবুও মায়ের কথা গায়ে না মেখে নরম গলায় বললো,
----- পপপ্রত্যয় ভাইয়া।
---- সি এফ ও অফ জেকে গ্রুপ?
মায়ের কথায় অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই কোথা থেকে যেন শ'ক্ত চ'পেটাঘা'ত এসে আঁচড়ে পরলো অরুর গালে। শরীরটা বেশ দূর্বল, তারউপর এতো শক্ত চ'ড় খেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো অরু।তীব্র ব্যথায় চ'ড় খাওয়া গালে হাতদিয়ে চোখদুটো খানিকক্ষণ খিঁচে রাখলো ও। অরুর দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অনু বললো,
---- তোকে আমি এসব বলতে বলেছি? সত্যি করে বল অরু? আমিকি একবারও বলেছি মাকে গিয়ে এসব বল, তাহলে কেন বললি?
অরু ফুপিয়ে উঠে বললো,
------ আমিতো মিথ্যে কিছু বলিনি আপা, তাছাড়া যা বলেছি তোর ভালোর জন্যই...
অরু কথা শেষ করার আগেই অনু তেতে উঠে বললো,
-----কে বলেছিল তোকে আমার ভালো করতে? আমি বলেছি?আমার ভালো করতে গিয়ে এখন যদি মায়ের কিছু হয়ে যায় তখন কি করবি তুই? এমনিতেই সারা ঘরে একাই অশান্তি বাধিয়ে রেখেছিস, আর কত অশান্তি হলে থামবি তুই? বল আমায়?
অনুর প্রতিটি ঝাঁঝালো কথায় ডুকরে কেঁদে ওঠে অরু। ওর শরীরটাও যে আর নিতে পারছে এই অশান্তি। অথচ যার কারণে এই ন'রক জীবন যাপন, তারই তো হদিস নেই। সে আদৌও বাংলাদেশে ফিরবে কিনা তাও জানা নেই অরুর। অথচ সব অপবাদ, সব তিরস্কার এসে জুটলো অরুর কপালে। বিয়ের পরে তো এইসব অশান্তিরই ভ'য় পেয়েছিল অরু।
নিজের আকাশচুম্বি রা'গকে দমাতে না পেরে অনু আরও কিছু বলবে, তার আগেই আজমেরী শেখ বলে ওঠেন,
----- তোমরা দুজনই এক্ষুনি বাইরে যাও, শরীরটা ভালো লাগছে না আমার। একটু একা থাকতে চাই।
অনু এগিয়ে এসে বললো,
---- মা কোথায় খারাপ লাগছে তোমার? বলো আমায়, মাথা টিপে দেবো একটু।
----- চুপচাপ বাইরে যাও।
আজমেরী শেখের রাশভারি আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল অনুর, ও তৎক্ষনাৎ অরুর হাত ধরে গম্ভীর গলায় বললো,
----- চল।
*****************************************
চোখের পলকে খসখস করে উল্টে গিয়েছে ক্যালন্ডারের পাতা। বাংলা ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাকে বিদায় জানিয়ে বৈশাখ এসেছে ধরনীতে।
অরুরা বাংলাদেশ ফিরেছে প্রায় একমাস হতে চললো। বৈশাখে পা দিতে না দিতেই প্রায় প্রতিটি বিকেলেই আকাশ কালো করে তীব্র ঝড়ে ফেটে পরে প্রকৃতি। আজকেও তেমন এক বিকেল, মেঘ তো নয় যেন আকাশ জুড়ে বুনো মহিষের পাল। সেথা থেকে গুড়গুড়িয়ে ভেসে আসছে কাল বৈশাখী সংকেত। চারিদিকে ঘূর্নি হাওয়া বইছে।
একাডেমী গেইট দিয়ে বেরিয়ে অরু দ্রুত পা চালাচ্ছে বাড়ির দিকে। আজ পুরো রাস্তায় একটাও রিকশার দেখা নেই।যার ফলসরূপ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে অরুকে। তবে মেইন রাস্তা ছেড়ে গলির মোড়ে ঢুকতেই দেখা মিললো চেনা পরিচিত একটা সাদা গাড়ির। অরু ফুটপাত ধরে এগিয়ে আসতেই সহসা গাড়ির কাঁচ নামিয়ে কিছুটা ঘাড় বাকিয়ে উঁকি দিলো ধূসররঙের সিকোয়েন্স পাঞ্জাবি পরিচিত এক সুদর্শন। চোখে তার রোদ চশমা। অরু কাছাকাছি আসতেই লোকটা আগ বাড়িয়ে বললো,
---- আরে অরোরা যে,
অরু সম্মোহনী হেসে জবাব দিলো,
---- জ্বি অমিত ভাই।
অমিত আরিয়ান, বাংলা একাডেমিতে যার যাতায়াত অহরহ। থাকবে নাইবা কেন, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা নামকরা উপন্যাস আর ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে তার। বছরের বেস্ট সেলের তালিকায় তার বইয়ের নামই সর্বাগ্রে। সাহিত্য কলার সদস্যদের কাছে অমিত আরিয়ান অনেকটা সেলিব্রিটিদের মতোই, যে একাডেমিতে আসলে হইচই লেগে যায় পুরো একাডেমি জুড়ে, কেউ নিজের পছন্দের বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ নেয়, তো কেউ পাশে দাড়িয়ে সেলফি।
মূলত গত বছর অমিতের যে রোমান্টিক জনরার উপন্যাসটি বের হয়েছে সেটার পর থেকেই অমিতের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অরুও সভাব সুলভ সেই উপন্যাসটা পরেছিল। পড়ার পরেই বুঝেছিল অমিত আদতে কতটা জ্ঞানের অধিকারী।একাডেমিতে নবীনদের বেশ ভালো উৎসাহ দেয় অমিত,সেইসাথে ছোটখাটো টিপস।
সেখান থেকেই মূলত অরুর সাথে মুখ চেনা চিনির পরিচয়। দেখা হলে নিজের ছোট বোনের মতোই লিখালিখি তে দু এক লাইন উৎসাহ দিয়ে যান অরুকে।অরুও বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধার নজরে দেখে অমিতকে, মাঝে মধ্যে নিজে থেকে দুএকটা প্রশ্নও করে বটে। যদি তার বিশাল জ্ঞান ভান্ডার থেকে এক আধটু আহরণ করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। তাছাড়া অমিতকে শ্রদ্ধা না করার তো কোনো কারণ নেই, আজ অবধি কখনো কোনো মেয়ে ঘটিত কিংবা অন্য কোনো খারাপ স্ক্যান্ডালে নাম জড়ায়নি অমিতের। অরু অন্তত শোনেনি কখনো।
----এই গলিতে কি করো হুম?
অমিতের প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো অরুর, মৃদু হেসে জবাব দিলো,
---- এই গলিতেই থাকি আমি।
---- ও এম জি, কোথায় থাকো?
অরু ইতস্তত কন্ঠে বললো,
---- জ্বি, ক্রীতিক কুঞ্জে।
আজকাল বাড়ির নামটা মুখে নিতেও কেমন যেন দম আটকে আসে অরুর। বাড়ির নামেও যে তার স্মৃতি জড়িয়ে।
অমিত আশ্চর্য হয়ে গেলো অরুর কথায়, চোখ দুটো বড়বড় করে বললো,
----- তুমি চৌধুরী বাড়ির মেয়ে?
জামশেদ জায়ান কি হয় তোমার?
এতো ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না অরুর, তাই গতানুগতিক কথা এড়িয়ে অরু বললো,
---- আকাশ কালো করেছে, মনে হয় ঝড় আসবে আমি আসি অমিত ভাই।
----- আরে কোথায় যাচ্ছো, গাড়িতে এসো আমি এগিয়ে দিচ্ছি ঝড়ে পরবে তো।
অরু দ্রুত পা চালাতে চালাতে বললো,
----- দরকার নেই চলে যেতে পারবো।
অরু চলে গিয়েছে অনেকক্ষন, অমিত এখনো সেদিকে তাকিয়ে, থাকতে থাকতে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
----- এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা সবসময় মুখ কালো করে থাকে কিসের এতো দুঃখ ওর?
অরু ঘরে ঢুকে ব্যাগটা ছোফার উপর ছু'ড়ে ফেলে ডাইনিং এ গিয়ে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি পান করলো।
পানিটা শেষ হতেই কানে ভেসে এলো মামির গা জ্বালানো কথা,
---- বিদেশ থেকে এক কাহিনী করে এসেছে, এখন আবার সন্ধ্যে পর্যন্ত বাইরে বাইরে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে বেড়ায়।
আমিও দেখবো আজমেরী কিভাবে বিয়ে দেয় এই ধিঙ্গি মেয়ে গুলোর। একজনকে তো এ বাড়ির ছেলেই ফূর্তি করে ছেড়ে দিলো,কই আর তো এলোনা, জানি জানি আর আসবেও না। যা নেওয়ার ছিল সে তা নিয়ে নিয়েছে। এখন আর কি করবে এই হাড় হাড্ডি ওয়ালা মেয়েকে দিয়ে?
অরু জানে মামি চটে আছে,চটে থাকারই কথা সেদিন অনুর ব্যাপারে সত্যি কথা গুলো বলে দেওয়ার পর আজমেরী শেখ আর বিয়েটা নিয়ে কথা বাড়ায়নি। সেই তেজে মামিও আর ক্রীতিক কুঞ্জ ছাড়েনি। সেও দেখতে চায় ঠিক কতদিন আর মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে থাকতে পারে আজমেরী। তার সোনার টুকরো ছেলেকে অনুর সাথে বিয়ে দিয়ে তবেই এ বাড়ি থেকে যাবে সে।
অন্যান্য দিন চুপচাপ থাকলেও আজ একটু বেশিই বেড়েছে মামি,তার কারন আজ বাড়িতে অনু আর মা নেই। ব্যবসায়ী কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে আজমেরী শেখ। শরীরটা ভালো না থাকার কারনে সাথে করে অনুকেও নিয়ে গিয়েছে। সেই সুযোগে অরুকে আজ ইচ্ছে মতো কথা শোনাচ্ছেন জাহানারা।
জাহানারা যখন এ বাড়ির ছোট সাহেব কে জড়িয়ে অরুকে হাজারটা নোংরা কটাক্ষ করায় ব্যস্ত, তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাইরে থেকে ছুটে আসে রুপা, কোনমনে হাঁপাতে হাঁপাতে গলা ছেড়ে ডেকে বলে,
---- মা, লম্বা মতো একটা ভাইয়া, রেজা ভাইয়াকে ইচ্ছে মতো পে'টাচ্ছে।
অরুর দুই পয়সার ইন্টারেস্ট নেই ওদের মা'রামা'রিতে, রেজা গোল্লায় যাক তাতে ওর কি? সেই হিসেব মতে ব্যাগটা নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা দিলো অরু।
জাহানারা হকচকিয়ে উঠে বললো,
---- কে মা'রে আমার ছেলেকে, এতো বড় সাহস কার?
রুপা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
---- জানিনা, কখনো দেখিও নি এই মহল্লায়। দেখতে বিদেশিদের মতো কিন্তু বিদেশি না, ভাইয়াকে বাংলায় গা'লি দিচ্ছিলো।
রুপার শেষ কয়েকটা কথা ছক্কা লাগার মতোই অরুর মস্তিষ্কে গিয়ে লাগলো, অজানা শিহরণে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল ওর পুরো শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। টলমলে চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছে এখনই চেতনা হারাবে ও। কিন্তু হারালো না। হাতদুটো শক্ত করে নিজেকে স্থির রেখে কাঁপা কন্ঠে বললো,
----- রুপা,যে এসেছে তার চুল গুলো কি ঘাড় অবধি লম্বা? আর চোখ গুলো কি ভাসা ভাসা?
রুপা ঠোঁট উল্টে হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই কাঁধ থেকে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে বাইরের দিকে ছুট লাগালো অরু।
ওর পরনে সুতির স্কার্ট আর টপস, লম্বা চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনমতে আটকানো। দুই পায়ে ক্রীতিকের পরিয়ে দেওয়া দুটো সোনার নুপুর। সেভাবেই ছুটছে অরু।
তবে অন্দরমহল থেকে বেরোনোর আগেই খপ করে ওর হাত টেনে ধরলো জাহানারা, চোখ রাঙিয়ে শুধালো,
---- কে এসেছে সত্যি করে বল?
অরু জবাব দিলো না, এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে ছুটে চলে গেলো সদর দরজার বাইরে, তবে ক্রীতিকের দিকে আর এক পা ও এগোতে না দিয়ে ওকে আবারও শক্ত করে চেপে ধরলো জাহানারা। হুট করে এভাবে টেনে ধরায় সদর দরজায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো অরু। ঠিক তখনই একজোড়া মোহাবিষ্ট ভাসা ভাসা চোখ স্থির হলো অরুর চোখে।
চোখের সামনে অরুকে দেখা মাত্রই হাতের হ'কিস্টিকটা দূরে ছু'ড়ে মা'রলো ক্রীতিক।
তারপর দাড়িয়ে রইলো রেজার পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়।
ক্রীতিককে এভাবে দাড়িয়ে পরতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো অরু, এক্ষুনি তো রেজার চ্যালাপ্যালারা ক্রীতিকের উপর নিজেদের রা'গ ঝা'ড়তে উদ্যত হবে, তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে পরার কি মানে?
অরু সেদিকে তাকিয়ে দু'হাতে ভর করে উঠতে যাবে তখনই ক্রীতিককে একেরপর এক তীব্র ক'ষাঘা'ত করতে লাগলো রেজার লোকেরা।
সঙ্গে সঙ্গে আবারও মুখ থুবড়ে পরলো অরু, চোখের সামনে নিজের স্বামীকে এভাবে মা'র খেতে দেখে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে ছি'ড়ে যাচ্ছে ওর।অথচ ক্রীতিক এক ধ্যানে অরুর দিকে তাকিয়ে মা'র খেয়ে যাচ্ছে।
মা'র খেতে খেতে এক পর্যায়ে ঠোঁট কে'টে ফিনকি দিয়ে র'ক্ত বেরিয়ে এলো ক্রীতিকের। ও হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটের র'ক্তটুকু মুছতে মুছতে ক্রুর হাসি হাসলো অরুর পানে চেয়ে।
ক্রীতিক কুঞ্জে দাড়িয়ে, ক্রীতিক কুঞ্জের মালিকই কিনা মা'র খাচ্ছে, তাও বাইরের লোকের হাতে। শুধু মাত্র অরুকে কাঁদানোর জন্য।
এবং সেই উদ্দেশ্য সফল ও হয়েছে, অরু বেশ ক'ষ্ট পাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে পৈচাশিক হাসিতে প্রসারিত হলো ক্রীতিকের দু'ঠোঁট। তবে এই অসহনীয় দৃশ্য আর সহ্য করতে পারলো না অরু,গলা ছে'ড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
---- ওনাকে মা'রছো কেন?ছাড়ো, উনি এই বাড়ির ছোট সাহেব।
অরুর শেষ কথাতে চমকে উঠে ভ'য়ে তটস্থ হয়ে দু'কদম পিছিয়ে গেলো সকলে।তবে শেষ রক্ষা হলো না আর।
ক্রীতিক কিছু না বললেও, এলিসা, অর্ণব আর সায়র গাড়ি থেকে নেমে এই দৃশ্য দেখেই দৌড়ে এসে একেক টাকে ইচ্ছে মতো রা'ম ধো'লাই দিয়ে মুখ বেঁকিয়ে দিলো।
আর ক্রীতিক ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অরুর দিকে। অরুও কোনো মতে হাতের তালুতে ভর করে উঠে দাড়ালো, এই আশায় হয়তো এখনই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ওকে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরবে ক্রীতিক। কিন্তু আদতে তেমন কিছুই হলোনা ক্রীতিক এগিয়ে এসে অরুকে ধরা তো দুরে থাক ওর ধারে কাছেও এলোনা,
উল্টো অরু এগিয়ে এসে ওর ক্ষ'তস্থানে হাত ছোঁয়াতে গেলে বিদ্যুৎ বেগে দূরে সরে যায় ক্রীতিক।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৩৯
ঈষান কোনে মেঘ ডাকছে। আকাশ জুড়ে বুনো মহিষের পাল। পরন্ত বিকেলে কাল বৈশাখীর স্পষ্ট পূর্বাভাস। চারিদিকের ঘূর্ণি বাতাসে ধুলোবালির ঝড় উঠেছে যেন।
তবে তকতকে পিচ ঢালা ফ্রর্ট ইয়ার্ড আর সুসজ্জিত বাগান বিলাশের পাঁচিল পেরিয়ে সেই ধূলোবালির ঝড় খুব একটা প্রবেশ করতে পারেনা ক্রীতিক কুঞ্জের আলিশান বাড়িতে । ফ্রন্ট ইয়ার্ডে ছোট্ট লেকের পাশ ঘেষে যে গোলাকার বৈঠকখানা বাঁধানো সেখানেই চ্যালাপ্যালা নিয়ে দলের মিটিং এ ব্যস্ত সময় পার করছে রেজা। ঢাকা দক্ষিণের সহসভাপতির পদ লাভ করার পর থেকেই ভারী ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটে রেজার সময়কাল।
সত্যি বলতে এই বাড়ির পূর্ব পুরুষদের রাজনৈতিক কতৃত্ব আর নাম ভাঙিয়েই রেজার এতদূর আসা, সে হিসেবে প্রমান সরূপ এ বাড়ির সুবিশাল বৈঠকখানায় প্রায়শই বসে রেজার রাজনৈতিক আসর, ও যে এই বাড়িরই কুটুম সেটা বোঝাতে হবে তো সবাইকে।
আলোচনা তখন মাঝপথে,একের পর এক নিজেদের বক্তব্য পেশ করছে দলের সদস্যরা, ঠিক সে সময় বাগানে বিলাশে ঘেরা বিশাল গেইটটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে খুলে যেতেই সবার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো সেদিকে। কার্ড দিয়ে উবারের ভাড়া মিটিয়ে মাত্রই বাড়িতে প্রবেশ করেছে সানগ্লাস পরিহিত, লম্বা মতো এক অচেনা সুদর্শন যুবক। তার প্রতিটি পদধ্বনিতে উপচে পরা কতৃত্ব্য আর আভিজাত্য। হাটার তালে তালে চওড়া কাঁধটা ক্রমশ দুলে উঠছে,দেখে মনে হচ্ছে কোন গ্লোবাল সুপারস্টার মাত্রই গুরুত্বপূর্ণ শর্ট শেষ করে শুটিং সেট থেকে বেরিয়ে এসেছে। এহেন ম্যানলি হাটা চলা পেছন থেকে যে কেউ দেখলে নিস্প্রভ হয়ে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য।
অচেনা কাউকে এভাবে হুট করে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে রেজার একজন বিশ্বস্ত ভৃত্য এগিয়ে এসে বিরক্ত কন্ঠে শুধালো,
---- কে আপনি? কি চাই?
ক্রীতিক হাঁটার গতি ধীর করে গম্ভীর গলায় বললো,
---- গেট আউট।
লোকটা এবার চড়াও হয়ে এগিয়ে এসে ক্রীতিকের পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলে,
-----বলেছি তো, পরিচয় না দিয়ে ওদিকে যাওয়া যাবে না।
লোকটার কথা বলতে বাকি, চোখের সানগ্লাসটা খুলে ওর গালে সপাটে চ'ড় বসিয়ে দিতে দেরি হলোনা ক্রীতিকের। অকস্মাৎ শক্ত জিম করা হাতের চ'পেটা'ঘাতে তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গিয়ে শুকনো মাটিতে মুখ থুবড়ে পরলো লোকটা।
ক্রীতিক পুনরায় সানগ্লাসটা চোখে চড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
----- এটাই আমার পরিচয়।
বাড়ি বয়ে এসে, নিজের লোকের উপর হঠাৎ আ'ক্রমণ দেখে, রেগেমগে বেশ ক্ষী'প্র গতিতে এগিয়ে এলো রেজা, ক্রীতিকের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে গাঢ় গলায় বললো,
---- আমার লোকের গায়ে হাত তুলিস কে তুই? আমাকে চিনিস, আমি হলাম সহসভা...
রেজার কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ওর বাম গালে আঁচড়ে পরলো তীব্র ক'ষাঘা'ত। হঠাৎ থা'প্পড়ের তাল সামলাতে না পেরে রেজা নিজেও ঘুরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পরলো শুকনো চৌচির মাটিতে।
নিজেদের নেতাকে এমন বলিষ্ঠ থা'প্পড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখে, হকিস্টিক নিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়েও ভয়ার্ত ঢোক গিলে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো দলের অন্য ছেলে গুলো।
এদের কান্ডে তরাগ করে ক্রীতিকের মাথায় র'ক্ত উঠে গিয়েছে, পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাড়িটাকে চিড়িয়াখানার মতোই অদ্ভুত লেগেছে ওর নিকট। মস্তিষ্কে দমে থাকা সুপ্ত রা'গটা হুট করেই চড়াও হয়েছে চোখের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা রেজার উপর। আজ এই সহসভাপতির তো একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে ও, যেই ভাবা সেই কাজ ছেলে পেলেদের হাত থেকে হকিস্টিক ছি'নিয়ে এনে ইচ্ছে মতো রাগ ঝেড়েছে রেজার উপর। ক্রীতিক যখন হকিস্টিকের শ'ক্ত প্রহা'রে ফা'টিয়ে ফেলছিল রেজার শরীর।ঠিক তখনই চোখের সামনে হাজির হয় আনচান করতে থাকা চূর্ণ বিচূর্ণ একজোড়া অসহায় চোখ।
যা দেখে পুরোপুরি থেমে যায় ক্রীতিক, হাতের হকিস্টিকটা ছু'ড়ে ফেলে দেয় অনেক দূরে, তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরে নিজে আ'ঘাতপাপ্ত হয়ে অন্য একজনের আত্মাকে য'ন্ত্রনায় পু'ড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
বালাইষাট ক্রীতিক তাতে সফল হয়েছে, অরু ক'ষ্ট পেয়ে সদর দরজার সামনে হু'মড়ি খেয়ে পরে চিৎকার করে কাঁ'দছে।
মনে হচ্ছে ওরা ক্রীতিককে নয়, প্রতিটা আ'ঘাত অরুর হৃদয়ে করছে। শেষমেশ দ্বিতীয় গাড়িটা গেইট দিয়ে ঢুকতেই ঝামেলার অবসান হলো। গাড়ি থেকে একে একে নেমে এলো, সায়র,অর্ণব, এলিসা, ক্যাথলিন আর প্রত্যয়।
*****************************************
ক্রীতিক ভারী পা ফেলে সদর দরজার কাছাকাছি আসতেই, অরু এগিয়ে এসে ওর ক্ষ'তস্থানের দিকে হাত বাড়িয়ে ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
----- কেন করলেন এমনটা?আমাকে কাঁদাতে খুব ভালো লাগে তাইনা?
ক্রীতিক জবাব দেয়া তো দূরে থাক বরং অরু ছোঁয়ার আগেই, ওর থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে দাড়ায়।
ওর এহেন কান্ডে অরু বিস্মিত হয়ে বললো,
---- কি হয়েছে আপনার? আমাকে চিনতে পারছেন না?
অরুর প্রশ্নের বিপরীতে ক্রীতিক কোনোরূপ জবাব দেওয়ার আগেই ওদিক থেকে সায়র এগিয়ে আসতে আসতে সম্মোহনী হেসে বললো,
----- আরে মিস এলোকেশী, আবার দেখা হলো আমাদের।দেখলে তো কেমন তোমার টানে চলে এলাম।
কথায় কথায় সায়র খেয়ালই করেনি ক্রীতিক যে ওর দিকে তখন থেকে অ'গ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যখন খেয়াল করলো,তখন সঙ্গে সঙ্গে গলা খাদে নামিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে মেকি হেসে বললো,
----- না মানে তোমাদের দেশের মানুষের টানে,কি ভালো মানুষ তোমরা বাবাগো, আসার সঙ্গে সঙ্গে কেমন মা'রামা'রি দিয়ে আপ্যায়ন করে নিলে।তততাইনা জেকে?
ক্রীতিক একইভাবে ভাবে দাড়িয়ে আছে, ওদিকে এলিসা এগিয়ে এসে অরুকে দেখা মাত্রই চমকে উঠে বললো,
---- শরীরের এ'কি হাল হয়েছে তোমার অরু? খাওয়া দাওয়া করোনা নাকি? এভাবে শুকিয়ে গেলে কেন?
এলিসার কথার মাথায় ক্রীতিক সাবধানে আড় চোখে একবার অরুর আগাগোড়া পরখ করলো।
ওদিকে অরু কারও কথার কোনোরূপ উত্তর না দিয়েই চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে অন্দরমহলের দিকে চলে গেলো।
অরু চলে গেলে সায়র হতবিহ্বল মুখে সেদিকে তাকিয়ে বললো,
---- আরে এতোদূর থেকে এলাম, একটুখানি ওয়েলকাম না করে এভাবে দাড় করিয়ে রেখে দৌড়ে চলে গেলো?
এলিসা একপলক ক্রীতিককে পরখ করলো, যে সেই কখন থেকে একইভাবে অরুর যাওয়ার পানে চেয়ে আছে, আর কোনো দিকে নজর নেই বললেই চলে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সায়রের হাত ধরে ভেতরে যেতে এলিসা বলে,
---- স্বামী স্ত্রীর মান অভিমানের পালা চলছে এখানে, চল ভেতরে যাই, এমনিতেও আমাদের ওয়েলকাম করার মতো কেউ নেই।
সায়র ভ্রু কুঁচকে ভেতরে যেতে যেতে গম্ভীর মুখে বললো,
---- হ্যা তাতো থাকবেই না, বাড়ির মালিক কে দেখতে হবে না? এক নম্বরের হিটলার।
*****************************************
আলিশান মহলের বসার ঘরে কয়েক ইঞ্চি গা দাবিয়ে দেওয়া নরম গদিতে বসে আছে সবাই। ক্রীতিক সেই তখন থেকে পায়ের উপর পা তুলে স্মো'ক করছে। প্রত্যয় চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে পুরো বসার ঘর পর্যবেক্ষন করে মনেমনে বললো,
---- ক্রীতিক ভাই শুধু শুধু টেনে হিঁচড়ে দেশে নিয়ে এলো। যার জন্য দেশে আসলাম সেই তো নেই।
ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ক্রীতিক ডেকে বলে,
------ আমার কয়েকটা আর্জেন্ট বাইক লাগবে প্রত্যয়,কোন ব্র্যান্ডের গুলো ইউজ করি তাতো জানোই। বাইরের গ্যারেজটা পরিস্কার করার ব্যাবস্থা করো। আর হ্যা, আমার রুমে একটা গেমিং মনিটর পাঠিয়ে দিও মনে করে।
সায়র তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে চারিদিকে একঝলক চোখ ঘুরিয়ে বললো,
---- ভাই এটা বাড়ি নাকি রাজ প্রাসাদ?সবকিছুতেই কেমন আভিজাত্যের ছোঁয়া।
সায়রের তালেতাল মিলিয়ে এলিসাও বলে ওঠে,
---- রিয়েলি জেকে ইটস অ্যামেইজিং।ইউর ফ্যামিলি হ্যাজ ভেরি গুড টেস্ট।
ওদের থেকে কিছুটা দূরত্বে ডাইনিং এর কাছে দাঁড়িয়ে জাহানারা আর রুপা হা করে ওদের কথা গিলছে। একপর্যায়ে রুপা তব্দা খেয়ে বললো,
---- মা দেখো কি সুন্দর সুন্দর ছেলে সব বিদেশি।
জাহানারার চোখ চিকচিক করে উঠলো মেয়ের কথায়, তিনি আবেগ সামলাতে না পেরে এলিসাকে দেখিয়ে বললেন,
---- ছেলে বাদ দে ওই মেয়েটাকে দেখ, কি সুন্দর। এরকম একটা মেয়ে যদি আমার ব্যাটার বউ হতো?
জাহানারার মুখ থেকে কথাটা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি কথায় কথায় যেন অর্ণব এগিয়ে গিয়ে এলিসার ঠোঁটে একসাথে কয়েকটা চুমু খেলো, সবার সামনেই সেই চুমুতে আবার পুরোদস্তুর সায় দিলো এলিসা। যা দেখে এই মূহুর্তে জাহানারার ভীমড়ি খাওয়ার উপক্রম, তিনি মেয়ের হাত দুটো ধরে হাসফাস করে উঠে বললেন,
---- রুপারে আমাকে একটু ধর।
এতোক্ষণ যাবত সেভাবে খেয়াল না করলেও এখন নিজের শার্টের কলার নাড়াতে নাড়াতে জাহানারার উদ্দেশ্যে অর্ণব বললো,
---- এই যে খালা একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিন তো।বিডিতে অনেক গরম।
ক্যাথলিন একটু ইতস্তত কন্ঠে ভা'ঙা ভা'ঙা বাংলায় বললো,
---- আমিও।
জাহানারা একটু জোরপূর্বক হেসে বললো,
---- ইয়ে মানে বাবা'রা আমি আসলে এ বাড়ির খালা নই।
বাকি কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক প্রত্যয়কে উদ্দেশ্য করে বললো,
---- বাড়ির কেয়ারটেকার মোখলেস চাচাকে খবর দাও, আমার ফ্রেন্ডসরা যতদিন আছে উনি যাতে একজন ভালো বাঙালি রাধুনি রেখে দেয়। ওরা যাতে বাঙালী এক্সোটিক খাবার দাবার গুলো টেষ্ট করতে পারে, আর হ্যা এস সুন এস পসিবল এদেরকে বিদেয় করো,আমার মহিলা সার্ভেন্ট পছন্দ নয়।
ক্রীতিকের কথায় অপমানে থমথমে হয়ে গেলো জাহানারার মুখ। রুপা চুপসানো মুখে ঠোঁট উল্টে মিনমিনিয়ে বলে,
---- মা কি বলছে উনি? আমরা নাকি সার্ভেন্ট?
জাহানারা মেয়েকে আস্বস্ত করে বললেন,
---- চুপ কর তোর ফুপি ফিরে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ক্রীতিক এতোক্ষণে সোফা ছেড়ে উঠে সামনের কেভিনেটের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
-----এখানে আমার ফেবারিট কিছু শোপিচ ছিল, কোথায় গেলো সেগুলো?
জাহানারা তৎক্ষনাৎ নালিশ করার মতো গলা উঁচিয়ে অরুর ঘরের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
----- ওই যে, ওই মেয়েটা ভে'ঙেছে, শুধু এগুলো না আরও অনেক কিছু ভে'ঙেছে।এইটুকু মেয়ের সে'কি তেজ।
ক্রীতিক সবাইকে শুনিয়ে বিড়বিড়ালো,
----- আমার বউ, তেজ থাকা মাস্ট। প্রত্যয় শোনো।
এগিয়ে এসে প্রত্যয় শুধালো,
---- হ্যা ভাই?
আগের শোপিচ গুলোর মতোই সেম কিছু শোপিচ অর্ডার করে দিও, ওগুলো আমার অনেক ফেবারিট। আর হ্যা একজোড়া করে অর্ডার করে দিও। বলা তো যায়না মহারানীর আবার কখন মুড সুইং হয়।
প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সবকিছু নোট করে বললো,
----- ভাই এখন আসছি, অনেক দিন পর ফিরেছি বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।
ক্রীতিক ওর কাঁধের উপর হাত রেখে আস্বস্ত করে বললো,
---- বিলিভ মি,এখন ফিরে যাচ্ছো, তবে খুব শীঘ্রই স্ব-সম্মানে এই বাড়িতে পা রাখবে তুমি।
ক্রীতিকের কথায় স্মিত হেসে দ্রুত পদধ্বনিতে যায়গা ত্যাগ করলো প্রত্যয়।
*****************************************
বিকেলের কালো মেঘ রাত হতেই পরিনত হয়েছে প্রকান্ড ঝড়ে, ঝড়ের বেগে চারিদিকে প্রবল হাওয়া দিচ্ছে। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই,জেনারেটর জ্বালিয়ে সকলে মিলে রাতের খাবার খেতে বসেছে ওরা। অনেক বছর পরে এমন বৈশাখী ঝড়ের মাঝে টিমটিমে আলোয় টেবিলে হরেক রকমের বাঙালি খাবার দেখে উৎকন্ঠার সীমা নেই ওদের সবার।
ঘি মাখানো ভাত, আমের ডাল, কুচো চিংড়ি ভুনা,কাতলা মাছের ঝোল, মাংস কষা, শিল পাটায় তৈরি ভর্তা,লাউ পাতার বড়া আর শেষ পাতে দই মিষ্টি।
কতোটা আমোদ করেই না খাবার গুলো হাতে মেখে উপভোগ করছে ওরা।
একটু পর ফ্রেশ হয়ে এসে ওদের মাঝে চেয়ার টেনে বসলো ক্রীতিক, ওর চোখ দুটো আইপ্যাডে নিবদ্ধ। সেদিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে খেয়ালই করলো না যে ও অরুর পাশে বসেছে।
বিকেলের ঘটনার পরে এলিসাই অরুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাবার খেতে নিয়ে এসেছে, এলিসা বড় আপার মতো, তাই ওর কথা ফেলতে পারেনি অরুও সহসাই চলে এসছে ডাইনিং এ।
চিকন কোমল হাতে প্লেটের মধ্যে কেউ ভাত তুলে দিচ্ছে, ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হতেই আইপ্যাড থেকে চোখ সরালো ক্রীতিক। দেখলো অরু, ওর পাশে বসে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে পটু গিন্নিদের মতো করে ওর প্লেটে খাবার বেরে দিচ্ছে। লম্বা চুলের আড়াল থেকে অরুর ঢিলে হয়ে যাওয়া জামাটা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে অরু কতোটা শুকিয়ে গিয়েছে। ক্রীতিক সেদিকে একঝলক তাকিয়ে, হুট করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। ক্রীতিকের কান্ডে অরু আচমকা লাফিয়ে উঠলো,সায়র খেতে খেতে শুধালো,
----- কি হয়েছে?
ক্রীতিক বেসিন থেকে হাত ধুয়ে উপরে যেতে যেতে বললো,
----- নাথিং।
অর্ণব হাঁক ছেড়ে বললো,
----- খাবিনা?
সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে যেতে যেতে জবাব দিলো ক্রীতিক,
------খিদে নেই।
ক্রীতিক এভাবে উঠে যাওয়াতে অরু অ'পমানিত বোধ করলো খুব ,লোকটা শুধু শুধু ওর সাথে কেন এমন রাগ দেখাচ্ছে কিছুইতো মাথায় ঢুকছে না ওর।ক্রীতিক কি এমন ভুলের শা'স্তি দিচ্ছে ওকে?
সবাই এই মূহুর্তে ওর থমথমে মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে যায় অরু।
ওরা দুজন চলে যাওয়ার পরপরই সায়র বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠে বললো,
---- তোর বন্ধু চাইছেটা কি অর্ণব? যার জন্য ইউ এস এ বসে ড্রা'গ,ফ্রা'গ নিয়ে যা-তা অবস্থা করে ফেলেছিল, আর এখন চোখের সামনে পেয়েও তাকে না দেখার ভান করে এরিয়ে যাচ্ছে আশ্চর্য।
এলিসা ক্যাথলিনের প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বললো,
---- জেকে নিজের অভিমানটা প্রকাশ করতে পারছে না, কারন এসব ওর ধাঁচে নেই,যার ফলস্বরূপ অরুর সাথে এমন রু'ড বিহে'ভ করছে। আই থিংক সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।অরুই ঠিক করে ফেলবে।কারণ ওই পিচ্চি মেয়ে ছাড়া আর কারোর ধার ধারেনা ঘাড় ত্যাড়া ছেলেটা।
এলিসার কথা শুনে অর্ণব খেতে খেতে আমোদিত সুরে বললো,
----- জান, তুইতো দেখি জাতে মাতাল তালে ঠিক আছিস।
এলিসা এদিক ওদিক তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,
----- একবার রুমে চল, তারপর তোর হচ্ছে।
.
বাইরে ঝড়ের তান্ডব ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মেঘভেজা শীতল বাতাসে দুলদুল করছে চারিপাশ, অন্ধকারে দৌড়াতে দৌড়াতে চিলেকোঠা অবধি চলে এসেছে অরু। বিদ্যুৎ নেই, তারুউপর দমকা, তাই অন্ধকারটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। অরু যখন চিলেকোঠার ঘরের সামনে এসে হাঁটু ভে'ঙে বসে তাতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, তখনই নাকে এসে সুড়সুড়ি দিলো চেনা পরিচিত ম্যানলি স্যান্ডালউড পারফিউমের সুঘ্রাণ। এই সুঘ্রাণটা অরুর বেশ পরিচিত।
শুধু পরিচিত বললে ভুল হবে, একটা সময় এই সুঘ্রাণে মিলে মিশে একাকার হয়ে উঠেছিল ওর শরীর। প্রথম নারী সত্তার বিসর্জন হয়েছিল সেই সুঘ্রাণ যুক্ত পুরুষের হাতেই। আর এখন এই অন্ধকার চিলেকোঠায় আবারও স্যান্ডাল উড পারফিউমের সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ফোপাঁতে ফোপাঁতে এদিক ওদিক চোখ বোলাতেই অরু দেখলো মানুষটাকে।
অন্ধকারের মাঝে ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে নির্বিগ্নে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে ক্রীতিক। ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে অরু চট করে উঠে দাড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,
----- আমাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্যই বুঝি হাজার মাইল দূর থেকে বাড়ি বয়ে এসেছেন?
ক্রীতিক কোনো প্রকার জবাব দিলো না। ক্রীতিকের নিরবতায় অরুর মস্তিষ্কটা টগবগিয়ে উঠলো, ও দু কদম এগিয়ে এসে ঝাঁজালো কন্ঠে বললো,
---- কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তাইতো?
ক্রীতিক এবারও নিশ্চুপ।
অরু এবার পেছন থেকে ক্রীতিকের টিশার্টটা খা'মচে টেনে ধরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
----এতোই যদি অপছন্দ আমাকে, তাহলে ডিভোর্স দিয়ে দিলেই তো পারেন৷ শুধু শুধু কেন এভাবে ন'রক য'ন্ত্রতা দিচ্ছেন?
ক্রীতিক এবার সিগারেটটা পায়ে পিশে অরুর দিকে তাকিয়ে তাছ্যিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
---- কলিজায় সাহস টা খুব বেড়ে গিয়েছে দেখছি? এখনই ডিভোর্স চাওয়া শিখে গেছিস? "ডিভোর্স" শব্দটা উচ্চারণ করতে একবারও বুক কাঁপলো না তোর? এই কথার জন্য তোর কি হাল করবো আমি সেটা একবারও কল্পনা করেছিস?
ক্রীতিকের শান্ত মসৃণ অথচ প্রান না'শকারী হু'মকির ন্যায় ধা'রালো কথায় শুকনো ঢোক গিলে দু কদম পিছিয়ে গেলো অরু।
পেছাতে পেছাতে নীড়হারা ব্যার্থ পাখির ন্যায় আহত কন্ঠে বললো,
----- আপনাকে ভালোবাসাটা যে এতো য'ন্ত্রনার তা আগে জানা ছিলোনা আমার।
ক্রীতিক অরুর দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বললো,
---- এতোটুকুতেই হাঁপিয়ে উঠেছিস? সারাজীবন আমার সাথে থাকবি কি করে তুই?
অরু ঠোঁট উল্টে অভিমানি কন্ঠে শুধায়,
----- এতোদিন দূরে থেকে পো'ড়াতেন আর এখন কাছে এসে পো'ড়াচ্ছেন কেন করছেন এমন? একটু ভালো বাসুন না? আমি আপনার একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো ছটফট করছি, আপনিকি বুঝতে পারেন না?
ক্রীতিক এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এগিয়ে অরুর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। দমকা হাওয়ায় অরুর লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। খানিক বাদে বাদে উড়ে গিয়ে ঠায় নিচ্ছে ক্রীতিকের চওড়া বুকে। অরুকে অবাক করে দিয়ে ক্রীতিক ওর চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ বন্ধ করে তাতে নিঃশব্দে নাক ছোঁয়ালো,অতঃপর মুঠো ভর্তি অরুর চুলের সুবাসে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো ক্রীতিক। দুজনার নিরবতায় কিছুক্ষণ সেভাবেই অতিবাহিত হলো।
পরমূহুর্তেই শুকিয়ে যাওয়ার দরুন অরুর বেড়িয়ে আসা কলার বোন গুলোর দিকে নজর পরতেই শক্ত হয়ে এলো ক্রীতিকের চোয়াল। ও তৎক্ষনাৎ অরুকে ধা'ক্কা মে'রে দূরে সরিয়ে দিয়ে গটগটিয়ে নিচে যেতে যেতে বললো,
---- ইউ ডিজার্ভ ইট।
*****************************************
কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভেঙেছে সায়রের। সকাল সকাল ঘুম ভাঙার অভ্যেস না থাকলেও ইউ এস এ, বাংলাদেশ সময়ের তারতম্যের কারণে রাতে সেভাবে ঘুম হয়নি ওর। রাতে ঘুম না হলেও দুপুরের দিকে হয়তো দেখা যাবে ঘুমের জন্য চোখের পাতা খুলে রাখাই দায় হয়ে পরেছে। তাই ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে সকাল সকালই একটু খানি লেকের আশেপাশে হাটতে বেরিয়েছে সায়র।
পেছনে অবশ্য ট্র্যাক স্যুট পরে ক্রীতিক আর অর্ণব ও বেরিয়েছে, তবে ওদেরকে পেছনে ফেলেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে সায়র।
রাতে ঝড়ের তান্ডবে পুরো ব্যাক ইয়ার্ড ভরে গিয়েছে কাঁচা আমে। মহলের চারপাশ থেকে সুক্ষ হাতে সেই আম কুড়াচ্ছে বাড়ির কেয়ারটেকার মোখলেস চাচা। সেখানটায় মোড়া পেতে বসে আছে এলিসা আর ক্যাথলিন। ক্যাথলিন ডিএসএলআর এর ক্লিকে কর্মরত মোখলেস চাচার ছবি ধারণ করায় ব্যস্ত। আর এলিসা এটা ওটা প্রশ্ন করায়। মোখলেস চাচাও হাত চালাতে চালাতে বেশ উৎসুক হয়ে উত্তর দিচ্ছেন এলিসার প্রশ্নের।
সায়র হাঁটতে হাঁটতে গেইটের কাছে এগিয়ে এসে গেইট খুলতে যাবে, তার আগেই কেউ একজন গেইট খুলে হুরমুরিয়ে প্রবেশ করে বাড়ির ভেতরে, হুট করে প্রবেশ করায় দুজনার একজনও ঠিক মতো ঠাওর করতে পারেনি, অগত্যাই টাইম টেবিল মিলে যাওয়ায় আগন্তুক তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পরলো সায়রের কোলে।
সায়রও সিনেমার হিরোদের মতোই দক্ষ হাতে ধরে ফেললো তাকে। ঠিক যেন বল নাচের সেই বিখ্যাত পোজ। আগন্তুকের বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে যাওয়া মার্বেলের মতো চোখের দিকে তাকিয়ে যেন কবি বনে গেলো সায়র, হুট করেই সুর ধরে বলে উঠলো,
----- এই কাক ডাকা ভোরে, পথ ভুলে আমার মনের অভ্যায়রন্যে এসে উষ্ঠা খেয়ে পরে গেলে,কে তুমি অবলা নারী?
সায়রের কথায় বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো নীলিমা , তরিঘরি করে পা'গল লোকটার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে, জামা কাপড় ঠিক করতে করতে নীলিমা বললো,
----- কান খুলে শুনুন ব'দমা'শ পুরুষ, আমি মোটেও অবলা নারী নই। আর না আমি পথ ভুলে কোথাও উষ্ঠা খেয়েছি। বরঞ্চ আপনিই এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহল্লায় নতুন মনে হচ্ছে, তাই নীলিমাকে চেনেন না। ইভ'টিজিং করতে আসলে না?আব্বাজানকে বলে এমন ক্যালানী খাওয়াবো,যে সারা জীবনের জন্য এই মহল্লার ঠিকানাই ভুলে যাবেন,হুহ।
গড়গড়িয়ে কথাগুলো শেষ করে,একটা মুখ ঝামটি দিয়ে চলে গেলো নীলিমা।
সায়র ঠোঁট উল্টে ক্যাবলা কান্তের মতো বিড়বিড়িয়ে বললো,
---- আশ্চর্য বাঙালি মেয়েরা এতো সেনসিটিভ কেন? কি এমন বললাম? মেয়ে তো নয় যেনো ধানিলঙ্কা, আব্বাজানের ভ'য় দেখায়। আজিব!
এতোক্ষনে ক্রীতিক আর অর্ণব ও এগিয়ে এসেছে গেইটের কাছে। সায়রকে এভাবে একা-একা কথা বলতে দেখে অর্ণব ওর কাঁধে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বললো,
----- কিরে ঠিক আছিস?
সায়র ঠোঁট কামড়ে বললো,
-----দোস্ত মেয়েটাকে দেখেছিস, পুরাই রাগিণী।
অর্ণব ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
---- জেকে অরুতে আসক্ত, আর আমার এলি আছে, তাই আমাদের মেয়ে দেখিয়ে লাভ নেই দোস্ত।
সায়র মাথা চুলকে শুকনো মুখে বলে,
----- হ্যা ঠিকই তো তোমাদের বিয়ে বাসর সব শেষ, আর আমি এখনো সিঙ্গেল।
সায়রের কথার পাছে অর্ণব আবারও ভুল ধরে বললো,
---- এবারও মিস্টেক আমার বিয়ে হয়নি, আর জেকের বাসর।
সায়র চোখ ছোট ছোট করে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
---- আমি ওকে বিশ্বাস করিনা দোস্ত । ও যা অধৈর্য, সুযোগ পেলে গাড়ির মধ্যে বাসর সেরে ফেলতেও দু'মিনিট ভাববে না।
সায়রের কথায় ক্রীতিক আচমকা বিষম খেলো। কাশতে কাশতে বললো,
----- আমাকে নিয়ে গবেষণাটা এবার বন্ধ করবি তোরা?
ক্রীতিকের নাজেহাল অবস্থা দেখে সায়র অর্ণব ওর দিকে তীক্ষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে একই সুরে বলে উঠলো,
----- তুই কি আসলেই গাড়িতে.......
ওদের কথা বলার আর কোনো কোনোরূপ ফুরসত না দিয়ে হনহনিয়ে গেইটের বাইরে চলে গেলো ক্রীতিক।
ক্রীতিক চলে যেতেই, সায়র আর অর্ণব একজন আরেকজনার দিকে তাকিয়ে আপসোসের সুরে বললো,
----- হাহ,জেকে শালা সব কিছুতেই ফার্স্ট।
*****************************************
ক্রীতিক গেইট ছাড়িয়ে বাইরে বেরোতেই দেখতে পেলো একটা সাদা টয়োটাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ক্রীতিক কুঞ্জের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অমিত।
একসাথে একই ভার্সিটিতে পড়ার সুবাদে প্রথম দেখাতেই অমিতকে চিনতে পারলো ও। তাই সহসা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো ক্রীতিক,
----- অমিত আরিয়ান রাইট?
অমিত তরিঘরি করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ক্রীতিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-----চিনতে পেরেছো তাহলে?
ক্রীতিক একটু ইতস্তত করে হাত মিলিয়ে বললো,
----- তা আমার বাড়ির সামনে কি করছো?
অমিত মৃদু হেসে বললো,
----- তোমার বোনের জন্য ওয়েট করছিলাম, ও তো বাংলা একাডেমিতে যায় প্রতিদিন, তাই ভাবলাম আমি যেহেতু এই গলি দিয়ে যাচ্ছি ওকেও নিয়ে যাই ।
ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্জিত করে অবাক হয়ে বললো,
---- আমার বোন মানে?
---- কেন অরোরা তোমার বোন না?
ওর কথায় পেছন থেকে সায়র ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,
---- গেলো!
অমিত একটু ঝুঁকে মাথা কাত করে শুধালো,
---- কি গেলো?
অমিতের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে ক্রীতিকের। কোনো মতে হাতদুটো মুঠি বদ্ধ রেখে নিজেকে সংবরণ করে, দাঁতে দাঁত চেপে ও বললো,
----- অরোরা আজকে যাবেনা, শরীর ভালো নেই ওর, তুমি যেতে পারো।
অমিত আর কিইবা করবে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করে।
অমিতের গাড়িটা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক কাউকে কল দিয়ে বললো,
----- ক্রীতিক কুঞ্জের সীমানা ছাড়ানোর আগেই সাদা টয়োটার টায়ার বরাবর গু'লি করে দাও। যাতে করে সারা জীবনে আর এই বাড়ির সামনে দাড়ানোর সাহস না পায় ওই গাড়ি।
এতোক্ষণ যাবত সবকিছুই পেছনে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষন করছিল সায়র আর অর্ণব। ক্রীতিকের শেষ কথাগুলো শুনে সায়র অর্ণবের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
---- দোস্ত তোকে বলেছিলাম না সকাল থেকেই বাম চোখটা কেমন লাফাচ্ছে, দেখলি তো?
অর্ণব চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
---- তোর জীবনে নারী নামক প্যারার এন্ট্রি ঘটেছে ওই জন্য লাফিয়েছে। এখানকার ঘটনার জন্য নয়, তাই ভুলভাল যুক্তি প্রদান করা বন্ধ কর।নয়তো জেকে কে বলে তোর অন্য চোখ লাফানোর ব্যাবস্থা করছি আমি।
সায়র বিস্ময়ে ভ্রু কুঞ্জিত করে শুধালো
------কি বলবি?
----- বলবো তুই আবারও অরুর নাম মুখে নিয়েছিস।।
কথাটা শেষ করেই কপট হাসিতে প্রসারিত হলো অর্ণবের ঠোঁট।
ওদিকে সায়র অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রাগে কটমটিয়ে উঠে বিড়বিড়ালো,
----- শা'লা মীরজাফর।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ৪০
গোধূলি বিকেলে সূর্যের ঝাঁ ঝাঁ উত্তাপ কমে এসেছে কিছুটা। এখন পর্যন্ত পায়ের তলার মাটি লোহার তাওয়ার মতোই তেতে আছে।
চারিদিক নিস্তব্ধ, দুপুরের ভাতঘুমে বিভোর পুরো মহল্লা। শুনশান নিরবতার মাঝেই গলির মোড় থেকে ক্ষনে ক্ষনে ভেসে আসছে নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ।
ভেজা টিস্যু দিয়ে কপালের অর্হনিশ ঘাম টুকু মুছে মাত্রই ক্রীতিক কুঞ্জের কলিং বেলে হাত চালালো প্রত্যয়।
আজ আর কোনো ফর্মাল পোশাকে নয়, মেরুন টিশার্ট আর ব্ল্যাক ডেনিমে হাজির হয়েছে সে। কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ। বাংলাদেশে আসার দরুন। আমেরিকার আবহাওয়ার সাথে মিলিয়ে ডাই করা হালকা বাদামি চুলগুলোতে রুক্ষতা স্পষ্ট দৃশ্যমান।
চোখের চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে, দরজার বাইরে দাড়িয়েই নিজের পছন্দের স্টাইলিশ চুলগুলোতে হাত বোলালো প্রত্যয়, অতঃপর অপেক্ষারত হলো সদর দরজা খোলার।এই উত্তপ্ত বিকেলে কিছুতেই ক্রীতিক কুঞ্জে আসার ইচ্ছে ছিলো না প্রত্যয়ের। কিন্তু ক্রীতিকের জরুরি তলবে না এসে আর উপায় কি?
ক্রীতিকের সিদ্ধান্ত এখন থেকে জেকে গ্রুপের বাংলাদেশি ব্র্যাঞ্চে নিয়মিত বসবে সে। তাই কোম্পানির প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস গুলো নিয়েই এই ভর দুপুরে ছুটে আসা। ক্রীতিক মালিক মানুষ, সে চাইলেই হাজার দিন দায়িত্ব ফেলে রাখতে পারে। কিন্তু প্রত্যয়ের তো আর সেই সুযোগ নেই। পুরো কোম্পানির দ্বায়িত্ব তার কাঁধে, বাংলাদেশ হোক কিংবা বিদেশ অফিস তো তাকে নিয়মিতই করতে হয়। তারউপর ক্রীতিকের ব্যক্তিগত একটা সাইড ও পুরোপুরি প্রত্যয়ের দেখভাল করতে হয়, সে হিসেবে প্রত্যয় ভিষণ ব্যস্ত একজন মানুষ।
নিজের হাজার রকম দ্বায়িত্বের কথা চিন্তা করতে করতে আবারও ভেজা টিস্যু দিয়ে কপাল মুছলো প্রত্যয়। ঠিক তখনই ঝনাৎ করে খুলে গেলো সদর দরজা। নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে প্রত্যয় সামনে তাকাতেই দেখলো কালো চুড়িদার পরিহিত অনুকে। যে এই মূহুর্তে প্রত্যয়কে দেখে চোখদুটো রসগোল্লা বানিয়ে দাড়িয়ে আছে। অনুর চোখে চোখ পরার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো ছোট ছোট করে ফেললো প্রত্যয়। ধীর পায়ে সামনে এগোতে এগোতে ধা'রালো গলায় কথা ছু'ড়লো তৎক্ষনাৎ,
---- তোমার না বিয়ে হয়ে গিয়েছে কোন ভুড়ি ওয়ালা আড়ৎদারের সাথে? খুব বড়লোক,পুরান ঢাকার নামকরা ব্যবসায়ী,তোমাকে অনেক ভালোবাসে, বাসর করাও শেষ। তাহলে এখানে কি করছো?
প্রত্যয়ের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে ঢকাত করে শুষ্ক গিলে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো অনু। অনুর পদচারণ অনুসরণ করে প্রত্যয় এগোতে এগোতে পুনরায় বললো,
----কোথায় সেই গোঁফধারী সুদর্শন পুরুষ? আমিও একটু দেখি আমার অনুকে কে দিলো এতো সুখ? বিছানায় পারফর্মেন্স কেমন ছিল সেটাও তো জানতে হয়। আমার জিনিসকে আমার আগেই উপভোগ করেছে, ভুড়িওয়ালার লাক আছে বলতে হয়। আমার অপরিচিতা যে ভুঁড়িতে এতো শান্তি খুঁজে পায়, তা জানলে এতো কষ্টে জিম করে আর বডি বানাতাম না, ট্রাস্ট মি।
প্রত্যয়ের উল্টাপাল্টা কথা শুনে অনু মনেমনে বললো,
---- রাগের চোটে ওনার মাথার তাড় ছি'ড়ে গিয়েছে, এক্ষুনি আইসব্যাগ দিতে হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, অনু ছুটে গিয়ে ফ্রীজ থেকে আইস ব্যাগটা এনে প্রত্যয়ের মাথার উপর রেখে দিলো ভোঁ দৌড়। অনু ভয়ের চোটে গা ঢাকা দিতে চাইছে ব্যাপারটা বুঝে আসতেই অনুর পেছন পেছন ছুট লাগালো প্রত্যয়, ওকে তাড়া করতে করতে চেঁচিয়ে প্রত্যয় বললো,
---- অনুর বাচ্চা, তোমাকে আমি ছাড়বো না। আমাকে মিথ্যে বলার শা'স্তি সরূপ মুখ সেলাই করে দেবো তোমার। তারপর তোমায় দেখিয়ে দেখিয়ে আন্টিমার্কা মহিলাদের সাথে ফ্লার্ট করবো, তখন বুঝবে কেমন লাগে।
ধা'ন্দাবাজ মহিলা দাঁড়াও বলছি।
কে শোনে কার কথা অনু ছুটছে তো ছুটছেই। একতলা পেরিয়ে দোতলা, দোতলার করিডোর পেরিয়ে তিনতলা তারপর সোজা ছাঁদ। প্রত্যয়ও দমবার পাত্র নয়, এতোগুলো মিথ্যে বলার শাস্তি আজ অনুকে দিয়েই ছাড়বে ও। তাইতো অনুর পিছনে ছুটতে ছুটতে ছাঁদে চলে আসা।
দৌড়ে ছাঁদের শেষ মাথায় এসে অকস্মাৎ থেমে গেলো অনুর পা। কোনো মতে পাঁচিলে হাত দিয়ে নিজেকে সামলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলো অনু। দেখলো ওর থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাত ভর করে হাঁপাচ্ছে প্রত্যয়। কয়েক সেকেন্ড হাঁপিয়ে, নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে, অনুর দিকে তাকিয়ে রা'গে গজগজিয়ে উঠে প্রত্যয় বললো,
---- স্কুলে কি দৌড়ের কম্পিটিশন করতে নাকি? বাপরে বাপ।
অনু মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
--- আপনি কেন তাড়া করছেন আমাকে? ওই জন্যই তো দৌড়ালাম।
প্রত্যয় দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে অনুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
--- শা'স্তি দেবো বলে। তোমার সাহস কি করে হয়, আমাকে এতোগুলা মিথ্যে কথা বলার? তোমার কি মনে হয়? তুমি বলেছো আর আমি তোমার কথা বিশ্বাস করে বসে আছি? স্টুপিড মেয়ে। সবসময় প্রশ্রয় দিয়েছি, কথার প্রাধান্য দিয়েছি, তাই বলে যা খুশি তাই বলবে? আমার ইমোশন নিয়ে খেলবে? স্পিক আপ?
অনুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো প্রত্যয়। প্রত্যয় প্রচন্ড রেগে আছে, চোখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি অনুকে চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেবে এই ভদ্র,সভ্য,ঠান্ডা মেজাজের ছেলেটা।
তারউপর মিথ্যে বলার দরুন অনুকেই দোষারোপ করছে বারবার , তাই এইমূহুর্তে ভয়ে কুকরে গিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে অনু।
প্রত্যয় কা'ন্নারত অনুর দিকে তাকিয়ে রাগে ফোসফাস করতে করতে বললো,
---- তোমাকে আমি ম্যাচিউর ভাবতাম অনু।সবসময় বিশ্বাস ছিল তুমি সবকিছু ম্যাচিউরিটি দিয়ে হ্যান্ডেল করবে, আমাদের সম্পর্কটাকেও।কিন্তু না, একটুখানি সাময়িক টানাপোড়েনে তুমি আমাকে জাস্ট ওয়ান টু তে দূরে সরিয়ে দিলে। ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের মিথ্যে বিয়ের কাহিনী শোনালে। তারপর বললে আমাকে ভুলে যান, হাউ সিল্যি।এটাকি বাংলা সিনেমা পেয়েছো?
অনু ফোঁপাতে ফোপাঁতে সামান্য গলা উঁচিয়ে বলে,
--- আআসলে পরিস্থিতি।
---ফা'ক ইউর পরিস্থিতি। ভালো কিভাবে বাসতে হয় নিজের বোনকে দেখে শেখো। ক্রীতিক ভাই এসেছে শব্দে কথা বলাতো দূরে থাক অভিমানে ফিরেও তাকাচ্ছে না অরুর দিকে। তবুও চুপচাপ সহ্য করছে মেয়েটা।কেন জানো? কারণ ও সত্যিকারের ভালোবেসেছে। সত্যিকারের ভালোবাসায় পরিস্থিতির দোহাই দেওয়াটা একটা অজুহাত মাত্র। ভালোবাসায় যতটা সুখ ঠিক ততটাই য'ন্ত্রনা, এই মাত্রাতিরিক্ত সুখ আর মাত্রাতিরিক্ত য'ন্ত্রটা দুটোকে সয়ে নিতে পারলে তবেই না তুমি সত্যিকারের ভালোবেসেছো।
কিন্তু আপসোস, তুমি এসবের কিছুই জানোনা,কিছুই বোঝোনা, শুধু একটু আবেগের বশে বলে দিয়েছো সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। আরে একসাথে থাকাটা কি এতোই সোজা? ফা'ক ইওর ম্যাচিউরিটি।
রেগেমেগে কথা শেষ করে হনহনিয়ে পিছু হাটে প্রত্যয়। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ছুটে এসে ওকে শক্ত করে জাপ্টে ধরলো অনু। অনুর কান্নারত তীব্র শরীরের ঝাঁকুনি পুরোপুরি অনুভব করতে পারছে প্রত্যয়। বৈশাখী বিকেলের উত্তাপের মাঝেও তৎক্ষনাৎ একটা নরম ভেজা অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো প্রত্যয়ের হৃদয় মন।
এভাবে কিছুটা সময় অতিবাহিত হলে, চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ রেখে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে নরম স্বরে প্রত্যয় বলে,
---- সরি অনু, মাথা ঠিক ছিলোনা তাই তোমাকে একটু বেশিই বকে ফেলেছি।কেঁদোনা।
অনু প্রত্যয়ের পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
---- আমিই সরি, খুব সরি, কোনোকিছু ভাবনা চিন্তা না করে, আপনার সাথে নিজের সমস্যা শেয়ার না করে, এভাবে এতোগুলা মিথ্যে কথা বলে আপনাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অজুহাত তৈরি করা আমার মোটেই ঠিক হয়নি। আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না?শুধু একবার,প্লিইইজ।
---- যেখানে তুমি আমার কাছে অ'পরাধীই নও,সেখানে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে অপরিচিতা?
অনু এবার চোখ তুলে তাকায় প্রত্যয়ের পানে, বোঝার চেষ্টা করে ওর কথার সারমর্ম। প্রত্যয় ঘুরে দাঁড়িয়ে অনুর চোখ মুছিয়ে দেয়, অতঃপর হিসহিসিয়ে শুধায়,
---- ক্যান ইউ ফিল ইট ডিয়ার?
অনু হেঁচকি টেনে বলে কি?
---- কি ফিল করবো?
প্রত্যয় একই সুরে বলে,
---- মাই লাভ। ইউ ফল ইন লাভ উইথ মি, হার্ডলি, শেইম লেসলি,ডেস্পারেটলি এন্ড আনকন্সিয়াসলি।
প্রত্যয়ের কথায় অনু লজ্জায় মিয়িয়ে যায়। লতানো তরুর ন্যায় মাথাটা নুয়িয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ। প্রত্যয় অনুর চিবুকে হাত দিয়ে মাথাটা একটু তুলে বলে,
---- আর যদি কখনো কিছু লুকিয়েছো, তাহলে সত্যি সত্যি তোমাকে আর ক্ষমা করবো না আমি।
অনু হেঁচকি তুলতে তুলতে না সূচক মাথা নাড়ালে, প্রত্যয় ওকে দু'হাতে বাহুডোরে আগলে ধরে, তপ্ত গমগমে চমৎকার আওয়াজে বলে,
-----আমি তোমার হৃদয়ের গোপন থেকে গোপনীয় কথাটাও জানতে চাই অনু।
হতে চাই তোমার সুখের সন্ধি আর দুঃখের পিছুটান। আমার নীরে তুমি সর্বক্ষন ভালোবাসায় অম্লান।
বুড়িগঙ্গা পারের নাতিশীতোষ্ণ বাতাসের সাথে সাথে তখনও ভেসে আসছিল বেসুরো দুটো গানের লাইন,
"আমার বেঁচে থাকার প্রার্থনাতে
বৃদ্ধ হতে চাই তোমার সাথে,
অনেক খুঁজে তোমায়, নিলাম চিনে,
ভালোবাসার এই দিনে.... "
****************************************
আলিশান মহলের সবচেয়ে সুন্দর আকর্ষনীয় আর বড় ঘরটায় থাকেন আজমেরী শেখ। এটা মূলত ক্রীতিকের বাবা জামশেদ জায়ানের ঘর ছিল। স্বামীর সূত্রেই এই ঘরের উত্তরাধিকারী এখন তিনি।
আপাতত এই ঘরের কর্ণারে যে দামি মখমলের ডিভানগুলো রয়েছে, তাতেই মুখোমুখি হয়ে বসে আছে আজমেরী শেখ আর জায়ান ক্রীতিক।
ক্রীতিক সেই তখন থেকে বসে বসে পায়ের উপর পা রেখে দোলাচ্ছে। দু আঙুল দিয়ে বারবার ঘসে যাচ্ছে নিজের কপাল। মূর্তিমান ক্রীতিকের দিকেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন আজমেরী। ক্রীতিক দেশে আসার পরে এটাই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ।
ক্রীতিক কি বলতে এসেছে, কিংবা কি বলবে সেসবের জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে নিজেই গভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন আজমেরী শেখ ,
----- এই ঘরে কেন এসেছো, কি চাই?
ক্রীতিক নিজের বন্ধ চোখ জোড়া অকস্মাৎ খুলে ফেললো, অতঃপর শান্ত মসৃণ গলায় বললো,
---- কি চাই সেটা আপনি ভালো করেই জানেন, তাহলে কেন করলেন এটা? কোন সাহসে অরুকে আমার কাছ থেকে কে'ড়ে নিয়ে এলেন? অরু ছাড়া পুরো দুনিয়াতে এখন আর আমার কেউ নেই।আপনি সেটা ভালোভাবে জানতেন, তবুও আমায় দ্বিতীয়বার একাকিত্বের য'ন্ত্রনায় ভোগালেন কেন? আন্সার মি?
আজমেরী থমথমে গলায় বললেন,
---- ভদ্রভাবে কথা বলো, আমি তোমার গুরুজন হই।
ক্রীতিক এক পা অন্য পায়ের উপর তুলে ডিভানে গা ছড়িয়ে বসে বললো,
--- হ্যা তা হোন বটে, শাশুড়ী মা বলে কথা।
---- আমি কারও শাশুড়ী নই।
ক্রীতিক একটু তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,
---- আপনি মানেন বা না মানেন, অরু আমার। আপনি ভালো করেই জানতেন, ইউ এস এ টু বিডি কেন, পৃথিবীর মধ্যে যে কোনো গর্তে গিয়ে লুকালেও অরুকে আমি ঠিক খুজে বের করতাম। শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট করলেন।
আজমেরী শেখ দমে যাওয়ার পাত্রী নন, যথেষ্ট সুকৌশলী মহিলা তিনি। তাই এবার চোয়াল শক্ত করে ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে আজমেরী বললেন,
---- আমি যা করেছি, তোমার আর অরুর মান সম্মান বাঁচানোর জন্যই করেছি।একবার ভেবে দেখেছো, এ বাড়ির একমাত্র ছোট সাহেব তার সৎ বোনকে বিয়ে করেছে একথা জানাজানি হলে, তোমার পরিবারের এতো বছরের ঐতিহ্য, নামদাম, আভিজাত্য কোথায় গিয়ে দাড়াবে?
সমাজের মানুষ তোমার চরিত্রে আঙুল তুলবে, সেই সাথে আমার ওইটুকুনি মেয়ের দিকেও।
আজমেরী শেখের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের টি টেবিলে পা'ঞ্চ মে'রে গ'র্জে উঠলো ক্রীতিক,
---- আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট দিস ফা''কিং সমাজ। আমার আত্মা যাকে চেয়েছে আমি তাকিয়েই বিয়ে করেছি,তাকেই ভালোবেসেছি আর তার সাথেই বেড শেয়ার করেছি।
দেখি কোন সমাজের সাহস আছে আমার অরুকে কটাক্ষ করার। যেই সমাজ অরুর কিংবা আমার ফিলিংসের দিকে আঙুল তুলবে সেই সমাজের নিয়মই ভে'ঙে দেবো আমি। তাতে যদি আমি জায়ান ক্রীতিক শেষ হয়ে যাই তবে তাই হবো, তবুও অরুকে আমি এই জনমে ছাড়ছি না।
আজমেরী শেখের মুখের উপরে একনাগাড়ে অনেক গুলো কথা ছু'ড়ে মে'রে,গটগটিয়ে বেরিয়ে যায় ক্রীতিক। যাওয়ার আগে পিছু
ডেকে নির্লিপ্ত কন্ঠে আজমেরী বলেন,
----- যেদিন সন্তানের বাবা হবে,সেদিন ঠিক বুঝবে, আমি কেন এতোসব করেছি।
ক্রীতিক না ঘুরেই দাঁড়িয়ে বললো,
---- আমার আর আপনার মেয়ের ডিএনএ আর যাই হোক দু''শ্চরিত্রের অধিকারী হবেনা। এজ এ প্যারেন্ট, দ্যাটস এনাফ ফর মি।
পরক্ষণেই কি ভেবে যেন ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রীতিক বলে,
---- আর হ্যা, অনু প্রত্যয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত, আপনার ভাইয়ের পরিবার কিছুতেই যাতে ক্রীতিক কুঞ্জ ত্যাগ না করে। পুরো বিয়ের অকেশনে তারা আমার স্পেশাল গেস্ট।
ক্রীতিক যখন কথাগুলো বলছিল তখন ওর ঠোঁট ভে'ঙে বেড়িয়ে আসছিল সামান্য রহস্যময়ী ক্রুর হাসি।
ক্রীতিক স্থান ত্যাগ করে চলে যেতেই তীরের ছিলার মতো এক ভ্রু উঁচিয়ে,আজমেরী শেখ কটমটিয়ে বললেন,
---- কিয়ারা রোজারিও যে কি খেয়ে এমন ত্যাঁদর ছেলে জন্ম দিয়েছিল কে জানে? এ নিশ্চয়ই ব্রিটিশদের বংশ ভূত।
ক্রীতিকের উপর রাগ ঝাড়তে গিয়ে একটা কথা মিস করে গিয়েছে আজমেরী শেখ, মাত্র সেটা মস্তিষ্কে বিট করতেই, তিনি অস্ফুটে বললেন,
---- অনু আর প্রত্যয়ের বিয়ে মানে? কি বললো এই ত্যাঁদর ছেলে? আমার মেয়ে গুলো কি ওর খেলার পুতুল নাকি? না না এক্ষুনি ওর এসব কৌশলী পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে।
আজমেরী শেখ রে''গেমেগে ডিভান ছাড়লেন, তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলেন ক্রীতিককে অনুসরণ করে।
করিডোরের এমাথা থেকে ওমাথা কোথাও ক্রীতিক নেই। অগত্যাই হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গিয়ে দাড়িয়ে পরলেন তিনি, আজমেরী শেখ যেখানে দাড়িয়ে ছিলেন, তারপাশে সিঁড়ি ঘরের ওঠার রাস্তা। ঠিক সেখান থেকেই কিছু অযাচিত আওয়াজ কর্ণকূহরে পৌঁছালে, তরিৎ গতিতে চোখ ঘোরালেন তিনি, মরচে যাওয়া আবছা আলোতে দেখেলেন, অন্ধকার সিঁড়িতে বসেবসে ফোপাঁচ্ছে অনু,পাশেই বসে আছে প্রত্যয়। অনু কাঁদছে দেখে বারংবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রত্যয়। অনুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে আওয়াজ ভেসে এলো প্রত্যয়ের দিক থেকে,
----- এতো কাঁদে কেউ? মাথা ব্যাথা করবে তো জান। আর বকবো না সরি তো। এই যে দেখো কানে ধরছি, ঘাট হয়েছে আমার। আমার অনু, আমার ময়না পাখি আর কাঁদেনা।
পরক্ষনেই আবারও নিজের বলিষ্ঠ হাতের পিঠ দিয়ে অনুর দু কপোল মুছে দিলো প্রত্যয়।
আজমেরী শেখ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে, একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে অনু আর প্রত্যয়ের দৃষ্টিগোচর হবার আগেই দ্রুত চলে এলেন সেখান থেকে।
*****************************************
তখন মাঝরাত, বাইরে পূর্নিমা,রাতের আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোতে ভেসে যাচ্ছে ক্রীতিক কুঞ্জের সুবিশাল মহল। রুপার বার্তায় মাত্রই রুম থেকে বেরিয়েছে অরু। মা নাকি ওকে ডেকে পাঠিয়েছে। গত দুদিনে মামির উপদ্রপ কমেছে খানিকটা, সে আপাতত রেজাকে নিয়ে হসপিটালে রাত্রিযাপন করছে। আর রুপা মামির মতো এতো ভেজাল করেনা, তাই রুপাকে খুব বেশি বিরক্তও লাগেনা অরুর। ওই জন্যই তো রুপার কথামতো সহসা রওনা হয়েছে মায়ের ঘরের দিকে।
কিছুদুর গিয়ে করিডোরের মাঝ পথেই আটকে গেলো অরুর পা। দেখলো অন্যপাশ দিয়ে অনুও বের হয়ে এসেছে। অনুকে শুকনো মুখে এগিয়ে আসতে দেখে অরু তারাহুরো করে ওর কাছে গিয়ে শুধালো,
---- কিছু কি হয়েছে আপা? মা আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠালো যে?
অনু ঠোঁট উল্টে জবাব দেয়,
----- জানিনা রে, আমাকেও ডেকে পাঠিয়েছে। সত্যি করে বল অরু, ক্রীতিক ভাইয়ার সাথে কিছু করিস নি তো?
অরু বিরক্ত কন্ঠে বললো,
----- আপা! উনি এসেছে থেকে আমার মুখের দিকে অবধি ভালো করে তাকাচ্ছে না,কথা বলা দূরের থাক।
অনু বললো,
----- ভাগ্যিস মামি নেই, থাকলে এটাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে হাজারটা অপবাদ জুড়ে দিতো।
অরু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো, মনেমনে ভাবলো,
----- হতেও তো পারে মামির কথায়ই ঠিক, জায়ান ক্রীতিক এখন আর আমাকে ভালোবাসেনা। এখন আর আমি আগের মতো গোলগাল নেই,শুকিয়ে গিয়েছি অনেক, তাই হয়তো আমার সৌন্দর্যে উনি আকর্ষিত হচ্ছেন না, ভালো লাগছে না আমাকে আর।
ভাবনার মাঝপথে অনু আচমকা ধাক্কা দিলো অরুকে, অরুর ভ্রম কেটে গেলে, গলা খাদে নামিয়ে অনু বলে,
----- এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে চল, আর হ্যা কিছু কড়া কথা শোনার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখ। মা তো একটু বলবেই, ওসব মনে রাখার দরকার নেই। কেমন?
অরু অনুর কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে অনুর আঁচল ধরে পেছন পেছন এগিয়ে গেলো।
---- মা আসবো?
আজমেরী শেখ হাতের বইটা রেখে ঘুরে তাকালেন, পাওয়ারি চশমায় স্পষ্ট দেখতে পেলেন ফুটন্ত কলির মতো তার দুই মেয়েকে। একজনের পরনে লাল টকটকে চুড়িদার, আরেকজনের পড়নে কালো। আমেরিকা থেকে আসার পরের দিনগুলোতে যেমন বিষন্ন, মলিন মুখশ্রীতে ঢাকা পরে থাকতো স্নিগ্ধ চেহারাটা, এখন এই মূহুর্তে তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। যদিও অরুকে কাহিল দেখাচ্ছে, তবুও কোথাও একটা লাবন্যের আভা ফুটে উঠেছে ছোট্ট মুখটায়।
মেয়েদেরকে একনজর পরখ করে আজমেরী শেখ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে গম্ভীর গলায় বললেন,
----- হ্যা এসো।
অনু ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
---- কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ করছে তোমার?
---- আমি ঠিক আছি, তুমি ঠিক আছোতো?
মায়ের কথার রহস্য ছেদ করার ক্ষমতা নেই অনুর, অগত্যাই শুষ্ক ঢোক গিললো ও। জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে বললো,
----- ঠিকই তো আছি মা।
আজমেরী শেখ আর কথা ঘোরালেন না, স্পষ্ট আওয়াজে বললেন,
----- প্রত্যয়ের পরিবারের সাথে কথা বলা হয়েছে, ওরা কাল সন্ধ্যায় আসছে। দু'বোন সেজেগুজে রেডি থাকবে। আমিতো আর জায়ান ক্রীতিক না, যে পরিবার সমাজ এসবের বাইরে গিয়ে যা ইচ্ছে করবো। যা হবে দু পরিবারের সম্মতি এবং সকল রিচুয়াল মেনেই হবে।
আজমেরী শেখের কথায় অরুর মুখটা চুপসে গেলেও, আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে অনুর হৃদয়। সকল আশা ভরসা বিসর্জন দেওয়ার পরে এ যেন মেঘ না চাইতে জল। ও পারছেনা খুশিতে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠতে, কারণ সেটা ওর ধাঁচে নেই। তাই চুপচাপ মায়ের কথায় মাথা কাত করে সম্মতি জানালো অনু।
----- এবার যেতে পারো।
আজমেরী শেখ যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু বোন বাইরের দিকে অগ্রসর হয়।ঠিক তখনই পুনরায় অরুকে ডেকে ওঠেন তিনি,মায়ের ডাকে অরু পিছু তাকালে, একটা ভারী দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে আজমেরী বলেন,
---- তোমার স্বামীকে বলবে, সে যাতে যথা সময়ে মেহমানদের সামনে উপস্থিত থাকে। আমরা সামাজিক জীব তো তাই এসব আতিথেয়তা আমাদের পালন করতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় অতিথিদের সর্বোচ্চ আপ্যয়নে। তাই কালকের দিনটা অন্তত যাতে একটু ভদ্রভাবে নিচে নামে।
কেন যেন মায়ের তিক্ত কথাগুলোও আজকে বেশ মনে ধরলো অরুর। ইচ্ছেতো করছে উড়ন্ত পাখির ন্যায় উড়ে উড়ে ডানা ঝাপটাতে। এই প্রথম ক্রীতিক আর ওর সম্পর্কটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে মা, তার মানে কি একটু একটু করে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে মায়ের কাছে?
এর চেয়ে খুশির আর কিই হতে পারে। আজ অনেক গুলো দিন পরে হয়তো অরু একটু ঘুমোতে পারবে। যাকে বলে সত্যিকারের ঘুম ।
ওদিকে ঘুম নেই অনুর চোখে। কি বললো মা এটা? এতো তাড়াতাড়ি কি মনে করে সবকিছু মেনে নিলো মা? এটা কি আসলেই সত্যি নাকি সপ্ন? ঘুম ভেঙে গেলে যদি সব মিথ্যে হয়ে যায়,তখন? অযাচিত ভয়ের সত্যতা যাচাই করার জন্য নিজের শরীরেই নিজে চিমটি কাটলো অনু।
---- আউচ!
ব্যথা পেয়ে তরাগ করে উঠে বসলো ও। মনেমনে বললো,
---- সবই ঠিক আছে, কোনো কিছুই স্বপ্ন কিংবা ভ্রম নয়। কিন্তু রেজা ভাই আর মামি জানলে কি অশান্তিটাই না করবে,কে জানে? মাকে না আবার কথা দিয়ে পিষ্ট করে ফেলে।তখন তো আমারই কষ্ট হবে। হে উপর ওয়ালা যা হওয়ার তা যাতে ভালোয় ভালোয় হয়, নয়তো মায়ের কষ্ট আমি দেখতে পারবো না, কিছুতেই না।
নিশুতি, নিস্তব্ধ, শুনশান তমসাচ্ছন্ন রাত। অরু গভীর তলিয়ে আছে। দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খোলা, সেথা থেকে বুড়িগঙ্গা পারের শা শা বাতাস ধেয়ে আসছে। অদুরে লঞ্চের হুইসেল বাজছে, হয়তো শেষ রাতে ঘাটে ভিড়েছে, তাই ঘুমন্ত যাত্রীদের জানান দিতেই এই তীক্ষ্ণ আওয়াজ।
লঞ্চের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুমের খুব একটা অসুবিধা না হলেও, সিগারেট পো'ড়া উৎকট গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসছে ঘুমন্ত অরুর। মনে হচ্ছে কেউ নাকের কাছে এসে সিগারেট ধরিয়েছে, যে সেই সিগারেট না, বিদেশি ব্র্যান্ডেট কোনো সিগারেট, যার দরুন গন্ধটাও তীক্ষ্ণ, ঘুমের মাঝেও কেমন মস্তিষ্কে গিয়ে লাগছে।
বাইরের হিমেল হাওয়াও সেই গন্ধ দূর করতে পারছে না। বেশকিছুক্ষন ঘুমের তালে হাসফাস করে শ্বাস নিতে না পেরে অবশেষে লাফিয়ে উঠে বসলো অরু। বাইরের চাঁদের আলোতে আলোকিত ঘর। সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পুরো রুমে কেউ নেই, অথচ সিগারেটের গন্ধটা এখনো বর্তমান। নিজের মনের ভ'য় আর সন্দেহ কাটাতে উঠে গিয়ে বৈদ্যুতিক লাইট জ্বালালো অরু। রুমজুড়ে ফকফকে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পরতেই অরুর দৃষ্টিগোচর হলো মিয়িয়ে যাওয়া ধোঁয়ার কুন্ডলী। দেখে মনে হচ্ছে এখানে একটু আগেও কেউ ছিল, কিন্তু কে?এতো রাতে নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কে আসতে পারে এই রুমে, ভাবনায় পরে গেলো অরু।
তবে ভাবনারা ঘনীভূত হওয়ার আগেই চোখের পাতা ভার হয়ে এলো ঘুমে, অরু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না,তৎক্ষনাৎ গিয়ে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়, ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবলো,
----- যে থাকার থাকুক, জায়ান ক্রীতিক বাড়িতেই আছে, কেউ আমার কিছু করতে পারবে না, আফটার অল হি ইজ মাই সুপার হিরো।
****************************************
আজ আর একাডেমিতে যাওয়া হলোনা অরুর। সন্ধ্যায় মেহমান আসবে, তারউপর এখনো ক্রীতিকের বন্ধুরা আছে,তাই বাড়িতে অনেক কাজ। সকাল সকালই টেলিফোন করে নীলিমাকে জানিয়ে দিয়েছে অরু। বলেছে সন্ধ্যা বেলায় যাতে শাড়ি টাড়ি পরে নীলিমাও চলে আসে, তাহলে একসাথে সেলফি তোলা যাবে। নীলিমাও বেশ উৎসুক হয়ে সায় জানিয়েছে অরুর কথায়। অবশেষে অনু আপার বিয়ে হতে যাচ্ছে। ওদের খুশির যেন সীমা নেই।
নীলিমার সাথে কথা শেষ করে অরু খাবার টেবিলে আসলে, আজমেরী শেখ বলেন,
----- তাকে বলা হয়েছিল?
"তাকে" বলতে মা ক্রীতিককে বুঝিয়েছে, ব্যাপারটা মাথায় আসতেই অরু দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে যেতে যেতে বললো,
------- এক্ষুনি বলে আসছি মা, তাড়াহুড়োয় ভুলে গিয়েছিলাম।
অরু যখন উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ক্রীতিকের রুমে প্রবেশ করলো,তখন সেই আট বছর আগের মতোই অনুভূতি হচ্ছে ওর।মনে হচ্ছে এই বুঝি উঠে এসে ঠাস করে থা'প্পর লাগিয়ে দেবে ক্রীতিক, তারপর দাঁত খিঁচিয়ে বলবে,
---- আমার রুমে কি চাই?
অথবা হিতে বিপরীত ও হতে পারে, না উঠেই হাতের ইশারায় ডেকে বলতে পারে,
---- এখানে বস তোকে দেখবো।
মনের মাঝে বাসা বাঁধা তখনকার য'মরাজ যে এখন হৃদয়ের পৃথ্বীরাজ হয়ে যাবে কে জানতো?
অতীতের কথা মনে করে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রুমের মাঝে এগিয়ে যায় অরু। বেলা প্রায় এগারোটার কাছাকাছি, অথচ এখনো উদম শরীরে উপর হয়ে ঘুমাচ্ছে ক্রীতিক। কোমড় অবধি টানা কম্ফোর্টার ছাড়িয়ে তার ভি শেইপ পৃষ্ঠদেশ, পুরুষালি বাহু,ফর্সা পিঠের ইতি উতি রাজত্ব গেঁড়ে বসা কুচকুচে কালো তিল সবকিছুই দৃশ্যমান অরুর চোখে। সেদিকে তাকালেই যেন ঘোর লেগে আসে, জাগ্রত হয় অবাধ্য নারী সত্তা। তাই বেশিক্ষণ না তাকিয়ে, তাড়াহুড়ো করে চোখ নামিয়ে, অন্যদিকে তাকিয়ে রিনরিনে আওয়াজে ডাকলো অরু,
----- শুনছেন, কথা ছিল, কাজের কথা।
ক্রীতিকের কোনো হেলদোল নেই। অথচ অরু একই ভাবে ডাকলো বেশ কয়েকবার।
পরক্ষণেই মনে মনে বললো,
---- আমি জানি সজাগ থাকলেও সারা দিবেন না আপনি। আমারই ভুল আগ বাড়িয়ে ডাকতে এসেছি।
অরু যখন বিরক্ত হয়ে গাল ফুলিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখনই আওয়াজ ভেসে আসে ক্রীতিকের। সকালের হাস্কিটোনে ক্রীতিক বলে,
----- চোখ ভর্তি ঘুম, আর মাথা ভর্তি শুধু তুই।
অরু তরতরিয়ে এগিয়ে এসে শুধালো,
---- কি বললেন?
ক্রীতিক এবার ঘুরে শুলো, বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা কুড়িয়ে চেইক করতে করতে বললো,
------ নাথিং, কি বলতে এসেছিস সেটা বল।
অরু চোখমুখ শক্ত করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
---- আজ প্রত্যয় ভাইয়াদের বাড়ি থেকে মেহমান আসবে, মা বলেছে আপনাকে উপস্থিত থাকতে।
ক্রীতিক ফোন স্ক্রল করতে করতে বললো,
----- রাতে ঘুমাতে পারিনি, পার্টি অফিসের পূর্নমিলনীও ঘুমের জন্য ক্যান্সেল করেছি। সারাদিন ঘুমাবো। সন্ধ্যায় ডেকে দিস, ঘুম হলে চলে আসবো।
অরু কঠিন গলায় বললো,
------ বাড়ির জামাইদের এসবে থাকতে হয়, আর আপনি বাড়ির ছোট জামাই।
------ ওহ তাই আমি বুঝি ক্রীতিক কুঞ্জের জামাই? আগেতো জানা ছিলোনা?
---- হ্যা তাইতো।
কথায় কথায় ক্রীতিক খেয়াল করলো অরু সেই তখন থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলছে, কাহিনি ধরতে না পেরে ক্রীতিক ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো,
----- আমি তোর শশুর না ভাসুর? এভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন?
অরু চোখমুখ খিঁচিয়ে বললো,
----- দয়া করে কিছু পড়ুন।
ক্রীতিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
----- এমন ভাব করছিস যেন এর আগে তুই আমাকে আনড্রেস দেখিসনি।আমিতো প্যান্ট.....
---- থাআআআক!
কানে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো অরু। তৎক্ষনাৎ রুম ত্যাগ করতে করতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
----- নির্লজ্জ, বেহায়া লোক। এই রুমে এসে আমার ঘাট হয়েছে।
****************************************
সন্ধ্যে হতেই হ্যাজাক আর ল্যানটার্নের আলোতে সেজে উঠেছে ক্রীতিক কুঞ্জ। চারিদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ। মূলত ক্রীতিকের বন্ধুরাই মাতিয়ে রেখেছে সবকিছু। সায়র আজকে ফটোগ্রাফার। এদিকে সেদিক যেখানে যা পাচ্ছে তারই ছবি তুলে নিচ্ছে ও।
এলিসা ব্যস্ত সময় পার করছে অনুকে সাজাতে। পাশেই দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় ফুল পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ক্যাথলিন। আজ বাঙালিদের মতো থ্রী পিচ পরেছে সে। রুমের কোথাও অরুর দেখা নেই। মেয়েটা সাজেওনি। ক্রীতিক এখনো ওর সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনা, চোখে চোখ রেখে তাকায় না।
ওই জন্যই সাজগোজ করার ইচ্ছেটাও ম'রে গিয়েছে। কিন্তু এলিসা তো মোটেও কথা শোনার পাত্রী নয়, ঠিকই কোথা থেকে যেন ধরে এনে অরুকেও সাজাতে বসেছে।
মেহমান এসেছে এইতো কিছুক্ষন। ঘরোয়া আয়োজন, ছোটখাটো আংটি বদল যাকে বলে, তাই মেহমানের সংখ্যাও কম। প্রত্যয়ের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া তেমন কেউ আসেনি।
অতিথিদের কিছু সময় পরে, প্রত্যয় নিজেও এসেছে, পুরোপুরি ফর্মাল স্টাইলে। অফ হোয়াইট শার্ট, ব্ল্যাক কোটি আর ব্ল্যাক রিস্ট ওয়াচে তাকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে। প্রত্যয়ের কোলে তার বড় বোনের পিচ্চি মেয়ে অন্তু। অন্তুকে কোলে নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে আজমেরী শেখকে সালাম জানালো প্রত্যয়। আজমেরী শেখ হাসিমুখে সালাম গ্রহন করে প্রত্যয়কে বসতে বললো।
মোখলেস চাচা সহ বাড়ির অন্য ভৃত্যরা অতিথি সমাদরে ব্যস্ত।অর্ণব আর এলিসা অতিথিদের সাথে টুকটাক কথা জমিয়েছে। সায়র সকলের ভিডিও ধারণ করছে। ঠিক সেসময় অনুকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে অরু আর ক্যাথলিন।
কটকটে গাঢ় মেরুন রঙের হাফসিল্ক শাড়ি আর হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি পরিহিত অনুকে চেনাই যাচ্ছে না এখন। দেখতে অপরূপ লাগছে। হুট করেই মনে হচ্ছে সিনেমার মেইন ক্যরেক্টারের এন্ট্রি হয়েছে। সবার চোখ অনুর দিকে। অন্তুকে চকলেট দিতে দিতে প্রত্যয়ও দু একবার আড় চোখে দেখে নিলো অনুকে।
অরুও আজ শাড়ি পরেনি, সিকোয়েন্স থ্রী পিচ পরেই অনুকে নিয়ে নেমেছে সে। নিচে এসে অনুকে বসানো হলো প্রত্যয়ের পাশেই। ভালোবাসার বিয়ে দেখা দেখির কিছু নেই। ডিরেক্ট আংটি বদল হলেই চলে, তবুও আশ মেটাতে সবাই একটু একটু করে দেখে নিলো হবু বউকে।
একজন মাত্র মানুষ যিনি অনুর পাশাপাশি, উঠে এসে অরুকেও চিবুক তুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি হলেন প্রত্যয়ের বড় ফুপি। অরু বুঝলো না ওকে এভাবে দেখার কি আছে, তবে সেরকম কিছু মনেও করলো না।
সবাই যখন অনু আর প্রত্যয়কে নিয়ে মেতে আছে, তখন অরুর দিকে এগিয়ে আসেন আজমেরী শেখ। কিছুটা রাগান্বিত হয়ে গলা খাদে নামিয়ে শুধান,
----- তোমার স্বামী কোথায়?
অরু থতমত খেয়ে উপরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলবে, তার আগেই দেখা গেলো সিঁড়ি দিয়ে নামছে ক্রীতিক। চোখে মুখে এখনো ঘুমের রেশ। এলোমেলো চুল, পড়নে কালো টিশার্ট আর ট্রাউজার৷ পায়ে স্লিপার, হাতে আইপ্যাড। সেভাবেই অতিথিদের সামনে চলে এলো ক্রীতিক। আজমেরী শেখ ক্রীতিককে দেখে অরুকে চোখ রা'ঙিয়ে চলে গেলেন। আর অরু সেখানে দাড়িয়েই কপাল চাপড়াতে থাকলো। এ কি স্বামী কপালে জুটলো তার? রাইট বললে লেফ্টে যাবে, তো লেফ্ট বললে রাইটে । ঘাড় ত্যাড়ামির ও তো একটা সীমা থাকা দরকার।
ক্রীতিক সবার মাঝে আসতেই প্রত্যয় দাড়িয়ে ওকে বসতে বললো,
ক্রীতিক ও গিয়ে একটা সিঙ্গেল সোফার উপর বসে পরলো। ওকে দেখে প্রত্যয়ের পনেরো বছরের কাজিন ফট করে বলে উঠলো,
---- ভাইয়া আপনি দেখতে পুরাই রানবীর কাপুরের মতো। এলোমেলো চেহারাতেও হট লাগছে।
প্রত্যয়ের ফুপি তৎক্ষনাৎ মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
---- চুপ করবে তুমি? ইউ হ্যাভ নো ম্যানারস।
ক্রীতিক ইতস্তত কন্ঠে বললো,
----- ইটস ওকে ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি।
সায়র মিনমিনিয়ে বললো,,
------ নিজে একটা ছোট মেয়ের জন্য দিওয়ানা হয়ে ঘুরছে, আর এখানে আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে ঢং যত্তসব।
সবার সব টকশোতে ইতি টেনে অবশেষে ছোটমোটো করে আজমেরী শেখ অনু আর প্রত্যয়ের আংটি বদলের ঘোষণা করেন। এবং সবার হইহুলোরে ওদের আংটি বদলটা হয়েও যায়।
দুই পরিবারের সম্মতি সাপেক্ষে একসপ্তাহ পরে ঠিক করা হয় বিয়ের দিন তারিখ।
এইংগেজমেন্ট মানে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দুজন দুজনকে নতুন করে চিনতে শুরু করা। অনেকটা কাছ থেকে, আর অনেকটা আন্তরিকতা দিয়ে। তাই মেয়ে আর জামাইকে একটু প্রাইভেসি দিয়েছে সবাই।
আলাদা কথা বলার জন্য ওদের ছাঁদে পাঠানো হয়েছে।
আর নিচে আপাতত সবাই মিষ্টি মুখ করায় ব্যস্ত। প্রত্যয়ের ফুপি আজমেরী শেখের মুখে একটুখানি মিষ্টি পুরে দিয়ে, হাসিমুখে বললেন,
---- আপা, আমাদের তো আরও একটা আবদার বাকি রয়ে গেলো।
আজমেরী শেখ খানিকটা উৎসুক হয়ে শুধালেন,
----- কি আবদার বলুননা।
---- আমাদের আরও একজন ছেলে আছে, প্রত্যয়েরই চাচাতো ভাই, ওর নাম অমিত। নামকরা নোবেলিস্ট,কিছুদিন আগে ছোট খাটো একটা কার এ'ক্সি'ডেন্ট হয়েছে দেখে আজ আসতে পারেনি, ও আসলে আপনার ছোট মেয়েকে খুব পছন্দ করে। অনু আর প্রত্যয়ের কথা বলা, কওয়ার আগে থেকেই অরুর কথা বলাবলি করেছি আমরা।
ছেলেটা অবশেষে কাউকে পছন্দ করেছে, তাই আবদার না করে থাকতে পারিনি, এখন আপনাদের মতামত।
প্রত্যয়ের ফুপির কথা শেষ হতেই ঘর শুদ্ধ সবাই বিব্রত চাহনি নিক্ষেপ করলো ক্রীতিকের পানে। যে এতোক্ষণ যাবত আইপ্যাড স্ক্রল করছিল, কিন্তু এই মূহুর্তে বাঁজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চাহনিতে চেয়ে আছে, এককোনে কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকা অরুর দিকে।
অরুর নিজেও এহেন প্রস্তাবে হতবাক। কিন্তু আপাতত ওর ভ'য় করছে, ভীষণ ভ'য়। ক্রীতিক না আবার বড়সড় ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে। চারিদিক এমন থমথমে হয়ে আছে দেখে প্রত্যয়ের ফুপি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শান্ত স্বরে ক্রীতিক বলে ,
----- অরু যে ভা'র্জিন না সেটা আপনার ভাতিজা জানেতো?
----কিহ!
হতবিহ্বল হয়ে গেলেন প্রত্যয়ের ফুপি,এই টুকু মেয়ে ভা'র্জিন না, তাও আবার এসব গোপনীয় কথা সবার মাঝে বসে বলছে তারই সৎ ভাই?
ক্রীতিক চারিদিকে একবার চোখ বোলালো, তারপর উঠে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
---- এনজয় ইওর কোয়ালিটি টাইম।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে উপরে যেতে যেতে সবার সামনে অরুকে ডেকে ক্রীতিক বললো,
---- অরু এক্ষুনি উপরে আয়। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।
****************************************
অরু রুমে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওকে হ্যাচকা টান দিয়ে বিছানায় ছু'ড়ে মা'রলো ক্রীতিক।
শরীরের শক্তি ক্ষীণ, তার উপর এভাবে ছু'ড়ে মা'রাতে মারাত্মক ব্যথা পেলো অরু। ক্রীতিকের সেদিকে খেয়াল নেই। গত কয়েকদিনের রা'গ, হিং''স্রতা সব একসাথ হয়ে মস্তিষ্কে জমা হয়েছে ওর। চোখদুটোতে ভর করেছে র'ক্তিম তে'জক্রিয়তা কপালের সবকটা রগ ফুলে আছে।
অরু নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালো। ও বুঝতে পারলো না ওর দোষটা কোথায়, তাই ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
---- সমস্যা কি আপনার, যখন ইচ্ছে মা'রছেন, যখন ইচ্ছে অবহেলা করছেন, যখন ইচ্ছে কাছে টেনে নিচ্ছেন,কেন? কি করেছি আমি?
ক্রীতিক জো'র করে শ'ক্ত হাতে অরুর ঠোঁটের লিপস্টিক ঘষে মুছতে মুছতে বললো,
---- কতবার বলেছি অন্যকারও সামনে সাজবি না কথা শুনিস নি, আমি মাত্র একটা মাস দূরে ছিলাম এর মধ্যে অন্য নাগর জুটিয়ে ফেলেছিস। তারা এখন আমার বউয়ের জন্য, আমার বাড়িতেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। তোকে আজ আমি কি করবো নিজেও জানিনা।
অরু ক্রীতিককে দু-হাতে ধা'ক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
----- কি করবেন আপনি আমাকে, মে"রে ফেলবেন? মা'রুন,কা'টুন যা ইচ্ছে করুন। আপনার জন্য এমনিতেই আধম'রা হয়ে আছি আমি। অথচ আপনাকে দেখুন কষ্ট দিয়েই যাচ্ছেন, তো দিয়েই যাচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন তার কোনো উত্তর নেই। কি দোষ আমার বলুন, কেন এমন করছেন? কেন!!
আবারও ক্রীতিকের শক্ত বুকে ধা'ক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো অরু।
এবার আর নিজের ক্রো'ধটাকে সংবরণ করতে পারলো না ক্রীতিক। ওর হাতদুটো নিজের মুঠোয় পুরে,গলা ছেড়ে চিৎকার করে বললো,
----- বিকজ আই লাভ ইউ ড্যামএট।
ক্রীতিক এতো জোরেই কথাটা বলেছে যে ওর গ'র্জন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মহলের প্রতিটি দেওয়ালে। সেইসাথে হলরুমে বসা সকলেই লাফিয়ে উঠেছে এহেন গর্জনে।
অরুর নিজেও এই মূহুর্তে থরথরিয়ে কাঁপছে, ক্রীতিক নিজের দাঁতে দাঁত পিষে অরুর মুখের কাছে মুখ এনে বললো,
----- ইচ্ছেতো করছে মে'রে মে'রে নরম তুলতুলে গালগুলোকে র'ক্তা''ক্ত করে দিতে। কিন্তু না খেয়ে খেয়ে নিজের এমন হাল করেছিস সেটা করতেও কলিজায় লাগছে। এদিকে রা"গটাকেও কমাতে পারছি না। ওহ গড!
অরু ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে কাঁদছে।
ক্রীতিক ও অরুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেভাবেই খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে,খানিকটা শান্ত স্বরে বলে,
------ অরু, আমার অ্যারোগেন্সি, আমার রা'গ, আমার জিদ, আমার ডেস্পারেটনেস। তুই না সহ্য করলে আর কে সহ্য করবে বলতো? কার কাছে খোলা বই হবো আমি? তুই কি চাস আমি সারাজীবন ডি'প্রেশন আর এ্যাং'সাইটিতে ধুঁকে ধুঁকে ম''রি?
অরু জবাব দেয় না, শুধু ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের পিঠে পরে থাকা লম্বা চুল গুলোকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে চুপচাপ স্থির হয়ে থাকে।
ক্রীতিকের রা'গ সংযত করার জন্য অরু নিজেকে তার কাছে সমর্পন করছে, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই একটানে ওর জামার ফিতেটা খুলে শক্ত হাতে ওর বাহু চেপে ধরে অরুর তুলতুলে কোমল উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশে ঝড়ের গতিতে মুখ ডুবিয়ে দিলো ক্রীতিক।
........................................................................
𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃
***Download NovelToon to enjoy a better reading experience!***
Updated 62 Episodes
Comments