#পর্বঃ১১
সেই তখন থেকে জেকে স্যারের গুনগান করে যাচ্ছে সায়নী, মাঝেমধ্যে নিজের কথার সামিল করতে দুএকবার অরুকেও বলছে,
---তাই না বলো?
অরু সায়নীর কথা মতো হুম, হা করছে ঠিকই তবে ওর মনে চলছে অন্যকিছু। সেটাও অন্যকাউকে নয় সয়ং ক্রীতিককে নিয়েই। ও ভাবছে ট্যুরের কথাটা আপা জানলে যেমন তেমন, বকা ঝকা করে হলেও শেষমেশ যেতে দিতে রাজি হবে। কিন্তু ক্রীতিক? এই ঘার ত্যারা লোকতো জীবনেও রাজি হবেনা। উল্টে এমন ভাবে চোখ রাঙাবে,যে ভ'য়ে অরুর ছোট্ট হৃদপিন্ডটা ওখানেই কাজ করা বন্ধ করে দেবে। তাহলে সাধ করে নিখিল ভাই কে যে আশ্বাস দিয়ে এলো তার কি হবে??
---এ্যাই অরু, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা??
হুট করে সায়নীর কনুইয়ের গুঁতোয় সম্বিত ফিরে পেলো অরু, ও কাঠেল পুতুলের ন্যায় উপর নিচ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
--- হ্যা হ্যা, শুনছি বলো বলো,তারপর?
সায়নী ভ্রু কুচঁকে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করে বলে,
---কিসের তারপর?? দেখো আমরা চলে এসেছি, অলরেডি রেসিং শুরু হয়ে গিয়েছে তাড়াতাড়ি এসো।
রাস্তার দু'ধারে থ্রি'লিং প্রিয় মানুষদের শ'য়ে শ'য়ে ভীর। সেই গাদাগাদি আর ভীরের ফাঁক গলিয়ে ওরা দুজনও যায়গা করে নিলো রাস্তার এক কোনে। ওরা যতক্ষণে এসেছে ততক্ষণে বাইকার'রা ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতায় ব্যাস্ত।
অডিয়েন্সদের পাশে এসে দাড়াতে দাড়াতে অরু শুনতে পেলো জেকে নামের উচ্ছ্বাস। তারমানে সায়নী শুধু একা নয় এরাও রাইডার জেকের ভক্ত।
আচ্ছা এরা কেন এতো পাগল ক্রীতিকের জন্য? এরা কি আদৌও জানে ক্রীতিক কতোটা নির্দ'য়? ক্রীতিক মোটেই এই জনপ্রিয়তা ডিজার্ভ করেনা, চারিদিকে জেকের জয়জয়কার শুনে এসব উল্টোপাল্টা কথায়ই ভাবছিল অরু। তখনই সায়নী আবারও অরুকে ডেকে বলে,
--- ওমাই গড, ওমাই গড দেখো দেখো এ্যাগেইন চ্যাম্পিয়ন।
অরুও এবার সচকিত হয়ে বাইক গুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সকালের উরন্ত পেজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘ এতোক্ষনে কালো মেঘে পরিনত হয়েছে।চারিদিকে মেঘ ভেজা দমকা হাওয়া আর ঝিরঝিরি বৃষ্টিতেই বাইক রাইডিং এর শেষ রাউন্ড শেষ হয়েছে মাত্র।রেচিংএর মেইন পয়েন্ট ওদের থেকে খানিকটা দুরে হবার কারণে চোখ উঁচিয়ে দেখতে হয় সেখানটা। তবে এতোটা দূর থেকেও স্ট্যান্ড করানো বাইক গুলোর মধ্যে সারির প্রথম বাইকটাতে বসা ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট আর ব্ল্যাক হেলমেট পরিহিত বাইকার টাই যে ক্রীতিক সেটা বুঝতে বাকি নেই অরুর।
কারণ জেকের বডি স্ট্রাকচার সবার থেকে আলাদা। কাল্পনিক গ্রীক গডের বাস্তব চিত্র বলা চলে। এক ঝলকে দেখলে মনে হবে উপরওয়ালার শখের কারুকাজ এই জায়ান ক্রীতিক নামক সুদর্শন পুরুষটা। তবে ক্রীতিকের সৌন্দর্য নিয়ে অরুর এসব অগভীর ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা, তার আগেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো এক অপ্রীতিকর নি'ন্দনীয় ঘটনা। অরুদের থেকে বেশ অনেকটা দুরে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলে অন্য এক প্রতিযোগিকে হ'কিস্টিক দিয়ে ইচ্ছে মতো মার'ছে ক্রীতিক। ওর মা'রে'র গতিবেগ এতোটাই বেশি যে লোকটা উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ টুকু পর্যন্ত পাচ্ছে না। কিন্তু এভাবে মা'রা'র কারন কি??
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে মুশল বারিধারায় রূপ নিয়েছে । আশেপাশের জটলা পাকানো ভীর ছাড়িয়ে অনেকেই যায়গা করে নিয়েছে কোনো না কোন শুকনো ছাউনি অথবা ছাতার নিচে। তবে অরুর আপাতত বৃষ্টিতে খেয়াল নেই আর না আছে ক্রীতিকের ।
ঝুম বৃষ্টিতে কথা শোনার যো নেই মোটে,তবুও অরুকে উদ্দেশ্য করে সায়নী চেঁচিয়ে বললো,
--- অরু, দ্রুত চলো, ভিজে যাচ্ছি। কোন একটা ছাউনি খুজে তার নিচে গিয়ে দাঁড়াই।
অরুর কান অবধি সে কথা পৌঁছালো কি না সন্দেহ, আর না'তো ও কোন ছাউনির নিচে গিয়ে আশ্রয় নিলো। বরং ঝুম বৃষ্টির মাঝেই দ্রুত এগিয়ে গেলো সামনের প্রসস্থ রাস্তার দিকে। এগিয়ে যেতে শুনতে পেলো, অনেকেই বলাবলি করছে,
জ্যাকসন নামক বাইকারটা জেকের মায়ের নাম করে কিছু একটা বাজে গা'লি দিয়েছে, আর তাই লোকটা সেই ছোট্ট একটা গা'লি দেওয়ার মাশুল চোকাচ্ছে গত আধঘন্টা যাবত এক নাগাড়ে হ'কিস্টিকের মা'র খেয়ে। আশ্চর্যের বিষয় হলো কেউ ক্রীতিককে থামাচ্ছে না পর্যন্ত। এইসব দৃশ্য কি এদেশের মানুষের কাছে এতোটাই সাভাবিক আর উপভোগ্য?
--- দয়ামায়'হীন নি'র্দয় আমেরিকান।
নিজের আ'ক্রোশ দমিয়ে রেখে মনে মনে কথাটা ছাড়লো অরু।
.
ওদিকে নিজের সর্ব সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জ্যাকসনের শরীরে একের পর এক হ'কিস্টিক ভা'ঙছে ক্রীতিক।মা'রতে মা'রতে ওর নিজ হাতের অবস্থাও বেগতিক, কিন্তু সেইসবে বিন্দুমাত্র নজর নেই ওর। আপাতত নিজের দমিয়ে রাখা জি'দ আর তপ্ত মস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ব্যাস্ত ও। কেন যেন মনে হচ্ছে এই মা'রটা জ্যাকসনের বহু দিনের পাওনা। রেসিং ক্লাবে ক্রীতিককে টেক্কা দেবার মতো রাইডার যদি কেউ থেকে থাকে সেটা জ্যাকসন। রাইডিং-স্ট্যান্ডিং সব কিছুতেই বেশ পারদর্শী জ্যাকসন। তবে এ যাবত কোন ম্যাচেই জেকে কে হারাতে না পারার জি'দটা ভেতরে ভেতরে ওর রয়েই গিয়েছে বরাবর । সামনা সামনি বুঝতে না দিলেওও,নিজ দেশের রেচিং ক্লাবে ফরেইনার একটা ছেলের এতোটা জনপ্রিয়তা জ্যাকসন মোটেই সহ্য করতে পারতো না, সেই যের ধরেই পেছনে পেছনে নানা কৌশলে বিভিন্ন ভাবে ক্রীতিকের ক্ষ'তি করার ফন্দি এঁটেছে বহুবার। তবে একটা স্ট্রং বন্ধু মহল আর ক্রীতিকের সুকৌশলী বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্কের কাছে সেগুলো বরাবরই ফে'ইল করে গেছে। ক্রীতিক ভালোভাবেই জানতো কাজ গুলো কে করছে, বা কার দ্বারা ঘটছে। তবে এসব খুব একটা গায়ে লাগাতো না ও। বরং পিঠ পিছনেই দিয়ে যেতো একের পর কৌশলী দাবার চাল।কারণ ক্রীতিকের কাছে ওর করা ফন্দি গুলো হাস্যকর ঠেকতো বরাবরই।সেইসাথে মা'রাত্নক ইনটারেস্টিং ও মনে হতো। কারন ক্রীতিক,অর্নব,এলিসা,আর সায়র এর থেকেও বড়বড় দাবার চাল চেলে অভ্যস্ত।
তবে আজ এই মূহুর্তে জ্যাকসন অস্ফুটে যেই শব্দটা উচ্চারণ করেছে তার মূল্য তো ক্রীতিক ওকে হাড়েহাড়ে বুঝিয়েই ছাড়বে।
আজ মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল ক্রীতিকের, ওই জন্যইতো ক্লাবের কল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছিল জোস একটা রাইড করতে। সবার উচ্ছ্বাসে জোয়ার দিতে বাইক রাইডও করেছিল প্রায় দু'শো কিলোমিটারের আঁকাবাকা অমসৃণ রাস্তা এবং শেষমেশ প্রতিবারের মতো আজও চ্যাম্পিয়ন তকমাটাও ওর গায়েই লেগেছিল। সব কিছু সাভাবিক,ক্রীতিকের মুড ও ঠিকঠাক । তখনই ব্যাথর্তা হটাতে জ্যাকসনের মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত দুটো শব্দ।
--- মা*** ফা'কিং বা'স্টা'র্ড।
জ্যাকসন নিজেও বুঝতে পারেনি যে ক্রীতিক কথাটা শুনে ফেলবে।
তবে ওর ব্যাড লাক, ক্রীতিক কথাটা স্পষ্ট ভাবে শুনতে পায়,
ব্যাস, তৎক্ষনাৎ ক্লাবের মধ্যে থেকে হ'কিস্টিক এনে উইথ আউট এনি ওয়া'র্নিং ওকে ইচ্ছে মতো মা'রতে শুরু করে ক্রীতিক। না নিজে মুখ দিয়ে কোন একটা শব্দ করেছে আর না জ্যাকসনকে করতে দিয়েছে। একেএকে ওর পি'ঠে ভে'ঙে'ছে চারখানা সরু ধাঁচের মজবুত কাঠের হ'কিস্টিক। তবুও যেন মস্তিষ্কটা শান্ত হবার নাম নিচ্ছে মোটেই। তবে ওর অ'শান্ত মস্তিষ্ক খুব বেশিক্ষন আর অ'শান্ত রইলো না। বেশ খানিকটা পরেই চলমান উত্ত'প্ত রা'গের বহিঃপ্রকাশে খুব বড়সড় একটা বাঁধা প্রাপ্ত হলো ক্রীতিক।
খুব পরিচিত আর আপন একটা রিনরিনে মায়াভরা কন্ঠস্বর ভেসে এলো ক্রীতিকের দুই'কর্ণকূহরে।
ওর আ'ক্রম'নাত্তক পেশিবহুল বাহুটা দুইহাত দিয়ে আগলে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে অরু বললো,
--- কি করছেন,মে'রে ফেলবেন নাকি লোকটাকে?
ক্রীতিক তরিৎ গতিতে ঘুরে তাকালো। কেবল পরিচিত নয়, শুধু আপনও নয়, বক্ষপিঞ্জনের গহীনে লুকিয়ে রাখা আকাশসম অনুভূতির ছড়াছড়ি, আর অজনা বেসামাল উন্মাদনা যে মেয়েটাকে নিয়ে, বয়স,সম্পর্ক সব কিছুর মাথা খেয়ে বছর ত্রিশের হৃদয়টা যার অনুপস্থিতিতে আনচান করে,যাকে দেখলে সবার অগোচরে অবাধ্য, অপ্রতিরদ্ধ ইচ্ছেরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বারংবার এখন এই মূহুর্তে সেই পিচ্চি অষ্টাদশীকে দেখেই, মস্তিষ্কে হলহলিয়ে বইতে থাকা জল'ন্ত আ'গ্নেয়গি'রির লাভাটা মূহুর্তেই দপ করে নিভে গেলো জায়ান ক্রীতিকের।
ধরনীতে ঝুম বৃষ্টি তখনও একই গতিতে বহমান। অরুর চোখ,নাক, ঠোঁট সব কিছু চুইয়ে চুইয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি কনারা। সফেদ রঙা চুড়িদারটা ভিজে একাকার। ঠান্ডার তোপে তিরতির করে কাঁপছে সরু চিবুক আর গোলাপি রঙা ওষ্ঠাধর। বৃষ্টি ভেজা অরুকে দেখে কয়েকমূহুর্তের জন্য থমকে গেলো ক্রীতিক। সব ছেড়ে ছু'ড়ে হুট করেই রা'গ হতে লাগলো বহমান বৃষ্টি কনাদের উপর। যেগুলো ও আজ পর্যন্ত ছুয়ে দেখতে পারলো না।সেগুলো কিনা বৃষ্টি কনারা এতো সহজে ছুঁয়ে দিচ্ছে? আশ্চর্য ।
বৃষ্টির সাথে ক্রীতিকের ক্রো'ধ বেশিক্ষণ টিকলো না বৈকি। কারন তার আগেই অরু আবারও কথা ছু'ড়লো ওর পানে।
--- কেন এভাবে মা'রছেন ওনাকে? আপনার দয়ামায়া নেই?
অরুর কথায় ক্রীতিক পেছনে ঘুরলো, দেখলো একটা বি'শ্রী কপট হাসি ঝুলিয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে আছে জ্যাকসন। জ্যাকসনের হাসিটা চোখে পরতেই এতোক্ষণের ভ্রম ছুটে গেলো ক্রীতিকের। ও তৎক্ষনাৎ ক্ষী'প্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরুর দিকে। যেন চোখ দিয়েই ঝ'লসে দেবে অরুকে। ক্রীতিকের অ'গ্নিমূর্তি দেখে অরু আড়ালে শুষ্ক ঢোক গিলে থেমে গেলো।
ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
--- তুই এখানে কি করছিস? কে নিয়ে এসেছে তোকে?? ক্রীতিকের কপাল জুড়ে হাজারো চিন্তার ভাঁজ।
অরু এবার পুরোপুরি নিশ্চুপ, মানবতা দেখাতে গিয়ে যে নিজেই ফেঁ'সে গিয়েছে এতোক্ষণে তা বোধগম্য হলো ওর।
ক্রীতিক কিছু একটা ভেবে ক্লাবের একজন কে দিয়ে একটা হেলমেট আনালো, তারপর ওটা অরুকে পরিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
---দ্রুত বাইকে ওঠ।
অরু করুন দৃষ্টিতে জ্যাকসনের দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
--- ওনাকে এভাবে, ফেলে রেখে, না মানে যদি কিছু হয়ে যায়।
-- ওর ব্যাবস্থা প্রত্যয় করবে, আমি বলে দেবো, তুই ওঠ।
বৃষ্টির মাঝেই চারদিকে তাকিয়ে সবাইকে একবার পর্যবেক্ষন করে নিলো অরু। আশেপাশে যত মানুষ, যে যেখান থেকে পারছে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই নিশ্চয়ই অরুর উপর বেজায় চটে গিয়েছে, কিন্তু এই মূহুর্তে ওর হাতে কিছুই নেই, এখন কথা না শুনলে নির্ঘাত এখানে দাঁড়িয়েই ক্রীতিকের হাতে মা'র খেতে হবে, তাই অপারগ অরু, চুপচাপ উঠে পরে বাইকের ব্যাক সিটে। মেয়েদের মতো করেই কাঁচুমাচু হয়ে বসেছে ও। তখনই নিজে হেলমেট পরতে পরতে ক্রীতিক বলে,
---ধরে বস।
অরু, খুব সংকোচে ক্রীতিকের জ্যাকেটটা একটু খা'মচে ধরে।
কিন্তু বাইক তার যায়গা পরিবর্তন করতেই ও এক প্রকার হুমড়ি খেয়ে পরলো ক্রীতিকের পিঠের উপর।
--- ধরে বসতে বলেছিনা?
ক্রীতিকের ধম'ক খেয়ে এবার সত্যিই ওর কাঁধে হাত রাখলো অরু। অরুর হাতের আর কানের ছোট্ট অলংকার গুলো থেকে রিনঝিন আওয়াজ হচ্ছে। খুব কাছাকাছি বসাতে সেই আওয়াজ সোজা গিয়ে ক্রীতিকের হৃদয়ে লাগছে, সেই সাথে অরুর বৃষ্টি ভেজা চুল আর শরীর থেকে ভেসে আসা মেয়েলী সুঘ্রানে কেন যেন ওর দমব'ন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে অরুকে একান্তে কাছে পেতে খুব কাছে।যতটা কাছাকাছি এলে অরুর আর ক্রীতিকের মাঝে সেন্টিমিটার দূরত্ব ও ঘুচে যাবে, ঠিক ততটা। কিন্তু এই মূহুর্তে সেটা সম্ভব নয়, আর না অরুকে এতো কাছে বসিয়ে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব।তাই মনের মধ্যে একান্ত গোপনে বেড়ে ওঠা অবাধ্য বাসনা গুলোকে দূর করার উদ্দেশ্যে, রাইড করতে করতেই নিরবতা ভা'ঙে ক্রীতিক,একটু আগের সেই গমগমে রা'গি আওয়াজের পরিবর্তে নরম আওয়াজে অরুকে শুধায়,
--- আচ্ছা অরু, আমি যে এতোগুলা বছর দুরে ছিলাম তোর আমাকে মনে পরেনি কখনো?
ক্রীতিকের কথার পিঠে অরু কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না, কারন ক্রীতিক যখন দেশ ছাড়ে তখন অরু নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে, কতইবা বয়স হবে দশ কি এগারো।
অরু নিশ্চুপ দেখে ক্রীতিক আবারও শুধায়,
--- বাবার মৃ'ত্যুতে যখন গিয়েছিলাম, তুই আমাকে দেখেছিলি?
এবার অরু সময় নষ্ট না করেই উত্তর দিলো।
---কি করে দেখবো, আপনিতো বাড়িতে যাননি।
ক্রীতিক জবাবে একটু বাঁকা হেসে বললো,
--- আমি কিন্তু তোকে দেখেছি, ঠিক আজকের মতোই একটা সাদা ড্রেস পরেছিলি। তোর মা আমার বাবার জন্য কাঁ'দছিল খুব।তুই আর অনু তার পাশেই দাড়িয়ে ছিলি।
ক্রীতিকের কথায় অরু চমকালো, কারন ওর দেওয়া একটা বর্ননা ও ভুল নয়। অরুর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,
---আপনি কি করে দেখলেন?
কিন্তু ও জিজ্ঞেস করতে ভ'য় পাচ্ছে, পাছে না আবার ক্রীতিক রে'গে গিয়ে এই বৃষ্টির মাঝেই ওকে বাইক থেকে নামিয়ে দেয়।ওদিকে অন্তহীন কৌতুহল গুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করছে অযথাই । তবুও জিজ্ঞেস করার সাহস নেই।কি বলতে কি বলবে আবার রেগে মেগে আ'গুন হয়ে যাবে।তার থেকে চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।
অরুর কূলহীন ভাবনার মাঝেই মাঝ রাস্তায় বাইকের ব্রেক কষলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরুর আত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। মনে মনে ভাবছে,
--- এই রে চুপ থেকেও ভুল করলাম নাকি? এই ঝুম বৃষ্টিতে মাঝরাস্তায় গেট আউট বলে নামিয়ে দিলে , কোথায় যাবো আমি?
---কি হলো নাম! কাঁধ হালকা পেছনে ঘুরিয়ে বলে ওঠে ক্রীতিক।
জবাবে অরু মুখ চোখ কালো করে বললো,
--- না মানে এই বৃষ্টির মাঝে...
অরু কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক বলে,
--- হ্যা বৃষ্টির জন্যই তো, সামনে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, তারউপর এতো ভিজলে জ্বর চলে আসবে নিশ্চিত।
--- না না আমি ঠিক আছি।
--- আমি তোর কথা বলিনি, আমার কথা বলেছি।
এই বলে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটা ক্যাফের করিডোরে গিয়ে আশ্রয় নিলো ক্রীতিক। অরু পেছন পেছন যেতে যেতে ঠোঁট উল্টে মিনমিনিয়ে বললো,
--- আমার কথা কেনইবা বলবেন? নিজেকে ছাড়া আর কিছু বোঝেন নাকি আপনি? সা'র্থপর লোক।
অরু এগিয়ে গিয়ে ক্রীতিকের পাশেই দাঁড়ালো। বৃষ্টি আর বাতাসের গতিবেগ এতোই বেশি দেখলে মনে হবে দিন দুপুরে রীতিমতো ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে।
কাচেঁর দরজার ভেতরে ঝিঁমুতে থাকা স্টাফ ছাড়া পুরো এরিয়াটাই ফাঁকা পরে আছে। চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে অরুর চোখ পড়লো ক্রীতিকের হাতের দিকে,বৃষ্টি আর র'ক্ত একাকার হয়ে টুপটুপ করে হাত দিয়ে ঝরে পরছে র'ক্ত ভেজা পানি।
অরু সেদিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে মনেমনে বললো,
--- আশ্চর্য এই লোকের অনুভূতি শক্তি নেই নাকি? কতক্ষণ ধরে এভাবে র'ক্ত ঝরছে কে জানে??
কিছু একটা ভেবে ব্যাগ থেকে নিজ হাতের নকঁশি কাজ করা শুকনো রুমালটা বের করে একটু সাহস করেই ক্রীতিকের র'ক্তা'ক্ত হাতে বেধে দিলো অরু। ব্যাথা যায়গাতে একটু আরাম অনুভব হতেই নিজ হাতের দিকে চোখ দিলো ক্রীতিক। দেখলো সুতোয় কাজ করা একটা মেয়েলি রুমাল ওর ক্ষ'তস্থানে খুব সাবধানে বেধে দিচ্ছে অরু।
ক্রীতিক বাধা দিলোনা, এমনকি টু শব্দ ও উচ্চারণ করলো না, বরং অরু নিজের কাজ শেষ করে উপরে মাথা তুলতেই চোখ রাখলো অরুর মায়াবী চোখ জোড়ায়।
ক্রীতিকের চোখের ভাষা আপাতত পড়তে পারছে না অরু, ক্রীতিক রে'গে গেলো কিনা সেটাই আপাতত ভাবছে ও। ক্রীতিক ধীর গতিতে নিজের মাথাটা অরুর মুখের সামনে নিয়ে এলো। অনেকটা কাছে, যতটা কাছে এলে অরুর শরীরের মিষ্টি সুঘ্রানটা ক্রীতিক খুব সহজে অনুভব করতে পারে।
অরু ভ'য় পেয়ে একটু অস্পষ্ট সুরে বললো,
---রর..র'ক্ত ঝরছিল তাই ভাবলাম। আপনার আনইজি লাগলে খুলে ফেলতে পারেন, ক..কোন সমস্যা নেই।
অরুর কথায় পাত্তা না দিয়ে চোখে একরাশ মাদকতা নিয়ে অরুর দু’চোখে চোখ রেখে, নিজের মুখটা অরুর কানের খুব কাছে নিয়ে ক্রীতিক হাস্কি স্বরে বললো,
--- এতো বেশি দূর্বল করে দিসনা অরু।নয়তো ক্ষ'তিটা তোরই হবে। আমার হাত থেকে নিজেকে বাঁচা'তে পারবি না। বিশ্বাস কর, আমি খুব করে চাইছি, আজকে অন্তত আমার হাত থেকে বেঁচে যা তুই।
ক্রীতিকের নেশা ধরা কন্ঠস্বর আর তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁপছে অরু। কনকনে ঠান্ডার মাঝে হুট করেই কেমন গড়ম হয়ে উঠলো শরীরটা । জীবনে প্রথম কোনো ছেলে এভাবে এতোটা কাছাকাছি এসেছে অরুর যার দরুন ভেতরে তোলপার হয়ে যাচ্ছে অজানা অনুভূতির দল।এই মূহুর্তে অরুর জন্য মেয়েলী অনুভূতি গুলো সামলানো বেশ মুশকিল। এককথায় দূর্বিসহ।একটা নরম ভেজা অনুভূতি হৃদয় ছুয়ে যাচ্ছে বারংবার , এমন অনুভূতি গুলো আগে কখনোই হৃদয়ে অনুভব করেনি অরু। হুট করেই ক্রীতিকের কাছ থেকেই কেন? কই নিখিল ভাই সামনে এলেতো এমনটা হয়না। তলপেটে হুটহাট প্রজাপতি উড়াউড়ি করেনা। তাহলে জায়ান ক্রীতিকের মতো অপছন্দের লোকটার সান্নিধ্যেই কেন এমন হয়? এটাতো ঠিক নয়, মোটেই ঠিক নয়। ও এই নিস্তব্ধতা আর বেসামাল অনূভুতি গুলোকে মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
--- আপনি কেন আমাকে মা'রতে যাবেন, কি করেছি আমি??
--- কখন বললাম আমি তোকে মা'রবো?
--- এই যে বললেন, আপনার হাত থেকে নিজেকে বাঁ'চাতে পারবো না।
অরুর কথায় ক্রীতিকের ঠোঁটে খেলে গেলো একটা চমৎকার বাঁকা হাসি। ও অরুর থেকে নিজের দূরত্ব খানিকটা বারিয়ে হট করেই অরুকে হ্যাচকা টানে পেছনে ঘুরিয়ে দিলো, তারপর একটানে ওর লম্বা চুল থেকে গার্ডারটা খুলে নিলো নিজ হাতে। সঙ্গে সঙ্গে অরুর দীঘল কালো একঝাঁক ভেজা চুল আঁচড়ে পরলো সমস্ত পিঠ জুড়ে।
অরু সাবধানে পেছনে ঘুরে বললো,
--- চুল কেন খুললেন??
ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দিলো,
---বৃষ্টির দিনে সাদা কেন পরেছিস??
ক্রীতিকের কথার মানে বুঝতে পেরে প্রচন্ড লজ্জায় নিজের দু-হাত ভাঁজ করে নিলো অরু। তারপর বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
--- আর অপেক্ষা করতে হবে না, চলুন বাসায় যাবো।
ক্রীতিক আর কিইবা করবে,মনে মনে ভাবলো, অরুকে এভাবে সরাসরি লজ্জা দেওয়াটা তার উচিৎ হয়নি, যতই হোক অরু ওর থেকে বয়সে অনেক বেশি ছোট।যা বলেছে বলেছে এখন আর করার কিছুই নেই, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ও নিজেও এগিয়ে গিয়ে বাইকে বসে পরলো।
*****************************************
বাড়িতে আসতেই অরু সোজা চলে গেলো নিজের রুমে। রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো অনু ব্যালকনিতে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে আর মুঠো ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। অরু সেদিকে খুব একটা নজর দিলোনা, কারণ অরু জানে ফোনের ওপাশের লোকটা কে।তাই সোজা চলে গেলো ওয়াশরুমে।
একটা আরামদায়ক হট বাথ শেষে চুল মুছতে, মুছতে বের হয়ে দেখলো, মাত্রই কথা শেষ করে রুমে এসেছে অনু। আজ রবিবার তাই ওর পার্টটাইম নেই, তারউপর আবহাওয়ার জন্য হসপিটালেও যেতে পারেনি সকালে। তাইতো আজ অসময়ে বাসায় আছে অনু।
অরু বেরুতেই অনু শুধায়,
--- এভাবে ভিজেছিস কিকরে?
অরু খাটে বসতে বসতে বললো,
--- সে অনেক কথা পরে বলবো। তার আগে তুই বলতো আপা, ক্রীতিক ভাইয়ার মা কোথায়??
অরুর অযাচিত প্রশ্নে অনুর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো, ও সচকিত হয়ে অরুকে বললো,
---- তুই হঠাৎ এসব কথা নিয়ে কেন পরলি, তারউপর ক্রীতিক ভাইয়া এখন বাড়িতেই আছেন, উনি ওনার মায়ের নামটাও শুনতেও পারেননা।
অরু মনে মনে বললো, সত্যিই কি শুনতে পারেননা না? তাহলে মাকে নিয়ে কথা বলায় আজ লোকটাকে ওভাবে মা'রলো কেন?
--- কিরে কি ভাবছিস?
--- আপা, বলনা ওনার মা কোথায়?
অনু একটু ভাবুক হয়ে বললো,
---- আমি খুব বেশি কিছু জানিনারে অরু, মায়ের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, ওনার মা বাঙালি নন, আমেরিকান বংশভূত কোন বিদেশিনী। শুধু বিদেশিনীই নন শোবিজ জগতের কোন নামকরা তারকা।যৌ'বন কালে ক্রীতিক ভাইয়ার বাবা যখন বিদেশে পড়াশোনা করতে আসেন তখনই নাকি ভালোবেসে বিয়ে করেন তারা।
অরু কৌতূহল নিয়ে শুধালো,
--- তাহলে উনি চলে গেলেন কেন??
অনু দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
--- উনি ভালোবেসে বিয়ে সংসার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার কিংবা ফ্যান্সি লাইফস্টাইল কোনোটারই মায়া ছাড়তে পারেননি পরবর্তীতে, তাই খুব ছোট বেলাতেই ক্রীতিক ভাইয়াকে রেখে আবারও নিজ গন্তব্যে পারি জমান তিনি।
অরু, জ্ঞানীদের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
--- ওই জন্যই ক্রীতিক ভাইয়া দেখতে পুরোপুরি বাঙালিদের মতো না।মনে হয় নানা বাড়ির চেহারা পেয়েছে ।
অনু ঠোঁট উল্টে বললো,
--- হবে হয়তো, কিন্তু তুই হঠাৎ এসব নিয়ে পরলি কেন??
ততক্ষনে বিড়াল ছানা ডোরা এসে অরুর পায়ের কাছে লেজ নারছে।
অরু ডোরাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
--- তুই থাক আমি একটু আসছি।
--- আরে কোথায় যাচ্ছিস? চুল থেকে পানি ঝরছে তো, আয় মুছিয়ে দিই। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
পেছন থেকে হাক পেরে যাচ্ছে অনু। তবে অরু আর তাতে কান দিলো না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
****************************************
ডোরাকে কোলে নিয়েই হল রুমে এলো অরু। কিন্তু যখন দেখলো হল রুমে কাউচের উপর ক্রীতিক বসে আছে,তৎক্ষনাৎ ডোরাকে কোল থেকে নামিয়ে অন্যদিকে ভাগিয়ে দিলো ও। ডোরাকে বিদেয় করতে করতে অরু খেয়াল করলো ফাস্টএইড বক্স নিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে ক্রীতিক।
দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই শাওয়ার নিয়েছে, পরনে ব্লু হোয়াইট কম্বিনেশনে টিশার্ট আর থ্রী কোয়ার্টার। মাথার স্টাইলিস্ট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে লেপ্টে আছে। একটু আগে আপার বলা কাহিনি আর ক্রীতিকের ক্ষ'তযুক্ত হাত দেখে কোথায় যেন বড্ড মায়া হলো অরুর। কেন যেন হুট করেই মনে হলো ক্রীতিকের এমন বেপরোয়া, র'গচটা, আর খামখেয়ালি সভাব গুলো নিতান্তই সাভাবিক।
অনেকক্ষণ ধরে অরুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের গলায় ঝোলানো তোয়ালেটা ওর মুখের উপর ছু'রে মা'রলো ক্রীতিক, ভ্রকুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলো,
---- এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন, আমার কি রূপ বেরিয়েছে?
অরু মুখের উপর থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ক্রীতিকের পাশে বসে হাত বাড়িয়ে বললো,
----দিন আমি অসুধ লাগিয়ে ব্যা'ন্ডেজ করে দিচ্ছি।
--- তোর অনেক সা'হস বেড়ে গিয়েছে অরু। আজকাল আমাকে ভ'য় পাসনা দেখছি।
--- তা বলতে পারেন।
ক্রীতিকের যা বলার ইচ্ছে হয় তাই বলতে দিয়ে, নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে ওর পুরুষালী হাতটাকে ধীরে ধীরে সফেদ রঙের ব্যা'ন্ডেজে মুড়িয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো অরু।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১২
পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে। গোধূলির আকাশ সিদূর রাঙা হয়ে আছে। গর্জে ওঠা সাগরের উত্তাল ঢেউ আর শঙ্খচিলের চিউ চিউ গলা ফাটানো আওয়াজ ভেসে আসছে ক্ষনে ক্ষনে। খানিক বাদে বাদে এলোমেলো বাতাসে বালু আস্তরিত সাগর কোল ভিজে যাচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের পানিতে। মাঝে মধ্যে সেই পানি পার ছাপিয়ে এসে আঁচড়ে পরছে মোমের মতো ফর্সা দু'পায়ে। পায়ের সাথে সাথে চিকচিকে বালুতে ভরে যাচ্ছে সুন্দর কারুকাজ করা রুপোলী নুপুর জোড়া। অনু সাগরের কোল ঘেষে নরম বালুতে , "দ" আকারে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাত দিয়ে ভেজা নুপুরটা নাড়াচাড়া করছে সেই কখন থেকে। এতোক্ষণ একাই বসেছিল। তবে একটু আগেই ওর পাশ ঘেঁষে বসে পরে প্রত্যয়। হাতে দুটো বাবল টি এর জার।
একটা বাবল টি'তে স্ট্র ঢুকিয়ে অনুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে প্রত্যয় বলে,
--- এখানকার বাবল টি অনেক ফ্যামাস,টেস্ট ইট।
অনু হাত বাড়িয়ে সেটা গ্রহন করে নিঃশব্দে একটা সিপ নেয়, আসলেই মজার চা টা।কিন্তু এতো বড় জারে চা কে খায়? ভাবছে অরু।
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে প্রত্যয় বললো,
--- এবার বলুন, হঠাৎ করে এই অধমের তলব কেন করলেন?
---- তার আগে আপনি বলুন, এতদূরে কেন নিয়ে এলেন? আমিতো স্রেফ হসপিটালের সামনে ওয়েট করতে বলেছিলাম।
অনুর জবাবে প্রত্যয় হেসে বলে,
--- আপনি কি করে ভাবলেন যে, শুধু মাত্র দেখা করেই আমি ক্ষান্ত হবো?
প্রত্যয়ের কথার জবাবে, অনু একটু ব্যাথাতুর হেসে বললো,
--- আমার জীবনটা সামনে থেকে দেখতে যতটা সহজ আর সাবলীল মনে হয় ততটাও সহজ নয়,প্রত্যয় সাহেব। হুটহাট ডেটে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে একাকী সময় কাটানো কোনোটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
আপনি হয়তো আরও একটা জিনিস জানেন'না আমি আন্ডার গ্রাজুয়েট। ইন্টারমিডিয়েটের পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি আমার।
--- এগুলো আমাকে কেন বলছেন?
অনু রোবটের মতো জবাব দেয়,
--- আমি নিজেও জানিনা আপনাকে কেন এসব বললাম, শুধু মনে হলো বলা উচিৎ।
প্রত্যয় সাগরের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো,
--- তারমানে আপনি বুঝতে পারেন আমি আপনার জন্য কি ফিল করি তাইতো?
অনু জবাব দিলো না, বরং আগের ন্যায় মাথাটা এলিয়ে দিলো দু'হাটুর উপর, অহেতুক তাকিয়ে রইলো অন্যদিকে।তখনই কানে এসে পৌঁছালো প্রত্যয়ের ডিপ ভয়েস।
---- আমাকে সময় দিতে হবেনা, আমার সাথে সারাদিন কথা বলতে হবে না,আমাকে প্রেমিক ভাবতে হবেনা, প্রেমিকার মতো আবদারও মেটাতে হবেনা, আমার খোঁজও নিতে হবে না, শুধু একটা শর্ত।
প্রত্যয়ের কথায় বেশ কৌতুহল বোধ করলো অনু, তাই এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো প্রত্যয়ের পানে।
প্রত্যয় আগের মতোই সাগরের পানে চেয়ে বললো,
---- একজীবনে আমি ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের কথা কল্পনাতেও ভাবা যাবেনা।
--- ব্যাস এইটুকুই?
প্রত্যয়, অনুর হাটুতে এলিয়ে দেওয়া মুখের পানে চাইলো, সূর্যের নিংড়ানো শেষ আলোটুকু ধ'নুকের ন্যায় তীর্যক হয়ে আঁচড়ে পরছে অনুর চোখে মুখে। ঘন পল্লব বিশিষ্ট আঁখি দু'টো টল-টল করছে অশ্রু জলে। সোনালী আলোর ছটা আঁচড়ে পরে ছলছলে চোখ দুটো ঝিলিক দিচ্ছে বারবার, কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রত্যয়ের মনে হলো, এগুলো কোন চোখ নয়, বরং গহীন অভ্যায়রন্যের মাঝে দুটো জংলা দিঘী, কাঁচের মতোই স্বচ্ছ সেই দিঘীর মায়াবী জল।এই দিঘীর মায়াতে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়সে অকপটে। প্রত্যয়ও নিজেকে হারিয়ে ফেললো অনুর দীঘির মতো টলটলে চোখে, অতঃপর অনুর প্রশ্নে আস্তে করে জবাব দিলো,
--- ব্যাস এটুকুই।
অনু এবার সার্থপরের মতো বললো,
--- বিপরীতে আমি কি পাবো??
--- যা চাইবেন তাই।
অনু আড়ালে চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বুক ভরে সাগর পারের স্নিগ্ধ বাতাস ভেতরে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর জিভ দিয়ে নিজের শুকনো অধর ভিজিয়ে বললো,
--- আমি আপনার শর্তে রাজি আছি প্রত্যয় সাহেব। বিনিময়ে আমারও যে কিছু চাই।
---কি চাই?
---- আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবেন?এখন এই মূহুর্তে?
অনুর মুখশ্রী জুড়ে অসহায়ত্বের ছাপ সুস্পষ্ট।খুব অল্প বয়সে অনেক বেশি ভারী দায়িত্ব বহন করতে করতে ক্লান্ত মেয়েটা। অথচ এতো কিছুর পরেও দিনশেষে নিেজর ছেলেমানুষী, নিজের আবদার কোনোটাই তুলে ধরার যায়গা ওর নেই। মা বোন থেকেও পৃথিবীর বুকে বড্ড একা এই অনু। ওর স্নেহের প্রয়োজন, দিন শেষে ক্লান্ত শরীরটাকে আগলে রাখার জন্য দুটো বাহুর প্রয়োজন।আর এই মূহুর্তে ও সেটাই চায়। অন্য কিছুই নয়, না কোনো শারীরিক চাহিদা, না কোনো কমিটমেন্ট, না সারপ্রাইজ, না কোন আয়োজন। কিচ্ছু না, ওর শুধু একটা বাহুডোর আর একটুখানি স্নেহের পরশ প্রয়োজন।
আশ্চর্যজনক হলেও প্রত্যয় অকপটে তা দিতে সায় জানালো, তৎক্ষনাৎ উপর নিচ মাথা দুলিয়ে অনুকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো সে,পরম আবেশে একহাত বুলিয়ে দিলো অনুর মাথায়, আর তারপর আরো খানিক টা গভীর ভাবে ছুয়ে দিলো ওর ছোট্ট কপালটাকে। কপালের মাঝ বরাবর একটা উষ্ণ আর গভীর চুমু এঁকে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো প্রত্যয়।
তখনও সাগরের ঢেউয়ের তালেতাল মিলিয়ে বাড়ছিল অনুর কা'ন্নার গতিবেগ ।
*****************************************
ড্রেসিং টেবিলের সামনে মুখ কালো করে অসহায়ের মতো বসে আছে অরু। ওর ঠিক সামনে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে দক্ষ হাতে, সুন্দর ফর্সা গালে একে একে প্রাইমার,ফাউন্ডেশন, কনসিলার,ব্ল্যাশ আর হাইলাইটারের আস্তরণ লাগিয়ে যাচ্ছে এলিসা।
অরু মেকআপ বলতে ওই সান্সক্রীন আর লিপস্টিক ছাড়া তেমন কিছু ব্যাবহার করেনি কখনো। করতে যে খুব ভালো লাগে তেমনটাও নয়। ওর কাছে সাজুগুজুর চেয়ে স্কিন কেয়ার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাইতো এতো ক্যা'মিক্যাল মিশ্রিত মেকআপ লাগানো হয়না কোনো কালেই।তবে আজ যখন এলিসা নিজে থেকে এসে বললো সাজিয়ে দিবে, তখন আর না করতে পারেনি অরু। চুপচাপ ভদ্রমেয়ের মতো গিয়ে বসেছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে।
মনেমনে ভাবছে ক্রীতিক আদৌও জানেতো যে ও এলিসার বার্থডে পার্টিতে যাচ্ছে।
এই খানিকক্ষণ আগের কথা। ভার্সিটি থেকে ফিরে মাত্রই ফ্রেস হয়ে বেরিয়েছিল অরু। বাড়িতে আপাতত ক্রীতিক, অনু কেউই নেই।
অনু আজকাল দেরি করে ফিরলে অরু তেমন একটা ভাবেনা, কারন ওর দৃঢ় বিশ্বাস প্রত্যয় ভাইয়া অনুকে ঠিক দেখে রাখবে,কোনো অযাচিত বিপদে পরতেই দেবেনা। আর ক্রীতিকের চিন্তা করে লাভ নেই, সে তো কখন ফেরে আবার কখন বেরিয়ে যায় তার কোন হদিসই জানেনা অরু।
কেউ নেই দেখে অরু একাই কিছু একটা সহজে বানিয়ে খাবে বলে কিচেনে পা বাড়িয়েছিলো কেবল। ঠিক তখনই আগমন ঘটে এলিসার। ভেতরে এসে এলিসা জানায়, আজ তার জন্মদিন। অরু সম্মোহনী হাসি দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে,এলিসা বলে ও অরুকেই নিতে এসেছে। অর্নব নাকি এলিসার জন্য ছোটখাটো একটা পার্টির এ্যারেঞ্জ করেছে।
অর্নব পার্টি এ্যারেঞ্জ করেছে কথাটা মাথায় আসতেই খানিকক্ষন আগের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চট করে এলিসাকে প্রশ্ন করে বসে অরু,
---- অর্নব ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে তাইনা আপু?
অরুকে খুব যত্ন করে আই শ্যাডো লাগিয়ে দিতে দিতে এলিসা বলে,
--- পছন্দ টছন্দ কিছুইনা, পাগলটা হুদাই আমার পেছনে পরে আছে।
---- পছন্দ করে দেখেই পিছনে পরে আছে আপু,আর তাছাড়া তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে কে না পছন্দ করে?
--- তুমি আমার থেকে কোনো অংশে কম নও অরু, বরং অনেকটা বেশি।তুমি ন্যাচারাল বিউটি, আর আমিতো সবসময় মেকআপে ঢেকে থাকি।তাছাড়া তোমার চুল দেখেই তোমার স্বামী তোমার প্রেমে পরে যাবে, আ'ম ড্যাম সিওর।
অরু লাজুক হেসে বলে,
---আপসোস কেউ পরলো না।
----পরবে পরবে, আর একটু বড় হও ঠিক পরবে, তখন ক্রীতিকের নিজের বোনকে পাহারা দেওয়ার জন্য পেছনে হাজারটা বডিগার্ড লাগিয়ে রাখতে হবে।
--- উনি আমাকে বোন হিসেবে পরিচয় দিতে চায়না আপু, তাই আমিও চাইনা যেচে পরে কারও বোন হতে।
নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব আসে অরুর দিক থেকে।
--- ওর কথা বাদ দাও, জেকে সব সময়ই এমন করে,বেশি ভাব দেখায়। আসো তোমার চুল গুলো ঠিক করে দিই।
অরু বুঝলো ক্রীতিকের কোনো খারাপ অভ্যাসই, এদের কাছে দোষের নয়। তাই আড়ালে ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলে ও।
নিজের পরিপাটি চেহারাটা আয়নায় দেখে, অরু বলে,
--- অর্নব ভাইয়া তো ভালো মানুষ, তাহলে তাকে কেন ক'ষ্ট দিচ্ছো আপু।
অরুর চুলে হেয়ারব্রাশ চালাতে চালাতে এলিসা বলে,
--- আমারও এই একটাই আপসোস জানোতো। অর্নবের মতো ছেলে আমার মতো একটা মেয়েকেই কেন পাগ'লের মতো ভালোবাসে দুনিয়াতে কি ভালো মেয়ের অভাব ছিল?
অরু চকিতে পেছনে ঘুরে শুধালো,
--- মানে?
-- তুমি প'কার প্লেয়ার মানে বোঝো?
অরু অজ্ঞাতদের মতো এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো।
--- জু'য়া চেনো নিশ্চয়ই ? কার্ড দিয়ে যে খেলে?
একটা শুষ্ক ঢোক গিলে, অরু এবার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,
--- হ্যা!টট...টিভিতে দেখেছি।
আমি ওটাই খেলতাম অরু। ইভেন যেমন তেমন নয়,আজ পর্যন্ত প'কার খেলে আমাকে কেউ বিট করতে পারেনি। প'কার প্লেয়ারদের কাছে আমি সেলিব্রিটিদের মতোই। ওরা আমার একটা অটোগ্রাফের জন্য তৃষ্ণার্থ চাতকের মতোই অপেক্ষা করে থাকে। আর যে সেটা একবার পেয়ে যায়, তার ডিমান্ডও বেড়ে যায়।
অরু পেছনে ঘুরে এলিসার হাত ধরে বললো,
--- আপু এটাতো খা'রাপ কাজ তাহলে বেরিয়ে কেন আসছো না??
এলিসা জোরপূর্বক হেসে জবাব দেয়,
--- আমি ছাড়তে চাইলেও এই বিভীষিকা ময় খেলার জগত আমার পিছু ছারছে না অরু।
*****************************************
স্ফটিকের লাল,নীল, সবুজ আলোয় ঝিকমিক করছে পুরো হল রুমটা। কিছু কিছু নজর কাড়া লাইট সফ্ট মিউজিকের তালেতালে জ্বলছে আবার নিভছে। আর্টিফিশিয়াল বেবি পিংক কালারের থীমটা ভালোই মানিয়েছে লাইটিং এর সাথে। এককথায় চোখ ধাদানো ব্যাপার স্যাপার। হলরুমটা মানুষদ্বারা পরিপূর্ণ , বেশিরভাগই জোড়ায় জোড়ায়। তবে এতো এতো চিকচিক আলোয় কারোরই মুখ দেখে চেনার জো নেই। না এই মূহুর্তে অরু কারো মুখ দেখার মতো অবস্থায় আছে, এর কারন, ওর দৃষ্টি আড়াল করে শক্ত চোয়াল আর অ'গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপন করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক।
দেখে মনে হচ্ছে পাবলিক প্লেস না হলে এই মূহুর্তে খুব বড়সড় সিনক্রিয়েট করতো সে।
অরু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এলিসা ওকে রেখে কই যে উধাও হয়ে গেলো সেটাই ভাবছে আপাতত।
--- চুপ করে থাকিস না অরু, কথা বল ? আমাকে না জানিয়ে এখানে কোন সাহসে এলি তুই?
ক্রীতিকের আকস্মিক ধ'মকে অরু, মাথা তুললো,
একটা ব্ল্যাক ভেলভেট পার্টি জ্যাকেট পরে আছে ক্রীতিক। ঘার অবধি চুল গুলো জ্যাকেটের সাথে ম্যাচিং করেই সেট করা। মনে হচ্ছে কোন হেয়ারস্টাইলিস্ট এর সূক্ষ হাতের কাজ এটা।
তবে ক্রীতিককে দেখতে যতটা ড্যাশিং লাগছে, ওর সুন্দর হ্যান্ডসাম রাগী চেহারাটা দেখতে ততটাই ভ'য়ানক লাগছে। সুন্দর বড়বড় ছোট দুটি যেন জ'লন্ত অ'ঙ্গার।
অরু ভেবে পায়না ও করেছেটা কি? এলিসা নিতে গিয়েছে দেখেই তো এলো। তাহলে এতো রাগের কি আছে, আর সব ব্যাপারেই কেন ক্রীতিককে জানাতে হবে? কি হয় ক্রীতিক ওর? এইরকম শাসন করার মতো এতোটাও তো ক্লোজ ওরা নয়, তাহলে?? মনে মনে ক্রীতিকের উপর খুব বি'রক্ত হলো অরু। অজানা কারনে জিভটা নিম পাতার মতোই তেঁতো ঠেকলো ওর। তাই ইচ্ছে করেই মৌনতা পালন করলো ক্রীতিকের হাজারটা প্রশ্নের জবাবে।
--- অরু আমাকে রাগাস না, তুই এখানে কি করছিস? এভাবে আমাকে না জানিয়ে আর কোথায় কোথায় যাস তুই ?কি হলো জবাব দে?
অরু চুপ রইলো এবারও। কিন্তু ক্রীতিক আর নিজের রা'গ সংবরণ করে রাখতে পারলো না, পকেট থেকে হাত বের করে চেপে ধরলো অরুর নরম চিকন হাতটা। তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে কথা ছুড়লো এলিসা,
---- কি করছিস জেকে।
ক্রীতিক অরু সমেত এলিসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
--- ওকে এখানে নিয়ে এসে কাজটা তুই একদম ঠিক করিস নি এলিসা? তুই ভালো করেই জানিস আজকে পার্টির পেছনে আমাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে, আর সেখানে তুই আমার দূর্বলতা টেনে নিয়ে এলি? হোয়াই?
এলিসা লম্বা একটা শ্বাস টেনে অরুকে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
--- যদি কিছু হয়, সেটা আমার সাথে হবে, অরুর সাথে নয়,তাছাড়া, কিছু যে হবে তাও তো সিওর না, তাহলে আমার বার্থডে টাকে নরমাল বার্থডে পার্টি কেন ভাবতে পারছিস না? আর সবচেয়ে বড় কথা অরু ছোট বাচ্চা নয়, তুই সবসময় ওকে এভাবে ডমিনেট করিস কেন বলতো?
ক্রীতিক তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দিলো,
--- কারণ ও আমার।
--- বলা হয়েছে? এবার আমরা আসছি।
এলিসা কিংবা অরু কেউই ক্রীতিকের কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়েই ওখান থেকে চলে গেলো।
দু'হাত মুঠি বদ্ধ করে রেখে পেছন থেকে বিড়িবিড়িয়ে ক্রীতিক বললো,
--- সাবধানে এলিসা, সি ইজ মাই হার্টবিট।
*****************************************
পার্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি, বরং সবাই জমিয়ে আনন্দ করেছে, কেক কে'টেছে খাওয়া দাওয়া হৈ-হুল্লোড় করে অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছে। পুরোটা সময়ই অরুকে সাথে সাথে রেখেছে এলিসা, সেই সাথে চোখে চোখে রেখেছে অন্য আরেকজন।
আজ প্রথমবার ক্রীতিক বোধ করলো ও খুব দূর্বল হৃদয়ের, অন্তত অরুর ক্ষেত্রে তো তাই। পুরো পার্টিতে ঘুরে ফিরে ওর দুচোখ অরুতেই নিবদ্ধ ছিল । কয়েক সেকেন্ডের জন্যেও যদি অরু চোখের আড়াল হয়েছে তো ক্রীতিকের মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হৃদয়টা এক্ষুনি ব্লা'স্ট করবে।
কিন্তু এখন এই মূহুর্তে ক্রীতিক নিশ্চিন্তে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে ড্রিংক করছে, কারন অরু ওর চোখের সামনেই বসে আছে, যদিও ওদের মাঝে দূরত্ব বেশ অনেকটা, তবুও চোখের সামনে তো আছে। ক্রীতিক যখন নির্বিগ্ন বসে বসে এসব ভাবছিল,তখনই বল ড্যান্সের ঘোষনা করা হয়।
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বল নাচ খুবই জনপ্রিয়। আজকাল বাংলাদেশেও বিভিন্ন পার্টি কিংবা অনুষ্ঠানে কপোত-কপোতীদের বল নাচের আয়োজন করা হয়। কিন্তু অরু কিভাবে নাচবে? একেতো পার্টনার নেই তার উপর বোকার মতো জরজেট শাড়ি পরে এসেছে। তাই বসে বসেই সবার পারফরম্যান্স দেখতে লাগলো ও।
ঠিক তখনই ক্রীতিকের দৃষ্টি আড়াল করে অরুর সামনে এসে দাঁড়ালো সায়র। রাজকুমার দের মতো করে মাথাটা হালকা নুইয়ে ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে অরুকে শুধালো,
-- লেটস হ্যাভ আ ডান্স।
অরু না করতে চাইলো, কিন্তু না করাটা মূর্খতার লক্ষন, সবার সামনে না করে দিলে সবাই ওকেই আনস্মার্ট ভাববে, তাছাড়া সায়র ও অনেকটা লজ্জিত হবে। সেই ভেবে ও নিজেও হাত বাড়ালো বল নাচের উদ্দেশ্যে। তবে সায়রের হাতের মাঝে আর হাত রাখা হলোনা ওর, তার আগেই মসৃণ হাতটা ঈগলের মতো ছোঁ মে'রে নিজের হাতে নিয়ে এলো ক্রীতিক। সায়রকে ইচ্ছা করেই ধা'ক্কা মে'রে দাড়িয়ে পরলো অরুর সামনে।
হুট করে একদম হুট করে, চোখের পলকে ঘটনাটি ঘটায়, কিছুই ঠাহর করতে পারলো না অরু, শুধু দেখতে পেলো ওর হাতটা সায়র নয় ক্রীতিক ধরে আছে।
অরু সচকিত হয়ে কিছু বলতে চাইলো, তবে তার ফুরসত দিলোনা ক্রীতিক। টেনে নিয়ে গেলো বল নাচের স্টেজে।
অরুর এক হাত নিজের কাধে রেখে, নিজের শক্ত হাতটা ছোঁয়ালো অরুর লতানো কোমড়ে। অন্যহাত ঢুকিয়ে দিলো অরুর পাঁচ আঙুলের ভাঁজে। বল নাচের মঞ্চটা ছিল পুরো পুরি অন্ধকার। ফেইরী লাইটের ম্যাজিকাল আলো ছায়ায় কোন কিছুই খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। অরুও দেখতে পেলো না, ক্রীতিকের আ'গুন ঝরা চোখ জোড়া ওর শরীরের স্পর্শ পেয়ে মূহুর্তেই কতোটা কামুকতায় ডুবে গিয়েছে।
ব্যাকরাউন্ডে তখন সবার প্রিয় বাংলা গানের দুটো লাইন বাজছিল,
"হালকা হাওয়ার মতোন চাইছি এসো এখন..
করছে তোমায় দেখে.. অল্প বে'ঈমানী মন
বাঁধবো তোমার সাথে... আমি আমার জীবন। "
ওরা দুজনও তখন সফ্ট মিউজিকের তালে তালে পা মেলাচ্ছে নির্দ্বিধায় । কি জানি হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলো দুজন। এতো জড়তা, এতো দূরত্ব, এতো প্রতিকূলতা সব কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। পাছে শুধু পরে রইলো দু'টো অশান্ত মন।
ক্রীতিক নাচের তালে তালে অরুকে ঘুরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
---তুই সত্যিই অসাধ্য সাধন করতে পারিস অরু, আমাকে দিয়ে কেমন ডান্স করিয়ে ছাড়লি।
অরু নাচের মুদ্রা অনুসরন করতে করতে ক্রীতিকের পেশিবহুল ঢেউ খেলানো বুকে দুহাত রেখে বললো,
--- কেন এলেন? আপনার সাথে নাচতে আমার ভ'য় করছে বড্ড ।
ক্রীতিক এবার অরুকে নিজ বাহুতে ছেড়ে দিয়ে, আবারও কাছে টেনে নিয়ে এলো, খুব কাছে । হুট করে টান দেওয়াতে অরুর রেশমের মতো লম্বা খোলা চুল গুলো আঁচড়ে পরলো ক্রীতিকের চোখে মুখে। অরুর মাতাল করা চুলের সুবাস ছড়িয়ে পরলো ক্রীতিকের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
ক্ষনিকের নিরবতা ভে'ঙে ক্রীতিক অরুকে আঙুলের মাথায় ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
--- আজকের পার্টিতে না এলে হতোনা? তুই কি ঠিক করেই নিয়েছিস?আমাকে এ জীবনে টেনশন ফ্রী থাকতে দিবিনা?
অরু দু'হাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে নাচের তালে তালে বললো,
--- আমি আপনাকে একদম বুঝতে পারিনা।আপনি কি আসলেই জায়ান ক্রীতিক?
ক্রীতিক এবার অরুকে টেনে একটু খানি আলোতে নিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
--- কি করে পারবি, বুঝতে চেয়েছিস কখনো আমায়?
---কি'করে বুজবো? আপনি যে রহস্যময় মানব।
অরুর কথা বিপরীতে কোনো জবাব দিলোনা ক্রীতিক। তার বদলে নিজ হাতে অরুর গাড়ো নীল জরজেট শাড়িতে লাগানো ব্রোঞ্জটা খুলে দিলো একটানে, সঙ্গে সঙ্গে পাতলা আঁচলটা কোমর ছাড়িয়ে নিচে পরে গেলো।
ক্রীতিক ওর আঁচল গলিয়ে উন্মুক্ত কোমরে আলতো হাত ছুয়িয়ে বললো,
--- আমার জিনিস অন্য কাউকে দেখানোর কোন অধিকার তোর নেই।
অরু সেই কখন থেকেই ক্রীতিকের নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো ওর চোখের ভাষা পড়তে চাইছে। কিন্তু জায়ান ক্রীতিক চৌধুরীর চোখের ভাষা পড়া কি এতোটাই সহজ?
অরু পড়তে পারলো না, উল্টে হুট করেই মনে পরে গেলো সেদিন বৃষ্টি ভেজা দুপুর বেলার কথা। সেই একই চোখ, একই হাস্কি কন্ঠস্বর, একই ভেজা অনুভূতি। অরুর হৃদমাঝারে আবারও তোলপাড় শুরু হয়েছে খুব। পেটের ইতিউতি উড়ছে অবাধ্য প্রজাপতির দল।
ক্রীতিক ওর সাথে কি করেছে,কি বলেছে কিছুই মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছায়নি অরুর। ও তো ক্রীতিকের চোখেই ডুবে ছিল। ডুবে থাকতে থাকতেই উপলব্ধি করলো ক্রীতিকের চোখ দুটো বড্ড নে'শা ধরানো আর কাতরতা জড়ানো। কোন এক অজানা চৌম্বকীয় শক্তির দ্বারা ক্রীতিকের চোখ দুটো ওকেখুব করে টানে,হৃদয়টা বেসামাল করে তোলে বারবার। কিন্তু কি এমন আছে ওই ভাসমান গোলগোল চোখে? ভেবে পায়না অরু।
---- অরু?
ক্রীতিকের হঠাৎ ডাকে কম্পিত হয়ে উঠলো অরুর শরীর,নিজের হুশ খেয়াল ফিরে পেয়ে কোথায় যাবে কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না খানিকক্ষণ । এখনো ক্রীতিকের বাহুতেই সিটিয়ে আছে অচল শরীরটা। চোখ মুখ লজ্জায় র'ক্তবর্ণ ধারন করেছে। কপালে বসানো স্টোনের বিন্দির আশেপাশে বিন্দু বিন্দু ঘামের ছড়াছড়ি। কার চোখের দিকে এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিল ও? ক্রীতিকের? যে কিনা সম্পর্কে ওর মায়ের সৎ ছেলে ছি ছি।
ক্রীতিক নিজেও এই মূহুর্তে কৌতুহলী আর প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে ওর পানে।
অরু একঝলক ক্রীতিকের ফর্সা ড্যাসিং চেহারার দিকে তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে বিড়বিড়িয়ে বললো,
--- দয়া করে এভাবে তাকাবেন না, আমার কেমন যেন লাগে, আপনি যতই সুদর্শন হোননা কেন এটা কখনোই সম্ভব নয়।
নিজের মনে কিছু একটা বলে, ক্রীতিকের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে ওই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলো অরু।
পেছনে ক্রীতিকের জন্য শুধু খুলে পরে রইলো অরুর এক পায়ের চিকন রুপোলী নুপুর।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১৩
শীত পেরিয়ে সেই কবেই বসন্ত নেমেছে ধরনী জুড়ে। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার জগাখিচুড়ী আবহওয়ায় সেই বসন্ত খুব একটা উপভোগ্য নয়। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর থেকে দু কদম বাইরে দিলেই যেন যত্রতত্র শীত বুড়ি এসে জড়িয়ে নিচ্ছে আষ্টেপৃষ্টে।
দীর্ঘদিন ধরে বইতে থাকা শীতের সেই দাঁত কাঁপানো কনকনে হাওয়াকে হটিয়ে , আজ সকাল সকাল বাসন্তিক হিমেল হাওয়া বইছে পুরো ক্যালিফোর্নিয়া টু সানফ্রান্সিসকো জুড়ে। নাক চেনে বুক ভরে বাতাস নিলে মনে এটা শহুরে জনবহুল স্টেট থেকে আসা কোন দূষিত বাতাস নয়,বরং প্রশান্ত মহাসাগর ছাপিয়ে আসা বিশুদ্ধ দক্ষিনা বাতাস।বাতাসের তালে তাল মিলিয়ে ভেসে আসছে চেরিব্লোসমের দারুণ মিষ্টি সুবাস।হাইওয়ে বা জনবহুল কোনো ফুটপাত কিংবা নামি দামি কর্পোরেট অফিস, চেরিব্লোসমের কারনে আজকাল সব যায়গাকেই কেমন ফুলের বাগান মনে হয়।
বছর তিনেক আগে কেনা ক্রীতিকের ডুপ্লেক্স বাড়িটার ফ্রর্ন্ট ইয়ার্ডেও দু'টো চেরিব্লোসম গাছ রয়েছে। কালো ফেঞ্চ গেইটটার দুইধারে পাহারাদারের মতোই সর্বক্ষন পাহাড়ায় দাড়িয়ে তারা। বসন্ত হওয়ার দরুন চেরিব্লোসমের ভারে কেমন নুয়িয়ে পরেছে গাছ দুটো।
অরু একঝলক গেইটের দু'পাশে ব্লোসম সজ্জিত গাছের দিকে তাকাচ্ছে, তো পলক ফেলে আবার ক্রীতিকের দিকে।
যে এই মূহুর্তে কপাল কুঁচকে রেখে, শক্ত মুখে অরুর দিকেই তাকিয়ে আছে।
ফর্মাল ড্রেসআপ, হাতে ম্যাকবুক, চোখে মুখে কঠিন বিরক্তির ছাপ, গত পাঁচ মিনিট যাবত এভাবেই চলমান মূর্তি হয়ে হলরুমে দাঁড়িয়ে আছে ক্রীতিক।
আর অরু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের মুখের পানে, যেন ক্রীতিক জাদুঘরে সংরক্ষিত কোন বিশেষ বস্তু, সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখলেই নয়।
তবে ক্রীতিকের মতো রগচটা মানুষের কাছে ব্যাপারটা বেশ বিরক্তি কর। কথা নেই বার্তা নেই পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্রেইঞ্জ।একটানা একই যায়গায় বিনা বাক্যে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে এতোক্ষণে সেই বিরক্তি কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে পৌঁছালো সপ্তম আসমানে, ক্রীতিক নিজের তীক্ষ্ণ চোয়ালে আরও খানিকটা তীক্ষ্ণতা ধারণ করে বললো,
--- সেই কখন থেকে পথ আটকে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস,কি সমস্যা?
চোখে কয়েকবার পলক ফেলে, ঢকাত করে এটা শুকনো ঢোক গিলে অরু শুধায়,
--- ভাবছি, আপনি কি আসলেই কালকের সেই মানুষটা?? যে ওভাবে বল নাচ...
--- শাট আপ।
ক্রীতিকের ধ'মকে অরুর কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো।
---আমি বয়সে তোর থেকে কত বড় তা খেয়াল না রেখেই যা মুখে আসছে তাই বলে দিচ্ছিস,স্টুপিড একটা।
ধ'মক খেয়ে অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
--- আপনি বড় সেতো আমিও জানি, আর তাইতো আরও বেশি আশ্চর্য হচ্ছি, কালকের আপনাকে তো আমি চিনতেই পারছিলাম না,জানেন? কেমন কেমন যেন লাগছিল আপনাকে, আর ওই চোখ গুলো।
অরু হাত উচিয়ে ক্রীতিকের চোখে ইশারা করতেই ক্রীতিক ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেলে, তারপর গমগমে আওয়াজে বলে,
--- জ্ব'রটা এখনো আছে তাই ভুলভাল বকছিস, আজ আর ভার্সিটি যেতে হবে না।
অরু নিজ ভ্রুকুঞ্চিত করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে, মুখে বির'ক্তির ছাপ টেনে ক্রীতিকের আদেশের ঘোর বিরো'ধীতা করে বললো,
--- ভার্সিটি যাবোনা মানে? দেখছেন সকাল সকাল রেডি বেরিয়েছি, তাও বলছেন ভার্সিটিতে যাবোনা?
--- তোর শরীরটা ভালো নেই তাই বলছি, নয়তো তুই কোথায় যাবি, না যাবি সেসবে আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই।
অরু নিজের গাল গলায় হাত ছুয়িয়ে বললো,
--- এতোটুকু জ্বরে কিছু হবেনা। সরুন তো আমি ভার্সিটি যাবো, আজ নিখিল ভাইয়ের সাথে ট্যুরের ব্যাপারে দরকারি কথা বলার আ...
তপ্ত গালে খরখরে হাতের শ'ক্ত চা'প অনুভব করতেই অরুর কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো,ক্রীতিকের হঠাৎ আ'ক্রমনে স্ব স্থান থেকে কয়েককদম পিছিয়ে অরুর পিঠ গিয়ে ঠেকলো কাঁচ লাগানো প্রসস্থ দেওয়ালে,ক্রীতিক এমন ভাবে চোয়াল চে'পে ধরেছে যেন মনে হচ্ছে এখনই গাল ফেটে র'ক্ত বেরিয়ে আসবে।
ক্রীতিক নিজ হাতের বাধন ঢিলে না করেই রুষ্ট কন্ঠে বললো,
--- আমি বলেছি," না" তার মানে না'ই।কথার উপর পাল্টা যুক্তি আমার একদম পছন্দ নয় অরু। একদিন একটু নরম বিহেভিয়ার দেখেছিস বলে এইনা যে, আমি প্রতিদিন সেটা কন্টিনিউ করবো। এখন যেটা দেখছিস এটাই আমি, রুড,উ'গ্র, বেপরোয়া। আর এই রুড মানুষটাকেই সারাজীবন সহ্য করতে হবে তোর। এন্ড দিস ইজ মাই সেকেন্ড টাইম ওয়া'র্নিং। নেক্সট টাইম আর ওয়া'র্নিং দিতে আসবো না ডিরেক্ট একশন নেবো,মার্ক মাই ওয়ার্ড।
অরুর মুখ থেকে অস্পষ্ট সুরে কথা বেরুলো এতোক্ষণে,
--- উমম লা..লাগছে আমার..
ক্রীতিকের হঠাৎ প্রতিক্রিয়াটা ভেতর থেকে এসেছিল,তাই নিজেও বুঝতে পারেনি ও অরুকে নিজ হাত আর কথার দ্বারা ঠিক কতটা ব্যাথা দিচ্ছে।
তবে খানিকক্ষণ আগে অরুর বলা," লাগছে আমার" কথাটাই যথেষ্ট ছিল ক্রীতিকের গ'র্জে ওঠা অ'গ্নিস্ফু'লিঙ্গতে শীতল জলের ছাট দেওয়ার জন্য। ক্রীতিক নিরবে অরুর গালটা ছেড়ে দিতেই অরু নিজের নরম গাল দুটোতে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্ত সুরে অস্ফুটে বললো,
--- সারাজীবন তো দূরে থাক, উপরওয়ালার ইচ্ছায় মা সুস্থ হয়ে গেলে, আপনার মতো মানুষের সাথে এক ছাদের তলায়, তারপর আর এক মূর্হুত ও নয়।
অরুর বিড়িবিড়িয়ে বলা বাক্যটা ক্রীতিক খুব ভালো ভাবেই শুনলো, অতঃপর নিজ পকেটে দুহাত গুঁজে রেখে সটান দাড়িয়ে ঘাড়টা একটু কাত করে জবাব দিল,
--- বিলিভ মি অরু, তুই শুধু আমার সাথে এক ছাঁদ নয়,আরও অনেক কিছু শেয়ার করবি। তাও নিজ ইচ্ছাতে, আই সয়ার।
অরু এবার আর মুখে কোনো কথায়ই উচ্চারণ করলো না,বরং মনে মনে বললো,
--- এই জীবনে অন্তত তা হবে না। মা সুস্থ হয়ে গেলেই দেশে ফিরে যাবো আমরা। তারপর আপনি আর আপনার বোরিং জীবন, দুটোর হাত থেকেই রেহাই পাবো আমি আর আপা।
অরু এখনো দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক বললো,
--- এবার পথ ছাড়, নয়তো কাঁ'ধে তু'লে গেইটের বাইরে ফে'লে রেখে আসবো।
অরু তৎক্ষনাৎ সরে দাঁড়ায়। অরু সরতেই ক্রীতিক গটগট পায়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো পেছনে তাকিয়ে অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
--- টেইক সাম রেস্ট,ইউ আর উইক।
ভার্সিটি যেতে দেয়নি দেখে অরুর মেজাজ এমনিতেই সপ্তম আসমানে চড়ে ছিল, ক্রীতিকের দরদী কথায় তাতে যেনো আগু'নে ঘি ঢালার উপক্রম হলো,ও তেতিয়ে উঠে বললো,
--- মোটেই আমি উইক না বুঝেছেন, মেয়ে মানুষ বলে এতো স'স্তা ভাববেন না, লাগতে আসলে আপনাকেও দু'হাতে তুলে গেইটের বাইরে ফে'লার ক্ষমতা আমি রাখি।
ক্রীতিক পেছনে না তাকিয়েই চোখের উপর সানগ্লাস বসাতে বসাতে বিড়বিড়িয়ে বললো,
--- সময় হলে সে ক্ষমতা নিশ্চয়ই দেখবো জান।
কথাটা বলার সময় ক্রীতিকের ঠোঁটের কোনে দৃশ্যমান ছিল সেই মনোমুগ্ধকর বাঁকা হাসি।
*****************************************
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। সকালের পর থেকে অরুর জ্ব'রটা বেড়েছে দিগুণ অথচ পুরো বাড়িতে কেউ নেই। কি করে থাকবে? অনু ডাক্তারের আর্জেন্ট কলে সেই সকাল সকাল হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে এখনো ফেরার নাম নেই। আর ক্রীতিকের থাকা না থাকা অরুর জন্য সমান কথা।কারন আর যাই হোক অরু জ্বরে জ্ঞান হা'রিয়ে পরে থাকলেও ক্রীতিকের মতো মানুষ অন্তত ওকে সেবা করতে আসবেনা,নিশ্চয়ই?
সেই সকাল থেকে হল রুমের কাউচে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অরু, শরীরের প্রচন্ড দাপদাহে সারাদিনে কিছু খাওয়ার ইচ্ছাও হয়নি আর। ক্রীতিকের ভ'য়ে ভার্সিটি না গিয়ে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, ভার্সিটিতে বসে এমন জ্ব'র বেড়ে গেলে তো মহা মসিবত হতো। পাছে না আবার সেদিনের মতো ভরা ক্যাম্পাসে সবার সামনে অজ্ঞান হয়ে পরে গিয়ে মানসম্মানের বারোটা বেজে যেতো ।
জ্বর ওঠার মূহুর্তটা রোমাঞ্চকর,আপাতত সেই রোমাঞ্চকর সময়টাই পার করছে অরু। গড়ম কম্ফোর্টারের মাঝে শুয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাথায় কিলবিল করছে হাজার খানেক প্রশ্ন। কখনো অজান্তেই মনে পরে যাচ্ছে বাংলাদেশের আঁকাবাকা মেঠোপথ, তো কখনো আরাম প্রিয়, সংস্কৃতি মনা, নানা বৈশিষ্ট্যের অধিকারি নিজ দেশের সরলমনা মানুষ গুলোর কথা। বাঙালি, সংস্কৃতি এসব ভাবতেই অরুর মনে পরে যায়, কাল পার্টিতেও কোনো একটা বাংলা গান বাজছিল, তারপর ক্রীতিকের মাঝেই যেন অন্য কেউ হানা দিলো, একজোড়া মাদকতা জড়ানো বেসামাল নিস্প্রভ চোখ। যে চোখে কয়েকমূহুর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল অরু। আর তারপর? তারপর ওর সাথে যে ভ'য়ং'কর আর বা'জে কাহিনিটা ঘটলো। যার
ফলস্বরূপ এখন এই মূহুর্তে একশো তিন ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্ব'রে ঝ'লসে যাচ্ছে অরু।
জ্বরে পুড়'তে পুড়'তেই হঠাৎ বোধ হলো,কালকে ক্রীতিকের অনুমতি ছাড়া পার্টিতে যাওয়া মোটেই উচিৎ হয়নি ওর। হাজারো চিন্তার মাঝেই অরুর বুক চিড়ে বেড়িয়ে এলো একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস। ঠিক তখনই কানে ভেসে আসে পাসওয়ার্ড টিপে মেইনডোর খোলার পিকপিক আওয়াজ। কে এসেছে দেখার জন্য অরু কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়েই উঠে বসলো, তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের নাম করে হাঁক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে ভেতরে প্রবেশ করলো এলিসা।
এলিসার চোখে মুখে রা'গের ছাপ স্পষ্ট।রা'গের তোপে এই মূহুর্তে নাকের ডগাটা তিরতির কাঁপছে ওর। অরু এলিসার অ'গ্নি মূর্তি দেখে খানিকটা ভরকালো,অতঃপর সাহস জুগিয়ে শুধালো
--- কোন সমস্যা আপু?
এলিসা দোতলার করিডোর থেকে চোখ সরিয়ে অরুর পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঠকাঠ আওয়াজে জিজ্ঞেস করল ,
--- জেকে কোথায় অরু?
--- সকালেই ভার্সিটিতে গেলো।
মিনিমিনিয়ে জবাব দেয় অরু।
অরুকে ভারি কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে থাকতে দেখে এলিসা নিজের রা'গী ভাব আড়াল করে নরম কন্ঠে শুধায়,
--- তুমি ঠিক আছো অরু, কাল শুনলাম তুমি নাকি সে'ন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে? কিন্তু কেন? আমিতো তোমাকে সাথে সাথেই রেখেছিলাম সারাটাক্ষন মাত্র কয়েক মূহুর্তের জন্য ক্লাবের বাইরে গিয়েছিলাম তাও অত্যাধিক প্রয়োজনের বশবর্তী হয়ে। এর মাঝে তুমি কি এমন দেখলে যে এভাবে জ্ঞা'ন হারালে? বলো আমাকে?
অরু হাসার চেষ্টা করে বললো,
--- আমি বদ্ধ কিংবা আটকানো যায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা আপু,দ'ম ব'ন্ধ হয়ে আসে। সে কারনেই তো প্রতিদিন মায়ের কাছে যাই না, সপ্তাহে একবার করে যাই।
এলিসা সচকিত হয়ে বললে,
--- কে আটকে রেখেছিল তোমায়??
এলিসার প্রশ্নে অরুর মুখটা পাংশুটে রূপ ধারণ করলো।ও কেন যেন জবাব দিতে চাইলো না।
এলিসা আবারও অরুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ফোন কল চলে আসাতে জিজ্ঞাসাবাদ পর্বের এখানেই ইতি ঘটে। এলিসা ফোন কানে তুলে মেইনডোর দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে অরুর উদ্দেশ্যে বললো,
--- আমি একটু তাড়ায় আছি অরু। নেক্সট টাইম এসে শুনবো।
এলিসা চলে যাওয়াতে অরু যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো। জ্ব'রের ঘোরে এটা ওটা এতো প্রশ্নের মোটেই উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না অরুর,এলিসা চলে গিয়েছে ভালোই হয়েছে।
মুখে আটকে রাখা দমটা এক নিঃশ্বাসে বের করে দিয়ে, আবারও সাবধানে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো অরু। ঠিকঠাক হয়ে শুতে শুতে অস্ফুটেই বললো,
--- এলিসা আপু হঠাৎ ক্রীতিক ভাইয়ার খোজ করছে কেন? তাও বাড়ি বয়ে এসে?ফোন করলেই তো হয়, অদ্ভুত মানুষ।
*****************************************
ভার্সিটির গেইটে এসে দাড়াতেই সিকিউরিটি গার্ডটা এলিসার পথ আটকে দাঁড়ালো। অতঃপর প্রশিক্ষন প্রাপ্ত রোবটের ন্যায় একনাগাড়ে বললো,
--- সরি ম্যাম, আইডি কার্ড ছাড়া ভেতরে প্রবেশ এলাউ না।
এলিসা মাথা নিচু করে কথাটা শুনলো, অতঃপর নিজের এ্যাথলেটিক পাঁচ আঙুল মু'ঠিবদ্ধ করে সিকিউরিটি গার্ডের নাক বরাবর একনাগাড়ে দুই তিনটা পা'ঞ্চ বসিয়ে কটমটিয়ে বললো,
--- কে আটকাবে আমায়??বল কে আটকাবে?
এলিসার শক্ত হাতের ঘু'ষি খেয়ে সিকিউরিটি লোকটা সেখানেই পরে রইলো, আর এলিসা ঢুকে গেলো ক্যাম্পাসের ভেতর।
ভার্সিটিতে নিজের অফিস রুমে বসে ম্যাকবুকে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে ক্রীতিক। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার দরুন, সুন্দর চোখ দুটো স্ক্রীনেই আটকে আছে,সেইসাথে খানিক বাদে বাদে অজান্তেই দাঁত দিয়ে নিজের অধর কা'মড়ে ধরছে ও। ব্যাপারটা বেশ চমৎকার দেখাচ্ছে। এই দৃশ্যটা এক পলক দেখলে যে কোন মেয়ের মুখ থেকেই বেরুবে একটা বাক্য,
--- হাউ ম্যানলি।
তবে এলিসা তো কোন সাধারন মেয়ে নয়,বরং আস্ত একটা ডে'ঞ্জার। তাই ওর এসবে খেয়াল ও কম।আর এই মূহুর্তে এলিসা নিজের মেয়েলি চেহারার নিচে আসল রূপটা দেখিয়েও দিলো, ও ক্রীতিকের কেভিনের দরজাটা সশব্দে খুলে, জেকে বলে চেঁচিয়ে উঠলো ।
ক্রীতিক ওর দিকে চোখ না ঘুরিয়েই শান্ত স্বরে বললো,
--- হোয়াটস রং চেচাচ্ছিস কেন? এটা বিদ্যাপিঠ ভুলে গিয়েছিস?
এলিসা ধাপধাপ পায়ে দু'কদম এগিয়ে এসে বললো,
--- তুই ক্যাথের সাথে এটা কেন করেছিস ক্রীতিক?
--- কি করেছি?
ক্রীতিকের দায়সারা উত্তর শুনে বিরক্ত লাগছে এলিসার। তবুও চোখ বন্ধ করে নিজেকে খানিকটা সংবরণ করে বললো,
--- তুই ক্যাথলিনের চুল কেন কে'টে দিয়েছিস?তাও এমন ভাবে কে'টেছিস মেয়েটার ন্যাড়া হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
এলিসার কথায় আপাতত ক্রীতিকের কোনো হেলদোল নেই, ও মনদিয়ে ম্যাকবুকে কিছু একটা টাইপ করে যাচ্ছে এক নাগারে।
এলিসা এবার রে'গে ক্রীতিকের ডেস্কের উপর সজোরে বারি মেরে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
--- পা'গলামির একটা সীমা থাকে ক্রীতিক। তুই যখন যা করিস আমরা তোকে সবসময় সাপোর্ট করে যাই।হোক সেটা ভালো কাজ কিংবা খারাপ। তাই বলে এতোটা জ'ঘন্য কাজ? তুই কি আদৌও জানিস একটা মেয়ের কাছে তার চুল কতোটা মূল্যবান? চুল হারানোর দুঃখে মেয়েটা লিটরেলি সুই'সা'ইড করতে গিয়েছিল। ক্যান ইউ ইমাজিন?
এবার ম্যাকবুক থেকে চোখ সরিয়ে কথা পারলো ক্রীতিক,
--- একজ্যাকলি আই ক্যান ইমাজিন। এন্ড দ্যাটস হোয়াই আই ডিড ইট। কারণ ক্যাথলিনেরও বোঝা উচিৎ অন্যকারও চুল
আমার কাছেও ঠিক কতোটা মূল্যবান।
মখমলের ন্যায় মসৃণ কন্ঠস্বর অথচ কথার পরতে পরতে তীব্র রা'গের বহিঃপ্রকাশ।
এলিসা বি'রক্ত হয়ে বললো,
---তোর কথার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার জেকে। প্লিজ এই হাইড এন্ড সিক গেইমটা এবার অফ কর।
ক্রীতিক কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
--- খুলেই তো বললাম, আমিই ক্যাথলিনের চুল কে'টে দিয়েছি।
--- কেনো কে'টেছিস?
কারণ ক্যাথলিন অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলো। থ্যাংকস টু সায়র এন্ড অর্নব ভুলটা করার আগেই ওরা ঘটনাস্থলে চলে আসে। ক্যাথলিন যে ভুল করার সাহস দেখিয়েছে তারজন্যই স্রেফ ছোট্ট একটু শা'স্তি দিলাম।
ক্রীতিকের ঘুরানো প্যাঁচানো কথার জট খুব বেশি খোলা হলোনা এলিসার, তার আগেই কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড এসে ক্রীতিককে আর্জি জানিয়ে বলে,
--- স্যার উনি, গেইটের সিকিউরিটি গার্ডকে মে'রে ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। কতৃপক্ষ থেকে ওনাকে ধ'রে ক্যাম্পাসের বাইরে বের করে দেওয়ার অর্ডার এসেছে ।
এলিসা চোখ ছোটছোট করে ক্রীতিকের তাকিয়ে ইশারা করে বললো,
--- কিরে বল আমি তোর ফ্রেন্ড?
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে একবার এলিসার ইশারা'রত মুখের পানে চাইলো তারপর সিকিউরিটির পানে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,
--- যা বলা হয়েছে তাই করুন, টেনে টুনে নিয়ে যানতো। সেই কখন থেকে এসে কানের মাথা খাচ্ছে, পা'গল মনে হয়।
এলিসা ক্রীতিকের দিকে তে'ড়েমে'রে এসে বললো,
--- জেকের বাচ্চা আমাকে তোর পা'গল মনে হয়?
তবে খুব বেশি কাছে আসার আগেই সিকিউরিটিরা সবাই মিলে ধরে ওকে টান'তে টান'তে নিয়ে গেলো একেবারে ক্যাম্পাসের শেষ মাথায় গেইটের কাছে।
ক্রীতিক থাই লাগানো জানালার সামনে দাড়িয়ে কফি পান করতে করতে সে দৃশ্য দেখেই ঠোঁট কাম'ড়ে হাসছে। হাসতে হাসতেই চোখ মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেলো ওর। এতোক্ষণের হাস্যোজ্জল গৌড়বর্ণ মুখটা ক্ষনিকের মাঝেই কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেলো, মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো কাল সিসিটিভি ক্যামেরায় ব'ন্ধি অযাচিত মূহুর্ত গুলো।সেই সাথে কালকের পার্টিতে ঘটে যাওয়া ছোট বড় প্রত্যেকটা ঘটনা।
.
.
কাল বল নাচের সময় অরুকে এতোটা কাছে পেয়ে ক্রীতিক নিজের মধ্যে ছিলনা। অজান্তেই আটকে গিয়েছিলো অরুরময় ভ্রমের গোলকধাঁধায়। সবসময়ের বাধ্য মস্তিষ্কটাও তার তাল হালিয়ে চলে গিয়েছিল অ'বাধ্য মনের বশে।
তারপর অরু যখন ওভাবে দৌড়ে চলে গেলো,তখনই সম্বিত ফিরে পায় ক্রীতিক, ফিরে আসে কঠিন বাস্তবতায়।তবুও কোন এক অযাচিত বি'পদ থেকে অরুকে প্রটেক্ট করতেই পিছু নিয়েছিল ওর। কিন্তু অরু স্টেজের পেছনে চলে গেলেও ক্রীতিকের আর যাওয়া হয়নি সেদিকে, তার আগেই ওকে ডেকে ক্লাবের বাইরে নিয়ে যায় এলিসা। নিয়ে যাওয়ার অবশ্য যথাযথ কারন ছিলো, তাই মনের মাঝে হাজারটা দিধা থাকা সত্বেও ক্রীতিকের যেতে হয়েছিল এলিসার সাথে।
*****************************************
ওদিকে অর্নব আর সায়র এলিসাকে খুঁজতে খুঁজতেই ব্যাক স্টেজে এসেছিল। কারণ এই পার্টিতে ওদের একমাত্র মিশন আর ভীষণ এলিসাকে প্রটেক্ট করা,কিন্তু আপসোসের বিষয় এলিসা ওদের থেকে ক্রীতিককে বেশি ভরসা করে। সায়র আর অর্নব যখন ব্যাকস্টেজের অন্ধকার করিডোর দিয়ে পা টিপে টিপে এগুচ্ছিলো, তখনই পাশের রুম থেকে কারও গো'ঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে সেদিকে দৌড়ে যায় ওরা,
রুমটা তখন পুরোপুরি অন্ধকার ছিলোনা, ভেন্টিলেটরের থেকে আসা বাইরের মৃদু আলোতে ওরা ভালোভাবেই দেখছিল ফ্লোরে অগোছালো হয়ে পরে মৃদু আওয়াজে কাতরাচ্ছে কেউ। দেখে মনে হচ্ছে খুব চো'ট পেয়েছে কিন্তু কোথায় পেয়েছে?? ব্যাপারটা বোঝার জন্য ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতেই অরুর মুখটা দেখে আঁ'তকে ওঠে সায়র। সায়র কে এভাবে শকট হতে দেখে অর্নব শুধালো,
--- কিরে আঁ'তকে উঠলি কেন?
সায়র চোয়াল শক্ত করে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
--- অর্নব এটাতো অরু, ক্রীতিকের স্টেপ সিস্টার।
--- হ্যা তাই তো দেখছি, কি হলে বলতো মেয়েটার?
সায়র অর্নবের কলার চে'পে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
--- তাইতো দেখছি মানে? খবরদার এটা যাতে জেকের কান অবধি না পৌঁছায়,তাহলে তোর এ্যারেঞ্জ করা এই পার্টি ফার্ট ল'ন্ডভন্ড করে দিতে ও এক সেকেন্ডও ভাববে না, এখন চল তারাতারি ওকে সারিয়ে তুলতে হবে।
অর্নব সায়রের হাত টেনে থামিয়ে দিয়ে,
--- ওয়েট, তুই এতো প্যানিক হচ্ছিস কেনো? তাছাড়া ও স্টেপ সিস্টার হয় জেকের। আ...
সায়র ওকে মাঝে পথেই থামিয়ে দিলো, দেওয়ালেরও কান আছে এমন মুখভঙ্গিমা করে বললো,
--- তুই ভুল ভাবছিস অর্নব, ওসব সিস্টার ফিস্টার কিছুইনা। জেকে এই মেয়েটার প্রতি লিটরেলি অবসেশট। এই মেয়েটার জন্য ওর পা'গলামি তুই নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না, ও সবার সামনে এমন ভাব দেখায় যেন, হি ডিডন্ট ফা'কিং কেয়ার,বাট এক্সুয়ালি হি কেয়ার, নো নো কেয়ার ইজ আ লেইম ওয়ার্ড এর থেকেও বেশি কিছু।
অর্নব সায়রের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,
--- আজ বোধ হয় তুই একটু বেশিই খেয়েছিস সায়র, ক্রীতিক? হাটুর বয়সই একটা মেয়ের প্রতি অবসেশট?তাও যার সাথে কিনা সম্পকের দিক দিয়ে ওর দা-কুমড়া সম্পর্ক।আর তুই এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?হাহ!
একটা উপহাসের হাসি বেড়িয়ে এলো অর্নবের ঠোঁট গলিয়ে।
তবুও যদি তুই হতি তাহলে একটা কথা ছিল। ক্রীতিকের মতো পার্সোনালিটিতে কোনোরূপ কম্প্রোমাইজ না করা মানুষ কিনা নিজের অর্ধেক বয়সী স্টেপ সিস্টারের প্রতি অবসেশট হাহাহা,ভেরি নাইস জোক্স।
অর্নবের যুক্তির পেছনে সায়র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, আচ্ছা তোকে বিশ্বাস করতে হবে না, এটলিস্ট আমার কথাটা রাখ ব্যাপারটা ক্রীতিককে জানানো যাবেনা, কোন ভাবেই না।
--- কি জানানো যাবেনা আমাকে সায়র?
পেছনের দরজা থেকে ক্রীতিকের চমৎকার পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সায়রের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।আড়ালে শুকনো ঢোক গিলে সায়র শুধালো,
---জজেকে তুই এখানে হঠাৎ?
ক্রীতিক এগিয়ে আসতে আসতে জবাব দিল,
--- হুম একজন কে খুজছি। অর্নব সরতো,কে পরে আছে ওখানে?
এতোক্ষণ সায়রের কথায় মজা নিলেও এখন কেন যেন অর্নবের ও একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে। তাই ও নিঃশব্দে সরে গেলো।অর্নব সরতেই অরুর মলিন অবচেতন মুখটা দৃশ্যগত হলো ক্রীতিকের। খানিক্ষন আগে একটু একটু কাতরালেও এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ অরু। মায়বী,কোমল গোলগাল মুখটায় ফ্যাকাশে ছাপ সুস্পষ্ট। ক্রীতিক টু শব্দও না করে, চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে আলগোছে কোলে তুলে নিলো অরুর তুলতুলে নরম অসার শরীরটাকে।অর্নব সায়র কেউই ক্রীতিকের নিস্তব্ধতা নিতে পারছে না,এ যেন ঝ'ড়ের পূর্ব লক্ষন।
--- কে করেছে এটা?
ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে সায়র জবাব দিলো,
--- জানিনা, হঠাৎ কারও গো'ঙানির আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলাম আর এসে দেখলাম অরুকে।
ক্রীতিক অরুকে নিয়ে ওই রুম ত্যাগ করতে করতে রু'ষ্ট কন্ঠে অর্নবকে আদেশ করার মতোই বললো,
--- পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ গুলো সেন্ড করবি আমাকে।কোনো অন্ধকার রুমের ফুটেজও যাতে বাদ না থাকে।
*****************************************
ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর ঘর ছুঁই ছুঁই। বাইরে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। রাস্তাটা পুরোপুরি নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। একের একের সোডিয়ামের নিয়ন আলো পেছনে ফেলে সামনে এগুচ্ছে ক্রীতিকের কালোরঙা মার্সিডিজটা। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে,খুব সাবধানে প্যাসেঞ্জার সিটে অরুকে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়েছে ক্রীতিক। মাথাটা সাবধানে রেখে দিয়েছে গাড়ির ব্যাকসিটে।
যাতে অরুর কোনোরূপ কষ্ট না হয় তাই হাইওয়ে রাস্তাতেও খুব অল্প স্পিডে ড্রাইভ করছে ক্রীতিক। কিন্তু ভেতরের কুন্ডলী পাঁকানো ক্রো'ধের তোপে বারবার নিজের অজান্তেই সেই স্পিড বেড়ে যাচ্ছে দিগুণ। পরক্ষণেই অরুর মলিন অচেতন মায়া মায়া মুখের পানে তাকিয়ে সে স্পীড কমিয়ে আনছে পুনরায়।
এমন ভাবেই মেজাজের তারতম্য চলছিল পুরো রাস্তা জুড়ে, কিন্তু হঠাৎ করেই ফোনের ভাইব্রেট আওয়াজ পেয়ে পুরোপুরি গাড়ি থামিয়ে দিলো ক্রীতিক। অতঃপর ব্লুটুথ কানে লাগিয়ে ফোনের ভিডিওস চেইক করতে করতে বললো,
--- হ্যা বল অর্নব।
অর্নব ক্ষীণ আওয়াজে বলে,
--- বলছি যে, যে এই কাজটা করেছে তার সাথে কি করবি?
ক্রীতিকের ফোনে ততক্ষণে আসল কা'র্লপিটের চেহারা ভেসে উঠেছে,
--- তাকে তার কাজের পারিশ্রমিক দেবো।
চোয়াল শ'ক্ত করে কথার জবাব দিয়ে,কল কেটে, ভিডিওতে মনোযোগ দিলো ক্রীতিক,যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ক্যাথলিনের মুখের সামনে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালানো, ও প্রথমে অরুকে রে'খেমে'গে কিছু বলে তারপর জামার আড়াল থেকে কিছু একটা বের করে অরুর মুখের সামনে স্প্রে করতেই অবচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অরু। অরু যখন পুরোপুরি অচেতন ঠিক তখনই এর থেকেও ভ'য়ংকর কাজ করতে উদ্যত হয় ক্যাথলিন। ও কোথা থেকে যেনো একটা কাঁ'চি এনে অরুর চুল গুলো মু'ঠিবদ্ধ করে ধরে সেগুলো কা'টার জন্য উদ্যত হবে, ঠিক তখনই সায়র আর অর্নব চলে আসে ওখানে, আর ক্যাথলিন লুকিয়ে পরে ডেকোরেশনের স্তুপাকার কাপড় চোপরের আড়ালে।
ক্রীতিক পুরো ভিডিওটা দেখে বিড়বিড়িয়ে বললো,
--- তারমানে ক্যাথলিন এখনো পার্টিতে উপস্থিত।
অতঃপর মোবাইলটা আগের যায়গায় রেখে অবচেতন অরুর দিকে খানিক ঝুঁকে গিয়ে মৃদু আওয়াজে ক্রীতিক বলে,
---আমার কথা কেন শুনিস না বলতো? কে আছে এই দুনিয়ায়, যে আমার মতো করে তোকে প্রটেক্ট করবে?
ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসটাকে বের করে দিয়ে ক্রীতিক অরুর মুখটা তীক্ষ্ণ চোখে খুব কাছ থেকে পড়খ করে বলে,
--- আ'ম সরি হার্টবিট। বাট আই উইল টেইক রি'ভেঞ্জ।
*****************************************
গতকাল রাতের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে হাতের কফিটা শেষ হয়ে গিয়েছে টের পায়নি ক্রীতিক। কিন্তু যখন টের পেলো মগটা পুরোপুরি খালি হয়ে গিয়েছে তখন ও কফি হীন চ্যাটচ্যাটে মগটার দিকে তাকিয়ে কপট হেঁসে বললো,
--- সরি ক্যাথলিন, তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কাজিন, কিন্তু তুমিতো খুব বড় ভু'ল করেছো, আমার দূর্বলতায় হাত দিয়ে ফেলেছো, তাই ছোটখাটো শা'স্তি তো তোমাকে পেতেই হতো।
ক্রীতিক নিজ কথা শেষ করে সিরামিকের কফির মগটা আস্তে করে ফেলে দিলো মেঝেতে, সঙ্গে সঙ্গে বিকট ঝনঝন আওয়াজে মুখরিত হলো পুরো অফিস রুম। এতোকিছুর পরেও ক্রীতিকের মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন গেঁথেই রয়,
সব কিছু রেখে শুধুমাত্র অরুর চুলই কেন কা'ট'তে গিয়েছিল ক্যাথলিন?
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১৪
দিনের অন্তিম প্রহর চলমান। সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গিয়েছে সেই কবেই। তাও সূক্ষ্ম সোনালী মিয়িয়ে যাওয়া আলোর ছঁটা দেখে মনে হয় রাত নামেনি,এখনো সন্ধা বেলাতেই আটকে আছে প্রকৃতি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ আলোটুকু হানা দিলেও পুব আকাশে ঠিক তার বিপরীত।সেথায় ঘন-কালো মেঘ গুরগুর করছে, এক পলক তাকালে মনে হয় এখনই তুফান ধেয়ে আসবে।
ভর সন্ধ্যা বেলা মেঘমল্লার গুরগুরানি আর দমকা হাওয়া পেছনে ফেলেই বাসায় ফিরেছে ক্রীতিক। সাধারণত সপ্তাহে তিনদিন ম্যাক্রোকোনোমিক্স এর উপর ক্লাস থাকে ক্রীতিকের। এছাড়া বাকিটা সময়, পাহাড়ি দূ'র্গম কোন রাস্তায় বাইক রাইডিং নয়তো অন্ধকার রুমে শুয়ে বসে অডিও বুক শুনে কাটিয়ে দেয় ও। নিজের একঘেয়ে জীবনটা বর'ই অপ্রীতিকর ক্রীতিকের কাছে।মাঝেমধ্যে ই মনে হয়, এমন জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই শ্রেয়।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেওয়া ক্রীতিকের আশেপাশে মানুষের অভাব ছিলোনা কোনো কালেই।তবুও সে ছিল চিরাচরিত একা। এতো টাকা, পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স ক্ষমতা সব কিছুই ওর কাছে মূল্যহীন ছিল বরাবরই, বুঝ হবার পর থেকে কোনদিন কোনো আবদার অপূর্ণ থাকেনি ক্রীতিকের। হোক সেটা ন্যায় আবদার কিংবা অন্যায়।এই সোনায় মোড়ানো জীবনে ক্রীতিক আজন্ম যেটা পায়নি সেটা হলো, ভালোবাসা,আদর, স্নেহ আর পরিবার নামক অদৃশ্য বন্ধন। যার দরুন ছোট থেকেই নরম হৃদয় তৈরি হওয়ার জন্য সকল উপকরণ সর্বেসর্বা বাদ দিয়ে, স্কুল, কলেজ,ভার্সিটি সব খানে তৈরি করেছে নিজের ক্ষমতা আর নেতৃত্বের প্রভাব। নেতৃত্ব আর কতৃত্বের মাঝে র'ক্ত মাং'সের হৃদয়টা কবেই যে পাথর রূপ ধারণ করেছে তা টের পায়নি ক্রীতিক। ঢাকা দক্ষিণের প্রাক্তন মেয়র তারউপর বর্তমান মন্ত্রী জামশেদ জায়ান চৌধুরীর একমাত্র ছেলে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। পাবলিক ভার্সিটির বাঘা বাঘা ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে এলাকার ছোট বড় পাতি নেতা,সবাই সমীহ করে চলতো নর্থসাউথে পড়া অবাঙালি চেহারার ক্রীতিককে। পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে যে কোন চায়ের আড্ডা কিংবা মিছিল মিটিং ক্রীতিকের নাম ছিল সবার মুখে। দিন আর রাত নেই, মা'রামা'রি কা'টাকা'টি, মিছিল মিটিং থেকে শুরু করে সব কিছুতে ক্রীতিকের এক ইশারায় সবাই তৎক্ষনাৎ হাজির হতো বিনাবাক্যে। সে সসময়ে পুরান ঢাকার রাস্তাঘাটে সবাই একই বুলি আওরাতো,
----জামশেদ জায়ানের বডিগার্ডের দরকার নেই ,তার ছেলে একটাই একশো।
একটা অপারগ, অনিশ্চিত, হৃদয় নিংড়ানো অদম্য কষ্টকে হটাতে হৃদয়টাকে পাথর বানিয়ে, নেতৃত্বের জয়জয়কারে তখনও ভালোই ছিল ক্রীতিক।উঠতে বসতে দলের লোকেদের ভালোমন্দ খেয়াল রাখতে রাখতে সময় কে'টে যেত ওর।
কিন্তু আটবছর আগে হঠাৎ করে হৃদয়ে অরুর আগমন, আর অরুর সাথে করা সেই ছোট্ট একটা ভুলের জন্য সব ছাড়তে হয়েছিল ওকে।নিজের বাড়ি,নিজের দেশ,নিজের কতৃত্ব, নিজের দল, নিজের লোক সব,সবকিছু।
সবকিছু ছেড়ে হাজার মাইল দূরে এসে,ধরাবাধাহীন ক্রীতিক কে বন্ধী হতে হয়েছিল আমেরিকার মতো নিয়মতান্ত্রিক সমাজে। তখন থেকেই মানুষের উপর ক্রীতিকের চরম বি'রক্তি। তখন থেকেই ওর কাছে ভালোবাসার মানেই স্বার্থ হাসিল। স্বার্থের পৃথিবীতে নিঃস্বার্থে ভালোবেসে বুকে টেনে নেওয়ার মানুষের উপস্থিতি কল্পনা বইকি কিছুই না। প্রথম দিকে আমেরিকার দিন গুলো ক্রীতিকের জন্য ছিল, ভ'য়ংক'র ক:ষ্টদায়ক আর বিভৎস। যে ক্রীতিক ডানে বামে, পেছনে, মানুষ ছাড়া এককদম বাইরে পা বাড়াতো না, সে নিজের জন্য একটা হাউজ মেইড কিংবা সার্ভেন্ট পর্যন্ত নিয়োগ দেয়নি। আমেরিকা আসার পরেই যোগাযোগ ছিন্ন করেছে দেশের প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেকটা শুভাকাঙ্খীর সাথে।এমন কি নিজের বাবার সাথেও। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে কক্ষব'ন্ধী দূর্বিষহ জীবন কাটিয়েছে ও । এভাবে দিন মাস যেতে যেতে একটা পর্যায়ে এসে উ'গ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে ক্রীতিক। হুট করে রে'গে যাওয়া, যাকে তাকে একটুতেই আ'ঘাত করে বসা, দিকভ্রান্তের মতো বাইক রাইড করা থেকে শুরু করে নিজেই নিজের হা'ত কাঁ'টা কি করেনি ও। ক্রীতিক যখন নিজেই নিজের জন্য অনিরাপদ হয়ে পরে,তখনই এঞ্জেল এর মতো আবির্ভাব ঘটে ওরই মতো ছ'ন্নছাড়া আরও তিনজন মানুষের। তাদের জীবনেও ভালোবাসার বড্ড অভাব। একেকজনার জীবন যেন একেকটা ট্রা'জেডী।
এলিসা, অর্নব আর সায়রই পরক্ষনে সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শে একটু একটু করে, সাভাবিক করে তোলে ক্রীতিককে। ওই জন্যই তো ক্রীতিকের হাউজ পাসওয়ার্ড প্রতিবার হ্যা'ক করে ওরা। আর সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ মতেই প্রত্যেক উইকএন্ডে একজন না একজন চলে আসে জনমানবহীন শুনশান এই শহরতলীতে।
আর অরু? সেতো তখন খুব ছোট ক্রীতিকের পুরুষালী হৃদয়ে হঠাৎ করে জন্মানো অজানা মায়া, অজানা অনূভুতি, অজানা আসক্তি কিছুই ওর বোধগম্য নয় তখন। তবুও ক্রীতিকের অরুর উপর আকাশসম রা'গ,জি'দ আর অভিমানের ছড়াছড়ি। আট বছর পরে এসেও না ও অরুকে ভুলতে পেরেছে আর না নিজের রা'গটা অরুর উপর ঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছে।এতোবছর পর আবারও আটকা পরেছে বহুদূরে ফেলে রেখে আসা সেই পুরনো মায়াডোরে।কেনইবা পরবে না? অরুর প্রতি ক্রীতিকের আসক্তি টা যে এক দুদিনের নয়, তারউপর অরু এখন সদ্য যৌবনে পা রাখা অষ্টাদশী রমনী। ক্রীতিক যখন মায়ায় পরেছিল তখন নিতান্তই কিশোরী অরু, গরন বরন ও তেমনই ছিল।
আর এখন, সর্বাঙ্গে রূপের ছড়াছড়ি তার।
কি নেই? ভালোবাসা হীন একাকী হৃদয়ের ক্রীতিকের অদম্য বাসনা পূরনের জন্য সব কিছুই উপস্থিত ওর মাঝে। তাহলে ক্রীতিক কেন পারছে না খুব সহজে অরুকে আপন করে নিতে? ক্রীতিক তো সমাজের নিয়ম কিংবা নি'ন্দা কোনোটাতেই পরোয়া করেনা কোনোকালেই , তবুও হৃদমাঝারে কেন এই পাহাড়সম দূরত্ব ? আপাতত নিজ মন গহীনের অযাচিত প্রশ্নের কোন উত্তরই নেই ক্রীতিকের কাছে। তাই পেছনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, ভেতরের দীর্ঘশ্বাস নিংড়ে বের করে পাসওয়ার্ড টিপে মেইন ডোরের লক খুলে ঘরের দিকে পা বাড়ায় ক্রীতিক।
*****************************************
পুরো হলরুম না,পুরো বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। তিমিরে ঢাকা ঘরের দুয়ারে পা রাখা মাত্রই, পায়ের কাছে নরম কিছুর অনুভূতি হতে, ভ্রুকুঞ্চিত করে নেয় ক্রীতিক। তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে জ্বলতে থাকা সবুজ চোখ জোড়া দেখে বুঝতে পারে এটা অরুর নেউটে বিড়ালটা। বিড়াল এখানে তাহলে অরু কই?
তাছাড়া বিড়াল সব যায়গায় গেলেও ঘুনাক্ষরেও ক্রীতিকের সামনে আসেনা, তাহলে আজ হলোটা কি? আশ্চর্য। বিড়ালের এমন আকষ্মিক গায়ে মাখামাখি ভাব দেখে ভাবনায় পরে গেলো ক্রীতিক। তাই দেরি না করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো লাইটের সুইচবোর্ডের কাছে। অন্ধকারে ক্রীতিক নতুন হাটছে না, তাই সুইচবোর্ড পর্যন্ত যেতে মোবাইলের আলো জ্বালানোর আর প্রয়োজন পরেনি ওর।
একযোগে পুরো বাড়ির প্রত্যেকটা রুমের আলো জ্বালিয়ে ডোরাকে খুজতে দরজার দিকে চোখ রাখলো ক্রীতিক,কই দরজার কাছেতো নেই,তাহলে? চারিদিকে হাতরিয়ে একটু পর খেয়াল করলো বিড়ালটা ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। বিড়ালের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে ক্রীতিক বললো,
--- হোয়াটস রং? কাপড় নোংরা করছিস কেন? এক্ষুনি দুরে যা বলছি। নয়তো তোকেও তোর মালকিনের মতো চ'ড়ি'য়ে গাল লাল করে দেবো।
ক্রীতিকের বাংলা ইংরেজি মিলানো ধমকেও কাজ হলোনা,ডোরা আগের ন্যায়ই দাঁড়িয়ে আছে। সেই দেখে ক্রীতিক দুকদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
---- ইউজলেস ক্যাট, কথা না শুনলে একদম ঘর থেকে বের করে দেবো। যেমন মালকিন তার তেমন পোষা বিড়াল, নিজে সারাদিন বে'য়াদবি করে করে, বিড়ালটাকেও বে'য়াদবি শিক্ষা দিয়েছে। ইচ্ছে করছে দুটোকেই ধরে আ'ছাড় মা'রি।
ডোরার দিক থেকে পাকাঁনো চোখ সরিয়ে ক্রীতিক দোতলার করিডোরের দিকে তাকিয়ে চেচাঁতে লাগলো,
---- কোথায়, তোর বে'য়াদব মালকিনটা? কতবার বলেছি আমার চোখের সামনে যাতে এই নেউটে বিড়ালটা না আসে। একে দেখলে আমার ইরেটেটিং হয়। অরু,এ্যাই অরু এক্ষুনি নাম নয়তো তোর বিড়ালকে ঘাড় ধরে বের করে দেবো আমি। অরু???
ডোরা কাঁউচের সামনে গিয়ে মিঁয়াও মিয়াঁও করছে দেখে ক্ষী'প্ত ক্রীতিকের চোখ গেলো সেদিকেই। দেখলো কাউচের উপর জুবুথুবু হয়ে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অরু। হাটু সমান লম্বা খোলা চুল গুলো মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর । দেখে মনে হচ্ছে চেতনা নেই।
অরুকে এমন অসার হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে ক্ষনিকের মাঝে হৃদপিন্ড ধরাক করে উঠলো ক্রীতিকের। এতোক্ষণ ধরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা মেজাজটা দপ করে নিভে গিয়ে অজানা ভয়ে ছেয়ে গেলো মস্তিষ্ক। ও এক পা দু'পা করে এগিয়ে হাঁটু গেড়ে কাউচের সামনে অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে পরলো, অতঃপর মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠলো,
--- অরু?
অরু নিশ্চুপ।
গলার মাঝে কাঁ'টার মতো তীক্ষ্ণ কিছু বিঁধছে মনে হচ্ছে গলার স্বর বের হওয়ার যো নেই,ক্রীতিক সেটাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে আবারও ডাকলো অরুকে।
---- অরু,
এবার গলার স্বরটা আরও খানিকটা নরম শোনালো ওর।
এক বার, দুইবার, তিনবারের সময় ব্যাস্ত হয়ে পরলো ক্রীতিক, ভেতরে জমিয়ে রাখা দূরত্ব, জরতা,অভিমান,আক্রোশ সব কিছুকে সাইডে সরিয়ে, দু'হাতে আঁজলা করে ধরলো অরুর জ্বরে লাল টকটকে হয়ে যাওয়া মুখটা।অতঃপর উদগ্রীব হয়ে ওর মুখমন্ডল ঝাঁকিয়ে উঠে বললো,
---- অরু,এই অরু, হার্টবিট, ক্যান ইউ হেয়ার মি?
এই প্রথম মনে মনে নয় বরং মুখ ফুটে অরুকে আদুরে নামে ডাকছিল ক্রীতিক। যদিও ক্রীতিকের আপাতত কোনোকিছুতেই খেয়াল নেই। ও তো স্রেফ অরুকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে।
.
অবশেষে প্রায় আধঘন্টার প্রচেস্টায় ঢুলুঢুলু করে চোখ খোলে অরু, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। তীব্র জ্বরে কি যেন বিড়বিড় করছে অস্পষ্ট আওয়াজে। অরু চোখ খুলেছে দেখে সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে ক্রীতিক। মনে মনে ঠিক করে এখনই একবার ডক্টর কে কল করে আনতে হবে।
কিন্তু ওর ভাবনার ছেদ ঘটে তপ্তদুটো নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে। জ্বরের ঘোরেই দুহাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরেছে অরু। ক্রীতিক সে অবস্থাতেই স্থীর হয়ে বসে আছে,যেন নড়াচড়া করতেই ভুলে গিয়েছে ও। এবার পাশঘুরে শুয়ে নিজের হাতদুটো আরও শক্ত করে নিলো অরু। সঙ্গে সঙ্গে অরুর দিকে ঝুঁকে পরলো ক্রীতিক, অরুর তপ্ত প্রশ্বাস, কাঁপা কাঁপা অধর আর নিঃশ্বাসের তালে তাল মিলিয়ে বারবার ওঠানামা করা ধনুকের মতো শরীরটা এক ঝলক পরখ করে দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয় ক্রীতিক।অরু জ্বরে পুড়ছে, এই সময় নিজের মস্তিষ্কের অযাচিত কামুক চিন্তা ধারা গুলো একধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ও জ্বরের ঘোরে থাকা অরুকে শুধালো,
---- অরু, ক্যান আই টাচ ইউ?
অস্পষ্ট সুরে কিছু একটা বিড়বিড়ালো অরু,ক্রীতিকের কান অবধি তা পৌঁছায় নি। তাও নিজের কোর্ট আর টাইয়ের নট'টা খুলে সেগুলোকে একপ্রকার ছু'ড়ে ফেলে, কাউচের উপর উঠে বসে, কম্ফোর্টার সহ'ই আলগোছে অরুকে কোলের মাঝে নিয়ে নিলো ক্রীতিক।
কম্ফোর্টার আর ক্রীতিকের শরীরের ওমে, মূহুর্তেই মুখের বিড়বিড়ানি বন্ধ হলো অরুর,মনে হয় শীত কমেছে।
ক্রীতিক অরুর মুখের পানে তাকিয়ে বলে,
---- এমন কেন করিস অরু? আমাকে কি একটু আপন ভাবা যায়না? একটা কল দিলে কি হতো? আমি নাহয় খুব খারাপ, অনুকে কি কল দেওয়া যেত না? এতো বেখেয়ালি কেন তুই?? তুই এমন করলে আমার অগোছালো জীবনটা কে সাজাবে বল?
অরুর কাছ থেকে জবাব আসেনা, আসার কথাও না, অরুতো এখন নিজের মাঝেই নেই।
ক্রীতিক একটু থেমে আবার বলে,
---- এখন তুই জ্বরের ঘোরে আছিস,কিছু বললেও মনে থাকবে না তোর, রাইট??এখন যদি আমি বলি,
ক্রীতিক কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো তারপর বললো,
---- কিছুনা। তোর যথেষ্ট বয়স হয়েছে বোঝার,আর আমাকেও তোর বুঝেই নিতে হবে। নেক্সট টাইম নিখিল নিখিল করলে তোকে চি'বিয়ে খাবো আমি। সেই সাথে ওই ধূর্ত নিখিলকেও পুঁ'তে রেখে দিয়ে আসবো ।
. বেশ অনেকটা সময় পর অরুকে কোলে তুলে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে আবারও নিচে নামে ক্রীতিক।ফর্মাল শার্টের উপরেই এ্যাপ্রোন পরে পুরো রুম গুছিয়ে ফেলে সে। তারপর কিচেনে গিয়ে হোয়াইট পোরিজ বানিয়ে নিয়ে যায় অরুর কাছে। মাথার জলপট্টিটা উল্টে দিয়ে অরুর মুখে একটু একটু পোরিজ দিতে দিতে ক্রীতিক আহত সুরে বলে,
----- আমি খুব খারাপ তাইনা? সব সময় কষ্ট দিই তোকে। কথার আ'ঘাতে হৃদয়টা বিষিয়ে দিই। কি করবো বল? তোর জন্যই আমি এমন...
*****************************************
ক্যাফের সর্বশেষ কাস্টমারকে বিদায় জানিয়ে মাত্রই পার্ট টাইম শেষ করে বেরিয়েছে অনু। আজ কাজের অনেক চাপ ছিল, তার উপর সেই সকালে বেরিয়েছে,আসার আগে দেখে এসেছে অরুর শরীরটা ভালো নেই,তাই দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে ফোন বের করে ডায়াল করলো ক্রীতিকের বাসার ল্যান্ডলাইনে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কলটা কেউ তুললো না, বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। অনু অবশ্য ছাতা নিয়েই এসেছে সাথে করে, তাই আর বৃষ্টি কমার অপেক্ষা না করে ছাতা মাথায় বেড়িয়ে পরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাতের বেলায় ঝুম বৃষ্টিতে পিচ ঢালা রাস্তা গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পরছে গিয়ে ঢালু জমিনে। কুর্তি আর স্কিনি ডেনিম পরিহিতা অনু,সেই বৃষ্টির পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে হাটছে ঠিক ছোট বেলার মতো। এভাবে কিছুক্ষণ হাটতে হাটতে অনু খেয়াল করে ও একা নয় ওর পাশে আরও একজন ওর সাথে তাল মেলাচ্ছে। বিস্ময়ে, বিহ্বলিত হয়ে অনু ছাতা তুলতেই দেখতে পায় পরিচিত সেই হাসি মুখখানা। প্রত্যয়ের মুখটা একবার পরখ করে আবারও ছাতা নামিয়ে নিয়ে অনু বলে,
----- আপনি সবসময় রাতের বেলা উদয় হোন কেন বলুনতো?
---- কারন আমি চাঁদ।
অনু একই ভাবে ছাতা তুলে শুধালো,
----- কি বললেন?
প্রত্যয় এবার নিজের ছাতাটা উঁচিয়ে বলে,
---- দিনের বেলা অফিস থাকে ম্যাডাম।
নিজের কাজ জেকে ভাইয়ের কাজ দু'টো একসাথে সামলাতে হয়।
---- আপনি ক্রীতিক ভাইয়াকে ভাই ডাকেন কেন?
প্রত্যয় জবাব দেয়,
---- সে আমার বহু পুরোনো বড় ভাই। সে জন্য।
---- আর আপনার পরিবার?
----- সবাই আছে বিডিতে।
অনু বুঝতে পারার মতো উপর নিচ মাথা নাড়ালো।
ততক্ষণে উল্টে প্রশ্ন ছু'ড়লো প্রত্যয়,
---- আপনার মা তো কোম্পানির চেয়ার ওয়েম্যান, তাহলে এতো কষ্ট করে পার্ট টাইম কেন করেন?
অনু হাসার চেষ্টা করে বললো,
----- আমাদের আর ক্রীতিক ভাইয়ার সম্পর্কের জটিলতা তো জানেনই। উনি মায়ের চিকিৎসার জন্য এতোএতো খরচ বহন করছে সেই অনেক। তাছাড়া মায়ের অধিকার থাকলেও আমাদের তো এসবে কোনো অধিকার নেই, তাই নিজের আর অরুর হাত খরচ মেটানোর জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটার ব্যাবস্থাই করা আর কি।
অনুর আত্মসম্মান প্রগার, নিতান্তই ঠ্যাকায় পরে মাকে নিয়ে এতোদূর এসেছে, অনুর কথার টোনে তা স্পষ্ট বোধগম্য হলো প্রত্যয়ের। তাই ও এসব ফিন্যান্সিয়াল কথার বাইরে গিয়ে শুধালো,
---- আপনার মা এখন কেমন আছেন?
অনু হাসি মুখে জবাব দেয়,
---- ভালো আছেন। ডাক্তার বলেছেন শারীরিক উন্নতি হচ্ছে দ্রুত। এরকম হলে খুব শীঘ্রই অপা'রেশন করানে সম্ভব হবে।
প্রত্যয় সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
---- আপনাকে খুশি দেখতে ভালো লাগছে। আপনার হাসিটা আমার হৃদয় ছুয়ে যায়। দেখলে মনে হয়,হৃদপিন্ডে ছো'ড়া তরতাজা তী'রের ফলা।
অনু হাটার গতি পুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে প্রত্যয়ের পানে চেয়ে বললো,
---- প্রত্যয় সাহেব, বৃষ্টিতে ভিজবেন? বসন্তের বৃষ্টিতে?
প্রত্যয় তৎক্ষনাৎ নিজের ছাতা ছু'ড়ে ফেলে দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
----- আপনার এই খুশিটুকু ধরে রাখার জন্য জান কোরবান।
প্রত্যয়ের সাথে সাথে অনুও নিজের ছাতাটা নামিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বরফ শীতল বারিধারা এসে ছুঁয়ে যায় দুটো উচ্ছ্বাসিত,রোমাঞ্চকর প্রান।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
#পর্বঃ১৫
অন্ধকার বদ্ধ রুমে আটকে থাকার ফলস্বরূপ, অরুর শরীরে যে জ্বরের দাপদাহের সূচনা হয়েছিল,আজ প্রায় পাঁচ দিনের মাথায় তা একটু একটু কমেছে। জ্বর পুরোপুরি না কমলেও অরু যেচে পরে সবার কাছে নিজের সুস্থতা প্রমান করতে চাইছে, কারণ আগামীকাল নিখিলদের ট্যুর।
ধরনীতে নতুন সূর্য উদীয়মান। সুন্দর ঝকঝকে সকাল। ছাঁদবারান্দার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের তীক্ষ্ণ মোলায়েম আলো এসে হানা দিচ্ছে দোতলার সরু করিডোরে। রুম থেকে বেরিয়ে, করিডোর ধরে সামনে এগুচ্ছে অরু, সাথে পিছু নিয়েছে ওর ছায়াটাও।গন্তব্য ক্রীতিক সাহেবের রুম।
ক্রীতিকের রুমটা করিডোরের শেষ প্রান্তে।হাতে একটা ম্যাক্রোকোনোমিক্সের বই আর ডোরাকে কোলে নিয়ে ক্রীতিকের রুমের দরজায় এসেই থামলো অরু। সেই যে প্রথম দিন এসে ক্রীতিকের বেডে ঘুমিয়েছিল, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ওর রুমের চৌকাঠ অবধি মাড়ায়নি অরু। কিন্তু আজ তো আসতেই হতো, যে করেই হোক ক্রীতিককে রাজি করিয়ে, আগামীকাল ভার্সিটিতে যাওয়ার ব্যাবস্থা করতেই হবে, আর তার পর ভার্সিটি থেকে সোজা নিখিল ভাইয়ের সাথে ট্যুরে।
সেই কখন থেকে দরজার সামনে সটান দাড়িয়ে আছে অরু।নক করতে কেমন যেন ইতস্তত লাগছে ওর। রুমের দরজা লাগিয়ে ক্রীতিক কি না কি করছে, কি করছে কে জানে? দেখা গেলো নক করতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে অকস্মাৎ থাপ্প:ড় লাগিয়ে দিলো দু'গালে। সেসব হাবিজাবি ভেবে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বুকের মাঝে অনেকটা সাহস জুগিয়ে শেষমেশ দরজায় টোকা মে'রেই দিলো অরু। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কাঠকাঠ আওয়াজ ভেসে এলো ক্রীতিকের,
--- কি চাই?
অরু বাইরে থেকেই জবাব দিল,
--- কিছু চাইনা, একটু একটু....
অরু কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক বললো,
--- দরজা খোলাই আছে।
ক্রীতিকের জবাব শুনে অরু তারাহুরো করে ডোরাকে কোল থেকে নামিয়ে নিজের শরীরটা ঝেড়েঝুরে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকতেই অরু দেখতে পায় ক্রীতিক তোয়ালে দিয়ে চুল মুচ্ছে,পড়নের ট্রাউজার আর টিশার্ট দুটোর রঙই কালো। মনে হচ্ছে শাওয়ার শেষে মাত্রই বেরিয়েছে সে। পুরোরুম জুড়ে স্যান্ডালউড পারফিউম আর মাতাল করা পুরুষালী গন্ধ মো মো করছে। ক্রীতিকের রুমে, ক্রীতিকেরই সামনে দাড়িয়ে, অরু বেহায়াদের মতো মনে মনে ভাবছে,
--- আচ্ছা, রুম থেকেই এতো সুন্দর সুঘ্রাণ বের হচ্ছে । তাহলে ওনার শরীরের গন্ধটা কেমন? ওনার বউতো মনে হয়, ওনার শরীরের সুঘ্রানেই পাগল হয়ে যাবে।
---ছি ছি আবারও ভুলভাল ভাবছি। তওবা তওবা।
অরুকে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
---কিছু বলার না থাকলে যেতে পারিস। আমি রেডি হবো, ম্যাচ আছে।
অরু তৎক্ষনাৎ ভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
--- ইয়ে মানে, একটু পড়া বুঝতে এসেছিলাম কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।
অরু পড়া বুঝতে এসেছে তাও ক্রীতিকের কাছে?ব্যাপারটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়,নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে,সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে ক্রীতিক, তবুও অরুর উদ্দেশ্য ধরার জন্য বললো,
--- আমি যখন ক্লাসে লেকচার দিই,তখন মন কোথায় থাকে তোর? বিশ্বাস কর অরু ফার্স্ট সেমিস্টারে ফেইল করলে তোকে আর পড়াবো না আমি।
অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
--- এতোকথা কেন শোনাচ্ছেন, দিননা একটু বুঝিয়ে, টিচার হোন আপনি আমার,স্টুডেন্টের প্রতি এইটুকুনি কর্তব্য তো আছে, নাকি?
--- তোর আমাকে কর্তব্য শিখাতে হবে না।এসব কর্তব্য টর্তব্যের ধারধারিনা আমি।
অরু জানে ও কিছুতেই ক্রীতিকের সাথে তর্কে পেরে উঠবেনা, তাই দমে গিয়ে নরম সুরে অনুনয় করে বললো,
---- দিননা প্লিজ।
অরুর অনুরোধে বোধ হয় কাজ হলো,ক্রীতিক অরুর মুখের উপর নিজ তোয়ালেটা ছু'ড়ে মে'রে বললো,
--- ঠিকাছে বুঝিয়ে দিবো, তার আগে কাজ শেষ কর।
অরু কয়েক কদম এগিয়ে এসে ক্রীতিকের মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে ওর চুল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে, পা উঁচু করে, দু আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ক্রীতিকের চুল মুছতে যাবে, তার আগেই ক্রীতিক ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো,
--- হয়েছে আর লাগবে না, এইটুকু কাজ সেটাও ঠিক মতো করতে পারিস না, বিয়ে হয়ে গেলে তখন কি করবি?
অরু মিনমিনিয়ে বললো,
--- খাম্বার মতো দাড়িয়ে ছিলেন কেন?মাথাটা একটু নোয়ানো যেতো না?
--- কিছু বললি?
অরু না সূচক মাথা নাড়ালো।
--- কোন টপিকটা দেখিয়ে দিতে হবে?
অরু বই সমেত ক্রীতিকের দিকে এগিয়ে এলেই ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে ক্রীতিক বলে,
--- খবরদার কাছে আসবি না, যা বলার ওখানে দাঁড়িয়ে বল।
--- কাছে না এলে, পড়া বুঝবো কি করে?
--- সে আমি জানিনা, তুই আমার কাছে আসবি না ব্যাস।
অরু অসহায় মুখে ক্রীতিকের পানে তাকিয়ে আছে, আর ক্রীতিক তীর্যক চোখে অরুর আগা গোড়া পরখ করছে,কালো ফ্রক আর লেগিংস, সেই সাথে মেঘের মতো ঘন কালো লম্বা চুল। সব কিছু কালোরঙ দিয়ে মুড়িয়ে রাখায় ফর্সা শরীরটা যেন জলজল করছে ওর। দেখলেই কেমন চোখ ধরে যায়।হৃদয়টা নিসপিস করে।
কিছু একটা ভেবে ক্রীতিক অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
--- তুই স্টাডি টেবিলে গিয়ে বস, আমি এখান থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছি।
অরু ক্রীতিকের কথা মতো তাই করলো।গিয়ে বসলো ক্রীতিকের অত্যাধুনিক টেবিল চেয়ারে। এরপর শুরু হলো ক্রীতিকের প্রফেশনাল আচরণ। একে একে পুরো চ্যাপ্টারের প্রত্যেকটা টপিকের উপর টানা একঘন্টা লেকচার দিয়ে তবেই থামলো সে।এই একঘন্টায় অরু পাঁচ মিনিট ঠিক মতো শুনেছে কিনা সন্দেহ। ও কতক্ষণ নিখিল ভাইয়ের কথা ভেবেছে, তো কতক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্রীতিকের রুমটা পর্যবেক্ষন করেছে। পুরো রুমটা গ্রে থীমে সাজানো। সবকিছুতেই কেমন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। দেখলে মনে হবে,রুমের সব আসবাবপত্র মুখ গোমড়া করে বসে আছে। যেমন মালিক তেমন তার ঘর বোরিং।
--- কি বোরিং?
ক্রীতিকের হঠাৎ ছোঁ'ড়া প্রশ্নে কম্পিত হয়ে উঠলো অরু, মুখ ফসকে কখন যে কথা বেরিয়েছে সে খেয়াল নেই ওর। দাঁত দিয়ে জিভ কেটে,তারাহুরো করে উত্তর দিল,
--- আআপনাকে বলিনি, রুমের কথা বলেছিলাম।
ক্রীতিক নিজের কপালে গম্ভীরতার ভাজ টেনে এগিয়ে এসে অরুর গাল চেপে ধরে বললো,
--- আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছিস কেন? কি চাই, সত্যি করে বল?
ক্রীতিকের র'ক্ত চক্ষুর দিকে একপলক তাকিয়ে, চোখ নামিয়ে অরু বলে,
--- আমি কাল ভার্সিটিতে যেতে চাই।
--- কেন, কাল কি আছে?
নিখিলের ব্যাপারটা পুরোপুরি এরিয়ে গিয়ে অরু বলে,
--- এএ..একদিনের একটা ট্যুর আছে, শুধু আমাদের ব্যাচ। সবাই যাবে, তাই আমিও যেতে চাই।
ক্রীতিক কিছুক্ষণ নিস্প্রভ তাকিয়ে রইলো অরুর মুখের পানে, তারপর বেশ সাবলীল ভাবে জবাব দিলো,
--- ওকে ফাইন।ইউ ক্যান গো।
ক্রীতিকের সম্মতি পাওয়ার সাথে সাথে অরুর বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো। চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। সবচেয়ে কঠিন কাজ সম্পাদন করার মতোই আনন্দ হতে লাগলো ভেতরে ভেতরে। ও আর ক্রীতিকের রুমে বসে থাকলো না,কারণ এখানে তো ওর আর কোনো নেই,তাই নাচতে নাচতেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
বুকে দু'হাত গুঁজে টেবিলে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ক্রীতিক বললো,
--- কি সুন্দর মিথ্যা কথা বলতে শিখেছিস জান।
কথাগুলো বলার সময় অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল ওর।
*****************************************
বিকেল বেলা এলিসা আর অর্নব এসেছে ক্যাথলিনের ডরমেটরিতে। গত একসপ্তাহ ধরে মেয়েটার কোন হদিস নেই। এলিসার বাবা জে'ল থেকে ছাড়া পেয়েছে কয়েকমাস হলো। সেই থেকেই বিভিন্ন পকার ক্লাব থেকে একেরপর এক হু'মকি আসছে ওর নিকট।সবাই নাকি ওর বাবার কাছ থেকে টাকা পায়, ওর বাবা বারবার জু'য়ায় হেরে মোটা অঙ্কের ঋণগ্রস্থ। এখন এলিসাকেই সেইসব টাকা পকার খেলে শোধ করতে হবে। নয়তো ওর বাবাকে শ্যু'ট করে মে'রে ফেলা হবে। এলিসা কখনোই চায় না ওর বাবা টাকার জন্য মা'রা যাক, কিন্তু আগের বার ঠিক একই কৌশলে এলিসাকে ওই পাপের খেলায় সামিল করেছিল ওর বাবা। এবারও যে একই নোংরা কাজ করবে না তার গ্যারান্টি কি?
কারন ওর বাবার কাছে এলিসা মেয়ে নয়, কেবলই টাকা বানানোর মেশিন মাত্র। সেবার ক্রীতিক, অর্নব আর সায়রের সাহায্যে জুয়ার জগত থেকে বের হতে পেরেছিল এলিসা, অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই একই পিছুটান ওকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে যত্রতত্র। এলিসা জানে এবার আর এতো সহজে সবটা সমাধান হবেনা,এবার হয়তো সত্যিই ওর বাবা জু'য়ারিদের হাতে মা'রা পরবে। মা'রা পরলে পরুক,তবুও আর ওই পাপের খেলা খেলবে না এলিসা।
নিজের মধ্যে গুমোট হয়ে কুন্ডলী পাকানো এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝেই ক্যাথলিনের সাথে কি থেকে কি হয়ে গেলো। ওরই বেস্টফ্রেন্ড এই নিন্দনীয় কাজটা করেছে, ভাবতেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে এলিসার।
---ক্যাথলিন মেয়েটা জেকে কে চোখে হারাতো অথচ জেকে এটা কি করলো?বিরক্তিতে ফোসফাস করছে এলিসা।
পাশ থেকে অর্নব বললো,
--- ক্যাথলিনের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল,ও যার লেজে পা দিয়েছে সে কোনো ডোড়া সাপ না,বরং বি'ষ দিয়ে ভরা ড্রাগন।
এলিসা ভ্রু কুঞ্চিত করে অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- কি এমন করেছে আমার ছোট্ট বোনটা? আর যদি কিছু করেও থাকে সেটা কি মুখে বলে সমাধান করা যেত না?? এরকম একটা অ'পমান জনক কাজ করতে হলো? একটা মেয়ের জন্য চুল ঠিক কতোটা ইমোশন ধরে রাখে তোরা ছেলেরা আদৌও তা বুঝিস? ভালো বলিস আর খারাপ বলিস জেকে একটা হার্টলেস, একটা মেয়ের চুল কে'টে দিতে ওর বুক কাঁপলোনা একবারও?
---- ক্যাথলিন যখন অরুর চুল কা'টতে গিয়েছিল তখন ওর বুক কেঁপেছিল?
অর্নবের কথায় ডরমিটরির গেইটে এসে হাটার গতি থেমে যায় এলিসার।
--- কিহ! কার চুল কে'টেছে?
--- কা'টেনি কা'টতে চেয়েছিল, তাছাড়া ক্যাথলিনই অরুকে ব্যাকস্টেজের বেজমেন্টে আট'কে রেখেছিল।
আরও একবার চমকালো এলিসা, মুখ ফুটে বললো,
--- ক্যাথ হঠাৎ এসব কেন কেন করতে যাবে?
অর্নব এলিসার হাতটা ধরে যেতে যেতে বললো,
--- সেটা তো আমারও প্রশ্ন।চল এবার ক্যাথলিনকে দেখে আসি।
এলিসা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
--- হাত ধরেছিস কোন অধিকারে? হাত ছাড়।
অর্নব পুনরায় ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
--- তোকে আমি ভালোবাসি, বিয়ে করবো, তুই আমার ভবিষ্যত বাচ্চার মা, সেই অধিকারে ধরেছি, এখন চুপচাপ চল।
*****************************************
ডরমিটরিতে এসে একটানা আধঘন্টা যাবত ডাকাডাকির পরে রুমের দরজা খুললো ক্যাথলিন। ওর চোখ মুখের অবস্থা বি'ভৎস দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন রাত একাকার করে কেঁ'দেছে।বাদামি রঙের বেনি হ্যাট দিয়ে পুরো মাথাটা ঢেকে রেখেছে বলে, চুল আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। এলিসাকে দেখে পুনরায় আরও এক দস্তুর কেঁদে ভাসালো ক্যাথালিন। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
--- আপু জেকে ভাইয়া আমার সাথে এসব কেন করলো বলোতো?
এলিসা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালো,
--- এসব মানে?
ক্যাথলিন হেঁচকি টেনে জানায়, শুধু চুল কা'টা নয়, সেদিন ক্রীতিকের বাসায় ইলেকট্রিক্স শকট টাও ক্রীতিক ইচ্ছা করেই দিয়েছে।
ক্যাথলিনের কথায় এলিসা অর্নবের চোখ কপালে। এলিসা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
--- তুই কি করে জানলি কাজটা ক্রীতিক করেছে?
--- জেকে ভাইয়া নিজ মুখে বলেছে।
পেছন থেকে অর্নব শুধালো,
---কি বলেছে?
--- বলেছে তুমি আমার হৃদয়ে আ'ঘাত করেছো তাই তোমাকে সেদিন ইলেকট্রিক্স শক টা আমিই দিয়েছি। আর আজ আবারও একই ভুল করেছো, তাই আজও শা'স্তি দেবো। জানো আপু, তখন আমি জেকে ভাইয়াকে চিনতেই পারছিলাম না,কি ভ'য়ানক দেখতে লাগছিল,আর তারপর....কথাটুকু শেষ করার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ক্যাথলিন।
অর্নব দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,
--- সায়র ওয়াজ কমপ্লিটলি রাইট।হি ইজ অবসেশট উইথ হিজ স্টেপ সিস্টার। হলি শীট...
****************************************
মন মস্তিষ্কের আন্দোলন তীব্র বেদনাদায়ক।তারউপর মনের মানুষটার মন যদি হয় অন্যকারও দখলে। এতোদিন ধরে ক্রীতিক যেটা আড়ালে অনুভব করে এসেছে। আজ তা সরাসরি অনুভব করলো অরু। সকাল সকাল এতো এক্সাইটমেন্ট এতো আনন্দ সব কিছু পু'ড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে এতোক্ষণে। হবে নাই'বা কেন? আনন্দঘন দিনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছে নিখিল ভাই আসলে ওকে কথার কথা ট্যুরে ইনভাইট করেছিল। আসলে ওর যাওয়া না যাওয়ায় নিখিলের কিছুই আসে যায়না।
সকাল সকাল বাসে উঠে অরু যখন নিজের পাশের বে'দখল সিটটা নিখিলের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল, তখনই বাসের লুকিং গ্লাসে অরু দেখতে পায়, নিখিল ভাই আর তার বিদেশিনী বান্ধবী ইতিমধ্যে বাসে উপস্থিত। তারা কি নিয়ে যেন উল্লাসে মেতে আছে ঠিক সেদিনের মতোই। অরু এসেছে কি আসেনি সেদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই নিখিলের। অরু যখন অসহায়ের মতো ঠোঁট কামড়ে পেছনে তাকিয়ে ছিল তখনই ওর পাশে এসে বসে পরে সায়নী।
সায়নীকে দেখে অরু, দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে শুধায়,
--- আচ্ছা সায়নী, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যদি সারাক্ষণ একসাথে থাকে, একসাথে হাসাহাসি করে, তাহলে কি তারা শুধু বন্ধু?
ওপাশ থেকে সায়নীর নির্লিপ্ত জবাব আসে,
--- হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।
অরু ভেতরে ভেতরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে, এমনটা নয়তো,এই বিদেশিনীই নিখিল ভাইয়ের প্রেমিকা? এমনটা হলে অরুর হৃদয়টা ভে'ঙে যাবে পুরোপুরি।
কিন্তু এই মূহুর্তে সকালের সেই অযাচিত প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব অরুর সামনে। সন্ধ্যা রাতে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, সউচ্চ চূড়া থেকে নেমে আসা ঝরনাকে সাক্ষী রেখে অ'ন্তরঙ্গ সময় পার করছে নিখিল আর তার বান্ধবী। অরু সকাল থেকেই নিখিল কে চোখে চোখে রেখেছিল। সারাদিন ওরা কি করেছে না করেছে সবই আড়ালে খেয়াল রেখেছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার আগে আগে হঠাৎ করে সবার চোখের আড়াল হয়ে যায় ওরা দুজন। তবে অরুর নজর তো নিখিলের দিকেই ছিল, তাই চুপিচুপি পিছু নিয়েছিল ওদের। খুজেও পেয়েছিল খুব সহজে। কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখতে হবে তা কল্পনাতেও ভাবেনি অরু।
সেই জগন্নাথে পা রাখার পর থেকে নিখিল ভাইয়ের পিছনে ছুটেছে ও।মায়ের অসুখ, আপার বকুনি কিংবা ক্রীতিকের অ'পমান কোনো কিছুই দমাতে পারেনি ওকে। সেই একই নিখিল ভাইয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে আজ এতোদূর চলে এসেছে ঘর কুনো মেয়ে অরু। অথচ আজ মনে হচ্ছে,এখানেই থেমে যেতে হবে ওর, আর কোনো আশা নেই,নিখিল ভাই নিজ হাতে ওর ছোটার রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে।
শরীরের জ্বরটা বোধ হয় হুহু করে বারছে। নিরব অস্রু জ্বলে ভিজে যাচ্ছে গ্রীবা। মেয়েটাকে করা নিখিল ভাইয়ের একেকটা চুম্বন অরুর শরীরে যেন বিষা'ক্ত তী'রের মতো বিঁধ'ছে, এই দৃশ্য কতক্ষণই বা দাড়িয়ে থেকে দেখা যায়? অরুও দাড়িয়ে রইতে পারলো না। কাঁ'দতে কাঁ'দত ধপ করে বসে পরলো অসম ভূমিতে। ঘাস আবৃত জমিনে দু'হাত চাপরাতে চাপরাতে বললো,
--- কেন এমন করলেন নিখিল ভাই? আপনি যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসবেন তাহলে আমাকে কেন নিয়ে এলেন? আমি তো কোনো কালেই ট্যুরে আসতে চাইনি, কেবল আপনার একটা কথাতে সবাইকে মিথ্যা বলে,অসুস্থ শরীরটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছি আমি, তাহলে এটা কি দেখালেন আপনি? আমার হৃদয়ে ফোঁটা প্রথম প্রেমের ফুলটাকে আপনি এভাবে পা দিয়ে পিষি'য়ে দিলেন।কেন?
--- প্রেমে পরা কি এতোই সহজ?
পরিচিত,চমৎকার পুরুষালি কন্ঠস্বরটা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই অকস্মাৎ থেমে গেলো অরু।তরিৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। মাথায় বাকেট হ্যাট, পরনে হোয়াইট ওভার সাইজ টিশার্ট। অরু বুঝতে পারছে না ক্রীতিককে দেখে ও কি খুশি হবে নাকি,লজ্জা পাবে।
--- কি হলো আর কতো কাঁদবি, ক্রাশের জন্য?
অরু নাক টেনে জবাব দিলো,
--- ভুল ভাবছেন উনি আমার ক্রাশ না।
তারপর হুট করেই বললো,
--- আপনি সবটা জানতেন তাইনা? সব জেনে শুনেই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাইনা? কিভাবে পারলেন আপনি?
ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে অরুর হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওকে দাঁড় করায়,অতঃপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
--- বিশ্বাস কর অরু, এই মূহুর্তে তোকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একটা থা'প্পড় দিতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু কি জানিস তো? সেটা আমি পারবো না।কারন আমার হাত অগ্রসর হওয়ার আগে আমার কলিজা কেঁপে উঠবে।
অরু ক্রীতিকের কথায় খানিকটা ভরকে গিয়ে আবারও নিখিলদের দিকে তাকালো, যারা এখন গভীর চুমুতে মত্ত।
--- হি ইজ আ প্লেবয়, ওই যে মেয়েটা দেখছিস,ও আর ওর বান্ধবী দুইজনার সাথেই একত্রে লিভ টুগেদারের আছে বা'স্টার্ডটা।
অরু চমকে গিয়ে বোকার মতো শুধালো,
---দুইজনার সাথে, একই সাথে কিভাবে কি?
অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক ঠোঁট টিপে হাসলো, কষ্ট পেয়ে মেয়েটা বোধ বুদ্ধি সব খেয়ে ফেলেছে মনে হয়। তবুও ক্রীতিক ওর কথার জবাব দিয়ে বলে,
--- ট্রিও রিলেশনশীপ, এর বেশি বুঝাতে পারবো না, ব্যাপারটা তোর আর আমার বয়সের সাথে যায়না। তাছাড়া তোর বান্ধবী তিথির সাথেও দীর্ঘদিন ফিজিক্যাল রিলেশনে ছিল ও।
একদিনে ঠিক কতোগুলো শক নেবে বুঝতে পারছে না অরু, ওর মাথাটা ভঁনভঁন করে ঘুরছে, সেইসাথে নিখিলের প্রতি জমাট বাঁধা অভিমানটা পরিনত হয়েছে তীব্র ঘৃণায়।মনে মনে ভাবছে তাইতো সেবার তিথি এতোটা বা'জে ব্যাবহার করেছিল ওর সাথে।
--- তুই বসে বসে তোর প্লেবয় নিখিল ভাইয়ের জন্য কাঁদতে থাক আমি গেলাম।
বাইকের চাবির রিংটা আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে যেতে যেতে কথাটা বললো,ক্রীতিক।
অরুর ভ্রম ভেঙে গেলে ও ছুটে এসে ক্রীতিকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাক টেনে বললো,
--- আমি কি করে যাবো?
---কেন তোর নিখিল ভাইয়ের সাথে যাবি।
ক্রীতিকের কথায় অরু আবারও অসহায় দৃষ্টিতে নিখিলদের দিকে তাকালো, পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে গলার আওয়াজ শক্ত করে বললো,
--- কক্ষনো না।
--- তাহলে কিভাবে যাবি?
অরু মুখ ফুলিয়ে বললো,
--- আপনার সাথে।
ক্রীতিক বাইকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
--- আমি মেয়ে মানুষ বাইকে নেইনা।
অরু দুকদম এগিয়ে এসে বললো,
--- প্লিজ নিয়ে যান, আমি ওই বাজে লোকটার মুখোমুখি হতে চাইনা এজীবনে।
ক্রীতিক অরুর চোখে চোখ রেখে বললো,
--- নিয়ে যাবো, বিনিময়ে আমি কি পাবো?
--- যাই চাইবেন তাই দেবো, এখন চলুন।
ক্রীতিক বাঁকা হেসে শুধায়,
--- আর ইউ সিওর যা চাইবো তাই?
---হ্যা তাই, শুধু আমাকে আর ডোরাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইবেন না দয়া করে।
অরুর কথায় ক্রীতিক অন্যদিকে ঘুরে হাসি সংবরণ করলো,মনে মনে ভাবলো,
--- পিচ্চি মেয়ের মায়ায় পরলে এই হয়।
---কি হলো, চলুন।
ক্রীতিক নিজের বাকেট হ্যাট, ওয়ালেট, সিগারেট সবকিছু বের করে অরুর হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
--- ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্নাটা বন্ধ কর, নয়তো ফেলে চলে যাবো।
অরু নাক টেনে ক্রীতিকের জিনিস গুলো নিজের ব্যাগে ভরে নিলো। যেন ওই বহু বছর ধরে ক্রীতিকের গিন্নি দায়িত্ব পালন করে আসছে।
ক্রীতিক বাইকে বসে নিজে হেলমেট পরে আরেকটা হেলমেট বাড়িয়ে দেয় অরুর দিকে,
অরু করুন সুরে জিজ্ঞেস করে,
--- এটাও ব্যাগে রাখতে হবে?
ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজ হাতে অরুকে হেলমেট পরিয়ে দিতে দিতে বলে,
--- স্টুপিড কি তোকে সাধে বলি???
.
নিশুতি রাতে পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকটা। ঝিরিঝিরি মিষ্টি বাতাসে এতোক্ষণে বুকটা হালকা লাগছে অরুর। যদিও ভেতরের ক'ষ্টটা আকাশসম,তবুও ক্রীতিকের ভ'য়ে জোর করে কা'ন্না থামিয়ে রেখেছে ও।যার দরুন হেঁচকি ওঠাটাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন। অরুর দুইহাত ক্রীতিকের কাঁধের উপর নিবদ্ধ । রাস্তার মোড় ঘুরতেই সেই হাতের বাধন বারেবারে শক্ত হয়ে ওঠে দিগুন তালে। এভাবেই যেতে যেতে একপর্যায়ে বহু সময়ের নিরবতা ভেঙে অরু শুধায়,
---- আপনি হঠাৎ পাহাড়ে কেন এলেন?
ক্রীতিক জবাব দেয় না, মনে মনে বলে,
--- শুধু তোর জন্য.....
..............................................................................
𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃
***Download NovelToon to enjoy a better reading experience!***
Updated 62 Episodes
Comments