সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]

#পর্বঃ৩২

সেই সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত অবধি একনাগাড়ে শাওয়ার ছেড়ে ভিজেছে অরু। নিজের সাথে নিজে না পেরে চিৎকার করে কেঁদেছে, শরীরের ব্যাথা, মনের ব্যাথা, সব কিছুতে জর্জরিত হয়ে আছে ও। হাত পা গুলো পানিতে ভিজে আরও ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত ভেজার ফলসরূপ, ঠান্ডায় তিরতিরিয়ে কাপছে ছোট্ট শরীরটা। একপর্যায়ে নিজের ভ্রম ছুটে গেলে জামাকাপড় পাল্টে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে নিজেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে অরু।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় টানা বারান্দায়, আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন, দূর আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে, হয়তো আজ রাতেও ঝড় আসবে। প্রচন্ড ঝড়ে ভে'ঙে যাবে গাছপালা। সেই তীব্র ঝ'ড়ের তান্ডব ও হয়তোবা অরুর মনের ঝ'ড়ের কাছে সামান্য মাত্র। তখনও কংক্রিটের ভবনের কোনো একতলা থেকে ভেসে আসছে বেসুরো গানের লাইন,

" রাত চান্দের আলো ঝড়ে বন্ধু তোমারও ঘরে

হায়, আলো যে জ্বলে না আমি একলা আন্ধারে

বন্ধু বিব্রতি যে না আমি খুঁজি তোমারে....

তুমি কোথায় আছো, কোথায়

দেইখা যাও আমারে......"

গানের লাইন গুলো খুব মন দিয়ে শুনতে শুনতেই, অস্ফুটে অরু বললো,

আমার থেকে লুকিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি জায়ান ক্রীতিক? তুমিহীন আমিটা যে বিদ্ধস্ত, বিমূর্ষ, আর পা'গলপারা সেটা তোমার অদেখাই রয়ে গেলো। সেদিন তোমার বলে যাওয়া প্রতিটি কথার মর্ম আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি আমি। নিজের অজান্তেই তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে পরেছি আজ, এখন তোমাকে যে আমার চাইই চাই, কিন্তু তুমিতো নেই, কোথাও নেই।

আর কত পো'ড়াবে আমায় বলো? কত বোঝাবে তোমার মর্ম? পারছিনা তো আর, এবার তো ফিরে এসো??

অরুর নিদারুণ ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রুমে প্রবেশ করে অনু। রুমের মাঝে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অরু এগিয়ে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

--- খাবোনা আমি, যেতে পারিস।

অনু বললো,

--- খেতে ডাকার জন্য আসিনি, প্রত্যয় সাহেব কথা বলতে চাইছে।

অরু একদিকের চুল অন্যদিকে এনে পুনরায় তোয়ালে চালাতে চালাতে বললো,

--- এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

-- বলেছে ইম্পর্টেন্ট কিছু, হয়তোবা ক্রীতিক ভাইয়া....

অনু কথাটুকু শেষ করার আগেই ওর হাত থেকে ছো মে'রে ফোনটা নিয়ে কানে ধরলো অরু, এই মূহুর্তে খুব ভয় করছে ওর, শরীরটা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে, কোনোমতে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, কাঁপা গলায় অরু বললো,

--- হ্যালো!

অরুর প্রতিউত্তরে ওপাশ থেকে প্রত্যয় আস্তে করে বললো,

--- ভাই নিচে অপেক্ষা করছে।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে, ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো অরু। দু'হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের ক্রন্ধনরত মুখ। কাঁদতে কাঁদতে ক্রমাগত পা দুটোকে বাচ্চাদের মতো মেঝেতে ছুড়তে লাগলো ও। হুট করেই হৃদয়ের ব্যথাটা তরতর করে বেড়ে গিয়েছে । অভিমানের ঝড়ে মস্তিষ্কটা ব্লক হয়ে আছে। আজ আবারও কতগুলো দিনপর পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়ছে ।ইচ্ছেতো করছে চিৎকার করে কাঁ'দতে। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়। তাই মেঝেতে বসেই দু'হাতে মুখ চেপে ধরে চোখের পানি ফেলছে অরু। অরুকে এভাবে কাঁদতে দেখে অনু আর কথা বাড়ায়না ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ রুম ত্যাগ করে।

অরু যখন নিচে আসে তখন রাত বারোটা কি একটা। চারিদিকের তীব্র ঝড়োহাওয়া আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ভবন থেকে বেড়িয়ে আসে অরু। ওর পরনে ফ্রক আর লেগিংস, ভেজা চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনোমতে আটকানো। মাথার উপর বড় করে ঘোমটা টানা। নিচে এসে ক্রীতিক কিংবা তার বাইক কোনোটাই দেখতে পেলোনা অরু, শুনশান নিরব রাস্তায় শুধু মাত্র চোখে পরলো একটা ব্ল্যাক মার্সিডিজ। অরু জানে এটা কার গাড়ি তাই ও আর দেরি করলো না, ছুটে চলে গেলো গাড়ির সামনে।

এতোগুলা দিন পর ক্রীতিককে দেখার উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে ওর, সেই সাথে হৃদয় ভার হওয়া অভিমান তো আছেই। অরু গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই একটানে দরজা খুলে দিলো ক্রীতিক।

ক্রীতিককে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে অরু, পরনের অফ হোয়াইট ব্র্যান্ডেট শার্ট আর ওভার সাইজ ব্ল্যাক ডেনিম দুটোই অগোছালো। কপাল জুড়ে আঁটোসাটো ব্যান্ডেজ, লম্বা ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো আরও খানিকটা লম্বা হয়ে কপালে পরে আছে। বাম হাতের পিঠে এখনো ক্যানোলা লাগানো।

অরু জানেনা ক্রীতিকের কেন এই হাল, তবে কিছুটা আঁচ করতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠে অরু বললো,

--- এখনো বলবেন মাইনর বাইক এ'ক্সি'ডেন্ট তাইতো?

ক্রীতিক মৃদু হেসে বললো,

--- বেশি না মাত্র তিনদিন সে'ন্সলেস ছিলাম। পায়ের ফ্যাকচা্রের কারনে হাটতে পারিনি, আজই ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে, আর আমি হসপিটাল থেকে সোজা তোর কাছে চলে এসেছি।

ক্রীতিকের কথা শুনে অরুর অপ'রাধবোধ তুঙ্গে উঠে যায়, ও কত কিই না ভেবেছিল এই কদিন। অথচ ক্রীতিক কিনা হসপিটালে শুয়ে শুয়ে মৃ'ত্যুর সাথে পাঞ্জা লরছিল?নিজের উপর বড্ড রাগ হলো অরুর। অরুকে কাঁদতে দেখে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে বললো,

--- ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি নাতো একদম, তোর কান্না বিশ্রী লাগে।আমি কি ম'রে গেছি?আশ্চর্য!

অরু নাক টেনে বললো,

--- লাগলে লাগুক।

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম সুরে বললো,

--- বুকে আয়।

ক্রীতিক কি বললো সেটা শোনার জন্য অরু এবার চোখ তুলে তাকালো,

অরু এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে? তাহলে ভিজতে থাক আমি গেলাম।

অরুর তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,

--- আমায় রেখে কোথায় যাবেন আপনি?

অরুর কথায় ক্রীতিক গভীর চোখে তাকালে, অরু পুনরায় মিনমিনিয়ে বললো,

--- না মানে বৃষ্টি নেমেছে তাই।

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বললো,

-- কতক্ষণ ধরে বলছি বুকে আয় কথা শুনিস আমার?

-- হ্যা??

ক্রীতিক আর কথা বাড়ালো না অরুর হাতে হ্যাচঁকা টান দিয়ে ওকে গাড়ি মধ্যে নিয়ে শব্দ করে গাড়ির ডোর লক করে দিলো। সেই সাথে নিভিয়ে দিলো অবশিষ্ট আলোটুকুও। তবুও সোডিয়ামের টিমটিমে আলোয় ক্রীতিকের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাঁচ্ছে অরু। যে এই মূহুর্তে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ওর দিকেই মাতাল চাহনীতে চেয়ে আছে।ক্রীতিক কে হুট করে এতোদিন পর এতোটা কাছে দেখতে পেয়ে কেন যেন এই মূহুর্তে প্রচন্ড কা'ন্না পাচ্ছে অরুর। খুশির কান্না। ও কাঁপা হাতে ক্রীতিকের গালে হাত ছুয়িয়ে মনে মনে বললো,

---- আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় বুক ফেটে ম'রেই যাচ্ছিলাম, তারপর হুট করেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে আবারও ফিরে এলেন আপনি,ধরা দিলেন হৃদয়ে, পুনর্জীবিত করে দিলেন আমার আত্মাটাকে। এ কোন মায়ায় বাঁধা পরেছি আমি?

অরু চুপচাপ ক্রীতিকের গালে হাত রেখে চোখের জল ফেলছে দেখে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বললো,

--- আই মিসড ইউ বেইবি। তোর কি একবারও মনে পরেনি আমাকে?

অরু কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না, তাই উল্টো প্রশ্ন করে বললো,

--- আপনি ঠিক আছেন? হাতে এখনে ক্যানোলা লাগানো কেন?

ক্রীতিক নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

--- ডিসচার্জ করার আগেই বেরিয়ে এসেছি তো তাই খোলা হয়নি।

অরু পটু গিন্নির মতো করে ওকে শা'সিয়ে বললো,

--- এটা কি ঠিক হলো? আপনি এখনো ইনজুরড।

ক্রীতিক অরুর গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বললো,

--- তোর কাছে ফিরে এসেছি, এবার ঠিক হয়ে যাবো।

অরু চোখ দুটো বুজে কাঁপা গলায় বললো,

--- আমি ভেবেছিলাম আপনি আর আসবেননা।

ক্রীতিক অরুর ওড়নাটা সরিয়ে ওর লম্বা চুলগুলো একটানে খুলে দিয়ে, চুলের সুঘ্রাণে মুখ ডোবাতে ডোবাতে বললো,

--- তোকে ছাড়া বাঁচতে পারলে তো।

ক্রীতিকের কথায় অরু মৃদু হাসে, তীব্র ঝরের শেষে প্রকৃতি যেমন পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায় ওর হৃদয়টাও এই মূহুর্তে পুরোপুরি শান্ত।

বাইরে বৃষ্টি ছাপিয়ে ঝড় শুরু হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে আকাশ। এমন ঝড়োহাওয়ার মধ্যে গাড়িতে বসে থাকতে ভ'য় করছে অরুর। অথচ ক্রীতিক সেই যে গলায় মুখ ডুবিয়েছে এখনো ছাড়েনি। অরু এখন ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে চোখ বুজে সহ্য করছে সবকিছু। এক পর্যায়ে গগন কাঁপানো আওয়াজে হুট করেই বাজ পড়লো ধরনীতে, সঙ্গে সঙ্গে অরু ঘুরে এসে ক্রীতিককে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।

অরু জড়িয়ে ধরাতে এতোক্ষণে ক্রীতিক পার্থক্যটা বুঝতে পারলো, অরু শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা। শরীরটা এইটুকুনি হয়ে গিয়েছে। ক্রীতিক এবার ভ্রু কুঞ্চিত করে অরুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,

--- এভাবে শুকিয়ে গিয়েছিস কেন? কি হয়েছে এই কদিনে তোর সাথে?

ক্রীতিকের কথায় অরু মাথা নিচু করে ঠোঁট উল্টে ফুপিয়ে উঠলো, অভিমানী কা'ন্নায় ভে'ঙে পড়ে অস্পষ্ট সুরে বললো,

--- কি হয়েছে সেটাতো আপনি ভালো বলতে পারবেন। সেদিন কি কি সব কঠিন কথা বলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, আর এলেন না, দিন যায়, রাত যায় আপনি আর আসেন না। আমিতো ভেবেছি আপনি আমাকে শা'স্তি দেওয়ার জন্য লুকিয়ে আছেন কোথাও।আমার বুঝি কষ্ট হয়নি?

অরুর কথায় ক্রীতিক যেন আকাশ থেকে পরলো, ও অরুর গাল দুটো হাতে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো,

--- মাত্র কয়েকটা দিন আমি আসি নি বলে তুই খাওয়া বন্ধ করে দিবি?এটা কেমন কথা? আমাকে কি তোর এতোটাই লেইম মনে হয়? যাকে না দেখে একমূহুর্ত থাকতে পারিনা, তাকে শা'স্তি দেওয়ার জন্য নিজেই লুকিয়ে থাকবো?এই তোর বুদ্ধি? নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার সাহস কোথায় পেলি তুই? মাত্র পনেরো দিনে ভুলে গেলি, শরীরটা তোর হলেও আত্মাটা যে আমার?

অরু কাঁদতে কাঁদতে অভিমানের পসরা সাজিয়ে বসেছে, একেএকে উগরে দিচ্ছে সব, ক্রীতিকের শার্টের বোতাম খুঁটতে খুঁটতে হেঁচকি তুলে অরু বললো,

---- শুধু আসেন নি তাতো নয়, একটা খোজ নেই, খবর নেই, আপনার ফোনটাও বন্ধ। আপনি জানেন আমি আপনার বাড়িতে পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে এসেছি কিন্তু আপনাকে পাইনি।

অরুর কথায় ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

--- খুজেছিস ভালো কথা, তাই বলে নাওয়া,খাওয়া বন্ধ করে এভাবে শুকিয়ে যেতে হবে?এখন আমি আদর করবো কোথায়? পিচ্চি মেয়েদের বিয়ে করলে এই হয়, পরিস্থিতি বোঝে না, কিছুনা, সারাক্ষণ ইমোশনাল হয়ে থাকে।

অরু কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,

--- ইমোশন যদি বুঝবেনই না, তাহলে করেছেন কেন পিচ্চি মেয়েদের বিয়ে? আমিকি বিয়ে করার জন্য নাচছিলাম?

অরুর এতোএতো কান্নাকাটি সহ্য হলোনা ক্রীতিকের, ও অরুকে এক ঝটকায় টেনে এনে নিজের বাহুতে আগলে ধরে এবার নরম সুরে বললো,

--- আমি কল্পনাও করিনি যে তুই আমার জন্য এতোটা ডেস্পারেট হয়ে যাবি, তাহলে জ্ঞান ফেরার পরে অন্তত অর্ণব কে দিয়ে খবর পাঠাতাম। কিন্তু তাই বলে তুই এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবি?

অরুর উত্তর নেই, ওতো ফোপাঁতে ফোপাঁতে নাকের পানি চোখের পানি দিয়ে ক্রীতিকের শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। ক্রীতিক সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে পুনরায় বললো,

--- এখানে আর থাকতে হবেনা, চল আমার সাথে।

অরু এবার মাথা তুলে শুধালো,

---কোথায় যাবো?

--- তোর হাসবেন্ডের বাড়ি আছে, সেখানেই।

অরু আঁতকে উঠে বললো,

---কি বলছেন, এই ঝড়ের মাঝে এতো রাতে?

--- যাবি কি না?

অরু কিছু বলছে না দেখে ক্রীতিক গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো,

--- আমিওবা তোকে কেন জিজ্ঞেস করছি অযথা? তোকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারবো না, সো না এর কোনো অপশন নেই।

ক্রীতিকের কান্ডে অরু হতভম্ব। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর, তাই একবার সবটা বোঝার জন্য নিজের দিকে তাকালো অরু,

পায়ে স্যান্ডেল, গায়ের ওড়নাটা ব্যাকসিটে পরে আছে, পরনে ফ্রক। বাইরে তুমুল বর্ষন। পেছনে ফেলে এসেছে মা আর আপাকে। পাশে বসে দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে সব চেয়ে কাছের মানুষটা আর অরু এভাবেই তার সাথে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে। অবশ্য জায়ান ক্রীতিকের দ্বারা সবই সম্ভব।

সানফ্রান্সিসকো ছাড়িয়ে শহরতলীর সেই নির্জন শুনশান রাস্তায় আসতেই ঘটলো বিপত্তি, গাছপালা ভে'ঙে পরে পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে আছে। সামনে যাওয়ার কোনোরূপ উপায়ান্তর নেই। অগত্যাই ক্রীতিক ব্রেক কষলো সেখানেই। পুরো রাস্তা জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার,বিদ্যুতের লাইনচ্যুত হওয়ায় রোড লাইট গুলোও নিভে আছে। চারিদিকে মানুষতো দূরে থাক একটা মশা-মাছিরও আনাগোনা নেই। অথচ বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এমন একটা পরিবেশে আটকে পরে অরুর গা ছমছম করছে। তাই ও মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,

--- এবার কি হবে?

ক্রীতিক একবার অরুর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো, অতঃপর গমগমে আওয়াজে বললো,

--- অরু ব্যাকসিটে চল।

অরু অবাক সুরে শুধালো,

--- কেন?

--- আমি বলেছি তাই।

অরু উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,

--- এভাবে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস কেন ফেলছেন?আপনার কি শরীর খারাপ করছে?

ক্রীতিক বললো,

--- হ্যা, চল এবার।

অরু আর কিইবা করবে, ক্রীতিকের শরীর খারাপ লাগছে দেখে তারাহুরো করে বেরিয়ে গেইট খুলে ব্যাক সিটে গিয়ে বসলো। ক্রীতিক ও অন্য সাইড থেকে এসে গেইট লাগিয়ে দিলো।

ক্রীতিক এসেছে দেখে অরু নিজের জামা কাপড় থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়া বাদ দিয়ে ওর ব্যান্ডেজ করা কপালে হাত ছুয়িয়ে বললো,

--- কোথায় খারাপ লাগছে দেখি?

ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ কোনোকিছুর পূর্বাভাস না দিয়েই, অরুর হাতটা পিছনে চেপে ধরে নিজের ঠোঁট দিয়ে ওর ওষ্ঠাধর দখল করে। ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরু বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ও নড়তে পারছে না, ক্রীতিককে ছাড়াতেও পারছে না, ওদিকে দম আটকে আসছে।

একটা দীর্ঘ আর গভীর চুম্বন শেষে ক্রীতিক অরুর ঘাড়টা চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে হিসহিসিয়ে বললো,

--- হার্টবিট, একবার তুমি বলে আপন সুরে ডাক, তোর মুখে তুমি শোনার ইচ্ছে আমার বহু বছরের।

অরুর চোখ বন্ধ, কোনোমতে জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

--- আপনিতো আমার অনেক বড়।

ক্রীতিক হাস্কিস্বরে বললো,

--- সো হোয়াট? আমি তোর সব থেকে আপন, আরেকটু পরে আমাদের মধ্যে কোন দূরত্ব থাকবে না, তাহলে আমাকে ডাকবি নাতো কাকে ডাকবি?

অরু এই মূহুর্তে পুরোপুরি ক্রীতিকের বশবর্তী, কোন এক অদৃশ্য জা'দুবলে ক্রীতিক ওকে পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে, তাই অরুও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

--- আপনাকেই বলবো।

--- তাহলে বল।

অরু পরাজিত সৈনিকের মতো ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো,

---ততুমি!

ক্রীতিক পুনরায় বললো,

--- চোখ খুলে, আমার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বল।

অরু এবার তাই করলো,শুষ্ক ঢোক গিলে ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে রিনরিনিয়ে বললো,

--- তুমি।

অরুর লজ্জারাঙা মুখ দেখে ক্রীতিক নিঃশব্দে হাসলো, অতঃপর একটানে অরুকে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,

--- আই নিড ইউ অরু, আই ডেস্পারেটলি নিড ইউ রাইট নাও। হবি না আমার?

ক্রীতিকের কথা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরে ভ্রম ছুটে গেলো অরুর,মূহুর্তেই ভ'য়ের চোটে আ'ত্মাটা শুকিয়ে গেলো ওর। ক্রমাগত ছটফট করতে লাগলো ক্রীতিকের কোল থেকে নামার জন্য। ক্রীতিক একহাতে অরুকে চেপে ধরে অন্যহাত দিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিরক্ত হয়ে বললো,

--- কি হয়েছে? ছটফট করছিস কেন?মা'রছি তোকে? আদরই তো করবো।

অরু আতঙ্কিত সুরে বললো,

--- আমার ভ'য় করছে।

অরু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক নিজের হাতে লাগানো ক্যানোলাটা একটানে বের করে ফেললো, তৎক্ষনাৎ ফিনকি দিয়ে র'ক্ত বেরোলো ওর হাত থেকে। অরু সেখানটায় চেপে ধরে বললো,

--- কি করছেন?

--- এটা ডিস্টার্ব করছে।

অরু এবার কম্পিত কন্ঠে বললো,

--- আপনি কি চাইছেন?

ক্রীতিক পুনরায় নিজের শার্টের বোতামে হাত চালাতে চালাতে অরুর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

--- তোকে।

ক্রীতিকের নেশালো আওয়াজে কেঁপে উঠলো অরু, তবুও অনেকটা সাহস সঞ্চার করে মিনমিনিয়ে বললো,

--- আমার ভ'য় করে আপনাকে।

ক্রীতিক একটানে অরুকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিয়ে বললো,

--- ভয় কেন?

অরু কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,

--- আপনি ডার্ক রোম্যান্স শোনেন সবসময়।

ক্রীতিক অরুর লম্বা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে ধীরে ধীরে ওর জামার চেইনটা খুলতে খুলতে বললো,

--- দিস ইজ ইউর ফার্স্ট টাইম, সো আ'ল বি জেন্টাল বেইবি.....

অরুর মাঝে ডুবে যেতে যেতে ক্রীতিকের মন বলছে,

"ঝলসানো রাতে,এ পো'ড়া বরাতে

তুমি আমার অন্ধকার..

আর রোশনাই....... "

মধ্যরাতে আকাশ বাতাস ছাপিয়ে বর্ষনে মুখরিত ধরনী,সেই সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তাল ঝড়ো হাওয়ায় চারিদিক কনকনে ঠান্ডা। ঝড়ের তান্ডব কমে এসেছে একটু একটু, অথচ অন্ধকারের মাঝে আটকে পড়া ব্ল্যাক মার্সিডিজটা এখনো সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে। ধরনীতে বহমান ঝড়ের গতিবেগ কমে এলেও দুটো হৃদয়ে এলোপাথারি বইতে থাকে উত্তাল জলো'চ্ছ্বাসের তান্ডব আজ রাতে বোধ হয় কমবে না আর। ক্রীতিকের অবাধ্য আচরণে ইতিমধ্যে অরু বুঝতে পেরেছে,আজ রাতটা ওর জন্য দীর্ঘতম হতে চলেছে, সেই সাথে নিদ্রাহীন।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩৩

একটি অপার্থিব সকাল, সেই শুরুর দিন গুলোর মতোই নিরিবিলি, নিস্তব্ধ,শুনশান পরিবেশ, দীর্ঘ ঝড়ের তান্ডব আর ঝুম বর্ষাকে সর্বেসর্বা বিদায় জানিয়ে, খুব ভোরেই সূর্য কীরন উঁকি দিয়েছে পূব আকাশে। দক্ষিণ জানালার কাঁচ গলিয়ে সেই একফালি মিঠে রোদ এসে আঁচড়ে পরছে অত্যাধুনিক ধাঁচের রুমটিতে। অরুর কাছে এই পরিবেশ, এই আবহাওয়া নতুন কিছু নয়, বরঞ্চ অনেকদিনের অভ্যেস।

তবে আজ এই নিস্তব্ধতার সাথে প্রথমবার নতুন করে যা যোগ হয়েছে,তা হলো চন্দন কাঠের মন মাতানো সুঘ্রাণ। রুমের আনাচে-কানাচেতে ম ম করছে এই চেনা পরিচিত পুরুষালী সুঘ্রাণ। বিছানা, বালিশ, কুশন,কম্ফোর্টার সব কিছুই বেশ স্নিগ্ধ লাগছে চনমনে এই স্যন্ডল উড পারফিউম আর মাস্কি সৌরভে। অরুর মনে হচ্ছে গত পনেরোটা দিনের নির্ঘুম রাতের কাছে আজকের এই আড়ামদায়ক ঘুমটুকু অমৃত সম। আর ও এই অমৃত সম ঘুমটুকু পুরোপুরি আহরন করতে চায় নির্বিগ্নে, তাইতো ঘুমের মাঝেই অরুর হৃদয়ে গিয়ে ঠেকছে নিদারুন এই সুগন্ধ,বারংবার মনে হচ্ছে এতোটা আরামের ঘুম কোনোদিন ঘুমায়নি ও।

ব্যথাতুর শরীরটাকে একটুখানি নাড়িয়ে চারিয়ে আরও খানিকটা সময়ধরে নতুন এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে বলে ভেলভেটের মতো মসৃন কুশনের মাঝে মুখ দাবিয়ে, মিঠে রোদটুকু পিঠে পিছলে দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে শুলো অরু। এলোমেলো হয়ে ঘুমানোর দরুন ওর রেসমের মতো সিল্কি চুল গুলো ছড়িয়ে পরে আছে পুরো বিছানা জুড়ে। সেগুলোকে গোছানোর কোনোরূপ প্রয়াস না চালিয়েই আবারও ঘুমের দেশে পারি জমালো অরু। তবে অরুর এই অমৃতসম আরামদায়ক ঘুম গাঢ় হতে পারলো না খুব একটা, তার আগেই কানে ভেসে এলো ইলেকট্রনিক্স মেশিনের ভসস ভসস আওয়াজ।

এহেন আওয়াজে ঘুমের মাঝেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর।কোথা থেকে এই আওয়াজের উৎস তা ঠাওর করার জন্য খানিকটা চোখ ও খুললো বটে। ঘুমের রেশ কাটিয়ে আড়মোড়া ভে'ঙে চোখের পাতা খুলতেই সফেদ রঙা সিলিং এর দিকে চোখ গিয়ে ঠেকলো ওর, যা দেখে হুট করেই বড্ড অপরিচিত লাগছে অরুর। কিন্তু চারপাশের স্নিগ্ধ সুঘ্রাণটা বড়োই পরিচিত। অগত্যাই ঘুমের ঘোর কাটিয়ে চারিদিকে চোখ ঘোরালো ও, সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পরে যায় ঝড় আর বৃষ্টিস্নাত নির্ঘুম বিগত রাতের কথা। কিছু ঘোর লাগানো মূহুর্ত আর তারপর জায়ান ক্রীতিকের অনেকটা কাছে চলে আসা। সব কিছুই সুস্পষ্ট অরুর মস্তিষ্কে এখন। সেসব কথা মাথায় আসতেই তীব্র লজ্জায় চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো অরু।

অরু যখন ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের কথাই ভাবছিল, ততক্ষনে ছক্কা লাগার মতো আরও একটা প্রশ্ন এসে মাথায় লাগলো ওর, মনেমনে ভাবলো,

--- তখন তো গাড়িতে ছিলাম, তাহলে এখন কোথায়?

কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় কানে ভেসে এলো সেই বিরক্তিকর ভসস ভসস আওয়াজ। আওয়াজের উৎস খোজার জন্য অরু এবার চোখ ঘুরিয়ে চাইলো ওয়াল মিরর এর দিকে, দেখলো ওর থেকে খানিকটা দূরত্বে আয়নার সামনে দাড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে করে চুল শোকাচ্ছ ক্রীতিক, পরনে তার ট্রাউজার সেট। ক্রীতিককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে অরু তরিৎ গতিতে কম্ফোর্টারের মধ্যে মুখ লুকালো,মুখ ঢাকা দিতে দিতেই নিচু স্বরে বিড়বিড়ালো,

--- নির্লজ্জ,নির্দয় লোক।

ওদিকে অরুর নড়নচড়ন টের পেয়ে ক্রীতিক হাতের কাজ চালাতে চালাতেই ডাকলো,

--- মিসেস অরোরা জায়ান!

ক্রীতিকের এহেন সম্মোধনে, কম্ফোর্টারের মাঝে বসেই উষ্ণতায় ছেয়ে গেলো অরুর সর্বাঙ্গ। লজ্জারা র'ক্তিম হয়ে ঘীরে ধরেছে মুখ মন্ডলের আনাচে কানাচে, সেই সাথে যোগ হয়েছে তলপেটের উড়ন্ত প্রজাপতি। লজ্জায় রাঙা হয়ে অরু যখন ঠোঁট কামড়ে মটকা মে'রে পরেছিল, তখনই পুনরায় ডেকে ওঠে ক্রীতিক,আয়নার দিকে তাকিয়েই বলে,

--- এটা আপনার বাপের বাড়ি নয় মিসেস জায়ান, এটা আপনার স্বামীর বাড়ি, তাই বারোটা পর্যন্ত ঘুমানোর বদ অভ্যেস দূর করতে হবে, কজ আপনার হাসবেন্ডকে সকাল সকাল ভার্সিটি যেতে হয়।

ক্রীতিকের এহেন খোঁচামা'রা কথায় অরু আর শুয়ে থাকতে পারলো না, অগত্যাই মুখ কাচুমাচু করে উঠে বসে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো খাটের ব্যাক স্ট্যান্ডে। ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের সফেদ রঙা শার্ট। সামনের দিকে শার্টের দুটো বোতাম খোলা, অরু নিজের অপটু হাতে বোতাম দুটো লাগিয়ে, একটু একটু চোখ উঁচিয়ে ক্রীতিককে দেখলো অতঃপর মিনমিনিয়ে শুধালো,

--- বাসায় কি করে এলাম?

ক্রীতিক এদিকে না ঘুরেই জবাব দিল,

--- ভুতে নিয়ে এসেছে তোকে।

অরু জানে ক্রীতিক মজা করছে, কিন্তু ওর কেন যেন কথা বলতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে, কথা তো দূরে থাক ক্রীতিকের চোখের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে এই মূহুর্তে । শান্ত,সাবলীল চোখ দুটোর দিকে তাকালেই বারংবার মনে পরে যাচ্ছে কাল রাতের অশান্ত, আর ঘোর লাগানো দৃষ্টিপাতের কথা, যা অরু উপেক্ষা করতে পারেনি,নিজের অজান্তেই আপন করে নিয়েছিল সেই মিষ্টি যন্ত্রনাটুকু। অথচ এখন সেসব কথা মনে পরলেই লজ্জায় ম'রে যেতে ইচ্ছে করছে অরুর। অরু চুপ হয়ে আছে দেখে ক্রীতিক বললো,

--- ঘুম না হলে,ঘুমাতে পারিস, ডিস্টার্ব করবো না।

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে মিনমিনিয়ে বললো,

--- আপনার মাথার ব্যন্ডেজ কোথায়?

ক্রীতিক বললো,

--- ফ্রেশ হওয়ার ছিল তাই খুলে ফেলেছি।

অরু ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- তাই বলে পুরো ব্যন্ডেজ খুলে ফেলতে হবে? আপনি এতো ছন্নছাড়া কেন বলুন তো?

অরুর কথায় ক্রীতিক এবার ঘুরে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,

--- কাল পুরোপুরি স্বামীর অধিকার দিয়েছিস, আর আজই শাসন করার স্টার্ট?

ক্রীতিকের কথা গায়ে না মেখে অরু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, ক্রীতিকের শার্টটা ওর হাঁটুতে গিয়ে ঠেকেছে, অরু সেটাকে টেনে হিঁচড়ে আরও খানিকটা নিচে নামাতে নামাতে বললো,

--- এখানে তো আমার কোনো জামা কাপড় নেই কি পরবো?

ক্রীতিক বললো,

--- ক্লজেট ভর্তি জামাকাপড় আছে যা খুশি পর গিয়ে।

--- ওগুলো তো আপনার, আমি কিভাবে পরবো?

ক্রীতিক এবার ম্যাকবুক নিয়ে ডিভানের উপর বসতে বসতে বললো,

--- আমার যা, তাই তোর। এখন থেকে আমার ড্রেসই পরবি তুই,সব তোর।

ক্রীতিকের কথায় অরু দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে বিড়বিড়িয়ে বললো,

--- আশ্চর্য লোক, এমনভাবে বলছে যেন সে ইনার ও পরে।

--- পরার দরকার নেই।

ক্রীতিকের রাশভারি আওয়াজ কানে ভেসে আসতেই, অরু হকচকিয়ে বললো,

--- কিহহ!

ক্রীতিক এবার ম্যাকবুক থেকে চোখ সরিয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বললো,

--- আমার সামনে ইনার পরার দরকার নেই।তোকে এসব ছাড়াই সুন্দর লাগে।

ওর এহেন কথায় অরু দ্রুত মাথা নিচু করে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,

--- নির্লজ্জ, বেহায়া লোক মুখে লাগাম নেই কোনো। ওনার লজ্জা নাই থাকতে পারে, তাই বলে কি আমারও নেই?

তবে ওয়াশরুমে আর ঢোকা হলো না অরুর, তার আগেই ওর চোখ আটকালো পায়ের নুপুরে, পা দুটো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নুপুরজোড়া ভালোমতো পরখ করে অস্ফুটেই অরু বললো,

--- অদ্ভুত তো আমার নুপুর গুলো এমন সোনালী রঙের হয়ে গেলো কেন?

অরুর কথায় ক্রীতিক ডিভান ছেড়ে উঠে এসে ওর সামনে দাড়িয়ে দু'পকেটে হাত গুঁজে বললো,

--- আর কবে বড় হবি অরু? তুই বড় হতে-হতে তো আমি বুড়ো হয়ে যাবো।

অরু মাথা তুলে করুন সুরে বললো,

--- কেন কি হয়েছে?

ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে বললো,

--- না কিছু না,আমার পিচ্চি বউ সোনা আর রূপার পার্থক্য বোঝেনা তাই বললাম আর কি। অবশ্য দোষটা আমারই।

মনেমনে বললো,

--- যখন পরিয়েছিলাম তখন তুই ঘুমের ঘোরে ছিলি, জানার কথাও নয়।

ক্রীতিকের কথায় মন খারাপ হয়ে গেলো অরুর,ও মুখ কালো করে শুধালো,

--- এভাবে কেন বলছেন কি করেছি আমি?

অরুর কথায় ক্রীতিক বললো,

--- কিছু করিস নি, হেটে যেতে পারবি নাকি হেল্প করবো?

আবার সেই লাগাম ছাড়া কথাবার্তা, ক্রীতিকের কথায় অরু দ্রুত ওই যায়গা থেকে প্রস্থান করতে করতে দাঁত কিরমিরিয়ে বলে,

--- পারবো আমি, সরুন তো।

*****************************************

দিনের দ্বিপ্রহর চলমান। সকালের মিঠে রোদ টুকু মিয়িয়ে গিয়ে কালো মেঘের আড়ালে ঠায় নিয়েছে সূয্যি মামা। যার দরুন অত্যাধুনিক হলরুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটা লম্বা হট শাওয়ার শেষে অন্ধকারের মাঝেই পা টিপে টিপে হলরুমে এসেছে অরু। নিচে নেমে কোনোকিছু না ভেবেই সবার আগে স্ফটিকের সবগুলো আলো জ্বালিয়েছে ও। এবার সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ফিকে হয়ে যাওয়া নিরিবিলি রুমে উপস্থিতি মাত্র দুজনার, অরু পাশ ঘুরে কাউচের দিকে তাকিয়ে দেখলো ক্রীতিক কাউচে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে বসে বাইক রেচিং গেইম খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অরু ক্রীতিককে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,অযাচিত মনটা লাফিয়ে উঠে শুধালো ,

--- আপনি কি করে থাকেন এতোটা একা একা? কষ্ট হয়না বুঝি?

অরু সেই তখন থেকে করুন চাহনিতে তাকিয়ে আছে দেখে গেইমটা পজ করে কানের হেডফোন নামিয়ে, ক্রীতিক বললো,

--- এভাবে ডিস্ট্রাক্ট করতে মন চাইলে রুমে চল,আমিও একটু মন ভরে দেখি তোকে। কাল রাতে মন ভরেনি।

ক্রীতিকের কথা গায়ে না মেখে অরু কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো,

--- খিদে পেয়েছে, কি রান্না করা যায় বলুন তো?

অরু কিচেনের দিকে দু'কদম এগিয়ে যেতেই কঠিন সুরে বাধ সাধে ক্রীতিক, ওকে আর এক পাও বাড়াতে না দিয়ে ক্রীতিক বলে,

--- খবরদার কিচেনে যাবি না তুই।

ক্রীতিকের কথায় অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে পেছনে তাকিয়ে শুধালো,

--- কিচেনে না গেলে রান্না কিভাবে করবো?

ক্রীতিক মনিটরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

--- ফ্রীজে স্যালাড, আর পাস্তা রাখা আছে গরম করে খেয়ে নে।

অরু নাক সিকোয় তুলে বললো,

--- আমি এসব খেতে পারিনা, তাছাড়া রান্না করলে সমস্যাটা কোথায়?আগেও তো রান্না করতাম, আর আপনি খেতেনও। তাহলে এখন কিসের অসুবিধা আপনার?

ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,

--- আগের কথা ভুলে যা,এখানে তোকে রান্না করার জন্য আনিনি আমি।

অরু কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে, দুহাত বুকে ভাজ করে বললো,

--- তাহলে কেন এনেছেন শুনি?

অরুর শেষ কথাতে ক্রীতিক মনিটরের গেইমটা পজ করে রিমোট কন্ট্রোলটা কাউচের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাড়ালো, অতঃপর ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে অন্যহাত দিয়ে লম্বা ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে অরুর দিকে এগিয়ে এসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কি আওয়াজে বললো,

--- দুটো রিজন, এক ইচ্ছে মতো আদর করার জন্য, আর দুই আমাকে অভ্যেসে পরিনত করার জন্য।

ক্রীতিকের কথায়, অরু খানিকটা ভরকে যায়, অযাচিত লজ্জায় মিয়িয়ে যাওয়া মুখখানা হুট করেই আড়াল করে দাড়িয়ে পরে উল্টো দিকে।

ক্রীতিক সেভাবেই দাড়িয়ে অরুর আগাগোড়া পরখ করতে থাকে। ক্রীতিকের ক্লজেটে কালোর সমাহার, সেখান থেকেই বেছে নিয়ে একটা একটা ব্ল্যাক ওভারসাইজ টিশার্ট, আর একটা থ্রী কোয়ার্টার পরেছে অরু। ক্রীতিকের থ্রী কোয়ার্টার অরুর ফুল প্যান্টে পরিনত হয়েছে। দেখতেও বেশ কিউট লাগছে ওকে। অরুকে ভালোমতো পরখ করে ওর কনের কাছে মুখ নিয়ে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

--- আমার ড্রেসে তোকে মারাত্মক লাগছে হার্টবিট।এখন থেকে আমার সামনে অন্যকিছু পরার দরকার নেই।

অন্য কিছু পরার দরকার নেই মানে? এ আবার কেমন কথা?অরু কি এখন সারাজীবন এসব দানবীয় সাইজের পোশাক আশাক পরে ঘুরে বেড়াবে নাকি আশ্চর্য? মানুষ কি বলবে? কথাটা ভেবেই বিরক্ত হলো অরু, বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে পেছনে ঘুরে ক্রীতিককে হালকা ধাক্কা মে'রে সরিয়ে কাউচে গিয়ে বসতে বসতে বললো,

--- খিদে পেয়েছেতো আমার,সালাদ খেতে পারবোনা, অন্যকিছুর ব্যবস্থা করুন।

ক্রীতিক পকেট থেকে ফোন বের করে, সেটা স্ক্রল করতে করতে বললো,

--- আমি রান্না টান্না করতে পারিনা, কি খাবি বল অর্ডার করে দিচ্ছি।

অরু একঝলক ক্রীতিককে পরখ করে কিছু একটা ভেবে বললো,

--- বলছি তার আগে এদিকে আসুন।

ওর অকস্মাৎ সম্মোধনে ক্রীতিক ফোন থেকে নজর সরিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

--- সিরিয়াসলি তুই আমাকে কাছে ডাকছিস? তাহলে কাল এতো কান্নাকা'টি করার কি মানে ছিল অরু?

আবার সেই ভুলভাল কথা টানছে ক্রীতিক, এই লোকের মাথায় আর কিছু নেই নাকি? ভেবে পায়না অরু, এমনকি ভাবার জন্য খুচরো সময় নষ্ট ও করেনা, বরং উঠে এসে কোনোরূপ কসরত না দেখিয়েই অনেকটা অধিকার নিয়ে নিজের হাত দিয়ে ক্রীতিকের খরখরে পুরুষালি হাতটা ধরে ওকে টেনে এনে কাউচে বসালো। অরুর কান্ডে ক্রীতিক আর বাঁধ সাধলো না, উল্টে কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে অরুকে নিজের কোলে বসিয়ে নরম সুরে শুধালো,

--- এখানে কেন?

অরু পেছনে ঘুরে ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে আলতো হাত বুলিয়ে বললো,

--- আপনার এখন হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে ফ্রুটস খাওয়া উচিৎ, তা না করে আমাকে কথা দিয়ে পিষ্ট করছেন।কতটা গভীর ক্ষত হয়েছে একবারও খেয়াল করেছেন?

ক্রীতিক অরুর কথার দু’পয়সা তোয়াক্কা না করে নিজ হাত দিয়ে ওর গালদুটো চেপে ধরে বললো,

--- কতবার বলেছি আমাকে তুমি করে বলবি, কথা শুনিস না কেন?

অরু ক্রীতিকের চোখ থেকে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে অস্পষ্ট সুরে বললো,

--- পারবোনা,আমার লজ্জা লাগে ভীষন।

ক্রীতিক ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,

--- এখনো লজ্জা?

অরু ক্রীতিককে কিভাবে বোঝাবে কাল রাতের কথা উঠলেই কান দিয়ে ধোয়া বের হয় ওর, ভীষণ লজ্জায় শিহরণ জেগে ওঠে ক্ষুদ্র নারীদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সেই শিহরণে কেঁপে ওঠে অষ্টাদশীর হৃদয়,মন সবকিছু। হৃদয়ের সাথে কম্পিত হয় ধনুকের মতো বাঁকানো নারী শরীরটাও।

পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নেয় অরু, শখের পুরুষের সেই শিহরণ জাগানো প্রথম ছোঁয়াকে পুরোপুরি মাথা থেকে সরিয়ে, মনের মাঝে জেঁকে বসে তার প্রতি একটুকরো ব্যাথাতুর ভালোবাসা, বারবার মনে হতে থাকে,

---- কেন আপনি এতো একা জায়ান ক্রীতিক? আপনার জীবনটা অন্যসবার মতো সাভাবিক নয় কেন? এতোগুলা বছর কি করেই বা একা একা বেঁচে আছেন আপনি? আমি কি আপনার জীবনের এই একাকিত্ব আদৌও দূর করতে পারবো কোনোদিন?

অরু চুপচাপ বসে আছে দেখে ক্রীতিক আগ বারিয়ে শুধালো,

--- কি ভাবছিস?

অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে টি টেবিল থেকে ফাস্ট এইড বক্স হাতরিয়ে, ক্রীতিকের কোল থেকে নেমে গিয়ে পাশে বসে বললো,

--- এ্যা'ক্সিডেন্ট কিভাবে করলেন?

ক্রীতিক কাউচের ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললো,

---- সেদিন তোর মায়ের বাসা থেকে বেরিয়ে বাইকে রাইডিং এ গিয়েছিলাম, ইম্পর্টেন্ট ম্যাচ ছিল তাই না করতে পারিনি,হয়তো মেন্টালি ডিস্ট্রাক্ট ছিলাম, তাই নিজের উপর কন্ট্রোল ছিলনা।

ক্রীতিকের কথায় ভয়ের চোটে অরুর শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে গেলো। কোনোমতে ওর মাথায় সফেদ ব্যান্ডেজের আস্তর লাগাতে লাগাতে অরু বললো,

--- আপনার রা'গটাকে ভীষন ভয় করে আমার। কোনোদিন যদি..

অরু কথা শেষ করতে পারলো আর,তার আগেই ওকে টান মে'রে নিজ বুকের উপর ফেলে দিয়ে ক্রীতিক আগের মতো করেই হিসহিসিয়ে বললো,

--- নিজের হার্টবিটকে কেউ আ'ঘাত করে?

অরু ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

--- তাহলে নিজেকে কেন করছেন? আপনি একটুখানি ব্যাথা পেলে আমারও তো কষ্ট হয়।

অরুর কথায় ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো, শেষ কবে, কোথায়,কখন ওকে কেউ এভাবে বলেছে। ওর ক্ষত,ওর ব্যাথা এসব নিয়ে চিন্তা করেছে, ওকে একটু আপন করে আগলে ধরেছে, ক্রীতিকের মনে নেই, তাই বোধ হয় অরুই জীবনে প্রথম যে ক্রীতিককে অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে বেধেছে। আজ ক্রীতিকের অশান্ত হৃদয়টা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলছে,

--- এতো বছরের অপেক্ষা খুব একটা কষ্টের ছিলনা অরু, এখন তো সেসব শুধুই স্মৃতি মাত্র, আমার অরু এখন আমার বুকেই আছে, আর কক্ষনো কেউ এই দূরত্ব বাড়াতে পারবে না, তোর আমার মাঝে যদি কেউ দুঃসপ্নেও চলে আসে, তবে তারাও বাকিদের মতোই আমার আসল পৈচাশিক রূপটা স্ব চোখে দেখতে পাবে। অর মেইবি লাইফটাও দিয়ে দিতে হতে পারে হু নোজ?

*****************************************

ইজি চেয়ারের নরম গদিতে বসে বারবার গা দোলাচ্ছেন গভীর চিন্তাগ্রস্থ আজমেরী শেখ।মনেমনে কষছেন একের পর এক ছক। তার ছোট মেয়েকে যে জায়ান ক্রীতিক নিয়ে গিয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই সুকৌশলি মস্তিষ্কের আজমেরী শেখের। তার এতো কড়া শাসন, এতোটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, এতোটা দাম্ভিকতা সবকিছুকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেলো তারই সৎ ছেলে। যে সবসময় আজমেরী শেখের সাথে টেক্কা দিয়ে চলতে পছন্দ করে, কিন্তু আজমেরী নিজেও তো চুপচাপ বসে থাকার মানুষ নয়, কৌশলে কিভাবে চেক মেট দিতে হয় সেটা তারও জানা।

তাছাড়া সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো মান সম্মান, জায়ান ক্রীতিকের মতো বে'য়াদব, বেহায়া ছেলে যে সমাজের ধার ধারে না কোনোকালেই তার দ্বারা সবই সম্ভব, নিজের সৎ বোনকে বিয়ে করাও সম্ভব।

কিন্তু আজমেরী শেখের চরিত্র পুরোপুরি ক্রীতিকের বিপরীত,সে সব কিছুতে সবার আগে সমাজকে প্রাধান্য দেয়, সে মতোই প্রতিটা কাজ করে ,ওই জন্যই হয়তো তাদের মাঝে এই দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধ।

---আমেরিকায় তোমাদের রেজিষ্ট্রি হয়েছে, বাংলাদেশে তো নয়। এখন আমিও যদি তোমার মতো কৌশলে চালি তাহলে কি করবে তুমি জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী?

বেশ অনেকক্ষন ধরে ভাবতে ভাবতে কিঞ্চিৎ ক্রুর হেসে বিড়বিড়ালেন আজমেরী শেখ।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩৪

আকাশে শুক্লপক্ষের মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে, তার চারিপাশে তারকারাজির নির্ভীক অবস্থান। মিটিমিটি জ্বলন্ত তারকারাজি আর চাঁদের রূপোলী আলোয় ভেসে যাচ্ছে নির্জন পাহাড়ি শহরতলীর রাস্তাঘাট।

ভোরের দিকে সেই যে একপশলা ঝুম বৃষ্টি হলো, তারপর থেকেই আকাশ পরিস্কার। রাতের আকাশে পেজা তুলোর মতো উড়ো মেঘের আড়ালে ক্ষনে ক্ষনে গা ঢাকা দিচ্ছে শুক্লপক্ষের সুন্দরী চাঁদ। তাই জোস্ন্যা রাতের নিয়ন আলো ছাপিয়ে একটু একটু আলোছায়া এসে খেলা করছে পর্দা সরিয়ে রাখা অত্যাধুনিক মাস্টার বেড রুমের আনাচে কানাচে ।

অরু আজ সন্ধ্যা হতে না হতেই রুমের সবকটা আলো নিভিয়ে পারি দিয়েছে ঘুমের দেশে , যদিও বা ক্রীতিক মুখে অনেক কিছুই বলেছিল, তবে কার্যত অনলাইনে অরুর সবরকম প্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করে দিয়েছে সে। কারণ আর যাই হোক অরুকে কোনোরূপ অসস্থিতে দেখতে চায়না ক্রীতিক,তাও ওর নিজের বাড়িতে বসে।

এই যেমন আজ সারাদিন অরুর ভীষণ মন খারাপ ছিল। ক্রীতিকের ভ'য়ে বেচারি বলতেও পারছিল না যে, ও আপা আর মাকে মিস করছে।দুদিন ধরে অরু নেই,তারা কি করছে, কেমন আছে, আদৌও অরুকে খুজছে কিনা সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অরু। সেদিন হৃদ মাঝারে সদ্য গজিয়ে ওঠা প্রনয়ের টানে ক্রীতিকের সঙ্গে চলে এলেও, এখন মা আর আপার কথা মনে পরতেই হৃদয় খামচে ওঠে অরুর। বুকের মাঝে দানাবাঁধে কষ্টরা,সেই কষ্ট প্রতিফলিত হয় ওর চোখে মুখে।

অরুর চুপসে থাকা মলিন মুখ দেখে কিছুটা হলেও ঘটনা আঁচ করতে পারে ক্রীতিক, কিন্তু ওর ও তো কিছু করার নেই, অরুকে যেতে দেওয়া, কিংবা ভুলে যাওয়া, দুটোই পুরোপুরি অসম্ভব ক্রীতিকের পক্ষে। কারন ক্রীতিক ভালো করেই জানে অরুকে যেতে দিলে ও নিজেই বাঁচবে না।তবে ক্রীতিক তো ভারী কঠিন হৃদয়ের মানুষ, তাই নিজের দূর্বলতাটুকু পুরোপুরি আড়াল করে, একটা টিভি আনিয়ে সেটাকে সেট করে দিয়েছে হলরুমের মাঝ বরাবর, নিজের গেমিং মনিটরের পাশেই। এতো বড় টিভি দেখে অরু যখন শুধালো,

--- এটা কেন এনেছেন?

তখন জবাবে ক্রীতিক বলে,

--- বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকার মতো টাইম আমার নেই,তাই সময় কাটানোর জন্য এনে দিয়েছি, আমি যখন না থাকবো তখন বসে বসে নেটফ্লিক্স দেখবি।

ক্রীতিকের গমগমে রুষ্ট কথায় মেজাজ খিটখিটিয়ে উঠলো অরুর, তবে এখন পর্যন্ত ঝাজিয়ে তেঁতো গলায় কথা বলার সাহস ওর হয়ে ওঠেনি, তাই অরু সহসাই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

---- সময়ই যখন নেই,তাহলে অমন মাঝরাতে রাস্তা থেকে নিয়ে এলেন কেন?

ক্রীতিক রিমোট কন্ট্রোলটা ভালোমতো চেক করতে করতে জবাব দেয়,

---- থাকতে পারছিলাম না তাই,তোকে দেখতে ইচ্ছে করলে হাজারটা ব্যস্ততাকেও পায়ে ঠেলে দিতে পারি আমি। তাই আমার ফিলিংস নিয়ে এতো ভাবতে হবে না তোর। নিজে কেন বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস সেটা নিয়ে ভাব।

অরু আর জবাব দিলোনা, ক্রীতিকের সাথে বেহুদা তর্ক করার এনার্জি নেই ওর,মনটা বিষিয়ে আছে সেই সকাল থেকেই, তাই কথা না বাড়িয়ে গটগট করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলায় চলে গেলো অরু। দোতলায় গিয়ে ক্রীতিকের রুমের দিকে আর পা বাড়ালো না ও, বরং উল্টো ঘুরে বিপরীত পার্শে ওর আর অনুর জন্য বরাদ্দ কৃত সেই আগের রুমটায় প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নিঃশব্দে তলিয়ে গেলো ঘুমের দেশে।

.

অরু অন্যরুমে গিয়ে শুয়েছে ব্যাপারটা নজরে আসতেই, ক্রীতিকের তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠলো। অকস্মাৎ র'ক্ত টগবগিয়ে উঠলো ধমনীর শিরায় শিরায়, এমনিতেই অরুর বিষন্ন মুখ আর উদাসীনতায় ক্রীতিকের মেজাজটা বিগড়ে ছিল সারাদিন , তারউপর এখন আবার অরুর এমন কান্ড। ক্রীতিকের শক্তপোক্ত চওড়া বক্ষ ছাড়া অরু অন্যকোথাও মুখ দাবিয়ে ঘুমাবে সেটা বোধ হয় ক্রীতিক কল্পনাতেও ভাবতে চায়না,আর অরু কিনা একদিনের মাথায়ই অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো? কথাটা ভাবতেই ক্রোধটা তুঙ্গে উঠে এসেছে ওর। হঠাৎ বেড়ে ওঠা তীব্র ক্রোধটাকে কোনোমতে ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে,দু'আঙুলে নিজের গলাটা ঘষতে ঘষতে কিছু একটা ভাবলো ক্রীতিক। অতঃপর চট করেই উঠে চলে গেলো দোতলায় অরুর ঘরের দিকে ।

.

প্রকট আক্রোশ আর চরম বিরক্তি নিয়ে রুমের মাঝে পা বাড়াতেই, ঘুমন্ত অরুকে দেখা মাত্র পা দুটো সহসা ধীর হয়ে যায় ক্রীতিকের, সেই সাথে মস্তিষ্কের জ্বলন্ত ক্রোধে ভাটি পরে তৎক্ষনাৎ, রুমের পর্দাগুলো আলগোছে ঠেলে ধীর পায়ে, ঘুমন্ত নিষ্পল অরুর দিকে এগিয়ে আসে ক্রীতিক।

খানিকক্ষন সেই ঘুমন্ত মুখটা মনদিয়ে পরখ করে ওকে দু-হাতে তুলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরে যেতে যেতে হিসহিসিয়ে ক্রীতিক বলে,

--- তোর ঘুম তোকে বাঁচিয়ে দিলো অরু, নয়তো আজ আমি তোর ঠিক কিই হাল করতাম সেটা নিজেও জানিনা। আজ তুই টের পেতিস জায়ান ক্রীতিকের রোমাঞ্চ আদতে কতটা মারাত্মক। যেটা সহ্য করতে পারবি না তার জন্য উইশ করিসনা হার্টবিট।কষ্টটা তোরই হবে।

*****************************************

অরু সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়েছে, আর এখন রাতের শেষ প্রহর চলমান, ঘড়ির কাটায় ঠিক কয়টা বাজে জানা নেই অরুর, জানার অবশ্য কথাও নয়, ও তো ঘুমের ঘোরে বুদ হয়ে আছে এখনো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, অরুর মনে হচ্ছে কয়েকক্রোশ দূর থেকে ওকে কেউ গলা উঁচিয়ে ডাকছে, গলার আওয়াজ স্পষ্ট নয়, তাই অরু এবার ঘুমের ভ্রম কাটিয়ে একটু সচকিত হলো, অতঃপর খেয়াল করে শোনার চেষ্টা করলো সেই দূরের আওয়াজ। এবার চোখ বুজেই সুস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো অরুর কানে, কয়েকক্রোশ দূর থেকে নয় বরং খুব কাছে, একেবারে কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে হাস্কিস্বরে ডাকছে ক্রীতিক,

--- আমার ঘুম পরী উঠে পরো।

ক্রীতিকের তপ্ত নিঃশ্বাস, আর আলতো ঠোঁটের পরশ ক্রমশই কানে গলায় এসে স্পর্শ করছে ওর,ক্রীতিকের এহেন নেশা ধরানো স্পর্শে অগত্যাই ঘুম ছুটে গেলো অরুর। ও চট করেই চোখ দুটো খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,

---- কি বললেন? আবার বলুন।

ক্রীতিক উঠে দাড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

---- বলেছি অনেক ঘুম হয়েছে, এবার উঠে পর,বের হবো আমরা।

অরুর স্পষ্ট মনে আছে, ক্রীতিক বেশ নরম গলায়, আদুরে ভাষায় সম্মোধন করেছিল ওকে,অথচ এখন তার পুরোপুরি বিপরীত, তবে এসবের বাইরেও যেই প্রশ্নটা সবার আগে অরুর মস্তিষ্কে গিয়ে ঠেকলো সেটা হলো,

---- এই ভোর রাতে কোথায় যাবেন উনি?

অরুকে ভাবতে দেখে ক্রীতিক বললো,

--- এখন আবার দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করলি নাকি?

অরু শোয়া ছেড়ে উঠে বসে শুধালো,

--- এতো রাতে কোথায় যাবো?

ক্রীতিক অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে এগোতে এগোতে বললো,

---- আমি যেখানে নিয়ে যাবো, যেদিকে নিয়ে যাবো, যে দেশে নিয়ে যাবো, ইভেন ম'রতে নিয়ে গেলেও, সেখানেই চুপচাপ যাবি তুই ,উইথ আউট এনি কোশ্চেন অর এনি ডাউট ।

অরু নিজের ঝীম ধরা ঘুমুঘুমু মাথাটা ক্রীতিকের কাঁধের উপর এলিয়ে দিয়ে মনেমনে বলে,

---- করবোনা, কখনো কোনো প্রশ্ন করবো না, যেখানে খুশি নিয়ে যাও শুধু এভাবেই নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখো,আমি চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করবো তোমায়,ইভেন উইথ আউট এনি কোশ্চেন অর এনি ডাউট।

*****************************************

হাইওয়ে রাস্তা ধরে হাওয়ার গতিতে ছুটে যাচ্ছে ইয়ামাহা খচিত গাঢ় নীল রঙের বাইকটা, স্পিডোমিটারের গতি তখনও একশোর কাটা ছুঁই ছুঁই। অরু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ক্রীতিককে, ও জানেনা ক্রীতিক ওকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তারউপর ঘুমের রেস এখনো কাটেনি ভালোকরে, কি করেই বা কাটবে? ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। অগত্যাই নিজের টাল সামলানোর জন্য ক্রীতিকের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে অরু। ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের কালোরঙা টিশার্ট আর থ্রী কোয়ার্টার। ক্রীতিকের পরনেও একই রঙের কেলভিন ক্লাইন খচিত টিশার্ট। দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুজন পরিকল্পনা করেই একই রকম কাপড় পরিধান করে বেরিয়েছে। যাকে বলে ম্যাচিং ম্যাচিং....

ঘন্টা খানেকের দূর্বার রাইডিং এর পর বাইক এসে থামলো একটা পাহাড়ি রিসোর্টের সামনে, সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় তার অবস্থান।অন্যদিক দিয়ে এলে সোজা রিসোর্টের গেইটে গাড়ি দাড় করানো যেত, অযথা এতোখানি ঘুরে এই পাহাড়ি রাস্তার ঢালে বাইক থামানোর কি মানে আছে জানেনা অরু। রিসোর্টে টাঙানো ল্যানটার্ন আর ফেইরী লাইটের কৃত্তিম আলোয় পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু করে আঁকাবাকা রাস্তা অবধি যতদূর চোখ যায় সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। অরু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ক্রীতিককে শুধালো,

---- এখানে কেন নিয়ে এলেন? এখান থেকে হেটে হেঁটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে অতো উপরে উঠতে গেলে জান বেরিয়ে যাবে। আমি পারবো না।

ক্রীতিক নিজের হেলমেট খুলে বাকেট হ্যাট টা পরে নিয়ে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললো,

---- তোকে উঠতে বলেছি আমি?

অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,

---- তাহলে?

ক্রীতিক আর জবাব দিলো না অরুর প্রশ্নের, বরং এগিয়ে এসে অরুকে কোলে নিয়েই, একে একে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলো পাহাড়ের চূড়ায়,

ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরুর চোখ কপালে উঠে গিয়েছে,সেই সাথে শুকিয়ে গিয়েছে গলার তরল টুকুও, নিজের শক্ত হাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে, জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে কম্পিত কন্ঠে অরু বলে,

---- এভাবে কোলে নিয়ে অতো উপরে ওঠা টা রিস্ক হয়ে যাচ্ছেনা? না মানে এধারওধার হলে যদি কিছু হয়ে....

ক্রীতিক অরুর দিকে না চেয়েই পা চালাতে চালাতে জবাব দিলো,

---- ম'রলে দুজন একসাথে ম'রবো, আর কোনো আপসোস থাকবে না,সেটাই ভালো নয় কি?

---- কিন্তু আপনার তো আমাকে নিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে।

ক্রীতিক অরুকে একঝলক দেখে নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো,

---- আমি একবারও বলেছি তোকে কোলে নিয়ে উপরে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছে?

ক্রীতিকের কথায় অরু না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,

---- তাহলে বেশি বোঝা বন্ধ কর নয়তো মা'র খাবি।

ক্রীতিকের এহেন কথায় অভিমান হলো অরুর, আগে সম্পর্ক যা-ই ছিলো মানা যায়,কিন্তু এখন তো স্বামী হয়ে গিয়েছে,এখনও কিনা ক্রীতিক মা'রতে চায় ওকে?ব্যপারটা বেশ অ'পমান জনক আর লজ্জার ।স্বাভাবিক ভাবে অরুরও খারাপ লেগেছে,তাই দরদ দেখানোর সকল ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর একটাও কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ হয়ে ক্রীতিকের কোলেই বসে রইলো অরু।

ক্রীতিক যখন পাহাড়ের চূড়ায় এসে অরুকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, রিসোর্টের আবছা আলোয় অরু চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যায়গাটা সংরক্ষিত, কিন্তু আপাতত কোনো মানুষের আনাগোনা নেই এখানে, পেছনে অবস্থিত সফেদরঙা কটেজ গুলোর ব্যাক ইয়ার্ডটা বেশ সুন্দর এবং সুসজ্জিত। আর সামনে রয়েছে বিস্তৃত খোলা আকাশ, অরু যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখান থেকে কয়েক কদম এগোলেই গভীর খাদ। সেদিকে ভুলক্রমে উঁকি দিলেও পিলে চমকে ওঠে অরুর, শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় শীতল ঠান্ডা স্রোত। অথচ সেখানে গিয়েই পা দুলিয়ে বসেছে ক্রীতিক,বসে থেকেই আঙুলের ইশারায় ডাকলো অরুকে।

ক্রীতিকের ইশারা বুঝতে পেরে অরু,না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,

---- আমি ওখানে যাবোনা, আমার ভ'য় করছে,তাছাড়া নিচের দিকে তাকালেই আমার কেমন গা গুলিয়ে ওঠে।

ক্রীতিক খানিকটা দূরে দাড়িয়ে থাকা অরুকে আশ্চর্য কন্ঠে শুধালো,

----- আমি থাকতে ভ'য় কিসের তোর?

ক্রীতিকের এই একটা বাক্যই যথেষ্ট ছিল অরুর আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্য। অরু জানে, জায়ান ক্রীতিক বেঁচে থাকতে ওর শরীরে বিপ'দের সুক্ষ্ম আঁচ ও লাগতে দেবেনা সে, অবশেষে সেই বিশ্বাসের দৃঢ়তা থেকেই সহসা এগিয়ে গিয়ে সাবধানে ক্রীতিকের গা ঘেঁষে পাহাড়ের চূড়ায় বসে পরলো অরু। অরু বসার সঙ্গে সঙ্গে ওর কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে কচি ঘাসে আবৃত মাটির উপর শুয়ে পরে ক্রীতিক। ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরু ধরফরিয়ে উঠে বললো,

---- কি করছেন, খাদে পরে যাবেন তো?

অরু কথায় ক্রীতিক বাঁকা হাসিতে ঠোঁট প্রসস্থ করে, অতঃপর কোনো টু শব্দ না করেই, হাত উঁচিয়ে একটানে অরুর লম্বা চুলের গার্ডারটা খুলে নেয় নিজ হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝরিয়ে ক্রীতিকের শরীরে আঁচড়ে পরলো রেশমের মতো সিল্কি চুল গুলো। অরুর চুলগুলোকে নিজের বুকে যায়গা করে দিয়ে ক্রীতিক বললো,

---- খোলা চুলে তোকে বরাবরই এট্রাক্টিভ লাগে। আমি পাগল হয়ে যাই দেখলে।

ক্রীতিকের কথায় অরু ভ্রু কুঁচকালো, কি প্রশ্নে কি উত্তর দিলো এই লোক? নিজের বিরক্তিটুকু ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে অরু আবারও শুধালো,

---- কি বলছেন এসব?

ক্রীতিক অরুর হাতটা নিজের চুলের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,

--- হাত বুলিয়ে দে,ঘুমাবো আমি। কাল সারারাত ঘুমায়নি।

অরু কর্কষ আওয়াজে শুধালো ,

--- কেন ঘুমাননি, নিষেধ করেছিলাম আমি?

ক্রীতিক চোখ দুটো বন্ধ করেই জবাব দিলো,

---- তোর জন্যই তো ঘুমাতে পারিনি, নিজের রূপ দেখিয়ে আমাকে সিডিউস করেছিস,তোর শা'স্তি হওয়া উচিৎ।

---- বা-রে আপনি বুঝি আমাকে খুব ঘুমাতে দিয়েছেন? গাড়ির মধ্যেই তো....

কথাটা শেষ করার আগেই নিজের জিভে লাগাম টানলো অরু, কথায় কথায় কিসব বলা শুরু করেছে টের পায়নি তখন, আর এখন নিজের লাগামহীন কথায় নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব, মনেমনে ভাবছে,

---- সব দোষ এই জায়ান ক্রীতিকের, ওনার সাথে দুদিন থেকেই ঠোঁট কা'টা হয়ে গিয়েছি আমি। ভবিষ্যতে যে আরও কত অভ্যেস জুটিয়ে ফেলবো তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এখন কি করি?অগত্যাই কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে অরু নরম স্বরে ক্রীতিককে বললো,

---- ঘুমাবেন যখন বাড়িতে ঘুমালেই তো পারতেন? কষ্ট করে এতো দূর রাইড করে আসার কি দরকার ছিল শুনি?

ক্রীতিক ঘুমু ঘুমু আওয়াজে জবাব দিলো,

---- কেন নিয়ে এসেছি সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবি।

*****************************************

ক্রীতিক ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ, অরু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ক্রীতিকের চুলের ভাঁজে, আর মনেমনে ভাবছে,

---- আগে আপনার চোখের দিকে তাকাতেও ভ'য় করতো আমার, মনে হতো এই বুঝি ভাসা ভাসা চোখ দুটো দিয়ে গিলে খাবেন আমাকে, অথচ এখন দেখুন, পুরো দুনিয়ার আড়ালে কতোটা আয়েশ করেই না ঘুমিয়ে আছেন আপনি আমার কোলে।আর আমাকে দেখুন কতোটা নিঃসংকোচে, কতোটা যত্ন করে আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কেনইবা দেবোনা বলুন, আপনাকে তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি, আপনি কি তা জানেন?

অরুর মন গহীনের হাজারও সহজ সীকারোক্তি তখনই থেমে যায়, যখন ও দেখতে পায় চোখের সামনে বিস্তৃত আকাশে কুসুম রঙা সূর্য উদয় হচ্ছে। ভোর হয়েছে,প্রশান্ত মহাসাগরীয় হিমেল হাওয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে শরীর,কর্ণকূহরে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ, আর চোখের সামনে পুরো আকাশ জুড়ে ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে একফালি র'ক্তিম সূর্য কীরন। কি অপরূপ দৃশ্য, এতোটা কাছ থেকে আগে কখনো সূর্যদয় দেখার সুযোগ হয়নি অরুর এটাই প্রথমবার, তাই নিজের ভেতরের চরম উৎকন্ঠাকে দমাতে না পেরে দু'হাতে ঘুমন্ত ক্রীতিকের চুল খামচে ধরে খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো ও।

হঠাৎ করেই চুলে বেশ জোরেশোরে টান পরায় অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠে বসলো ক্রীতিক,চিৎকার রত অরুর দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

---- কি হয়েছে?

অরু খুশিতে টলোমলো চোখে আঙুল উঁচিয়ে সূর্যদয় দেখালো,ক্রীতিক এবার মৃদু হাই তুলে সেদিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে অরুর দিকে চাইলো, যে এই মূহুর্তে মুগ্ধনয়নে ধরনী জুড়ে সোনালী সূর্যের আগমন দেখছে।

আর ক্রীতিক দেখছে তার অরুকে, নিস্প্রভ চোখে অরুকে দেখতে দেখতেই ক্রীতিকের মন বলে,

----- আমার চাঁদ সূর্য দুটোই তোর মাঝে নিবদ্ধ অরু, তোর মাঝেই তারা উদীয়মান, আবার তোর মাঝেই তারা অস্তমান, আমি কেবল মুগ্ধ নয়নে দেখি আর ভাবি কি অপরূপ তারা।

গলে যাওয়া মোমের নিয়ন অগ্নিশিখায় তোকে প্রথমবার দেখেছিলাম আমি,সেটাই ছিল আমার দেখা সবচেয়ে অপরূপ দৃশ্য। প্রথম দেখাতেই তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছিলো হৃদয়টা,যে তৃষ্ণা আজও মেটেনি আমার, বরাবরই আমি সার্থপর,আর সার্থপরের মতোই তোকে অতিরিক্ত চাই। সেদিনের পর থেকে এক অষ্টাদশী ছাড়া আর কাউকে মনভরে দেখার ইচ্ছে জাগেনি কোনোকালেই, এ জীবনে আর কোনোদিন জাগবে বলে মনেও হয়না।

ক্রীতিক সেই তখন থেকে তাকিয়ে আছে দেখে অরু একটু ইতস্তত বনে গেলো,নিজের জামা কাপড় কোনোমতে ঠিকঠাক করে মিনমিনিয়ে শুধালো,

---- কি দেখছেন অমন করে?

অরুর প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক ক্ষীণ আওয়াজে বললো,

---- আমার সূর্যদয়।

*****************************************

টিন্ডেট কটেজের জানালা দিয়ে সূর্যদয়ের দৃশ্য স্পষ্ট, অরু কাচের জানালা দিয়ে এখনো সেদিকেই তাকিয়ে আছে।পুরো দৃশ্য উপভোগ করার আগেই ক্রীতিক টেনেটুনে কটেজে নিয়ে এসেছে ওকে, ভারী নির্দয় আচরণ, কিন্তু এই মূহুর্তে ঝগড়া করার মতো সময় নেই অরুর হাতে, ও পুরোটা দৃশ্য ঠিকঠাক ভাবে দেখতে চায়, তাই কটেজের জানালা দিয়েই আপাতত উপভোগ করছে সাদামাটা সূর্যদয়।

কিন্তু এই মূহুর্তে বোধ হয় সেটাও সহ্য হলোনা নির্দয় ক্রীতিকের, ও কোনোরূপ আওয়াজ না করেই এগিয়ে এসে হাট করে লাগিয়ে দিলো জানালাটা। এবার বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে ওঠে অরু। নিজের রাগটাকে কোনোভাবেই দমাতে না পেরে তেঁতো গলায় ক্রীতিককে বলে,

--- কি সমস্যা?

অরুর কাঁধের উপর নিজের চিবুক ঠেকিয়ে, ক্রীতিক হিসহিসিয়ে জবাব দেয় ,

----- আমার এই টি শার্টটা তোর পরনে বি'শ্রী লাগছে অরু, খুলে ফেলি?

ক্রীতিকের কথায় অরুর গলা শুকিয়ে এলো, ঠান্ডার মাঝেও হাতের তালু ভিজে উঠলো তপ্ত ঘামে।লজ্জায় কথা আটকে আসছে,তবুও নিজের মধ্যে একটু মেকি গাম্ভীর্য ধরে রেখে কথা ছো'ড়ে অরু ,

-----ককেন?আপনিই তো কাল বললেন যে, আপনার জামা কাপড়ে আমাকে মারাত্মক লাগে।

ক্রীতিক নিজের বলিষ্ঠ হাতে অরুর পরনের টি শার্টটা টেনে খুলতে খুলতেই হাস্কিস্বরে বললো,

---- কাল পরার পরে মারাত্মক লেগেছে, আর আজ খোলার পরে, ডিপেন্ডস অন মাই মুড বেইবি।

*****************************************

একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ চারদিনের মাথায় আবারও সানফ্রান্সিসকো ফিরে যাচ্ছে অরু। ক্রীতিক নিজেই ড্রাইভ করে এগিয়ে দিয়ে আসছে ওকে। ওদিকে মনের মাঝে একরাশ ভয় আর দ্বিধা আকরে ধরে আছে অরুকে,মা আর আপার মুখোমুখি হলে ঠিক কি রকম লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে তারা, তা একমাত্র উপরওয়ালাই ভালো জানে।

কিন্তু পাশে বসা ক্রীতিকের গম্ভীর মুখটা দেখে আপাতত সেসব ভাবতে ইচ্ছে হলোনা অরুর, গত দু'ঘন্টার পিনপতন নীরবতা ভে'ঙে কোনোমতে হৃদয়ে সাহস সঞ্চার করে অরু ক্রীতিককে শুধালো,

---- কবে ফিরবেন?

ক্রীতিক স্টিয়ারিং এ হাত চালাতে চালাতে জবাব দিলো,

---- খুব শীঘ্রই।

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে আবারও শুধালো,

-----আপনি একাই যাচ্ছেন?

----- না প্রত্যয় ও সাথে যাচ্ছে।

অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,

---- আমাকে নিয়ে গেলে হতোনা?

ক্রীতিক অরুদের ভবনের সামনে এসে অকস্মাৎ ব্রেক কষে বললো,

--- তোকে নিয়ে যেতে পারলে আমার চেয়ে খুশি আর বোধহয় কেউ হতো না অরু, কিন্তু সেটা সম্ভব নয় মিডিয়ার ধারে কাছেও তোকে আমি এলাউ করবো না।

অরু অগত্যাই হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে শুকনো মুখে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ক্রীতিকও নামলো ওর সাথে সাথে, ক্রীতিককে নেমে আসতে দেখে অরু শুধালো,

---- আবার নামতে গেলেন কেন? আপনার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে তো।

ক্রীতিক স্ব পকেটে হাত গুঁজে,অন্যহাতে অরুর ঘাড় টেনে নিজের দিকে নিয়ে এসে কাতর কন্ঠে বললো,

---- একবার তুমি করে ডাক, তারপরেই চলে যাচ্ছি।

ক্রীতিকের কথায় অরু শুষ্ক ঢোক গিলে ওর গলাটা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,

---- ফিরে আসুন তারপর সব আবদার মেটাবো প্রমিস।

ক্রীতিক ব্যাথাতুর হাসলো, অতঃপর ক্রোধিত সুরে বললো,

---- তোর মাকে ম্যানেজ করা না করা একান্তই তোর ব্যাপার,বাট আমি ফিরে এলে আমার সাথে আমার বাড়িতে ফিরবি দ্যাটস মাই অর্ডার।

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়,ওকে আসস্থ করে বলে,

--- বুঝেছি এখন যান।

কথা শেষ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় অরু, ক্রীতিক এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে, এতোক্ষণ ধরে নাকের আসেপাশে মো মো করতে থাকা বুনোফুলের মেয়েলী সুঘ্রাণটা অরু যাওয়ার সাথে সাথে কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।

অরুর হঠাৎ দূরত্বে ক্রীতিকের কেমন দম আটকে আসছে, ব্যাথায় ভরে উঠেছে হৃদয়টা।নিজের অজান্তেই হাত চলে গিয়েছে বুকের বা পাশে, আজ এই মূহুর্তে জীবনে প্রথমবার ক্রীতিক অনুভব করলো ওর হার্টবিট ফে'ইল করছে, ক্রমশ হৃদস্পন্দন গতি হারাচ্ছে, অরুর প্রতি এট্রাকশন তো নতুন কিছু নয়, তাহলে নতুন করে এই সুপ্ত অনুভূতি কোথা থেকে উদয় হলো? ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো,তার পরক্ষনেই গলা উঁচিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো,

---- অরু আই লাভ ইউ।

ক্রীতিকের বলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটা শব্দে পা দুটো অকস্মাৎ থমকে গেলো অরুর, সামনে পা বাড়ানোর শক্তি নেই আর,পুরো শরীর মন ছেয়ে গিয়েছে অজানা বৈ'দ্যুতিক শিহরনে, হৃদয়ের কানায় কানায় টইটম্বুর হয়ে উপচে পরা অনুভূতির জোয়ার, গলায় আটকে আছে তীব্র কা'ন্নার রেশ। ও আর এভাবে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না একমুহূর্তও ,তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পরলো ক্রীতিকের বুকে,একবার, দুইবার, তিনবার ক্রীতিকের আঙুলে চাপ দিয়ে কিছু একটা সংকেত বোঝালো,অতঃপর গলা খাদে নামিয়ে রিনরিনে আওয়াজে বললো,

---- আমিও তোমাকে ভালোবাসি জায়ান ক্রীতিক, খুব ভালোবাসি।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩৫

ঝিমিয়ে পরা ম'রা বিকেলে সূর্যরশ্মির আলোর ছটা মিয়িয়ে এসেছে কিছুটা। চোখের সামনে পরিষ্কার তকতকে পিচ ঢালা রাস্তাতেও শেষ বিকেলের ছায়া পরেছে। মাঝ আকাশে পাখিদের ঘরে ফেরার ঢল।

সারিসারি উইল্ড মিল গুলো এখনো স্বীয় গতিতে ঘুরছে, ঈষান কোনে মেঘ জমেছে, খানিকবাদে বাদেই মেঘের গুড়গুড়ানি ভেসে আসছে সেথা থেকে। ব্ল্যাক মার্সিডিজের টিন্ডেট জানালা দিয়ে বাইরের দিকে একনজর পরখ করে আবারও ড্রাইভিং এ মন দিলো প্রত্যয়,গন্তব্য এয়ারপোর্ট।

গাড়ির স্টিয়ারিংএ হাত চালাতে চালাতেই লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে একনজর ক্রীতিককে পরখ করে নিলো সে। পেছনে বসে ব্যাকসিটে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। সেই তখন থেকে একই ভাবে বসে আছে দেখে এবার

প্রত্যয় একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুধালো,

---- ভাই, আর ইউ ওকে?

ক্রীতিক চোখ খুললো না আর, শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিলো,

--- ঠিক আছি।

যদিও বা প্রত্যয় ক্রীতিকের উত্তরে সন্তুষ্ট নয়, কারণ ও জানে ক্রীতিক ঠিক নেই, এমন একটা মূহুর্তে ঠিক থাকার কথাও নয়, তবুও জায়ান ক্রীতিক যখন বলেছে সবকিছু ঠিক আছে, তখন সেটাই সঠিক ধরে নিতে হবে।এর বাইরে কথা বাড়ানোটা মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই প্রত্যয়ও সেটাই করলো, ক্রীতিকের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পুনরায় ড্রাইভিং এ মন দিলো।

বেশ কিছুটা সময় ধরে চোখদুটো বন্ধ রেখেও অরুর মুখটা সরানো যাচ্ছেনা মানস্পট থেকে। গাড়িটা এয়ারপোর্টের দিকে যত এগোচ্ছে ততই হৃদয়টা অদৃশ্য বেদনায় তপ্ত খরার মতো খাঁ খাঁ করছে। ক্রীতিক বরাবরই উগ্র মেজাজী হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যখন তখন, কিন্তু অরুর বেলায় সম্পূর্ণ তার বিপরীত। আজও অরুকে ওমন করে একা ছেড়ে আসছে মন সায় দেয়নি ক্রীতিকের, তাইতো অর্ণবকে বলে এসেছে অরুর বাসায় সর্বক্ষন নজর রাখতে।

অরুর কথা ভাবতে গিয়ে পাশে পরে থাকা মোবাইল ফোনটা হাতরে নিলো ক্রীতিক, অতঃপর গ্যালারীতে ঢুকে,স্ক্রল করতে লাগলো কাল ভোরে ধারণকৃত কিছু একান্ত মূহুর্ত। ক্রীতিকের মোবাইলে অরুর তেমন কোনো ফটো নেই বললেই চলে, কিন্তু গতকাল সূর্যদয়ের সময় কটেজে নিজেদের অন্তরঙ্গ মূহুর্তের পরে অরুর বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিল ক্রীতিক। যেখানে দেখা যাচ্ছে শরীরে ছফেদ রঙা কম্ফোর্টার জড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে অরু, চোখ দুটো অশ্রুশিক্ত, কেঁদে কে'টে লালবর্ণ ধারণ করেছে সুন্দর ফর্সা কোমল মুখটা।

অরুর ছবিতে চোখ বুলিয়ে ওর রাগের কারণ ভাবতে ভাবতে আজও নরম করে হেসে ফেললো ক্রীতিক। একেএকে ভাবতে লাগলো কাল ভোর থেকে এই মূহুর্ত অবধি ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা।

.... কাল মিষ্টি ভোরে, নরম রোদের আড়ালে মিষ্টি অরুকে নিজের মতো করেই কাছে টেনে নিয়েছিলো ক্রীতিক,এরপর অরুর ছোট্ট শরীরে চলেছিল ক্রীতিকের দীর্ঘক্ষনের রাজত্ব আর কতৃত্ব।ভালোবাসার পর্ব শেষ করে ক্রীতিক যখন সবে সবে একটু আবেশিত ঘুমের তোপে চোখ দুটো বুজেছিল, তখনই কর্ণকূহরে ঝঙ্কার তোলে ক্রন্দনরত অরুর ফোপাঁনোর আওয়াজ।

অরু কাঁদছে ব্যাপারটা মস্তিষ্কে গিয়ে বিট করতেই শোয়া থেকে চট করে উঠে বসলো ক্রীতিক,ঘুম জড়ানো কন্ঠে অবুঝের মতোই চোখ বড়বড় করে প্রশ্ন করলো অরুকে,

---- কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?

বয়সে বারো বছরের বড় ক্রীতিকের কাছে অষ্টাদশী অরু বরাবরই বাচ্চাসম, একমাত্র ক্রীতিক আর আপার সামনেই ওর বাচ্চামী করার সভাব রয়েছে, ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে অরু এইমূহুর্তে বাচ্চাদের মতোই ফ্যাচফ্যাচিয়ে কেঁদে উঠলো, শরীরে একটা সুতা ও নেই,কোনোমতে নরম চাদরটাকে শরীরে পেচিয়ে অরু অস্পষ্ট আওয়াজে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো,

---- আপনি সেদিন গাড়িতে বলেছিলেন আমাকে একটুও ক'ষ্ট দেবেন না, সবসময় জেন্টাল থাকবেন, অথচ আজকে দেখুন, আপনার ভালোবাসার চোটে আমি আ'হত হয়ে গিয়েছি।

অরুর কথায় ক্রীতিক উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,

---- বেশি লেগেছে? ডক্টরের কাছে যেতে হবে?

অরু দাঁত কটমটিয়ে বললো,

---- চুপ করুন বেহায়া লোক, এসব অসুস্থতা নিয়ে কেউ ডক্টরের কাছে যায়?

---- কেউ না গেলেও তুই যাবি, কারণ তোকে নিয়ে আমি একটুও রি'স্ক নিতে চাইনা, এমনিতেও এসবের জন্য তোর বয়সটা অনেক কম।

ক্রীতিক কথা শেষ করে অরুকে কোলে নেওয়ার জন্য উদ্যত হলে অরু হুরমুড়িয়ে খাট থেকে নেমে যায়,তবে বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না বেচারি, পা দুটো অবশ হয়ে থাকার দরুন, কম্ফোর্টার সহ'ই ধপ করে বসে পরলো মেঝেতে। অরুর এহেন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করলো ক্রীতিক। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে অরুকে পুনরায় বাহুবদ্ধ করে কোলে তুলে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কিটোনে হিসহিসিয়ে বলে,

----- আগেই বলেছিলাম তোকে, ডার্ক রোমান্স আমার বেশ পছন্দ।

ক্রীতিকের কন্ঠে ঘোর মাদকতা,চোখ দুটোতে কামনার জোয়ার, ওর এমন দ্রত নিঃশ্বাসে ভরকে যায় অরু।শুষ্ক ঢোক গিলে শুধায়,

---ককি হয়েছে আপনার?

অরুকে বিছানায় ছু'ড়ে ফেলে দিয়ে তপ্ত আওয়াজে ক্রীতিক বলে,

--- বেইবি,ফ্রর্ম নাও অন, আই ওন্ট বি জেন্টাল এনি মোর।বি আ গুড গার্ল ওকে?

অরু হকচকিয়ে উঠে বললো,

--- কিহহ!

অরুর আশ্চর্যের সীমানা তুঙ্গে নিয়ে, ঠোঁটের কোনে একটা ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে, বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা হ্যা'ন্ডকাফ্ বের করতে করতে ক্রীতিক বললো,

---- ভ'য় নেই,আমার সাথে থাকলে অভ্যেস হয়ে যাবে।

*****************************************

রিসোর্ট থেকে বাড়িতে ফিরে, বেলা বারোটার দিকে পুরোপরি ফর্মাল গেটআপে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়েছে ক্রীতিক। এ'ক্সি'ডেন্টের কারনে বেশ অনেকদিন ভার্সিটিতে যেতে পারেনি ও, গতকাল উইকএন্ড ছিলো বলে বাড়িতেই সময় কাটিয়েছে।আর আজ হুট করেই ডিপার্টমেন্ট প্রফেসরদের মিটিং এ জরুরি তলব পরেছে ওর, না গেলেই নয়।তাইতো অরুকে নিয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরেছে ক্রীতিক।

তবে বিপত্তি ঘটেছে অরুকে নিয়েই, সেই যে রিসোর্টে বসে রা'গ করে গাল ফুলিয়েছে, এখনো সেভাবেই বসে আছে। অরুর কাছে অবশ্য রা'গ করার যথাযথ যুক্তি রয়েছে, তবে ক্রীতিকের মতামত অনুযায়ী,

---- নিজেকে সামলাতে না পারলে আমার কি করনীয়?

হলরুমের কাউচে বসে টিভি দেখতে দেখতেই অরুর চোখ গেলো ক্রীতিকের দিকে। শরতের আকাশের মতো লাইট ব্লু শার্টের ফুল স্লিভস হাতার বোতাম গুলো বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে লাগাতে লাগাতে নিচে নামছে ক্রীতিক। কাঁধের একপাশে ঝুলে আছে ল্যাপটপ ব্যাগ। আজ অনেকদিন পরে ক্লিন সেভ করায় ওকে দেখতে অন্য রকম সুদর্শন লাগছে। ক্রীতিককে আড় চোখে একঝলক পরখ করে ভেতরে ভেতরে জমিয়ে রাখা রাগটা আবারও মাথায় চড়ে বসলো অরুর,তৎক্ষনাৎ মুখ ঝামটি দিয়ে ক্রীতিকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে, টিভির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়ালো অরু,

---- দয়ামায়াহীন নির্দয়,পাষাণ, সা'ইকো,বদমাশ লোক।

অরুর এতো অভিযোগ আর গা'লাগাল বোধ হয় ক্রীতিক শুনেও শুনলো না, বরং এগিয়ে এসে অরুর কপালে টকাস করে একটা গভীর চুমু খেয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে শুধালো,

---- ব্যাথা কমেছে জান?

অরু জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

অরুর কান্ডে ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,

---- ইগনোর করা আমার পছন্দ নয় অরু। তুই আমাকে যা খুশি বল সমস্যা নেই, আমার উপর জিদ ফলাতে নিজের হাত ব্যবহার কর তাতেও সমস্যা নেই,কিন্তু আমাকে ইগনোর কিংবা রিজেক্ট করার দুঃসাহস দেখাবি না আর। কখনোই না।

অরু এবার মাথা নিচু মিনমিনিয়ে বললো,

--- আআপনি আমাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পান তাই না?

ক্রীতিক অরুর চিবুক ধরে ওর মাথাটা তুলে,চোখের মধ্যে চোখ রেখে বললো,

---- তুই আমার সম্পত্তি বেইবি,তোর সবকিছু আমার জন্য বিলোং করে, যেভাবে খুশি তোকে সেভাবে আদর করার অধিকার রাখি আমি। এটাকে যত দ্রুত পজিটিভলি নিবি, তত তাড়াতাড়ি তোর কাছেও সবকিছু স্বাভাবিক মনে হবে।

কথা শেষ করে নতুন উদ্যমে অরুর দু'গালে চুমু খেয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্রীতিক।

অরুর শরীরটা সত্যি সত্যিই ভালো নেই, সকাল থেকেই জ্বর জ্বর ভাব, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। আগের রাতে না ঘুমানোর দরুন মাথাটাও ধরে আছে খুব, এই মূহুর্তে বিশ্রাম নেওয়াটা বড্ড জরুরি। তাই ক্রীতিকের অর্ডার করে রেখে যাওয়া খাবার আর অষুধ খেয়ে হলরুমেই চাদর টেনে ঘুমিয়ে পরে অরু।

.

একটা দুঃস্বপ্নের মাঝপথে আটকে গিয়ে অরুর যখন হুট করেই ঘুম ছুটে যায় তখন সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে।দুঃস্বপ্নের পরিনতি জানার সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই ওর,অগত্যাই ধরফরিয়ে শোয়া ছেড়ে উঠে বসলো অরু। ঠান্ডার মধ্যেও শরীরটা ঘামে ভিজে জপজপ করছে, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

ভ'য়ে জর্জরিত চুপসে যাওয়া মুখমন্ডলটাকে বেশ অনেকক্ষন লাগলো স্বাভাবিক করতে। কিছুক্ষণ একই ভাবে বসে থেকে হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছে চারিদিকে চোখ বোলালো অরু, রুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে হয়তো ক্রীতিক এখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি, অন্ধকার রুমের আনাচে কানাচে লেজ নাড়িয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে বিড়াল ছানা ডোরা। ক্রীতিকের বাড়ির ফ্রি সার্ভিসে আগের থেকে বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে সে। এ বাড়িতে আসার পর অনেকদিনের মাথায় সুস্থ সবল টগবগে ডোরাকে দেখে বেশ আস্বস্ত হয়েছিল অরু, মনেমনে ভেবেছিল,

---- সবাই মিথ্যে বলে,আমার জায়ান ক্রীতিক এতোটাও খারাপ না।

কিছুক্ষন ধরে বসেবসে ডোরার নড়নচড়ন লক্ষ করার পরে, কয়েকবার নাক টেনে ভেতরে অনেকটা ঠান্ডা বাতাস পুরে নিয়ে ধীর পায়ে রুমে চলে গেলো অরু।অতঃপর ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে পুনরায় ফিরে এলো হলরুমে। এখন সত্যিই শরীরটা বেশ হাল্কা লাগছে,মেজাজটাও ফুরফুরে। অগত্যাই ডোরাকে কোলে নিয়ে অরু গিয়ে বসলো টিভি দেখতে, আজকাল এ বাড়িতে থাকা সত্বেও ডোরাকে সময় দিতে পারেনা অরু। কি করেই বা দেবে?আরেকজনার হাজার রকমের মুড সুইং মেটাতে মেটাতেই ওর ছোট্ট জীবনটা ফালাফালা। কখনো বিরক্ত হবে, তো কখনো আদর করবে। কখনো চ'ড়িয়ে গাল লাল করে দেবে, তো কখনো নিজেই সেখানে মলম ঘষবে, কি মুশকিল।

রিমোট দিয়ে একেক করে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে অরু, কোনো কিছুই ভাল্লাগছেনা। বিদেশি চ্যানেলের ছাতার মাথা কিছুই বোঝার জো নেই,ওদিকে নেটফ্লিক্স দেখার মতো ধৈর্য নেই।

অরু যখন টিভির চ্যানেল পাল্টাতে গভীর মনোযোগী তখনই বাড়িতে ফেরে ক্রীতিক। হলরুমে একমূহুর্তও অপেক্ষা না করে সোজা সিঁড়ি ডিঙিয়ে রুমে গিয়ে,গলা উঁচিয়ে ডাকতে শুরু করে অরুকে।

---- অরু,অরুউউ, ডাকছি আমি রুমে আয়!

সকালের রাগে এখনো ভাটি পরেনি অরুর,তারউপর এখন আবার উদভ্রান্তের মতো রাগী রাগী গলায় ডাকছে ক্রীতিক, ক্রীতিকের চোখের সামনে পরলেই সকালের কথা মনে পরে যায় ওর। লজ্জা আর অভিমান দুটোই তরতরিয়ে বেড়ে যায় তৎক্ষনাৎ, ওই জন্যই হয়তো অরু আর বেড রুমের দিকে পা বাড়ানোর সাহস পেলোনা। চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে রইলো কাউচের উপর ।

ওদিকে অরু রুমে আসছে না দেখে ক্রীতিক রাগে ফোসফোস করে উঠে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,

---- অরুর বাচ্চা রুমে আয়, নয়তো আমি একবার নিচে এলে তোকে কাঁ'চা চি'বিয়ে খাবো, সকালের কথা ভুলে গিয়েছিস?

নাহ, অরু এবারও এলোনা। ক্রীতিকের মেজাজ এতোক্ষণে সপ্তম আসমানে উঠে এসেছে, এতো তেজ কেন এই মেয়েটার?ক্রীতিক একটুতো কোলে নিয়ে আদরই করতো ওকে,খেয়ে তো আর ফেলতো না। তাও উপরে এলোনা ওই ছলনাময়ী পিচ্চি অরু।

ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে পায়ের জুতো জোড়া দুটোকে দুইদিকে ছু'ড়ে ফেলে দিয়ে, খালি পায়েই তরতর করে নিচে নেমে এলো। ক্রীতিক যখন শেষ সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে রেগেমেগে অরুকে কিছু বলবে,তার আগেই ওর চোখ গেলো চলন্ত টিভির স্ক্রিনে। বেশ বড়সড় ইংরেজি হেডলাইন। অরু ছলছলে চোখে সেদিকেই তাকিয়ে আছে, ক্রীতিকের উপস্থিতি টের পেয়ে, ওর দিকে না তাকিয়েই অরু বলে ওঠে,

---- কিয়ারা রোজারিও তো খুব নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন। শুনেছি উনিশ শতকে ওনার করা প্রতিটা শর্ট ফিল্ম, সিরিজ,মুভি সবকিছুর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে,এখনো চেহারায় বার্ধক্যের চিহ্নটুকু অবধি নেই, অথচ উনি কিনা এতো তাড়াতাড়িই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন? আর এই নিউজে কি বলছে এসব? ওনার নাকি দুই সন্তান, সারাজীবন তো টিভির পর্দায় একজনকেই দেখে এলাম,তাহলে আরেকজন কোথায়?

অরুর কথা ক্রীতিকের কানে আদৌও পৌঁছেছে কি-না তার হদিস নেই, নিউজটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও যেভাবে খালি পায়ে নিচে নেমে এসেছিল, সেভাবেই উপরে উঠে গেলো।

ক্রীতিক চলে যেতেই অরুর ভ্রম কাটে, কোনোরূপ বাক্য আদান-প্রদান না করেই ক্রীতিক এভাবে চলে গেলো কেন? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই অরু নিজেও ডোরাকে রেখে ক্রীতিককে অনুসরণ করে উপরে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

রুমে প্রবেশ করে অরু দেখতে পায়, দক্ষিণ দিকের যে কাচের দেওয়ালটা আছে সেদিকেই মুখ করে দু'পকেটে হাত গুঁজে জীবন্ত মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক।

অরুর মনে এক অজানা আ'তঙ্ক খচখচ করছে, নিজের উদ্বিগ্নতা দমাতে না পেরে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্নটা ছু'ড়েই ফেললো ও,

----- কি হয়েছে আপনার? আপনি কি কিয়ারা রোজারিও কে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন?

আহত গলায় উল্টো শুধালো ক্রীতিক,

---- আমার নাম কি অরু?

অরু ঠোঁট উল্টে অস্ফুটেই জবাব দিলো,

---- আপনার নাম তো জায়ান ক্রীতিক.....

কথা শেষ করার আগেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরে, থেমে গেলো অরু,ক্রীতিক ঘুরে তাকিয়ে বললো,

---- এখন বুঝেছিস আমার এই অদ্ভুত নামের রহস্য?

সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু ছানাবড়া হলো অরুর,চমকে গিয়ে ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে অরু বললো,

--- তারমানে আআপনিই কিয়ারা রোজারিওর বড় সন্তান!!

কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে অজান্তেই মুখের উপর দু'হাত দিয়ে অরু বলে ওঠে,

---- আআপনি ঠিক আছেন?

ক্রীতিক জবাব দিলো না, এগিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসে অরুকে নিজের কাছে টেনে এনে দু'হাতে শক্ত করে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে, মাথা ঠেকালো অরুর ছোট্ট পেটে।

ওর এমন কাতর,ব্যথাতুর স্পর্শে জমে গেলো অরু, যে মানুষটা সবসময় অরুকে নিজের বুকে ঠায় দিয়ে এসেছে, সে কিনা আজ হুট করেই অরুর বুকে মুখ লুকালো? ক্রীতিকের মা মা'রা গিয়েছে, যেভাবেই থাকুক না কেন মা নামক নাড়ির টানটুকু পৃথিবীর বুকেতো অন্তত জীবিত ছিল। আর আজ সেই বিনে সুতোর বাঁধনটাও ছিন্ন হলো।

ক্রীতিকের কষ্ট পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তাহলে ক্রীতিক কেন চুপচাপ বসে আছে? কেনইবা মায়ের কথা বলে বিলাপ করে কা'ন্না করছে না এখনো? জানা নেই অরুর। ও তো কেবল নিজের ছোট্ট দু'হাতে ক্রীতিকের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে ব্যস্ত।

এভাবে নিঃশব্দে শুধু ভারী দীর্ঘশ্বাসের আদান-প্রদানে কতোটা সময় যে অতিবাহিত হয়েছিল জানা নেই অরুর, ভীষণ হৃদয়বিদারক নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ক্রীতিকের ফোনটা যখন ভাইব্রেট হয়,তখনই ভ্রম ছুটে যায় অরুর, ও ক্রীতিককে বুকের মধ্যে আগলে রেখেই একহাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করলো।ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে প্রত্যয় বলে,

----- ভাইকে লস অ্যাঞ্জেলস যেতে হবে, ওনার মায়ের শেষ কার্য ওখানেই সম্পন্ন হবে।

অরু মিনমিনিয়ে বললো,

---- ওনার মা কি ওনাকে একবারও দেখতে চায়নি?

জবাবে প্রত্যয় বলে,

---- শুনেছি মৃ'ত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের ভুলের জন্য আহাজারি করছেন তিনি, চাতক পাখির মতো মুখিয়ে ছিলেন ছেলেকে একনজর দেখার জন্য, কিন্তু ভাই ইচ্ছে করেই নানা বাড়ির সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল বহুবছর আগেই। তাই শেষ ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি ওনার।

অরু কিছুটা হলেও ঘটনার সারাংশ বুঝতে পেরে কল কেটে দিলো তৎক্ষনাৎ ।

তারপর ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে হাটু গেড়ে বসে, ওর গাল দুটো দু'হাতে আঁজলা ভরে ধরে শুধালো ,

---- আমার শাশুড়ি মাকে যে সবসময় টিভিতে দেখাতো আগে বলেন নি কেন?

ক্রীতিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুর পানে,অরু এবার পুনরায় বললো,

----- শেষ কৃত্তের জন্য আপনি কাল এল. এ. যাচ্ছেন তাইতো?

ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, অরু বলে,

---- তাহলে এই সুযোগে আমিও একটু আমার মায়ের কাছে যাই? মা' তো মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক সবকিছু মেনে নেবে, দেখবেন।

আমি কথা দিচ্ছি আপনি ফিরে এসে দেখবেন সবকিছু স্বাভাবিক আর কতোটা সুন্দর হয়ে গিয়েছে। মা আপা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে।তারপর আমরা প্রতিদিন একসাথে ভার্সিটি যাবো, যে যার কাজ করবো, ফেরার পথে মায়ের বাসা থেকে রাতে খেয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরবো। উইকএন্ডে রাত জেগে মুভি দেখবো, অর্ণব ভাইয়া,সায়র ভাইয়া,আর এলিসা আপুর সাথে সুযোগ পেলেই ট্যুরে যাবো, আমাদের সপ্নের মতো সংসার হবে, আমি কথা দিচ্ছি, এ জীবনে আর কখনো একা হবেন না আপনি। আর না কখনো আমরা দুজন আলাদা হবো।এটাই শেষবার।

অরুর প্রতিশ্রুতির পালা শেষ হলে ক্রীতিক পুনরায় অরুকে দাঁড় করিয়ে ওর বুকে মাথা রাখে,চোখ দুটো আবেশে বন্ধ করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,

---- একটা সত্যি বলি? পুরো দুনিয়াতে তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই অরু। তুই না থাকলে এই বাড়িটার মতোই আমার হৃদয়টাও ফাঁকা হয়ে যায়, কি ভীষণ য'ন্ত্রনায় কাতরাই আমি,সেটা কেবল আমার হৃদয় জানে।তুই আমার অবসেশন অরু,আমার মাদকতা,আমার স্লিপিং পিল, আমার দিন, আমার রাত, আমার আশা, আমার গড়ন, আমার ভাঙন,আমার জীবন আমার মরন সবকিছু তুই। তাই কখনো যদি আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টাও করিস,সেদিন তোর য'ন্ত্রনাদ্বায়ক ভাগ্য আমি নিজের হাতে লিখবো জান।

.

গাড়িতে বসে বসেই কালকে অরুকে বলা ব্লে'ডের মতো ধারা'লো কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আজ আবারও একবার আওড়ালো ক্রীতিক,

----- আই রিপিট,আমার থেকে দূরে গেলে তোর জীবনে কালবৈশাখী ঝড় তুলে ছাড়বো আমি।

*****************************************

পরন্ত বিকেলে সাইক্লিং করে মাত্রই ইকো পার্কের শেষ প্রান্তে এসে থামলো অর্ণব আর এলিসা।

অর্ণব বরাবরই ম্যাকবুক,কম্পিউটার, কিবোর্ড এসব নিয়ে পরে থাকতে বেশি পছন্দ করে,কিন্তু আজকাল এলিসার পাল্লায় পরে প্রায়শই বিকেলের দিকে সাইকেল নিয়ে কিংবা হেটে হেটে বের হতে হয় ওকে।এলিসা আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী মেয়ে,সে এথলেটিক গার্ল, দৌড়, ঝাপ, লাফালাফি, মা'রামা'রি এসবে শীর্ষঅবস্থান ওর।

দুই মেরুর এই দুই প্রেমিক জুগলের মিলে মিশে থাকাটাও বেশ কষ্টসাধ্য, তবুও এলিসাকে বসে রাখার জন্য নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে অর্ণব,মনেমনে ভাবে ----ভালোবাসি,ফেলেতো আর দিতে পারবো না? কিন্তু এই বদ মেজাজী উড়নচন্ডী মেয়েটার একটা দফারফা করতেই হবে এবার।

এলিসা সাইকেলের চেইনে চোখ বোলাতে বোলাতে শুধালো,

---- কি ভাবছিস?

অর্ণব মাথা চুলকাতে চুলকাতে আশপাশটা পরখ করতে করতেই চট করে বলে ওঠে,

---- দেখ এলি ওখানে একটা চার্চ।

এলিসা একনজর সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,

--- তো?

---- তো মানে? চল গিয়ে ফাদারের কাছ থেকে আর্শিবাদ নিয়ে আসি।

উপরে উপরে এলিসাকে পটালেও মনেমনে অর্ণব ভাবে,

----- ব'জ্জাত মহিলা, একবার চার্চে চল, ফাদারের কাছ থেকে বশীকরন পানি পরা এনে যদি না খায়িয়েছি তোকে, তবে আমার নামও অর্ণব সায়ন্ত নয়।

অর্ণবের কথায় এলিসা কিছু একটা ভাবলো, তারপর না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,

---- নাহ যাবো না, সন্ধ্যা হয়ে আসছে চল ফিরে যাই।

অর্ণব তৎক্ষনাৎ নিজের সাইকেলটাকে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে এলিসার বাহু আঁকড়ে ধরে বললো,

----- এমন করেনা জান, সামনে বিয়ে করতে হবেনা? একটুখানিরই তো ব্যাপার, চলনা প্লিজ।

অর্নবের এহেন আহাজারিতে অপারগ এলিসা ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

----- ঠিকাছে চল।

অর্ণব খুশি মনে এলিসাকে ধরে নিয়ে চার্চের দিকে এগিয়েই যাচ্ছিল, তখনই কোথা থেকে যেন হাঁপাতে হাঁপাতে উদয় হলো সায়র। সায়রকে দেখা মাত্রই বিরক্তিতে চিড়িবিড়িয়ে উঠে অর্ণব বলে,

---- শালা বিরিয়ানির এলাচি, আাসার আর টাইম পেলিনা?

সায়র কথা বলার ফুরসত পাচ্ছে না, এখনো হাঁপাচ্ছে, তা দেখে এলিসা অর্ণবকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

---- চুপ কর অর্ণব, আগে ওকে শ্বাস করার সুযোগ দে।

অর্ণব থমথমে গলায় বললো,

---- দিলাম।

বেশ অনেকক্ষন পরে পানি পান করে খানিকটা শান্ত হয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে সায়র বলে,

---- জেকে তোর প্রেমের বারোটা বাজালো বলে, দোস্ত।

অর্ণব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

---- কেন কি হয়েছে? তোকে না ঘুরে আসতে বললাম অরুর বাসার সামনে থেকে? এতোটুকু দ্বায়িত্ব পালন করতে পারিস না? ম্যানারলেস কোথাগার।

---- আরে সেখানেই তো গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি অরুদের এ্যাপার্টমেন্টে অন্য ভাড়াটিয়া উঠেছে, অরুরা নেই।

অর্ণব বড়বড় চোখ করে বললো,

---- নেই মানে? হুট করে কোথায় গেলো অরুরা?

সায়রের কথায় অর্ণবের গলা শুকিয়ে এসেছে, এলিসা অর্ণবের ভয়ার্ত চাহনি দেখে আগ বাড়িয়ে সায়রকে শুধালো,

---- আজ প্রায় দশদিন হতে চললো, জেকে এখনো এল.এ থেকে ফেরেনি?

সায়র না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,

----- ওর মায়ের কিছু উইশ ছিল, সেগুলো ও আর ওর ভাই মিলে পূরন করতে করতেই শুনেছি টাইম লেগেছে, তবে আজ কিংবা কালের মধ্যে তো ফিরে আসার কথা।

সায়রের কথায় এবার এলিসার কপালেও চিন্তার ভাঁজ পরলো, ও একটা ভয়ার্ত শুষ্ক ঢোক গিলে, পেছনে খ্রীষ্ট ধর্মের পবিত্র ধর্মশালা চার্চের দিকে তাকিয়ে বুকে ক্রুশ এঁকে বিড়িবিড়িয়ে বললো,

---- আই উইশ, এভ্রিথিং উইল বি ভেরি ফাইন, আমেন।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

#পর্বঃ৩৬

"দিন পাল্টায় রঙ বদলায় অস্থির মন

হাতের মুঠোয় ফেরারি সময়,শুধু শিহরণ,

ছায়াপথ ধরে হাতছানি কার, সেই পিছুটান....

তার কথা মনে পরে... তার কথা মনে পরে..."

গাড়ির প্লে লিস্টে বাজতে থাকা চমকপ্রদ লাইন গুলো শেষ হতে না হতেই সহসা থেমে গেলো ব্ল্যাক মার্সিডিজ গাড়িটা। জানালার কাঁচ নামিয়ে সেই তখন থেকে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে ক্রীতিক,যার দরুন গাড়িটা থেমে যাওয়া সত্ত্বেও প্রত্যয়কে আগ বাড়িয়ে আর কিছু প্রশ্ন করলো না ও,বরং মসৃণ চামড়া দিয়ে তৈরি প্রসস্থ গদিতে পায়ে পা তুলে বসেই দু'ঠোটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী ছেড়ে,অন্যহাতে ফোন তুলে কল লাগালো ব্ল্যাক হার্ট ইমোজি দিয়ে সেভ করা একটা নাম্বারে।

ক্রীতিক কলে ব্যস্ত এই সুযোগে গাড়ি থেকে সহসা নেমে গেলো প্রত্যয়, আজ তেরো দিনের মাথায় লস অ্যাঞ্জেলস থেকে সানফ্রান্সিসকো ফিরেছে ওরা। ক্রীতিকের মা বড় পর্দার সাবেক তারকা, সে হিসেবে অনেক বেশি দায় দায়িত্ব আর ফর্মালিটিস ছিল সেখানে , এছাড়া বেশকিছু ইন্টারভিউ তো ছিলোই। কিয়ারা রোজারিওর দ্বিতীয় ঘরের সন্তান রয়েছে ঠিকই তবে সে একা হাতে সকল দ্বায়িত্ব সামলানোর মতো ততোটাও বড় নয়, একসাথে অনেক গুলো ধকলের ফলসরূপ পরিস্থিতিটাই বদলে গিয়েছিল তখন,অগত্যাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও থেকে যেতে হয়েছিল ক্রীতিক কে।

আর আজ কাঁধে জমে থাকা মাতৃত্বের শেষ দ্বায়িত্বটুকুর অবসান ঘটিয়ে সানফ্রান্সিসকো ফিরে সবার আগে অরুকে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ওদের ভবনের সামনে এসে গাড়ি থামাতে নির্দেশ করে ক্রীতিক।প্রত্যয় নিজেও অবশ্য মনে মনে এটাই চেয়েছিল, কারন ও নিজেও তো অনুকে দেখেনা বহুদিন। ক্রীতিক আর অরুকে নিয়ে সেই যে রাগারাগি হলো, তারপর প্রতিদিন ফোনে কথা হলেও মায়ের ভয়ে তটস্থ অনু সামনাসামনি দেখা করার সাহস করে উঠতে পারেনি আর,তাছাড়া গত তেরো দিন ধরে তো ফোনের যোগাযোগটুকুও পুরোদমে বন্ধ। ওই জন্যই তো বহুদিনের দূরত্বে প্রত্যয়ের হৃদয়টাও যে পু'ড়ছে খুব।

.

দিনের আলোকে পায়ে মাড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে এইতো কিছুক্ষন হলো। পশ্চিম আকাশে এখনো সূর্যের সোনালী আবিরের ছটা,গোধূলি সন্ধ্যায় তীব্র হাওয়া দিচ্ছে প্রকৃতি, যার দরুন ভবনের পাশে টাঙানো যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সাইজের একফালি পতাকাটা পতপত করে উড়ছে। সেই সাথে উড়ছে প্রত্যয়ের কপাল ছুঁই ছুঁই লম্বা চুল গুলোও। নতুন করে টাঙানো পতাকাটাকে এক নজর পরখ করে তরাগ গতিতে ভবনের দিকে চোখ সরিয়ে নিলো প্রত্যয়, একতলা দুইতলা ছাড়িয়ে নজরবন্দি হলো তিন তলায় অবস্থিত কর্ণারের এপার্টমেন্টটা। ভর সন্ধ্যা বেলাতেও সেথায় নিকোশ কালো অন্ধকার বিরাজমান, কোনোরুমেই একফোঁটা আলো জ্বলছে না। পুরো ভবনে এই একটা এ্যাপার্টমেন্টেরই এই হাল দেখে বিস্ময়ে বিমূর্ত হলো প্রত্যয়ের হাসিহাসি মুখখানা।

অনুর রুমের টানা বারান্দায় চোখ বুলিয়ে অস্ফুটেই বিড়বিড়ালো প্রত্যয়,

---- ব্যাপারটা কি?অনুতো সবসময় ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে আজ কোথায় গেলো সব?

প্রত্যয়ের অযাচিত ভাবনার ছেদ ঘটে ক্রীতিকের দ্রুত পায়চারির আওয়াজে, ও চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পায় এই ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেও নিজের ওভারকোর্টটা ছু'ড়ে ফেলে দিয়ে কানে ফোন আর হাতে সিগারেট নিয়ে ক্রমাগত পায়চারি করছে ক্রীতিক। চেহারায় তার ভীষণ তীক্ষ্ণতা আর বিরক্তির ছাপ, দেখে মনে হচ্ছে কোনোকিছুর অপারগতায়, জিদের তোপে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিড়ে ফেলতে চাইছে ও। ক্রমশ একই নাম্বারে ডায়াল করতে করতে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ক্রীতিকের, এদিক থেকে ওদিকে পায়চারী করতে করতেই বলে ওঠে ,

---- অরু, জানবাচ্চা আমার প্লিজ ফোনটা তোল।এই বয়সে তোর জন্য এতো পাগলামি করতে আর ভালো লাগেনা আমার। অথচ প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মূহুর্তে চিন্তা দিয়ে পাগল করে ছাড়িস আমাকে। এতো কেন নির্দয় তুই ?

ক্রীতিকের বেপরোয়া আর উদভ্রান্ত ভঙ্গিমা নজরে এলে প্রত্যয় এগিয়ে এসে শুধালো,

---- এনি প্রবলেম ভাই?

ক্রীতিক সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে তিন তলার দিকে একঝলক তাকিয়ে ভরাট গলায় বললো,

---- অনুকে কল দাও প্রত্যয়, আমার ব'দমাশ বউটা কল তুলছে না।

ক্রীতিকের কথা শুনে প্রত্যয়ের ভেতরটা ধক করে উঠলো আচমকা, ও তৎক্ষনাৎ গলা খাদে নামিয়ে বললো,

---- অনু তো সকাল থেকেই কল তুলছে না ভাই, আমি ল্যান্ড করার পর থেকেই কল দিয়ে যাচ্ছি,ফোন অফ।

প্রত্যয়ের কথায় ক্রীতিকের শক্ত চোয়াল ধা'রালো হয়ে উঠলো কিছুটা, বাঁজপাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরটা পুনরায় চলে গেলো তিনতলার টানা বারান্দায়, তিমিরে ঢাকা বারান্দার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকাতেই চট করে ক্রীতিকের সুকৌশলি মস্তিষ্কটা খারাপ কোনোকিছুর পূর্বাভাস অনুভব করলো।তৎক্ষনাৎ পেশিবহুল হাতদুটো মুঠি বদ্ধ হয়ে উঠলো ওর, ছু'রির ফলার মতো ধারালো নজরটা প্রত্যয়ের দিকে ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে ক্রীতিক হুকুমের স্বরে বললো,

--- প্রত্যয় উপরে যাও, ভেতরে কে আছে, না আছে,কে কি করছে,কে কি বলছে, কিচ্ছু দেখার দরকার নেই সোজা গিয়ে অরুকে টা'নতে টা'নতে নিচে নিয়ে এসো।

ক্রীতিকের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে প্রত্যয় ভবনের দিকে চলে গেলেও ক্রীতিকের মন বলছে অরু উপরে নেই,অরু যদি উপরেই থাকতো তবে তা ঠিকই টের পেতো ক্রীতিকের হৃদয়। আর ওই জন্যই শেষ সন্দেহটুকু হটাতে প্রত্যয়কে পাঠানো। প্রত্যয় চলে গেলে ক্রীতিক গাড়ির ডিকিতে হেলান দিয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো,প্রচন্ত য'ন্ত্রনায় মাথা ফে'টে যাচ্ছে ওর,তার সাথে যোগ হয়েছে হৃদয়ের লেলিহান। একটা মেয়ের জন্য আর কতো? আগে তাও শারীরিক মানসিক দুটোরই দূরত্ব ছিল, ভালোবাসাটা একতরফা ছিল।ক্রীতিক নিজেকে ব্যাপক ভাবে সামলে নিয়েছে বহুবছর।

কিন্তু এখন? সবটা পাওয়া হয়ে গিয়েছে, অরুর শরীরের প্রতিটা খাঁজে খাঁজে ক্রীতিকের তীব্র ভালোবাসার স্পর্শ জড়ানো, সেই সাথে হৃদয় উপচানো মায়া তো আছেই, এখন কি করবে ক্রীতিক? পেয়ে হারানোর ব্যথাটা যে বড্ড যন্ত্রনাদ্বয়ক। অরু কি তা বোঝেনা?

খানিকক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ রেখে অরুকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে করতেই অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো ক্রীতিকের গলা থেকে,

----আই সয়ার অরু,তোকে খুঁজে পেলে আমি যে তোর কি হাল করবো সেটা আমি নিজেও জানিনা।

*****************************************

লাইট, ক্যামেরা একশান, ডিরেক্টর রিচার্ডের মুখ থেকে শব্দ ক'খানি বের হতেই লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর সুদর্শন পোজ দিতে শুরু করলো সায়র। শেষ রাতে শ্যুট চলছে,সামনেই সামার ফেস্টিভ্যাল,বছরের শুরুর দিকে এই সময়ে এসে ফটোশ্যুটের কাজে বেশ ব্যস্ত সময় পার করে সায়র। রোগা পাতলা লম্বাটে গড়ন আর ব্রাউন স্কিন টোনের সায়রের নিখুঁত চেহারা আর আত্মবিশ্বাসী রেম্প ওয়াকের দরুন গুচ্চি,লুইস ভুইটোন,নাইক,কেলভিন ক্লাইনের মতো পৃথিবী সেরা নামি দামি প্রায় অনেক গুলো ব্র্যান্ডেরই সুপার মডেলের খেতাব রয়েছে সায়রের ঝুলিতে।

এতো সাকসেস আর প্রতিপত্তির বাইরে গিয়ে না পাওয়ার তালিকাটাও বৃহত ওর। আর এখন এই সময়ে এসে সবচেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন ওর জীবনে, সেটা হলো জীবন সঙ্গী, যাকে এখনো খুজে পাওয়া হয়নি সায়রের। কি জানি কবে পাবে, কার নামই বা লেখা আছে ওর ভাগ্য জুড়ে।

ডিরেক্টর সাহেব প্যাকআপ বলতেই, সায়র দ্রুত হেটে মেকআপ রুমে চলে গেলো, ওর পেছন পেছন গেলো আরও দুজন স্টাফ, যারা এই মূহুর্তে ওর মেকআপ ঠিকঠাক করবে। সায়র এগিয়ে গিয়ে চেয়ারের উপর গা ছেড়ে বসেছে কি বসেনি তার আগেই ঝীম ঝীম আওয়াজে ভাইব্রেট হলো ওর মোবাইলটা। কে কল দিয়েছে দেখার জন্য ফোনটা চোখের সামনে ধরতেই তরাগ করে লাফিয়ে উঠলো সায়র। ফোনের স্ক্রীনে ক্রীতিকের রাগারাগি চেহারাটা ভাসছে,তারউপরে গুটিগুটি ইংরেজি অক্ষরে লেখা "ব্রিটিশ হিটলার"।

ক্রীতিক কল দিয়েছে তাও এই সময় ব্যাপারটা সন্দেহ জনক, ফোনের দিকে তাকিয়ে মনেমনে সায়র বলে,

----এবার কি করবো? কি উত্তর দেবো? কল টা কি কেটে দেবো?কিন্তু কল না ধরলে তো আরেক বি'পদ, হিটলারের বাচ্চা সোজা শ্যুটিং সেটে এসে কেলিয়ে যাবে, তখন আবার মান ইজ্জতের ব্যাপার।

কিছুক্ষন একই ভাবে ফোনের দিকে চেয়ে থেকে, চোরের মতো এপাশ ওপাশ তাকিয়ে কয়েকদফা শুষ্ক ঢোক গিলে ফোন রিসিভ করে ভয়ে ভয়ে কানে ধরলো সায়র।

ফোন তোলার সঙ্গে সঙ্গে, এপাশ থেকে হ্যালো ট্যালো বলার কোনোরূপ ফুরসত না দিয়েই ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ক্রীতিক,

---- সায়রের বাচ্চা আমার অরু কই?

ক্রীতিকের কথায় ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সায়র,মনেমনে বললো,

--- জানতাম, যত দোষ সায়র ঘোষ।

---- সায়র উত্তর দে, অর্ণব কে আমি বলে যাইনি অরুর দিকে খেয়াল রাখতে? কোথায় ওই হতচ্ছাড়া? অরুকে খুজে না পেলে কিন্তু এলিসাকে আমি নিজে দাড়িয়ে থেকে অন্যত্র বিয়ে দেবো,কথাটা বলে দিস ওকে।

ক্রীতিক রাগে কাঁপছে, কথার টোনে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তাই সায়র আর কোনোরূপ মশকরা কিংবা ভনিতা না করেই বললো,

---- অরু যে নেই সেটা আরও দুদিন আগেই জেনেছি আমরা, তোর কথা মতো খোঁজ নিতে গিয়েই জেনেছি। পরে উপায়ন্তর না পেয়ে অর্ণব অরুর বোনের ফোন নাম্বার জোগাড় করে লোকেশন ট্র্যাক করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কাজ হয়নি,ফোনটা বন্ধ , লাস্ট লোকেশন ওদের এপার্টমেন্টেই।

ক্রীতিক ক্রোধে ফেটে পরে বললো,

--- হাদারাম, তাহলে আগে কেন জানাসনি আমাকে? এতোদিন পরে এখন আমি কোথায় খুজবো ওকে?

সায়র ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

---- তুই রেগে যাবি, দুশ্চিন্তা করবি তাই সাহসে কুলায় নি।

ওর কথায় ক্রীতিক দাঁত খিঁচে বলে ওঠে,

---- তো এখন কি আমি ঠিক আছি? তোর কি মনে হয়?

সায়র জবাব দিলোনা, অপর পাশের নিরবতা আঁচ করে ক্রীতিক নিজের অতিরিক্ত ক্রোধ দমিয়ে, গলা কিছুটা খাদে নামিয়ে শুধালো,

---- অর্ণব কোথায়?ফোন কেন তুলছে না ও?

সায়র বললো,

---- তোর ভ'য়ে ফোন টোন বন্ধ করে কোথায় যেন ঘাপটি মে'রে আছে, মেইবি এলিসার বাসায়।

---- ফা'ক অফ।

ক্রীতিক শেষ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে পিক পিক করে কল কাটার আওয়াজ ভেসে এলো।

সায়র একটা সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

----- যাক এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম।

অতঃপর পরক্ষনেই কপাল জুড়ে সুক্ষ চিন্তার ভাজ পরলো ওর,আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ালো সায়র,

----- কোথায় যেতে পারে অরু?

*****************************************

একটা ক্রোধিত গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে, মোবাইল ফোনটা শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে পাহাড়ের ঢালে ছুটে মারলো ক্রীতিক। সন্ধ্যা রাতে যা ভেবেছিল তাই হয়েছে, শুধু অরু কেন অরুর একটা চিহ্ন পর্যন্ত পরে নেই ক্রীতিকের জন্য। আর এই ব্যপারটাই জ্বা'লিয়ে পু'ড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে ক্রীতিক কে। হৃদয়ের অসহ্য য'ন্ত্রণা আর মস্তিষ্কে জ্বলতে থাকা আ'গ্নেয়গিরির দাবানল যেন একসাথে গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে।প্রচুর মানসিক চাপে নিজের অজান্তেই বারবার হাতের পিঠ দিয়ে নাক ঘষে যাচ্ছে সেই সন্ধ্যা থেকে।

মাথাটাকে সামান্য একটু ক্ষনিকের নিস্তার দিতে দিয়াশলাই দিয়ে আবারও সিগারেট ধরিয়ে নতুন উদ্যমে নিকোটিনের ধোয়া বাষ্পিত করতে ব্যতিগ্রস্থ হলো ক্রীতিক।সন্ধ্যা থেকে কতবার যে স্মোক করেছে সে খেয়াল নেই ওর। সিগারেটে পুড়ে সুন্দর ডার্কব্রাউন পুরুষালী ঠোঁট জোড়া একরাতেই কেমন তামাটে রঙ ধারণ করেছে।

শেষ রাতের আকাশে মিটিমিটি করে জ্বলছে শুক তারা। তমশাচ্ছন্ন রাতে পুরো শহর ঘুমিয়ে আছে,ঘুম নেই শুধু ক্রীতিকের দু’চোখে। ওর ঘোর লাগা নিদ্রাহীন চোখদুটো জুড়ে তো শুধু অরুর বসবাস,মেয়েটা হারিয়ে গিয়েও ঘুমাতে দিচ্ছে না। কি আশ্চর্য!

ক্রীতিক যখন বাইকে হেলান দিয়ে স্মোক করতে করতে হিজিবিজি ভাবছিল তখনই হুরমুরিয়ে ছুটে আসে প্রত্যয়, পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে ক্রীতিকের দেখা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় করে দম নিলো ও। সেইসাথে হাতদুটো দিয়ে হাঁটুতে ভর করে হাঁপাতে লাগলো কিছুক্ষন। নিস্তব্ধ রাতে শুনশান পরিবেশে হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে প্রত্যয়ের বক্ষদেশ, কোনোমতে নিজের ব্রেথক্যাচ করে অস্পষ্ট আওয়াজে প্রত্যয় শুধালো,

---- আপনার ফোন কোথায় ভাই?

ক্রীতিক নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

--- ফেলে দিয়েছি।

---- কোথায় ফেলেছেন?

ক্রীতিক চোখ দিয়ে ইশারা করলো পাহাড়ের ঢালে। প্রত্যয় সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

---- খোঁজ নিয়েছি ভাই,অরুরা সানফ্রান্সিসকোর কোথাও নেই।

ক্রীতিক বললো,

---- শুধু সানফ্রান্সিসকো না,পুরো ইউ এস এ তে যে নেই সেটা আমিও জানি, থাকলে লোকেশন ট্রাক করা যেত, অন্য কোনো ইনফরমেশন থাকলে বলো।

প্রত্যয় ঠোঁট কামড়ে বললো,

---- ডক্টর এডওয়ার্ডের চেম্বারে গিয়েছিলাম।

ক্রীতিক এবার সচকিত হয়ে শুধালো,

---- কি বলেছেন উনি?

--- উনি বলেছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি আজমেরী ম্যাম নিজের চিকিৎসা পত্রের সবকিছু গোছাচ্ছিলেন, এমনকি ওনার কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে জানিয়েছিলেন, কোনোভাবে এখন দেশে ফিরতে পারবে কিনা।

প্রত্যয় বাকি কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক বললো,

---- এবার সবকিছু ক্লিয়ার প্রত্যয়, আজমেরী শেখ তার মেয়েদেরকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। কিন্তু ওনাকে এতো তাড়াতাড়ি এ কাজে হেল্প করলো কে? কোম্পানির হেল্প নিলে তো আমার কানে ঠিকই পৌছাতো, তাহলে কার এতো সাহস?

প্রত্যয় এতো বেশি ঘাটালো না,বরং উল্টো প্রশ্ন ছু'ড়ে বললো,

---- কিন্তু ভাই বিডি তে ফিরে কোথায় যেতে পারে?

প্রত্যয়ের কথায় ক্রীতিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

---- আজমেরী শেখের দৌড় জেকে গ্রুপ, আর ক্রীতিক কুঞ্জ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

পরক্ষণেই ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছু একটা ভেবে ক্রীতিক বললো,

--- আচ্ছা আজমেরী শেখের এ্যাসিসট্যান্ট কি কোনোভাবে এতে ইনভলভ?

প্রত্যয় না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,

---- না ভাই, রাজ বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, তাছাড়া ওর পরিবার শান্তি প্রিয়।সেদিন আপনার সাথে ঝামেলা হবার পর,রাজ ওর বাবা মায়ের নির্দেশে চাকরিটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে।কারণ ওর পরিবার চায়নি দ্বিতীয়বার তাদের ছেলে আপনার সামনে পরুক।

--- ভেরি গুড, তুমি যাও রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে, গিয়ে রেস্ট করো।

প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে যাওয়ার আগে আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে শুধালো,

---- ভাই আপনি।

ক্রীতিক আরও একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো,

----- সময় হলে চলে যাবো, ইউ স্যুড গো।

প্রত্যয় আর কথা বাড়ায় না চুপচাপ বড়বড় পা ফেলে যায়গা ত্যাগ করে।

---- আহ!দিস ফা'কিং অবসেশন।

প্রত্যয় চলে যেতেই গম্ভীর আওয়াজে কথাটা বলে বাইকের লুকিং গ্লাসের মাঝ বরাবর সজোরে পাঞ্চ বসিয়ে দিলো ক্রীতিক,সঙ্গে সঙ্গে ভে'ঙে চৌচির হয়ে ঝরঝর করে মাটিতে আঁচড়ে পরলো কয়েক টুকরো ভগ্ন কাঁচ,সেই সাথে ধারালো কাচে আ'ঘা'তপ্রাপ্ত হয়ে র'ক্ত বেরিয়ে এলো ক্রীতিকের হাতের বেশ কয়েকটা আঙুল থেকে।

নিজের র'ক্তা'ক্ত হাতের দিকে এক পলক ও না তাকিয়ে উল্টে একের পর এক ধোঁয়ার কুন্ডলী ছাড়তে ছাড়তে পুনরায় গর্জে উঠে হিং'স্র গলায় ক্রীতিক বললো,

---- প্র'তারক, মি'থ্যাবাদী,ছ'লনাময়ী নিজের সবকিছু আমার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে, হাজারটা মি'থ্যা প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে, আমাকে নিজের জন্য উন্মাদ বানিয়ে ছেড়ে এভাবে মায়ের হাত ধরে পালিয়ে যেতে একবারও কলিজা কাঁপলো না তোর? আমি তোর আদতে কি হাল করবো সেটা একবারও মাথায় আসেনি তাইনা? ঠিকাছে, জায়ান ক্রীতিকের আসল চেহারাটা এবার তুইও দেখবি। কি ভেবেছিলি? পিচ্চি বলে ছেড়ে দেবো? মোটেই না, জায়ান ক্রীতিক এতোটাও স্বাধু পুরুষ নয়, ভালোবাসার দ'হনে একটু একটু করে পু'ড়ি'য়ে মা'র'বো তোকে আমি।ঠিক যেভাবে তুই আমাকে মে'রেছিস। তোকে যেদিন পুরোপুরি ভাঙতে পারবো, সেদিন আবারও এই বুকে ঠায় পাবি তুই, তার আগে আর নয় ।

*

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা নিচে গিয়ে ক্রীতিকের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে সেখানেই ধপ করে বসে পরে প্রত্যয়। দূর্বল হাতে চিকন ফ্রেমের চশমাটা খুলে,অদূরে সানফ্রান্সিসকো মূল শহরের দিকে নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে মনেমনে প্রত্যয় বলে,

----- ভাইকে কি করে বোঝাই আমার চোখেও যে আজ আর ঘুম নামবে না, এভাবে সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি অনু? এই হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব ছাপিয়ে আমি কি আদৌও তোমাকে খুঁজে পাবো? আর কি দেখা হবে আমাদের?

অযাচিত প্রশ্নের উত্তর মেলেনা আর, উল্টে প্রেয়শীকে হারানোর নিদারুণ বিজ্ঞাপ্তিতে ছেয়ে যায় হৃদয়ের শহর, সহসাই হাত দিয়ে নিজের বুকের বাম পাশটা চেপে ধরে প্রতয়,চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে অশ্রুশিক্ত দুফোঁটা নোনাজল, তৎক্ষনাৎ শার্টের হাতার উল্টো পিঠ দিয়ে সেই জল টুকু আড়াল করে পকেট থেকে ফোন হাতরে কাউকে কল লাগালো ও, ওপাশ থেকে কে কি বললো সেটা না বোঝা গেলেও এপাশ থেকে প্রত্যয় বললো,

----- অনন্যা শেখের বিডি নাম্বারটা চাই আমার, এস সুন এস পসিবল।

*****************************************

অবশেষে ক্রীতিক যখন বাড়িতে ফিরলো তখন সবে সবে ভোর হয়েছে মাত্র। চারিদিকে সূর্যের সোনালি ছটা নিদারুণ আলো ছড়াচ্ছে, ডুপ্লেক্স বাড়িটা কাঠের শোপিচের মতোন মাথা উঁচু করে স্ব স্থানে দাড়িয়ে আছে, এই একটা মায়া যা ক্রীতিককে আজ অবধি ছেড়ে যায় নি।

ফ্রেঞ্চ গেইট ছাড়িয়ে টলতে টলতে ভারী পদযুগলে বাড়ির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিক। ওর চোখ দুটো আগের চেয়েও অনুভূতি শূন্য। প্রতিটি কদমে অজানা আ'ক্রমন হানা দিচ্ছে হৃদয়ে। সেখান থেকে কেউ একজন অসহায় গলায় চিৎকার করে বলছে,

----- ভেতরে যাস না কষ্ট হবে, ওখানে অরু নেই,সব ফাঁকা।

তৎক্ষনাৎ জিদি উগ্র মনটা গম্ভীর ধা'রালো গলায় বলে উঠছে,

--- না থাকলে নেই, ওই মি'থ্যে বাদীটা কবেই বা ছিল আমার, কয়েক দিনের জন্য ফিরে এসে কেবল হৃদয়টাতে এক সমুদ্র জ'লোচ্ছ্বাস তুলে দিয়ে আবার জায়গা মতো ফিরে গিয়েছে, ছ'লনাময়ী একটা। নিজের সবকিছু দিয়ে আমাকে পাগল বানাতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।

শেষ কথাতে দম আটকে এলো ক্রীতিকের,চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো তৎক্ষনাৎ, আবারও সেই এলোমেলো অনুভূতি, অরুর গায়ের মিষ্টি গন্ধ, অরুর নরম তুলতুলে ঠোঁট, ওর স্পর্শ সবকিছু এখনো জীবন্ত দু’চোখের পাতায়। সেসব কথা মাথায় এলে উন্মাদ হয়ে যায় ক্রীতিক। তবে জিদি মস্তিষ্কটা খুব বেশিক্ষণ ভাবতে দিলোনা অরুকে,সবকিছু মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে অকস্মাৎ চোখদুটো খুলে ফেললো ও।পরবর্তীতে আবারও ভারী পা ফেলে এগিয়ে গেলো মেইন ডোরের কাছে।

দরজা খুলতে খুলতে হাতের পিঠ দিয়ে সেই কখন থেকে এক নাগাড়ে নাকের ডগা ঘষছে ক্রীতিক।ব্যাপারটা বিরক্তিকর আর আ'শঙ্কা জনক।কিন্তু ক্রীতিকের কাছে প্যানিক এ্যা'টার্ক নতুন কিছু নয়, তাই ও এসবে কোনোরূপ পাত্তা না দিয়েই চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেলো। ভেতরে প্রবেশ করে হলরুমে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃশ্যগত হলো বিড়াল ছানা ডোরা, আবারও সেই অরুর স্মৃতি, বিরক্তিতে এবার চিড়বিড়িয়ে উঠলো ক্রীতিক, গর্জে উঠে তেঁতো গলায় ডোরাকে ধমকের সুরে বললো,

----- তুই এখনো এখানে কি করছিস? যা ভাগ।

অবুঝ প্রানী ডোরা কি বুঝলো কে জানে? হুট করেই মিয়াঁও মিয়াঁও আওয়াজ করা থামিয়ে দিয়ে চুপচাপ লেজ গুটিয়ে অন্যদিকে হাঁটা দিলো সে। ডোরাও চলে যাচ্ছে, ব্যপারটা বোধগম্য হতেই হাঁটু ভেঙে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো ক্রীতিক,অতঃপর কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,

---- যাস না ডোরা।

ডোরা গেলোনা সেখানেই লেজ গুটিয়ে বসে পরলো তখনই। ক্রীতিক সেদিকে একনজর পরখ করে মৃদু হেসে, আবারও নাকের ডগায় আঙুল ছোঁয়াতেই বুঝতে পারলো ওর নোজ ব্লে'ডিং হচ্ছে। ক্রীতিক ঝাপসা চোখে আঙুলের দিকে তাকিয়ে বিড়িবিড়িয়ে বললো,

---- এগেইন, দিস ফা'কিং প্যানিক এ্যা'টার্ক। বির'ক্তিকর।

কোনোমতে হাতার উল্টো পিঠ দিয়ে ভালোমতো র'ক্তটুকু মুছে,ক্রীতিক কাঁপা হাতে পাহাড়ের ঢাল থেকে কুড়িয়ে আনা আধভাঙ্গা ফোনটা দিয়ে "আর্জেন্ট"লিখে ম্যাসেজ করলো ফ্রেন্ডস গ্রুপে। তারপর একটু নিচের দিকে স্ক্রল করে আবারও সেই ব্ল্যাক হার্ট ইমোজি দিয়ে সেভ করা নাম্বারের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে কাঁপা হাতে টাইপ করলো ক্রীতিক,

---- আবারও আমাকে একা করে দিয়ে কোথায় চলে গেলি হার্টবিট? তোকে ছাড়া আমি ঠিক নেই, মোটেই ঠিক নেই। তুই ঠিক আছিস তো জান?

পুরোপুরি চোখ বুজে যাওয়ার আগে এতোটুকুই টাইপ করেছিল ক্রীতিক। ও জানতো এই ম্যাসেজ কিংবা এই নাম্বার কোনোটাই অরুর কাছে পৌঁছাবে না আর, তবুও ছ'ন্নছাড়া, বেপরোয়া মনটাকে কে বোঝাবে এই কথা? কেই বা দেবে অরুর খবর?

আচ্ছা অরু আদৌও ঠিক আছে তো?

*****************************************

মাঝরাতে বিশাল কক্ষের লাগোয়া কাঠের দরজায় তীব্র করাঘা'তের ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দে যেন পুরো অন্দরমহল কেঁপে উঠছে ক্রীতিক কুঞ্জের।

সেই সাথে কাচের চুড়ি ভা'ঙার টুংটাং আওয়াজ। অমন শক্ত পোক্ত দরজা ভেদ করে ভেতরের আওয়াজ তো বাইরে আসার কথা নয়, তবুও ভেতর থেকে অরুর গগন কাঁপানো হৃ'দয় বিদা'রক একেকটা চি'ৎকারে কম্পিত হয়ে উঠছে অনুর শরীর। ওড়না দিয়ে দু'হাতে মুখ চেপে ধরে অরুর কক্ষের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে অনু।

ওদিকে দরজার বাইরে কারও উপস্থিতি টের পেতেই বারাবারি রকমের উত্তেজিত হয়ে উঠেছে অরু। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ধা'ক্কাতে ধা'ক্কাতে ভে'ঙে ফেলছে হাতের সবগুলো চুড়ি। অরুকে এভাবে বুক ফাটি'য়ে কাঁদতে দেখে অনু কাঁপা গলায় বলে ওঠে,

---- অরু বোন আমার একটু শান্ত, আমি মামির কাছ থেকে চাবি ছি'নিয়ে এনে তোর রুমের দরজা খুলে দিচ্ছি, তবুও এভাবে কাঁদিস না দয়া করে।

অনুর কথায় তীব্র কা'ন্নায় ভে'ঙে পরে অরু বললো,

----- জায়ান ক্রীতিককে ছাড়া আমি ম'রে যাবো আপা,তুই দয়া করে আমাকে তার কাছে যেতে দে, আর কোনোদিন তোদের এই অপয়া মুখ দেখাবো না, তবুও তাকে ছাড়া বাঁচবো না।

অনু ভেবে পায়না,জায়ান ক্রীতিকের মতো একটা উগ্র মেজাজী, দয়ামায়াহীন,পা'ষণ্ড পুরুষের জন্য কিনা তার এইটুকু বোন এভাবে পা'গল হয়ে গেলো? কিন্তু কেন? কি এমন আছে জায়ান ক্রীতিকের মাঝে? কোন জাদুবলেই বা বশ করেছে সে অরুকে?

কই অনুর চোখে তো কোনোদিন তেমন কিছু পরেনি, ক্রীতিক অরুকে জো'র করে বিয়ে করেছে ব্যাপারটা ভাবতে গেলেও মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় অনুর, মনে মনে বলে,

---- কি করে সম্ভব এটা? ক্রীতিক ভাইয়াকে তো কখনো অরুর দিকে ভালো করে তাকাতেও দেখলাম না,অথচ অরু কি-না তার জন্য এভাবে পা'গলামি করছে? আচ্ছা ক্রীতিক ভাইয়া কি আসলেই এতোটা ভালোবাসা ডিজার্ভ করে? উনি তো সুযোগ পেলেই অরুকে মা'রধর করে, তাহলে অরু কেন এমন করছে? একটুআধটু ভালোবাসলে কি কোনোদিন এতোটা পাগলামি করা যায়?মোটেই না। তারমানে কি ক্রীতিক ভাইয়ার ভালোবাসাটা ইনডিভিজুয়াল? আমরাই শুধু দেখতে পাইনা,যার জন্য রয়েছে সে ঠিকই গভীরতা টের পেয়েছে এই ভালোবাসার।

অনুর ভাবনার ছেদ ঘটে অরুর ফোপাঁনোর আওয়াজে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত কন্ঠে অরু পুনরায় বলে,

----- আপা দে'না যেতে, ম'রে যাবো তো। তুইওতো ভালোবাসিস, তাহলে আমি কি দোষ করেছি?

অরুর কাকুতি মিনতি শুনে কান্না দমিয়ে রাখতে পারলো না অনু, অজান্তেই চোখের পাতা ভারী হয়ে গড়িয়ে পরলো অশ্রুজল। অতঃপর কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে, অনু বললো,

----- কি করে যাবি ক্রীতিক ভাইয়ার কাছে? ভুল গিয়েছিস আমরা যে বাংলাদেশ চলে এসেছে,আর তোর জায়ান ক্রীতিক এখনো সেই ক্যালিফোর্নিয়াতে।

অনুর কথায় একপ্রকার ঝাঁজিয়ে উঠলো অরু, অসম্ভব তেঁতো গলায় বললো,

---- তাহলে কেন নিয়ে এলি আমাকে? তোদের কি মনে হয় ওনাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো? মোটেই না। জায়ান ক্রীতিক কে ছাড়া পাগ'ল হয়ে যাবো আমি, শুনেছিস তুই? তোর মামি আর মাকেও কথাটা বলে দে, আমার স্বামী একবার ফিরে এলে, প্রত্যেককে ক্রীতিক কুঞ্জ থেকে হটিয়ে ছাড়বে, তবুও আমাকে ছাড়বে না।

অনুর কষ্ট হচ্ছে খুব, ছোট্ট বোনটার এমন দূরহ অবস্থা আর সহ্য করা যাচ্ছে না, তাছাড়া মা তো এখন আগের চেয়ে ভালোই সুস্থ, দু'একটা কথা বললে খুব বেশি বারাবারি হবে না, সেই ভেবেই অনু চোখ মুছতে মুছতে পা বাড়ালো মায়ের কক্ষের দিকে। মনেমনে ঠিক করলো,

-----আজ মায়ের পায়ে পরে অনুরোধ করে হলেও সবকিছু ঠিক করতে হবে। মামি আর রেজা ভাইয়ের বুদ্ধিতে মা এবার সত্যি সত্যিই অতিরিক্ত করছে।অরুকে আটকে রাখার মতো তো এমন কিছু হয়নি? ও তো আর উড়ে উড়ে আমেরিকা চলে যেতে পারবে না,তাহলে কেন এই নি'র্দয় আচরন?

ভেবে পায়না অনু। তাছাড়া অরুতো ঠিকই বলেছে জায়ান ক্রীতিক অরুর খোঁজে বাংলাদেশে এলো বলে।তখন মামি আর মামির নেতা ছেলে রেজার যে তুলোধুনোর মতোই নাজেহাল অবস্থা হবে সেটা অনু ভালোই আঁচ করতে পারছে এখন থেকেই।

........................................................................

𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃

Episodes
1 List of stories...
2
3 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17 সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41 আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43 এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44 এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45 এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46 এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47 এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48 এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49 এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50 এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51 এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52 এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53 এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54 এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55 এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56 এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57 এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58 এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59 এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60 এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62 ইট পাটকেল [Part.1]
Episodes

Updated 62 Episodes

1
List of stories...
2
3
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.1]
4
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.2]
5
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.3]
6
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.4]
7
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.5]
8
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.6]
9
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.7]
10
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.8]
11
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.9]
12
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.10]
13
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.11]
14
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.12]
15
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.13]
16
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.14]
17
সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি [Part.15]
18
19
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.1]
20
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.2]
21
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.3]
22
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.4]
23
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.5]
24
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.6]
25
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.7]
26
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.8]
27
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.9]
28
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.10]
29
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.11]
30
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.12]
31
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.13]
32
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.14]
33
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.15]
34
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.16]
35
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.17]
36
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.18]
37
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.19]
38
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.20]
39
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.21]
40
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.22]
41
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে [Part.23]
42
43
এক সমুদ্র প্রেম [Part.1]
44
এক সমুদ্র প্রেম [Part.2]
45
এক সমুদ্র প্রেম [Part.3]
46
এক সমুদ্র প্রেম [Part.4]
47
এক সমুদ্র প্রেম [Part.5]
48
এক সমুদ্র প্রেম [Part.6]
49
এক সমুদ্র প্রেম [Part.7]
50
এক সমুদ্র প্রেম [Part.8]
51
এক সমুদ্র প্রেম [Part.9]
52
এক সমুদ্র প্রেম [Part.10]
53
এক সমুদ্র প্রেম [Part.11]
54
এক সমুদ্র প্রেম [Part.12]
55
এক সমুদ্র প্রেম [Part.13]
56
এক সমুদ্র প্রেম [Part.14]
57
এক সমুদ্র প্রেম [Part.15]
58
এক সমুদ্র প্রেম [Part.16]
59
এক সমুদ্র প্রেম [Part.17]
60
এক সমুদ্র প্রেম [Part.18]
61
62
ইট পাটকেল [Part.1]

Download

Like this story? Download the app to keep your reading history.
Download

Bonus

New users downloading the APP can read 10 episodes for free

Receive
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download MangaToon APP on App Store and Google Play