পর্ব____৩

\[পর্বঃ৩\]

************************************

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া,

ইনায়া আজ খুব সকালেই নির্জন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে, চারপাশে মানুষের সাড়া নেই বললেই চলে। নিঃশব্দ পথ ধরে, সে একা একা হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে যায়-বই পড়ার ইচ্ছেই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিঃসঙ্গতা তার কাছে ধীরে ধীরে বোরিং লাগছে।

সে লাইব্রেরির দরজা খুলে সামনে তাকাতেই,

তার চোখে ধরা পড়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য-

লাইব্রেরির নীরবতায় এক ছেলে গভীর ঘনিষ্ঠতায়, একটি মেয়ের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমু খাচ্ছে।

ইনায়া বিস্ময়ে থমকে গিয়ে,মনের গভীর থেকে উচ্চারণ করে-

“আস্তাগফিরুল্লাহ! এইখানে কী হচ্ছে এইসব?"

তার কথা শুনে মেয়েটি ছেলেটিকে ধাক্কাতে থাকে,

কিন্তু ছেলেটির মধ্যে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই বরং সে বিরক্ত হয়ে, আরও আগ্রাসী হয়ে মেয়েটিকে চুমু খেতে থাকে, কোনো বাধা যেন তাকে স্পর্শ করে না।

ইনায়া ছেলেটির এই কান্ড দেখে চেঁচিয়ে ওঠে,

“আপনার কোনো লজ্জা নেই? এখানে সবাই পড়তে আসে, আর আপনি এইসব বাজে কাজ করছেন!ছাড়েন বলছি মেয়েটাকে, দেখতে পারছেন না মেয়েটি শ্বাস নিতে পারছে না।”

ইনায়ার চিৎকার শুনে ছেলেটি এবার কিস্ ব্রেক করে ইনায়ার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

" আউট! ইউ স্টুপিড গার্ল। তুমি কী দেখতে পারছো না, এখানে আমরা কিছু প্রাইভেট কাজ করছি।এ্যান্ড লিসেন, ইফ ইউ হ্যাভ অ্যা প্রবলেম, কল দ্য ডিন। গট ইট!"

"কথাটি বলেই ছেলেটি চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আউট!"

ইনায়া আর এক মুহূর্তও সেইখানে দাঁড়ায় না-আর এইসব দেখার পর, তার দাঁড়ানোর প্রশ্নই উঠে না।

বাইরে বেরিয়ে আসে সে, নিঃশব্দ ক্যাম্পাসে তার নিঃশ্বাসে মিশে থাকে অজানা অস্বস্তি আর কিছু লজ্জাকর মুহুর্ত। সে মনে মনে তাদের দুইজনকে গালি দিতে দিতে সেইখান থেকে চলে যায়।

এইদিকে, কয়েক মুহূর্ত পর ছেলেটি লাইব্রেরির দরজা খুলে বাইরে এসে ইনায়াকে খুঁজতে শুরু করে- কিন্তু সে ইনায়াকে খুঁজে পাই না এতে সে ভীষণ রেগে যায়।সে রেগে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠে,

"ফা*কিং গার্ল, ইউ থিংক ইউ ক্যান এস্কেপ মে? জাস্ট ওয়েট টিল আই গেট মাই হ্যান্ডস অন ইউ। "

(স্টুপিড গার্ল, পালিয়ে গেছে।কী ভেবেছে,পালিয়ে এই অ্যারিক অ্যাসফোর্ডের কাছ থেকে বেঁচে যাবে?

রং বেবিগার্ল, ঘুরেফিরে সেই আমার কাছেই আসা লাগবে।)

*************************************

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সেই সুবিশাল, আধুনিক ক্লাসরুমটি হলো একেকটা বৈচিত্র্যময় চরিত্রের মিলনস্থল। উচ্চতর প্রযুক্তিতে সজ্জিত সেই রুমে, ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে মেতে উঠেছিল নানা আলাপচারিতায়। কেউ কেউ হাসছে, কেউ গ্যাজেট নিয়ে ব্যস্ত, কেউবা টিকটকের ট্রেন্ড নিয়ে আলোচনা করছে। আর ক্লাসরুমের একেবারে পেছনের সারিতে বসে আছে এরিক—তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু পরখ করছে, যার দিকে এক ঝলক তাকাতেই মেয়েরা স্বপ্নে হারিয়ে যায়। তার মুখে চিরন্তন বিদ্রুপের ছাপ, যা দেখে মনে হয়, এই দুনিয়ার সব কিছুকে এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

ঠিক সেই সময় ক্লাসরুমের দরজা খুলে গেল ধীরে ধীরে। ধূসর আলো আর সবার কৌতূহলী চোখের মাঝখানে ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়লো এক কোমল মুখের মেয়ে ইনায়া। ইনায়াকে দেখে মনে হচ্ছে, সে একটু নার্ভাস আসলে সে চিন্তিত যদি অলিভিয়া আর তার বন্ধুরা মিলে তাকে বুলি করে। না সে আর ভাবতে চাইল না, যা হবার দেখা যাবে। সে আল্লাহর নাম নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সহিত এগিয়ে গেল।মাথায় সুশৃঙ্খলভাবে জড়ানো হিজাব, পরনে ঢিলেঢালা পোশাক, যেন আধুনিকতার মাঝেও নিজের পরিচয় আঁকড়ে ধরা এক মৌন প্রতিবাদ।

কিন্তু সবার দৃষ্টি যেন একসাথে ছুটে গেল তার দিকে।ইনায়াকে দেখে একটা মেয়ে ব্যাঙ্গাত্বক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, Hey,Look guys, Who finally Showed up!

আরেকটা ছেলে সেই মেয়েটার তালে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,

"এই পুরোনো যুগের মডেলটা কোথা থেকে এলো রে!"

ছেলেটির কথার মাঝেই হাসিতে ফেটে পড়লো গোটা ক্লাস। কেউ চোখ চড়কগাছ করে তাকালো, কেউ ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগল,

"হিজাব পরে ক্লাসে এসেছে? কী ভয়ংকর পুরোনো চিন্তা - ভাবনা!"

আরেকটা মেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে উঠে,

"ইউনিফর্ম কি এটা এখন থেকে? কেউ যেন বলে দেয় ক্লাসে ফ্যাশনের মানে কী!"

ইনায়া সেসব উপেক্ষা করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। প্রতিটি পায়ে ছিল আত্মবিশ্বাসের শব্দহীন পদচিহ্ন। কিন্তু সামনে এগোতেই তার পথ রোধ করে কেউ ইচ্ছে করে পা বাড়িয়ে দিল। মুহূর্তের ভেতর ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল সে সোজা এরিকের পায়ের কাছে। তার বই, খাতা, কলম সব ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

হাসির রোল উঠলো আবার। এবার যেন আগের চেয়েও আরও জোরে সবাই হাসতে লাগলো।

এরিক এবার মুখ তুলে তাকালো। তার চোখে বিদ্রুপ, ঠোঁটে বাঁকা হাসি স্পষ্ট ফুটে রয়েছে ।সে ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“এই যে! মাদার টেরেসা ভার্সন টু! কোন কনভেন্ট থেকে এসে পড়লে এখানে? নাকি রোড ভুল করে চার্চ থেকে ক্লাসরুমে চলে এসেছো? দুনিয়াটা এগিয়ে গেছে, কিন্তু তুমি এখনও টাইম মেশিনে আছো মনে হচ্ছে!”

তার প্রতিটি কথায় ক্লাসের অন্যরা আরও বেশি করে হাসতে লাগলো।

পেছন থেকে একটা ছেলে গলা ছেড়ে বলে উঠল, "ভুল বলছেন ভাই, ওতো খ্রিষ্টান নই, মুসলিম! আমাদের শেষ করতে হয়তো ওকে কেউ পাঠিয়েছে। আমি বলি কী, ভালো করে খুঁজে দেখুন এই জুব্বার নিচে বোম নিয়ে এসেছে কিনা!

এরিক ছেলেটির কথা শুনে ইনায়াকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে, এরিককের পাশ থেকে আরেকজন ছেলে রসিকতার সহিত বলে ওঠে ,

আরে না! ও তো ‘শান্তির বার্তা’ নিয়ে এসেছে, বুঝলে না? এই জামা-কাপড়ের নিচে কিছু না থাকলে কী হবে, মাথার ভেতরে একখান পুরো ফতোয়ার বই বসানো! সাবধানে থাকতে হবে, নয়তো কালকেই আমাদের সবার ‘হেদায়েত’ শুরু হয়ে যাবে!"

এরিক ছেলেটির কথায় সম্মতি জানিয়ে ইনায়ার দিকে ঘুরে বাঁকা হেসে বলল,

"So, মিস মডেস্টি! Look around — we’re in a classroom, not some medieval costume party! এই গরমে তুমি কীভাবে বেঁচে আছো সেইটাই আমি বুঝতে পারছি না ! Honestly, তোমার এই ফ্যাশন-স্টাইলটা দেখে আমারই ঘাম ঝরতে শুরু করে দিচ্ছে!"

এরিকের মন্তব্যে দ্বিতীয়বারের মতো পুরো ক্লাস হেসে উঠল। কিন্তু এবার আর ইনায়ার পক্ষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই অপমান সহ্য করা সম্ভব হলো না। তারা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একজন মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধকে শুধু তার পোশাক দিয়ে বিচার করার অধিকার এদের নেই।

ইনায়া এগিয়ে এসে এরিকের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

"মিস্টার, আপনি যেই হোন না কেন, আমার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করার কোনো অধিকার আপনার নেই। একজন মানুষের মূল্যবোধ বা আত্মমর্যাদা তার পোশাক দিয়ে বিচার করা যায় না। যদি আমার পোশাকে আপনার সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা আমার নয়;আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা।

কারও শরীর বা পোশাক দেখে কটাক্ষ করা শুধু অসভ্যতা নয়, বরং তা আপনার মানসিকতার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।আপনার এতটা অস্বস্তি আসলে পোশাক নিয়ে নয় বরং আপনি আপনার চোখের ক্ষুধা মেটাতে না পেরে নিজেই অস্বস্তিতে আছেন।একটা কথা মনে রাখবেন—পোশাক নয়, দৃষ্টিভঙ্গিই একজন মানুষের পরিচয় দেয়। আর আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আপনার চরিত্রকে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।"

ইনায়ার কথা শুনে এরিক রাগে গর্জে উঠল,

"এই মেয়ে, মুখ সামলে কথা বলো! বুঝেছো? নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো তুমি। আর যদি আমিও সীমা ছাড়িয়ে যাই, তাহলে তোমায় দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থায়ও রাখব না!"

ইনায়ার এরিকের কথা শুনে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে,সে তেড়ে গিয়ে এরিকের মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে,

"আমি সীমা পেরোইনি, বরং আপনি বহু আগেই পেরিয়ে গেছেন নিজের নিচু মানসিকতার সীমা। আপনি ভাবছেন, আমি ভয় পেয়ে চুপ করে থাকব? ভুল ভেবেছেন। আমার পর্দা আমার অহংকার, সেটা অপমান করার আগে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শিখুন!"

আর হ্যাঁ, ইসলাম আমাকে এই পোশাকে রানির মতো মর্যাদা দিয়েছে। তাই পরবর্তীতে আমার পোশাক নিয়ে আর কোনো রকম কুরুচিকর মন্তব্য যেন আপনার মুখে না শুনি!”

এই কথা বলেই ইনায়া নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ এরিক তাকে থামাতে গিয়ে ইনায়ার হিজাবে টান মারে।

এরিকের এমন অশোভন আচরণে ইনায়া মুহূর্তেই সবার সামনে চরম অপমানিত বোধ করে।

তবে সে চুপ করে না থেকে সাহসিকতার সঙ্গে সোজা হয়ে এরিকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

তারপর কোনো দ্বিধা না করে ঠাস করে এরিকের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।

ইনায়া আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায়নি। চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। হয়তো সে যদি একবারও পিছন ফিরে তাকাত, তাহলে দেখতে পেত;এরিকের গালে চড়টমারাটা কী ভীষণ ভুল ছিল তার।

এরিকের হাত রাগে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল, যেন তার নিঃশব্দ ক্রোধ মুহূর্তেই এক ভয়াল ঝড়ের আকার ধারণ করবে।

************************************

চলবে.....

Download

Like this story? Download the app to keep your reading history.
Download

Bonus

New users downloading the APP can read 10 episodes for free

Receive
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download NovelToon APP on App Store and Google Play