ইট পাটকেল [Part.3]

#পর্ব_২৪

আশিয়ানের মুখোমুখি বসে আছে আশমিন। ঢাকার বিলাশবহুল পাচ তারকা হোটেলের সুইট রুমে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

-- কেমন আছেন জায়িন চৌধুরী?

আশমিন হালকা হাসলো।বাকা চোখে একবার আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল,

-- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মাফিয়া সাহেব।আপনার কি খবর? বাংলাদেশ ঘোরা হয়েছে? সুন্দরবন ঘুরে আসতে পারেন।বাংলার বাঘ সম্পর্কে আইডিয়া হয়ে যাবে।তখন আর এই শহরের বাঘের সাথে টক্কর দেয়ার চুলকানি উঠবে না।

আশিয়ান শব্দ করে হেসে উঠলো। আশমিনের দিকে হালকা ঝুকে কৌতুক গলায় বলল,

-- এতো ভালবাসা কার জন্য বাঘ সাহেব।নূরের জন্য?বোন কিন্তু আমার আস্তো বাঘিনী। আমি নাহয় কিছু না ই করলাম। আপনার বাঘিনী আপনাকে ছাড়বে তো?

আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

-- ছাড়বে কেন?আমি ই বা ছাড়তে দিবো কেন? আমি তাকে আমার ভালবাসায় বন্দিনী করবো।তার তেজ আমি তে শুরু হয়ে আমি তেই শেষ হয়ে যাবে। বড্ড আদরের বউ আমার। আমি আবার বউ ছাড়া একদম থাকতে পারিনা।

আশিয়ান খুক খুক করে কেশে উঠলো। সম্পর্ক যেমন ই হোক না কেন। বোন তো হয়।তাকে নিয়ে এমন লাগামহীন কথাবার্তা কানে লাগছে। আশমিন আশিয়ানের অস্বস্তি কে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি মুল কথায় ঢুকে গেলো।

-- তোমার মামী তোমাকে এখানে কি মনে করে আনলো ভাই আমার। কি চাই তোমার?

-- আমার পুরো সম্রাজ্য চাই। পুরোটা।

আশমিন বাকা হাসলো।

-- সম্রাজ্য তো আমার রানীর। তার রাজা তোমার সামনে বসে। তাকে টপকে নিতে পারলে নিয়ে নাও।

-- আর যদি রানী ই না থাকে?(এক ভ্রু উচু করে)

-- আমার ফুপ্পির শেষ অংশ তুমি।তোমাকে মারতে আমার খারাপ লাগবে।বিষাক্ত অতীত টেনে এনো না আশিয়ান। আমি ধ্বংস হলে কেউ সুখে থাকবে না। চেনো তো আমাকে?কি করতে পারি নতুন করে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়ই?

আশিয়ান আশমিনের শান্ত মুখের দিকে তাকালো। চেহারায় কোন ভয়,অস্থিরতা, চিন্তা, রাগ কোন কিছুরই ছাপ নেই। সে জানে আশমিন ভয়ংকর। যা কেউ জানে না তা আশিয়ান জানে।ভালো মানুষ তো সে ও নয়।

-- আপনার সত্যি সামনে এলে আপনার রানী ই যথেষ্ট আপনাকে ধ্বংস করার জন্য।

-- নিজেকে নিয়ে ভাবো। একটা মাত্র জীবন তোমার।এটা হারালে কি দিয়ে দেহ চালাবে!

ঠান্ডা মাথায় হুমকি দিয়ে চলে গেলো আশমিন। আশিয়ানের মাথায় চিন্তার ভাজ পরেছে।ভিতরে ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে। নূর কে মে*রে ফেলা তার উদ্দেশ্য না।তার উদ্দেশ্য সব কিছু নিজের করে নেয়া।অমির সাথে কথা বলতে চেয়েছে কয়েকবার।ফলাফল শূন্য। তাদের জীবন টা বড্ড অগোছালো। সব থেকেও কেউ নেই। আশমিনের সাথে তার যে সম্পর্ক তা কয়েক জন ছাড়া কেউ জানে না। এমন কি অমি ও না। কামিনী চৌধুরী কে নিরাশ করবে না সে।নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সে আশমিনের মোকাবেলা করবে। কেউ কাউকে জানে মা*রতে পারবে না সমস্যা টা এখানেই। নাহলে এতো দিনে কেচ্ছা খতম হয়ে যেতো।

আশমিন সরাসরি নূরের অফিসে চলে এসেছে। নূর সকাল থেকে তার ফোন রিসিভ করছে না। এতো আদর ভালবাসা দেয়ার পরেও বউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না! তার মেহনত সব জলে ভেসে গেলো! তাই সে চিন্তা করেছে এখন থেকে বউ কে বেশি বেশি ভালবাসবে।সকাল বিকাল ট্যাবলেট খাওয়ার মতো বউকে আদর কর‍তে হবে।দরকার হলে রাজনীতি ছেড়ে বউয়ের আচল ধরে ঘোরার চাকরি নিয়ে নিবে।বউ কে তার জন্য পাগল করেই ছাড়বে। তবে না প্রেম টা মাখোমাখো হবে।

আশমিন কেবিনে প্রবেশ করতেই নূর ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।আশমিন কে দেখে কপাল কুচকে বললো,

-- কি চাই?

-- বউয়ের এটেনশন।তুমি এমন বেঈমান কিভাবে হলে নূর! সারা রাত ভালোবাসার এই দাম দিলা?এতো আদর ভালবাসার পরে তোমার উচিত ছিল আমার কোলে বসে থাকা।আর তুমি সকাল হতেই সব ভুলে গেলে! মানে,কাজ শেষ খোদা হাফেজ!

নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে আশমিনের সমস্ত বাজে কথা হজম করে নিলো।আশমিন থামতেই পুনরায় কাজে মন দিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-- আপনার ছিঃ মার্কা কথা শেষ হলে বিদায় হন।

আশমিন নূর কে টেনে তুলে নিজের সাথে চেপে ধরলো। কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে শান্ত গলায় বললো,

-- ফোন ধরছিলে না কেন?

-- বিজি ছিলাম।

নূরের সহজ উত্তর টা সহজ ভাবে নিতে পারলো না আশমিন।তবে নূর কে কিছু বুঝতে দিলো না। কিছুক্ষণ নিজের সাথে জরিয়ে রেখে গালে বুলিয়ে বললো,

-- খেয়েছো কিছু? এখন শরীর কেমন লাগছে?

-- ভালো লাগছে।খাইনি,খাবো এখন।

-- চলো একসাথে খাই।লুবানা নামে একটা মেয়ে আসবে।আজ থেকে ও তোমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। সান সব বুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসবে।তোমার সাথে সারাদিন থাকবে।মেয়ে টা এতিম। রাতে নূর মঞ্জিলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ো।ছোট একটা ভাই আছে।সেও ওর সাথেই থাকবে।কোন অসুবিধা নেই তো?

-- সমস্যা নেই।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।এবার ছাড়ুন। ক্ষুধা পেয়েছে তো।

আশমিন ছাড়লো না। হাতের বাধর আরো শক্ত করে নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,

-- ছাড়তে পারবো না।আমার মুড নেই।বউ কি ছেড়ে দেয়ার জিনিস?বউ এভাবে জরিয়ে রাখার জিনিস।চুপ করে থাকো।নাহলে অফিস কে বেড রুম বানাতে আমার সময় লাগবে না।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_২৫

রাতের আকাশ দেখায় মগ্ন নূর।আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে।আশমিন এখনো বাসায় আসে নি।তার জন্যই অপেক্ষা করছে নূর।মুখে স্বীকার না করলেও সে আশমিন কে অসম্ভব ভালবাসে। আশমিন তার রক্তে মিশে আছে। এক মুহুর্ত চোখের আড়াল হলেই ভুকের ভিতর আনচান শুরু হয়ে যায়।আচ্ছা, আশমিন কি বুঝতে পারে তার অস্থিরতা? তার চোখ দেখে ভালবাসার গভীরতা বুঝতে পারে এই বজ্জাত মন্ত্রী? আশমিনের ভালবাসায় আবার অত রাখ ঢাক নেই।সে যেখানে সেখানে নিজের ভালবাসা প্রকাশ করে ফেলে।গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলাকালীন বউয়ের কথা মনে পরলে মিটিং থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

-- কিছুক্ষন আলোচনা বন্ধ রাখুন। আমি আমার বউ কে মিস করছি।তার সাথে কথা বলা এই মুহুর্তে অক্সিজেন নেয়ার মতো জরুরি।

প্রথম প্রথম সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেও এখন এসব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আড়ালে সবাই মুখ টিপে হাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস কেউ করে না।

পিছন থেকে কেউ জরিয়ে ধরায় ধ্যান ভাঙ্গলো নূরের।আশমিনের জেন্টস পারফিউম নাকে ধাক্কা খেতেই মুখে হাসি ফুটলো নূরের।

-- আমাকে রেখে আকাশে কি দেখো বউ?

নূর হালকা হেসে জরিয়ে ধরলো আশমিন কে।

-- আকাশের মাঝে আমি আপনাকেই খুজি মন্ত্রী সাহেব। আপনি যখন আমার থেকে দূরে থাকেন,তখন আমার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।মনে হয় এই আকাশের নিচেই তো আপনি আছেন।আমাদের মাঝে কোন দূরত্ব নেই। আপনি আর আমি এক আকাশের নিচেই আছি।

আশমিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আজ নূরের চোখে শুধু তার জন্য ভালোবাসা ই দেখতে পাচ্ছে। আশমিন নূরের কপালে চুমু খেয়ে মন্থর গলায় বলল,

-- ভালবাসি বউ।আমাদের মাঝে যাই কিছু হয়ে যাক না কেন, কখনো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।সহ্য করতে পারবো না আমি।আমার জীবনে আমি নিজের বলতে শুধু তোমাকেই বুঝি।যে আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। যাকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি চাই।তুমি হচ্ছো আমার একমাত্র প্রশান্তির কারণ। আমার চক্ষুশীতল কারিনী।তুমি যদি চাঁদ হও তাহলে আমি সুবিশাল আকাশ নূর।তোমার আমাতে উঠে আমাতেই অস্ত যেতে হবে। পালানোর চেষ্টা করো না নূর।তোমার শুরু থেকে সমাপ্তি আমিতেই সীমাবদ্ধ।

নূর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেতে আবদ্ধ করে নিলো নূর কে।নাকে নাক ঘষে গালে হাত বুলিয়ে নূরের চোখে চোখ রাখলো।নূর আশমিনের চোখে চোখ রেখে বললো,

-- আমার বিশ্বাস নিয়ে কখনো খেলবেন না মন্ত্রী সাহেব। আমি বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করি না। যে সম্পর্কে ধোকা,কপটতা, প্রতারণা থাকবে সে সম্পর্ক নূর পায়ে মারাতে এক মিনিট ও সময় নষ্ট করবে না।আপনি আমাকে বিশ্বাসের নিশ্চয়তা দিন।আমি আপনাকে সম্পর্কের নিশ্চয়তা দিবো।নূর নামের অর্থ জানেন তো মন্ত্রী সাহেব? নূর মানে হচ্ছে আলো।আলোকে বন্দি করার ক্ষমতা আল্লাহ বাদে কার আছে?আমি চাইলে আপনি আমার ছায়ার নাগাল ও পাবেন না। তাই সাবধান।যে নূর আপনাকে ভালবেসে জান্নাত দেখাতে পারে।সে নূর ঘৃণা করে আপনার জীবন জাহান্নাম ও করে দিতে পারে।

আশমিনের বুক কেপে উঠলো নূরের কথা শুনে। হাতের বাধন হালকা হয়ে গেলো। অস্থির চোখ জোড়া নূরের চোখে রাখতেই নূরের কথার সত্যতা দিনের মতো পরিস্কার দেখতে পেলো সে।নূর গভীর চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। তার বুকেও কাপন ধরেছে।এই ভালবাসায় ফাটল ধরবে না তো?

ভালবাসার খুনশুটি তে নূর আর আশমিনের জীবন। কামিনী চৌধুরী হঠাৎ করেই চুপ করে গেছে।আশিয়ান ও নিজের মতোই আছে।এ যেন ঝড় আসার আগের নিস্তব্ধতা। আশমিন আর নূরের সম্পর্ক স্বাভাবিক দেখা গেলেও তাদের মনের খবর সম্পর্কে কেউ ই অবগত না।গত দেড় মাস যাবৎ অমি গুম হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী নিজের মতো থাকে।সংসার টা মায়া বেগম টেনে হিচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংসারের দিকে কারোর মন নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত।আশমিন রাজনীতি নিয়ে ইদানীং খুব ব্যস্ত থাকে। যতটুকু সময় পায় নূরের সাথেই কাটায়।

হঠাৎ করেই নূরের অফিসে লারার আগমন। লারা কে দেখে বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।আশমিনের এতো অপমানের পরেও এই মেয়ের লজ্জা হয় নি।

লুবানা লারার এভাবে হুট করে ঢুকে পরায় কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুড়িয়ে নূরের দিকে তাকাতেই বুঝলো এই আগুন্তকের আগমনে নূর খুশি নয়।

-- এভাবে অসভ্যের মতো নক না করে ঢুকে পরলেন কেন?যান,আবার গিয়ে নক করে তারপর অনুমতি নিয়ে তারপর আসুন।

লুবানার কাটকাট গলায় বলা কথা গুলো শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো লারার।

-- মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলো।দু টাকার কর্মচারী হয়ে এভাবে কথা বলো কিভাবে?সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যাও।আমার নূরের সাথে কথা আছে।

-- মুখে লাগাম দিবো কেন?আমি কি ঘোড়া নাকি?আমার লাগামের কথা চিন্তা না করে আপনি আপনার পায়ে লাগাম দিন।যেখানে সেখানে ঢুকে পরে।

লারা দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইলো লুবানার দিকে। নূর নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কি হচ্ছে তাতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।লারা নূরের এই নির্লিপ্ততা দেখে ফুসে উঠলো। দাত কিড়মিড় করে বললো,

-- খুব দেমাগ বেড়েছে না?যে আশমিনের জন্য এতো আকাশে উড়ছো সেই তোমাকে ছুড়ে ফেলবে। ভোগ করা শেষ হলে রাস্তায় ছুড়ে মারবে।তখন না এ ঘাটের রবে না ও ঘাটের।

নূর শান্ত চোখে তাকালো লারার দিকে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-- নূর কোন মন্ত্রীর দাপটে চলে না।আমি কে ভুলে গেছো বুঝি?তেহজিব নূর শিকদার আমি।শিকদারেরা মন্ত্রী বানায়। মন্ত্রীদের ক্ষমতায় চলে না। তোমার কি মনে হয় লারা?পুকুরের পানি দিয়ে শিকদাররা এই সাগর বানিয়েছে? নর্দমায় থাকো তো।তাই এই বিশাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে ধারণা নেই।

লুবানা,,,একে নর্দমায় ফেলে দিয়ে এসো।ম্যাডামের এতো ভালো পরিবেশ সহ্য হয় না।

লারা সাপের মতো ফোসফাস করতে লাগলো। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। তখন দেখবে এতো ভাব কোথায় থাকে।

-- ও ম্যাডাম। দরজা ওই দিকে।নাকি সিকিউরিটি ডাকতে হবে।

লারা লুবানার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।

নূর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। লুবানা কিছু না বুঝলেও তার নূরের জন্য খারাপ লাগলো।আশমিন কে তার খারাপ মনে হয় নি। তার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করে। বড় ভাইয়ের মতো স্নেহ করে।নূরের সমস্ত খবরাখবর তার থেকেই নেয়।মাথা ঘুরতে শুরু করেছে লুবানার।

-- আপনি ঠিক আছেন ম্যাম?

-- হুম।আজকের মিটিং গুলো ক্যান্সেল করে দাও।আমি বাসায় যাচ্ছি।

লুবানা মাথা নেড়ে সায় জানালো। আশমিন আজ সারাদিন নূরের খবর নেয়ার সুযোগ পায়নি।মন্ত্রণালয়ে আটকে গেছে। ইদানীং নূরের শরীর খুব একটা ভালো থাকে না।খাওয়া দাওয়ার প্রচন্ড অরুচি। আশমিন জোর করে ও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই আজ ডাক্তার বাসায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।তার বউ খাবার দেখে নাক মুখ কুচকে ফেলবে আর সে মুখ বুজে দেখবে তা হতে পারে না। এক বিয়ে করেই তার এই অবস্থা! বাবার মতো দুই বউ থাকলে না জানি কি হতো!

নূর বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সোজা স্টাডি রুমে চলে গেলো। মায়া বেগম নূরের খাবার টা স্টাডি রুমেই পাঠিয়ে দিলো। বাসায় এখন আর একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া হয় না।একেক জন একেক সময় খায়।কামিনী চৌধুরী কানাডা গিয়েছে দুই দিন আগে।মায়া বেগমের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে না। কোন কথা ও বলে না।আমজাদ চৌধুরীর সামনেও খুব কম পরে। আমজাদ চৌধুরী চাতক পাখির মতো বসে থাকে তাকে এক পলক দেখার জন্য। কিন্তু দিনে একবার ও দেখা পান না। মাঝে মাঝে সপ্তাহ পার হয়ে যায়। অপেক্ষা শেষ হয় না।

আশমিন বাড়িতে যখন ঢুকেছে তখন রাত দশটা।আমজাদ চৌধুরী সোফায় চোখ বুজে বসে আছে। কয়েকদিনে বয়স অর্ধেক বেড়ে গেছে।আশমিন ধপ করে গিয়ে তার পাশে বসে পরলো। গম্ভীর গলায় বলল,

-- এভাবে বসে আছো কেন? ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।এভাবে চললে তো নূরের আর ননদের মুখ দেখা হবে না। আমি কতো বড় মুখ করে বলেছি, আমার আব্বু ইজ আ স্ট্রং ম্যান। আর তুমি কিনা বোয়াল মাছের মতো চিৎ হয়ে পরে আছো!কালকেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।কলিকাতা হারবাল। এক ফাইল ই যথেষ্ট।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_২৬

স্টাডি রুমে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে নূর। অনুভূতিহীন চোখে এক মনে তাকিয়ে আছে আশমিনের ডায়েরির দিকে।একটি মাত্র ডায়েরি জীবনের অনেক অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বসে আছে নূর। কান্না আটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁট কেটে র*ক্ত বেরিয়ে গেছে।ডায়েরি থেকে নজর সরিয়ে রক্তাক্ত চোখে তাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো আশমিনের বিশাল ফ্রেমের ছবির দিকে। নিজেকে টেনে হিচড়ে দাড় করালো নূর। ডায়েরি টা জায়গা মতো রেখে আশমিনের ছবির সামনে এসে দাড়ালো।

-- ধোকা! এত বড় ধোকা! (ছবিতে হাত বুলিয়ে) আপনাকে কি শাস্তি দেই বলুন তো মন্ত্রী সাহেব? কি নিখুঁত অভিনয় আপনার! আপনি তো নিজের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিলেন।এবার আমার টা দেখানোর পালা। অভিনয় করতে ভালো লাগে তাই না? তো চলুন,এক দফা টক্কর আমাদের মাঝেও হয়ে যাক(দাতে দাত চেপে)। আপনার চালে যদি আপনাকে মাত না দিয়েছি তো আমার নাম ও তেহজিব নূর শিকদার নয়।

আশমিন আসার পর থেকে নূর কে একবার ও দেখে নি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কপাল কুচকে চারিদিকে চোখ বুলালো সে।হাতের তাওয়াল টা বারান্দায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আশমিন নিচে এসে অস্থির গলায় বলল,

-- নূর কোথায় আন্টি?

-- বউমা তো অনেকক্ষণ আগে স্টাডি রুমে গিয়েছে। দুপুরের খাবার টাও ওখানেই খেয়েছে। নিচে তো আসতে দেখিনি।

আশমিন ভয়ার্ত চোখে তাকালো মায়া বেগমের দিকে। হুশ ফিরতেই এক প্রকার দৌড়ে গেল স্টাডি রুমের দিকে। মায়া বেগম প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলো। শুধু বাড়ির লোক ই না, চেনা জানা সবাই জানে আশমিন নূর কে চোখে হারায়।শাজাহানের মতো নূরের জন্য নূরমহল বানিয়ে ফেললেও কেউ অবাক হবে না।সেফ কে নিজের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে গেলেন মায়া বেগম। শরীর টা আজ খুব একটা ভালো না।জ্বর আসবে হয়তো। আমজাদ চৌধুরী তার দিকে ফিরেও তাকায় না।তাতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। বরং এমন নিখাত ভালবাসা দেখে মনে মনে তৃপ্তি পায় সে।

হুড়মুড় করে স্টাডি রুমে ঢুকতেই নূর আশমিনের দিকে চোখ তুলে তাকালো। নূরের হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি। আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। নূর মুচকি হেসে বই রেখে উঠে দাড়ালো। ধীর পায়ে কাছে এসে আশমিনের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। আশমিন ও আগলে নিলো নূর কে।হৃদপিণ্ডের তীব্র ধুকপুকানি নূরের কানে এসে বারি খাচ্ছে। নূর বাকা হাসলো, ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,

-- ভয় পেয়েছেন নাকি মন্ত্রী সাহেব? এভাবে বুক কাপছে কেন?এভাবে তো অপরাধীর বুক কাপে। করেছেন নাকি কোন বড়সড় অপরাধ?

আশমিন হাত আলগা করে নূর কে নিজের সামনে আনলো।নূরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নূরের চোখ একেবারে শান্ত।হাসি হাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেকে শান্ত করলো। নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,

-- অপরাধ তো করেছি বউ।আজ সারাদিন বউয়ের খবর নিতে পারিনি।এটা তো গুরুতর অপরাধ। শাস্তি তো পেতেই হবে।

-- হুম,আমি দিবো আপনাকে শাস্তি। আজ সারা রাত আমার সাথে বারান্দায় গল্প করে কাটাতে হবে। শাস্তি মঞ্জুর তো মন্ত্রী সাহেব?

আশমিন চোখে হাসলো। নূরের কপালে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা গলায় বলল,

-- এমন শাস্তি আমি সারাজীবন পেতে চাই বউ।

আশমিনের কাছে আসায় গা গুলিয়ে উঠলো নূরের। নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়ালো। আশমিন ভ্রু কুচকে ফেললো। নূরের ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। দ্রুত পায়ে এসে নূরের গাল চেপে ধরলো।কাটা জায়গায় স্লাইড করতে করতে বললো,

-- এভাবে কাটলো কিভাবে? ঠোঁট কামড়েছো কেন?এখন আমি চুমু খাবো কোথায়?

প্রথম কথা গুলো রাগ করে বললেও শেষ কথা টা দুঃখী দুঃখী গলায় বলল আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। অভিনয়েও বুঝি ভালবাসা এতো নিখুঁত হয়!

-- এই মেয়ে,কথা বলছো না কেন?

আশমিনের ধমকের পিঠে কিছু বলার আগেই মাথা ঘুরে উঠলো নূরের। ঝাপসা চোখে একবার আশমিনের দিকে তাকিয়ে ঢলে পরতেই আশমিন আগলে নিলো নূর কে। অস্থির গলায় ডাকতে লাগলো,,

-- বউ!কি হয়েছে তোমার? নূররর,,,,

নূর কে কোলে তুলে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতেই চিৎকার করে সবাই কে ডাকলো আশমিন।বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে ফোন করলো ডক্টর কে।ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।লুবানা গিয়ে নূরের হাত পা মালিশ করতে লাগলো। মায়া বেগম চোখে পানি ছিটিয়ে দিলেও নূরের জ্ঞান ফিরলো না।আশমিন পাগলের মতো নূর কে ডেকে যাচ্ছে বারবার। লুবানার ছোট ভাই লিমন এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে আশমিন কে ভয় পায়।এখন আশমিনের পাগলামি দেখে আরো ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে।আমজাদ চৌধুরী চিন্তিত গলায় বলল,

-- এভাবে বসে থেকো না। ওকে হসপিটাল নিয়ে যাও।

আশমিন আর এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না।নূর কে কোলে তুলে রুম থেকে বেরুতেই সানভি হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো ডক্টর নিয়ে।আশমিন আবার নূর কে রিমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো।সবাই কে বেরিয়ে যেতে বলতেই আশমিনের ভয়ংকর দৃষ্টিতে দমে গেল ডক্টর। সবাই বেরিয়ে গেল ও আশমিম নূরের হাত ধরে তার পাশেই বসে রইলো। ডক্টর চেকআপ করে মুচকি হেসে আশমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-- অভিনন্দন স্যার।সি ইজ প্রেগন্যান্ট। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।এখন ওনার রেস্ট প্রয়োজন। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালের আগে ঘুম ভাঙ্গবেনা।কাল হসপিটালে গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আনবেন।তাহলে ম্যামের কন্ডিশন ভালো ভাবে বোঝা যাবে।

ডক্টরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আশমিন।তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে,"সি ইজ প্রেগন্যান্ট "ডাক্তারের বাকি কথা তার কানে গেলো কি না বোঝা গেলো না।ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই ডাক্তার মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। আশমিন একমনে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আশমিনের হাতের মুঠোয় থাকা নূরের হাতটার কয়েকটা নখ ভেঙে গিয়েছে। আশমিন হালকা ঝুকে জরিয়ে ধরলো নূর কে।উত্তেজনায় তার পুরো শরীর কাপছে। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে।

নিচে লুবানার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সানভি ধমকেও তাকে থামাতে পারছেনা।

-- এভাবে চিৎকার করছো কেন সাবানা?অসভ্যের মতো চিৎকার করা বন্ধ করো।ছিঃ, কি গলা।মনে হচ্ছে ফাটা বাসের ভিতর আটকে পরা ইদুর কিচমিচ করছে।

লুবানা সমস্ত আনন্দ ভুলে ফুসে উঠলো। কটমট করে তাকালো সানভির দিকে।

-- ও হ্যালো,মি.কবরস্থানের বাসিন্দা। আমার নাম লুবানা।লু,,বা,,না।নট সাবানা। আর আমার গলা মোটেও ইদুরের মতো নয়।আপনার কানে সমস্যা।লক্কর ঝক্কর যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুরে বেরাতে লজ্জা করে না আপনার?তাজ্জব ব্যাপার!

সানভি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে। মেয়ের সাহস দেখে অবাক হচ্ছে সে।আর এদিকে লিমন দুজনের ঝগড়া দেখছে আর হাই তুলছে।আমজাদ চৌধুরী আর মায়া বেগম নূরের রুমে গিয়েছে। না হলে ইজ্জত পানি পানি হয়ে যেতো এই মেয়ের জন্য।

-- দেখো মেয়ে,, বেশি বারাবাড়ি করবে না। না হলে ছাদে তুলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো।বেয়াদবির একটা আদব থাকা দরকার।

-- হুহ,,আসছে ধাক্কা দিতে।বলি হাড়গোড় সব ঠিক যায়গায় আছে তো?আগে চেক করে আসুন।দেখা গেলো চোখ কানের মতো হাড্ডি ও দুই একটা কবরে রেখে এসেছেন।

লুবানা মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। সানভি কটমট করতে করতে লিমন কে বললো,

-- দেখেছো? দেখেছো কেমন বেয়াদব?

লিমন হচকচিয়ে গেলো। জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

-- জ্বি ভাইয়া।ছোট বেলা থেকেই দেখছি।

আশমিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমজাদ চৌধুরী।ছলের খুশির পরিমাণ তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাম্ভিক হাসি দিলো।আমজাদ চৌধুরী ভ্রু কুচকে তাকালো ছেলের দিকে। নিশ্চিত এখন বেহায়া মার্কা কিছু বলবে।এখানে মায়া বেগম ও আছে।আমজাদ চৌধুরী আর লজ্জায় পরতে চাইলো না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই আশমিন তার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

-- একা যাচ্ছো কেন? তোমার বউ নিয়ে যাও।একা গেলে সুখবর পাবো কিভাবে।ওষুধে তো কাজ করার কথা।খাচ্ছো তো ঠিকঠাক? মনের মধ্যে দুষ্টু আমজাদ চৌধুরী উকি দেয়নি এখনো? নাহ,, টিউবলাইট হয়ে যাও নি তো আবার?

আমজাদ চৌধুরী মনে মনে কয়েক ঘা লাগালেন ছেলের গালে। এরকম একটা বজ্জাত ছেলে তার ই কেন হতে হলো! দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলেন তিনি।বাকি ইজ্জত টুকু এই ছেলের হাত থেকে বাচিয়ে রাখতে হবে।নিজেকে মাঝে মাঝে অসহায় রমনী মনে হয়।আর আশমিন কে রাস্তার বখাটে।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_২৭

রাতের আকাশে অজস্র তারার মেলা বসেছে।চারিদিকের ভ্যাপসা গরমের কারনে সবার জীবন ওষ্ঠাগত। ছাদের দোলনায় বসে গরমের তীব্রতা আন্দাজ করতে পারছে নূর। সারাদিন এসির ভেতর থেকে গরমের তীব্রতা উপভোগ করার সুযোগ হয় না।পূর্বপুরুষদের অর্জনের জন্য এই বিলাসবহুল জীবন তার।কি হতো যদি এতো বিলাসিতা না থাকতো?আর পাচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো তারাও না হয় সংগ্রাম করে বেচে থাকতো।দামী গাড়িতে না চড়ে লোকাল বাসে চড়ে সবার মতো সাধারণ জীবন যাপন করতো। দিন শেষে আপন মানুষগুলো কে পাশে তো পাওয়া যেতো। কি হবে এতো অর্থ পতিপত্তি দিয়ে।আভিজাত্য যদি দিন শেষে নিঃসঙ্গতা দেয় সেই আভিজাত্য তো অভিশাপ স্বরুপ। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নূরের।পেটে হাত রেখে অনুভব করলো নিজের অস্তিত্ব কে। মা হওয়ার সংবাদ তাকে আশমিন ই দিয়েছে। চোখে মুখে তার কি নিদারুণ জোত্যি ছিল।ভাবতেই নূরের ঠোঁটে বিষাদের হাসি ফুটে উঠলো। কি হতো তাকে একটু ভালবাসলে? মিথ্যা ভালবাসি না বলে সত্যি ঘৃণা করি বলে নাহয় গু*লি ই করে দিতো।মৃ*ত্যু যন্ত্রণা হয়তো এই মিথ্যার যন্ত্রণার থেকে কম ই হতো। এই যে ক্ষনে ক্ষনে বুক ভারি হয়ে আসে।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থেকে মরণ যন্ত্রণা দেয়।এর চেয়ে কি মৃত্যু ভালো ছিল না?

আহা কষ্ট! এই কষ্ট তার পিছু কেন ছারছে না?আর কতটা যন্ত্রণা ভোগ করলে কষ্ট তাকে রেহাই দিবে?

-- এখানে কি করছো নূর?

আমজাদ চৌধুরীর কথায় চোখ তুলে তাকালো নূর।বিষাদমাখা হাসি দিয়ে আবার আকাশ দেখায় মন দিলো। আজকাল কাউকে তার সহ্য হয় না। আসেপাশের সবাইকে প্রতারক মনে হয়। এতো মানুষের ভিড়ে তার কেন একজন আপন মানুষ নেই এই ভেবেই দিনের অর্ধেক টা সময় কেটে যায়।

আমজাদ চৌধুরী এসে নূরের পাশে বসলো। নূরের মলিন চেহারা দেখে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। কিছু না করেও এই মেয়েটাকেই সব কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন?

-- রাত হয়ে গেছে তো মা।এই সময়ে এভাবে এখানে বসে থাকতে নেই।

-- ঘরেই যদি জান নেয়ার মানুষ থাকে তাহলে বাইরে আর কিসের ভয়?

আমজাদ চৌধুরী হচকচিয়ে গেলো। হতভম্ব গলায় বলল,

-- কি বলছো মা?

-- একটা গল্প শুনবে আংকেল? এক অভাগী রাজকুমারীর গল্প।

আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর হালকা হেসে বলতে শুরু করলো,

-- এক দেশে এক রাজকুমারী ছিল।রাজা রানীর চোখের মনি। হেসে খেলে তাদের জীবন পার হচ্ছিল। একদিন হুট করেই তাদের জীবনে অতীত হানা দিল।রাজার বোন প্রেমে পড়েছিল এক ভীনদেশী যুবকের।রাজার অগোচরে রেজিষ্ট্রি করে বিয়েও করেছিল তারা।

একমাত্র বোনের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি রাজা।ক্ষুব্ধ হয়ে বোনের কাছে গেলো জবাব চাইতে। বোন নিজের ভালোবাসার কথা জানালে রাজা তাদের মানতে অস্বীকৃতি জানান। বোন ও জেদ ধরে রাজার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়।রানী দুজন কে থামাতে ব্যর্থ হলে রাজার বোন কে বোঝায় আপাতত রাজার কথা মেনে নিতে। বোন তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না। বড় বোনের মতো ভাবির গায়ে হাত তুলতে ও পিছ পা হয় না। প্রেয়সীর গায়ে আঘাত সহ্য করতে পারে না রাজা।সকল রাগ গিয়ে জমা হয় ভীনদেশী যুবকের উপর। আঘাত করে বসে বোনের স্বামী কে।দুর্ঘটনা বশত মৃত্যু হয় তার। স্বামীর মৃত্যুর শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যায় বোন। মৃত্যুর কারণ ধামাচাপা দিলেও বোনের নজরে থেকে যায় আজীবন দোষী। দুই মাসের অন্তসত্তা বোন কে নিয়ে বারবার আফসোস করতে থাকে রাজা।বোনের নীরবতা তাকে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিজের অপরাধ দেখিয়ে দিচ্ছিলো। হাতে পায়ে ধরেও ক্ষমা পায় নি সে। নয় মাস পরে এক ফুটফুটে ছেলের জন্ম দেয় সে। ছেলে জন্ম দেয়ার তিন মাস পর বিয়ে করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে। যাকে ভালোবাসলেও আজ পর্যন্ত স্বামীর অধিকার দিতে পারে নি। নিজের প্রথম ভালবাসাকে ভুলে এগিয়ে যেতে পারে নি সে। ছেলে কে সব সময় নিজের থেকে দূরে রেখেছে সে।ছেলের মুখের আদল বারবার তাকে তার ভালবাসার মানুষ টির কথা মনে করিয়ে দিতো। যাকে তার ভাই খু*ন করেছে। প্রতিশোধের আগুনে বারবার নিজের স্বত্তা কে জ্বালিয়ে ভাইকে ধ্বংসের খেলার নেমেছে সে। ক্ষমা করার ভান করে তাকে বারবার আঘাত করেছে।ঠান্ডা মাথায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী কে খু*ন করে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিয়েছে। দেখাশোনার নাম করে রাজার আদরের রাজকুমারী কে চাকরানীর মতো ট্রিট করেছে। প্রথম স্বামীর বোন কে দিয়ে রাজা কে সিডিউস করেছে। সেই সন্তানদের কেই তাকে ধ্বংস করার কাজে লাগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেকে দিয়ে,,,,(তাচ্ছিল্যের হেসে)

আচ্ছা আংকেল, এক ভুলের কতো শাস্তি হয় বলো তো? অনুশোচনার চেয়ে বড় শাস্তি কি এই পৃথিবীতে আর কিছু আছে? এখন রাজকুমারী যদি প্রতিশোধ নিতে চায়! তার মাকে খু*ন করার প্রতিশোধ, তার শৈশব, কৈশোর নষ্ট করার প্রতিশোধ, মিথ্যা সম্পর্কে বেধে দেয়ার প্রতিশোধ, ভালবাসার নামে ঠকানোর প্রতিশোধ, তাকে এই পৃথিবীতে পুরোপুরি এতিম করে দেয়ার প্রতিশোধ, তাকে প্রতারণার মতো মরণ যন্ত্রণা দেয়ার প্রতিশোধ। তখন রাজকুমারী অপরাধী হবে না তো? কিছু না করেও সেই তো সবচেয়ে বেশি শাস্তি পেলো।তার প্রতিশোধ নেয়া অন্যায় হবে না তাই না?

আমজাদ চৌধুরীর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নূরের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।এই তিক্ত সত্যি গুলো নূর কিভাবে জানলো তা নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। আশমিন তার ছেলে না হলেও সে তাকে জীবনের চেয়ে ও বেশি ভালোবাসে। নিজের বুকে রেখে মানুষ করেছে তাকে।কখনো বুঝতে দেয় নি সে তার নিজের ছেলে না। একটা সময় এসে আশমিন ও সত্যি টা জেনে যায়। সত্য হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। হাজার মেঘের আড়ালে ঢাকা পরলেও তা একসময় প্রকাশ পাবেই। আশমিন সত্যি টা জানলে ও সবসময় না জানার ভান করে থেকেছে। আগের চেয়ে বেশি তার সাথে শুরু করে। বন্ধুর মতো মিশেছে তার সাথে। এক সিগারেট দুই জন ভাগ করে খেয়েছে কতো। তার বাবা হয়ে সে এখনো ভার্জিন সেই আফসোসে কতো কতো হতাশার শ্বাস ফেলেছে। শুধু মাত্র কামিনীর প্রতিশোধের নেশা সব কিছু শেষ করে দিল। নূরের অসমাপ্ত কথার রেশ প্রমান করছে সে আরো অনেক কিছু জানে।আর চুপ থাকার মেয়েও সে না।ছেলের জন্য বুকের ভিতর আনচান করতে লাগলো আমজাদ চৌধুরীর। সে জানে তার ছেলে কতটা হিংস্র। ঠান্ডা মাথায় বাঘ শিকার করার মতো ছেলে তার।

আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নূর। তাকে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,

-- চিন্তা করো না আংকেল।আমি প্রতিশোধ নিবো না।প্রতিশোধ শুধু ধ্বংস করে। আমি চাইনা আমার সন্তান আমার মতো জীবন পাক। মন্ত্রী সাহেব কে কিছু জানিয়ো না। সম্পর্কে আর কোন দূরত্ব চাই না আমি। স্বামী সন্তান নিয়ে শান্তিতে সংসার করতে চাই।

আমজাদ চৌধুরী স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। নূরের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভরাট গলায় বললো,,

-- কষ্ট পেয়ো না মা। সব কিছু বাদ দিলেও এ কথা সত্যি, আশমিন তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসে।ওর ধ্যান ধারণা একমাত্র তুমি। তোমার শূন্যতা ওকে কতটা উন্মাদ করে দেয় তা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। ওকে কষ্ট দিয়ো না।তারাতাড়ি নিচে চলে এসো।আশমিন এসে তোমাকে এখানে দেখলে রাগ করবে।

নূর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।আমজাদ চৌধুরী ধীর পায়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে। নূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,,

-- যে ভালবাসা আমাকে বারবার আঘাত করছে সে ভালবাসা দিয়ে আমি কি করবো আংকেল?আমি তাকে কষ্ট দিবো না। সে নিজেই তার কষ্টের কারণ হবে।সব থেকেও সে থাকবে নিঃস্বঙ্গ।যে বিষাদের সাগরে সে আমাকে ফেলে দিয়েছে সেই বিষাদের স্বাদ সে পাবে না তা কি করে হতে পারে? আশমিন জায়িন চৌধুরী যদি তার মায়ের ছেলে হয় তাহলে তেহজিব নূর শিকদার ও তার বাবার মেয়ে।ধোকার পাল্টা জবাব দেয়া তার রক্তের বৈশিষ্ট্য।

-- বউ,,,

আশমিনের ক্লান্ত গলা শুনে চোখ তুলে তাকালো নূর।সাদা পাঞ্জাবি তে রাজপুত্রের মতো লাগছে আশমিন কে। মুচকি হেসে হাত বারিয়ে দিল নূর।আশমিন নূরের হাত ধরে ধপ করে এসে বসে পরলো নূরের পাশে। নূরের হাতে চুমু খেয়ে এক হাতে জরিয়ে ধরলো তাকে।নূর ও বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে আশমিনের বুকে গা এলিয়ে দিলো।

-- ছাদে আসতে নিষেধ করেছি না? এতো গুলো সিরি বেয়ে উঠতে কষ্ট হবে তো তোমার। আমি যখন বাসায় থাকবো তখন আমাকে বলবে।আমি কোলে করে নিয়ে আসবো তোমাকে।

আশমিনের কুচকানো মুখ দেখে হেসে ফেললো নূর।কাধে থুতনি ঠেকিয়ে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো আশমিনের ক্লান্ত চেহারার দিকে।

-- এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো।আমার লজ্জা লাগে।

-- আপনার লজ্জা ও লাগে(অবাক হয়ে)?

-- আমি খুব লাজুক ছেলে বুঝলে? প্রথম যেদিন তোমাকে গভীর ভাবে ছুয়েছিলাম সেদিন আমি দুই সেকেন্ড লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ভাবা যায়! ইসসস,,এতো লজ্জার জন্যই তো সুখবর পেতে বারো দিন দেড়ি হলো। এতো লজ্জা নিয়ে তো বছর বছর বাবা হতে পারবো না।কেমন বউ তুমি?বরের লজ্জা ভাঙ্গাতে পারো না।

নূর হতভম্ব হয়ে রাগ করতেও ভুলে গেলো। দুই মিনিট আশমিনের গলা চেপে ধরার অদম্য ইচ্ছা টাকে ঘুম পারিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_২৮

চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিলাসবহুল কেবিনে বসে আছে আশমিন। শান্ত মুখে পরাজয়ের ছাপ স্পষ্ট। তার সামনেই আমজাদ চৌধুরী বসে ছেলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।

-- সব কিছু জেনেও এভাবে হাতে হাত রেখে বসে আছো কেন? ও তোমাকে আঘাত করবে আশমিন।বাবা হতে চলেছো তুমি।নিজেদের মধ্যে সবকিছু মিটিয়ে নাও।

আশমিন চোখ তুলে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। শান্ত গলায় বললো,

-- ও আমাকে ঘৃণা করে আব্বু।যতটা ঘৃণা করলে একটা মানুষের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দেয়া যায় ও আমাকে ঠিক ততটা ঘৃণা করে। আমি প্রতিটি মুহুর্ত তা অনুভব করতে পারি।

-- তাহলে কি তুমি এভাবেই সব কিছু চলতে দিবে? রাগের বসে ও যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে?বাচ্চার সাথে ও তো কিছু করে ফেলতে পারে।যে তোমাকে ঘৃণা করে সে তোমার বাচ্চাকে ও তো ঘৃণা করবে।বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?(অস্থির হয়ে)

আমজাদ চৌধুরীর অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো আশমিন। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।

-- ভুল ভাবছো তুমি আব্বু।ও কখনো আমাদের সন্তানের কোন ক্ষতি করবে না। ও আমার একার সন্তান না।ও নূরের ও সন্তান।আমি হয়তো এখনো ওকে অনুভব করতে পারি নি।কিন্তু নূর প্রতি মুহুর্তে ওকে অনুভব করছে। একজন মা কখনো তার সন্তানের ক্ষতি চাইতে পারে না।আমার প্রতি যতই ঘৃণা থাকুক না কেন,নিজের সন্তান কে অবহেলা করবে না ও। আর আমার প্রতি ঘৃণা টা কি অযোক্তিক আব্বু?

আমজাদ চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন। নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হচ্ছে। রাফসান শিকদার ভুল ছিল।সে ইচ্ছে করে কামিনীর স্বামী কে মারে নি। ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিল। এক প্রতিশোধের জন্য কামিনী নূরের মা কেও মেরে ফেলেছে। এর পরেও সে থেমে থাকে নি।রাফসান চৌধুরী কে ও ছাড়েনি সে। নূরের মায়ের এখানে কোন দোষ ছিল না। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল।কামিনী কে রাফসান শিকদারের কথা মেনে নিতে বলেছিল যাতে পরবর্তীতে রাফসান শিকদার কে বোঝানোর কিছুটা সময় পায়।কিন্তু বরাবর উগ্র মেজাজের কামিনী তাকেই আঘাত করে বসলো।পরিস্থিতি খারাপের দিকে একমাত্র কামিনী চৌধুরীর ঔদ্ধত্যের কারনে গিয়েছে। সে কামিনী কে বিয়ে করেছে তাকে আগলে রাখার জন্য। তার প্রখর ভালবাসা কামিনী বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছে। কামিনী চৌধুরী যে তাকে ভালবাসে না তা কিন্তু না। কিন্তু তাদের মাঝে সারাজীবন দেয়াল হয়ে রয়ে গেলো তার প্রাক্তন। কামিনী চৌধুরীর প্রত্যেক টা অন্যায় জানার পর বারবার মুষড়ে পরেছেন।বাধা দিতে গিয়ে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে।প্রচন্ড ভালবাসার কারণে আইনের হাতে তুলে দিতে পারেনি।আজ তার প্রখর ভালবাসা ই কাল হয়ে দাড়ালো। তার আবেগে ভেসে যাওয়ার কারনেই এতো গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।

-- বাসায় যাও আব্বু। সব কিছুর উর্ধ্বে আমি নূর কে ভালবাসি।ও আমাকে ঘৃণা করুক বা ভালবাসুক। আমার সাথেই ওকে থাকতে হবে। এই জীবনে ওর আমি থেকে মুক্তি নেই।

আমজাদ চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন।কামিনী চৌধুরী ফিরে এসেছে কানাডা থেকে।আমজাদ চৌধুরী আমতা আমতা করে বললো,

-- তোমার আম্মু যদি,,

আশমিন ঠান্ডা চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। হিমশীতল গলায় বলল,

-- নিজের বউ সামলে রেখো আব্বু।আমি মানুষ টা মোটেও সুবিধার নয়। প্রচন্ড স্বার্থপর মানুষ আমি।আমার স্বার্থে আঘাত লাগলে কেউ ছাড় পাবে না।

আমজাদ চৌধুরী ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ছেলে কতটা সিরিয়াস তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।

আশমিন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দেয়ালের দিকে। সে কোন ভুল করে নি।সেদিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে নূর ও কোন ভুল করছে না।তাহলে ভুলটা কার?বুকের ভিতর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো আশমিনের।নিজের অস্থিরতা কমাতে তার বউ দরকার। অস্থির পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল আশমিন। না জানি বউ তার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করছে।তাই বলে সে তো আর তাকে একা ছেড়ে দিতে পারেনা।

সাত মাসের পেট নিয়ে অফিসে এসেছে নূর। এই কয়েকমাসে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন খু*ন হয়েছে।দুটো পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে।রাতের আধারে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই যে সব করেছে তা সে জানে। মেশিন সব পুড়ে গেলেও মাল সব অক্ষত ছিল। প্রতিদিনের মালামাল সবার অগোচরে নূর কারখানা থেকে সরিয়ে ফেলতো। কয়েক কোটি টাকার মাল বেচে গেলেও মেশিন গুলো আর বাচাতে পারে নি।ক্ষতির পরিমান টা তাই একটু কম হয়েছে। তাই প্রতিটি কারখানায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে নূর।নিজেই সব মনিটরিং করছে। আশমিন বাধা দিলেও আমলে নেয়নি। বাড়িতে থাকা এখন তার জন্য আরো বেশি অনিরাপদ। কামিনী চৌধুরী কখন কিভাবে তার ক্ষতি করে ফেলবে তার নিশ্চয়তা নেই।

-- আসবো ম্যাম,,

নূর ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। অমি ক্লান্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

-- না। আসবে না। কতো বার ম্যাম বলতে নিষেধ করেছি?

অমি বোনের অভিমান দেখে মুচকি হাসলো। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,

-- আপনি সব সময় আমার ম্যাম হয়েই থাকবেন। আমি এতেই কমফোর্ট ফিল করি।

নূর মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো।

-- আচ্ছা সেসব বাদ দাও।কাজ হয়ে গেছে?

-- হুম।আশিয়ান এসেছিল। সব স্বিকার করেছে সে।

নূর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। শরীর টা ইদানীং খুব খারাপ যাচ্ছে। পা গুলো অসম্ভব ফুলে উঠেছে।রাতে ঘুম হয় না ভালো করে। আশমিন ও তার সাথে জেগে থাকে।তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। নূর কিছু নিয়ে আবদার করে না আশমিনের কাছে। যা দরকার হয় নিজেই করে নেয়। এর জন্য আশমিনের অভিযোগের শেষ নেই।

-- শরীর খারাপ লাগছে ম্যাম?

-- নূর মাথা নেড়ে সায় জানালো। অমি অস্থির হয়ে নূরের কাছে গেলো। পাশের কেবিন থেকে লুবানাও ছুটে এসেছে।নূরের কেবিন আর লুবানার কেবিনের মাঝে গ্লাসের দেয়াল থাকায় লুবানা স্পষ্ট সব দেখতে পায়।

নূর অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। লুবানা পানি এগিয়ে দিলো নূরের দিকে। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলেও নূরের অস্থিরতা কমছে না। অমি চিৎকার করে নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরলো। অস্থির গলায় লুবানা কে বললো,,

-- তারাতাড়ি ডাক্তার ডাকো লুবানা।

নূর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। অমি পাগলের মতো ডেকে চলেছে তাকে।

-- নূর,,কি হয়েছে বোন।চোখ খোল।কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বল। আল্লহ! নূর চোখ খুলছেনা কেন? (অস্থির হয়ে)

-- ডাক্তার চলে আসবে স্যার।আমি কল করে দিয়েছি।

লুবানা ভয়ে ঘেমে গিয়েছে।নূরের অবস্থা দেখে তার আত্মা কাপছে। আশমিন জানতে পারলে তাকে আর আস্তো রাখবে না।

-- নূর!!

আশমিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিস্তেজ নূরের দিকে। অমির কান্নারত চেহারা দেখে তার বুক কেপে উঠলো। দ্রুত পায়ে এসে নিজের বুকে আগলে নিলো নূরকে।

-- কি হয়েছে নূরের? ও কথা বলছে না কেন?

আশমিনের রক্তিম চোখ দেখে দুজনেই কেপে উঠলো। আশমিন দেড়ি না করে নূর কে কোলে তুলে পাশের রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ও যখন নূরের জ্ঞান ফিরলো না তখন শুরু হলো তার পাগলামি। ভয়ে তার বুক কাপছে। আশমিন জায়িন চৌধুরীর বুক কাপছে!

দুই মিনিটের মধ্যে ই ডাক্তার চলে এসেছে।আশমিন নূর কে এক মুহুর্তের জন্য ও ছাড়েনি। নূরের মাথা টা নিজের বুকের সাতগেই চেপে ধরে ছিল।ডাক্তার নূর কে চেকআপ করে বললো,

-- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারনে জ্ঞান হারিয়েছে। ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া ও করে না হয়তো। শরীর খুব দুর্বল। রক্ত শূন্যতা ও থাকতে পারে। এই সময় এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। টেনশন ফ্রী রাখার চেষ্টা করবেন সব সময়। এমন চলতে থাকলে দুজনের জন্যই খুব রিস্ক হয়ে যাবে।

ডাক্তার কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন। অমি দ্রুত পায়ে চলে গেলো ঔষধ আনতে।আশমিন চুপ করে বসে আছে। রাগে তার মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। লুবানার দিকে অগ্নি চোখে তাকাতেই লুবানা কান্না করে দিলো।

-- আমি খুব চেষ্টা করেছি স্যার।ম্যাম আমার কোন কথা ই শুনে না।আপনাকেও কিছু বলতে দেয় না।আমি কি করবো বলুন?

আশমিন কিছু বললো না। তার এখন কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ডাক্তার সেলাইন দিবে নূর কে।ডাক্তার কে নূর মঞ্জিলে আসতে বলে আশমিন নূর কে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। লুবানা আর ডাক্তার ও তার পিছনে ছুটলো।

-- ভাইয়া আপনি ঔষধ নিয়ে বাসায় চলে আসুন।আমরা ম্যাম কে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি।

অমি আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। টেনশন হচ্ছে তার।তারাতাড়ি বাসায় পৌছাতে হবে।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_২৯

শুভ্র পাঞ্জাবি ছেড়ে সাদা টি-শার্ট পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে আশমিন।চুল থেকে টপটপ করে পানি পরছে। শরীরের থেকে তার মনের ক্লান্তি বেশি।নূর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।আধঘন্টা আগে স্যালাইন শেষ হয়েছে।এতক্ষণ সে নূরের হাত ধরেই বসে ছিল। নূরের দিকে তাকালে তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মাথা ভালো করে মুছে টাওয়াল বেলকনিতে দিয়ে এলো আশমিন। নূরের দিকে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যতই দেখুক না কেন,চোখের তৃষ্ণা মেটে না।নূরের ফোলা পেটের দিকে তাকিয়ে হালকা ঢোক গিললো আশমিন।তাকে পুড়িয়ে ছাই করার অস্ত্র এই ছোট্ট পেটে লুকিয়ে আছে। এখনি সে নিজের করুণ পরিস্থিতি অনুভব করতে পারছে।মনে মনে চিৎকার করে উঠলো আশমিন।তার এতো পরিশ্রমের ফল নিয়ে নূর বাহাদুরি করবে ভাবতেই মুখটা শুকিয়ে গেলো। এক পুকুর কষ্ট নিয়ে নিজেকেই গালাগালি করতে লাগলো, কি দরকার ছিল এতো মেহনত করার? হলো তো এবার! বউ তোমার মেহনত দিয়েই তোমার থোতা মুখ ভোতা করে দিবে।খুশি?

আহ! কি দিন আসলো। এই দিন দেখার জন্য ই সে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশমিন ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নূরের দিকে। হালকা ঝুকে পেটে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,

-- মায়ের কথায় কান দেয়ার কোন দরকার নেই। তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ। ফুলের মতো পবিত্র। বাবার পক্ষে থাকবে সবসময়। তাহলে চকলেট আইসক্রিম পাবে। এটা আমাদের গোপন ডিল।কাউকে বলবে না। ইটস ভেরি কনফিডেনসিয়াল।

আরেকটা চুমু খেয়ে বিজয়ী হাসি হাসলো আশমিন। ডিল করা শেষ। বউ টা ঝামেলা না পাকালেই হয়। এবার ঝামেলা মিটে গেলেই সে তওবা করে ফেলবে।এই জীবনে ডায়েরি নামক কোন বস্তু সে হাতে নিবে না।এতো বছরের গভীর সম্পর্ক থাকার পরেও বউয়ের কাছে ধরা খাইয়ে দিল। মীরজাফর।

নূরের পাশেই শুয়ে পরলো আশমিন।শরীর মন দুটো ই খুব ক্লান্ত। নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া জরুরি হয়ে গেছে।

রাত দশটায় পিটপিট করে চোখ খুললো নূর।মাথা টা ভার হয়ে আছে। কারো শক্ত বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। কয়েক বার চোখের পাতা ঝাপটে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলো নূর। হালকা ডিম লাইটের আলোতে আশমিনের মুখ দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। নূরের নড়াচড়ায় আশমিনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নূর কে আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

-- মোচড়ামুচড়ি করছো কেন? আমি কি তোমাকে চিমটি দিয়েছি?

-- আমি এখানে এলাম কিভাবে(ভ্রু কুচকে)

-- তোমার একমাত্র বরের কোলে চেপে। তোমার বর টা যে কি রোমান্টিক না। আহা! ভাবতেই তো হিংসা হয়।

নূর আশমিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো।ইন্টারকম থেকে কল করে তাদের খাবার উপরে পাঠিয়ে দিতে বললো। এক কাপ কফি হলে ভালো হতো। মাথা টা ভার ভার লাগছে। বেড থেকে নেমে নিজের স্টাডি টেবিলের কাছে থাকা কফি মেকার থেকে কফি নিয়ে সোফায় বসতেই ওয়াশরুম থেকে নূর বেরিয়ে এলো। টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে আশমিনের দিকে আড় চোখে তাকালো। আশমিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নূর টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আশমিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে।

আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি। কালো মেঘের ফাকে ফাকে বিদ্যুতের ঝলক মাঝে মাঝে পরিবেশ কে আলোকিত করে তুলছে। আশমিনের বারান্দা টা নূরের বারান্দার মতো। বারান্দার পাশেই সুইমিংপুল। ছোট বেলায় বাবার সাথে এখানে কতো সাতার কেটেছে নূর।রাফসান শিকদার নিজে তাকে সাতার শিখিয়েছে। বাবার কথা মনে হতেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।

-- ভিতরে এসো নূর।খেতে হবে তোমার।মেডিসিন আছে।

রুম থেকে আশমিন ডাকছে। নূর নিজেকে সামলে ভিতরে গেলো। আশমিন টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে।

নূর মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে পরলো। ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,

-- এতো আদর করে খাবার খাওয়াচ্ছেন যে বড়।বিষ টিস মিশিয়ে দিন নি তো আবার?

আশমিনের হাত থেমে গেলো। শান্ত চোখে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর খাওয়া শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। আশমিনের বুক ভাড় হয়ে এলো। এতো অবিশ্বাস! হওয়ারই কথা। বিশ্বাস করার মতো কিছু করেনি সে।

-- আমার বাবা কে কেন মারলেন মন্ত্রী সাহেব?

আশমিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

-- দরকার ছিল।সে আমার বাবার খু*নি।আমি সহ্য করতে পারিনি নূর। তাকে মারতেই আমি বাংলাদেশ এসেছিলাম। রাজনীতি তে জরিয়ে যাওয়া আমার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। ঠিক ভুল বিচার করার অবস্থায় ছিলাম না নূর।বিশ্বাস করো আমাকে।

আশমিনের কাতর গলা শুনে হাসলো নূর। ঘাড় নেড়ে কয়েক বিশ্বাস শব্দটা কে আওরালো।

-- আপনি কি বিশ্বাসের যোগ্য মন্ত্রী সাহেব? আপনার পুরো পরিবার বিষাক্ত সাপের মতো। যত্ন করে বুকে আগলে রাখলেও বুকে কামড়ে দিতে এক বার ও ভাবে না। তা আমাকে কবে মারবেন? আমি ই তো এই পরিবারের শেষ সদস্য। একজনের মৃত্যুর বদলা কতোবার নিলেন মন্ত্রী সাহেব। আমার মা কে মারলেন।আমাকে অত্যাচার করলেন। ভালবাসার অভিনন্দন করলেন।আমার বাবা কে মারলেন। আচ্ছা আমি যদি প্রতিশোধ নিতে যাই তখন কি হবে মন্ত্রী সাহেব?

আশমিন অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো। আশমিন থম মেরে বসে আছে। সে তো এটা ও বলতে পারবে না যে রাগের বসে সে রাফসান শিকদার কে খু*ন করেছে।সে যা করেছে সব ঠান্ডা মাথায় করেছে। তবে নূর কে সে ভালবেসেই বিয়ে করেছে।সেখানে বিন্দুমাত্র অভিনয় ছিল না। আশমিন জানতো না কামিনী চৌধুরী নূরের মা কে খু*ন করেছে।নূরের উপর হওয়া অত্যাচার সম্পর্কে ও তার কোন ধারণা ছিল না।এসব কিছু সে নূর চলে যাওয়ার পরে জেনেছে। কিন্তু তখন আর তার হাতে কিছুই করার ছিল না।

নূর নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।আশমিন আগের মতোই খাবার সামনে বসে আছে। একবার ও খাবার মুখে দেয়নি সে। আশমিন ধীর পায়ে উঠে স্টাডি টেবিলের প্রয়াত থেকে নিজের গান বের করলো। এলোমেলো পায়ে এসে নূরের দিকে গান এগিয়ে ফিয়ে ধীর গলায় বলল,

-- তুমি ও তোমার বাবার খু*নি কে মেরে ফেলো নূর। নিজের প্রতিশোধ নিয়ে নাও।

নূর শব্দ করে হেসে ফেললো। আশমিনের হাত থেকে গান নিয়ে তার মুখোমুখি দাড়ালো।

-- মারবো কেন মন্ত্রী সাহেব? আমি তো আপনাকে বাচিয়ে রাখবো। বলেছিলাম না,আমাকে ধোকা দিলে আমি আপনাকে পৃথিবীতেই জাহান্নাম ঘুরিয়ে আনবো। আমি তো আপনাকে ভালবাসি বলেন। ভালবাসার মানুষ কে মে*রে ফেলা যায় বুঝি?

আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। যাক, এ যাত্রায় বেচে গেছে।তবে বাঘিনী যে মনে মনে কোন ভয়ংকর ছক কষছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দোষ না করেও সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিতে হচ্ছে । ম আর মাত্র কয়েকটা মাস।একবার নূরের মায়ের সঠিক ঠিকানা জানতে পারলে কামিনী চৌধুরী কে কবরে বসে বরের সাথে লুডু খেলার ব্যবস্থা করে দিবে। জ্বালিয়ে খেলো।

আশমিন নিজের জান হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই সব ঠিক করতে হবে। নূর কে এসবে জরানো যাবে না কোনভাবেই। কামিনী চৌধুরী কে বোঝাতে হবে সব কিছু তার প্ল্যান মতো ই হচ্ছে।

দরজার সামনে আশমিন কে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমজাদ চৌধুরী কপাল কুচকে ফেললো।

-- রুম থেকে বের করে দিয়েছে?(ভ্রু কুচকে)

-- আমি তোমার একটা বউ কে খু*ন করতে চাইছি।তাই আগে ভাগেই আরেকটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বউয়ের মতো আমার হাড় না জ্বালিয়ে বলে দাও মামুনি কে তোমার বউ কোথায় আটকে রেখেছে?

আমজাদ চৌধুরী আকাশ থেকে পরলো।অবাক গলায় বলল,

-- নূরের মা বেচে আছে?

-- একদম ঢঙ করবে না। সব জানো তুমি। ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে নূর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়েছে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বউয়ের কাছে অপরাধীর মতো দাড়াতে হচ্ছে। মেন্টাল স্ট্রেস নিতে নিতে যদি আমার বউয়ের কিছু হয় তাহলে তোমার বউ কে আমি ভয়ংকর মৃ*ত্যু দিবো। সে মা কেন মানুষ হওয়ার ও যোগ্য নয়।মেন্টালি সিক সে। মামা কে সে নিজের হাতে মেরেছে আব্বু। তার পরেও কেন এতো ষড়যন্ত্র? আমাদের কে একটু শান্তি তে বাচতে কেন দিচ্ছে না? তার পার্টনার কে সহ তাকে জ্যান্ত যদি না জ্বালিয়েছি আমার নাম ও আশমিন জায়িন চৌধুরী না।

আমজাদ চৌধুরীর মন টা কামিনী চৌধুরীর প্রতি বিষাক্ত অনুভূতি তে ভরে গেলো। কামিনী কি পারতো না সব ভুলে তাকে নিয়ে সুখের একটা সংসার সাজাতে। রাফসান শিকদার কে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। সব কিছু বিষিয়ে দিয়েছে সে।

গার্ড ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছে আশমিন।সেবার কানাডা গিয়ে তন্নতন্ন করে খুজেছে নূরের মা নাফিজা শিকদার কে। ফলাফল শূন্য। কামিনী চৌধুরীর উপর বাজ পাখির মতো নজর রেখেছে সে।আশিয়ান ডুবাই গিয়ে বসে আছে। এই বজ্জাত কে হাতে পেলে আস্তো রাখবেনা সে।সানভি বিরস মুখে বসে আছে আশমিনের পাশে।আশমিন কে বের হতে দেখে সে ও পিছু নিয়েছে।

-- শোন সান,বিয়ে করলেই হুট করে বাবা হওয়ার চিন্তা মাথায় আনবে না।এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত।সব সময় পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হয় না। কখনো কখনো বাশ ও হয়ে যায়। ইউ শুড ইউজড প্রোটেকশন। আমি বিয়ের আগেই তোমাকে দিয়ে দিবো। আচ্ছা বাদ দাও।তোমার বিয়ে ই করার দরকার নেই। বুঝেছো?

সানভি দুঃখী দুঃখী চেহারা করে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। এমনি চলতে থাকলে তার বিয়ে করার স্বাদ এমনিতেই মিটে যাবে।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩০

মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর স্ত্রী কে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আজ সকালে অফিসে আসার সময় তার গাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর স্ত্রী সনামধন্য সিঙ্গার তেহজিব নূর কে জোর করে কিছু লোক গাড়ি থেকে বের করে তাদের গাড়ি তে তুলে নিয়ে গেছে।তেহজিব নূরের সাথে তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট লুবানা জান্নাত ও ছিল।বাধা দেওয়ায় তাকে আঘাত করে আততায়ীরা।

সানভি অস্থির হয়ে পায়চারি করে সব জায়গায় কল করে যাচ্ছে। ভয়ে তার আত্মা লাফিয়ে বাইরে আসার অবস্থা। কয়েকদিন যাবত আশমিনের কাছে হুমকির কল আসছিলো। নারী পাচারকারীরা হুমকি দিচ্ছিলো তাকে আশমিন কে।আশমিন খুব শান্ত গলায় তাদের বলেছিল,

-- বাচ্চাদের এতো দুষ্টুমি করতে হয় না। আংকেল রাগলে কিন্তু কান মলা দিবো। ভালো বাচ্চারা এসব করে? কালকে গিয়ে শিশু ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাবে।বাচ্চা কাচ্চা হুমকি দিচ্ছে। দেশটা রসাতলে গেলো।

আশমিন ফোন কেটে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে।সানভি এখন বুঝতে পারছে তার স্যার মস্তো বড় ভুল করেছে।

সানভি অস্থির হয়ে আশমিনের দিকে তাকালো। সে এখন ফোনে এঞ্জেলো গেম খেলতে ব্যস্ত।দুই দিন আগে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে জেনেছে তার দুই টা রাজকুমারী হবে।উত্তেজনায় ডাক্তার কে জরিয়ে ধরেছিলো সে।হুস ফিরতেই তাকে ছেড়ে দিতে মিনমিন করে নূরের দিকে তাকাতেই দেখে নূর তার দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে। কারন ডাক্তার ছিল একজন ইয়াং মেয়ে। আশমিন নূরের ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে কাচুমাচু করে বললো,

-- স্লিপ অফ জরাজরি বউ।আমি তো তোমাকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম।মাঝখানে এ চলে এসেছে।আমার ছোট বোনের মতো। আজ থেকে এ তোমার ননদ। ননদের সাথে ভাব করো। আমি বাইরে আছি।

কথাগুলো বলেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল আশমিন।সেদিন থেকেই সে এঞ্জেলা খেলা শুরু করেছে। তাদের খাওয়া, গোসল, সাজগোছ সব শিখে ফেলছে।আশমিন একশ পার্সেন্ট শিউর নূর তাকে দিয়েই বাচ্চাদের ডায়পার চেঞ্জ করাবে।

সানভি করুন গলায় বলল,

-- স্যার,, পুলিশের আশায় বসে না থেকে আমরা নিজেরাই খুজলে ভালো হবে।এভাবে বসে থাকলে ওরা যদি ম্যামের কোন ক্ষতি করে ফেলে।

সানভির ভয়ার্ত গলা শুনে মুখ কুচকে ফেললো আশমিন। মনে হলো কেউ তাকে এক গ্লাস নিম পাতার রস খায়িয়ে দিয়েছে।

-- তুমি একপাক্ষিক কথা বলছো সান।তোমার ম্যামের জন্য চিন্তা না করে ওই অসহায় ভোলা ভালা সন্ত্রাসী গুলোর কথা চিন্তা করো।তার জন্যই আজকে তাদের প্রাণ যাবে।এমন চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে আমি ভোট পাবো? বউয়ের জন্য কতগুলো ভোট হারালাম। সন্ত্রাসীদের ও একটা করে এন আই ডি কার্ড আছে। তারা দেশের জনগণ। এমন করলে জনগণ আমাদের পাশে থাকবে?

সানভি চোয়াল ঝুলিয়ে না বোধক মাথা নাড়লো। আশমিন নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠে পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বললো,

-- চলো বউ খুজতে যাই। না জানি বেচারা সন্ত্রাসীরা কোন হালে আছে।(দুঃখী গলায়)

সানভি আহত চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। এই চাকরি ই একদিন তার প্রাণ নিবে।এতো অনাচার চোখে দেখা যায় না।

আশমিন কে বের হতে দেখে রিসিপশন থেকে ছুটে এলো লুবানা।মাথায় ব্যন্ডেজ করা হয়েছে। আশমিন কে অনুরোধ করে বললো,

-- আমাকে ও সাথে নিয়ে চলুন স্যার।এভাবে বসে থেকে চিন্তা করতে করতে আমি বোধহয় পঙ্গু হয়ে যাবো।

সানভির কপাল কুচকে গেলো। সে বিরক্ত গলায় বলল,

-- চিন্তা করতে করতে কেউ পঙ্গু হয় না সাবানা।ঝামেলা না করে চুপচাপ এখানে বসে থাকো।আমরা দরকারী কাজে যাচ্ছি। পিকনিকে যাচ্ছি না যে তোমাকে নিয়ে নাগরদোলায় চড়াবো।

লুবানা তেতে গেলো। তাকে আবারো সাবানা বলেছে এই লোক।তার কি সাবানার মতো সেলাই মেশিন আছে? নাকি সে সারাদিন কান্নাকাটি করে? আজব!

আশমিন এই ফাকে আরেক রাউন্ড এঞ্জেলা খেলায় মন দিলো। হাতে আরো কিছু সময় আছে।এই ফাকে গোসল করানো টা শিখে ফেলা যাবে।

-- জরুরি কাজে আপনাকে কি দরকার মি.সরকারি হাসপাতালের মর্গে সুয়ে থাকা অর্ধেক পচা লাশ।মুখ বন্ধ রাখুন।নইলে আপনার কংকাল মেডিক্যাল এ দান করে দিবো। তখন ঝুলে থাইকেন আজীবন।

ওদের তর্কের মাঝেই মেসেজ পেয়ে বেরিয়ে গেছে আশমিন। তার লোকের নূর কে ট্রেস করে ফেলেছে। পুরো জায়গা ঘেরাও করে আশমিনের জন্য অপেক্ষা করছে।

সানভি ও ছুটছে আশমিনের পিছনে। হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠতেই লুবানা ও তার সাথে এসে উঠলো। সানভি কিছু বলবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-- একদম জ্ঞান দিতে আসবেন না।ম্যাম কি হালে আছে কে জানে।আমি গেলে তাকে সামলে নিতে পারবো।চুপচাপ গাড়ি চালান।

আশমিন কড়া চোখে তাকাতেই সানভি গাড়ি স্টার্ট দিলো।তাদের গন্তব্য এখান থেকে দুই ঘন্টার পথ।অমি ওখানেই আছে।

এতক্ষণ নির্লিপ্ত থাকা আশমিনের কপালে ঘাম দেখে অবাক হলো লুবানা।তবে আশমিনের চেহারা শান্ত।চোখে ও কোন অস্থিরতার ছাপ নেই। হাত শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে। সমান সর্বচ্চো স্পিডে গাড়ী চালাচ্ছে।

এতো এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে হিমালয়ের গুহায় গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়।নেহাৎ ই তার টনসিল ফুলে যায় বলে যেতে পারছে না। আজকের ঝামেলা শেষ হলেই সে কুকুর খুজতে বের হবে। কোন পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে এই চাকরি তে এসেছিল তাকে খুজে বের করা দরকার। তার কাছে জবাব চাইতে হবে, সে তার কি ক্ষতি করেছিলো? এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়ার দরকার।

সানভির ভাবনায় ছেদ পরল আশমিনের ডাকে।

-- এখানেই গাড়ি থামাও সান।

গাড়ি থামতেই আশমিন নেমে গেলো। পাঞ্জাবি খুলে একটা সাদা শার্ট পরে তার জন্য রাখা বাইক নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেলো। সানভি আর লুবানা হা করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এতো এতো ঝগড়া বৃথা করে আশমিন তাদের না নিয়েই চলে গেছে। সানভির চোখ ফেটে কান্না এলো। আশমিন তাকে ছাড়া চলে গেছে ভাবতেই বউ মরে যাওয়ার ফিলিং হলো।

-- দেখলে সাবানা!স্যার আমাকে না নিয়েই চলে গেলো। এখন আমি কি করবো?

-- আসেন গলাগলি ধরে কাদি।(বিরক্ত হয়ে)

সানভি নিজেকে সামলে নিলো। এই মেয়ের সামনে কেদে ভাসালে তার আর ইজ্জত থাকবে না। এই মেয়ে তার ইজ্জত লুটে নিবে।

আধঘন্টার মধ্যেই আশমিন তার গন্তব্যে পৌঁছে গেলো।একটা ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়ি। কপাল কুচকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পুরোটা। আশমিন কে দেখে অমি দৌড়ে এলো তার কাছে।

আশমিন বিরক্ত গলায় বলল,

-- ভিতরে কয়জন আছে?

-- বিশ জন আছে স্যার।

-- আমার বউয়ের কি অবস্থা?

-- চেয়ারে বেধে রেখেছে (ভয়ে ভয়ে)

-- তাই! ভিতরে গিয়ে সব কটা কে বেধে ফেলো তো অমি।আমার প্রেম পাচ্ছে। বউয়ের সাথে কিছুক্ষণ সুখ দুঃখের গল্প করবো।কেউ যাতে ডিস্টার্ব না করে।

অমি বিরস মুখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। মনে মনে তার ছেড়া বলতেও ভুললো না।

অমিরা ভিতরে ঢোকার কয়েক মুহুর্ত পরেই গোলা*গু*লি শুরু হলো। আশমিন শান্ত চোখে একবার তাকিয়ে নিজের গা*ন বের করে এগিয়ে গেলো। তাকে কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না!

সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে তাদের উপর। আটঘাট বেধেই নেমেছে তারা। আশমিনের কয়েকজন লোক খুব বাজে ভাবে আহত হয়েছে। বাহাদুরের বা হাতে গু*লি লেগেছে। তবুও সে থেমে নেই। অমি সব জায়গায় নূর কে খুজে যাচ্ছে। নূর কে না দেখে তার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছে।বোনের চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। আশমিন কয়েক পলক গো*লা*গু*লি দেখে অলস হাই তুললো। হাই তুলতে তুলতেই কয়েকজনের মাথায় শুট করে দিয়েছে সে। ব*ন্দুক পকেটে রেখে আয়েশ করে বসলো সে। তার লোকেরা পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। অমি এসে ভয়ার্ত গলায় বলল,

-- ম্যাম কে কোথাও পাচ্ছি না স্যার।

আশমিন চোখ তুলে তাকালো অমির দিকে। রক্তিম চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলো চেয়ারের উপর। চোখ বন্ধ করেই হুংকার দিয়ে বললো,

-- আমার বউ কোথায়?

আশমিনের হুংকারে সন্ত্রাসীদের সাথে সাথে অমি আর তার লোকেরা ও কেপে উঠলো। আশমিনের রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে সবার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। একজন কাপা কাপা হাতে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে একটা বস্তা দেখিয়ে দিলো।অমি এক মিনিট হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে গিয়ে বস্তা থেকে নূর কে বের করলো। তার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে।নূরের কপাল থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে রক্ত পরছে।অমির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। নূর কে বুকের সাথে আগলে ধরে বোবার মতো তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। আশমিন সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। হিংস্র বাঘের মতো সবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,

-- ওকে কে আঘাত করেছে? নাম বল।নাহলে সব কয়টা কে আজ কিমা বানিয়ে ফেলবো।হাড় ও খুজে পাবে না কেউ।

সবাই ভয়ে কাপতে লাগলো। আশমিনের হিংস্র রুপ দেখে বাহাদুর নিজেও কাপছে।

সবাই তাদের লিডার কে দেখিয়ে দিলো।আশমিন সাথে সাথে নির্মম ভাবে মারতে লাগলো তাকে।একটা একটা করে সব গুলো হাড় ভেঙে আবার গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পরলো। লোকটা নড়াচড়া করছে না। আশমিন বজ্র কন্ঠে বললো,

-- এখনই মরবি না।আমার মারা শেষ হয় নি।আম টেকিং রেস্ট।মরে গেলে হাড়গোড় একটা ও আস্তো রাখবো না।

বাকি সন্ত্রাসীদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,

-- ওরে জাগা।নাইলে তোদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ করে দিবো।আমার বউ রে বস্তায় ভরা! ভাবলাম বউরে এসে বাধা দেখবো।সেই সুযোগে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে ফেলবো। অথচ তোরা আমার বউয়ের কপাল ফাটিয়ে বস্তায় ভরে রাখিস।

বাহাদুরররর,,ডাক্তার কই।আমার বউরে তারাতাড়ি চেকআপ করতে বল।বউয়ের যদি কিছু হয়, তোদের সবাইকে কবরে পাঠিয়ে দিবো।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩১

হাসপাতালে গম্ভীর মুখে বসে আছে আশমিন। নূর কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে দুই ঘন্টা হতে চললো। আশমিন তখন থেকেই থম ধরে বসে আছে। আট মাসেই সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। নূরের কন্ডিশন ভালো ছিল না। একজন হলে সমস্যা হতো না। টুইনস বেবি হওয়ায় সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। বাচ্চা উল্টে গেছে।নূর কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।তখন পেটে আঘাত লাগায় রক্তপাত শুরু হয়।নূর কিডন্যাপ হওয়ার দুই ঘন্টা পরে আশমিন নূরের কাছে পৌঁছেছে।বেবিদের কোন ক্ষতি হয়নি।ব্লিডিং বন্ধ না হওয়ায় এখনি সিজার করতে হচ্ছে। নূরের শরীরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো না।আশমিন অমি দের সাথেই একজন ডক্টর পাঠিয়ে ছিল।সে চেকআপ করে নূরের কন্ডিশন বলতেই আশমিন সাথে সাথে নূর কে হসপিটাল নিয়ে এসেছে।

অমি অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আশমিন কে এতো শান্ত দেখে অবাকের সাথে সাথে মেজাজ ও খারাপ হচ্ছে। নূর কে নিয়ে আশমিনের কোন মাথা ব্যথা ই নেই!সানভি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।নূরের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে। লুবানা পাশে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে কেদে যাচ্ছে। সানভি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেললো। এই মেয়েকে দেখে তার মাথা ব্যথা হচ্ছে।

আশমিনের ফোন বাজতেই কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেলো। আশমিন ফোন রিসিভ করে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো।

-- বলো বাহাদুর।

-- নাফিজা ম্যামের খবর পেয়েছি ম্যাম।

-- আচ্ছা। এড্রেস পাঠিয়ে দাও।

-- এদের কি করবো স্যার?(আমতা আমতা করে)

-- মে*রে দাও।এতো গুলো পি*স করো যে বোঝা না যায় এরা মানুষ ছিল।

আশমিনের শান্ত গলায় এমন ভয়ংকর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো বাহাদুর। সে জানে আশমিন কতটা ভয়ংকর। মনে মনে একটু আফসোস হলো এদের জন্য।

-- মা*রার আগে মেয়ে গুলোর খোজ নিয়ে নিবে। এদের হদিশ যেন কাক পক্ষি ও টের না পায়।

বাহাদুর সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিল। আশমিন গিয়ে আবার আগের যায়গায় বসে পরলো। অপারেশন থিয়েটারের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলো। সানভি আশমিনের বসার জন্য ভিআইপি ক্যাবিন নিলেও আশমিন সেখানে যায় নি।তার ভিতরের অস্থিরতা সে কাউকে দেখাতে পারছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।হুট করেই বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেলো আশমিন। অপারেশ থিয়েটারের দরজায় নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো। অমি এসে আগলে ধরলো আশমিন কে। আশমিনের সারা শরীর কাপছে।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলে ও এখন আর তার সহ্য হচ্ছে না। নূর কি অবস্থায় আছে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই তার।বুকের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বুকের যন্ত্রণায় তার শ্বাস আটকে আসছে। আশমিন কে অমি ধরে রাখতে পারছে না।আশমিনের শক্তির সাথে তার মতো দুইটা অমিও কিছু না। সানভি ভয়ে সামনে যাচ্ছে না। লুবানা শব্দ করে কাদছে।

-- দরজা খোল,,আমি ভিতরে যাবো।

আশমিনের হুংকার শুনে একজন নার্স দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা কে এভাবে ভয়ংকর রুপে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো তার।আশমিন নার্স কে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। নূর কে অপারেশন টেবিলে দেখে তার অশান্ত চোখ গুলো আপনা আপনি শান্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার অপারেশন বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন ইশারায় তার কাজ করতে বলে নূরের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের ফ্যাকাসে মুখের দিকে। অক্সিজেন মাক্স লাগানো নূর কে দেখে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশমিন। বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। বুকে কয়েক বার হাত বুলিয়ে অসহায় চোখে চারিদিকে চোখ বুলালো। সে অসুস্থ হতে চায় না এখন। নূরের পাসে থাকতে চায়।কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। বউয়ের সিজার দেখে সে বুক ব্যথায় মরে যাচ্ছে। এমন দুর্বল মন্ত্রী দিয়ে দেশ চলবে!কি লজ্জাজনক ব্যপার।

বাচ্চার হালকা কান্নার আওয়াজে ধ্যান ফিরলো আশমিনের।বুকের ব্যথা ভুলে সেদিকে তাকিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেলো। দুজন নার্সের কোলে দুটো রাজকন্যা। রক্তে মাখামাখি তাদের ছোট্ট শরীর পরিস্কার করে তার কাছে নিয়ে এলো বাচ্চাদের।আশমিন শুধু এক পলক দেখার সুযোগ পাবে।তার পর তাদের এনআইসিউ তে নিয়ে যাবে।ওখানেই পনের দিন রাখার পরে তাদের মায়ের কাছে দেয়া হবে। আশমিন একপলক দেখে বাচ্চাদের নিজের কোলে নিলো।নার্স কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আশমিন কে কিছু বলার ক্ষমতা নেই তাদের।একজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার করতে বললো মিনমিন করে। আশমিন বাচ্চাদের দিয়ে নিজের হাত স্যানিটেশন করে আবার তাদের কোলে নিলো।দুজনের কানের কাছে আজান দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে তাদের আবার নার্সদের কোলে দিয়ে দিলো।

-- অপারেশন হয়ে গেছে স্যার।ম্যাম কে কিছুক্ষণ পরে কেবিনে সিফট করা হবে। আপনি যদি একটু,,

শেষের কথা টা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েও থেমে গেলো ডাক্তার।আশমিন আর কিছু বললো না। নূরের কপালে চুমু খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। বুকের ব্যথা টা এখন কমেছে।প্রিন্সেসদের কোলে নিয়ে অর্ধেক কমে গেছে। বউকে বুকে নিলে পুরোটা চলে যাবে নিশ্চিত। অমি সানভি আর লুবানা বাচ্চাদের দেখে এসেছে একপলক। উত্তেজনায় কখন সানভির হাত জরিয়ে ধরেছে নিজেও টের পায়নি। সানভি লুবানার বাচ্চামো দেখে হালকা হাসলো। রাগ করার ভান করে বললো,

-- এই হাত ছাড়ো সাবানা।তোমাকে বিশ্বাস নেই।এখন হাত ধরছো একটু পরে গলা ধরতে আসবে। আমি কোন দুই ইঞ্চি লিলিপুট কে আমার গলা জরিয়ে ধরতে দিবো না। নারী কেলেংকারী হলেও মেনে নেয়া যাবে। কিন্তু বাচ্চা কেলেংকারি হলে আমি মুখ দেখাতে পারবো না।আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে ছেড়ে দাও।

লুবানা ঝামটা দিয়ে সানভির হাত ছেড়ে দিলো। কটমট করতে করতে বললো,

-- এমন একটা ভাব করছেন জেন আমি আপনার ইজ্জত লুটে নিচ্ছি। ফালতু যত্তসব। আর আমার নাম লুবানা। আরেকদিন সাবানা বললে আপনাকে সাবান দিয়ে মুচড়ে মুচড়ে ধুয়ে দিবো আমি। ল্যাব পিপলস।

লুবানা গটগট করে চলে গেলো। সানভি বিরস মুখে তাকিয়ে দেখলো তার চলে যাওয়া। অমি কপাল চাপড়ে বললো,

-- সমস্যা কি তোমাদের।সতিনের মতো সারাদিন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকো কেন?আর এই ল্যাব পিপলস মানে কি?(অবাক হয়ে)

-- আমার কংকাল ল্যাবে দান করা হয়েছে।তাই আমি ল্যাব পিপলস। (শ্বাস ছেড়ে)

-- মানে??

-- লম্বা কাহিনি। বাদ দাও।

-- হুম।

আমজাদ চৌধুরী হসপিটালে এসেছে পাচ মিনিট হলো। আশমিন হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। সারাদিনের চিন্তা ক্লান্তি চিন্তায় শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে।আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলো ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে।বাড়ি তে নাচতে থাকা বিপদের কথা কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।কামিনী চৌধুরীর উপর বিতিষ্ণা চলে এসেছে। তবুও সে ঘৃণা করতে পারে না তাকে।একেই বুঝি ভালবাসা বলে।

-- বউ ছেড়ে আসতে মন চাইলো?তুমি তো দিন দিন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছো।পুরুষ মানুষের এমন বউ পাগল হলে চলে!

আশমিনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কে এই কথা বলছে! যে নিজেই সারাদিন বউয়ের আগে পিছে ঘুরঘুর করে।

-- ক্লান্ত লাগছে আব্বু।

আমজাদ চৌধুরীর মায়া হলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-- নূরের কি অবস্থা?

-- ভালো।

-- আমার নাতনি রা কেমন আছে?

-- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আব্বু।এই এটুকু হয়েছে(হাত দিয়ে ইশারা করে) আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েরা কিনা ইদুরের বাচ্চার সাইজ নিয়ে দুনিয়ায় এলো! ওদের কান্না ও ঠিক ভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না।চোখ খুলে আমাকে দেখেনি ওরা।আমার নূরের কতো কষ্ট হয়েছে! সব কয়টা কে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।কার কলিজায় হাত দিয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।(দাতে দাত চেপে)

-- ওদের তুমি এখনো বাচিয়ে রেখেছো এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো?(ভ্রু কুচকে)

-- ওরা তো চুনোপুঁটি আব্বু।রাঘববোয়ালদের ধরা এখনো বাকি।সব কয়টা কে ইঞ্চি দিয়ে মেপে মেপে সাইজ করবো।

-- আচ্ছা বাদ দাও। ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।একটু রেস্ট নাও।

-- দুই দুইটা মেয়ে পৃথিবীতে আনা চারটি খানি কথা! তুমি কি বুঝবা।নিজে দুই বাচ্চার বাপ হয়েও ভার্জিন বাপ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। তুমি আমার মান সম্মান ধূলিসাৎ করে দিলে। এ জীবন দিয়ে কি হবে আমার।শুধু বউ টার জন্য বেচে আছি।না হলে মসজিদের দান বক্সে দান করে দিতাম।

আমজাদ চৌধুরী হনহন করে বেরিয়ে গেল। এই ছেলের জন্য মায়া দেখানো তার জীবনের চরম ভুল।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩২

নূরের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই নূর অস্থির হয়ে আছে বাচ্চাদের জন্য। আশমিন বুঝিয়ে ও রাখতে পারছে না। অপারেশনের পর নূরের বেশি নড়াচড়া করা নিষেধ। সে মেয়ে এখন চিংড়ি মাছের মতো তিরিং বিরিং করছে।প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো আশমিনের।জোড়ে ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। মুখে হালকা হাসি টেনে দাতে দাত চেপে বললো,

-- চুপচাপ শুয়ে থাকো বউ।আমার মেজাজ খারাপ হলে খুব খারাপ হবে।মেয়েদের জন্য এতো উতলা হয়ো না।বছর বছর এই অনুভূতি পাওয়ার সুযোগ পাবে তো তুমি।তোমার বরের মন অনেক বড়। সে তোমাকে টুইনস বেবির মা বানাবে।এবার চুপ করে ঘুমাও সোনা।একটু সুস্থ হলে পরিদের কাছে নিয়ে যাবো। এখন আমাকে একটা চুমু খাও।আমি চুমু শূন্যতায় ভুগছি।

নূর ব্যথা অস্থিরতা বাদ দিয়ে আশমিনের দিকে কটমট করে তাকালো। কোমরের নিচের অংশ এখনো অবস হয়ে আছে। সুস্থ হলে সবার আগে এই লোক কে পিটিয়ে হাতের সুখ করে নিবে।অসহ্য মানুষ একটা।

নূরের খেয়ে ফেলা লুক দেখে আশমিন এদিক ওদিক তাকিতুকি করলো।গলা ঝেড়ে দুঃখী গলায় বলল,

-- এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি কতো টেনশনে ছিলাম জানো? এই বারান্দায় কতো বার চক্কর লাগিয়েছি ধারণা আছে? তোমার জন্য আমার ব্যক্তিগত বুকে পোষা মীরজাফর কলিজা লাফিয়ে বাইরে চলে আসছিল প্রায়!কতো কষ্টে চেপে চুপে আটকে রেখেছি হিসেব আছে! আর এখন তুমি আমাকে চোখ দেখাচ্ছো! মানবতা আজ কোথায়? আজকেই মানবাধিকার কমিশনে একটা লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে। আমি গাল এগিয়ে দিচ্ছি চুপচাপ চুমু খাও।নাহলে আমি জোর করে ও নিতে পারি।

নূর চোখ বুজে রইলো। কথা বলার ইচ্ছা আগ্রহ কোনটাই নেই।এই লোকের রেললাইনের মতো মুখ লাগাম ছাড়া চলতেই থাকে।

নূর কে চোখ বন্ধ করতে দেখে বিজয়ের হাসি হাসলো আশমিন। যাক, আপাতত শান্ত করা গেছে।এটা কে বলে প্রতিভা। বউ কে চুপ করানো তার কাছ থেকে শিখা উচিত। সময় থাকলে একটা কোচিং সেন্টার খোলা যেতো। আহা!কতো অসহায় স্বামীদের উপকার হতো। এটা ও একপ্রকার জনসেবা।

সানভি আশমিন কে ম্যাসেজ করলো বাইরে আসার জন্য। আশমিন আজ দুই দিন কিছুই মুখে দেয়নি।তার উপর তার বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দিয়েছে।কিন্তু আশমিন নূরের কেবিনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। অমি কাল সারাক্ষণ এখানে ছিল।সকালে লুবানা কে নিয়ে বাসায় গিয়েছে। একেবারে অফিস করে বিকেলে আসবে।আগামী কয়েকদিনের দলীয় সমস্ত মিটিং ক্যানসেল করেছে আশমিন।অফিস আমজাদ চৌধুরী সামলে নিবেন।

সানভির মেসেজ পেয়ে বেরিয়ে এলো আশমিন। চোখে মুখে ক্লান্তি চেপে ধরেছে।সানভি নিজেও ক্লান্ত।

-- আপনার পোশাক নিয়ে এসেছি স্যার।ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন। খাবার রেডি আছে।একবার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।আর না করবেন না স্যার প্লিজ।

সানভির করুন গলা শুনে মলিন হাসলো আশমিন। উদাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলল,

-- মানুষ চোখের ভালবাসা কেন অনুভব করে না সান?চোখ তো মনের আয়না। ভালবাসার মানুষ টা আমার চোখে থাকা ভালবাসা, অভিমান, কষ্ট অনুভব করতে পারে না এই পরাজয় আমি কিভাবে মেনে নেই সান? সে আমাকে কষ্ট দেক।আঘাত করুক।আমি মেনে নিবো।কিন্তু সে আমার চোখের ভাষা বোঝে না এটা আমি কিভাবে সহ্য করি বলো তো? আমার মনে রাজ করা মানুষ টার ভালবাসায় এতো ক্ষাদ আমার সহ্য হচ্ছে না। ছোট বেলা থেকেই আমি শুধু অবহেলা পেয়ে গেলাম বুঝলে? আপনজনদের অবহেলা নিতে নিতে আমি ক্লান্ত।তুমি কোন ব্যথা সারাবে সান? এই বুকে সারাক্ষণ আমার প্রিয় মানুষ গুলো আঘাত করে চলেছে। ক্ষত সারাতে মলম দিতে হয়।পুনোরায় একই জায়গায় আঘাত করলে কি ক্ষত সারবে? এসব বাদ দাও। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো।

আশমিন আবার নূরের কেবিনে চলে গেলো। সানভি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আশমিনের কষ্ট সে বোঝে।এতো বছর ছায়ার মতো লেগে আছে তার পিছনে। আশমিনের প্রতিটি নির্ঘুম রাতের সাক্ষী সে।কি গভীর যন্ত্রণায় মাঝ রাতে বারান্দায় ডুকরে কেদে উঠতো আশমিন। এমন শক্ত পোক্ত গম্ভীর মানুষ টা কে রাতের আধারে কাদতে দেখে নিজের চোখ ও ভিজে উঠতো সানভির।নূরের প্রতিটি কথা আশমিন কে গভীর ভাবে আঘাত করে। আশমিন হাসি মুখে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করলেও সানভি বোঝে তার স্যার হাসি মুখে আঘাতের বি*ষ পান করছে। মাঝে মাঝে সানভির খুব আফসোস হয় নূরের জন্য। এমন একটা ভালবাসার মানুষ পেয়ে ও সে অবহেলা করছে।যদি কখনো হারিয়ে যায় কেদেও কুল পাবে না।

পনের দিন পরে আজ নিজের মেয়েদের কাছে পেয়েছে নূর।সে নিজেও পুরো পুরি সুস্থ না।তাই এখনো হসপিটালে আছে।আমজাদ চৌধুরী প্রতিদিন এসে নাতনিদের দেখে যান।কামিনী চৌধুরী একবার ও আসেনি।মায়া বেগম কয়েকবার এসেছে।আশমিন কড়া গলায় তাকে বাসায় থাকতে বলেছে।তার একমাত্র কাজ হচ্ছে কামিনী চৌধুরীর উপর নজর রাখা। আর কোন ছাড় দেয়া হবে না কামিনী চৌধুরী কে।

বাচ্চাদের নিজের কোলে নিয়ে কেদে ফেললো নূর।আশমিন চোখ ভরে দেখছে তার রাজকুমারীদের। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের মুহুর্ত বুঝি এটাই।একজন নার্স এসে নূর কে ফিডিং করাতে বললে নূর উসখুস করতে লাগলো। আড় চোখে আশমিনের কয়েকবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স আবার তারা দিতেই নূর আমতা আমতা করে বললো,

-- ওনাকে বাইরে যেতে বলুন।

আশমিন যেন এই কথার অপেক্ষায় ই ছিল।সাথে সাথে গম্ভীর গলায় নার্স কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-- আউট।

নার্স কোন দিরুক্তি না করেই বেরিয়ে গেল। নূর হতভম্ব গলায় বলল,

-- আরে আমি আপনাকে বলেছি।

-- আমি থাকতে তাকে কেন লাগবে? আমি হেল্প করছি। আমাদের মধ্যে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই।এই মুহুর্ত গুলো খুব অমূল্য নূর। তোমার এই সুখের কষ্টে আমি তোমার সহযোদ্ধা।তোমার জন্য আমি ই যথেষ্ট।

কথা বলতে বলতেই নূর কে হেল্প করে মাথার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো আশমিন।

-- বসতে কষ্ট হচ্ছে?

নূর মাথা নাড়িয়ে না বললো। আশমিনের চোখের দিকে তাকালে তার বিশ্বাস হয়না সে তার বাবাকে খু*ন করেছে।তবে আশমিনের খাপছাড়া ভাব আর স্বিকারউক্তি তার ভাবনা গুলুকে বারবার এলোমেলো করে দেয়। এই দোটানায় সে নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশমিন যদি সত্যি তার বাবাকে খু*ন করে থাকে তাহলে তাকে মরণ যন্ত্রণা দিবে সে। একবার সঠিক তথ্য তার হাতে আসুক। একটা ডায়েরির উপর ভিত্তি করে কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না। আর রইলো আশমিনের স্বিকার উক্তি,আশমিনের মতো বদ লোকের কোন কথা ধরা মানে নিজের মাথা দেয়ালে মারা।আস্তো ইতর একটা।

-- আমার ডাক্তার হওয়া উচিত ছিল বউ।ওই ডাক্তার আমার বউয়ের পেট কেটে দুই ভাগ করে ফেললো আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম! ডাক্তার হলে কি এই দিন দেখতে হতো বলো? বউ ও আমার বউয়ের পেট ও আমার।আর কাটলো কি না ডাক্তার! শুধু আমার রাজকন্যা গুলোর জন্য কিছু বললাম না। নাহলে আমিও ওই ডাক্তারের পেট কেটে দিতাম। মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর বউয়ের পেট কেটে ফেলে! কি সাহস ভাবা যায়?

নূর ক্লান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। লোকটা আবার বাজে কথা বলা শুরু করেছে।কাছের মানুষের কাছে আশমিনের এই অসহ্য কথা গুলো বের হয়।বাইরের মানুষের কাছে আশমিন মানেই একজন গম্ভীর রাগী নেতা।নূর কিছু না বলে চুপ করে থাকল।বাচ্চাদের খাওয়ানো হলে তাদের নিয়ে দোলনায় শুয়িয়ে দিলো আশমিন। তার লোক কল করছে তাকে।নূরের সারপ্রাইজ আনতে যাবে সে। ফোনে চোখ বুলিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো আশমিন। নূর তার এই নির্জিব হাসি ও যে কেড়ে নিবে তা হয়তো তার ধারণা তে ও ছিল না।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩৩

কামিনী চৌধুরী আজ সবার চোখের আড়ালে হসপিটাল এসেছে। বাচ্চারা এতো দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিল তাই সে আসে নি। কানাডার এক পরিবারের সাথে কথা হয়েছে তার।দুটো বাচ্চা ই তারা নিবে। সে তো মেরেই ফেলতে চেয়েছিলো। বাচিয়ে রেখে যদি কিছু টাকা ইনকাম হয় তাহলে ক্ষতি কি। নূর কে সে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিবে না। তার সব কিছু এই মেয়ে কেড়ে নিয়েছে। এতো সহজে ছেড়ে দেয়ার মানুষ সে না।সারাজীবন সন্তানের শোকে কপাল চাপড়ে মরবি এবার।নিজ মনে বিরবির করে নিজের পরিচিত নার্সের কাছে গেলো কামিনী চৌধুরী।

-- আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।বাচ্চাগুলো কে নিয়ে এসো।

-- স্যার জানলে আমাকে মে*রে ফেলবে ম্যাম। আপনি অন্য কাউকে বলুন।

নার্সের করুন গলা শুনে ক্ষেপে উঠলো কামিনী চৌধুরী। ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো হুংকার দিয়ে বললো,

-- আমার কথা মতো কাজ না করলে আমি তোমার পুরো পরিবার কে মে*রে ফেলবো। এখন কথা না বারিয়ে যাও।টাকা তোমার একাউন্টে পৌঁছে যাবে।কাজ শেষ হলে কয়েকদিন অন্য কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দিবে।

মধ্য বয়স্ক নার্স টি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললো,

-- কোথায় গা ঢাকা দিবো? কবরে চলে গেলেও স্যার আমাকে মাটি খুড়ে খুজে বের করে আনবে।

কামিনী চৌধুরী বিরক্ত হলো। কর্কশ গলায় বলল,

-- ঠিক আছে।আমি তোমার স্বামী আর বাচ্চাদের কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

-- না না ম্যাম।প্লিজ এমন করবেন না। আমি এখনি যাচ্ছি।

কামিনী চৌধুরী বাকা হেসে নিজের গাড়ি তে গিয়ে বসলো। আশিয়ান কে এ ব্যপারে কিছুই বলে নি।আশিয়ান কে যতই নিজের মতো করে বড় করুক না কেন।তার শরীরে রাফসান শিকদারের ই রক্ত বইছে।সে কখনো ই এমন কিছু করতে দিবে না কামিনী চৌধুরী কে। তাই যা করার তাকেই করতে হবে।

আশমিন বেরিয়ে যেতেই নূর অমি কে করলো।

-- চলে এসো অমি।আমি আজ ই এখান থেকে যেতে চাই।

-- আরেক বার ভাবুন ম্যাম।স্যার জানলে আস্তো রাখবে না।

-- এটাই আমার শেষ কথা। যা বলেছি তাই করো।

অমি আর কিছু বললো না। চুপ থেকে সম্মতি জানালো। সে কোন ভাবেই বিশ্বাস করে না আশমিন রাফসান শিকদার কে খু*ন করতে পারে। রাফসান শিকদার আশমিন কে অনেক স্নেহ করতেন। আশমিন নিজেও রাফসান শিকদারের প্রতিটি কথা মেনে চলতো। অমি নিজের চোখে আশমিন কে ভেঙে পরতে দেখেছে রাফসান শিকদারের মৃত্যুর পরে। আর কিছু না ভেবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো অমি।

নূর ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।অমি এলেই তারা বেরিয়ে যাবে। নিজের বাবার খু*নির সাথে আর নয়।যতদিন আশমিন নির্দোষ প্রমাণ না হচ্ছে ততদেন সে বাচ্চাদের নিয়ে দূরে থাকবে।

নূর ওয়াশরুমে ঢুকতেই নার্স এসে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। কেবিনের সামনের গার্ড গুলো তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। নার্সের কোলে বাচ্চাদের দেখে তাকে আটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-- কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

এমন রাশভারী গলা শুনে কেপে উঠলো নার্স।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-- ডক্টরের কাছে চেকআপ করাতে নিয়ে যাচ্ছি।

গার্ড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো নার্স কে।একে প্রথমদিন থেকেই দেখেছে এখানে।তাই আর কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে যেতে বললো।

নার্স যেন হাফ ছেড়ে বাচলো।তড়িঘড়ি করে চলে এলো সেখান থেকে। লিফটে ঢুকে সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে পার্কিং-এ এসে কামিনী চৌধুরীর কাছে বাচ্চাদের দিয়ে দিলো।কামিনী চৌধুরী নাক সিটকে বললো,

-- আমার কাছে দিচ্ছো কেন? পিছনের ঝুড়ি তে রাখো।

নার্স টি অবাক হয়ে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। একটা কাপড়ের ঝুড়ি তে বাচ্চাদের রাখতে বলছে!

তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খ্যাঁক করে উঠলো কামিনী চৌধুরী। রাগী গলায় বলল,

-- সঙ সেজে দাড়িয়ে আছো কেন? যা বলেছি তা করো।যত্তসব।

নার্স টি আর কিছু না বলে বাচ্চাদের বাস্কেটে রেখে একবার করুন চোখে তাকিয়ে বললো,

-- আমার কোন টাকা লাগবে না ম্যাম।আমার স্বামি সন্তানদের ছেড়ে দিন। আমি তাদের নিয়ে খুব দূরে চলে যাবো।

-- ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি তাদের ছেড়ে দিয়েছি।এখন এখান থেকে সরে পরো।তোমাকে যেন আর এই শহরে না দেখি।

বাচ্চারা কেদে উঠতেই কামিনী চৌধুরী বিরক্ত চোখে তাকালো। নার্স কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।

গাড়ি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যেতেই নার্স দ্রুত পায়ে ছুটলো হসপিটালের দিকে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দোলনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো নূর।দ্রুত গতিতে সেদিকে গিয়ে বাবুদের না দেখে বুক কেপে উঠলো তার। চিৎকার করে গার্ডদের ডেকে বললো,

-- বাহাদুর,,, আমার বাবু রা কোথায়?

গার্ড গুলো সাথে সাথে কেবিনে প্রবেশ করে নূর কে কাদতে দেখে বললো,

-- বেবিদের ডক্টর চেকআপ করাতে নিয়ে গেছে নার্স।চিন্তা করবেন না।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।

নূরের চিৎকার চেচামেচি শুনে ডাক্তার আর নার্সরা ও এসে হাজির হয়েছে।একজন নূর কে বেডে বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে।এভাবে চিৎকার করলে সেলাই ছুটে যেতে পারে। ডক্টর গার্ডের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো,

-- কি বলছেন? আমি নিজেই তো আসতাম বেবিদের দেখতে।আমার কাছে নিয়ে যেতে হবে কেন? আমি কাউকে বলি নি নিয়ে যেতে।

নূর ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো তাকাল সবার দিকে।রক্তিম চোখে নিজের সন্তানদের জন্য হাহাকার। সবার দিকে আঙ্গুল তুলে দাতে দাত চেপে বললো,

-- আমার বাচ্চাদের দশ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে চাই।নাহলে একটা কেও জীবিত রাখবো না। এই এপ্যোলো হাসপাতাল গুড়িয়ে দিবো।

সবাই ভয়ে ঘেমে একাকার অবস্থা। অথোরিটি ও চলে এসেছে ততক্ষণে। আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েদের কিছু হলে সব কিছু ধ্বংস করে দিবে সে।

-- কি হয়েছে?(অবাক হয়ে)

অমি কে দেখে ডুকরে কেদে উঠলো নূর। ভাই কে জাপটে ধরে চিৎকার করে বললো,

-- আমার মেয়েদের এনে দাও অমি।আমার মেয়েদের কেউ নিয়ে গেছে।ওরা অসুস্থ। ওরা কাদছে হয়তো আমাকে ছাড়া। আমার মেয়েদের কিছু হলে আমি সবাই কে শেষ করে দিবো।

অমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। নূরের কান্নায় সবার চোখে পানি চলে এসেছে।

-- কি বলছেন ম্যাম? বাবুরা কোথায়?কে নিয়ে গেছে ওদের?(অস্থির হয়ে)

নূর কিছু বলতে পারলো না।পেট ব্যথায় চিনচিন করে উঠতেই আর্তনাদ করে উঠলো। অমি নূর কে আগলে ধরে বেডে বসিয়ে দিয়ে নার্সদের নূর কে সামলাতে বললো। অথরিটি হেড ততক্ষণে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে এসেছে।অমি আশমিন কে কল করে যাচ্ছে। আশমিন ফোন তুলছে না।সানভি কে কল দিতেই সে কল রুসিভ করলো। অমি সংক্ষেপে সব বলে আশমিন কে ইনফর্ম করতে বললো। গার্ডদের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বললো,

-- বাহাদুর কোথায়?

-- স্যারের সাথে গিয়েছে।(মাথা নিচু করে)

নূর নিস্তেজ হয়ে বেডে পরে আছে। ব্লিডিং হচ্ছে সেলাইয়ের জায়গা থেকে। অমির নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। নিজের চুল টেনে অস্থির পায়চারি করতে করতে কল করলো আশিয়ানের কাছে।

-- বাবুরা কোথায় আশিয়ান? বাচ্চাদের গায়ে ফুলের টোকা লাগলে আমি তোকে খু*ন করে ফেলবো।(চিৎকার করে)

অমির চিৎকার শুনে আশিয়ান অবাক হয়ে গেলো। হতভম্ব গলায় বলল,

-- কি বলছো ভাই? বাবুরা কোথায় আমি কিভাবে বলবো? কি হয়েছে?

অমির চেহারা রাগে লাল হয়ে গেলো। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনের সোফায় লাথি দিয়ে বললো,

-- একদম নাটক করবি না।তুই ওদের কিডন্যাপ করিস নি? আরে তোর বোনের মেয়ে ওরা! এতো টা নিচে কিভাবে নামতে পারলি! তোর দুশমনি সম্পত্তি নিয়ে।বাচ্চাদের দিকে কেন হাত বাড়ালি? আশমিন মেরে ফেলবে তোকে। কোথায় আছিস আমাকে বল।আমি ওদের নিয়ে আসবো। নূরের অবস্থা ভালো না।আমার বোন মরে যাবে।

অমি কথা বলতে বলতে কান্না করে দিলো। আশিয়ান স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে ওর।সে ক এতোটাই খারাপ যে দুধের বাচ্চাদের সাথে দুশমনি করবে! বাচ্চাগুলো হওয়ার পর থেকে ওদের দেখার জন্য মন আকুপাকু করছিলো। কতো কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছে একমাত্র ও ই জানে।ও রাফসান শিকদার কে ঘৃণা করে। নূরের প্রতি ওর কোন রাগ নেই।রাফসান শিকদারের রাজত্ব ধ্বংস করতে চায় ও।কিন্তু নূরের কোন ক্ষতি তো কোনদিন ও চায়নি।নিজেকে সামলে আমি আসছি বলেই কল কেটে দিলো আশিয়ান। গাড়ির চাবি নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আজ এই শত্রুতার শেষ করবে ও। যাদের জন্য এই দ্বন্দ্ব তারা কেউ ই তো আর বেচে নেই। তাহলে প্রতিশোধ নিয়ে কি হবে? তার নিজের ও একটা পরিবার চাই।আগাছার মতো জীবন তার নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে।

সমস্ত রোড ব্লক করে দেয়া হয়েছে।একটা গাড়ি ও নড়তে দেয়া হচ্ছে না। জনগণের মধ্যে অনেকেই পুলিশ কে সাহায্য করছে তল্লাশি করতে।সানভির কাছ থেকে নিজের মেয়েদের নিখোজ হওয়ার খবর শোনার সাথে সাথেই আশমিন ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। সে জানে এই কাজ কামিনী চৌধুরী ছাড়া আর কেউ করে নি।

তিন রাস্তার মাথা ব্লক করে সেখানেই গাড়ির ডিকি তে শুয়ে আছে আশমিন। এই রাস্তা দিয়েই সব গাড়ি বের হতে হবে। আহ! শেষে কি না তার হাতেই কামিনী চৌধুরীর মৃ*ত্যু লেখা আছে! আমজাদ চৌধুরী ছুটে এসেছে ছেলের কাছে।

আশমিনের ফোন বেজে উঠতেই সে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। কয়েকটা কথা বলে রক্তিম।চোখে আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,

-- চলো আব্বু।একটু ঘুরে আসি। (আমজাদ চৌধুরীর কাধে হাত দিয়ে) তোমাকে আমার টর্চার সেল দেখাবো আজ।চলো চলো।

আমজাদ চৌধুরী অসহায় চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। মন বড় কু গাইছে। করুন গলায় বলল,

-- প্রাণ টা না নিলে হয় না?

-- আমি তোমাকে আরো তিনটা বউ এনে দিবো।এটা নিয়ে এতো বায়না করো না তো।ভালো ছেলেরা বায়না করে না। চুপচাপ গাড়ি তে বসো।নাহলে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর শেষ দর্শন ও পাবে না।

একটু থেমে আবার দাত কিড়মিড় করতে করতে বললো,

-- এই শহর আমার।আমার শহর থেকে আমার মেয়েদের দিকে হাত বাড়ানোর শাস্তি তাকে পেতে হবে।একদম পুরনো দিনের নায়িকাদের মতো ন্যাকামি করবে না।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩৪

কামিনী চৌধুরী কে একটা চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেধে রাখা হয়েছে। চারিদিকে গার্ড রা ঘিরে রেখেছে তাকে।বাচ্চাদের আলতো করে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাহাদুর আর একজন মেয়ে গার্ড। অনেকক্ষন না খেয়ে থাকার দরুন তার একটু পর পর কেদে উঠছে।কামিনী চৌধুরীর গায়ে কেউ হাত তুলে নি।যতই অন্যায় করুক না কেন কামিনী চৌধুরী আশমিনের মা।তাকে আঘাত করার সাহস কারোর নেই।

আশমিন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সবাই সরে দাড়ালো। আশমিনের পিছনে সানভি আর আমজাদ চৌধুরী ও ভিতরে ঢুকলো। কামিনী চৌধুরী রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। আশমিন সেদিকে একবার তাকিয়ে নিজের মেয়েদের কাছে গেলো। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবানু মুক্ত করে মেয়েদের নিজের কোলে নিয়ে বুকের সাথে আগলে রাখলো কিছুক্ষণ। বুকের অসহ্য অস্থিরতায় এতক্ষণে পাগল হওয়ার দশা তার। সন্তাদের কোলে নিয়ে অশান্ত বুক শান্ত হয়ে এসেছে। বাবার কোলে উঠে মেয়েরা ও চুপ হয়ে গেছে। আশমিন দুজনের কপালে চুমু খেয়ে তাদের কোলে নিয়েই কামিনী চৌধুরীর সামনা সামনি বসলো। মেয়েদের বুকের সাথে আগলে ধরে কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-- আমাকে ও কি এভাবে নিজের বুকে আগলে রাখতে পারতে না আম্মু?

এতো বছর পরে ছেলের মুখে আম্মু ডাক শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কামিনী চৌধুরী।

-- কিসের প্রতিশোধ নিতে চাইলে আম্মু? ভালবাসার মানুষ হারানোর? তাহলে তার একমাত্র অংশ কে এভাবে অবহেলা করলে কিভাবে? তার ভালোই বাসা যদি তোমাকে এতটা উন্মাদ ই করে থাকে তাহলে তার সন্তানের জন্য নিজেকে মমতাময়ী করতে পারলে না কেন? আসলে তুমি কখনো কাউকে ভালোই বাসোনি। তুমি শুধু তাকে উপলক্ষ্য বানিয়েছিলে নিজের মনের ভিতর থাকা ঘৃণা প্রকাশ করতে।তাই না আম্মু?

কামিনী চৌধুরী রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আমজাদ চৌধুরী সহ সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বাচ্চাদের আমজাদ চৌধুরী আর সানভির কোলে দিয়ে কামিনী চৌধুরীর মুখ খুলে দিলো।অগোছালো চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে জরিয়ে ধরলো তাকে।কামিনী চৌধুরীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে ধরা গলায় বলল,

-- আমার একা থাকতে খুব কষ্ট হতো আম্মু। হোস্টেলের অনেক ছেলেরা আমাকে মারতো।আমি খুব ছোট ছিলাম।কিছু বলতে পারতাম না তাদের।একা একা ঘুমাতে ভয় হতো খুব।মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভয়ে জোড়ে কেদে উঠতাম।তখন পাশের ছেলেরক আমাকে বারান্দায় বন্ধ করে দিতো।ঠিক ভাবে খেতে দিত না।মাঝে মাঝে সারাদিন বাথরুমে বন্ধ করে রেখে আমাকে কষ্ট দিতো।ওরা আমাকে পছন্দ করতো না আম্মু।তুমি কেন আমাকে তোমার সাথে রাখলে না? রাতে তোমার বুকে ঘুমাতে খুব ইচ্ছে করতো আমার। আমাকে একটু বুকে কেন জরিয়ে ধরতে না আম্মু? আমি তোমার ছেলে বলো? সন্তানের সাথে কেউ এমন করে?

কামিনী চৌধুরী চুপ করে আছে। আশমিনের কোন কথা তার মনে আচড় কেটেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অমি আশিয়ানের সাথে নূর ও এসে পড়েছে। অগোছালো নূর কে দুই দিক থেকে আগলে রেখেছে দুই ভাই।নিজে নিজে দাড়ানোর অবস্থায় নেই নূর।অমি অনেকবার আটকানোর চেষ্টা করে ও সফল হয় নি। আশমিনের দেয়া মেসেজের কথা অমির মুখে শুনেই আসার জন্য পাগলামি শুরু করে। আশিয়ান ও তখন সেখানে উপস্থিত হয়।নূরের অবস্থা দেখে আশিয়ান নিজেই তাকে এখানে নিয়ে আসে।

কামিনী চৌধুরী নূর আর আশিয়ান অমি কে একসাথে দেখেই জ্বলে উঠলো। আশমিন তার হাতের বাধন খুলে দিতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নূরের উপর আক্রমণ করে বসলো সে।আশিয়ান আর অমি আটকে দিলো কামিনী চৌধুরী কে। আশমিন কামিনী চৌধুরীর ধাক্কায় কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে।নিজেকে সামলে শান্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। নূর নিজের বাচ্চাদের কাছে গিয়ে তাদের সারা মুখে চুমু খেলো।

তাদের কোলে নেয়ার অবস্থায় নেই সে।আশমিন ধীর পায়ে এসে দাড়ালো কামিনী চৌধুরীর সামনে। আশিয়ান আর অমি তাকে ধরে রেখেছে।আশমিন শান্ত গলায় বললো,

-- আমার মেয়েদের কেন কিডন্যাপ করেছিলেন?

কামিনী চৌধুরী দাত কিড়মিড় করতে করতে বললো,

-- বেচে দিতাম তোর মেয়েদের। আমার সামনে তোরা শান্তিতে থাকবি তা আমি থাকতে সম্ভব না। ওর বাবার জন্য আমি ছোট থেকেই অবহেলায় বড় হয়েছি।কারন আমি মেয়ে।বাবা মা সারাদিন ভাইয়ের পিছনেই লেগে থাকতো। মরে যাওয়ার আগে সব সম্পত্তি ও তার নামেই দিয়ে গেল। আমাকে বাচতে হতো তার দয়ায়।নিজের ইচ্ছায় ভালবাসার মানুষ টা কে বিয়ে করলাম তাকে ও খু*ন করলো। আমি কোন ভুল করিনি। আর তুই, তুই আমার পেটের ছেলে হয়ে আমার সংসার ভাঙ্গলি।আমার জন্য সতিন নিয়ে এলি। তোকে আমি শান্তিতে থাকতে দেই কি করে?

আমজাদ চৌধুরী তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,

-- তাই নাকি কামিনী? তোমার সংসার? তা কবে আমাকে স্বামীর অধিকার দিয়েছো।আমাদের কি আদেও কোন সংসার ছিল?

-- আমি তোমাকে ভালবাসি আমজাদ।

কামিনী চৌধুরীর কাতর গলা শুনে আমজাদ চৌধুরী মলিন হাসলো। কামিনী চৌধুরীর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-- সত্যিই কি ভালবাসো কামিনী?

-- আমি বিয়ের সময় ই তোমাকে বলেছিলাম আমজাদ।আমরা কখনো স্বামী স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক সম্পর্কে থাকবো না।তুমি সব মেনেই আমাকে বিয়ে করেছিলে।তাহলে আজ অভিযোগ কেন?

আমজাদ চৌধুরী আর কিছু বললো না। মুখ ঘুড়িয়ে নিলো কামিনী চৌধুরীর থেকে।আশমিন অমি আর আশিয়ানের থেকে ছাড়িয়ে নিলো কামিনী চৌধুরী কে। আরেকবার তাকে বুকের সাথে জরিয়ে ধরলো। নূর চুপ করে আশমিন কে দেখে যাচ্ছে। আজ আশমিন কে তার স্বাভাবিক লাগছে না।কামিনী চৌধুরী ছটফট করছে ছোটার জন্য। আশিয়ান কে বেঈমানের রক্ত বলে গালাগালি করছে।আশমিন তার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে তলপেটে পর পর তিন বার শু*ট করে দিলো। আশমিনের রক্ত লাল চোখ থেকে গড়িয়ে পরা পানি কামিনী চৌধুরীর কপালে এসে পরলো।সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কামিনী চৌধুরী কয়েক বার গুঙিয়ে সাথে সাথেই শান্ত হয়ে গেছে। আশমিন তার নিথর দেহ এখনো নিজের বুকে আগলে রেখেছে। বুক থেকে মাথা টা একটু আলগা করে কপালে চুমু খেয়ে আবার মাথা টা বুকে চেপে ধরে ধরা গলায় বলল,

-- আমাকে কেন ভালবাসলে না আম্মু? একটু ভালবাসলে কি হতো? কেউ আমাকে কেন ভালবাসে না? আমি কি এতোই খারাপ বলো? আমি তো তোমাদের খুব ভালবেসেছিলাম।তাহলে আমাকে কেন তোমরা একটু ভালবাসা দিলে না। আমাকে কেন তোমার খু*নি হতে হলো আম্মু? যে হাত দিয়ে আমি তোমাকে খু*ন করেছি সে হাত আমি কিভাবে বয়ে বেরাবো? আমার বেচে থাকাকে কেন এমন যন্ত্রণাময় করে দিলে।

কামিনী চৌধুরীর নিস্তেজ দেহ নিয়েই ফ্লোরে বসে পরলো আশমিন। নূর দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আমজাদ চৌধুরীর হাত কাপছে।অমি এসে তার কাছ থেকে বাবু কে নিয়ে নিলো।আশিয়ান অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে কামিনী চৌধুরীর নিথর দেহের দিকে।আমজাদ চৌধুরী আশমিনের বুক থেকে কামিনী চৌধুরী কে নিজের কাছে নিলেন।তার সারা মুখে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে ডুকরে কেদে উঠলেন।

-- তোমাকে এভাবে বুকে রাখা আমার স্বপ্ন ছিল কামিনী। আমি চেয়েছিলাম আমার বুকের উষ্ণতা তুমি উপভোগ করো।আমি তোমাকে বুকে নিয়েছি ঠিকই কিন্তু তুমি উপভোগ করছো না। তুমি কেন এমন বিনাশিনী হলে? আমার মায়াবিনী হয়ে কি বেচে থাকতে পারতে না! তুমি ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো? তোমার এই দেহে প্রাণ নেই ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে কিসের শাস্তি দিলে কামিনী! আমি তো শুধু ভালবেসেছিলাম। একটুও ক্ষাদ রাখিনি আমার ভালবাসায়।তাহলে কেন?

নূর পাথর চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিনের এক হাতে কামিনী চৌধুরীর হাত। আশমিন কে দেখে মনে হচ্ছে একটা প্রাণহীন দেহ বসে আছে। নূরের কানে শুধু একটা কথা ই বাজছে,,কেউ আমাকে কেন ভালবাসে না। তাহলে কি নূর আশমিন কে ভালবাসেনি? নূর কে অমি একহাতে ধরে রেখেছে।সানভি নিরবে চোখের পানি ফেলছে।আশমিনের জন্য তার বুকটা হুহু করে উঠছে।তার স্যার ভালো নেই।সত্যিই তাকে কেউ ভালবাসে না।সে ই শুধু বুক উজার করে সবাই কে ভালবেসে গেলো ।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩৫

আশমিন আমজাদ চৌধুরীর কাছ থেকে কামিনী চৌধুরী কে সরিয়ে নিজের দিকে টেনে নিলো।বাহাদুর কে ইশারায় কিছু বলে কামিনী চৌধুরী কে কোলে নিয়ে সাথে সাথেই বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আমজাদ চৌধুরী আশিয়ান তার পিছু নিতে চাইলে তাদের আটকে দিলো বাহাদুর। সানভি বাবুকে মেয়ে গার্ডের কোলে দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল আশমিনের পিছু পিছু।আমজাদ চৌধুরী বাহাদুরের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বললো,

-- আমার সামনে থেকে সরে যাও বাহাদুর। নাহলে আজ আমার হাতে অনর্থ হয়ে যাবে।কোথায় নিয়ে গেল কামিনী কে? পথ ছাড়ো। আমাকে কামিনীর কাছে যেতে দাও।

বাহাদুর নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নূর এক কোনে চুপ করে বসে আছে। তার ভালো খারাপ কোন অনুভূতি ই হচ্ছে না। আশমিন এতো পাষাণ কি করে হলো। যাই হোক না কেন কামিনী চৌধুরী তার মা! তাকে সে কিভাবে গু*লি করতে পারলো! নূরের মাথা ধরে যাচ্ছে। আশিয়ান বাহাদুর কে সরিয়ে খুব সহজেই বেরিয়ে গেছে।তার কাছে বাহাদুর দুধভাত। নূরের জন্য খারাপ লাগছে তার। বাস্তবতার মুখোমুখি হলে মেয়েটা আবার কি করে বসে কে জানে! এখানে তার ও কিছু ভুমিকা আছে।তা পালন করতেই তাকে ছুটতে হচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব চোখে শুধু সব দেখেই গেলো। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বাহাদুর অমি কে কিছু বলতেই অমি আমজাদ চৌধুরী নূর আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নূর মঞ্জিলের দিকে রওনা হলো। নূর চুপ হয়ে সব মেনে নিচ্ছে। খেলার শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়। আশমিন মানুষ টা তার কাছে একটা গোলকধাঁধার মতো। তাকে বুঝতে চাওয়া আর অদৃশ্য গুহায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা একই কথা।আপাতত নিজের সুস্থ হওয়া টা খুব জরুরি। তবেই না খেলা জমবে।

আশমিন কামিনী চৌধুরী কে নিয়ে কোথায় গেছে তা কেউ জানে না।সানভি আর আশিয়ান কেউ ই তার নাগাল পায়নি।সানভির ফোনে আশমিনের এস এম এস আসতেই সানভি কাজে লেগে পরলো।এতক্ষণ কামিনী চৌধুরীর জন্য খারাপ লাগলেও আবার তার মন টা বিষিয়ে উঠলো। মৃত মানুষের উপর রাগ রাখতে নেই।তবে সানভির রাগ হচ্ছে। ভভয়ংকর রাগ হচ্ছে। আশমিনের দেয়া ঠিকানায় আসতেই সেখানে পুলিশ কে ফোর্স সহ পজিশন নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো সানভি।সেখান থেকে সরে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সে।তাকে কেউ এখানে দেখলে স্ক্যান্ডেল হতে সময় লাগবে না। গত কয়েকমাসে গায়েব হওয়া মেয়ে গুলো এখানেই আছে।তাদের মধ্যে কিছু কিছু মেয়েকে পাচার করে দেয়া হয়েছে চড়া দামে।আশমিনের মেয়েদের ও বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল কামিনী চৌধুরী। না জানি এভাবে আরো কতো মায়ের বুক সে খালি করে দিয়েছে।পাচার চক্রের মেইন মাথা ই ছিল কামিনী চৌধুরী। আশিয়ানের ডুবাই তে অ*স্ত্রের ব্যবসা আছে। সেখানকার মাফিয়া সে।তবে মেয়ে পাচারের সাথে সে জড়িত নয়। কামিনী চৌধুরীর এই চক্রের খবর আশিয়ান ই আশমিন কে দিয়েছে। আশমিন নিজেই সব কিছু করেছে। একজন মন্ত্রীর মা নারী পাচারকারি! বিষয় টা জানাজানি হলে জনগণের তোপের মুখে পরতে হবে তার পুরো পরিবার কে। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে এক মুহুর্তে। তবুও সে এসব কিছুত তোয়াক্কা করে নি।আশিয়ানের মাধ্যমে অনেকবার কামিনী চৌধুরী কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে।ফলাফল শূন্য। কিন্তু তার মেয়েদের সাথে যখন একই কাজ করতে চাইলো তখন আশমিন শান্ত থাকতে পারলো না। তার পনের দিনের মেয়েদের জন্য যদি তার এতো কষ্ট হয় তাহলে যারা পনের বিশ বছর লালন পালন করে নিজের মেয়েদের হারিয়েছে তাদের না জানি কি অবস্থা। এই সিদ্ধান্ত নিতে তার অনেকবার ভাবতে হয়েছে। এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হলে তার পরিবার কে ও সে বাচাতে পারতো না। চারিদিকে শত্রুর মেলা।সুযোগ পেলে তাকে শেষ করতে এক মুহুর্ত ও সময় নিবে না কেউ।জনগনের ভালো করতে গিয়ে নিজের দলেই অনেক শত্রু হয়েছে তার।তাই সব কিছু গোপনেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

শহর থেকে দূরে একটা ভাঙা বাড়ির সামনে পুলিশের অবস্থান। সানভি জানে ভিতরে কয়েকজন পাতি গুন্ডা ছাড়া আর কেউ নেই। তবুও পুলিশের এতো সময় নেয়া দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার।বাংলা সিনেমার পুলিশের মতো কি ক্লাইমেক্স হওয়ার অপেক্ষা করছে নাকি! এদিকে মশা তকে নিয়ে মনের সুখে পিকনিক করছে।

খাজা বাবার ডেগ আকারের পেটের অধিকারী পুলিশ অফিসার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। সানভি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পুলিশের একটা টিম ভিতরে ঢুকতেই সে সেখানে উপস্থিত হলো। গোলাগুলির মধ্যে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। একটা মাত্র প্রাণের অধিকারী মানুষদের এতো রিস্ক নেয়ার কোন মানে হয়না।

আমজাদ চৌধুরী বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে ফিরলো। মায়া বেগম গার্ডের কোল থেকে বাবু কে নিয়ে করুন চোখে অমির দিকে তাকালো। অমি মাথা নিচু করে ভিতরে চলে গেলো। তার কিছু ভালো লাগছে না। এখানে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার।যেখানে বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায়।

নূর কে নিজের রুমে নিয়ে গেলো মায়া বেগম।তার মুখটাও শুকিয়ে গেছে।আজ বারবার নিজের অতীত মনে পরে যাচ্ছে। নূর কে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে বালতি তে করে হালকা গরম পানি এনে ফ্রেশ করিয়ে দিলো।বাচ্চাদের ফিডিং করাতে হেল্প করে নূরের পাশেই উদাস মুখে বসে রইলো মায়া বেগম।

-- কামিনী আপা কি আর বেচে নেই বউমা?

নূর ঘাড় উচু করে মায়া বেগমের দিকে তাকালো। তার উদাস দৃষ্টি ভাবিয়ে তুললো নূর কে।এটা কি শুধু সতিনের জন্য মায়া নাকি এর পিছনে ও অন্য কোন গল্প আছে। আজকাল কাউকে বিশ্বাস হয় না নূরের।সবার মুখের উপরই যেন এক একটা মুখোশ টানা। মায়া বেগমের প্রশ্নের উত্তর দিলো না নূর।মায়া বেগম ও আর কোন কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। লুবানা আজ সকাল থেকে গায়েব। সে থাকলে এখন নূরের কাছে থাকতে পারতো।মায়া বেগম কে নূর খুব একটা পছন্দ করে না।তাই সে ও দূরত্ব বজায় রেখে চলে।একজন মেয়ে স্টাফ কে নূরের রুমের বাইরে থাকতে বলে মায়া বেগম নিচে চলে গেলো। আমজাদ চৌধুরী কামিনী চৌধুরীর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। থেকে থেকে ফুপিয়ে উঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মায়া বেগম সেদিকে না গিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ক্লান্ত দেহমন এবার একটু বিশ্রাম চায়।

দুই'শ বেয়াল্লিশ জন মেয়েকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।তাদের মধ্যে একজন লুবানা। পরিস্থিতি আয়ত্তে আসতেই ভিতরে গিয়েছে সানভি।খাজা বাবার ডেগ ধাচের লোকটা আসলেই খুব কাজের।এখন আর তাকে এই নামে ডাকা যাবে না।হি ইজ আ রেস্পেক্টেড পারসন। ভিতরে গিয়ে মেয়েগুলোর অবস্থা দেখে বুক কেপে উঠলো সানভির।সে পাগলপ্রায় হয়ে লুবানা কে খুজতে লাগলো। একটা মেয়েও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই।সবাইকে প্রচুর আঘাত করা হয়েছে। এখানে নিয়জিত থাকা লোক গুলো ক্রশ*ফায়ারে মারা গেছে।আশমিনের অর্ডারেই তাদের ক্র*শ*ফায়ার দেয়া হয়েছে।নহলে সত্যি বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে না। সানভি চারিদিকে খুজে ও যখন লুবানা কে পেলো না তখন তার হাত পায়ে কাপুনি উঠে গেলো। ও ঠিক আছে তো? এই প্রশ্ন তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু করে দিলো।

-- স্যার এখানে একটা মেয়ে পরে আছে।মনে হয় না বেচে আছে।

এক কনস্টেবলের ডাকে সবাই সেদিকে তাকালো।সানভির বুক অসম্ভব কাপছে। পুলিশ অফিসার যাওয়ার আগেই সানভি দৌড়ে গেলো সেদিকে। লুবানা কে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ফর্সা মুখ রক্তিম আকার ধারণ করেছে তার।সামনে আগানোর সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছে না সে। লুবানার সারা শরীরে মারের দাগ স্পষ্ট। সানভি কাপা কাপা পায়ে এগিয়ে গেলো লুবানার দিকে। হাটু গেড়ে বসে আলতো হাতে সোজা করল লুবানা কে।

-- সাবানা,,,এই সাবানা।

গালে হালকা চাপড় দিতেও ভয় করছে সানভির। পাছে সে ব্যথা পায়। নাকের কাছে হাত নিয়ে চেক করতেই দেখলো হালকা নিশ্বাস পরছে। তড়িঘড়ি করে পাজা কোলে তুলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল সানভি।একজন কনস্টেবল ও গেলো তার সাথে।মেয়েটাকে এখানে পাওয়া গেছে তাই তাকে এভাবে যেতে দেয়া যায় না।

■■■■■■■■■■■■■■

#পর্ব_৩৬

মামনী কোথায় ভাই?

আশমিন বিরক্ত চোখে তাকালো আশিয়ানের দিকে। কপাল কুচকে গমগমে গলায় বলল,

-- তোমাকে আমার বিরক্তির লাগছে আশিয়ান। এখান থেকে যাও।ভাই হিসেবে একটা পরামর্শ দিচ্ছি,এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যাও। আমি নিজের মা কেই ছাড় দেই নি।সেখানে তুমি তো সৎ শম্বোন্ধি। মিসেস চৌধুরীর কথা আর কখনো জানতে চাইবে না।পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তাই তাকে নিয়ে কথা না বলাই তোমার জন্য ভালো।

আশিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ওই ঘটনার আজ এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আশমিন সেদিন অনেক রাতে বাসায় এসেছিলো। কাউকে কিছু না বলেই নিজের রুমে দুই দিন দরজা বন্ধ করে বসে ছিল। দুই দিন পর যখন রুম থেকে বেরুলো তখন সব কিছু স্বাভাবিক। নূর শারীরিক ভাবে অনেকটাই অসুস্থ।

মেয়েদের নিয়ে আরো নাজেহাল অবস্থা। একটা ঘুমালে আরেকটা জেগে বসে থাকে।কারোর কোলে দিলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়।একমাত্র নূর আর আশমিনের কাছেই তারা শান্ত থাকে। মাঝে মাঝে তো নূরের কোলেও থাকতে চায় না। দুই ইঞ্চি মেয়েরাই তার কলিজা ভেজে দিচ্ছে। একেবারে বাপের মতো হয়েছে।বেয়াদব!

রাতে টিউবলাইটের মতো চোখ দুটো খোলা থাকে তাদের একটা ও রাতে ঘুমায় না।তবে নূর কে জাগতে হয় না।আশমিন সারা রাত মেয়েদের নিয়ে বসে থাকে। মন্ত্রী সভার গভীর সমস্যা নিয়ে মেয়েদের সাথে আলোচনায় বসে।মেয়েরা ও গোল গোল চোখ করে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্যা পু শব্দ করে নিজেদের মতামত দেয়। মেয়েদের মতামত এয়ে আশমিন নতুন উদ্যমে আবার নতুন আলোচনা শুরু করে। এসব দেখে মাঝে মাঝে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে নূর।এতো মাস পেটে রেখে শত্রুর দোসর জন্ম দিলো সে!

গতকাল লুবানা কে বাড়ি নিয়ে এসেছে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে লুবানার ট্রিটমেন্ট করিয়েছে আশমিন।মুলত কামিনী চৌধুরীর পরিকল্পনা জেনে ফেলায় লুবানার এই করুন পরিনতি। তার এক হাত ভেঙে গেছে। নির্মম ভাবে মারা হয়েছে তাকে।এক চোখ ফুলে আছে। শারীরিক অবস্থা আরেকটু স্টেবল হলে তার চোখ অপারেশন করা হবে। এখন এক চোখে দেখতে পায় না লুবানা।ফুলে যাওয়ার কারনে চোখ বন্ধ হয়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেতলে গিয়েছে।যন্ত্রণায় মাঝরাতে চিৎকার করে কাদতো লুবানা।তাই তাকে বেশিরভাগ সময় গুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়। সানভি এই কয়দিন লুবানার সাথেই ছিল। তবে সবসময় থাকতে পারে নি। আশমিনের সাথে ও থাকতে হয় তাকে। লামিম সারাক্ষণ বোনের সাথে থেকেছে।এই একটা মাত্র বোন ছাড়া তার আর কেউ নেই। যন্ত্রণায় ছটফট করে যখন লুবানা কেদে উঠত তখন তার সাথে লামিম ও কেদে ফেলতো।সানভি অসহায় চোখে ভাই বোনের কান্না দেখতো।লামিম কে বুকে জরিয়ে শান্ত করলেও লুবনার কষ্ট কমাতে পারতো না। নিজেকে তখন কতটা অসহায় লাগতো একমাত্র সানভি ই জানে।

আশমিনের সাথে আমজাদ চৌধুরীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সে আশমিনের সাথে কথা বলা ই বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদিন কিছু একটা চিন্তা করে গুমরে থাকে।আশমিন দেখেও কিছু বলে না। তাকে সময় দিচ্ছে নিজেকে সামলে নেয়ার।মায়া বেগম ও নিজের মতো ই থাকে।নিজের মতো কাজ করে রুমে গিয়ে বসে থাকে। কারোর সামনে পরতে চায় না। নিজেকে খুব উটকো লাগে তার। তবে এখানে থাকা ছাড়া তার কোন গতি নেই।ভালোই তো আছে।আশমিন তাকে খুব সম্মান করে। আর কি চাই!

...........................................

𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃

Download

Like this story? Download the app to keep your reading history.
Download

Bonus

New users downloading the APP can read 10 episodes for free

Receive
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download MangaToon APP on App Store and Google Play