𝐓𝐇𝐄 𝐈𝐍𝐃𝐄𝐗
#পর্ব_১
বিচ্ছেদের চার বছর পরে প্রিয় মানুষটির হলুদ সন্ধায় লাইভ পারফর্ম করছে নূর। পুরো নাম তেহজিব নূর। একজন প্রফেশনাল সিঙ্গার সে।মাস খানেক আগেই তাদের সাথে কনট্রাক করেছে মিনিস্টার আশমিন জায়িনের পি.এ সানভি।সব কিছু জেনে শুনেই কন্ট্রাক পেপার সাইন করেছে নূর। যে বর্তমানে স্টেজ কাপাচ্ছে নিজের সুরেলা গলার গান দিয়ে। তার সাথেই একদল মেয়ে গানের তালে তালে নেচে যাচ্ছে। নূর ও তাদের সাথে তাল মেলাচ্ছে মাঝে মাঝে। তার দিকেই রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আশমিন।অথচ তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই মুহুর্তে তার রাগ পুরো কমিউনিটি সেন্টার জ্বালিয়ে দিতে পারে।আশমিনের বাবা কিছুটা আচ করতে পেরে মুচকি হাসলেন।ছেলের চোখে চোখ পরতেই গা জ্বালানো হাসি দিতে ভুললেন না।আশমিনের রাগ তরতর করে বেড়ে গেলেও সে নূরের দিকে পুর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকালো।
Shuru!
Jo akh lad jaave
Saari raat neend na aave
Mainu bada tadpaave
Dil chain kahin na paave paave paave x (2)
Khan khan khan khan choodi
Teri khan khan khan khan khanke re
Khan khan khan khan khanke
Vekh vekhkechehra
Mera dil yeh dhak dhak dhadke re
Dil yeh dhak dhak dhadke
Tarsaave tere bin yeh reh na paave
Maahi jo tu na aave aave aave
বেবি পিনক গ্রাউনে নূর কে প্রিন্সেসের মতো লাগছে।হেলেদুলে যখন ডান্সারদের সাথে পা মেলাচ্ছে তখন আশমিনের কলিজায় আগুন লেগে যাচ্ছে। অথচ তার পাশেই তার হবু বউ বসে রাগে ফুসছে তাতে তার কোন হেলদোল নেই।তার কলিজা কয়লা করার জন্য স্টেজে হাজির হলো মেল সিঙ্গার তাসিন।যে আপাতত নূরের সাথে ডুয়েট করছে।দুজন যে খুব বেশি ইনজয় করে গাইছে তা কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে। আশমিনের হবু বউ লারা এবার নিজের বেচারি মার্কা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। কটমট করতে করতে আশমিন কে বললো,
-- প্রাক্তনের প্রতি দরদ উতলে উঠছে নাকি?এভাবে তাকিয়ে কি তার রুপের সাগরে ডুব দিয়েছো তা সবাইকে বোঝাতে চাইছো।
আশমিন পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো লারার দিকে।পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে উপহাসের স্বরে বললো,
-- সামনে রুপের সাগর রেখে আমি পাশে পচা ডোবা নিয়ে বসে আছি।কি দিন আসলো আমার।আমি কি ভেবেছি জানো লারা,এবার শহরের সমস্ত পচা নর্দমা গুলো পরিস্কার করে ফেলবো।আবর্জনা সব ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবো। মন্ত্রী হিসেবে আমার একটা কর্তব্য আছে তো নাকি।
লারার মুখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে।আশমিনের নজর এখোনো নূরেতেই স্থির। প্রথম থেকে সবটা খেয়াল করলেও আশমিন কে পুরো পুরি ইগনোর করে গেছে নূর।প্রিয়জনের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করা মানে নিজের কলিজায় নিজেই করাত চালিয়ে দেয়া।তবুও নূর নির্বাক।আর তার এই নির্লিপ্ততাই তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এইযে সামনের মানুষটা তাকে হাদি খুশি আরেক ছেলের সাথে পারফর্ম করতে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছে তাতেই তো তার নিজের কলিজায় বরফ পরছে।
গান শেষ হতেই উত্তেজনায় ফেটে পরলো দর্শক।করা তালিতে তাদের বাহ বাহ দিচ্ছে সবাই।নূর স্টেজ থেকে নেমে আমজাদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গেলো নূর।হাসি হাসি মুখে বললো,
-- কেমন আছেন স্যার?
-- মার খাবি।আমি আবার স্যার হলাম কবে রে?
-- মিনিস্টার আশমিন জায়িনের বাবা আপনি।স্যার না বললে গর্দান যাবে যে।
-- ওই সব মিনিস্টার ফিনিস্টার বাদ দে।দু পয়সার মূল্য নেই আমার কাছে এসবের।আমি তোর আঙ্কেল ছিলাম তাই আছি। খবরদার এইসব স্যার টের ডাকবি না।
-- আচ্ছা আচ্ছা ডাকবো না।রাগ করো না তুমি।অনেকদিন পরে দেখা, এভাবে রাগ করলে আমার খারাপ লাগবে।ছেলের বিয়েতে মজা করো।মুখ গোমড়া করে আছো কেন?
নূরের কথা শুনে মুখ গোমড়া করে ফেললো আমজাদ চৌধুরী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
-- অনেক বড় হয়ে গেছিস।দোয়া করি আরো বড় হ।সবাই সবকিছুর মূল্য দিতে জানে না রে মা।কাচ কে হীরা ভাবতে ভাবতে আসল হীরাকেই কাচ ভেবে হারিয়ে ফেলে। যে মূল্য দিতে জানে না তাকেও মূল্যহীনের খাতায় ফেলে দিয়ে এগিয়ে যা।নিজেকে এতটা শক্ত কর যাতে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তোকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা না রাখে।
নূর মলিন হাসলো। আমজাদ চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।রুমে প্রবেশ করতেই নূরের হাসি হাসি মুখটা বিষাদের কালো মেঘে ছেয়ে গেলো।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরার আগেই সন্তপর্ণে তা মুছে নিলো সে।
আশমিনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নূরের দিকেই সীমাবদ্ধ।নূর এখোনো আশমিন কে খেয়াল করে নি।বিলাশবহুল স্যুটের ড্রয়িং রুম থেকে বেড রুমে ঢুকতেই একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে।শক্ত হাতের ধাক্কায় দেয়ালের উপর আছরে পরলো নূর।কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঝাপসা হয়ে গেলো সব কিছু।নিজেকে সামলে নেয়ার আগেই সেই হাতের মালিক শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে।ভীত চোখে সামনে তাকিয়েই শান্ত হয়ে গেলো নূর। আশমিন চোখ লাল করে তার দিকেই তাকিয়ে।
-- সরে দাড়ান মন্ত্রী সাহেব। সামান্য একজন সিঙ্গারের এতো কাছে আসবেন না প্লিজ। চরিত্রে দাগ লাগতে পারে।
নূরের নির্লিপ্ত ভাব আশমিনের রাগে ঘি ঢালার কাজ করলো। হাতের বাধন শক্ত করে দাতে দাত চেপে বললো,
-- আজকাল সিঙ্গাররা সস্তা হয়ে যাচ্ছে নাকি?নাকি তাদের চরিত্র এতোটাই নিম্নমানের হয়ে গেছে যে কেউ কাছে আসলে তার চরিত্র ও খারাপ বলবে লোকে।
নূর চোয়াল শক্ত করে তাকালো আশমিনের দিকে।পুরনো ক্ষত তাজা হয়ে উঠছে।নূর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-- মানুষ নিজের চরিত্র দিয়ে অন্যকে বিচার করে জানেন তো মন্ত্রী সাহেব। যার চরিত্র যেমন সে অন্যকে তেমন ই ভাবে।সেসব কথা বাদ দিন,নিজের হবু বউয়ের দিকে নজর দিন।আমি এখানে আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট নিতে বা দিতে আসি নি।ব্যক্তিগত কোন কথা না বললে খুশি হবো।দয়া করে হাত ছাড়ুন।
-- যদি না ছাড়ি?
-- হাহ!ধরে রাখা আপনার স্বভাবের সাথে যায় না।আপনি ছেড়ে দিতেই অভ্যস্ত। তাই অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
-- বদলে গেছো!
--পৃথিবী টা বড্ড নিষ্ঠুর মন্ত্রী সাহেব।কি?বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্বাস না হলে একবার আমার জায়গায় নিজেকে দাড় করিয়ে দেখুন। আমার চোখ দিয়ে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মানুষ গুলো কে দেখুন। দেখবেন প্রতারকদের মেলা বসেছে।ঠান্ডা মাথায় খু*ন করে দিয়ে চলে যাবে বুঝতেই পারবেন না।আচ্ছা মন্ত্রী সাহেব! আপনি কখনো আয়না দেখেন না?চোখ মেলাতে পারেন তো নিজের সাথে? ঘৃণা হয় না এই জঘন্য প্রতারক চেহারা দেখে?বমি পায় না?আমার কিন্তু বমি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘৃণা গুলো বমি হয়ে আপনার গায়ে উগড়ে দেই ।আপনি বরং চলে যান।অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয়?
-- নূর!!!
আপনার উপরে আমার কোন দাবি নেই মন্ত্রী সাহেব। নূর এতটা ও বেহায়া না।ভাববেন না আপনার নতুন সংসারে ঝামেলার সৃষ্টি করবো।জীবন অনেক লম্বা জানেন তো?সেখানে আপনার মতো প্রতারকদের পাত্তা দিতে নেই।আমার করা প্রতিটি ওয়াদা আমি পূরোন করেছি। আরেকটা ওয়াদা আমি আপনাকে করতে চাই মন্ত্রী সাহেব, আমার শূন্যতায় আপনার সুখের সংসার জ্বালিয়ে রাক করে দিবো। এটা এই নূরের ওয়াদা। প্রতি মুহূর্ত আপনি পোড়বেন।আপনার মনের ভিতর থাকা শান্তির শেষ বিন্দুটুকূ নিংড়ে বের করে আনবো।এতোদিন এই নূরের ভালোবাসা আপনাকে উষ্ণতা দিয়েছে।এবার নূরের তেজ আপনাকে ছাই করবে।নতুন জীবনের জন্য অভিনন্দন।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_২
বারান্দার সোফায় আয়েসি ভঙ্গিতে বসে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে রেখেছে আশমিন। নূরের কোন কথাই তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে নি। সেসব নিয়ে মাথা ও ঘামাচ্ছে না সে।তার বর্তমান মাথা ব্যথার নাম লারা।এই মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কয়েক দিনেই মাথা খেয়ে দিল।কয়েকটা বিশ্রী গালি দিয়ে মাথা সোজা করে বসলো সে।সামনেই কাচুমাচু করে সানভি দাঁড়িয়ে। কি বুঝে যে এই ছেলেটা কে নিজের পি.এ. করেছে আজো মাথায় আসে না।
--কি বলবে বলো।
আশমিনের গম্ভীর গলা শুনে শুকনো ঢোক গিললো সানভি। ভয়ে ভয়ে বললো,
-- ম্যাম কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।
তরাক করে বন্ধ চোখ খুলে ফেললো আশমিন।রক্তিম চোখে তাকাতেই কাপা কাপি শুরু হয়ে গেলো সানভির।আশমিন নিজের ফোনে দৃষ্টি রেখে গম্ভীর গলায় বললো,
-- নূর রুমেই আছে সান।অযথা আমার সময় নষ্ট না করে বাকি দিকটা সামলাও।
-- আমি লারা ম্যামের কথা বলছি স্যার।
সানভির তারাহুরো জবাব।
বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেলো আশমিনের।তবে চেহারায় তার রেশ মাত্র নেই।শান্ত ভঙ্গিতে শুভ্র পাঞ্জাবির পকেট থেকে রি*ভালবার বের করে শান্ত গলায় বললো,
-- ওই মেয়েকে আরেকবার ম্যাম বললে এই রি*ভালবারের একটা গু*লি তোমার নামে দান করে দিবো। বুঝে শুনে কথা বলবে এর পর থেকে। ঠিক আছে?
তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সানভি।যে লোক কোল্ড ড্রিংক খেতে খেতে ঠান্ডা মাথায় খু*ন করতে পারে তার দ্বারা সব কিছুই সম্ভব। প্রানের নিশ্চয়তা থাকলে এই চাকরি সে কবেই ছেড়ে দিতো।এসবে এমন ভাবে জরিয়ে গেছে যে চারিদিকে শত্রুর অভাব নেই। আশমিনের ছায়া মাথা থেকে উঠতেই সে দুনিয়া থেকে উঠে যাবে।
-- লারা কে আমি সরিয়েছি।তাই চিন্তা বাদ দাও।
-- ঠ ঠিক আছে স্যার।তবে অভয় দিলে আরেকটা কথা বলতাম।
আশমিন শান্ত চোখে তাকালো সানভির দিকে।সাথে সাথেই সানভি গড়গড় করে সব বলতে শুরু করলো,
-- আপনি লারা কে যে গোডাউনে রেখেছিলেন সেখানে সে নেই স্যার।আমাদের গার্ডদের চোখ ফাকি দিয়ে কেউ তাকে নিয়ে গেছে।আশেপাশের সব জায়গায় খোঁজ চলছে কিন্তু কোন আশানুরূপ খবর এখনো পাই নি।
আশমিন চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো, কাজ টা তুমি ঠিক করলে না নূর।আমার কাজে বাম হাত ঢোকানো আমি পছন্দ করিনা। আমার অপছন্দের কাজ গুলোই তুমি সবচেয়ে বেশি করো।ফলাফল ভোগ করার জন্য তৈরি থাকো।চোখ বন্ধ রেখেই সানভি কে বললো,
-- এই মুহুর্তে শুধু আমার মায়ের কাছে এই খবর টা পৌঁছে দাও যে,বউ পালিয়েছে।আর অন্দরমহল খালি করে দাও।শুধু আমার কাছের মানুষ গুলো ছাড়া আর কেউ যেন না থাকে।
-- ওকে স্যার।
হন্তদন্ত পায়ে বেড়িয়ে গেলো সানভি।রাত তিনটায় আড়ামের ঘুম বাদ দিয়ে এসব করতে হচ্ছে। কালার ফুল প্রজাপতির মতো সুন্দরী মেয়েরা এদিক সেদিক উড়ে বেরাচ্ছে।অথচ তার সেদিকে নজর দেয়ার ও সময় নেই।এই জীবন রেখে কি হবে।এর চেয়ে সন্যাসী হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ঢেড় ভালো।।
ভোর রাতে মিসেস কামিনী চৌধুরীর বিলাপে ঘুম ভাঙলো সবার।আশমিন একমনে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নূরের রুমে হিডেন ক্যামেরা লাগিয়েছে সে। ফোনের স্ক্রিনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে।নূর ঘুমাচ্ছে। ঠিক দু মিনিটের মাথায় আলসে ভঙ্গিতে উঠে বসলো নূর।চুল গুলো মেসি বান করে আড়মোড়া ভেঙে ফিচলে হাসলো। হেলেদুলে এসে আশমিনের সেট করা ক্যামেরার সামনে দাড়িয়ে দুই ঠোঁট উচু করে চুক চুক শব্দ করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। আশমিন হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করছে। এই মেয়েটা এতো বিধ্বংসী হলো কবে থেকে! নূর নিজের হাসি থামিয়ে চেহারা দুঃখী দুঃখী করে ফেললো। আফসোসের স্বরে বললো,
-- আহারে!মন্ত্রী সাহেবের বউ পালিয়েছে বুঝি?এখন কি হবে?প্রেস, মিডিয়া তো মন্ত্রী সাহেব কে বদনাম করে দিবে।আপনি চিন্তা করবেন না মন্ত্রী সাহেব, আমি কোন ভাবেই আপনাকে বদনাম হতে দিবো না।আমি ওয়াদা করেছিলাম তো!আপনার বিপদে আপনার পাশে থাকবো।লুক,আম হেয়ার।
নূর রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার দশ মিনিটের মাথায় সমস্ত শোরগোল থেমে গেলো। পুরো দমে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো।
বিশাল বাগানের মধ্যে বরের গোসলের প্রস্তুতি চলছে। এক সাইডে নূরের ব্যান্ড একের পর এক গান পারফর্ম করে যাচ্ছে। আজকে নূর এখনো স্টেযে উঠে নি।সে আশমিনের আসার অপেক্ষায় আছে। তার পারফরম্যান্স শুরু হবে আশমিন আসার পর পর।
কয়েক মুহুর্ত পরে আশমিন উপস্থিত হলো বাগানে।শুভ্র পাঞ্জাবিতে রাজকুমারের মতো লাগছে তাকে।হলদেটে গায়ের সাথে পাঞ্জাবি টা অসাধারণ ভাবে মানিয়ে গিয়েছে।তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নূরের দিকেই স্থির। নূর মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়লো। আশমিন বাকা হেসে গোসলের জন্য নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দাড়াতেই মহিলারা তাকে আবারও হলুদ মাখিয়ে দিলো।স্টেজে তখন শুভ বিবাহ গান বাজছে।আমজাদ চৌধুরী হাক ডেকে নূর কে বললো,
-- এদিকে আয় তো তেহজিব মা।আশমিন কে হলুদ লাগিয়ে দে।
নূর শয়তানি হেসে হাত ভর্তি হলুদ নিয়ে এলো। নূর কে আসতে দেখে মহিলারা একপাশ হয়ে দাড়িয়ে গেলো। আশমিন শান্ত চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে। নূর আশমিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুন গুন করে গান গাইতে লাগলো,
"আমার জায়গায় বসিয়েছো অন্য কাউকে যেমন
তোমার জায়গা ও দিয়ে দিবো অন্য কাউকে তেমন।
আশমিনের গালে হলুদ লাগিয়ে দিতেই আশমিন নূরের হাত চেপে ধরলো। হেচকা টানে নূর কে ঘুড়িয়ে নিলো।সাথে সাথে আশমিনের বুকের সাথে নূরের পিঠ লেগে গেল। আশমিন হালকা নিচু হয়ে গুন গুন করে গাইলো,
" tera muskurana,
nazar yu jhukana,
mere liye he bass, mere liye hai.
নূরের গালে নিজের গাল ঘষে দিলো।নূর বাকা হেসে সামনে বসে থাকা কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকালো।সে কটমট করে তাদের দিকেই তাকিয়ে।লারা কে এখনো পাওয়া যায় নি।নূর তাদের আশ্বাস দিয়েছে,সে সময় মতো লারা কে বধু বেসে উপস্থিত করবে।কামিনী চৌধুরী জানেন নূর নিজের কথা রাখবে।তবুও নিশ্চন্ত হতে পারছেন না।আশমিনের মতিগতি তার ঠিক লাগছে না। ভালোয় ভালোয় বিয়ে টা মিটে গেলেই হলো।
আশমিন নিজের রুমে দাঁড়িয়ে। বর বেশে তাকে কোন দেশের রাজা লাগছে। কিছু একটা ভেবে শয়তানি হেসে বিরবির করলো,
--তোমার জীবনে কালবৈশাখী ঝড় তুলে দিবো তেহজিব, ঠিক যেমন আজ আমার হৃদয়ে ঝড় উঠেছে। ঝড়ের তান্ডবে যেমন শুকনো ডাল ভেঙে পড়ে ঠিক তোমাকেও সেভাবে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবো। তবে তোমার মতো আমি একা ছাড়বো না তোমাকে। খুব যত্নে কুড়িয়ে নিবো বাহুডোরে।আজ যেমন তুমি আমাকে শূণ্যতার মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলেছো।ঠিক আমিও তোমাকে আমার হৃদয়ের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলবো।দেখা হবে শীঘ্রই,,,
আশমিনের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।বর বেশে বসে আছে সে।পাশেই তার বাবা মলিন মুখে বসে।প্রেস মিডিয়া চারিদিকে গিজগিজ করছে। সামিয়ানার ওপাশে লারা বধু বেশে উপস্থিত। নূর সামনেই দাঁড়িয়ে। মুখে তার ক্রুর হাসি।আশমিন হঠাৎ করেই খুব হাসি হাসি মুখ করে তাকালো নূরের দিকে। হচকচিয়ে গেলো নূর। এর মধ্যেই কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছে।লারা কে কবুল বলতে বললে লারা ভীতু চোখে আশমিনের দিকে তাকালো।আশমিন হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কবুল বলতে বললো। লারা কাপা কাপা গলায় কবুল বলে দিলো।আমজাদ চৌধুরী মুখ কাল করে ফেললো। হঠাৎ করেই আশমিন চিৎকার করে উঠল।
-- কি হয়েছে আব্বু?বুকে ব্যথা করছে? চিন্তা করো না।আমি এখনি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।
আশমিনের চিৎকার শুনে আমজাদ চৌধুরীর হাত এমনিতেই বুকে চলে গিয়েছিল। সে এখন হতভম্ব চোখে আশমিনের দিকে তাকিয়ে। আশমিন ফিসফিস করে বললো,
-- যদি চাও এই মেয়েকে বিয়ে করে সত্যি সত্যি তোমাকে হার্ট অ্যাটাক না দেই তাহলে আমার সাথে এই মুহুর্তে হসপিটালে চলো।
আমজাদ চৌধুরীর এবার সত্যিই বুকের ব্যথা শুরু হয়ে গেলো।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৩
আমজাদ চৌধুরী কে যখন হসপিটালে নেয়ার তোড়জোড় চলছে ঠিক সেই মূহুর্তে তাদের সামনে হাজির হলো নূর। আশমিন চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সানভি আমতা আমতা করে বললো,
-- সরে দাড়ান ম্যাম।স্যার কে এখনি হসপিটালাইজ করতে হবে। নাহলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
নূর বাকা হেসে আমজাদ চৌধুরীর কাছে গিয়ে দাড়ালো। কামিনী চৌধুরী তাকে ধরে বিলাপ করে যাচ্ছে। লারা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে পাশেই দাড়িয়ে। নূর আশমিনের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
-- সবাই শান্ত হন।কেউ অস্থির হবেন না প্লিজ। আংকেলের গ্যাস্টিকের ব্যথা হয়েছে।ছেলের বিয়ে বলে কথা, হেভি খাবার খাওয়ায় এই অবস্থা। নাথিং এলস।আশমিনের সামনে গ্যাস্টিকের মেডিসিন এগিয়ে দিয়ে বললো,
-- নিন,এটা আংকেল কে খাইয়ে দিন।দশ মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বরং ভালো ছেলের মতো বিয়ে টা করে নিন।সুন্দরী সুশীল বউ অপেক্ষা করছে তো।বিয়ে টা আপনাকে করতেই হবে মন্ত্রী সাহেব। নাহলে আমার শূন্যতা অনুভব করবেন কিভাবে।আমাকে ফিরে পাওয়ার বিন্দু মাত্র আশার স্বস্তি আমি আপনার ভিতর অবশিষ্ট রাখবো না। নূর তার কথার খেলাপ করে না।
শেষের কথা গুলো ফিসফিস করে বললো নূর।আশমিন তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে। ভিতরে রাগে ফেটে পরলেও ভাইরে সে একদম শান্ত।নূরের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো সে।নূরের দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বললো,
-- আমি একজন মন্ত্রী নূর।তোমার মতো হাজার হাজার কুটিল বুদ্ধি পিছনে ফেলে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।তুমি এতদূর করতে পেরেছো কারণ আমি চেয়েছি।উড়ে বেড়াও,যতো খুশি উড়ে বেড়াও।কিন্তু এটা ভুলে যেও না তোমার নাটাই এই আশমিন জায়িনের হাতে।উড়বে,গোত্তা খাবে সমস্যা নেই।কিন্তু যখন সুতা টান দিবো তখন আমার কাছেই আসতে হবে। তখন কি হবে নূর! তোমার মন্ত্রী সাহেব কিন্তু খুব নিষ্ঠুর। তার নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে পারবে তো! ভেবে চিন্তে কদম ফেলো নূর।তোমার পায়ে শিকল লাগাতে আমি মোটেও সময় নিবো না। (দাতে দাত চেপে)
-- একি মন্ত্রী সাহেব! নাটাই থেকে সুতো ছিড়ে কবেই উড়ে গেছে আর আপনি তো দেখছি খবর ও রাখেন না।এতো বেখেয়ালি হলে চলে!(বাকা হেসে)
-- দেখা যাক।
নূরের থেকে দূরে সরে চারিদিকে চোখ বুলালো আশমিন।সবাই আমজাদ সাহেব কে ঘিরে ধরে আছে। সেদিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো সে,
-- সবাই এভাবে ভীড় করে আছেন কেন।সরে দাড়ান। গাড়ি বের করো সানভি।আর মিস.তেহজিব নূর,আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তার নন।আপনার দূরদর্শী খমতার বলে আব্বুর বুকের ব্যথা গ্যাস্টিক মনে হতেই পারে।তাই বলে ছেলে হিসেবে তো আমি তা ধরে বসে থাকতে পারি না।কারোর খামখেয়ালি ধারণা নিয়ে তো আর বাবা কে হারাতে পারি না।আপনার কাছে হয়তো বাবার মূল্য তুচ্ছ্য।তবে আমার কাছে সব কিছুর চেয়ে বাবার মূল্য বেশি।আশা করি বোঝাতে পেরেছি।
সানভি গাড়ি নিয়ে আসতেই আমজাদ সাহেব কে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো আশমিন। নূর কে ইচ্ছে করেই এতো তিক্ত কথা শুনিয়েছে সে।নিজের করা ভুল গুলো সেও নাহয় একটু উপলব্ধি করুক।গর্ত থেকে যখন টেনে বের করে এনেছে তখন ঘাড়ের বাকা রগ গুলোও ঠিক সোজা করে দিবে। কামিনী চৌধুরী সাথে আসতে চাইলে সাথে সাথে মানা করে দিলো আশমিন। এমনিতেই মেজাজ পুরো খিচে আছে।মায়ের ফেচফেচ কান্না এখন টোটাল সহ্য করতে পারবে না সে।এর মধ্যেই বিভিন্ন চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলছে,
"ছেলের বিয়েতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরলেন মন্ত্রী আশমিন জায়িনের বাবা আমজাদ চৌধুরী"
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। পিছনে গার্ড আর মিডিয়ার প্রায় পঞ্চাশ টার মতো গাড়ি তাদের ফলো করছে।আমজাদ চৌধুরী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে।আশমিনের তাতে কোন হেলদোল নেই।সে একমনে ফোন ঘেটে যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী এবার মেজাজ হারালেন। কর্কশ গলায় বললেন,
-- এদিকে তাকাও বেয়াদব ছেলে। বিয়ে যখন করবেই না তাহলে এতো নাটক করার কি দরকার ছিল।কেমন ছেলে তুমি?বিয়ে বন্ধ করার জন্য বাবা কে হার্ট এট্যাকের রুগি বানিয়ে দাও!দিন দিন অসভ্য হচ্ছো।
সানভি শুকনো ঢোক গিলে পিছু ফিরে আমজাদ চৌধুরী আর আশমিনের দিকে তাকালো। তা দেখে আমজাদ চৌধুরী ফুসে উঠলো,
-- এভাবে তাকাচ্ছো কেন? ছেলে হয় আমার।চাইলে দু চার ঘা লাগিয়ে ও দিতে পারি।আর তোমাকে বলছি বেয়ারা ছেলে,আমি কিছুতেই হসপিটাল যাবো না।ফিনাইলের গন্ধ আমার একদম সহ্য হয় না।
-- ঠিক আছে।তোমাকে নানা বাড়ি রেখে আসছি।সানভি,গাড়ি ঘোরাও।
আশমিনের শান্ত গলা। সানভি অসহায় চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে।আমজাদ চৌধুরী মুখ কালো করে বসে আছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কটমট করে সানভিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো। আমজাদ চৌধুরীর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে সানভির প্রচন্ড দুঃখ হলো। এরকম একটা নিষ্ঠুর ছেলের পিতা হওয়া তার মোটেও উচিত হয় নি।
আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূর কে দেখে যাচ্ছে। যে বর্তমানে রুমের এক কোনায় বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে। বিরবির করে কিছু বলছেও হয়তো।কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আশমিন বোঝার চেষ্টা ও করলো না।সে শুধু একমনে নূর কে দেখে গেল।
চোখ বন্ধ করে রুমের এককোনায় চুপ করে বসে আছে নূর।বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা চেপে ধরেছে তাকে।কিন্তু সে কাদছে না।সে জানে, আশমিনের বাজপাখির মতো নজর এখন তার উপরেই।তাই তার সামনে কোন ভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবেনা সে। চার বছর আগের আশমিনের একটা কথাই তার কানে বার বার বেজে যাচ্ছে,
-- যে মেয়ে নিজের বাবার ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না সে আমার ভালোবাসার মূল্য দিবে কিভাবে।বাবার মৃত্যু থেকে যার ক্যারিয়ার বড় সে মেয়েকে আমি আমার জীবনে চাই না। দেখা গেলো আমাকে মৃত্যু মুখে রেখে সে নিজের স্বপ্ন পুরন করতে চলে গেলো। এই নূর কে আমি ভালোবাসি নি।তাই এই নূরের জায়গা আমার জীবনে নেই। গো টু হেল উইথ ইয়োর ফা*কিং ড্রিম।
চোখ খুলে ফেললো নূর।বাবা নেই ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসলো তার।এই পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই।সে একা।মহাকাশের এক বিন্দুর মতো সে একদম একা।আশমিন পুরনো ঘা তাজা করে দিয়েছে তার।তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নূর।যে তাকে তখন বোঝে নি সে আজ আর কি বুঝবে?ভালোবাসি বললেই হয় না। বিশ্বাস করতে হয়,ভরসা করতে হয়।শুধু ভালোবাসা কখনোই টিকে থাকে না। আশমিন সেদিন তার বিধ্বস্ততা দেখে নি।তার ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া ভঙ্গ হৃদয় দেখে নি।সে শুধু তার ভুল দেখেছে।তাকে এতো বড় পৃথিবীতে সম্পুর্ন একা ছেড়ে দিয়েছে।সদ্য বাবা হারানো মেয়েটা কে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা দিয়েছে।আশমিন কে আর যাই হোক ক্ষমা করা যায় না।এবার আশমিন বুঝবে ভাঙ্গনের যন্ত্রণা কাকে বলে। আমি তোমাকে বোঝাবো নিঃসঙ্গতা কাকে বলে। ক্ষমতার খুব বড়াই না তোমার? দেখি কতো ক্ষমতা তোমার। কামিনী চৌধুরী এবার বুঝবে তেহজিব কি জিনিস।মায়ের কুৎসিত চেহারা সহ্য করতে পারবে তো আশমিন জায়িন। উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো নূর।
রুমের মধ্যে পায়চারি করে যাচ্ছে কামিনী চৌধুরী। নূর কে এখানে সে একদম সহ্য করতে পারছে না।ভাইয়ের মেয়ে হলে কি হবে।আস্তো বজ্জাত একটা। এতো বছরের সাজানো প্ল্যান কোন ভাবেই নষ্ট হতে দিবে না সে।আশমিনের মতিগতি ভালো ঠেকছে না।সে জানে,আমজাদ চৌধুরীর কিছু হয় নি।বিয়ে বন্ধ করতেই আশমিন এই নাটক করেছে।ছেলে কে হাড়ে হাড়ে চেনে সে।অনেক কষ্টে দুজনের মধ্যে দূরত্ব এনেছে। এখন কিছুতেই তাদের কাছাকাছি রাখা যাবে না। এই মেয়েকে যেভাবেই হোক বিদায় করতে হবে।
লাক্সারি কেবিনে শুয়ে আছে আমজাদ চৌধুরি।পাশেই সানভি দাঁড়িয়ে। আশমিন সোফায় বসে নূর কে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। নূরের হাসি বিষাদ কোনটাই চোখের আড়াল হয়নি তার।দুটোর মানেই সে বোঝে। সঠিক সময় আসলে নূর কেও বুঝিয়ে দিবে।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৪
বিশাল ড্রয়িং রুমে গম্ভীর হয়ে বসে আছে আশমিন।পরিবারের সবাই এখানে উপস্থিত। কামিনী চৌধুরী থমথমে মুখে আমজাদ চৌধুরীর পাশে বসে। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো নূর।আশমিন শান্ত চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আশমিনের পুরো পরিবার অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আশমিন কি বলতে চায় তা জানার জন্য। লারা আর তার পরিবার একপাশে বসে।আশমিন চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-- বিয়েটা ক্যান্সেল করছি আমি।লারা কে বিয়ে করবো না আমি।কারোর কোন প্রশ্ন থাকলে একজন একজন করে জিজ্ঞেস করতে পারেন।আগামী দশ মিনিট সময় আছে আপনাদের কাছে।দশ মিনিট পর আমি এখান থেকে চলে যাবো। ইমপোর্ট্যান্ট মিটিং আছে আমার।
আশমিনের এমন খাপছাড়া ভাব দেখে ফুসে উঠলো কামিনী চৌধুরী। বাজখাঁই গলায় বলল,
-- এটা কেমন মশকরা আশমিন? বিয়ে করবে না মানে?এতো ঘটা করে অনুষ্ঠান করে লোকজন জানিয়ে এখন বলছো বিয়ে করবে না।মশকরা হচ্ছে এখানে!প্রেস,মিডিয়া সবাই জানে তুমি লারা কে বিয়ে করছো। সোসাইটি তে কতটা অপমান হতে হবে ধারণা আছে তোমার? বিয়ে আজকেই হবে এবং এক্ষুনি। কাজি ডাকো সানভি।
চিৎকার করে কথাগুলো বলে হাপিয়ে উঠলো কামিনী চৌধুরী। আশমিন ভাবলেশহীন ভাবে ফোন স্ক্রোল করে যাচ্ছে। সানভি অসহায় চোখে আশমিনের দিকে তাকালো। আশমিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে, ব্যস্ত গলায় বলল,
-- আর কারোর কিছু বলার আছে?সময় শেষ হচ্ছে। আর প্লিজ, কেউ মিসেস চৌধুরীর মতো এতো লম্ভা স্পিচ দিবেন না। সময় সল্পতা বুঝতেই তো পারছেন।
সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। লারা ভীতু চোখে আশমিনের দিকে তাকালো। নূরের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে একমনে নুডুলস খেয়ে যাচ্ছে।
কামিনী চৌধুরী ক্রোধে ফেটে পরলেন। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নূর কে টেনে দাড় করিয়ে হিসহিস করে বললেন,
-- সব তোর জন্য হয়েছে।আবার কেন এসেছিস এখানে?আমার ভাই কে খেয়ে শান্তি হয় নি?এখন আমার সংসারে আগুন লাগাতে এসেছিস।বেহায়া মেয়ে।লজ্জা নেই তোর?এভাবে আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙে দিতে বিবেকে লাগছে না?এই মুহুর্তে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাবি।তোর অপয়া চেহারা আর দেখতে চাই না এ বাড়িতে।
আশমিন চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে কামিনী চৌধুরীর দিকে।কিন্তু মুখে কিছুই বলছে না সে।লারার বাবা মা মুচকি মুচকি হাসছেন নূরের এই অবস্থা দেখে।নূর নুডলসের বাটি টা সানভির হাতে দিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,
-- খবরদার এখান থেকে খাবে না।শুধু ধরে দাড়াও।
কামিনী চৌধুরীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো নূর।নূরের নখ দেবে কিছুটা জায়গা তৎক্ষনাৎ কেটে গেলো। কামিনী চৌধুরী হালকা আর্তনাদ করতেই নূর নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে 'হুস' বলতেই থেমে গেলো সে। নূর তার হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,
-- গার্ডস,,,
সাথে সাথে বিশজন পালোয়ান সাইজের লোক এসে দাঁড়িয়ে গেলো নূরের চারিদিকে। নূর হুংকার দিয়ে বললো,
-- আবর্জনা পরিস্কার করো।রাইট নাও।আমার সামনে আমি কোন আবর্জনা দেখতে চাই না।
গার্ড গুলো সাথে সাথে সোফা সহ লারা আর তার পরিবারকে বাইরে ছুড়ে ফেললো। একজন মেয়ে গার্ড এসে কামিনী চৌধুরী কে ধরে নূর থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। আমজাদ চৌধুরী আশমিনের পাশে বসে তার ফোনের দিকে ঝুকে আছেন।আশমিন বাইক রেসিং গেম খেলছে সে সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। বাকি কোন কিছুতে তাদের খুব একটা আগ্রহ নেই।
সানভি ভয়ে কাপছে।আশমিনের এমন হেয়ালি ব্যবহার দেখে নূরের রাগ তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। হাতের থেকে ফোন টা নিয়ে সাথে সাথেই সমস্ত শক্তি দিয়ে দেয়ালে ছুড়ে মারলো। সানভি আর্তনাদ করে বললো,
-- কি করলেন ম্যাম।এতে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল।
-- আই ডোন্ট কেয়ার।(দাতে দাত চেপে)
কামিনী চৌধুরী পারছে না নূর কে কাচা চিবিয়ে খেতে।আমজাদ চৌধুরীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
-- বসে বসে তামাশা দেখছো? আমাদের গার্ডদের ডাকো।এই মেয়েকে এখানেই মেরে পুতে দিবো আমি।আমাকে পাওয়ার দেখানো হচ্ছে।এই কামিনী চৌধুরী কে!আশমিন, চুপ করে বসে আছো কেন?পুলিশ কে কল করো।একে এক্ষুনি জেলে ভরবো আমি।
আশমিন হালকা বিরক্তির চোখে তাকালো নূরের দিকে।যে এই মুহুর্তে চোখ দিয়েই তাকে ভষ্ম করতে ব্যস্ত।
আশমিন ইশারা করতেই গার্ড গুলো কামিনী চৌধুরী কে ছেড়ে বাইরে চলে গেলো।
-- মিসেস চৌধুরী কে নিয়ে ভিতরে যাও।
মেয়ে গার্ড টা আশমিনের কথা অনুযায়ী কামিনী চৌধুরী কে জোর করে ভিতরে নিয়ে গেলো। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-- তুমি কি ছেলে আর ছেলে বউয়ের রোমান্স দেখতে চাচ্ছো?
আমজাদ চৌধুরী চোখে রাঙিয়ে তাকালো আশমিনের দিকে। মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
-- বাবা হই তোমার।অসভ্যের মতো কথা বলছো কেন?আমি তোমার মতো মেনার্সলেস নই।
আমজাদ চৌধুরী হনহন করে চলে গেলো ভিতরে। আপাতত বউ কে ঠান্ডা করতে হবে। সানভি এখনো নুডুলসের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে। যাবে নাকি থাকবে সেই দ্বিধায় ভুগছে।
আশমিন সানভি কে কিছু একটা টেক্সট করতেই সানভি নুডলসের বাটি রেখে গন্তব্যের দিকে চলে গেলো।
আশমিন কয়েক কদম এগিয়ে নূরের সামনা সামনি দাড়ালো। সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট উচু করে শীষ বাজাতেই নূর বাকা হাসলো। মনে মনে কপাল কুচকালেও উপরে স্বাভাবিক থাকলো আশমিন।
-- লুকিং সো হট বেইব।
-- ইউ অলসো লুকিং লাইক আ লুজার।(বাকা হেসে)
-- রিয়ালি???(ঘার কাত করে)
-- ইয়াহ।
-- দেন মিট মি ইন মাই আরমস।আই প্রমিস ইউ,ইউ ওইল নট সে দিস এগেইন।
-- অশ্লীল।
আশমিন নিজেদের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো। নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,
-- নেতারা অশ্লীল ই হয়।তোমার সাথে আমার সম্পর্ক এর চেয়েও গভীর। ভুলে গেলে নাকি নূর?
-- সরে দাড়ান।কতো বার বলবো এভাবে কাছে আসবেন না (আশমিন কে সরানোর চেষ্টা করে)। আর কোন সম্পর্কের কথা বলছেন আপনি? সব সম্পর্ক আপনি নিজেই শেষ করেছেন। যেহেতু বিয়ে আর হচ্ছে না তাই আমি কালকেই ব্যাক করছি কানাডা।লিভ মি।
-- তোমাকে গর্ত থেকে বের করতেই এতো আয়োজন তেহজিব নূর।পালানোর কথা ভাবলে কি করে।মুক্তির স্বাদ আর এ জীবনে তোমার পাওয়া হবে না। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে।আমার বন্দিনী হয়ে।
আশমিনের চোখ গুলো রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। নূর সেদিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো। দাতে দাত চেপে ফিসফিস করে বললো,
-- আমার সাথে লাগতে আসবেন না মন্ত্রী সাহেব। পৃথিবীতেই জাহান্নাম ভ্রমণ করিয়ে আনবো।চিনেন তো আমাকে নাকি?
আশমিন হাতের বাধন আরেকটু শক্ত করলো। নূর কে নিজের সাথে আরেকটু নিবিড় ভাবে মিশিয়ে নিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। মন্থর গলায় নূরের মতো ফিসফিসিয়ে বললো,
-- আপাতত জান্নাত ভ্রমণ করতে চাইছি।ইউ ওয়ান্না গো উইথ মি?
নূর কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তার ঠোঁট আকড়ে ধরলো আশমিন।দুই মিনিটের মতো নিজের রাজত্ব চালিয়ে নূর কে ছেড়ে দিলো সে।নূর ক্ষেপা বাঘিনীর মতো আশমিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আশমিন ভাবলেশহীন ভাবে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতেই নূর আশমিনের পাঞ্জাবীর ঠিক দুই ইঞ্চি উপরে গলায় নিজের দাত বসিয়ে দিল।আশমিন বাধা দিল না।এমনকি নড়লো ও না।নিজের কাজ শেষ করে নূর সরে আসলো। আয়েশ করে সোফায় বসে আশমিনের গলার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে বললো,
-- আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না মন্ত্রী সাহেব। তাহলে এভাবে বার বার র*ক্তাক্ত হবেন।বাই দ্যা ওয়ে,গুড লাক ফর ইউর মিটিং।
আশমিন টিস্যু দিয়ে গলার হালকা র*ক্ত টুকু মুছে ফেললো। নূরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
-- এমন র*ক্তাক্ত আমি বারবার হতে চাই।
সানভি এসে আশমিনের হাতে কিছু ডকুমেন্টস দিতেই আশমিন সাথে সাথে সেগুলোতে আগু*ন লাগিয়ে দিলো। নূর হতভম্ব হয়ে গেলো আশমিনের এমন কাজে। আশমিন নিরীহ চোখ নূরের দিকে তাকালো।
-- মাই ফোন ইকুয়াল টু ইয়ুর পাসপোর্ট। হিসাব বরাবর তো?
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৫
অন্ধকার ছাদের এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে নূর। বিষন্নতার মরণবান বার বার আঘাত করছে তার বুকের ভিতর। মনে পরছে ছয় বছর আগের কথা।
বাড়ির সবছেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে নূর।রাফসান শিকদারের একমাত্র আদরের মেয়ে।নূরের পাচ বছর বয়সে তার মা মারা যায়। তখন থেকে নূরের বাবা নূর কে আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে।মেয়ের অবহেলা হবে ভেবে নিজে দ্বিতীয় বিয়ের কথা কখনো চিন্তা করে নি। স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা টা ও ছিল অমলিন। কামিনী চৌধুরী অবশ্য অনেকবার চেষ্টা করেছে ভাই কে বিয়ে করাতে। কিন্তু রাফসান শিকদার কখনো তার কথা পাত্তা দেয়নি।তার একটাই কথা, আমি বিয়ে করে নতুন সংসার করবো আর আমার নূর একা হয়ে যাবে তা আমি কখনো মানতে পারবো না। এই সংসার তারার ছিল আর তারার ই থাকবে।বিয়ে নিয়ে এটাই যেন এবাড়িতে তোমার শেষ কথা হয়।নূরের সামনে কখনো এব্যাপারে কোনো কথা বলবে না কামিনী।
তখন থেকেই নূরের উপর ক্ষোভ তৈরি হয় কামিনী চৌধুরীর।নূরের মা মিসেস তারা মারা যাওয়ার পর কামিনী চৌধুরী কানাডা থেকে তার পরিবার নিয়ে ভাইয়ের কাছে চলে আসে। আমজাদ চৌধুরী আলাদা বাড়ি করতে চাইলে বাদ সাধেন রাফসান শিকদার।তার এতো বড় বাড়ি থাকতে বোন বাইরে থাকবে তা সে কোন ভাবেই মানতে পারেন নি।তাই আমজাদ চৌধুরীর বাধ্য হয়েই নূর মঞ্জিলে থেকে যান।আশমিন তার বাবা মায়ের সাথে বাংলাদেশ আসে নি।সে কানাডায় হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো।ওখান থেকেই গ্রেজুয়েশন শেষ করে আসবে জানায় সে। নূর যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন আশমিন প্রথম বাংলাদেশে আসে। সবাই তাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গেলেও নূর যায়নি। আশমিনের তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ও ছিল না।কামিনী চৌধুরী নূরকে আশমিনের থেকে দূরে থাকতে বলেছে। তাই নূর আশমিনের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে চলতো।ব্যবসা আর রাজনীতিতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকায় নূর কে খুব একটা সময় দিতে পারতো না রাফসান শিকদার।বাবার সাথে দূরত্ব তখন থেকেই।রাফসান শিকদার নিজের বোনের কাছে নূরের দায়িত্ব তুলে দিয়ে অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তা সে ঘুনাক্ষরে ও টের পায়নি। কামিনী চৌধুরী নূর কে সারাক্ষণ লাঞ্চনা গঞ্জনা করতেই থাকতো। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকা আরো বেশি চুপ হয়ে গেলো। বাবার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো অভিমান।আশমিন দেশে আসার পরে রাফসান শিকদারের সাথেই বেশির ভাগ সময় কাটাতো।রাজনীতির উপর ছিল তার অপার আগ্রহ। রাফসান শিকদারও হাসিমুখে হাতে কলমে আশমিন কে সবকিছু শিখাচ্ছিলেন।
আশমিন বাংলাদেশে আসার দুই মাসের মধ্যে নূর একদিন ও তার সামনে আসে নি।প্রথম প্রথম অবাক লাগলেও আশমিন অতটা পাত্তা দেয়নি।
আশমিন বাংলাদেশে আসার ঠিক দুই মাস আট দিনের দিন রাতে অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ হয় নূরের সাথে।
সেদিন পার্টি ক্লাব থেকে আসতে অনেকটা রাত হয়ে যায় আশমিনের।বাসায় কেউ জেগে নেই ভেবে সে কলিং বেল না চেপে নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ভিতরে ঢোকে।ক্লান্ত পায়ে দুইতালায় উঠতেই কারো মোহনীয় গলা শুনে পা থমকে গেলো আশমিনের।কান খারা করে শুনতেই বুঝতে পারলো কন্ঠটা ছাদ থেকে আসছে।আশমিন এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে। নূর ছাদের চিকন রেলিঙের উপর বসে একমনে গাইছিল,
জানি একদিন আমি চলে যাবো সবই ছেড়ে
যত বুক ভরা দুঃখ কষ্ট নিয়ে, হো
জানি একদিন আমি চলে যাবো সবই ছেড়ে
যত বুক ভরা দুঃখ কষ্ট নিয়ে
ফিরবো না কোন দিন এই পৃথিবীতে
কোন কিছুর বিনিময় এই পৃথিবীতে
একদিন চলে যাবো
জানি একদিন আমি চলে যাবো সবই ছেড়ে
যত বুক ভরা দুঃখ কষ্ট নিয়ে, হো
জানি একদিন ভুলে যাবে সবাই
আমায়, আমার স্মৃতি মুছে যাবে ধরায়
ও, জানি একদিন এক মুহুর্ত
আরো মনে পড়বেনা আমার কথা
ফিরবনা কোনো দিন এই পৃথিবীতে
কোন কিছুর বিনিময় এই পৃথিবীতে
একদিন চলে যাবো
জানি একদিন আমি চলে যাব সবই ছেড়ে
যত বুক ভরা দুঃখ কষ্ট নিয়ে, হো
ছাদে আসতেই আশমিমের হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিল।কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে শান্ত করার চেষ্টা করলো নিজেকে। মনে হচ্ছে কোন বিষাদ নগরের রাজকুমারী ছাদের রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।আশমিনের মনে হলো এটা একটা বার্বিডল।কুকরানো কোমর পর্যন্ত চুল গুলো বাতাসের তালে তালে সেই পুতুলের মুখের উপর উড়ে আসছে বারবার। তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার।নূরের চোখ গুলো ঠিক বার্বি ডলের মতো। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটিকে আশমিনের কাছে একটা আদুরে বাচ্চা মনে হলো।
জানি একদিন দূর থেকে
দেখব সবার এই ভুলে যাওয়া
ও, জানি একদিন চোখ থেকে
পড়বে শুধু অশ্রুরি ধারা
ফিরবো না কোন দিন এই পৃথিবীতে
কোন কিছুর বিনিময় এই পৃথিবীতে
একদিন চলে যাবো
জানি একদিন আমি চলে যাবো সবই ছেড়ে
যত বুক ভরা দুঃখ কষ্ট নিয়ে
ফিরবো না কোনো দিন এই পৃথিবীতে
কোনো কিছুর বিনিময় এই পৃথিবীতে
একদিন চলে যাবো
জানি একদিন আমি চলে যাবো সবই ছেড়ে
যত বুক ভরা দুঃখ কষ্ট নিয়ে, হো
নূরের কন্ঠে এমন বিষাদ শুনে কপাল কুচকে গেলো আশমিনের । মেয়েটা কে তা নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। হঠাৎ করেই নিজের ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো আশমিন। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো নূরের দিকে।নূর তখনো আশমিনের উপস্থিতি টের পায়নি। আশমিন এক ঝটকায় নূর কে নামিয়ে আনলো রেলিং থেকে। তাল।সামলাতে না পেরে নূর ধাক্কা খেল আশমিনের শক্ত বুকে।
-- কে তুমি? এতো রাতে এখানে কি করছো?
আশমিনের কঠোর কণ্ঠস্বর মোটেও বিচলিত করলো না নূর কে। আশমিন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শান্ত গলায় জবাব দিলো,
-- আমি নূর মঞ্জিলের নূর।
শক্ত দৃষ্টি নরম হলো আশমিনের।অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে।
নূর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে পরলো।পিছনে না তাকিয়েই শান্ত অথচ শক্ত গলায় বলল,
-- এর পর থেকে এভাবে আমার কাছে আসবেন না মি. আশমিন জায়িন।আর ছোয়ার ভুল তো একেবারেই নয়।আই হেইট আনএক্সপেক্টেড টাচ।
আশমিন হা করে তাকিয়ে রইলো নূরের যাওয়ার দিকে।কি বলে গেলো মেয়েটা।আনএক্সপেক্টেড টাচ!
এতো তেজ?বাকা হাসলো আশমিন।নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে হাসি বিস্তর হলো তার।
পরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটে গেলো নূর আর আশমিনের জীবনে। আশমিন নূর কে মনে মনে ভালবাসলেও কখনো তা প্রকাশ করে নি। তবে রাফসান শিকদার ঠিকই বুঝতে পারলেন ভাগিনার মনের কথা।আশমিন তার মেয়ের অমর্যাদা কখনো করবে না এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। আশমিন কে জিজ্ঞেস করতেই আশমিন অকপটে স্বীকারও করে নিল।রাফসান শিকদার ভাবলো তার এই ঝুকিপূর্ণ জীবনে মেয়েকে আশমিনের মতো কারোর কাছে মেয়েকে দিয়ে যেতে পারলে মরে ও শান্তি পাবেন।ততদিনে নূরের এস এস সি দেয়া হয়ে গেছে। তবে আঠারো বছর হওয়ার আগে বিয়ে দেওয়া টা সম্মতি দিলেন না সে।কামিনী বেগম ভাইয়ের দেয়া প্রস্তাব সাথে সাথেই লুফে নিলেন। ছেলে একবার মন্ত্রী হয়ে গেলে ভাইয়ের এই অঢেল সসম্পত্তির মালিক তার ছেলেই হবে।নূর কে সরানো চুটকির ব্যপার। ছেলের মনের খবর সম্পর্কে না জেনেই ভয়ংকর পরিকল্পনা করে ফেললেন কামিনী চৌধুরী। আপাতত সিদ্ধান্ত হলো মাওলানা দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে রাখবে।নূরের আঠারো বছর হলে রেজিস্ট্রি করে ফেলবে।সবাই সায় দিলেও আশমিনের কপালে ছিল চিন্তার ভাজ।বিয়েটা নূর কিভাবে নিবে য়া নিয়েও সে যথেষ্ট চিন্তায় আছে।নূরের সেফটির জন্য বিয়ের কথাটা পাচকান হতে দেয়া যাবে না। তার দুর্বলতা ভেবে সবাই নূর কে টার্গেট করে ফেলবে।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৬
আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হবে।দমকা বাতাসে চারিদিকের গাছপালা দুলে দুলে উঠছে। বারান্দায় বসে একমনে সামনের কৃষ্ণচুরা গাছের দিকে তাকিয়ে আছে নূর।কৃষ্ণচুরা ফুলে গাছটি নতুন সাজে সেজেছে। সেদিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নূর।মেয়ে কে এক ধ্যানে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে দরজায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাফসান শিকদার। দরজায় নক করতেই নূর সেদিকে তাকালো।বাবা কে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মলিন হাসলো সে।
-- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন আব্বু।ভিতরে এসো।
-- কি করছিলে মা?এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল্র কেন?
(মুচকি হেসে ভিতরে আসতে আসতে)
নূর বাবার কথায় প্রতিউত্তর করলো না।রুমে এসে সোফায় বসলো। রাফসান শিকদার ও মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।মেয়েটা কতো বড় হয়ে গেছে। অথচ সে খেয়াল।করার ই সময় পায়নি। মেয়ে ও যে তার কাছে আগের মতো বায়নার ঝুড়ি নিয়ে বসে না।কেমন যেন দূরত্ব চলে এসেছে বাবা মেয়ের মধ্যে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো রাফসান শিকদার । মেয়েটা আগের থেকে আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে।
-- তুমি কি কিছু বলতে চাও আব্বু?
মেয়ের নির্লিপ্ত গলা শুনে হালকা কেপে উঠলো রাফসান শিকদার। মেয়ে তার মন পড়তে শিখে গেছে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নূর মলিন হাসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
-- দরকার ছাড়া তুমি আমার রুমে আসো না আব্বু।তাই এটা বোঝা খুব একটা কঠিন বিষয় নয়।নির্দিধায় বলতে পারো কি বলতে চাও।
রাফসান শিকদারের বুকে কিঞ্চিৎ ব্যথা হলো। প্রয়োজন ছাড়া কি আসলেই মেয়ের কাছে আসে না! অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে কি সে মেয়ে কে সত্যি সত্যি একা করে দিয়েছে!
-- এভাবে বলো না মা।তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ।যাকে আমি আমার বুকের লকারে নিয়ে ঘুরি।তোমার কাছে গল্প করতে আসতে পারি না আমি!
-- আসতেই পারো আব্বু।তবে গল্পের পাট আমাদের অনেক আগেই চুকে গেছে। আচ্ছা বাদ দাও,কফি খাবে?
-- নাহ মা।তুমি বলো, তোমার দিনকাল কেমন চলছে?
-- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আব্বু।
রাফসান শিকদার মেয়েকে বিয়ের কথা বলতে ইতস্তত করছে।মেয়ে এখনো ছোট। তার উপর আশমিন কে মেনে নিবে কিনা তারও একটা ব্যপার আছে। নূর তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
-- যা বলতে চাইছো বলে ফেলো আব্বু।
-- আমি তোমার বিয়ে ঠিক করেছি মা।আমি যে পেশায় আছি তাতে আমার জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আমি চাই যোগ্য কারোর হাতে তোমাকে তুলে দিয়ে যেতে। নাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না।আমাকে ভুল বুঝো না মা।
নূর এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে।বাবার ইতস্ততা বুঝতে পারছে সে।মলিন হেসে বাবা কে আস্বস্ত করা গলায় বলল,
-- আমি জানি তুমি আমার জন্য বেষ্ট ডিসিশন ই নিবে আব্বু।সমস্যা নেই।কবে বিয়ে করতে হবে বলে দিও।আমি রেডি থাকবো।
-- তোমাকে কিছু কথা বলি মা।মনযোগ দিয়ে শুনবে।পৃথিবী খুব কঠিন যায়গা। এখানে প্রত্যেক টা পদক্ষেপ আমাদের জন্য একেকটা পরিক্ষা। তাই নিজেকে সেভাবেই তৈরি করবে। তুমি যদি দুর্বল হও মানুষ তোমাকে বার বার আঘাত করবে।তাই নিজেকে শক্ত করো। নিজেকে ঠিক এতটা কঠোর করো যায়ে কেউ শত আঘাতেও তোমাকে ভাঙতে না পারে। সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ও ছাড় দেয়া যাবে না। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?
নূর তার বাবার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রাফসান শিকদার মুচকি হাসলেন। কিছু কাগজ পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে নূরের হাতে দিলেন।
-- এখানে আমাদের সমস্ত প্রোপার্টির দলিল রাখা আছে।তোমার বাইশ বছর বয়সে তুমি সব নিজের কাছে পাবে।এই জায়গায় হদিস তুমি বাদে আর একজন শুধু জানে।সে আমার কাছে ঠিক তোমার মতোই বিশ্বস্ত। তুমি হয়তো জানো না,আমি তোমার বিয়ে আশমিনের সাথে ঠিক করেছি।
রাফসান শিকদারের কথা শুনে চমকে উঠলো নূর। মেয়ের মুখ দেখে হেসে উঠলেন রাফসান শিকদার। মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
-- আশমিন খুব ভালো ছেলে। তোমাকে ভালবেসে আগলে রাখবে দেখো।তোমরা আমার ঠিক দুটো হাতের মতো। আশমিন আমার রাজনীতির দিকটা সামলাবে আর তুমি বিজনেস।তুমি নিজেকে তৈরি করার আগ পর্যন্ত সবকিছু আশমিন দেখবে।সময় হলে বুঝে নিও তুমি।বাবার উপর একটু ভরসা রেখো মা।ঠকবে না।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন তিনি। এদিকে নূর ভাবনায় পরে গেলো। কামিনী চৌধুরী বিষয় টা স্বাভাবিক ভাবে নিবেন না।
এক সপ্তাহের মাথায় হুজুর ডেকে আশমিন আর নূরের বিয়েটা হয়ে গেলো। কামিনী চৌধুরী হাসি মুখেই ছিল সারাটা সময়।নূরের প্রতি মেকি ভালবাসা ও দেখিয়েছে খুব।নূর শুধু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছে।নূরের মতো আশমিন ও ছিল নির্লিপ্ত। তার কথা মতোই বাইরের কাউকে তাদের বিয়ে নিয়ে কিছু জানানো হয় নি। নূরের ও এতে কোন মাথা ব্যথা নেই। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করেই কেউ বিয়ের আসরে বসতে পারে তা নূর কে না দেখলে বুঝতেই পারতো না আশমিন।সে ও ট্রেডমিল থেকে নেমেই এখানে এসেছে।অবশেষে হুজুরের কথায় অজু করে এসে কবুল বলেছে দুজন।তাদের বিয়েতে না ছিল কোন সাজসজ্জা আর না ছিল কোন আয়োজন।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই নূর নিজের রুমে গিয়ে আবার শুয়ে পরেছে।আজ সে সারাদিন ঘুমাবে।আশমিন নিজের রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে সোজা নূরের রুমে গেলো। নূর ততক্ষণে গভীর ঘুমে।ঘুমন্ত নূর কে কোলে করে নিজের রুমে নিয়ে এলো আশমিন।নূরের ঘুম ভেঙে গেছে নড়াচড়ায়।চোখ খুলে অবাক হয়ে বললো,
-- কি করছেন এসব? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?নামান বলছি।
-- পালকি করে নেয়ার অপশন নেই আপাতত। তাই কোলে করেই তোমাকে তোমার স্বামীর রুমে নিয়ে যাচ্ছি। বাই দ্যা ওয়ে,ইটস টোটালি এক্সপেক্টেড টাচ।সো বি কোমফোর্ট ডিয়ার।
আশমিনের কথা শুনে নূর লজ্জা পেয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে চুপ করে রইলো আশমিনের বাহুতে। আশমিন তা দেখে বাকা হাসলো। নিজের রুমে ঢুকে নূর কে বেডে নামিয়ে দিয়ে নূরের রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
-- ও মাই আল্লাহ! তুমি লজ্জা পাচ্ছো?এ ও সম্ভব!
নূর কোন উত্তর না দিয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে পরলো। আশমিন ও মুচকি হেসে নূরের পাশে শুয়ে নূরের কানে ফিসফিস করে বললো,
-- আমার শূন্য বুক অনেকদিন তোমার অপেক্ষায়। এখানে একটু মাথা রাখবে নূর?ভয় পেয় না।তোমার অনুমতি ছাড়া কিছুই করবো না। সম্পর্কের পূর্ণতা তুমি তখনই পাবে যখন আমার মনে হবে তুমি আমার ভালবাসা সহ্য করার জন্য তৈরি। ততদিন না হয় আমরা প্রেম টা আয়েশ করে করি।কি বলো?
নূর চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেললো। এই লোক এখন প্রেমের কথা বলছে!অথচ সে কবেই তার প্রেমে বরফের মতো জমে বসে আছে। এই প্রেমে প্রকাশ হওয়ার ভয়েই তো তার থেকে নিজেকে এতো দূরে রাখা।আশমিন একহাতে নূরের কোমড় টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। নূরের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,
-- ঘুমাও।আজ সারাদিন ঘুমিয়ে নাহয় আমরা বাসর দিন উৎযাপন করবো। তুমি চাইলে আমি কয়েকটা চুমু ও খেতে পারি।আমাকে কিপটে ভেবো না।বর হিসেবে আমার মন অনেক বড়।
বলতে বলতেই নূরের সারা মুখে চুমু খেয়ে ফেললো আশমিন।
-- নাও প্রমাণ দিয়ে দিলাম।
নূর হা করে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে।মনে মনে বিরবির করলো,
-- অসভ্য।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৭
বিয়ের ছয় মাসের মাথায় কামিনী চৌধুরী হঠাৎ করেই নিজের আগের রুপে ফেরা শুরু করে। কথায় কথায় নূর কে অলক্ষি অপয়া বলে অপমান অপদস্ত করতে থাকে।নূর তাতে খুব একটা পাত্তা দেয় নি।নিজের মতো করে জীবন কাটাতে থাকে সে।আশমিন কিংবা রাফসান শিকদার কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলতো না নূর।এর মধ্যেই তাদের জীবনে আবির্ভাব ঘটে লারা নামক রমনীর।কানাডায় আশমিনদের প্রতিবেশি ছিল তারা।লারা আশমিন কে ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতো। তবে এক আশমিনে মজে থাকার মেয়ে লারা না।কানাডায় আরো অনেক ছেলেদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। ম্যাডিসন নামের এক ছেলের সাথে দুই বছর লিভ ইন রিলেশনে ছিল সে।কিছুদিন আগে কামিনী চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ হলে কামিনী চৌধুরী আশমিনের কথা বলে লারা কে।এ ও বলে যে,কয়েকদিন পরেই আশমিনের ডিভোর্স হয়ে যাবে।আশমিন কে পেতে চাইলে লারা যেন বাংলাদেশে চলে আসে। লারা ও ম্যাডিসন কে কিছু না জানিয়েই বাংলাদেশ চলে আসে।লারার বাবা মা ও মেয়ে কে পূর্ণ সমর্থন করে। লারার বাবা কানাডার অনেক বড় বিজনেস ম্যান।ভাইয়ের সম্পত্তি তো এখন তাদের ই। সাথে লারার টা পেলে সোনায় সোহাগা। কামিনী চৌধুরীর এর কুৎসিত পরিকল্পনার কথা কেউ জানতে পারলো না।কয়েকদিনের মধ্যেই লারা এসে হাজির হলো নূর মঞ্জিলে।বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা না ঘামালেও গম্ভীর হয়ে রইলেন আমজাদ চৌধুরী।এতিম আমজাদ চৌধুরী পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় স্কলারশিপ নিয়ে যায় কানাডায়। বাবা মা মারা যাওয়ার পর নিজেদের অনাথ আশ্রমেই বড় হয় সে।পুর্নবয়স্ক না হওয়ায় বাবার সম্পত্তি সব ম্যানেজার সামলাতো।বিশ বছর বয়সে সম্পত্তি সব নিজের নামে আসার পর বাংলাদেশের বিজনেস গুটিয়ে কানাডায় পারি জমায় আমজাদ চৌধুরী।দেশের অনাথ আশ্রম সে নিজের আরেকটা ঘর মনে করে। অনাথ আশ্রমের দায়িত্বে থাকা ফাদার দেখাশোনা করে সব কিছু। সমস্ত খরচ আমজাদ চৌধুরী নিজেই চালায়। কানাডায় গিয়েই কামিনী চৌধুরীর সাথে পরিচয়। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন কামিনী চৌধুরী কে। রাফসান শিকদার ও তাতে আপত্তি করে নি।বাবা মা মরা বোন কে সে খুব আদরে মানুষ করেছে।তাই তার সুখ ই মূখ্য। দুজনে একসাথেই কানাডায় পড়াশোনা করতো। কখনো বুঝতেই পারে নি তার প্রেয়সীর ভিতরে এতো কুৎসিত।
লারা আসার পর থেকে আশমিন খুব কম কথা বলতো লারার সাথে। নির্বাচন মাথায় নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছে রাফসান শিকদার ও আশমিন।বিরোধি দলিয় নেতা আয়মান তালুকদার উঠে পরে লেগেছে তাদের পেছনে। আশমিনের চমৎকার বুদ্ধিমত্তার জন্য কিছুতেই পেরে উঠছে না। তবে হাতে গুটিয়ে বসে নেই সে।শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। নির্বাচনী প্রচারণর জন্য নূর কেউ খুব একটা সময় দিতে পারছিল না আশমিন।বহু কষ্টে সময় বের করলেও লারার জন্য তা কোন না কোন ভাবে নষ্ট হয়ে যেত।আশমিন রেগে কিছু বলতে গেলে নূর তাকে থামিয়ে দিত।বাড়ির মেহমানের সাথে এমন আচরণ মোটেই শোভনীয় নয়।সেই সুযোগ ই লুফে নিতে লাগলো লারা।দূরত্ব সৃষ্টি হলো আশমিনের সাথে নূরের।মাঝে মাঝে রাতেও দেখা হতো না দুজনের। গভীর রাতে এসে আবার ভোরেই বেড়িয়ে যেতো আশমিন। অন্তর্মুখি হওয়ায় নূরের খুব একটা বন্ধু ছিল না।একমাত্র তানভীর সাঈদ ই ছিল নূরের ছোট বেলার বন্ধু। দুজন দুজনের প্রাণ টাইপের বন্ধুত্ব তাদের।
তাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় হয়ে আসে তানভীরের জন্মদিনের দিন।রাতে পার্টি থাকায় নূর আর কলেজে যায় নি।সারাদিন বাসায় থাকার প্ল্যান করে সে।বাবার সাথে ও খুব একটা দেখা হয় না তার।একাকিত্বে অভ্যস্ত সে।তবে মাঝখানে আশমিনের যত্ন তার অভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এখন খুব শূণ্যতা অনুভব হয় আশমিন কে ছাড়া। নিজের রুমের বারান্দায় বসে ছিল নূর। ফোনের ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠতেই ভ্রু কুচকে গেল তার। এসময়ে আবার কে ম্যাসেজ দিচ্ছে? মন্ত্রী সাহেব নয়তো? মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে মেসেজ অপশনে ঢুকতেই চোখ স্থির হয়ে গেলো নূরের।ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আশমিন আর একটা মেয়ের অন্তরঙ্গ ছবি। কোন এক অভিজাত হোটেল রুমে বিবস্ত্র এক নারী কে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে আশমিন। এতটা ঘনিষ্ঠ আজ পর্যন্ত তারা ও হয়ে উঠে নি। নির্লিপ্ত ভাবে চোখ সরিয়ে নিলো নূর। ফোনটা যায়গা মতো রেখে আগের মতো প্রকৃতিতে বিভোর হলো সে।সন্ধ্যায় রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো তানভীরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। নূর কে বোনের নজরেই দেখে তানভীর। জজন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় দশটায়। অথচ নূর জানতেই পারলো না সন্ধ্যা সাতটায় তার একমাত্র অবলম্বন তার বাবা তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে সন্ত্রাসীদের গু*লিতে।কয়েক হাজার কল এসে জমা হয়েছে নূরের ফোনে।আশমিনের লাস্ট ম্যাসেজ ছিল,
"কোথায় তুমি নূর?যেখানেই থাকো তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসো।মামার গু*লি লেগেছে।তোমাকে দেখতে চাইছে।নাহয় আমাকে বলো কোথায় আছো?আমি তোমাকে পিক করছি।একা বের হওয়ার দরকার নেই। প্লিজ ফোন রিসিভ করো জান আমার।আমার খুব টেনশন হচ্ছে"
মিনিট কয়েক পরেই আশমিনের ফোনে ম্যাসেজ এলো,
"আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি ব্যস্ত আছি।এখন আসতে পারবো না। গু*লি ই তো লেগেছে।মরে তো আর যায় নি।আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।গীতিকারের সাথে কথা বলছি।সব ঠিক থাকলে আজকেই আমার ক্যারিয়ারের সূচনা হয়ে যাবে।আপনার অনুপস্থিতিতে এই গান ই আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। তাই সবার আগে আমার ক্যারিয়ার"
শক্ত চোখ ম্যাসেজ পড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো আশমিন।এটা নূরের ম্যাসেজ নয়।হতে পারে না। তার নূর এমন কথা কিছুতেই বলতে পারে না। কোথায় নূর?
এদিকে নূরের অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা বারান্দা থেকে তুলে নিয়েছে কামিনী চৌধুরী। আশমিন কে ম্যাসেজ সেই করেছে। লারা তানভীরের সাথে নূরের কয়েকটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল কামিনী চৌধুরীর কাছে। কামিনী চৌধুরী নূরের ফোন থেকে সে ছবি আশমিনের মোবাইলে সেন্ড করে দিল। ছবি দেখার আগেই খবর এলো ব্যস্ততম পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে রাফসান শিকদার। ঘামে লেপ্টে যাওয়া শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো আশমিন।আমজাদ চৌধুরী ও স্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু হাপ ছেড়ে বাচলো কামিনী চৌধুরী। এই বিশাল সম্রাজ্য এখন তার।একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক করতে না পারলে ও কান্নার অভিনয় করলো পাক্কা অভিনেত্রীদের মতো। হাসপাতালের বারান্দায় ভাইয়ের শোকে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করা বোনের আর্তনাদ ফলাও করে প্রচার করা হলো। আশমিন এসে সামলে নিলো মা কে।আমজাদ চৌধুরী স্ত্রীর অভিনয় বুঝেও চুপ করে রইলেন। মৃতদেহ নিয়ে নূর মঞ্জিলে পৌছানোর একঘন্টা পরে বিধ্বস্ত অবস্থায় খালি পায়ে দৌড়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো নূর।নিউজ দেখে সে দৌড়ে এসেছে সারা রাস্তা।পা থেকে রক্ত ঝড়ছে সমানে।সেদিকে হুস নেই নূরের।বাবার মৃতদেহের সামনে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো নূর।কাপা কাপা হাতে হাত বুলিয়ে দিলো বাবার শান্ত মুখশ্রী তে।লাশের বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আজ থেকে এই বুকটা চিরদিনের মতো হারালো সে।তার আব্বু আর নেই ভাবতেই নিঃশ্বাস আটকে আসছে নূরের।তার থেকে কয়েক হাত দূরত্বে বসে আছে আশমিন।তার পাশেই গা ঘেঁষে বসে লারা।সেই মুহুর্তে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষের পরিচয় দিল কামিনী চৌধুরী। নূর কে টেনে সরিয়ে নিলো রাফসান শিকদারের বুক থেকে।পর পর কয়েকটা চর লাগিয়ে দিল তার গালে।আসার পর থেকে একবিন্দু পানি ও চোখ থেকে বের হয় নি নূরের।থাপ্পড় খেয়েও সে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন চোখ সরিয়ে নিলো তার থেকে।নূর নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো আশমিনের মুখ ফিরিয়ে নেয়া।আরেকদফা শক্ত করলো নিজেকে।কামিনী চৌধুরী একের পর এক অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে তার উপরে।
-- বেহায়া চরিত্রহীন মেয়ে মানুষ। বাবার মৃত্যুর আগেও তার সাথে দেখা না করে পরপুরুষের সাথে রঙঢঙ করে এখন এসেছে নাটক করতে।নষ্টা মেয়ে কোথাকার।লজ্জা করে না এমন নোংরামি করতে।আমার ভাইয়ের আসেপাশে ও আসবি না তুই।তোর এই কলঙ্কিনী মুখ নিয়ে বেড়িয়ে যা এখান থেকে।
কামিনী চৌধুরীর দিকে একপলক তাকিয়ে নূর আশমিনের সামনে গিয়ে দাড়ালো। শান্ত গলায় বললো,
-- আপনার কিছু বলার আছে মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকালো নূরের দিকে। ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
-- যে মেয়ে নিজের বাবার ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না সে আমার ভালোবাসার মূল্য দিবে কিভাবে।বাবার মৃত্যু থেকে যার ক্যারিয়ার বড় সে মেয়েকে আমি আমার জীবনে চাই না। দেখা গেলো আমাকে মৃত্যু মুখে রেখে সে নিজের স্বপ্ন পুরন করতে চলে গেলো। এই নূর কে আমি ভালোবাসি নি।তাই এই নূরের জায়গা আমার জীবনে নেই। গো টু হেল উইথ ইয়োর ফা*কিং ড্রিম।
নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। তার চোখে বাবা হারানোর শোক নেই।স্বামীর প্রতারণা, অবিশ্বাস, ধোকা কোন কিছুর জন্য কোন অনুভূতি নেই। চোখে নেই একবিন্দু নোনাজল। আশমিনের সামনে থেকে বাবার লাশের পাশে গিয়ে বসলো নূর।বাবা কে জরিয়ে ধরে ক্লান্ত গলায় বলল,
-- তুমি মানুষ চিনতে ভুল করেছো আব্বু।অযোগ্য মানুষের হাতে নিজের মূল্যবান রত্ন তুলে দিয়েছো।আমাদের শেষ দেখা টা সুখকর হলো না আব্বু। যে শূণ্যতা নিয়ে তুমি চলে গিয়েছো আমাকে তা সারাজীব বয়ে বেরাতে হবে।পরপারে ভালো থেকে আমার সুপার হিরো।আমি তোমার রত্নের যত্ন নিবো।
কামিনী চৌধুরী তেড়ে আসতে নিতেই আমজাদ চৌধুরী তাকে শক্ত হাতে থামিয়ে দিল।ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিল ফলাফল ভালো হবে না। স্বামীর কড়া চাহনিতে থেমে গেলো কামিনী চৌধুরী। কটমট করে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে।
বাবার কপালে চুমু খেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো নূর।রাফসান শিকদার কে দাফন করতে নিয়ে যাওয়ার সময় ও নিচে আসেনি সে।তানভীর সারাটা সময় চুপচাপ সব কিছু দেখে যাচ্ছিল। নূরের এই শান্ত ব্যবহার ভাবাচ্ছে তাকে।নূরের পিছুপিছু সেও এসেছিল এখানে।কামিনী চৌধুরীর নূর কে আঘাত করার সময় যখন সে রেগে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নূরের ইশারায় থেমে যায় সে।তখন থেকে সারা শরীর রাগে জ্বলছে তার।
রাফসান শিকদারের দাফন শেষ হলো রাত দুই টায়।দলীয় নেতা সহ হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে।বিরোধী দলীয় নেতা আয়মান তালুকদার ও এসেছে জানাজায়।সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো খু*নিকে ধরার জন্য। আশমিন হিংস্র বাঘের মতো শত্রুদের একে একে শেষ করতে লাগলো। তবুও কোথাও কোন লিংক পাওয়া যাচ্ছিল না।সারারাত বাইরে কাটিয়ে ভোরে বাসায় আসে আশমিন।রক্তজবার মতো লালা চোখ নিয়ে রুমে ঢুকেই শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য বাবা হারানো মেয়েটির দিকে ফিরে ও তাকায় না।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় সে। সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নূর।চোখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে লতা মঙেস্কারের গাওয়া গানের কয়েকটা লাইন গাইলো,
Lag ja gale ke phir yeh
Haseen raat ho na ho…
Shayad phir iss janam mein
Mulaqaat ho na ho
Lag ja gale… ae… ae…
Humko mili hain aaj yeh
Ghadiyaan naseeb se
Humko mili hain aaj yeh
Ghadiyaan naseeb se
Jee bhar ke dekh leejiye
Humko qareeb se
Phir aap ke naseeb mein
Yeh baat ho na ho…
Shayad phir is janam mein
Mulaqaat ho na ho
Lag ja gale… ae… ae…
কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো আশমিনের চোখ থেকে।তানভীরের সাথে নূরের ছবি গুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।নূর কে সে অবিশ্বাস করছে না।তবে এই মুহুর্তে নূর কে বাচাতে তাদের মধ্যে দূরত্ব জরুরি। যতই কষ্ট হোক না কেন, কাল পর্যন্ত অপরাধী কে বোঝাতে হবে তার জ্বালে আশমিন ফেসেছে।নূরের প্রতি দুর্বলতা দেখালেই সে নূরের উপর আক্রমণ করবে।অজানা শত্রু কে আর সুযোগ দেয়া যাবে না।
বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে আশমিন। এত বড় প্রাপ্তিতে ও তার চোখে মুখে খুশির লেশ মাত্র নেই।পার্টি অফিসের সমস্ত কাজ শেষ করে বাসায় আসতেই ভ্রু কুচকে গেলো তার। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে আছে।একমাত্র কামিনী চৌধুরী আর লারা কেই প্রফুল্ল দেখালো।আমজাদ চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে। আশমিন খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসে পরলো। চারিদিকে ফুলের তোড়ায় ভরে গেছে। সবাই শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুল পাঠিয়েছে।
-- নূর কোথায় আব্বু?
-- তাকি দিয়ে তোমার কি দরকার?
আমজাদ চৌধুরীর কর্কশ গলা শুনে থতমত খেয়ে গেল আশমিন।অজানা ভয়ে বুক কেপে উঠলো। বার কয়েক নূর কে ডেকেও যখন সারা পাওয়া গেলো না তখন আশমিন উত্তেজিত হয়ে দ্রুত পায়ে সারা বাড়ি খুজলো।আশমিনের চিৎকার শুনে কামিনী চৌধুরী সহ সবাই হাজির হলো বিশাল ড্রয়িং রুমে। আশমিন দৌড়ে এসে আমজাদ চৌধুরীর সামনে দাড়িয়ে কাপা কাপা গলায় বলল,
-- নূর কোথায় আব্বু।
-- চলে গেছে।
আশমিন বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। মহুর্তেই ভয়ের জায়গায় চোখে এসে ভীড় করলো ক্রোধ। চিৎকার করে বললো,
-- চলে গেছে মানে?কোথায় গেছে নূর?আমি বলেছিলাম না নূর যাতে বাসা থেকে বের না হয়।কে বের হতে দিয়েছে ওকে?
আশমিনের ভয়ংকর রুপ দেখে কেপে উঠলো কামিনী চৌধুরী। কপালের ঘাম কাপা কাপা হাতে মুছে লারার দিকে তাকালো। তার ও একই অবস্থা। থরথর করে কাপছে সে।
আমজাদ চৌধুরী কামিনী চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাড়ালো। রক্ত চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
-- মা মরা মেয়েটা তো তোমার নিজের রক্ত ছিল কামিনী।তার উপর কিসের এতো রাগ তোমার বলতে পারো? ছোট থেকে তাকে অবহেলা অপমান করে তার কোমল হৃদয় টা তুমি বিষিয়ে দিয়েছো।আমি বাধা দিলে আমাকেও কথা শোনাতে ছাড় নি।ভাইজান একটা কোমল ফুল তুলে দিয়েছিল তোমার হাতে।অথচ তুমি তার জীবন টা কাটায় ভরে দিয়েছো।এই বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারি কতবেলা না খেয়ে কাটিয়েছে তার কোন হিসেব নেই।সব কিছুতো মেয়েটা মেনেই নয়েছিল।তাহলে তাকে এভাবে ঘর ছাড়তে বাধ্য করলে কেন?তার চরিত্রে সবার সামনে দাগ লাগালে কেন?উত্তর দাও কামিনী।
স্বামীর এহেন রুপে কলিজা শুকিয়ে গেলো কামিনী চৌধুরীর।আশমিন অবাক চোখে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো কামিনী চৌধুরী।
আশমিন যেন বোবা হয়ে গেলো। টলমল পায়ে দেয়ালের উপর হাত রেখে নিজেকে সামলালো।
মরার উপর খারার ঘা হয়ে আগমন হলো তানভীরের।কারোর দিকে না তাকিয়ে নিজের ফোনটা কানেক্ট করে দিল ড্রয়িং রুমের টিভিতে। সাথে সাথেই টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠলো নূরের পরিশ্রান্ত পরাজিত মুখখানা।ভিডিও টি গাড়ির ভিতরে বসে করা।আশমিন দৌড়ে এসে দাড়ালো টিভির সামনে। কাপা কাপা হাতে ছুয়ে দিলো নূরের মুখখানা।
-- জয়ের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা মন্ত্রী সাহেব। আপনার এই সাফল্য ভরা জীবনে আমার মতো অপয়া থাকা মানায় বলেন? ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয় মন্ত্রী সাহেব। ভালোবাসায় ভরসা থাকতে হয়।কোন ঠুনকো আঘাত যদি তা ভেঙ্গে দেয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কোন ভালোবাসা ছিল না।পুরো টাই অভিনয় বা মোহ।আপনার বেলায় ঠিক কোনটা বুঝতে পারছি না। আপনি যখন বলেই দিয়েছেন আমি আপনাকে আর কি ভালোবাসবো?নিজের বাবা কেই তো ভালোবাসতে পারি নি তখন আর নিজের হয়ে কোন সাফাই আমি দিবো না।আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে সমস্ত সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়ে চলে যাচ্ছি । প্রমাণস্বরূপ এই ভিডিও টি আপনার কাছে রেখে দিতে পারেন।যেহেতু আমাদের বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন হয়নি সেহেতু ডিভোর্স পেপার দিতে পারলাম না। ভিডিও শেষে আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে।দেখে নিবেন প্লিজ । মিসেস চৌধুরীর কে টেনশন করতে নিষেধ করবেন।আমি নামক বোঝা সারা আপাতত বিদেয় হচ্ছি।তবে আমি ফিরবো। আমার আব্বুর খু*নীদের ভয়ংকর মৃত্যু দিতে আমি ফিরবো। কিন্তু আপনার জীবনে কখনো না মন্ত্রী সাহেব। কষ্ট দিয়েছেন আমায়।অবিশ্বাসের আগুনে জ্বা*লিয়ে আমাকে মে*রে ফেলেছেন আপনি। লাশের কি কারোর প্রতি ভালোবাসা থাকে বলেন?ভালবাসার বি*ষে আপনার হৃদয় বিষাক্ত হোক এই দোয়া রইলো। আমার ফিরে আসা পর্যন্ত জীবন টাকে উপভোগ করুন।নূর ফিরে আসলে স্বস্তির নিশ্বাস নেয়া দুস্কর করে দিবে। রাফসান শিকদারের নেয়ে তেহজিব নূর শিকদারের ওয়াদা এটা।
নূরের জ্বলন্ত চোখের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো আশমিন।নূরের ভিডিও বন্ধ হতেই স্ক্রিনে সেদিনের আশমিনের ছবি গুলো ভেসে উঠলো। রাফসান শিকদারের মৃত্যুর দিন সকালেই পাঠানো হয়েছে নূরকে।আশমিন একের পর এক ধাক্কা সামলাতে পারলো না। মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেলো। অতিরিক্ত চাপের ফলে মাইনর এট্যাক হয়ে গেলো তার। আমজাদ চৌধুরী মেঝেতে লুটিয়ে পরা ছেলেকে ধরে চিৎকার করে কেদে উঠলো। সিংহের মতো দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ টাকে এভাবে দেখে সবার চোখে অশ্রুরা ভীর করলো। দেহরক্ষীরা আর তানভীর মিলে আশমিন কে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গেলো। আমজাদ চৌধুরী ছেলের সাথে যেতে নিয়ে স্তব্ধে বিমূঢ় কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল
-- আমার ছেলের কিছু হলে তোমাকে আমি নিজের হাতে খু*ন করবো কামিনী। ভুল করেও নিজের এই নোংরা চেহারা আমার ছেলের সামনে নিয়ে আসবে না।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৮
আব্বুর গাড়ির ড্রাইভারের খোঁজ পেয়েছো অমি?
-- পাইনি ম্যাম।লোকটা হয়তো দেশে নেই।তার গ্রামের বাড়িতে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম তার পুরো পরিবার ওইদিনের পর থেকে নিখোঁজ। কোথাও তাদের পাওয়া যায় নি।
-- মন্ত্রী সাহেব এসেছেন?
-- না ম্যাম।তবে রাস্তায় আছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
-- ঠিক আছে। তুমি এখন যাও।
অমি নামের ছেলেটা নূরের পার্সোনাল সেক্রেটারি। তার এক কথায় সে জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত। প্রচুর বিশ্বাসী হওয়ায় নূর তাকে সব সময় কাছে কাছেই রাখে।
এতক্ষণ নিজের রুমেই কথা বলছিল তারা।অমি বেরিয়ে যেতেই নূর সোফা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালো। আজ আকাশে চাঁদ নেই।মেঘের কবলে পুরো আকাশ।খনে খনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশের থেকে চোখ সরিয়ে নিচে তাকাতেই আশমিনের গাড়ি ঢুকতে দেখলো নূর। কালো দশটা গাড়ির দ্বিতীয় গাড়ি টা আশমিনের। সেদিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো নূর।
-- আপনি আমাকে নিয়ে আসেন নি মন্ত্রী সাহেব। আমি চেয়েছি তাই আজ আমি এখানে।শত্রুকে কখনো চোখের আড়াল করতে নেই।তাকে সব সময় রাখতে হয় চোখের সামনে।আপনি আমার শত্রু নন।আপনি আমার জয়। আপনাকে হারিয়েই তো আমি বার বার জয়ের স্বাদ গ্রহণ করবো।তাই আপনি থাকবেন আমার চোখের সামনে।যতটা সামনে থাকলে আপনার প্রতিটি লোমকুপের খবর ও আমি জানবো ঠিক ততটা কাছে।রাফসান শিকদারের মেয়ে আমি।তার রক্ত।আপনি যা এতো বছর শিখেছেন তা আমার জন্ম থেকেই শেখা।আমার রক্তে রাজনীতি। তাহলে এখন না হয় সমানে সমানে টক্কর টা হয়েই যাক। প্রতি মুহূর্ত আপনি ভয় পাবেন।আমাকে হারানোর ভয়।আর আমি আপনাকে সেই পরিস্থিতিতে এনে দাড় করিয়ে দিবো।
কথা গুলো বলে হাসলো নূর।সাদা গ্রাউনের সাথে হালকা গোলাপি ওড়না টা গলায় পেচিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল নূর।ততক্ষণে আশমিন বাসায় এসে ঢুকেছে।ড্রয়িং রুমে সানভির সাথে দাঁড়িয়ে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছে হয়তো। নূর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি গিয়ে তার বাবার জন্য বরাদ্দকৃত কাউচে গিয়ে বসে পরলো। রাফসান শিকদার মারা যাওয়ার পর থেকে এখানে আর কেউ বসে নি।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আশমিন স্বাভাবিক ভাবে একপলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো। সানভি কাপা কাপা গলায় বলল,
-- স স্যার।
আশমিন বিরক্ত চোখে তাকালো সানভির দিকে।আশমিনের দৃষ্টি দেখে সানভি আর কিছু বললো না।কামিনী চৌধুরী রুমেই ছিল।নূর অমি কে বললো সবাই কে ডেকে নিয়ে আসতে।অমি মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো সবাই কে ডাকতে।
কামিনী চৌধুরী এসে নূর কে রাফসান শিকদারের কাউচে দেখে ক্ষেপে গেলো।তেড়ে তার দিকে যেতে নিতেই নূর বিরক্ত চোখে তাকালো। পাশে থাকা মেয়ে গার্ড টা আটকে দিলো তাকে।কামিনী চৌধুরী সেদিকে তোয়াক্কা না করে চিৎকার করে বললো,
-- এখানে বসেছিস কোন সাহসে?বেহায় মেয়ে, লজ্জা করলো নাএ বাড়িতে এসে আবার নিজের কলংকিত মুখ সবাকে দেখাতে?আজকেই বেড়িয়ে যাবি এখান থেকে।
আশমিন ক্লান্ত চোখে সবকিছু দেখছে।বিরক্তি আর রাগ তরতর করে বেড়ে চলেছে তার।কামিনী চৌধুরীর পিছনেই আমজাদ চৌধুরী এসেছিলেন। তিনি এতক্ষণে বসে পড়েছেন সোফায়।আশমিন ও গিয়ে বাবার পাশে বসে পড়লো।
নূর কামিনী চৌধুরীর দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে। মেয়ে গার্ড টা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-- আগামী দশ মিনিট আমি কোন রকম ডিস্টার্বেন্স চাই না।তাই এই মহিলার মুখটা বন্ধ করে দাও।এতে যদি অন্য কারোর সমস্যা হয় তাহলে তাদের ক্ষেত্রে ও এপ্লাই করতে পারো।
আশমিন সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে।মাথা ব্যথায় দপদপ করছে।চোখ খুলে রাখা ও দায়।তবুও সে এখানে বসে আছে। মেয়ে গার্ড টা ততক্ষণে কামিনী চৌধুরীর মুখে টেপ লাগিয়ে দিয়েছে। হাত দুটো ধরে থাকায় কামিনী চৌধুরী কিছু করতে পারছে না। শুধু আগুন চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলেও সে চুপ করে আছে।কামিনী চৌধুরীর অন্যায়ের কাছে এটুকু কিছুই না।
-- আপনাদের এখানে ডাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার কিছু সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া।যাতে পরবর্তীতে আমার কোন সমস্যা ফেস করতে না হয়। যেহেতু এতো দিন আপনারা সব কিছু সামলেছেন সেহেতু কোন কিছু করার আগে আমার আপনাদের জানাতেই হতো। (হালকা নিশ্বাস নিয়ে)কাল থেকে আমি অফিস জয়েন করবো। আগের এমপ্লোয়ি কে এক মাসের নোটিশে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হবে।আমার টিম আমার সাথে কাজ করবে।তারা কালকেই বাংলাদেশে এসে পৌছাবে।অফিসের দায়িত্বে যে আছে তাকে বলে দিবেন আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকে সমস্ত হিসেব এই একমাসে আমার টিম কে বুঝিয়ে দিতে।যাদের যাদের চাকরি যাবে তাদের মধ্যে পুরোনো যারা আছে তারা আংকেলের কোম্পানি তে জয়েন করবে।আর হিসাবে যত পরিমাণ টাকা ঘাটতি থাকবে তা মিসেস চৌধুরীর একাউন্ট থেকে পুরোন করা হবে।কারন নূরানী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একাউন্ট তিনি হ্যান্ডেল করতেন।কারোর কোন প্রশ্ন থাকলে ও করার অনুমতি নেই।আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।কোম্পানি যেহেতু আমার তাই আমার সিদ্ধান্ত ই শেষ কথা।
আশমিন চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে বসে আছে। ঘুমিয়ে ও পরেছে হয়তো। সেদিকে তাকিয়ে গা জ্বলে গেলো নূরের।দাতে দাত চেপে নিজেকে সামলে নিলো সে।এদিকে কামিনী চৌধুরীর অবস্থা নাজেহাল। রাগ আর ভয় দুটো ই ঘিরে ধরেছে তাকে।এতো বছরে সে কোটি কোটি টাকা সরিয়েছে কোম্পানি থেকে। আমজাদ চৌধুরী ও এ বিষয়ে কিছু জানে না। সেদিনের পর থেকে আশমিন আজ পর্যন্ত তাকে মা বলে ডাকে নি। সরাসরি কোন কথা ও বলে না তার সাথে।অনেক কষ্টে আমজাদ চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক টা ঠিক করেছে সে।এখন এমন কিছু শুনলে সে ও না আবার মুখ ফিরিয়ে নেয় তার থেকে!ভয়ে কামিনী চৌধুরীর কলিজা লাফাচ্ছে।
নূর অমির দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস গলায় বলল,
-- ঢাকার সবচেয়ে বড় বড় হসপিটাল গুলোতে খোজ লাগাও অমি।অর্গান,চোখ,লিভার এসবের কারেন্ট রেট গুলো জেনে নাও। খুব শীঘ্রই আমাদের কাজে লাগবে।
আশমিন বাদে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকালো নূরের দিকে।সানভি শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
-- এগুলো জেনে কি হবে ম্যাম?
নূর বাকা হাসলো। কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ক্রুর গলায় বলল,
-- আপনি বড্ড অবুজ সানভি। টাকার ঘাটতি যদি একাউন্টের টাকা দিয়ে না পূরণ হয় তাহলে এগুলো কাজে লাগবে। একটাকা ও ছাড় দেয়া হবে না।
নূর মেয়ে গার্ডের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- মিসেস চৌধুরী কে ছেড়ে দাও। উনি হয়তো কিছু বলতে চায়।আর মন্ত্রী সাহেবের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো।তার ঘুম ভাঙানো টা এই মুহুর্তে জরুরি।
-- বর কে চুমু খেয়ে ঘুম থেকে তুলতে হয়।পানি মেরে নয়।বিজনেসের পাশাপাশি রোমান্স টা ও শিখে নিয়ো নূর।আমার এখনো বাসর করা বাকি।
আশমিন চোখ বন্ধ করেই বো*মা ফেললো ড্রয়িং রুমে।
আমজাদ চৌধুরী কেসে উঠলো ছেলের কথা শুনে। সে যে একটা নির্লজ্জ ছেলে পয়দা করেছে এখন সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। নূর কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন আড়মোড়া ভেঙে সেদিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
-- আজ থেকে রাত তিন টা থেকে সকাল আমার কাছে রোমান্স শিখার ক্লাস করবে।সব কিছু হাতে কলমে শিখিয়ে দিবো।টানা এক সপ্তাহ ক্লাস করলে তুমি একেবারে রোমান্টিক হয়ে যাবে বুঝলে?
-- বাবা মার সামনে এসব বলতে লজ্জা করছে না তোমার?অসভ্য হচ্ছো দিন দিন।
-- লজ্জা করলে বাবা হবো কি করে।আমাকে অসভ্য বলার আগে নিজের দিকে তাকাও।তুমি ভালো মানুষ হলে আমি এই পৃথিবীতে আসতাম না।এতো কথা না বলে ছেলের বাসর করার ব্যবস্থা করো।নাকি দাদা হতে চাও না জীবনে?
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে।কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করে বললো,
-- সত্যি করে বলো কামিনী এটা কার ছেলে। সত্যি বললে ক্ষমা করে দিবো। এটা আমার ছেলে হতেই পারে না।
কামিনী চৌধুরী স্বামীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে রুমে চলে গেলো। আশমিন তখনই চলে গেছে নিজের রুমে।থমথমে পরিবেশের রেশ কেটে এখন সবাই মুখ টিপে হাসায় ব্যস্ত।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_৯
সকাল সকাল ফর্মাল ড্রেসে অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিচে এসেছে নূর।অফ হোয়াইট কালার লেডিস কোটের সাথে কালো প্যান্ট। চুল গুলো পোনিটেইল করে বাধা। আশমিন সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আমজাদ চৌধুরী নূরের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,
-- গুড মর্নিং মা।
রাফসান শিকদারের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসতে বসতে নূর ও হাসিমুখে আমজাদ চৌধুরী কে গুড মর্নিং জানালো।
-- অফিসের প্রথম দিনের জন্য শুভকামনা। অনেক অনেক এগিয়ে যাও মা। আমি আছি তোমার সাথে।
নূর প্লেটে পরোটা নিতে নিতে কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো। আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রসিকতার স্বরে বললো,
-- ধন্যবাদ আংকেল। তবে এই মুহুর্তে দোয়া মিসেস চৌধুরীর বেশি প্রয়োজন। আপনি বরং তাকেই একটু দোয়া করে দিন। বলা তো যায় না,আর কখনো এভাবে রাজকীয় ক্ষমতা নিয়ে আপনাদের সামনে বসতে পারেন কি না।
আমজাদ চৌধুরী মলিন চোখে তাকালো নূরের দিকে। আশমিন একমনে খেয়ে যাচ্ছে। তার এদিকে কোন ধ্যান নেই। আজ তার অনেক কাজ।দলীয় কিছু কর্মসূচি আছে আজ। মন্ত্রী পরিষদে আজ সারাদিন থাকতে হবে। তার আগে বাসার গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শেষ করতে হবে।
নূর খাওয়ার মাঝেই লারা এসে হাজির হলো নূর মঞ্জিলে। আশমিনের পাশের চেয়ারে বসে আশমিনের দিকে অসহায় চোখে তাকালো। ন্যাকা কান্না করে বললো,
-- বিয়ের ডেট টা কবে ফিক্সড করবে আশমিন?হঠাৎ করে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার আমাদের অনেক হিউমিলিটেড হতে হচ্ছে। পাপা সোসাইটি তে মুখ দেখাতে পারছে না। প্লিজ আমার সাথে এমন করো না।সবাই জানে আমি তোমার বউ হবো। এভাবে বিয়ে টা ভেঙে দিলে আমার বেচে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।আমি তোমাকে ভালবাসি আশমিন।
আশমিন নির্লিপ্ত চোখে লারার দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।আশমিনের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে মনে মনে রাগে ফুসে উঠলো লারা।কিন্তু চেহারায় তা প্রকাশ করলো না। মনে মনে বললো,
-- একবার শুধু বিয়ে টা হয়ে যাক। তোমাকে আর তোমার পুরো পরিবার কে আমি লারা আমার পা চাটা গোলাম যদি না করিয়ে রাখি তাহলে আমার নাম ও লারা নয়।
নূর ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো। লারা নূরের দিকে তাকিয়ে আশমিনের আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে বসলো। আশমিন লারার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
-- কোলে বসতে চাও?
আমজাদ চৌধুরী চোখ বড় বড় করে তাকালো আশমিনের দিকে। নূর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কফিতে মনোযোগ দিলো। লারা আশমিনের দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
-- সবার সামনে?বেডরুমে গেলে ভালো হতো না?
-- দরকার নেই।তুমি এখানেই উঠতে পারো।
-- ওকে।
আশমিন টেবিল থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পালোয়ান সাইজের লোকটির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-- বাহাদুর, লারা কে কোলে নাও।আজ সারাদিন সে তোমার কোলেই থাকবে।আজ আর তোমার কোন কাজ নেই।
আশমিনের শান্ত গলা শুনে বাহাদুর নামের লোকটা ভয়ার্ত চোখে আশমিনের দিকে তাকালো। আশমিনের এই শান্ত গলা যে কতটা ভয়ংকর তা সে হাড়ে হাড়ে জানে।তাই কাল বিলম্ব না করে দ্রুত পায়ে এসে শক্ত হাতে লারা কে কাধে তুলে নিল। লারার মনে হচ্ছে কেউ লোহা দিয়ে তাকে চেপে ধরেছে।চোখের পলকে কি হয়ে গেলো বোঝার আগেই বাহাদুর নামের কালো পালোয়ান সাইজের লোকটা তাকে কোলে নিয়ে একটা চেয়ারে বসে পরলো। কামিনী চৌধুরী সেদিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আমজাদ চৌধুরী একটু শব্দ করেই হেসে ফেললো। সানভি আর অমি এতক্ষণ সব কিছু নিরব চোখে দেখলেও এবার দুজনেই মুখ টিপে হাসতে লাগলো। নূর অমির দিকে তাকিয়ে লারার বসা চেয়ারটা দেখিয়ে শক্ত গলায় বলল,
-- এটা এখনি বাইরে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা করো।
কামিনী চৌধুরী তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
-- চেয়ার ফেলে কি লাভ। তোমার বর কে ও অনেক বার ছুয়েছে ও।এখন তো তার সাথেই বাসর করতে চাইছো।
-- আমি ফেলেছি বলেই সে ছুতে পেরেছে।নাহলে কার সাধ্যি নূরের জিনিসের দিকে হাত বাড়ানোর? নূরের টেস্ট এতটাও খারাপ না মিসেস চৌধুরী।(বাকা হেসে)
আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে কফিতে শেষ চুমুক দিলো। নূর দাঁড়িয়েছে অফিসে যাওয়ার জন্য।
-- তাড়াতাড়ি অফিসে আসবেন মিসেস চৌধুরী।আই হেইট লেইট।
আশমিন নিজের চেয়ার ছেড়ে নূরের মুখোমুখি দাড়ালো। শুভ্র পাঞ্জাবির হাতা সামান্য গুটিয়ে ঘার হালকা কাত করে নূরের দিকে বাকা হেসে তাকালো।নূরে ভ্রু কুচকে তার দিকেই তাকিয়ে। হাতা গুটানো শেষ হতেই হুট করে আশমিন নূর কে কোলে তুলে নিলো।নূর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে।আশমিন ধুপধাপ পা ফেলে সিড়ি বেয়ে চলে যাচ্ছে নিজের রুমে। আমজাদ চৌধুরী মুখ কুচকে তাকিয়ে রইলো ছেলের যাওয়ার দিকে।সানভি আর অমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বসে গেলো ব্রেকফাস্ট করতে।আজ তাদের যেতে লেইট হবে তারা বুঝে গেছে।
-- ওকে এভাবে কোথায় নিয়ে গেলো তোমার স্যার?
আমজাদ চৌধুরীর প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো সানভি। ও কিভাবে জানবে কোথায় নিয়ে গেলো?তবুও সন্দিহান কন্ঠে বললো,
-- কাল রাতের ক্লাস টা মনে হয় এখন করাবে।রাতে তো ম্যাম যায়নি স্যারের রুমে।
আমজাদ চৌধুরী কটমট গলায় বলল,
-- চুপ করো বেয়াদব ছেলে। যেমন স্যার তার তেমন পি.এ।সব কয়টা অসভ্য হচ্ছো দিন দিন।
সানভি কাদো কাদো চোখে তাকিয়ে পরোটা খাওয়ায় মনোযোগ দিল।অমি মনে মনে হেসে লুটপুটি খাচ্ছে। কামিনী চৌধুরী গটগট করে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে। লারার বাবার সাথে কথা বলতে হবে।এতো বছরের সাজানো প্ল্যান কিছুতেই এই দুই দিনের মেয়ের জন্য সে নষ্ট হতে দিবে না।
অমি কাউকে ম্যাসেজ করে আবার খাওয়ায় ধ্যান দিলো।
আশমিন নূর কে নিজের রুমে নামিয়ে সাথে সাথে দরজা লক করে দিলো।এখন এই দরজা আশমিনের ইচ্ছে ছাড়া আর খুলবে না।খুলতে হলে পাসওয়ার্ড লাগবে।নূর সেদিকে আগুন চোখে তাকালো। আশমিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নূর কে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলো।এক হাতে কোমড় পেচিয়ে ধরে হালকা উচু করে নিজের মুখ বরাবর করলো নূর কে। নূরের পা ফ্লোর থেকে তিন ইঞ্চি উপরে।
-- ছাড়ুন।
নূরের শান্ত গলায় ছাড়ুন বলায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো আশমিন। নূরের ঠোঁটের ঠিক বা পাশে গাঢ় চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,
-- রাতে আসতে বকেছিলাম।আসো নি কেন?ছাত্রী হিসেবে তুমি ফাকিবাজ হতেই পারো।কিন্তু স্যার হিসেবে আমি মোটেও ফাকিবাজ নই।তুমি ফাকি দিবে, আর আমি তোমাকে যেখানে পাবো সেখানেই ক্লাস করাবো।হোক সেটা রাস্তা,ড্রয়িং রুম,অফিস বা বেডরুম। এখন তোমার ইচ্ছা তুমি কোথায় ক্লাস করতে চাও।
আশমিনের কথা শুনে ক্রুর হাসলো নূর। আশমিনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে ও ফিসফিস করে বললো,
-- অনেক বড় টিচার হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে? তা কয়জনের সাথে ইন্টিমেন্ট হয়ে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন? প্রোটেকশন নিয়েছিলেন তো?দেখা গেলো এইচ আই ভি পজেটিভ হয়ে বসে আছেন।আমি আবার নিজেকে নিয়ে খুব প্রোটেকটিভ।আগে মেডিকেল চেকাপ করিয়ে আসুন মন্ত্রী সাহেব।ক্লাসের কথা নাহয় আমরা পরে ভাববো।
আশমিন শান্ত চোখে তাকালো নূরের দিকে। মলিন হেসে ক্লান্ত গলায় বলল,
-- সেটা তো তুমি চার বছর আগেই দেখে গিয়েছো নূর।আমার চরিত্র সসম্পর্কে সার্টিফিকেট তো সেদিন ই দেয়া শেষ। তবে আজ এতো প্রশ্ন কেন?স্ত্রী হিসেবে আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি।আমার সবকিছু অর্ধেক তোমার।হোক সেটা এইচ আই ভি।
নূরের ঠোঁটে কয়েক মিনিটের লম্বা চুমু খেয়ে গলায় মুখ গুজে দিলো আশমিন। নূর চোখ বন্ধ করে শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে।চোখের কোন বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে আশমিনের কপালে পরলো।আশমিন নূরের গলায় ছোট ছোট চুমু দিয়ে সেদিন নূর আশমিনের যেখানে কামড় দিয়ে ছিল ঠিক সে জায়গায় আশমিন ও দাত বসিয়ে দিল।নূর হালকা আর্তনাদ করে উঠলেও সাথে সাথে ছাড়লো না আশমিন।কয়েক সেকেন্ড দাত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখে আস্তে করে ছেড়ে দিলো।নূর কে নিচে নামিয়ে কামড়ের স্থানে আলতো করে চুমু দিয়ে মন্থর গলায় বলল,
-- উইস ইউ ভেরি গুড লাক ফর ইউর ফার্স্ট ডে ইন অফিস।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_১০
অফিসে নূরের ত্রিশ জনের টিম সহ নূর কে প্রবেশ করতে দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিশাল বিল্ডিংয়ের আট তলায় রাফসান শিকদারের অফিস। প্রতি তলায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির অফিস থাকলেও আট তলায় হেড অফিস। সব কোম্পানি এখান থেকেই পরিচালনা করা হয়।নূর সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে কনফারেন্স রুমে চলে গেলো। অমি ও বাকি ত্রিশ জন নূরের সাথে কনফারেন্স রুমে গিয়ে নিজেদের জায়গায় বসে পরলো। নূর রাফসান শিকদারের চেহারের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। পাথরের চোখ ফেটে অশ্রু আজ বেরিয়ে আসতে চাইছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে ফেললো নূর।এখনো অনেক পথ বাকি।এভাবে ভেঙে পরলে পরের দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া কঠিন হয়ে পরবে।
নূর নিজের বাবার চেয়ারে বসে অমি কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-- সব ফ্লোরে প্রজেক্টের সেট করে দাও অমি। কামিনী চৌধুরী কে আগামী সাত মিনিটের মধ্যে অফিসে হাযির হতে বলো।সাথে এটা ও বলে দাও,যদি সে সময় মতো এখানে উপস্থিত হতে না পারে তাহলে পরবর্তীতে আমার সিদ্ধান্তই হবে শেষ সিদ্ধান্ত। তার কোন এক্সপ্লেইনেশন গ্রহণযোগ্য হবে না।
অমি "ইয়েস ম্যাম" বলে দ্রুত নিজের কাজ কমপ্লিট করতে চলে গেলো। নূর রাফসান শিকদারের চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। রাফসান শিকদার খু*ন হওয়ার পর এই চেয়ারে এখন পর্যন্ত আর কেউ বসে নি। এমন কি আশমিন ও না।নূরের মনে হচ্ছে চেয়ারে নয় বাবার কোলে চড়ে বসে আছে সে। বাবা আদুরে হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবার গায়ের গন্ধ এখনো এই চেয়ারে লেগে আছে। নূরের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। নূর সন্তপর্ণে তা মুছে নিলো কেউ দেখার আগে।আশমিন গাড়ি তে বসেই নূর কে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সে ও আজ অফিসে যাচ্ছে। মিটিংয়ে থাকতে হবে তাকে। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই বাঘিনীর সামনে যাচ্ছে সে। দেখা যাক তার তেজীনি কিভাবে তাকে কুপকাত করে।
নূর সোজা হয়ে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো।তার টিম মেম্বার নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। এখানকার সবাই আমজাদ চৌধুরীর অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে।ছোট বেলা থেকেই নূরের তাদের সাথে সখ্যতা। কামিনী চৌধুরীর তিক্ত কথা থেকে বাচাতে আমজাদ চৌধুরী নূর কে প্রতিদিন বিকেলে অনাথ আশ্রমে নিয়ে যেতেন। ছোট বলে সবাই নূর কে স্নেহ করত।নূর ও খুব সহজেই মিশে গেছে তাদের সাথে। চার বছর আগে নূর দেশ ছাড়ার আগে কৌশলে এই ত্রিশ জনের টিম কে তাদের কোম্পানির বিভিন্ন ব্রাঞ্চে উচ্চ পদে জয়েন করিয়ে দিয়ে যায়।এটা অবশ্য আমজাদ চৌধুরীর বুদ্ধি ছিল।তিনিই এই টিম মেম্বারদের নূরের জন্য তৈরি করে দেন।এরা প্রত্যেকে নূরের এক কথায় নিজের জীবন দিয়ে দিবে বিনা প্রশ্নে। নূর তাদের থেকে চোখ সরিয়ে কনফারেন্স রুমের বা পাশের বিশাল থাই গ্লাসের সামনে গিয়ে দাড়ালো। পকেটে দুই হাত গুজে চোখ মুখ শক্ত করে বিরবির করে বললো,
-- তোমার খু*নের বদলা আমি নিবো আব্বু।তোমার নূর কখনোই নরম মনের মেয়ে ছিল না।শুধু শান্তিতে জীবন কাটানোর জন্য সব চুপচাপ মেনে নিতাম।আমার নীরবতা আমার দুর্বলতা ছিল না।কিন্তু তারা সেটাকেই আমার অস্তিত্ব ভেবে জীবনের চরম ভুল করে বসলো। যে রাফসান শিকদারের মেয়ে তেহজিব নূর শিকদার।যার নামে পুরো শহর কাপতো তার মেয়ে এতো নরম মনের হবে এটা যারা ভাবে তারা এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছে। প্রত্যেকটা কে গর্ত থেকে টেনে বের করে তাদের বুক থেকে কলিজা বের করে আনবো আমি। আমি মেয়ে বলে আমি দুর্বল নই আব্বু।নির্মমতা আমার রক্তে মিশে আছে। আমার ভালোবাসা থেকে আমার হিংস্রতা তীব্র। একটা কেউ বাচিয়ে রাখবো না। সব কয়টা কে পিপড়ার মতো পিষে মা*র*বো।
নূরের রক্তলাল টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে আশমিন ঠোঁট কামড়ে হাসলো। এদিকে নূরের এই রুপ দেখে পাশে বসে থাকা সানভির ঘাম ছুটে গেছে।কাপা কাপা হাতে টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে আশমিনের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালো। আশমিন সানভির অবস্থা বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ফেললো। সানভি চোখ বড় বড় করে তাকালো আশমিনের দিকে। চার বছরে এই প্রথমবার আশমিন কে এভাবে হাসতে দেখছে সে।যার হাসি এতো সুন্দর সেই মানুষ টা একদম ই হাসে না।আর যখন হাসে তখন তার সেই বাকা হাসিতে সামনের মানুষটার কাপড় নষ্ট হয়ে যায় ভয়ে।সানভির নিজের ও কয়েক বার হতে হতে বেচেছে।
-- আমি আবার ও প্রেমে পরেছি সান।
ফোনে চোখ রেখেই মুচকি হেসে বললো আশমিন। সানভি কনফিউজড হয়ে গেলো তার কি রিয়াকশন দেয়া,উচিত এটা ভেবে।তার এখন নূরের তেজী রুপ দেখে ভয় লাগছে,আবার আশমিনের প্রানবন্ত হাসি দেখে খুশি ও লাগছে,আশমিনের প্রেমে পড়ার বিষয় টা নিয়ে চিন্তা ও হচ্ছে। নূরের যা রুপ দেখা যাচ্ছে, প্রেমে পরার কথা জানলে না জানি কোথায় কোথায় আগু*ন লাগিয়ে নিজের হাত সেকতে বসে যায়।পরে দেখা গেলো টক্কর দেয়ার আশমিন নিজেই খুজে খুঁজে তার প্রেমে পাগল কয়েকটা কে ধরে এনে আগু*নে নিক্ষেপ করলো। বিশ্বাস নেই,এখন এই কলি যুগে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।সানভি ডিপ্রেশনে চলে গেলো টেনশনে।
মিটিং শুরু হওয়ার দশ সেকেন্ড আগে আশমিন নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে এসে বসে পরলো। কামিনী চৌধুর এসে পৌছালো ঠিক তিন মিনিট পরে।তাই তাকে আর ভিতরে ঢুকতে দেয়া হলো না।কনফারেন্স রুমের বাইরে বিশাল এলইডি স্ক্রিনে নূরের বক্তব্য শুনতে লাগলো সে।
-- আমি রাফসান শিকদারের একমাত্র মেয়ে তেহজিব নূর শিকদার আজ থেকে কোম্পানি হ্যান্ড ওভার করে নিচ্ছি।আজ থেকে আশমিন জায়িন চৌধুরী বা কামিনী চৌধুরী কেউ কোম্পানির দায়িত্বে থাকবে না।সমস্ত কোম্পানি আমি পরিচালনা করবো। আপনারা যারা এখানে কর্মরত আছেন তারা আগামী এক মাসে বিগত চার বছরের সমস্ত হিসাব আমার টিম কে বুঝিয়ে দিবেন।আর অবশ্যই নিজেদের জন্য অন্য জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করে নিবেন। কয়েক জনের চাকরির ব্যবস্থা আমি করে দিবো। বাকি যারা বাদ পরেছেন তারা ঝামেলা করতে চাইলে সরাসরি কোর্টে দেখা হবে।আমার কাছে উপযুক্ত রিজন আছে আপনাদের চাকরি থেকে অব্যবহিত দেয়ার।আশা করি সবাই আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।কাজে কোন রকম গাফিলতি আমি বরদাস্ত করবো না। তাই বিকেয়ারফুল।
কামিনী চৌধুরী রাগে ফুসছে।একেও এর বাবার মতোই মরতে হবে। খুব বার বেড়েছে। নূরের দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করতে করতে মনে মনে বললো,
-- আমিও শিকদার বংশের মেয়ে নূর।তোর আগে জন্ম আমার।আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো। তোর অবস্থা রাস্তার কুকুরের মতো না করে আমি কামিনী চৌধুরী স্বস্তির নিশ্বাস নিবো না।
আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে কামিনী চৌধুরীর দিকে। সে যে আবার কোন খিচুড়ি পাকাচ্ছ তা তার চেহারায় স্পষ্ট। আশমিন পাশের চেয়ারে বিমুর্ষ মুখে বসে থাকা আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকালো। সে ও কামিনী চৌধুরীর দিকেই তাকিয়ে। আশমিন তার বাবার হাতে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললো,
-- সামনে আমাদের খুব কঠিন সময় আসছে আব্বু। শিকদার দের দুই রমনীর যু*দ্ধে কে পরাজিত হয় বলা যায় না।এক জনের বিনাশ নিশ্চিত। আমি আমার বউয়ের পাশে আছি।তাই তার কোন ভয় নেই।মিনিষ্টার আশমিন জায়িনের বউ কে সে কিভাবে প্রোটেক্ট করবে বুঝতেই তো পারছো।কিন্তু তোমার কি হবে? তোমার উচিত অন্য অপশন হাতে রাখা।আমার জানাশোনা অনেক মেয়ে আছে।দেখবো নাকি?
আমজাদ চৌধুরী বজ্রাহত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। সে এখন সিরিয়াস মুখে নূরের দিকে তাকিয়ে। আমজাদ চৌধুরীর বুকের ব্যথা টা আবার বাড়তে লাগলো।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_১১
আশমিন নূরের কেবিনে আয়েশ করে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। শুভ্র পাঞ্জাবি পাজামায় অসাধারণ লাগছে তাকে।চোখে মুখে একটা নেতা নেতা ভাব আছে।নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন কফি খাচ্ছে আর একটু পর পর নূরের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছে। নূর বিরক্তি তে মুখ কুচকে ফেললো।
-- কোন ইমপোর্টেন্ট কথা না থাকলে আপনি আসতে পারেন। আমি এখন বিজি আছি।
-- আমিও বিজি।
আশমিনের গম্ভীর গলায় ফালতু কথা শুনে কপালের ভাজ ভারী হলো নূরের।মনে মনে পেপার ওয়েট ছুড়ে মাথা ফাটাতে ইচ্ছে হলেও মুখে কিছু বললো না। আশমিন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
এদিকে সানভি কেবিনের বাইরে পায়চারি করে যাচ্ছে অনবরত। আগামি বিশ মিনিট পর মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। এখন বের হলেও আধঘন্টা লেটে পৌছাবে তারা।কিন্তু আশমিনের কোন হেলদোল নেই।সে বউয়ের কেবিনে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সানভি কিছুক্ষণ নিজের চুল টানাটানি করে নূরের কেবিনে নক করলো,
-- মে আই কামিং ম্যাম?
-- ইউ আর নট।
আশমিনের কাটকাট উত্তরে সানভির চিন্তায় জর্জরিত মুখটা ভোতা হয়ে গেলো। মুখ কালো করে দরজায় ইদুরের মতো মাথা ঢুকিয়ে মিনমিন করে বললো,
-- আপনার মিটিং আছে স্যার। আমরা অলরেডি লেট হয়ে গেছি।
নূর সেদিকে পাত্তা দিয়ে একমনে ল্যাপটপে কাজ করে যাচ্ছে।যেন কেবিনে সে ছাড়া আর কেউ নেই। আশমিন সেদিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো। সানভির গুরুত্বপূর্ণ কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
--বুঝলে সান! কোম্পানি তে আমার আর কোন কাজ নেই।তাই ওসব মিটিং ফিটিং বাদ দাও। পাচ বছর হচ্ছে বিয়ে করছি।এখনো বাসর করতে পারলাম না।জনগণ এটা মেনে নিবে না।বলবে,যে মন্ত্রী পাচ বছরে বউয়ের সাথে বাসর করতে পারলো না সে আর আমাদের কি উন্নয়ন করবে?আমি এটা কিছুতেই মেনে নিবো না। আজকেই বাসরের ব্যবস্থা করো।আমি বাসর না করে আর কোন কাজ করবো না। বেলি ফুল দিয়ে আমার রুমটা সাজিয়ে ফেলো
নূর আর সানভি হা করে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। সানভি অর্ধেক মাথা আর বাইরে নেয়া হলো না। ভয়ার্ত চোখে নূরের দিকে তাকালো। নূর নিজের হতভম্ভতা কাটিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। একটা লোক কতটা নির্লজ্জ হতে পারে তা আশমিন কে না দেখলে সে বুঝতেই পারতো না। নেতারা যে নির্লজ্জ হয় তার,জলন্ত প্রমাণ আশমিন নিজেই।
আশমিন শয়তানি চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে।এখন আশমিনের একমাত্র কাজ হচ্ছে নূর কে ভরকে দেয়া।যা এই মুহুর্তে খুব বেশি জরুরি। আশমিনের চিন্তা কে এক সাগর পানিতে ছুড়ে ফেলে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
-- দাঁড়িয়ে কি দেখছো সানভি। তোমার স্যারের আদেশ পালন করো।
সানভির চোখ রসগোল্লার আকার ধারণ করলো। আশমিন নিজেও কিছুটা চমকে গেলেও তা প্রকাশ করলো না।সানভি কে ইশারা করতেই সানভি যন্ত্রের মতো মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। নূর এখনো হেলান দিয়ে আশমিনের দিকে তাকিয়ে।
-- এতো দিনের অপেক্ষা তাহলে শেষ হবে?
-- আপনার কি তাই মনে হয়?(ভ্রু উঁচু করে)
আশমিন বাকা হেসে টেবিলে দু হাত রেখে নূরের দিকে হালকা ঝুকে বললো,
-- স্বপ্ন বাস্তব করা আশমিন জায়িন চৌধুরীর এক প্রকার নেশা।আর তা যদি হয় নিজের বউ কে ভালবাসার তাহলে তো কথাই নেই।
-- তো বাসর করা আপনার নেশা?
-- উহু।এক সাথে দুই বাচ্চার বাবা হওয়ার নেশা চেপেছে।বউ পালিয়ে না গেলে এতো দিনে তো দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম।তাই চিন্তা করেছি আল্লাহ চাইলে একসাথে দুই বাচ্চার বাবা হয়ে যাবো।
নূর ক্রুর হাসলো। ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল,
-- বউ কে নিজের কাছে রাখতে পারেন না কেমন বর আপনি? যে নিজের বউয়ের সম্মান রক্ষা করতে পারে না সে দেশের জনগণ কে কিভাবে রক্ষা করবে বলুন তো মন্ত্রী সাহেব! আর কার সাথে বাসর,বাচ্চা জন্ম দেয়ার চিন্তা করছেন বলুন তো!যে কিনা নিজের ক্যারিয়ারের জন্য বাবার মৃ*ত্যু কেও পরোয়া করে নি তার সাথে?হাসালেন মন্ত্রী সাহেব। আপনার তো ভয় পাওয়ার কথা। দেখা গেলো নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আপনি আর আপনার বাচ্চা ফেলেই চলে গেলো। তখন কি হবে!
নূরের তীক্ষ্ণ খোচা টা একেবারে ঠিক জায়গায় গিয়ে লেগেছে।চোখ মুখ শক্ত করে ফেলেছে আশমিন। রক্তিম চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললো,
-- সব সময় তাকে যে ছাড় দেয়া হবে তা ভাবার কারন কি মিসেস আশমিন?
আশমিনের মুখে মিসেস আশমিন শুনে চমকে উঠলো নূর। আশমিনের চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা ভরকে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো সে। আশমিন চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নূরের দিকে শান্ত চোখে তাকালো। অনেকটা উদাস গলায় বলল,
-- আমি যা জানি তুমি তা জানো না নূর।যাই করো না কেন ভেবে চিনতে করবে।আমি চাই না তুমি কখনো আমার সামনে দাড়িয়ে লজ্জিত বোধ করো।
নূর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। আশমিনের গলাটা খুব অন্যরকম শোনালো। কি এমন কথা আছে যে সে জানে না?চিন্তায় কপালে ভাজ পড়লো নূরের।আশমিন নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে নূরের সামনে দাড়ালো। হালকা ঝুকে নূরের কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,
-- বি রেডি ফর টু-নাইট।
কথা শেষ হতেই বাকা হেসে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।নূর দাতে দাত চাপলো। হিসহিসিয়ে বললো,
-- আপনি ও রেডি থাকবেন মন্ত্রী সাহেব।
কামিনী চৌধুরী নিজের কেবিনে এদিক সেদিক পায়চারি করছে। সারে তিন'শ কোটি টাকার হিসেব গোলমাল।এই টাকা সে নিজেই সরিয়েছে। কানাডায় নিজের জন্য বাড়ি করেছে দুটো। বাকি টাকা নিজের বেপরোয়া জীবন যাপনে খরচ করেছে।তার ধারণা মতে আশমিন বা আমজাদ চৌধুরী কেউই জানে না এ সম্পর্কে। কিন্তু আশমিন আগাগোড়া সবটাই জানে।সে শুধু চুপ করে আছে নূরের জন্য। তার কথা হচ্ছে,
-- যার সম্পদ সে নিজেই সব কিছু বুঝে নিবে।নিজের খাবার অন্যের পেট থেকে কিভাবে গলায় পাড়া দিয়ে বের করতে হয় তা নূর খুব ভালো করেই জানে। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা কখন কিভাবে গলায় নিজের পা চেপে ধরে নূর।
কামিনী চৌধুরী পাগলের মতো কয়েক জায়গায় কল করলো। আশানুরূপ কোন ফল না পেয়ে ফোর ছুড়ে মারলো দেয়ালে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের চুল টানতে লাগলো।
ল্যাপটপের স্ক্রিনে কামিনী চৌধুরীর বেহাল দশা দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো নূর। মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বেরিয়ে গেলো বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় গিয়ে আবার বউ সাজতে হবে।আশমিন জায়িন চৌধুরীর বউ!
আশমিন নূরের অফিস থেকে বেরিয়ে মন্ত্রণালয়ে চলে গিয়েছিল। মিটিং সে নিজেই দুই ঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছিল।সারাদিন নিজের অফিসে ব্যস্ত ছিল সে।এদিকে তার কথা মতো সানভি সত্যি সত্যিই বাসর সাজিয়ে বসে থাকবে তার ধারণা তেও ছিল না তা।
রাত দশটায় নিজের বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে নূর মঞ্জিলে প্রবেশ করলো আশমিন।দেহরক্ষীরা বের হয়ে তার গাড়ি ঘিরে দাড়াতেই বেরিয়ে এলো আশমিন। প্রচন্ড গরমে আর ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসতে চাইছে।এসি গাড়িতে থাকা সত্ত্বেও ঘামে সাদা পাঞ্জাবি ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে। বাড়িতে ঢুকতেই ভ্রু কুচকে ফেললো আশমিন।চারিদিক ফুলের গন্ধে মো মো করছে।মাথায় হালকা চাপ দিতেই মনে পরলো সকালের কথা। বিরক্তি তে মুখ থেকে 'চ' উচ্চারণ করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো আশমিন। নূর নিশ্চয়ই এসব নিয়ে কোন মাথা ঘামায় নি।
রুমে ঢুকে আরেকদফা চমকে গেলো আশমিন। নূর বউ সেজে দাড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়েই বাকা হাসছে।সারা রুম যেন ফুল দিয়ে ঢেকে ফেলেছে।এতো বেলি ফুল কোথা থেকে জোগাড় করলো তা ও চিন্তার বিষয়!
-- ফ্রেশ হয়ে আসুন মন্ত্রী সাহেব।
নূরের কথায় ঘোর ভাঙ্গলো আশমিনের। কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।এদিকে ঘাট বরাবর রাখা ইজি চেয়ারে বসে পরলো নূর।মুখে বাকা হাসি বিদ্যমান।
দশ মিনিটের মাথায় শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো আশমিন। নূর কিছু একটা নাড়াচাড়া করছে নিজের হাতে।আশমিন টাউজার আর সাদা শার্ট পরেছে।বুকের কাছের কয়েকটা বোতাম খোলা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে।এদিকে নূর কে দেখে বারবার ঢোক গিলছে আশমিন। আজকে সে বাসর করতে চায় না।এমন জ্বালাময়ী রুপের সাথে বাসর করা মোটেও ভাল সিদ্ধান্ত নয়।আশমিন কিছু একটা ভেবে নূরের দিকে এগিয়ে যেতেই নূর নিজের হাতের লাইটার টা বিছানায় ছুড়ে মারলো। সাথে সাথে দাউ দাউ করে আ*গুন জ্বলে উঠলো ফুল সজ্জিত খাট টিতে।আশমিন পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো সেই আগু*নের দিকে।
নূর বাকা হেসে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল,
-- আপনার বাসর এই আগু*নের মতো উজ্জ্বল হোক মন্ত্রী সাহেব।
আশমিন দু কদম এগিয়ে একটা সুইচ টিপতেই উপর থেকে পানি পরতে লাগলো। আশমিন আর নূর মুহুর্তেই কাক ভেজা হয়ে গেলো। নূর কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন মাথার চুল গুলো উল্টে নূরের কাছে গিয়ে কোমড় আকরে ধরে দাড়ালো। ঠোঁট জোড়া নূরের কাধে চেপে গুন গুন করে গাইতে লাগলো,,
-- আগুনের দেখেছো কি, আগুন হয়ে জ্বলছি আমি।
তুমি যাকে আগুন বলো আমি তাকে বলি পানি।
■■■■■■■■■■■■■■
#পর্ব_১২
অন্ধকার কোন ঘর থেকে কারো বিভৎস চিৎকার ভেসে আসছে। মস্তবড় এক গুদাম ঘরের বিলাসবহুল এক রুমে বসে আছে আশমিন। তার পাশের ই কোন রুম থেকে কারোর আর্তনাদ ভেসে আসছে। সোফায় বসে হাটুতে দুই হাত ভর দিয়ে পা নাচিয়ে যাচ্ছে আশমিন। সানভি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। লোকটার আর্তনাদ শুনে তার নিজের ই বুক কাপছে।অথচ আশমিন গুন গুন করে গান গেয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই সোজা হয়ে বসলো আশমিন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। সানভি বার কয়েক ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নিলো।আশমিনের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
-- আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে লোকটা ম*রে যাবে স্যার।
-- তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে সান।ম*রতে পারবে না ও। মা*রতে থাকো। অবস্থা খারাপ হলে ডাক্তার দেখাও।সুস্থ করে আবার মা*রো। যতক্ষণ মুখ না খুলছে এভাবে চলতে থাকবে।
সানভি হন্তদন্ত পায়ে চলে গেলো ডাক্তার ডাকতে। মিনিট দশেক পর ডাক্তার নিয়ে একটা অন্ধকার নোংরা রুমে প্রবেশ করলো সানভি।একটা মাঝবয়েসী লোককে উল্টো ঝু*লিয়ে রাখা হয়েছে। নাক মুখ দেখে চেনার উপায় নেই। আশমিনের নির্দয় লোক গুলো সারা মুখ থেত*লে দিয়েছে। দাত পরে গেছে কয়েকটা। ডাক্তার নিজেও শিউরে উঠল।এভাবে কেউ কাউকে মা*রে!কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পেলো না।
-- এভাবেঝুলিয়ে রাখলে ট্রিটমেন্ট করবো কিভাবে?নামিয়ে শুয়িয়ে দিন প্লিজ।
সানভির কপালে চিকন ঘামের দেখা দিলো।কাপা কাপা চোখে রুমে সেট করা সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে তাকালো। শুকনো ঢোক গিলে কাপা কাপা গলায় বলল,
-- যা করার এভাবেই করুন।নিচে নামানো যাবে না।
ডাক্তার আর কিছু না বলেই নিজের কাজ করতে লাগলো। সে জানে যে বলেও কোন কাজ হবে না। র*ক্ত পরিস্কার করে ব্যন্ডেজ করে দিলো সে।ব্যথা নাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।লোকটার কোন হুশ নেই।আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু দেখে চলেছে। শত রেগে গেলে ও আশমিন নিজের চেহারায় তা কখনোই প্রকাশ করে না।নিজেকে সবসময় রাখে শান্ত। কিন্তু ইদানীং তার মেজাজ ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। নূর তো উঠে পরে লেগেছে তাকে ধ্বংস করতে। এই যে এখন ধৈর্য ধরে দু ঘন্টা যাবত তার রুম তল্লাশি করে চলেছে।ঠিক কি খুজছে তা আশমিন জানে। হাজার খুজলেও নূর কিছুই পাবে না আশমিন তা জানে।তবুও সে এক ধ্যানে নূরকেই দেখে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পেয়ে নূর এখন রীতিমতো রাগে ফুসছে।আর নূরের রাগী ফেস দেখে মুচকি হাসছে আশমিন।সেই মুহুর্তে আবার সানভির আগমন।
-- জ্ঞান ফিরেছে স্যার।
-- যাও।আমি আসছি।
আশমিন নিজের শুভ্র পাঞ্জাবি বদলে একটা ক্যাজুয়াল শার্ট পরে সেই অন্ধকার রুমে ঢুকলো। লোকটা তাকে দেখে থরথর করে কাপছে। আশমিন ইশারা করতেই গার্ড গুলোর মধ্যে কয়েকজন এসে লোকটাকে নামিয়ে দিলো।আশমিনের সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আবার নিজেদের জায়গায় গিয়ে দাড়িয়ে গেলো।
আশিমিন লোকটার মুখোমুখি বসে শান্ত গলায় বললো,
-- কেমন আছেন ড্রাইভার আংকেল?
আশমিনের 'কেমন আছেন'শুনে ড্রাইভার মতিন মিয়া থরথর করে কাপতে লাগলো। মুখে কিছু না বলতে পারায় বার বার হাত জোর করে মাফ চাইতে লাগলো। আশমিন ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। চেয়ারের পিছনে মাথা এলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-- দীর্ঘ বিশ বছর যাদের নুন খেয়েছেন তাদের সাথেই বেঈমানী করলেন আংকেল! ব্যাপার টা আমার একদম ই ভালো লাগে নি।
আশমিনের গলায় দুঃখী দুঃখী ভাব।সানভি পকেট থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘাম মুছে ফেললো। আশমিনের দুঃখী গলা শুনে ভীতু চোখে তাকালো আশমিনের দিকে।
আশমিন আফসোসের স্বরে বললো,
-- আমার আপনাকে মা*রতে ইচ্ছে করছে না আংকেল। আর কয় বছর ই বা বাচবেন বলুন?এখন আর আপনাকে মে*রে লাভ কি!আমি বরং আপনারা দুই ছেলে কে মে*রে ফেলি।
লোকটা ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। অস্পষ্ট গলায় গুঙ্গিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো বার বার। কিন্তু আশমিন সেই আকুতি শুনলো না।সে পায়ের উপর পা তুলে পা নাচিয়ে গার্ড কে ইশারা করলো। সাথে সাথে সেখানে বাইশ বছরের এক যুবক কে নিয়ে হাজির হলো গার্ড।ছেলেটার হাত পা বাধা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে খুব টর্চার করা হয়েছে।মতিন মিয়া ছেলের এমন দুর্দশা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। এই ছেলেদের জন্য ই তো রাফসান শিকদারের মতো মানুষের সাথে বেঈমানী করেছে।তার পাপ আজ তাকে এনে এখানে দাড় করিয়েছে।
আশমিন রি*ভালভার হাতে নিয়ে ঘার কাত করে মতিন মিয়ার দিকে তাকালো। মতিন মিয়ার বড় ছেলে মারুফ ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে।ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই তার।
-- আমার জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো সান।গরমে গলা শুকিয়ে গেছে একেবারে।
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো আশমিন। দুটো বোতাম খুলে দিয়ে শার্ট কিছুটা এলিয়ে দিলো ঘাড়ের দিকে।সানভি ইশারা করতেই একজন এক বোতল ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটার এনে দিলো আশমিনের হাতে।আশমিন দুই চুমুক দিয়ে মতিন মিয়ার কে শান্ত গলায় বললো,
-- সে এখন কোথায় আছে আংকেল?
মতিন মিয়া অস্পষ্ট গলায় বলল,
-- আমি সত্যিই জানি না সে এখন কোথায়।বিশ্বাস করুন বাবা।তবে সে দেশে নেই।
-- কোন দেশে আছে।
-- জানি না। তবে কিছু দিনের মধ্যেই সে দেশে ফিরবে।
-- তার সাথে আর কে কে জড়িত?
আশমিন ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই কেপে উঠলো মতিন মিয়া। চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের নজর লুকালো।আশমিন শক্ত গলায় বলল,
-- এটাই আপনার শেষ সুযোগ।
মতিন মিয়া মাথা নিচু করে ফেললো। কাপা কাপা গলায় বলল,
-- আপনি বিশ্বাস করবেন না।
-- আপনি বলুন।
-- আপ আপনার মা কামিনী চৌধুরী আর লারার বাবা।
চোখ বন্ধ করে ফেললো আশমিন। ব*ন্দুকের নল দিয়ে কপাল ঘষে চোখ বন্ধ করেই পর পর পাচ টা শু*ট করে দিলো মতিন মিয়ার বুকে।মারুফ ডুকরে কেদে উঠলো। ছোটার জন্য ছটফট করতে লাগলো বারবার। শত হোক,নিজের বাবা তো।তার এমন করুন মৃ*ত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।আশমিন মারুফের সামনে গিয়ে হাটু মুরে বসলো।মারুফের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-- তোমার বাবা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মারুফ। তার জন্য ও কেউ তার বাবা কে হারিয়েছে। আমি বিশ্বাসঘাতক দের বাচিয়ে রাখি না মারুফ। তোমার পরিবার কে দূরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তোমরা এখানে নিরাপদ নও।আমি চাইলে তোমাদের সবাইকে মে*রে ফেলতে পারতাম।কারণ তোমার গায়ে ও বিশ্বাসঘাতকের রক্ত বইছে।কিন্তু আমি তা করবো না। সব মানুষ এক হয় না। যেমন বিশ্বাসঘাতকের সন্তান হয়েও আমি বিশ্বাস ঘাতক নই।কখনো আমাকে ভুল প্রমাণ করো না।
মারুফ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ধরা গলায় বলল,
-- আমি আপনাকে প্রমাণ করে দিবো আমি বাবার ছেলে হলেও বিশ্বাস ঘাতক নই।
আশমিন মলিন হাসলো। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। সানভি আশমিনের পিছু পিছু আসলো। আশমিনের মনের ভিতর যে তুফান চলছে তা সানভি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।কিন্তু আশমিন ঠিক আগের মতোই শান্ত,গম্ভীর।
-- এদিকটা সামলে নিয় সান।আমি বের হচ্ছি।
-- আমি ও আসছি আপনার সাথে।
সানভির দ্রুত জবাব। আশমিন গাড়ির দরজা খুলে গম্ভীর গলায় বলল,
-- দরকার নেই।আমি একা যেতে পারবো।
আশমিনের গাড়ি চলে যেতেই সানভি আরো চারটি গাড়ি আশমিনের পিছনে পাঠিয়ে দিলো। এভাবে সিকিউরিটি ছাড়া তাকে কিছুতেই ছাড়া যাবে না ।
...........................................
𝐓𝐎 𝐁𝐄 𝐂𝐎𝐍𝐓𝐈𝐍𝐔𝐄𝐃
***Download NovelToon to enjoy a better reading experience!***
Comments