NovelToon NovelToon

শালুক ফুলের লাজ নাই

পর্ব_____১

আদনান গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে জিন্স, টপস পরা এক মেয়েকে বের করে আনলো। চার বছর ধরে দেখা শালুকের দুই চোখ ভর্তি স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে আর এক মুহূর্ত ও সময় লাগলো না সেই মুহুর্তে। আদনান ভাই!শালুকের আদনান ভাইয়ের পাশে এই কে?এরকম হবার তো কথা ছিলো না।

অথচ আদনান ভাই আসবে বলে শালুক আজ লাল শাড়ি পরেছে।

আদনান ভাই তো তাকে বলেছিলো, শাড়িতেে শালুককে একেবারে বউ লাগে, তিনিি যেদিন দেশে আসবেন শালুক যেনো একটা লাল শাড়ি পরে সেদিন।

আদনান সবার সাথে বিদেশিনীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,শালুকের সামনে এসে বললো, “মিট মাই লাভলি লিটল সিস্টার।শালুক,এই তোর ভাবী আশা।যদিও ওর নাম হার্দিকা তবে আমি ওকে ভালোবেসে আশা বলি।ওর বিদেশি নাম তো সবাই ঠিক করে বলতে পারবে না।হার্দিকা নামের অর্থ জানিস?অর্থ হচ্ছে প্রেমে ভরা একটি হৃদয়।

আর তুই তো আরো আগে ওর নাম ভুল উচ্চারণ করবি, এমনিতেইই সারাবছর অংক আর ইংরেজিতে ডাব্বা মারিস।”

একদমে কথাগুলো বললো আদনান।

আদনানের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। লজ্জায়, অপমানেে শালুকের দুই কান লাল হয়ে গেলো। শালুক তাকিয়ে দেখে তার নিজের মা বাবা ভাই বোন ও হাসছে সবার সাথে তাল মিলিয়ে।

এক মুহুর্ত ও দাঁড়ালো না শালুক সেখানে আর।এক ছুটে ছাদের ছোট্ট খুপরি ঘরে গিয়ে লুকালো।ভেতর থেকে কে যেনো বিদ্রোহ শুরু করেছে।বারবার বলছে,”আদনান তোকে ঠকিয়েছে শালুক।তুই ঠকেছিস।”

শালুকদের বিশাল বাড়িটি সাড়ে তিনতলা।এক তলায় ১৫ টা করে রুম। দুই তলার ছাদের অর্ধেক জুড়ে আছে বিভিন্ন ফল, ফুলের গাছ, দোলনা,বসার জন্য বেঞ্চি।তার একপাশে দুইটা রুম ও আছে।আর অন্যদিকে আছে ছোট একটা খুপরি। খুপরি আর দুইটা রুমের মাঝখানে বিশাল খালি জায়গা।খুপরিটা শালুকের একান্ত ব্যক্তিগত। খুপরি ঘরের নীল দরজায় কালো মার্কার পেন দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখা,”শালুকের রাজ্যে আপনাকে স্বাগতম।”

ভেতরে ঢুকে শালুক শাড়িটি খুলে ফেললো। সেলোয়ার-কামিজ পরে একটা কাঁ/চি নিয়ে শাড়িটি অসংখ্য টুকরো করে ফেললো কে/টে।ক্লাস টেনে পড়ুয়া শালুকের কাছে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে পৃথিবীতে তারচেয়ে বেশী অসহায় আর অন্য কেউ নেই।

একপাল বাচ্চার মধ্যে বড় হওয়া শালুক খুব ছোট বেলায় টের পেলো আদনান ভাই নামক মানুষটাকে তার ভীষণ ভালো লাগে।আদনান ভাই শালুকের নাম ধরে ডাকলে শালুকের ভীষণ লজ্জা লাগতো। এই ভালো লাগা কি শালুক জন্ম দিয়েছে?

মোটেও না,আদনান ভাই যেদিন থেকে ওকে হেসে হেসে বলতো,”এই ফেলটুস শালুককে আমি ছাড়া অন্য কেউ বিয়ে করবে না।”সেদিন থেকেই শালুক লজ্জা পেতো।সেই লজ্জা ধীরে ধীরে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় রূপ নিলো।

সবাই তাকে আদনানের বউ বলে খেপাতো।সেই ছোট বয়সেই শালুক ধরে নিয়েছিলো আদনান ভাই তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ।

সেই ধারণা আরো পোক্ত হলো আদনান ভাই বিদেশ যাবার পর। শালুক যখন ক্লাস এইটে উঠলো আদনান ভাই তো সেদিন তাকে বলেছিলো,”জেএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে শালুক,আমার বাচ্চারা নয়তো তোকে ফেলটুস মা বলে খেপাবে।”

সেদিন আদনান ভাইয়ের কথা শুনে শালুক কল কেটে দিয়েছে। এই লোকটা এতো লজ্জা দিয়ে কথা বলতে পারে!

সেই মানুষের পাশে আজ অন্য মেয়ে দাঁড়িয়ে।হার্দিকা না ফার্দিকা নামের একটা মেয়েকে নিয়ে এলো আদনান ভাই?

শালুকের কেমন দম বন্ধ লাগছে,অনুভূতিতে আজ সবচেয়ে বড় আঘাত লেগেছে।কিশোরী মনের প্রলয়ঙ্কারী ভালোবাসা আদনান বুঝলো না।

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শালুক অঝোরে কাদলো।শালুকের সেই কান্নার একমাত্র সাক্ষী ছিলো নীল আকাশ।

এই নীল আকাশ সব কিছুর সাক্ষী, সেদিনও এই আকাশ সাক্ষী ছিলো যেদিন আদনান ভাই তাকে বলেছিলো,”আমার শালুকটা আজ কতো বড় হয়েছে কে জানে!চুমু খাওয়ার মতো বড় হয়েছে কি?”

বৈশাখ মাস শুরু হয়েছে,হঠাৎ করেই নীল আকাশ কালো হয়ে গেলো। শালুকের অশান্ত মনের মতো আকাশটাও মুহুর্তে আশান্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।

শালুক বৃষ্টিতে ভিজতে পারে না,বৃষ্টির পানিতে ওর এলার্জি আছে।

জানালার কাঁচের এপাশে দাঁড়িয়ে শালুক চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে আর তার ব্যথায় ব্যথিত হয়ে আকাশ ও সমানতালে বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরেই শালুক দেখতে পেলো আদনান ভাই মেয়েটার হাত ধরে ছাদে চলে এসেছে। দুজন মিলে হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজছে।

শালুকের বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠলো। হার্দিকা না ফার্দিকা মেয়েটার রিবন্ডিং করা সোজা তারের মতো চুলগুলো লাফালাফি করার কারণে মুখে এসে পেঁচিয়ে গেছে। জানালার ওপাশ থেকে শালুক দেখলো আদনান ভাই পরম যতনে মেয়েটার চুল সরিয়ে দিচ্ছে মুখ থেকে।

খিলখিল করে হেসে মেয়েটা তার মাথা নাড়াচ্ছে,তার কাঁধ সমান চুল আদনানের মুখে গিয়ে লাগছে।মুগ্ধ হয়ে আদনান তা দেখছে।মেয়েটা টুপ করে আদনানের গালে একটা চুমু খেলো।

শালুকের কি প্রচন্ড রাগ হলো,জানালার পর্দা টেনে দিয়ে কোমর সমান লম্বা চুলগুলো শালুক কাঁ/চি দিয়ে কে/টে একেবারে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে এলো। তারপর এক অজানা শোকে মাথার চুল খামচে ধরে কাঁদতে লাগলো। আদনান ভাই অন্য কারো এটা শালুক মানতে পারছে না কিছুতে।এই ধ্রুব সত্যিটা কেনো শালুকের সহ্য হচ্ছে না, শালুক জানে না।

বৃষ্টি থামলো দুইটা বাজার একটু আগে।শালুক তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে।এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো তার?

নিজের কান্না কিছুতেই শালুক সামলাতে পারছে না।মতির মা এসে শালুকের খুপরির দরজায় দুমদাম কিল মারতে লাগলো। তারপর চিৎকার করে ডেকে বললো, “সবাই খাইতে বসছে,বড় চাচায় আপনেরে ডাকে। তাত্তাড়ি আইতে কইছে,নয়তো ছোট আম্মা কইছে ঝাড়ু নিয়া আসবো আপনের জন্য।বিদেশি ভাবীর সামনে কি একটা বেইজ্জতি হইবেন আপা।আসেন তাত্তাড়ি।”

বিদেশি ভাবী!

শালুক করুণ হাসলো শব্দ দুটা শুনে।ভাবী!

বাহ!

মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে শালুক মতির মা’র সাথে নেমে এলো নিচতলায়। বিশাল ডাইনিং টেবিলে ২৫ টা চেয়ার।শালুকদের যৌথ পরিবার।বাবারা তিন ভাই,তাদের ছেলেমেয়ে, দাদা দাদী, বিধবা বড় ফুফু,তার ছেলেমেয়ে নিয়ে বিশাল বড় সংসার তাদের।

শালুক যেতেই আশা বললো, “তুমি আমার পাশে বসো শালুক।”

বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে শালুক সরে গেলো। বড় চাচার পাশের চেয়ার খালি ছিলো শালুক সেখানে গিয়ে বসলো। মেয়েটার মুখে বাংলা কথা শুনে শালুক কিছুটা আশ্চর্য হয়েছে।

টেবিলে আজ বিভিন্ন পদের খাবার সাজানো। সব কিছু আদনান আসবে উপলক্ষে করা।শালুকের একবার ইচ্ছে হলো, টেবিলে থাকা সব খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে।

সাহসের অভাবে শালুক পারলো না।

তবে অভিমান করে একটা কাজ করলো,নিজের অতি প্রিয় খাবারগুলো ও খেলো না।ডাল আর করলা ভাজি দিয়ে মেখে মেখে ভাত খেতে লাগলো। এক লোকমা ভাত খায় আর একগ্লাস পানি খায়।শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো প্লেটে অর্ধেক ভাত রয়ে গেছে কিন্তু শালুকের পেটে আর জায়গা নেই।

শালুকের মা হাসনা সবাইকে খাবার সার্ভ করছেন,হঠাৎ করে তার নজর গেলো মেয়ের দিকে।

করলা দেখলেই যেই মেয়ে নাক সিটকায় সে কিনা করলা দিয়ে ভাত খাচ্ছে, অথচ কলিজা ভুনা,চিংড়ি ভাজা,ইলিশ মাছের ডিমের পাতুরি এসব তার সামনে রয়েছে।

হাসনা মেয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,”কি ব্যাপার শালুক,এসব কি?কি দিয়ে ভাত খাচ্ছিস?”

শালুক মাথা নিচু করে বললো, “খেতে ইচ্ছে করছে না মা।করলা তো কখনো খাই না,তাই আজ একটু চেখে দেখলাম।”

হাসনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালো। শালুক কিছু বলার আগে আদনান বললো, “ইলিশ মাছের ডিমের পাতুরির বাটিটা এদিকে দাও তো চাচী।আশার আবার মাছের ডিম ভীষণ ফেভারিট। ”

হাসনা মেয়ের পাশ থেকে সরে আশার কাছে এলেন।শালুক ততক্ষণে উঠে চলে গেলো।

নিজের রুমে গিয়ে বসে রইলো ঘূর্ণয়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে।

খাওয়ার পর শাপলা এলো শালুকের রুমে,শালুকের বড় বোন শাপলা।বিছানার উপর পা তুলে বসে বললো, “কি হয়েছে শালুক?এরকম মনমরা হয়ে বসে আছিস কেনো? ”

শালুক চোখের জল আড়াল করে বললো, “ভালো লাগছে না আপা।”

শাপলা মুচকি হেসে বললো, “কষ্ট হচ্ছে তাই না শালুক?আশাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছিস?শোন শালুক,আদনান ভাই মানুষটাই এরকম।সবার মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়ায় ওস্তাদ। তুই জানিস না শালুক,মেয়েদের মন ভাঙ্গায় আদনান ভাইয়ের জুড়ি মেলা ভার।বড় ফুফুর মেয়ে নয়না আপা,আদনান ভাইকে কি ভীষণ ভালোবাসতো।আদনান ভাই ও তাতে সায় দিতো।সে হচ্ছে ধরি মাছ,না ছুঁই পানি টাইপের লোক।ওনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে শালুক।”

শালুক দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে লাগলো। শাপলা একটু সময় থেমে বললো, “আশা কে জানিস শালুক?আদনান ভাইয়ের খালাতো বোন।বড় চাচী সবসময় দেখিস না গল্প করে ওনার এক বোন আমেরিকায় থাকে এটা নিয়ে।আশা ওনার সেই বোনের মেয়ে।আশাকে বিয়ে করলে আদনান ভাইয়ের লাইফ সেটেল হয়ে যাবে।তাছাড়া আশা তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।বুঝিস-ই তো,চাচা চাচী কেনো এতো আদর যত্ন করছে।রাজত্ব, রাজকন্যা দুটোই পাবে আদনান ভাই।সেখানে তুই কি শালুক?তোর কোনো অস্তিত্ব আছে?”

শালুকের দুই চোখ আবারও অশ্রুসজল হয়ে গেলো। শাপলা বোনকে টেনে নিলো।শব্দ করে না কান্না করলেও শালুক টের পেলো আপাও কাঁদছে তার সাথে।

বিকেলে চায়ের আসরে সবাইকে ডাকা হলো। আদনান সবার জন্য কি উপহার এনেছে তা দিবে সবাইকে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও শালুককে যেতে হলো, নয়তো মায়ের হাতের মার সব পিঠের উপর দিয়ে যাবে।

বাবা,চাচাদের জন্য আদনান ব্রান্ডের ঘড়ি আনলো।মা,চাচী,ফুফুদের জন্য সেইম ডিজাইনের শাড়ি। ছেলেদের জন্য বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট। মেয়েদের জন্য মেকাপ, কসমেটিকস আইটেম।

দাদার জন্য আনলো কয়েকটা ব্যথানাশক বাম,শীতের চাদর।দাদীর জন্য চাদর,রুপোর কাজ করা একটা পানের বাটি।

মতির মায়ের জন্য ও শাড়ি আনলো।

সবার শেষে একটা সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর বের করে শালুককে দিয়ে বললো, “এটা তোর জন্য।অংকে যাতে ফেইল না করিস তার জন্য এই ক্যালকুলেটর। একেবারে অরজিনাল।দাম কতো জানিস এর?”

বারবার ফেইল করার কথা তোলায় রাগ করে শালুক ক্যালকুলেটর আদনানের কোলের উপর ছুড়ে মেরে উপরে চলে এলো।

সিড়ি দিয়ে উঠার সময় শুনতে পেলো আদনান হেসে হেসে বলছে,”ফেলটুস আবার কেমন রাগ দেখায়,এই রাগ ফেলটু মেয়েদের মানায় না।”

শালুকের এতো লজ্জা লাগলো এসব শুনে।কিছু বলতে পারলো না।

মনে মনে শপথ নিলো সে ও ভালো করে পড়ালেখা করে সবাইকে দেখিয়ে দিবে।

আদনান আসার খবর পেয়ে নয়না রাতেই শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এলো। আদনান তখন আশার হাত ধরে বাড়ির বাহিরে বাগানে হাটছে।এক বছরের মেয়ে নিধিকে কোলে নিয়ে নয়না আদনানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর হেসে বললো, “কেমন আছো আদনান ভাই? ”

নয়নাকে দেখে আদনান ভুত দেখার মতো চমকে গেলো। নয়নাকে এই মুহুর্তে আদনান এক্সপেক্ট করে নি।নয়নার চ্যাপ্টার আমেরিকায় পা দেয়ার সাথে সাথে আদনান ক্লোজ করে দিয়েছে।

শুকনো হেসে আদনান বললো, “ভালো আছি নয়না,তুই কেমন আছিস?এই কে তোর মেয়ে?খুব কিউট তো!”

নয়না বাঁকা হেসে বললো, “কিউট তো হবেই,আমি তো ফর্সা,মেয়ের বাবা ও ফর্সা।এজন্য আমার নিধিও এতো কিউট।”

নিধির নাম শুনে আদনানের বুক কেঁপে উঠলো। নয়নার সাথে প্রেম থাকাকালীন আদনান বলেছিলো,তাদের মেয়ে হলে নাম রাখবে নিধি,আর ছেলে হলে নাম রাখবে নিদ্র।

নয়না সেটা মনে রেখেছে দেখে আদনান লজ্জিত হলো।আশাকে সেটা বুঝতে না দিয়ে সহজ গলায় বললো, “ও আমার ফুফাতো বোন নয়না।”

আশা হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো নয়নার সাথে। নয়নার বুকে এক অচেনা ব্যথা শুরু হলো। এই ব্যথা সে গত তিন বছর ধরে বুকে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে।

আদনান আশার হাত ধরে বললো, “চলো বাসায় যাই।তোমার ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়। নাশতা করবে চলো।”

নয়না মেয়েকে কোলে নিয়ে আদনানের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বিড়বিড় করে বললো, “প্রতারক! ”

চলবে…….

পর্ব_____২

শালুক সিদ্ধান্ত নিলো ওই হার্দিকাকে ও আশা বলে ডাকবে না,হার্দিকা ও বলবে না।ও তাকে ফার্দিকা বলে ডাকবে।রাতে খাওয়ার সময় শালুক বসলো না প্রথম ব্যাচে।শালুকদের বাড়িতে মা, চাচী,ফুফু,দাদী এরা সবাই পরের ব্যাচে বসে।শালুকের ওই ফার্দিকাকে সহ্য হচ্ছে না কিছুতেই।খেতে বসে আদনান ভাইয়ের করা আদিখ্যেতা দেখলে শালুকের ইচ্ছে করবে কাঁচের গ্লাস ছুড়ে ফার্দিকার মাথা ফা/টিয়ে দিতে।

তবে একটা নাটক দেখার লোভ ও শালুক সামলাতে পারলো না। নয়না আপার সামনে আদনান ভাই কিভাবে ফার্দিকাকে যত্ন খাওয়ায় তাই দেখার ইচ্ছা।

শালুক স্টাডি রুম থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ফ্রিজের পাশে বসলো। ফ্রিজ আর ডাইনিং টেবিলের দূরত্ব ১০-১২ হাত।

নয়না বসেছে আদনানের মুখোমুখি। আদনান মুরগির কলিজা ভুনা নিয়ে আশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “এটা খেয়ে দেখো,ছোট চাচীর হাতের স্পেশাল রান্না এটা।তোমাকে বলেছি না ছোট চাচী হচ্ছে দ্রৌপদীর ছোট বোন,উনি যা রান্না করেন তাই বেস্ট হয়।”

আশা মুচকি হেসে বাটিটা নিতে যাবে তখনই নয়না বললো,”বাটিটা এদিকে দাও তো আশা যদি তুমি না খাও।নিধিকে আবার সবসময় এসব পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হয়।এখন তো এসব খাবার ছোটদের বেশি দরকার। 

আশা হাসিমুখে বাটিটা ঠেলে দিলো নয়নার দিকে।আদনান জ্বলন্ত দৃষ্টিতে নয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। নয়না মুচকি হেসে বললো, “আশা তুমি আবার ভেবো না যেনো তোমার মুখের খাবার আমি কেড়ে নিয়েছি।না বোন,আমার আবার এসব অভ্যাস নেই।এসব আমাকে দিয়ে হয় না,মেয়েটা আবার সব খাবার মুখে তোলে না।বাবার আদরের মেয়ে তো,ডাল ভাত দিলে নাক সিটকায় এই মেয়ে এখনই। ওর বাবা ও তেমন, মেয়ে কি খাবে তা আগে হাজির করে রাখে।”

আশা হেসে বললো, “না না নয়না,এসব কি বলছো।নিধি বাচ্চা মানুষ, ওর তো এসব খেতে হবে এখন।”

আশা না বুঝলেও আদনান ঠিকই বুঝলো নয়না কি বুঝাতে চেয়েছে।আশা যদি বুঝতো নয়না তাকে মিন করে কথাটা বলেছে,আদনানকে আশা কেড়ে নিয়েছে তবে আদনানের কপালে শনি ছিলো।

নয়না বাড়িতে যতোক্ষণ আছে আদনানকে সতর্ক থাকতে হবে।কোনো ভাবেই যেনো নয়না আদনানের সাথে আলাদা করে কথা বলতে না পারে। বহু চেষ্টায় আদনান এই বড় মাছকে বঁড়শিতে গেঁথেছে। এ নয়না,শালুকের মতো চুনোপুঁটি নয়,রাঘব বোয়াল।

চোখ মুখ শক্ত করে আদনান নয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে রইলো শালুক।নয়নার কথাতে শালুক খুশি হলেও বুকের ভেতরের জ্বলুনি কমছে না।

ইচ্ছে করছে আদনান ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,”আমাকে এভাবে ঠকালে কেনো আদনান ভাই,আমি তো তোমার বউ হবার স্বপ্ন দুচোখ ভরে দেখেছিলাম।আমার কি দোষ ছিলো? ”

প্রথম ব্যাচের খাবার শেষ হওয়ার পর মহিলারা খেতে বসলো। শালুকের ততক্ষণে ক্ষিধে মরে গেছে।বুকভর্তি যন্ত্রণা শালুককে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে।

হাসনা এবার আর শালুককে আলাদা খেতে দিলেন না।নিজের পাশে বসিয়ে দিলেন।একপাশে শান্ত আর অন্য পাশে শালুককে নিয়ে হাসনা খেতে বসলেন।শান্ত শালুকের ছোট ভাই,৯ বছর বয়স। ডান পা আর ডান হাতে ওর কিছুটা সমস্যা আছে।ডান পা বাম পায়ের চাইতে খাটো হওয়ায় সমান তালে হাটতে পারে না।ডান হাতে খেতে পারে না,গুছিয়ে কথা বলতে পারে না,সহজে কিছু বুঝতে পারে না।

অথচ দুচোখ ভর্তি মায়া তার,চেহারা দেখলে মনে হয় যেনো দেবশিশু। শালুকের সবচেয়ে বেশি মায়া তার এই ছোট ভাইয়ের জন্য।

হাসনা এক লোকমা শালুকের মুখে দিচ্ছেন এক লোকমা শান্তর মুখে দিচ্ছেন।নিজে খাচ্ছেন না।

খাওয়াতে খাওয়াতে শালুকের মেজো চাচী ফরিদাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ধ্রুবকে কল দিয়েছো আপা?”

ফরিদা চোখ নিচু করে বললো, “আমার কল কি ও কখনো রিসিভ করে আপা?,আপনি দিয়ে দেখেন,এই জগৎ সংসারে আপনি ছাড়া অন্য কাউকে তো ও মান্য করে না।”

ধ্রুব ভাইয়ের কথা শুনে শালুকের চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো, কাশি লেগে গেলো।

হাসনা মেয়েকে পানি খাইয়ে দিয়ে বললেন,”মানুষ হবি না তুই আর।হাতে পায়ে বড় হয়েছিস শুধু মাথায় বুদ্ধি হয় নি।”

হাসনার কথার মধ্যেই শাপলা ফোন নিয়ে ছুটে এসে বললো, “মা ধ্রুব ভাই কল দিয়েছে। ”

হাসনা বেগমের চোখ মুখ ১০০ ওয়াটের বাল্বের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো। কল রিসিভ করেই বললেন,”হ্যাঁ বাবু,বল কেমন আছিস?তোর কথাই বলছিলাম তোর মায়ের সাথে।হাজার বছর বাঁচবি তুই।”

ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় ধ্রুব বললো, “আমি ভালো আছি চাচী।তোমরা সবাই কেমন আছো?”

আমরা ও ভালো আছি বাবা।জানিস তো,আজ সকালেই তোর ভাই এসেছে। খোকা আর ওর হবু বউ এসেছে আমেরিকা থেকে। বাসায় সবাই আছে, শুধু তুই নাই।”

“আমি ও আগামীকাল আসছি চাচী,ক্যাম্পাসে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরাট ঝামেলা লেগেছে। মারামারি, ভাঙ্গাভাঙ্গি চলছে হরদম। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ,এমনকি হল ও বন্ধ করে দিয়েছে। এবার আর না এসে পারছি না বাসায়।রাতের ট্রেনেই উঠছি,সকাল সকাল বাড়ি পৌঁছে যাবো।”

হাসনা বেগম আনন্দিত গলায় বললেন,”এরকম ঝামেলা যেনো তোর ক্যাম্পাসে সবসময় হয় বাবু,তাহলে অন্তত আমরা তোকে চোখে দেখার সুযোগ পাবো।খোকা বিদেশে ছিলো তাও ওকে রোজ ভিডিও কলে দেখতাম,অথচ তুই দেশে থেকেও আজ দুই বছর তোকে দেখি না।তোর চেহারাও প্রায় ভুলতে বসেছি।”

এই বাড়িতে সবাই আদনানকে খোকা বলে ডাকে আর ধ্রুবকে বাবু বলে ডাকে।

এবার আসলে একটা ছবি বাঁধাই করে তোমার বেডরুমে লাগিয়ে দিয়ে যাবো।প্রতিদিন ছবিটা দেখলে আর ভুলবে না।”

স্পিকার অন থাকায় সবাই খিলখিল করে হাসতে লাগলো ধ্রুবর কথা শুনে। ধ্রুব কল কেটে দিলো। ফরিদা বেগম কাঁচুমাচু হয়ে বললেন,”আপা,ধ্রুবর রাগ কি এখনো কমে নি?আমার ভীষণ খারাপ লাগে আপা।আমি কি দোষ করেছি,আমি তো জানতাম না ধ্রুবর বাবা মায়ের ব্যাপারে কোনো কিছু।মাঝখান থেকে ফেঁসে গেলাম আমি।তাছাড়া তখন অল্প বয়স ছিলো, সংসার বুঝতাম না।”

হাসনা বেগম আশ্বাস দিয়ে বললেন,”ভেবো না আপা,সব ঠিক হয়ে যাবে।”

শালুকের হাত পা কাঁপতে লাগলো থরথর করে। আদনান ভাই তো ফেলটুস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ত্থাকে,এই বান্দা তো তার ও এক কাঠি উপরে।শালুক মনে মনে বললো, “মরার উপর খাড়ার ঘা বুঝি একেই বলে আল্লাহ?”

হাসনা বেগম মতির মাকে ডেকে বললেন, “ধ্রুবর ঘর সবগুলো গুছিয়ে ফেলতে হবে রাতের মধ্যেই। ছাদের রুমটা তুমি পরিষ্কার করো,আমি ওর বেডরুম আর স্টাডি রুম গুছিয়ে ফেলছি। ”

মতির মা চোখ মুখ করুণ করে বললো, “আম্মা,এখন আমারে যদি কন একটা সুতা আইনা দিতে আমি তাও আনতে পারমু না।স্টার জলসায় অক্ষন আমার সিরিয়াল দেখনের সময়। এখন আমারে ডিস্টাপ দিয়েন না।”

হাসনা বেগম জানেন এখন মতির মা’কে দিয়ে কিছু করানো যাবে না।পানের বাটা কোলে নিয়ে শালুকের দাদী সিতারা বেগমের রুমে যাবেন,তারপর ওনার হাতে পায়ে মালিশ করবেন আর দুজনে মিলে সিরিয়ালের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করবেন।

হাসনা বেগম মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোরা দুইজন ছাদের রুমটা গুছিয়ে ফেল গিয়ে।কতোদিন পর ছেলেটা আসবে।”

শালুক মুখ বাঁকালো,শাপলা তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে গেলো। দুই বোন ছাদে গিয়ে ধ্রুবর রুমটা গুছাচ্ছে।শালুক কাজের চাইতে অকাজ বেশি করছে।

এই যেমন ধ্রুবর সবগুলো মেডেল এলোমেলো করে রাখছে।টেবিলের উপর থাকা ধ্রুবর বই যেভাবে সাজানো ছিলো শালুক সেগুলো এদিক সেদিক করে রাখছে।শাপলা গিয়ে ওয়াশরুম পরিষ্কার করছে।শালুক আলমারি থেকে তেলাপোকা বের করে ধ্রুবর বিছানার নিচে রেখে বিছানার চাদর তোশকের নিচে গুঁজে রাখলো যাতে করে তেলাপোকা বের হতে না পারে।

মার্কার পেন দিয়ে বাম হাতে রিডিং টেবিলের সাথের দেয়ালে লিখলো,”আমি ধ্রুব,সবকিছুতে সিরিয়াস থাকি।সিরিয়াস থাকতে থাকতে আমার টয়লেট ও সিরিয়াস হয়ে গেছে। এজন্য সহজে আমার টয়লেট পায় না।”

নিজের লিখা দেখে শালুক নিজেই সন্তুষ্ট হলো।রাইটিং এক্সপার্টের বাবার ও সাধ্য নেই বের করে যে এই লিখা শালুক লিখেছে।শালুকের প্রতিশোধপরায়ণ মন কিছুটা শান্তি পেলো।সেই কবেকার কথা,ধ্রুব ভাই বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে একদিন শালুকের সব হোমওয়ার্কের মাঝখানে গোটগোট করে লিখে দিয়েছিলো,”আমি শালুক,মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে থাকি।এজন্য সবসময় আমার শরীর থেকে গোবরের সুবাস আসে।গোবরভর্তি মাথায় এজন্য আমার পড়ালেখা ঢুকে না।”

সেদিন এক বিষয় হোমওয়ার্ক ও শালুক স্যারদের দিতে পারে নি। দুই হাত লাল করে বাড়িতে এসেছে স্যারদের বেতের মার খেয়ে।

ধ্রুবর উপর শালুকের ভীষণ ক্ষোভ। ছোট বেলা থেকেই এই লোকটা শালুককে জোর করে সব কিছুতে।বিশেষ করে পড়ার ব্যাপারে। যেখানে শালুক নিজেই জানে তার মাথা ভর্তি গোবর, এই মাথায় লেখাপড়ার চাইতে বেগুন টমেটোর চাষ করে লাভবান হওয়া যাবে সেখানে এই ধ্রুব কিছুতেই তা মানতে চায় না।তার কথা হচ্ছে আল্লাহ সবাইকেই মেধা দিয়েছে, শালুক নিজের মেধায় জং ফেলে দিয়েছে। শালুকের উচিৎ সেই মেধায় শান দিয়ে ধারালো করা।শালুককে পড়ানোর জন্য সবসময় খেপাতে থাকে ধ্রুব।যাতে করে রাগের বশে হলেও শালুক একটু পড়ে। কিন্তু শালুক কেনো জানি এই একটা ব্যাপারেই রাগ করতে পারে না। কিছুতেই না,যদি একটু রাগ করতে পারতো তবে সব বিষয়ে খারাপ করলেও অন্তত ইসলাম শিক্ষায় তো ভালো করতো।অথচ শালুক সব বিষয়ে টেনেটুনে পাশ মার্কস পায় আশেপাশের সবার থেকে দেখে দেখে। মাঝেমাঝে শালুক নিজেই নিজেকে বলে, “এতো গাঁধা স্টুডেন্ট যে এই পৃথিবীতে আছে তা আমি আমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।প্রাউড ফিল করছি নিজেকে নিয়ে। ”

শাপলা এসে দেখে শালুক তেমন কিছুই করে নি রাগে গজগজ করতে করতে শাপলা সোফা মুছলো,সেন্টার টেবিল মুছলো।ছোট ফ্রিজটা মুছলো।শালুককে কড়া গলায় বললো, “জলদি করে বইয়ের আলমারিটা মুছে ফেল শালুক।তারপর সবগুলো ক্রেস্ট মুছবি।”

শাপলা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে দেয়ালে লাগানো ধ্রুবর মা দীপালির ছবিটা নামিয়ে আনলো।তারপর কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,”দেখ শালুক,তোর আর চাচীর ছবির মধ্যে কতো মিল রয়েছে। ”

শালুক চাচীর ছবি দেখে কেঁপে উঠলো। শালুকের নাকের গড়ন মেজো চাচীর মতোই।ভয়ার্ত স্বরে শালুক বললো, “আপা,ছবিটা এখানে লাগানো কি ঠিক হয়েছে? কে লাগালো এখানে?কবে লাগালো? ”

শাপলা মাথা নেড়ে বললো, “কি জানি শালুক,আমি তো জানি না।এই ঘরে আজকেই তো এলাম।দেয়ালে লাগানো দেখে পরিষ্কার করতে নামিয়েছি।”

শালুকের ভীষণ ভয় হলো।ধ্রুব ভাই নিজের মায়ের ছবি দেখলে কেমন রিয়েক্ট করবেন কে জানে?

ফিসফিস করে শালুক বললো,”ছবিটা লুকিয়ে রাখ আপা,ধ্রুব ভাই রাগ করে বাড়ি থেকে চলে ও যেতে পারে। ”

শাপলা একটুক্ষণ ভেবে বললো, “এমন ও তো হতে পারে,মায়ের ছবি দেখলে ধ্রুব ভাইয়ের রাগ কমবে।অনেক বছর তো হলো, এখনো কি সেই রাগ পুষে রেখেছে না-কি? ”

শালুক কোনো কথা বলতে পারলো না। তবে বুকের ভেতর কেমন ভয়ের শিহরণ বইতে লাগলো। শালুকের এই ভয় একটু পরেই যন্ত্রণায় রূপ নিলো যখন দেখলো আদনান ভাই আর ফার্দিকা ছাদে এসে হাত ধরাধরি করে হাটছে।

শাপলা আর শালুক দুজনেই ধ্রুবর রুম থেকে বের হয়ে এলো। ধুপধাপ পা ফেলে শালুক চলে গেলো। নিজের রুমের সামনে গিয়ে ও শালুক থেমে গেলো। বেহায়া মনটা বারবার বলছে চোরের মতো গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে এরা ছাদে কি করছে?

এই ফার্দিকা কি আদনান ভাইকে আবারও চুমু খাচ্ছে?

শালুকের ভীষণ কষ্ট হলো এটা ভাবতেই।লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে,সকল ম্যানার ভুলে গিয়ে শালুক পা টিপে টিপে ছাদের দিকে গেলো।ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখলো দুজনেই দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে,দুজনের হাতে দুটো সিগারেট জ্বলজ্বল করছে আবছা অন্ধকারে।

চমকে উঠলো শালুক!

এই ফার্দিকা মেয়েটা ধুমপান করে?এ ও সম্ভব!

আদনান ভাই এরকম একটা মেয়েকে বউ করতে চাচ্ছে?আদনান ভাইয়ের রুচি এতোটা খারাপ?

শালুক আর দাঁড়াতে পারলো না ছাদে।নিচে নেমে এসে নিজের রুমে বসে ভাবতে লাগলো। শালুকের ছোট্ট জীবনে শালুক এতোটা অবাক আর হয় নি।ছেলেরা ধুমপান করে এই ব্যাপারটাই শালুকের যেখানে মেনে নিতে আপত্তি সেখানে ফার্দিকার ধুমপান করাটা শালুকের কাছে রীতিমতো অষ্টম আশ্চর্য!

ঘুমানোর সময় একটা মজার ব্যাপার ঘটে গেলো।শালুক এসেছিলো বড় চাচীর কাছে চুল বাঁধতে,এসে দেখে চাচী আদনান ভাইয়ের রুমে।

ফার্দিকা আদনান ভাইয়ের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আদনানের মা আদিবা বেগম বোনঝিকে ফিসফিস করে বললেন,”এটা বাংলাদেশ আশা,এখানকার কালচার অন্যরকম। সবাই কি মনে করবে তোরা এখনই একসাথে এক বিছানায় থাকলে?তুই আয়,তোর জন্য আমি অন্য একটা রুম গুছিয়ে রেখেছি সকালেই।”

আশা হতভম্ব হয়ে বললো, “এটা কেমন কথা আন্টি,আমি আর আদনান কেউই অবুঝ নয়।আমেরিকাতেও আমরা প্রায় সময় এক বেডে থাকতাম।তখন তো কোনো প্রবলেম হতো না। এখানে কিসের প্রবলেম আন্টি?”

আদনান মায়ের সামনে লজ্জা পেলো কিছুটা, তারপর আশাকে নানা ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বললো, “প্লিজ আশা,ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বেইব।”

আশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “ওকে ফাইন।তবে আমি একা ঘুমাতে পারবো না। আমি শালুকের সাথে ঘুমাবো।”

আদনান চমকে উঠলো শুনে।শালুক,নয়না কেউই নিরাপদ নয়।আদনান ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বললো, “শালুকের ঘুমের ঘোরে হাটাচলা করার অভ্যাস আছে,ওর পাশে কেউ ঘুমালে তার গলা টিপে ধরে ঘুমের ঘোরে,লাথি মেরে ফেলে দেয় বিছানা থেকে। বেইব,আমি তোমার কোনো ক্ষতি হোক তা চাই না।তুমি বেটার শাপলার সাথে ঘুমাও।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আশা বের হয়ে গেলো আদনানের রুম থেকে।আড়ালে দাঁড়িয়ে শালুক এসব শুনে রেগে গেলো।

দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে বললো, “আদনাইন্নার বাচ্চা, আমার নামে এসব মিথ্যা কথা বললি তুই?মনে রাখিস,এসব কিছু একদিন আমি বাস্তবায়ন করবো তোর আর তোর ফার্দিকার উপরে। যদি না করি তবে আমি ফেলটু শালুক না।এই দুইতলার ফ্লোরের উপর দাঁড়িয়ে শপথ নিলাম।কসম এই দুইতলার, যদি না করি তবে এই দুইতলা ভূমিকম্পে ভেঙে যাবে।”

চলবে……

পর্ব____৩

শালুক_ফুলের_লাজ_নাই(০৩)

শালুক আজকে নিজের রুমেই ঘুমাবে,শাপলার সাথে ঘুমাতে গেলে তার চুল কেটে ফেলার খবরটা জানাজানি হয়ে যেতে এক মুহুর্ত ও সময় লাগবে না।সবচেয়ে বড় কথা শালুককে নিয়ে একটা ছোট খাটো দরবার বসবে।বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে শুধুমাত্র শালুকের চুলই ঘন,লম্বা,সিল্কি।অন্যদের চুল কোঁকড়ানো অথবা ছোট অথবা পাতলা।এজন্য শালুকের চুলে শালুক নিজেই হাত দিতে পারে না। শালুকের মনে হয় চুলগুলো শুধু তার মাথায় রয়েছে,এমনিতে এই চুলের মালিক এই বাড়ির সবাই।

বড় , মেজোোমেজো চাচী সপ্তাহে দুই তিন দিন ধরে চুলে বিভিন্ন হেয়ার প্যাক লাগিয়ে দেয় শালুককে।

নিজের রুমের দরজা লাগাতেই শাপলা এসে দরজায় দুমদাম ধাক্কাতে লাগলো।

শালুক সবেমাত্র মাথা থেকে ওড়না সরিয়েছে,দরজায় দুপদাপ শুনে আবারও ওড়না ভালো করে মাথায় পেঁচিয়ে শালুক উঠে গিয়ে দরজা খুললো।

ফ্যাকাসে মুখে শাপলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। শালুক জিজ্ঞেস করার আগে শাপলাই বললো,”আদুর বিদেশিনী আমার রুমে এসে হাজির,আমার সাথে ঘুমাবে না-কি!আমার কেমন জানি লাগতেছে শালুক।তুই ও আয় আমার রুমে। এমনিতেই তো তুই একা ঘুমাতে পারিস না আজ কি মনে করে নিজের রুমে এলি।”

শালুক একটু ভাব নিয়ে বললো,”আমি কি আজীবন ছোট-ই থাকবো না-কি? একা ঘুমানোর অভ্যাস করছি।আর তোর রুমে তিনজন মিলে গাদাগাদি করে ঘুমাতে পারবো না আপা।ফার্দিকারে দেখলে কখন কি করে ফেলি আমার মাথার ঠিক নেই।আমি কসম করেছি এটা নিয়ে। ”

শাপলা চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করলো, “কিসের কসম?”

শালুক মাথা নেড়ে বলে, “এই দুই তলার কসম,একদিন চরম প্রতিশোধ নিবো।ওই আদনান তার ফার্দিকাকে কি বলেছে জানিস,আমার না-কি ঘুমের ঘোরে হাটার অভ্যাস,মানুষের গলা টিপে ধরার অভ্যাস,তাই আমার সাথে যাতে না ঘুমায়।তখনই আমি কসম করেছি,যদি না করি তবে এই দুইতলা ভূমিকম্পে ভেঙে খানখান হয়ে যাবে আদনাইন্না আর ওর পিরিতির ফার্দিকাকে নিয়ে।”

শাপলা বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “তুই থাকবি কোথায় তখন?”

শালুক ফিক করে হেসে বললো, “আমাকে এতো বোকা ভেবেছিস আপা?আমি কি সেটা না ভেবেই কসম করেছি না-কি? আমি ছাদে আমার চিলেকোঠার ঘরে থাকবো।ভেঙ্গে গেলে দুইতলা যাবে,ওটা তো ভাঙ্গবে না।ওটার কসম তো করি নি।”

শাপলা হতাশ হয়ে বললো, “তুই যদি জানতি শালুক তুই কি পরিমাণ বোকা,তবে এই কসম করতি না।”

শালুক রেগে গিয়ে বললো, “যা ভাগ এখান থেকে। আসছে আমার বুদ্ধিজীবি। ”

শাপলা হতাশ হয়ে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে।

দরজা বন্ধ করে শালুক বিছানায় পিঠ লাগাতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করলো শালুককে।নিজেকে কেমন নিস্তেজ,নিষ্প্রাণ লাগছে শালুকের কাছে।একটা মানুষের প্রতারণায় শালুক এভাবে গুড়িয়ে যাবে কখনো কি ভেবেছে সে?

অসাড় হয়ে যাওয়া দেহটা যখন ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করছে সেই মুহুর্তে শালুকের মাথায় আসলো সে আসলেই বোকা।

তা না হলে সে কিভাবে বড় চাচীর কাছে গিয়েছিলো তখন চুল বাঁধার জন্য?কেউ যাতে ওর চুল কেটে ফেলার ব্যাপারটা ধরতে না পারে তার জন্য ঘোমটা দিয়ে রাখছে সকাল থেকে। একা ঘুমাতে ভয় পাওয়ার পরেও নিজের রুমে একা ঘুমাতে এসেছে। অথচ সে কি-না এক মুহুর্তে ভুলে গেছে মাথার চুলের কথা।

নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলো শালুক,”কবে তোর মাথায় বুদ্ধি হবে শালুক?”

জবাব এলো না।

ঘুমাতে গিয়ে শালুকের হঠাৎ করেই মনে হলো জানালার ওপাশে কে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। আড়চোখে শালুক সেদিকে তাকাতেই যেনো কিছু একটা সরে গেলো। ভয়ে আতঙ্কে জমে গেলো শালুক।

একা ঘুমাতে গেলেই শালুকের এরকম হয়।সবসময় মনে হয় কেউ একজন আছে, তাকে আড়াল থেকে দেখছে।

হঠাৎ করেই শালুক যেনো নিশ্বাস ফেলার শব্দ ফেলো বিছানার নিচে থেকে।

পায়ের কাছ থেকে কাঁথা টেনে নিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো শালুক।মনে মনে একদমে আয়াতুল কুরসি পড়ে যাচ্ছে।

ঝুম বৃষ্টি নিয়ে সকাল শুরু হলো। জানালার গ্লাসে বৃষ্টির ঝাপটা এসে বারবার আঘাত হানছে।শালুক চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে চারদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আছে।হতভম্ব হয়ে গেলো শালুক!

এক ঘুমে সে এক রাত এক দিন কাটিয়ে ফেলেছে!

এমন ঘুম ঘুমিয়েছে যে সন্ধ্যা নেমে গেছে অথচ শালুক টের পায় নি।

অবাক হলো শালুক আবার কিছুটা। কেউ তাকে ডাকলো না কেনো?বিশেষ করে ধ্রুব ভাই বাড়িতে আসার সাথে সাথেই তো মা গলাটাকে একটা ছোটখাটো হ্যান্ডমাইকের রূপ দিয়ে সবার কান ফাটিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। যেনো ধ্রুব কোনো দেশের প্রাইম মিনিস্টার, তাকে দেখতে যেতেই হবে সবার।

আজ এরকম করলো না কেনো তবে মা? নাকি তাও শালুকের কানে যায় নি!

ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে শালুক পা টিপে টিপে বের হলো রুম থেকে।

তারপর শাপলার রুমে গিয়ে বললো, “আপা, আমাকে কেউ ডাকে নি কেনো?সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ কেউ একবার ডাকলো না।আমি যদি মরে যেতাম তবে কেউ জানতি ও না তোরা।”

শাপলা বিরক্ত হয়ে বললো, “কানের কাছ থেকে যা তো শালুক,গাধার মতো কথা বলছিস।এমনিতেই রাতভর ওই আশার আর আদনান ভাইয়ের কাহিনি শুনতে শুনতে কান ব্যথা হয়ে গেছে,ঘুমাতে পারি নি সারারাত ধরে। এখন ঘুমাতে দে।

কষ্ট করে একবার গিয়ে দেখ ধ্রুব ভাই আসার কতোদূর!

স্টেশনে কে গেছে তাকে আনতে? ”

শালুক চমকালো।ধ্রুব ভাই এখনো আসে নি?তারমানে এখনো সন্ধ্যা হয় নি।আর সে কি-না ভয় পেয়েছে এই ভেবে যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আনন্দিত হয়ে শালুক নিচে নেমে এলো।

হাসনা রান্না ঘরে, সবার জন্য নাশতা বানানো হচ্ছে।বড় চাচী আর মেজো চাচী রুটি বানাচ্ছেন।ফুফু রুটি সেঁকছে।শালুকের মা চুলায় আলু,গাজর,পেঁপে দিয়ে ভাজি করছে।

মতির মা মাছ কুটছেন।

শালুক নাক সিঁটকালো।এইসব হাবিজাবি ভাজাভুজি খেতে শালুকের একেবারে বিরক্ত লাগে।

মেজো চাচা চোরের মতো মুখ করে বসে আছে সোফায়।শালুকের ভীষণ মায়া হলো চাচার জন্য।এই লোকটা কতো বছর ধরে ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনে না।বাবা ছেলে মুখোমুখি হন না।একসাথে বসে খান না।

শালুককে দেখে সেলিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”স্কুলে যাবি কখন?”

শালুক আকাশ থেকে পড়েছে যেনো স্কুলের কথা শুনে। বিস্মিত হয়ে বললো,”এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে তুমি আমাকে স্কুলে যেতে বলো চাচা?সামান্য লেখাপড়ার জন্য তো আর আমি আমার জীবন রিস্কে ফেলতে পারি না, তাই না?বেঁচে থাকার অধিকার আমার ও আছে।”

আদনান চায়ের কাপ নিয়ে আসতে আসতে বললো,”সেই সাথে পরীক্ষায় গোল্লা মারার অধিকার ও শালুকের আছে।”

শালুকের ভীষণ বিরক্তি লাগলো। মনে মনে বললো, “ফার্দিকার সামনে স্মার্ট হতে চাচ্ছো সে আমি ভালো করেই বুঝি।একদিন সবকিছুর শোধ নিবো।শুধু তোমার প্রতি একটা ভালোবাসাআছে বলে চুপ করে থাকি।”

বাহিরে রিকশার টুংটাং শব্দ হতেই সেলিম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন।তারপর ব্যস্ত হয়ে উপরে চলে গেলেন।হাসনা বেগম চিৎকার করে বলতে লাগলেন,”আমার ধ্রুব বাবা আসছে রে,তোরা সব কোথায় গেলি।”

পাতলা একটা সাদা টি-শার্ট পরনে,ব্ল্যাক ট্রাউজার পরে ধ্রুব তখন আধ ভেজা হয়ে হাসনা বেগমের শাড়ির আঁচলে চুল মুছছে।সবাইকে সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলো আদনানের দিকে।তারপর দুই ভাই কোলাকুলি করলো।

আদনান আশার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর হবু ভাবী,আশা।আর আশা,এই তোমার বড় দেবর ধ্রুব।”

আশা বিড়বিড় করে বললো, “হ্যান্ডসাম! ”

শাপলা ততক্ষণে সেজেগুজে হাজির হয়ে গেলো নিচে।ধ্রুবর পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “কেমন আছো ধ্রুব ভাই?”

ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, “ভালো আছি,তোরা সব কেমন আছিস?”

শাপলা গাল ফুলিয়ে বললো, “এতোদিনে মনে পড়লো? ”

কিছু না বলে ধ্রুব হাসলো।

শালুক ঘোমটা টেনে দিয়ে বসে রইলো শক্ত হয়ে। ধ্রুব কাঁধ থেকে ব্যাগ খুলে শালুকের দিকে ছুড়ে দিয়ে বললো, “ভাব বেড়ে গেছে না-কি তোর?সবাই আমার সাথে কথা বলছে আর তুই ভাব নিয়ে বসে আছিস এখানে?আমার ব্যাগটা রুমে নিয়ে রেখে আয়।ব্যাগের সব কাপড় চোপড় সুন্দর করে গুছিয়ে রাখবি আমার আলমারিতে। ভাঁজ যেনো না ভাঙে শালুক,আই রিপিট ভাঁজ যেনো না ভাঙে। তাহলে তোকে দিয়েই আয়রন করাবো মনে রাখিস।”

শাপলা বললো,”আমাকে দাও,আমি রেখে আসি।”

চোখ লাল করে ধ্রুব তাকালো শাপলার দিকে।তারপর বললো,”তোকে আমি বলেছি?”

শাপলা নিভে গেলো ধ্রুবর চোখ রাঙ্গানো দেখে।

ধ্রুবর রুমে গিয়ে সব কাপড় বের করে শালুক সব দলা মোচড়া করলো প্রথমে।সবগুলোর ভাঁজ নষ্ট হবার পর এলোমেলো করে সবকিছু আলমারিতে গাদাগাদি করে রাখলো।

ব্যাগের উপরের চেইন খুলতেই শালুক অবাক হলো। ভেতরে একটা শপিং ব্যাগে প্লাস্টিকের ফুলের বিভিন্ন রঙের কয়েকটা গাজরা,নানান ডিজাইনের হেয়ার ব্যান্ড।একটা চিরকুটে লিখা,”কেশবতীর জন্য।”

শালুক মুখ বাঁকিয়ে বললো, “তলে তলে টেম্পো চলে,আমরা বললেই হরতাল!”

নিচে আসতেই দেখে সবাই খেতে বসেছে। মেজো চাচা নেই শুধু।শালুক আসতেই ধ্রুব বললো,”তোর চাচাকে বল খেয়ে যেতে,আমি পরে ছোট চাচীর সাথে খাবো।উনি আর ওনার স্ত্রী যেনো খেয়ে আমার সামনে থেকে বিদায় হয়।”

শালুকের বড় চাচা আজাদ সাহেব বললেন,”ধ্রুব বাবা,এখনো এসব ধরে বসে থেকে কি লাভ?শুধুশুধু বাবা ছেলের মধ্যে… ”

আজাদ সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না।ধ্রুব কঠোর স্বরে বললো, “এই ব্যাপারে আমি কারো থেকে কোনো সুপারিশ শুনতে চাই না।”

আজাদ সাহেব থেমে গেলেন।শালুকের বাবা ফয়েজ আহমেদ একটা নিশ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।

ধ্রুব গিয়ে দাদার রুমে বসে রইলো। নাশতা শেষ করে ধ্রুবর দাদা রশিদ সাহেব নাতির পাশে এসে বসলেন।তারপর নরম স্বরে বললেন, “আমাকে মাফ করে দিস দাদাভাই। আমার জন্যই তোর শৈশব,কৈশোর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার জন্যই তুই বাবা মা হারা হলি।”

ধ্রুব হেসে বললো, “তোমার কোনো দোষ নেই দাদা।এসব ভেবে তুমি আপসেট হইও না।”

দাদার রুম থেকে বের হয়ে ধ্রুব ছাদের দিকে গেলো।ছাদের নিজের রুমে ঢুকে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো ধ্রুব।দেয়ালে দীপালি নামক মহিলার একটা ছবি ঝুলছে।

মুহুর্তেই ধ্রুব ক্রোধান্বিত হয়ে গেলো। ছবিটি নামিয়ে সোজা নিচতলায় গেলো। সবাই তখনো ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। আচমকা ধ্রুব ছবিটি আছড়ে ফেললো ফ্লোরে।মুহুর্তের মধ্যে শত খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলো ফ্রেমের সব কাঁচ।কয়েকটা কাঁচ কুড়িয়ে নিয়ে ধ্রুব আবারও ভাঙ্গলো। ফলস্বরূপ নিজের দুই হাত কেটে গেলো কিছুটা।

চিৎকার করে ধ্রুব বললো, “এই কাজ কে করেছে?আমার অপছন্দ জেনেও কে এই কাজ আবারও করেছে ছোট চাচী?

এই ছবি আমার ঘরে কেনো লাগানো হলো?”

হাসনা নিজেও জানে না কে লাগিয়েছে।কিন্তু ধ্রুবকে এভাবে রাগতে দেখে বললেন,”বাবা মাথা গরম করিস না।আমি লাগিয়েছি বাবা।আমার ভুল হয়েছে। আর হবে না এরকম।”

ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে ধ্রুব বললো, “শুধু তুমি বলে আজ আমি থেমে গেলাম। এই কাজ আর করো না চাচী।নয়তো ধ্রুবকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।এখন তো তুমি আছো বলে তোমার টানে ফিরে আসি,এরপর আমাকে আর খুঁজে পাবে না।”

তারপর হনহনিয়ে দোতলায় নিজের রুমে চলে গেলো ধ্রুব।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ফরিদা থরথর করে কাঁপছে। হাসনা তার দিকে তাকাতেই ফরিদা বললো, “আমার ভুল হয়ে গেছে আপা।ধ্রুবর বাবা মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে এই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। বউ হয়ে আমি কিভাবে সহ্য করি বলেন যে আমার স্বামী তার প্রথম স্ত্রীর ছবি এভাবে লুকিয়ে দেখে?তাই ছবিটি আমি ধ্রুবর ছাদের ঘরে লাগিয়ে রেখেছি।ভেবেছি মায়ের ছবি দেখলে ধ্রুবর রাগ একটু হলেও কমবে।এখন দেখছি আমি ভুল ছিলাম।”

হাসনা কঠোর স্বরে বললো, “এরকম কাজ আর কখনো করতে যেও না আপা।আমাকে জিজ্ঞেস না করে আর কখনো এসব কাজ করবে না।”

শালুকের ভীষণ মায়া হলো ধ্রুব ভাইয়ের জন্য।একটা মানুষ মনের ভেতর কতো যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখে তা আমরা বাহিরে থেকে কি একটুও বুঝতে পারি?

মা নেই, বাবা থেকেও নেই,একা জীবন যে কাটায় তার কষ্টের গভীরতা কে মাপতে পারে?

হাসনা শালুককে ডেকে বললো, “ধ্রুবর ঘরে ওর নাশতা নিয়ে দিয়ে আয় শালুক।”

নাশতার ট্রে হাতে নিতেই শালুকের রাগ হলো। সে খেয়েছে হাবিজাবি ভাজাভুজি দিয়ে অথচ ধ্রুব ভাইয়ের জন্য ঘন করে বানানো দুধ চা,পরোটা, কসা মাংস,ডিম ভাজা।

শালুক মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে মনে মনে বললো, “এই যে আমার মা হয়ে আমার সাথে খাবার নিয়ে এই বাটপারি করলো মা,আমার কি কষ্ট কম হচ্ছে?সবাই ধ্রুব ভাইয়ের ব্যথা অনুভব করে,শালুকের ব্যথা কেউ বুঝে না।”

অভিশাপ দিলাম ধ্রুব ভাইকে,এই খাবার খাওয়ার পর তার পেট খারাপ করুক।যাতে বাথরুমেই তার থাকার ব্যবস্থা হয়।স্যালাইন ছাড়া আর কিছুই যাতে খেতে না পারে। ”

চলবে……

Download NovelToon APP on App Store and Google Play

novel PDF download
NovelToon
Step Into A Different WORLD!
Download NovelToon APP on App Store and Google Play